ফিরে এসে দেখে নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন বাবা। ভোরের আলোয় তার মুখ এত শান্ত দেখাচ্ছে যেন একটা ছবি দেখছে আনু। বাবা মোনাজাত শেষ করেই দেখতে পেলেন আনুকে। উঠে আনুর মাথায় মুখে সেই হাত দুটো মাখিয়ে দিয়ে বললেন, চল।
ওরা স্টেশন ঘরের ভেতর দিয়ে বেরুলো না। ট্রেনটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকের লাইন ধরে হাঁটতে লাগল সবাই। বাবা গল্প করতে লাগলেন জমাদার সাহেবের সঙ্গে। পেছনে মা বড় আপা মেজ আপা সালু আপা ডালু আপা। আর একেবারে শেষে আনু। আনু এর মধ্যে ভাব করে ফেলেছে সেপাইয়ের সঙ্গে। একজন গেছে মালের সঙ্গে গরুর গাড়িতে। আরেকজন তাদের পেছনে চলেছে। আনু জিগ্যেস করে গম্ভীর গলায়, হাঁ সেপাই, তুমি এই থানায় কাজ করো?
জি খোকা বাবু।
কী নাম তোমার?
ইয়াসিন আছে।
তুমি বেহারি?
ভ্রু কুঁচকে আনু জিগ্যেস করে। কিন্তু ভারী মজা লাগে তার কথা বলবার ঢং। আর কী মোটা গোঁফ, দুটো আমপাতার মতো বড় বড়। ইয়াসিন হেসে ফেলে। আবার তেমন জোরে হাসে না, সামনে হুজুর যাচ্ছেন যে! গলা নামিয়ে বলে, হাঁ বেহারি তো আছি খোকাবাবু। ফিন বেহারি নাই। এখন বাঙ্গালি আছি আমি। এহি হামার মুলুক আছে।
তুমি ছাতু খাও?
ও ভি খাই তো। এখন তো মাছ খায় খোকাবাবু। আমি একরোজ পকায়ে দিব, আপনি খাবেন, মা ভি খাবেন, বোলবেন কী রকম কে কভি খায় নাই। হাঁ।
শুনে ডালু আপা খিলখিল করে হেসে উঠে। মার আঁচল টেনে বলে, মা দ্যাখো আনু সেপাইটার রান্না খাবে।
ওর তো খালি ঐ সব।
চলতে চলতে মা তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করেন। আনু তখন খুব গম্ভীর হয়ে চলতে থাকে। পথ থেকে একটা কঞ্চি কুড়িয়ে নেয়। সেটা দিয়ে ভোরের শিশিরে ভিজে থাকা লজ্জাবতীর দল ছোঁয়। কেমন আস্তে বুজে আসে ওরা। আনু পিছিয়ে পড়ে সবার থেকে।
রেল লাইনের পাশে এত লজ্জাবতী যে বিস্ময়ে আনু সব কিছু ভুলে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে। একটাকে বোজায়, আবার আরেকটা অমনি রেখে দেয়। আর থানকুনি গাছ কত! পয়সার মতো গোল গোল পাতাগুলো থিরথির করে কাঁপছে ভোরের বাতাসে। এত থানকুনি গাছও একসঙ্গে আগে আর দেখেনি আনু। এখন ভাবনা কী? মা যদি ফোঁড়ার ওষুধ করতে চান তো আনু একদৌড়ে এক কোচড় থানকুনি এনে দিতে পারবে।
আনু, ও আনু।
বাবা সামনে থেকে ডাক দেন। অনেক পিছিয়ে পড়েছে সে। আনু দৌড়ে এসে বাবার হাত ধরে। বলে, কী বাবা?
জমাদার সাহেব বলেন, এই বুঝি আপনার ছোট ছেলে?
