যাহ্। আমি মারবো কিন্তু?
মেজ আপা ধমকে ওঠেন, ছিঃ আনু।
পানু ভাই তখন বলেন, গার্ডের বাতি পাবি কোথায়? তুই যখন গার্ড হবি, তখন রেল থেকে দেবে। তোর জন্যে অন্য একটা জিনিস এনেছি।
সঙ্গে সঙ্গে আনুর নাকের ভেতরে সুটকেশের খোলা ডালা থেকে উঠে এসে চামড়া আর ন্যাপথলিনের পাকানো ঝাঝালো ঘ্রাণ লাগে। মাথার ভেতরটা রিমঝিম করতে থাকে। বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে। পানু ভাই একেবারে তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা চৌকো বাক্স বার করে আনেন। আনুর সামনে তুলে ধরে বলেন, বলত কি?
আনু প্রায় লাফিয়ে কেড়ে নেয় বাকসটা। চেঁচিয়ে ওঠে, আমার আমার বলে। আপারা তাকে ছেকে ধরেন, দেখি দেখি করে। আনু একটানে বাক্সটা খুলে দেখে ছোট্ট একটা টেবিল ঘড়ি। ঘড়ির ওপরে একটা প্যাচার ছবি। সেকেণ্ডের কাটা টিকটিক করছে, তালে তালে প্যাঁচার চোখ দুটো একবার ডানে একবার বামে তাকাচ্ছে। আনু ঘড়িটা মাথার ওপর তুলে বাঃ কী মজার বলে নাচতে লাগল এক পায়ে। খিলখিল করে হেসে উঠল সালু আপা মিনু আপা।
পানু ভাই জিগ্যেস করলেন, কি পছন্দ? আবার অ্যালার্ম আছে। দেখিস, কী সুন্দর বাজে। আনু ঘড়িটা নিয়ে একদৌড়ে বাবার কাছে চলে যায়। বাবা ঘড়িটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দেখেন উজ্জ্বল চোখে। প্যাঁচাটার কাণ্ড দেখে হো-হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, মানুষের কী বুদ্ধি দ্যাখ, আনু।
একেবারে সত্যির প্যাঁচা যেন, না বাবা?
বাবা যেন কত হালকা হয়ে গেছেন, বয়স তাঁর কমে গেছে এক মুহূর্তে। ঝরঝরে গলায় তিনি বলতে থাকেন, কত দাম হবে? পানুটা চিরকাল খরুচে। তোর জন্যে এনেছে, এবার থেকে ঘড়ি ধরে পড়তে হবে। অ্যালার্ম দিয়ে রাখবি, টুনটুন করে বাজবে ভোর পাঁচটায়, ঘুম থেকে উঠবি তখন।
আরে, প্যাঁচাটা সত্যি ভারী সুন্দর এঁকেছে তো!
বাবার হাত থেকে ঘড়িটা কেড়ে নিয়ে মা-কে দেখাতে যায় আনু। মা রান্নাঘরে। গিয়ে দেখে বড় আপা পরোটা বেলছেন আর মা খুন্তি দিয়ে মোহনভোগ নাড়ছেন। ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ উঠেছে। জিভেয় পানি এসে যাচ্ছে। আনু ঘড়িটা মেঝের ওপর বসিয়ে বলে, বড় আপা, দ্যাখ।
আরে, এটা কী?
বড় আপা বেলন থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।
তোকে দিল পানু ভাই?
হ্যাঁ, আমাকে। আর কাউকে না।
তখন পানু ভাইর গলা শোনা গেল বাইরে, ডাকছেন, তুই কোথায় গেলি ফতেমা? ফতেমা। বড় আপা মুখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি আবার পরোটা বেলতে লাগলেন। মা বললেন, যা না, ডাকে তোকে।
বড় আপা মাথা আরো নামিয়ে নেন। ডাকতে ডাকতে পানু ভাই এসে হাজির হন রান্নাঘরের দরজায়। বলেন, তুই এখানে? দ্যাখ তো পছন্দ কিনা।
বলে একটা নীল ঝলমলে শাড়ি বড় আপার কোলে ছুঁড়ে দিলেন পানু ভাই।
ওর সঙ্গে ব্লাউজ পিসও আছে। বাব্বাঃ, আমি কি মেয়েদের জিনিস কিছু বুঝি না পছন্দ করতে পারি? আর যেমন কপাল, সবগুলোই মেয়ে এ বাড়িতে। কিরে, কেমন?
