আহা, ওদের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে তো? তোমার বড় ছেলে সে তো লেখাপড়াই করলো না। অন্তত জামাই নিয়ে যদি দশজনের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারো, তাও তো বংশের নাম থাকে।
বাবার কণ্ঠস্বর অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। একটু যেন বিষণও শোনাচ্ছে। যেন নিজেকেই কথাগুলো বলছেন বাবা। বললেন, টাকারই যুগ পড়েছে এখন। আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম লোকে অমুক বাড়ির ছেলে বলে পরিচয় দিলে আর কিছু লাগত না। তা আমি কি আর ম্যাজিক জানি যে তুড়ি দিলেই টাকা আসবে? অধর্ম করবো না বলেই তো নইলে তুড়ি দিলেও টাকা আসে। একেকটা এমনও কেস আসে, সুযোগ তো কত হয়েছিল, পাঁচ দশ হাজার হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। নিলেই হয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে জবাব দেব কী? আল্লাহ্ যখন হাশরের মাঠে ডেকে জিগ্যেস করবেন—-গোলাম হোসেন, তোমাকে দিলাম জুলুম আর অন্যায় থেকে মানুষকে রক্ষা করতে, তুমি তারই গোলাম হয়ে গেলে? কী জবাব দেব তখন বলো? এও আল্লাহর এক পরীক্ষা আনুর মা।
মা হঠাৎ নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে কেঁদে ফেললেন। তার কান্নাবিকৃত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তুমি তো আর বাসায় থাকো না। তুমি পেটেও ধরো নি। দিন রাত্তির পাড়াপড়শির কথা শুনতে কেমন লাগে তা তুমি বুঝবে কী করে?
শুনে আনুর মনটা হু–হুঁ করে উঠল। কান্না পেল। চলচ্ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল আপাদের চেহারা, ঘোট দারোগার বৌয়ের পিচপিচে হাসি, চাচার মুখ, সাইকেলের দোকান, টাউনক্লাবের রেডিওটা। টাকা তো দিতে চায় লোকে, কেন নিতে চায় না বাবা? কী হয় নিলে? বাবার ওপর ভীষণ আক্রোশ হতে থাকে তার। আল্লাহ্ যখন জিগ্যেস করবে তখন আল্লাহ্ কী বুঝবে না দরকার ছিল খুব তাই নিয়েছে বাবা। আল্লাহ্ সব জানে। তবু বাবা কেন জেদ করে থাকে? বাবা কি! ধর্ম আর অধর্ম কথা দুটো কতবার বাবার মুখে শুনেছে সে; ভালো করে প্রসঙ্গ বোঝেনি, অর্থ স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু এতটুকু বুঝতে পেরেছে আনু, যে একটা শক্ত দড়িতে তারা অসহায়ের মতো বাঁধা পড়ে গেছে। বালিশে মুখ গুঁজে আনু ভাবে আমি যখন বড় হব, আমি কিছু মানবো না, কিছু শুনবো না।
ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলা অনেক হয়ে গেছে। ফুল কুড়োবার জন্যে সালু আপা তাকে ডেকে ডেকে একাই চলে গেছে কখন। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনু দেখতে পেল একে একে সবাইকে—-মা, বাবা, বড় আপা, মেজ আপা, সেজ আপা, মিনু আপা, ছোট আপা। তবু সবাইকে কেমন নতুন আর অচেনা মনে হলো আনুর। মনে হলো, কাউকে সে কোনদিনই চিনতো না। মনে হলো, যেন সবাই অন্য বাড়ি থেকে বেড়াতে এসেছে।
বাবা নেই, বাসাটা তাই বড় খালি খালি ঠেকছে। দুধ নেবে গো সেই কখন হেঁকে গেছে, আকাশে গড়িয়ে পড়েছে দুপুর, বড় বড় গাছের ছায়াগুলো ক্রমেই লম্বা হয়ে আসছে আর আনুদের বাসাটা যেন আরো একেলা হয়ে যাচ্ছে। বাসার কাছেই থানা বলে প্রায় দুপুরবেলাতেই বাবা আসতেন একটু চোখ বুজতে। কিন্তু আজ তো বাবা নেই। বাবা গেছেন মফস্বলে। মা আপারা শোবার ঘরে কেউ শুয়ে কেউ মেঝেয় বসে গল্প করছেন, উল বুনছেন।
আনু হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল ইস্টিশানে। একা একা বসে ছিল গোডাউন শেডে পাটের বেলের ওপর। সেখানেও ভালো লাগল না তার। তখন আবার ফিরে এলো বাসায়।
বাইরের ঘরে এসে ঢুকতেই মাস্টার সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে বসে বললেন, আনু, তোমাদের একটা চিঠি এসেছে এইমাত্র। ওই তো টেবিলের ওপর দ্যাখো।
আনু চিঠিখানা হাতে নিয়ে জিগ্যেস করে, কার চিঠি মাস্টার সাহেব?
কী জানি।
আনু তাকিয়ে দেখে খামের ওপরে লেখা ফ্রম পানু, ঢাকা।
পানু, পানু ভাই! ঢাকা থেকে লিখেছেন! একদৌড়ে চিঠিখানা নিয়ে আনু ভেতরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, মা, মা, বড় আপা, পানু ভাইয়ের চিঠি এসেছে।
বড় আপা তাড়াতাড়ি খাম ছিঁড়ে চিঠিখানা বার করলেন। আর সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার, তারপর হেসে ফেললেন। তখন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল বড় আপার নিঃশব্দ হাসিটা। বললেন, মা, ভাইয়া চাকরি পেয়েছেন।
চাকরি!
সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
হ্যাঁ, রেলের। অ্যাসিসট্যান্ট স্টেশন মাস্টার।
ধক করে উঠলো আনুর বুকের ভেতর। রেলের চাকরি! স্টেশন মাস্টার! আনু কি স্বপ্ন দেখছে। খপ করে সে চিঠিটা কেড়ে নিতে গেল, আমি আগে দেখি।
তুই কী দেখবি? ভাগ্।
সেজ আপা থাপ্পড় দিয়ে তার উদ্যত হাতটা ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু আজ রাগ করলো না আনু। বরং সে গোড়ালির ওপর খুশিতে এক পুরো চক্কর কেটে চেঁচিয়ে উঠল, হিপ হিপ হুররে।
সবাইকে চিঠিটা পড়ে শোনালেন বড় আপা। মাইনে ভালো। এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবেন। কার কী চাই যেন আগে থেকেই লিস্টি করে পাঠিয়ে দেয়। মা বাবাকে সালাম আর সবাইকে স্নেহাশীষ। ছোট্ট এতটুকুন। তবু কী খুশি একেকজন। বারবার পড়েও যেন ফুরুচ্ছে না। মা তো দুবার পড়েও যেন কোনো অর্থ উদ্ধার করতেই পারলেন না, এত খুশি হয়েছেন তিনি। বারবার বলছেন,
আমি কিছু দেখতে পারছি নারে। পানুকে বলব এবার আমাকে একটা চশমা করে দেয় যেন। একবর্ণ পড়তে পারি না।
পড়বেন কী করে? আনু দেখেনি বুঝি? মার চোখে পানি এসে গিয়েছে।
সালু আপা বলল, আমি এক বাক্স ডি-এম-সি সুতো আর এক ডজন সোনামুখি সুঁই।