মেজ আপা বড় আপাকে ঠেলা দিয়ে বললেন, তুই কী নিবিরে?
উত্তরে কিছুই বললেন না বড় আপা। শুধু ম্লান হাসলেন। আনুর এত খারাপ লাগে, বড় আপার একটুও শখ নেই। সারাদিন শুধু কাজ করবে, ছাই মাখাবে হাতে, মাথায় খড়ি পড়ে যাবে। যাকগে, তার কী? আনু নিজেই একটা চিঠি লিখবে। বলবে, আমার জন্যে একটা সত্যিকারের গার্ডের বাতি এনো পানু ভাই। আর তারপর হঠাৎ উদার হয়ে গেল মনটা। সে। আরো লিখে দেবে, বড় আপার জন্যে একটা খুব ভালো শাড়ি আনে যেন পানু ভাই।
ঘরে ঝোলানো একটা ছবি ছিল পানু ভাইর। মা সেদিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। তাকে একেবারে নতুন দেখালো তখন। তখন যেন মনে পড়ল সবার। তখন সবাই ছবিটার দিকে তাকাল।
বাবা মফস্বল থেকে ফিরে এসে চিঠিখানা পড়লেন। চিঠিখানা আনু এ কদিন নিজের হেফাজতে রেখেছিল বাবাকে দেবে বলে। পকেটে করে ক্লাশেও নিয়ে গেছে। মুন্সেফের ছেলে দেবুর সঙ্গে খুব ভাব। দেবুকে দেখিয়েছে চিঠিটা। আর বলেছে, পানু ভাই তার জন্যে। গার্ডের বাতি নিয়ে আসবে। দেবু তাকে এখন থেকেই চীনেবাদাম খাইয়ে রাখছে, বাতিটা এলে একদিনের জন্যে সে খেলতে নেবে।
পড়া শেষ করে বাবা বললেন, যাক, পানুর তবে একটা হিল্লে হলো এবার, কি বলিস? আনু, তুমিও লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে আরো বড় চাকরি করবে। অনেক মাইনের। কেমন?
শুনে বোকার মতো হাসতে থাকে আনু। বাবা মনে করেন আনুর বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই তিনি আবার বললেন, হ্যাঁ তাই তো। মিছে কথা কি বলছি? আনু তখন ম–স্ত বড়লোক, কত টাকা। কত কী। ঢুকতে দারোয়ানের কাছে নাম লেখাতে হবে। বলতে হবে আমি সিভিল সার্জনের কাছে যাবো।
বাবার বড় শখ আনু সিভিল সার্জন হয়। আনুকে বাবা একটানে নিজের হাটুর ওপর তুলে বসিয়ে দেন। পা দোলাতে থাকেন। আনুর ভারী লজ্জা করে। সে কি ছোট এখনো? বড় আপাকে দেখে আরো লজ্জা করে তার। বড় আপা বলেন, বাবা তুমি হাতমুখ ধোবে না? নামাজের বেলা যায়।
ওরে তাই তো। নাম তো বাবা। যাঃ।
আনুর পাছায় চটাস্ করে একটা মিষ্টি থাপড় লাগিয়ে দেন বাবা। তারপর কাপড় ছেড়ে ওজু করতে বসেন। মফস্বল থেকে পাকা পেপে এনেছেন বাবা। সেইগুলো কাটা হচ্ছে রান্নাঘরে। আনু একদৌড়ে সেখানে গিয়ে উবু হয়ে বসে। যেন একাই সে আজ সবগুলো খেয়ে ফেলবে।
০৬. ট্রেনটা হুস-হুস ঝকঝক করতে করতে
ট্রেনটা হুস-হুস ঝকঝক করতে করতে অবশেষে স্টেশনে থামলো। মাঝখানে আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ডিসট্যান্ট সিগন্যালের পারে। ডাউন দেয়নি। সিগন্যালটা থানার একেবারে কাছে। আগে জানলে, ইস আনু গিয়ে ওখানেই দাঁড়াত। কে আসত এতদূর কষ্ট করে স্টেশন পর্যন্ত বয়ে।
ট্রেন দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে লোকে লোকে থইথই হয়ে গেল প্ল্যাটফরম। আনু কাছে যেতে পারছে না, কিছু দেখতে পারছে না। বাবা তাকে স্টেশনে পাঠিয়েছেন পানু ভাইকে আনবার জন্যে। সঙ্গে ইয়াসিন আছে। ইয়াসিন বলল, খোকাবাবু ইরকম কি দেখতে পাবেন? আপনাকে হামার কাঁধে লিয়ে লি।
ইয়াসিন নিচু হয়ে কাঁধ পেতে দিল তার। একলাফে আনু সওয়ার হলো তার ওপর। যাঃ ভারী খারাপ দেখাচ্ছে। আগে ভাবেনি, কাঁধে উঠে খারাপ লাগছে খুব। হাসি পাচ্ছে। ক্লাশের কেউ দেখে ফেললে যা খেপাবে। আরে ঐতো।
পানু ভাই হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছেন, আনু আনু।
সেকেণ্ড ক্লাশে এসেছেন পানু ভাই। রেলেব লোক তো। চাট্টিখানি কথা নয়। আনু খুশির তোড়ে পা ছুঁড়তে থাকে। ইয়াসিন ঊর্ধ্বমুখ হয়ে শুধোয়, ভাইয়া?
