মাথার ভেতরে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল আনুর। একটা প্রচণ্ড ঘুষি সে বসিয়ে দিল পিন্টুর মুখে। পিন্টু মুখ দুহাতে ঢেকে বসে পড়ল। তারপর যখন তাকাল তার চোখ লাল হয়ে গেছে, পানি ভরে এসেছে। সে প্রথমেই এক কাণ্ড করল। আনুর পড়ে থাকা ছিপটা দুহাতে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আনুর ওপর।
ইয়াসিনের কাছে কুস্তি শিখেছিল আনু। এখনো মনে আছে তার। চট করে সে সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল পিন্টু। তারপর দুজন দুজনকে ধরলো জাপটে। হাতে পায়ে লাথি মেরে ঘুষি দিয়ে গড়াতে গড়াতে শান বাঁধানো ঘাট পর্যন্ত চলে গেল ওরা। পিন্টুর গায়ে জোর কম না। আনু কিছুতেই আর সুবিধে করতে পারছে না। তার হাতটা বেকায়দায় পড়েছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কোথায় যেন নোখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে পিন্টু, পুড়ে যাবার মতো জ্বালা করছে। হঠাৎ পিন্টু তার মাথাটা ধরে আছড়ে দিল শানের ওপর। বিকট আর্তনাদ করে উঠল আনু। পায়ের শব্দে লাফ দিয়ে পালাল পিন্টু।
কে, কারা, কে ওখানে?
একটা মাঝবয়সী দারোয়ান ছুটে এলো। আর তার পেছনে জিনি সিস্টার স্বয়ং। আনু উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখে রক্ত।
রক্ত! জিনি সিস্টারকে দেখে আনু বড় বড় করে বলে ওঠে, আমার দোষ নেই। আমাকে মেরে পালিয়েছে। সিগারেট খেতে বলে।
তারপর মাথাটা কেমন ঝিম দিয়ে আসে আনুর। চোখের সামনে জিনি সিস্টার, দারোয়ান, গীর্জা ঘরের চকচকে টিনের চাল—-সব দুলে ওঠে। তারপর আঁধার হয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে, রক্ত! বহুদূর থেকে ভেসে আসা কথার মতো সে শুনতে পায় জিনি সিস্টার বলছেন, ওকে ধর, পড়ে যাচ্ছে। ঘরে নিয়ে আয়।
চোখ মেলে দেখে জিনি সিস্টার সামনে বসে আছে। হাতে তার গরম দুধের গেলাশ। দেয়ালে মা–মেরীর ছবি। হাত দিয়ে দেখে, মাথায় ব্যাণ্ডেজ। উঠে বসতে চায় আনু। তিনি তাকে শুইয়ে দিয়ে বলেন, আরো একটু শুয়ে থাকো খোকা। কিছু হয়নি তোমার।
আনু আবার শুয়ে পড়ে। কেমন একটা অবসাদ সারা শরীরে, আর আনু কিছু না। দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় সব—- পিন্টুর আসা, সিগারেট খাওয়া, মারামারি। ছিপটার জন্যে মন কেমন করে ওঠে। কত যত্ন করে বানিয়ে ছিল আনু। ভীষণ লজ্জা করতে থাকে তার। চুরি করে মাছ ধরতে এসে এইভাবে ধরা পড়ে গেল। আর সে কি ধরা পড়া! একেবারে জিনি সিস্টারের হাতে। চোখে তার পানি এসে যায়। পিন্টু তার বাবাকে ও ভাবে গাল দিতে গেল কেন? এর পরে আবার কোনদিন বললে আছড়ে মানুষ করে দেবে পিন্টুকে। আজ নেহাৎ তার হাতটা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল বলে।
চেয়ারে বসে আছেন জিনি সিস্টার। এই প্রথম তাকে এত কাছে থেকে দেখল আনু। অনেকটা মনিরের মা–র সমান। কিন্তু ছিপছিপে শ্যামল, গায়ে একটা গয়না নেই শুধু গলায় রূপোর চেনে স্কুশের লকেট, হাতে ঘড়ি, কালো চিকন পাড়ের শাদা শাড়ি পরনে। চোখের চশমার জন্যে ভারী গম্ভীর দেখাচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো কী মিষ্টি। তার বড় আপার মতো মায়া করে কথা বলেন। আনু চোখ বুজে থাকে। আবার যখন চোখ খোলে তখন জিনি সিস্টার গেলাশটা এগিয়ে বলেন, খেয়ে নাও দিকি।
লজ্জা করে আনুর, কিন্তু উঠে বসে চো চো করে সবটা খেয়ে ফেলে। কেন যেন চোখে পানি এসে যায় তার। জিনি সিসটার জিগ্যেস করেন, কি নাম তোমার?