হ্যাঁ। ক্লাশ ফোরে পড়ছে। ভেরি শার্প অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট।
আনু বুঝতে পারে তার প্রশংসা করছেন বাবা। সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। জমাদার সাহেব অকারণে নিঃশব্দে হাসতে থাকেন। বাবা বলেন, আর আমার ছোট মেয়ে মিনু, সে সঙ্গে নেই। ওদের মামা এসেছিল নিয়ে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের কাছে এসে পড়েছে ওরা। সিগন্যালের পাশ দিয়ে ডানে রাস্তা নেবে গেছে। সেই রাস্তা ধরলো ওরা। রাস্তার দুপাশে পাতলা বাঁশ-বন। একটুখানি হাঁটতেই বড় রাস্তা এসে গেল। বড় রাস্তার ওপরেই থানা।
হালকা লাল রং। আবার ছাদের কাছে শাড়ির পাড়ের মতো নীল রেখা। তাইতে খেলনা বাড়ির মতো দেখাচ্ছে। সামনে শান বাঁধানো বিরাট বারান্দা। বারান্দার নিচে মাঠ। থানার বামে কোয়ার্টারগুলো। ওরা এসে দেখল গরুর গাড়িটা তখনো এসে পৌঁছয়নি।
থানা থেকে ছোট দারোগা সাহেব বেরিয়ে এলেন। এসে বাবাকে আদাব করলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়।
আমার এখানেই ছেলেমেয়েরা নাশতা করে নিক স্যার। একটু আরাম করুক।
বাবা তার সঙ্গে চলে গেলেন থানা দেখতে।
কোনো নতুন বাড়ির ভেতরে এলে আনু একেবারে চুপসে যায়। দারোগার বৌ সবাইকে বসতে দিলেন ঘরে। আনু চুপ করে এককোণে মায়ের পাশে চোখ নামিয়ে বসে রইলো। মা বললেন, মেয়েরা হাতমুখ ধোবে ভাই।
যাক না, কুয়োতলায় পানি তোলাই আছে। যাও তোমরা।
ছোট দারোগার বৌ আঙ্গুল তুলে পথ দেখিয়ে দিলেন। মা বললেন, আনু, যা না সঙ্গে।
আনু যেন বেঁচে গেল। একলাফে বাইরে এসে দাঁড়ালো সে। তার পরে এলো বড় আপা ওরা।
কুয়োতলায় উবু হয়ে বসে দাঁত মাজতে মাজতে মেজ আপা হিহি করে হাসতে হাসতে সেজ আপাকে বলল, ছোট দারোগার বৌ এত গয়না পরেছে কেন রে?
সেজ আপা গলা নিচু করে বলে, তবু আনু শুনতে পায়।
ঠিক বেশ্যাদের মতো দেখতে। ম্যাগো!
বড় আপা ঘুরে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় ওরা। বড় আপা এবার আনুকে দেখেন। আনু জানে, ওটা খারাপ কথা শুনতে নেই। সে যেন আদৌ শোনেনি এ রকম মুখ করে একটা ডাল দিয়ে কষে দাঁতন করে চলে। কানে তার আবার ভেসে আসে মেজ আপার হি-হি। কি যে, খালি হাসতে পারে মেয়েটা! যখন ছোট দারোগার বৌ আসেন তাদের নাশতার জন্যে ডাকতে, সবাই পেটে হাসি চেপে মুখ কাঠ করে রাখে।
তা গয়না গায়ে একটু তার বেশিই। বোধ হয় ওদের অনেক টাকা, মনে মনে ভাবল আনু। তার বাবার মতো যে সবাই নয়, এটা অনেক দিন আগেই সে বুঝেছে। কিন্তু তার জন্যে একটুও রাগ হয় না বাবার ওপর, বরং কেমন মায়া করে। মনে হয়, সে যখন অনেক বড় হবে, অনেক টাকা রোজগার করবে, তখন বাবাকে এনে দেবে। বাবা সবাইকে গয়না বানিয়ে দেবেন, গাড়ি কিনবে আনু, আর নতুন জুতো। ট্রেনে করে কত দূরে দূরে যাবে আনু। জংশনে গিয়ে ছবি দেখে আসবে। একবার পানু ভাইয়ের সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছিল সে। তার মতো একটা ছোট ছেলে ছিল ছবিতে। কী চমৎকার ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে কাঁহা কাঁহা যাচ্ছিল।