আরে আমাকে নামাও না।
একদৌড়ে আনু ভিড় ঠেলে পানু ভাইর কাছে গিয়ে হাজির হয়। তিনি তার হাত দু হাতে ধরে ফেলেন।
এসেছিস?
ইয়াসিন এসে লম্বা সালাম ঠেকে। দাঁত বার করে জানায়, হামি ইয়াসিন সেপাহি, বড় খোকাবাবু। আপনার সামনে কী আছে?
পানু ভাই আনুকে জিগ্যেস করেন, বাসা কদুর রে?
আনন্দে এতক্ষণ একটা কথা বলতে পারে আনু। এবারে সে মহা উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, এই তো, এখানে। গোড়াগাড়ি নেবে? টমটম আট আনা নেবে। হ্যাঁ চলো টমটমে যাই।
টমটম ওঠার ভারী শখ ছিল আনুব। প্রথম যেদিন এসেছিল ওরা মহিমপুর, হেঁটেই গিয়েছিল বাসায়। সারা মহিমপুরে টমটম মাত্র তিনটে। তাও আগে থেকে ভাড়া হয়ে থাকে; দূরের গায়ে ভাড়া করে প্যাসেঞ্জারেরা নিয়ে যায়। আজ আনু দেখে এসেছে, দুটো টমটম দাঁড়ানো।
টকাটক টকাটক শব্দ তুলে টমটম চলতে লাগল লাল সুরবির রাস্তা দিয়ে। কোচোয়ান আবার পথ থেকে লোক সরাবার জন্যে হাতের ছড়িটা ঘুরন্ত চাকায় ছোঁয়াচ্ছে, শব্দ উঠছে কররররঠক। অবাক হয়ে আন দেখছে পানু ভাইকে।
কতকাল সে দেখেনি। মনেই পড়ে না শেষ কবে দেখেছে। শোর যখন তাকে দেখেছিল আনু, তখন কী রোগা আর ফ্যাকাশে ছিলেন পানু ভাই। চুলগুলো ছিল বাঁয়ে সিথি করা, বালিশের নিচে রেখে ইস্ত্রি করা জামা পরতেন তখন। এখন একেবারে অন্য মানুষের মতো মনে হচ্ছে সেই পানু ভাইকে। ধরতে গেলে যেন চেনাই যায় না। মাথার চুল পেছন দিকে উটিয়ে সিঁথি করেছেন, ধোবাবাড়ির ধোয়া শার্ট পরেছেন, গা থেকে আবছা একটা মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে। ট্রেনে আসবার ক্লান্তি এতটুকু লেখা নেই কোথাও। সেকেণ্ড ক্লাশ তো বাড়ির মতো। শুয়ে বসে যেমন খুশি আসো। ভিড় নেই, কী মজা! আনু এবার পানু ভাইকে বলে সেকেণ্ড ক্লাশে চাপরে, রাজশাহী–টাজশাহী যাবে। আবার সিগারেট খেতে শিখেছেন পানু ভাই। গুনগুন করে গান গাইছেন।