আনু।
কোন্ বাড়ির ছেলে তুমি?
কী বলবে আনু? বাবার নাম করতে সংকোচ হয়। আৰু কী দিয়ে সে পরিচয় দেবে নিজের বুদ্ধি করে শেষে বলে, আমার বোন পড়ত এই ইস্কুলে।
কে?
নাম করলো আনু। তখন ছোট্ট করে জিনি সিস্টার উচ্চারণ করলেন, ও।
অনেকক্ষণ আর কিছু বললেন না। অস্বস্তি করতে লাগল আনুর। ঝি এসে গেলাশ নিয়ে গেল। আনু মাথা নিচু করে রইলো। শেষে সে নিজেই বলল, পিন্টু, বশীদের ছেলে, চেনেন? আমাকে সিগারেট খেতে বলে। খারাপ কথা বলে। আমি ঘাটে চুপচাপ বসেছিলাম। আমি কিসসু করিনি।
জিনি সিস্টার হাসেন। আনু বুঝতে পারে ঘাটে চুপ করে বসে থাকার মিথ্যেটা ধরা পড়ে গেছে। সে সেটা ঢাকার জন্যে আবার বলে, আমার মাথা কেটেছে নাকি?
না। একটু কেটে গেছে। ওষুধ দিয়ে বেঁধে দিয়েছি। খারাপ ছেলের সঙ্গে কক্ষনো মিশো না। তুমি পড়ো?
হ্যাঁ, ফাইভে। এবার সিক্সে উঠব।
বাঃ, বেশ। তুমি এতো ভালো ছেলে, দুপুর বেলায় মাছ ধরতে বেরোও কেন? এখন লেখা পড়া করবার সময়।
চোখ নামিয়ে নেয় আনু। জিনি সিস্টারকে তার ভালো লাগে। ভয় করে না আর। তাই ভয় পায় না কথা শুনে। উনি তো জেনেই গেছেন আনু মাছ ধরতে এসেছিল। বলে, রোজ ধরি না। আমি পড়ি। ফোর থেকে সেকেণ্ড হয়ে ফাইভে উঠেছি।
এবার কি হবে?
কী জানি। আমার দুটো বই নেই।
মা–কে বোলো কিনে দিতে। তোমরা কভাই বোন?
পাঁচ বোন আর আমি। বড় ভাই ছিল, রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে।
হ্যাঁ, আমি শুনেছি।
তখন আরো আপন মনে হয় তার জিনি সিস্টারকে। বলে, এখানে কত ফুল গাছ। আমি বাগান করেছিলাম, একটা ভালো গাছ পাই না।
তুমি বাগানও করো? আচ্ছা, তোমাকে আমি চারা দেব। কাল এসো। এক যেতে পারবে?
হ্যাঁ
মাথার ব্যাণ্ডেজে হাত বুলোতে বুলোতে আনু বলে। কিন্তু উনি উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, তোমার মা দেখলে কি বলবেন? তোমাকে দিয়ে আসুক। এখন ভালো লাগছে না একটু?
আনু মাথা কাৎ করে সায় দেয়। জিনি সিস্টার দারোয়ানকে ডাকেন। আনু উঠে দাঁড়ায়।