হবেও বা। আনু কত জায়গায় ঘুরেছে, কত দেখেছে, ওরা তো আর কোথাও যায়নি! আনুর তখন গর্ব হয় খুব। সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা নিস্পৃহতা জাগে তার ভিতরে। পরম উদাস কণ্ঠে সে বলে, জানিস আমরা এখান থেকেও চলে যাবো। বাবা খুব শীগগীর বদলি হবে।
কোথায় রে?
চট করে কোনো জায়গার নাম মনে পড়ে না আনুর। তার পানু ভাই থাকে ঢাকায়। ঢাকায় থেকে পড়ে। আনু এক মুহূর্ত ইতস্তত করে অবলীলাক্রমে বলে, ঢাকায়।
ইস। ঢাকা যাবি ভাই?
হ্যাঁ, না তো কী? দেখিস।
এবার আনুর বাবা বদলি হলো মহিমপুরে। বাঁধাছাঁদা করবার সময় বাবা মাকে বলেছিলেন, ছেলেমেয়েগুলোর কিছু লেখাপড়া হলো না। বছরের শেষে বদলি। না এখানে পরীক্ষা দিতে পারল, না ওখানে গিয়ে নতুন ক্লাশে ভর্তি হতে পারবে।
তিনি বড় বড় ছালার মধ্যে হাড়ি বাসন রুটি বেলবার বেলন, ভাঙা একটা বেতের বাক্স, আধমণ পেঁয়াজ ভরে চলেছেন। তাঁর হাতের আর কামাই নেই। বড় আপা সাহায্য করছে মা-কে। আর কারো দেখা নেই। না মেজ আপা, সালু আপা, ডালু আপা কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আর ওরা সব ওদের বন্ধুদের কাছে গেছে। চলে যাচ্ছে কিনা! গলা ধরে ধরে গল্প করছে।
বাবা লেখাপড়া নিয়ে দুঃখ করেছিলেন। কিন্তু আনু ভেবেই পায় না দুঃখ করবার কী আছে! খামকা তার মন খারাপ করে দিতে পারেন বাবা! কেন, পানু ভাই ঢাকায় পড়ছে। সে এবার ক্লাশ ফোরে পড়ছে। গত বছর সেকেণ্ড হয়েছিল না সে? মাস্টার মশাই বলছিলেন প্রাইজ দেবে আনুকে। তা এখান থেকে চলে গেলে, আর কে আসবে প্রাইজ নিতে? এতে যা একটু মন খারাপ হয় আনুর। আর বড় আপার তো পড়া শেষ হয়ে গেছে। তার বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের জন্য বাবা কত চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, লেখাপড়া একেবারে করে না মেজ আপা। এত ফাজিল হয়েছে। খালি গল্প, গান আর পাড়া বেড়ানো। মাকে পর্যন্ত একটু কাজ করে দেয় না।
বাবা বলেন, আনু, হোন্ডলটার ওপর চেপে বসতো বাবু।
লাফিয়ে চড়ে বসে আনু। খুব করে জাততে থাকে। বাবা কষে টান লাগান চামড়ার স্ট্যাম্প ধরে। ঘামে তার মুখটা ভিজে ওঠে। বলেন, ভেতরে কটা বালিশ দিয়েছিস, অ্যাঁ?
সেই মহিমপুরে আসা।
ভোর বেলায় গাড়িতে উঠেছিল। কারু সঙ্গে দেখা হয়নি আনুর। ছেলেদের বলে দিয়েছিল ইস্টিশানে আসিস ভাই। কিন্তু স্টেশনে এসে তাদের মনে পড়ে নি। স্টেশনে এলেই আনু যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। সব কিছু ভুলে যায়। বুকের মধ্যে কেমন শিরশির দুপদুপ করতে থাকে। কোথাও যাবার জন্যে আনুর মনটা হুহু করে ওঠে। যেন এক মুহর্ত বসে থাকা যাবে না, থাকলে পৃথিবীর কত কী যেন সে আর দেখতে পাবে না; যেন পৃথিবী কোথাও একটা বিরাট মজাদার মেলা খুলে তাকে ডাকছে।
ধড়মড় করে উঠে বসলো আনু। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা থেমে আছে। একটা ইস্টিশান। ভোরের আবছা আলোয় কেমন বৃষ্টি ধোয়া মনে হচ্ছে। দূরে একফালি ঘন বনের মাথায় জমেছে মিহি কুয়াশা। প্ল্যাটফরমে পোড়া কয়লা দেখাচ্ছে ভিজে ভিজে।
ওঠ, ওঠ, মহিমপুর এসে গেছে দ্যাখ।
বাবা তাকে একটানে পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে দেন। তারপর গলা বাড়িয়ে চিৎকার করে কুলি ডাকেন। কিন্তু তার আগেই দুজন সেপাই এসে দাঁড়ায়। সালাম করে। আর একটু পরেই আসে আরেকজন। আনু তার পোশাক দেখে, মাথার টাক দেখে, গোঁফ দেখে, কেমন করে যেন বুঝতে পারে, এ হচ্ছে বড় জমাদার।
মেজ আপা আনুকে ডেকে ফিসফিস করে বলে, আমার আরেক জোড়া স্যাণ্ডেল কোন্ ট্রাঙ্কে আছে, জানিস ভাই?