আনু, ওকে একটা টুল দে।
মার কথায় চৈতন্য হয় আনুর। সে একটা টুল এনে মুছে দেয় বসবার জন্যে। পানু ভাই বসেন। তাকিয়ে থাকেন বড় আপার দিকে। বড় আপা তেমনি মুখ নিচু করে আড়-চোখে কাপড়টা একবার দেখে। নীল জমিন, পূর্ণিমা রাতের আকাশের মতো জ্বলজ্বল করছে। চওড়া রূপোলি জরির কাজ করা পাড়। আনুর খুব ভালো লাগে। বড় আপা কোনোদিন একটা ভালো কাপড় পরেন না। গলে; কাপড় পরলে ওকে কী সুন্দর লাগে, দেখতে! সেদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল মা–র পুরনো সবুজ শাড়িটা পরে, একেবারে জমিদার বাড়ির মেয়ের মতো লাগছিল বড় আপাকে। ম ঝংকার দিয়ে ওঠেন, এ কেমন মেয়ে? ভাই একটা জিনিস দিলে মানুষ কত খুশি হয়, বলে, আর একটা কী হয়েছে? মনিষ্যির জাত না?
পানু ভাই বলেন, না, ও যা লাজুক। চিঠি দেখেই বুঝেছি। সবার জন্যে সব লিস্টিতে আছে, ফতেমার কোন নামই নেই।
বলতে বলতে পানু ভাই কোলের কাছ থেকে দুটো মোড়ক তুলে ধরেন। আনু উদগ্রীব হয়ে ওঠে, আরে, এটা আবার কি?
মোড়ক খুলাতে দেখা গেল, একটা রূপোর পানের বাটা আর এক জোড়া নরম কালো কুচকুচে চাট। মা–র সামনে রেখে পানু ভাই বললেন, মা, তোমার জন্যে।
কড়াইটা উনোন থেকে নামিয়ে মা জিনিস দুটো হাতে নিয়ে কী খুশি হয়ে ওঠেন। গগনে আগুনে ঘাম ছুটতে থাকে তার। হাসিতে আলো হয়ে ওঠে মুখটা। বলেন, তুই আবার আমার জন্যে খরচ করতে গেলি কেন?
খরচ আর কি?
মা অনেকক্ষণ ধরে নেড়ে চেড়ে দেখলো! পানের বাটাটা খুলে ছোট ছোট বাটিগুলো তুলে দেখলেন আর হাসলেন। তারপর পানু ভাইর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন থেকে মাসে মাসে টাকা জমাস পানু। পাঁচ টাকা দশ টাকা করে জমালেই বছরান্তে কত টাকা হয়। আনু, যাতো জিনিসগুলো ঘরে রেখে আয়।
মার জিনিস, বড় আপার শাড়ি, নিজের ঘড়ি নিয়ে আনু এ ঘরে এসে দেখে এক মহা হুলস্থুল কাণ্ড—-ছড়ানো জিনিসপত্র, শাড়ি, ক্রুশকাটা, উল, ডিএমসি সুতো, স্নো, পাউডার, ফিতে, সাবান নিয়ে আপার বিছানা জুড়ে বসেছেন। এ ওর জিনিস মিলিয়ে দেখছে, গালে ঠোনা দিচ্ছেন, হেসে উঠছেন, কাপড়গুলো বুকে লাগিয়ে লাগিয়ে পরখ করছেন। বাবার জন্যে কার্পেটের জায়নামাজ আর পাঞ্জাবির কাপড় এনেছেন পানু ভাই। জায়নামাজটা জলচৌকির ওপর এরি মধ্যে কে বিছিয়ে দিয়েছে। ঘরটা একেবারে নতুন লাগছে। আনুর টেবিল ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বাজে।