হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেল। লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল আনু। পানু ভাই গান থামিয়ে হেসে জিগ্যেস করলেন, কিরে? লেখাপড়া করছিস, না, খালি টো-টো?
ধেৎ। আমাকে ফোরে নিতেই চায় না, হেডমাস্টার আমাকে নিজে পরীক্ষা করে তবে ফোরে নিয়েছে।
তাই নাকি?
কেমন অদ্ভুত একরকম চোখ করে পানু ভাই কথা বলেন, যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন, তার চোখটা সেইসব স্বপ্নের ছবি দেখে ফিকফিক করে হাসছে। আনু প্রতিবাদ করে ওঠে, বাবাকে জিগ্যেস কোরো না তুমি? এখানে সব নতুন বই। তাই আমি বলে সব পড়ে ফেলেছি।
বাহ। আর চাই কী?
পানু ভাই আবার গুনগুন করেন খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ শুধোন, হারে, বাবা আমার চাকরির কথা শুনে কী বলল?
কী খুশি সকলে। বাবা মিলাদ পড়ালো সেদিন। আমি ইস্টিশনের দোকান থেকে জিলিপি কিনে এনেছিলাম তিন সের।
হাঃ হাঃ হাঃ।
গলা খুলে হাসতে থাকেন পানু ভাই। তার হাসির শব্দ চাকার শব্দ একাকার হয়ে এক তালে বাজতে থাকে। আনু ভেবেই পায় না এতে হাসবার কি আছে? কিন্তু সেও হেসে ওঠে। বলে, কত লোক হয়েছিল।
চারদিকে দেখতে থাকেন পানু ভাই তার হাসি-হাসি চঞ্চল চোখ মেলে।
মহিমপুর তো বেশ শহর।
আবার নদী আছে পানু ভাই। নদীর পাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ দেখা যায়। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাবো।
কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার নামে বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না পানু ভাইর। বরং তিনি আনুকে অবাক করে দিয়ে জিগ্যেস করলেন, মাছ কেমন নদীতে? জানিস?
আনু হঠাৎ প্রসঙ্গটা বুঝতে পারে না। তার মনে পড়ে যায়, তাড়াতাড়িতে খেয়াল করেনি, পানু ভাই যখন বাক্স নামিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তিনটে বড় বড় হুইল লাগানো ছিপ দেখেছিল। ছিপগুলো ইয়াসিনের হাতে দিয়ে পানু ভাই বলেছিলেন, হুঁশিয়ারি সে লে জানা। বহুৎ নাজুক হয়।
মুঝে মালুম হ্যায় বড়া খোকাবাবু।
আনু বিস্মিত গলায় বলে টমটমের দুলুনিতে দুলতে দুলতে, তুমি ছিপ দিয়ে মাছ ধরো?
দূর বোকা! ছিপ দিয়ে মাছ ধরবো না তো কি বাঘ মারবো?
তা পানু ভাই যদি বলতেন যে ছিপ দিয়ে বাঘও তিনি মারেন তাহলেও অবিশ্বাস করতো না আনু। কারণ, তার ভাই জগতের সবচে অসম্ভব অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর কাজ করেন— রেলের স্টেশন মাস্টার তিনি। কেমন অজানা এক রহস্যের ঘ্রাণ তার চারপাশে। আনু যেন একেবারে সম্মোহিত হয়ে যায়। তার বিশ্বাসই হয় না, এই লোকটা, এই পানু ভাই, তার বড় ভাই।
টমটমওলা ঘাড় বাঁকিয়ে জিগ্যেস করে, কোনটে খাড়া করিম? বাসার গেটৎ?
বাসার সামনে এসে গেছে টমটম। আনু আধো উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্কেবারে গেটে লাগাও।
গাড়ির আওয়াজ পেয়ে আপারা সব ছুটে এসেছেন দরোজায়। তাদের একপাশে মা মাথায় ঘোমটা তুলে দিতে দিতে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানা তার থিরথির করে কাঁপছে, যেন পানিতে ছায়া পড়েছে। আনু লাফ দিয়ে নামবার সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন করে উঠল সবাই। সে গুঞ্জনের কোনো অর্থ নেই, একটা সুরের মতো।
পানু ভাই সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। খামোকা মাথার চুলে হাত ঘষলেন, তারপর বড় আপা মেজ আপাকে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছিস?
কাছে আসতেই, আনু দেখে, মা-র চোখে পানি। সে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে। মুছবার চেষ্টা করছেন না। পানু ভাই কাছে আসতেই তার গায়ে হাত রেখে মা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আনুর বড় অদ্ভুত লাগলো। আপারা সবাই হাসছেন, তাদের হাসি হাসি মুখগুলো ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে, পানু ভাইকে লজ্জিত বিব্রত দেখাচ্ছে, মা কাঁদছেন অথচ তার মুখেও হাসি। আনু একেবারে অবাক হয়ে গেল।
হঠাৎ পানু ভাই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আনুকে জিগ্যেস করলেন, ভাড়া কতরে?
আট আনা।
টমটমওলা একগাল হেসে বলল, না মুই আট আনা নিবার নই। এক টাকা দেন তোমরা।
আনু ধমকে ওঠে, কিসের এক টাকা?
কেনে? হামার খুশি নাগে না? বড় খোকা বাড়িতে আইচ্চেন, হামাকে তোমরা এক টাকা দিবেন না কেনে?
পানু ভাই তাকে আস্ত একটা টাকাই দিয়ে দিলেন।
বাবা উঠোনে একটা মোড়ায় বসে মুরগির বাচ্চাগুলোকে খুদ দিচ্ছিলেন। চোখ তুলে তিনি বললেন, এলি?
পানু ভাই তাঁর কাছে এসে কদমবুসি করল। বাবা তখন আরো মুঠো মুঠো খুদ দিলেন ছড়িয়ে দিয়ে হাতটা একেবারে খালি করে ফেললেন। তারপর হঠাৎ গরম হয়ে বললেন, এদ্দিন গেল একটা চিঠি নাই পত্র নাই, এই তোমার আক্কেল, আঁ? এখানে কেউ তোমার কিছু না? চাকরি পেয়ে চিঠি দিলে, আর আমি উদ্ধার হয়ে গেলাম? এই স্বাস্থ্য হয়েছে? আনু বুঝতে পারে, বাবা একটুও রাগ করেননি, যদিও গম্ভীর গলায় কথা বলছিলেন। পান ভাই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছিলেন, আমতা আমতা করছিলেন, হাসি পাচ্ছিল আনুর। তার এখন কত কাজ। পানু ভাইর সুটকেশ দুটো নতুন আর কী বড়। আনু যতক্ষণ না সেই সুটকেশ দুটো খুলতে পারছে, ভেতরটা ছটফট করছে। পানু ভাইর হাত ধরে সে টান দেয়। বলে, ঘরে এসো না মা ডাকছে।
বাবা আবার মুরগির বাচ্চাগুলোকে টি–টি আয় আয় বলে ডাকতে থাকেন।
সুটকেশে চাবি লাগাতেই আনু জিগ্যেস করে উঠল, আমার গার্ডের বাতি পানু ভাই?
ডালাটা লাফিয়ে উঠল সুটকেশের। পানু ভাই মুখ তুলে বললেন, দূর পাগল। গার্ডের বাতি দিয়ে তুই কী করবি?
বারে, তোমাকে বললাম যে!
চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছেন আপারা। সেজ আপা বলেন, আনুর যে কী কথা। জানো পানু ভাই, আনু না গার্ড হবে। আপাকে বলেছে।