আনু অবাক হয়ে তাকায়। বুঝতে পারে না। বলে, কেন?
দেখ না, এটার ফিতে ছিঁড়ে গেছে।
মা বুঝি শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি ঝামটা দিয়ে উঠলেন, এখন কে তোর স্যাণ্ডেল বার করবে?
বারে আমি যাবো কী করে?
খালি পায়ে যাবি। কে দেখতে আসছে তোকে?
কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় যেন মেজ আপা।
বাবা নিচে নেমে গেছেন। সেখান থেকে দরোজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে কী বলতে এসেছিলেন, মার কথা শুনে বললেন, আহা, আবার কি হলো?
মা তার জবাব না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিলেন ভালো করে। এখন তাকে নামতে হবে। সবার আগে লাফ দিয়ে নামে আনু। সবাই যখন নেমে আসে আনু দেখে মেজ আপা সালু আপার স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়েছে। আর সালু আপার পা খালি।
একটা গরুর গাড়ি এসেছে। ওতে সব মালপত্র যাবে। আর এই টুকুন তো পথ। রেল লাইনের ধারে ধারে হেঁটে গেলে আধমাইলও নয়। হেঁটে যাবে সবাই। জমাদার সাহেব বললেন, নাকি স্যার, আরেকটা গাড়ি ডাকব? মেয়েরা রয়েছে।
না, না, তার দরকার হবে না। বরং দিব্যি একখানা মর্নিং ওয়াক হয়ে যাবে। কী বলিস? বলতে বলতে সবার উপরে স্মিত মুখ ঘুরিয়ে আনলেন বাবা। তারপর জমাদার সাহেবকে বললেন, তাহলে আমি বরং এখানেই ফজরের নামাজটা পড়ে নেই।
ঠিক তখন বেজে উঠলো গার্ডের বাঁশি। হুস হুস করে চলতে শুরু করল ট্রেন। ঝকঝক করে আঁধারের মধ্যে গাড়িটা দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। প্ল্যাটফরমে পড়ে রইলো ছড়ানো বাক্স প্যাটরা, সুপুরির বস্তা, পোস্টাফিসের ব্যাগ, মাছের বাক্স। আনু একেবারে প্ল্যাটফরমের শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে গেল বড় আপার সঙ্গে।
আনুর সবচেয়ে ভালো লাগে বড় আপাকে। সারাক্ষণ যেন কী ভাবে বড় আপা, যেন কত দুঃখ ওর মুখটা একেবারে কালো আর এইটুকু করে রাখে। আনুকে কোনদিন বকে না, মারে না, আনুর জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি করে না। সারাক্ষণ বড় আপার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে আনুর। আনু যখন বড় হবে, যখন তার নিজের বিরাট বাড়ি হবে, যখন তার অনেক টাকা হবে তখন বড় আপাকে সে অনেক কিছু বানিয়ে দেবে, তার সঙ্গে রাখবে। কতদিন ক্লাশে যখন পড়া ভালো লাগেনি, তখন মনে পড়ে গেছে বড় আপার কথা। বসে বসে আনু তখন স্বপ্ন দেখেছে বড় আপাকে নিয়ে। দেখেছে, আনু বড় হয়ে গেছে। বড় আপার মুখখানা হাসিতে খুশিতে ফর্সা লাল দেখাচ্ছে। কোনো কিছুর অভাব নেই। সবাই ওদের দিকে দেখিয়ে বলছে—-ওরা কত সুন্দর!