সেইজন্যেই তো তোর বাবা নিজে খেতে পায় না, আবার বাড়িতে পর পুরুষ যোয়ান ছেলে এনে পুষছে।
তারপর তার হাতে আরো দুটো মায়া গুঁজে দিয়ে সাবধান করে দেন ছোট দারোগার বউ, খবরদার, কাউকে বলবি না, আমি কী বললাম। বুঝলি? তোর মাকেও না। আমি বাবা। তোদের সাতে–পাঁচে থাকতে চাই না। আমার মন পরিষ্কার। তাই পেটের কথা বলে ফেলি। আর বলব না বাবা, তওবা, তওবা। যাহ্।
এক দৌড়ে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আনু। কিন্তু খেলায় আর মন বসে না। তার দেরি দেখে ছেলেরা খুব ক্ষেপে গেছে। তাদের হাতে বল–ব্যাট সব ছেড়ে দিয়ে সে চুপ করে পথের। ধারে কালভার্টের ওপর বসে থাকে। আজ হাটবার। হাটের দিকে তোক যাচ্ছে, বাকে করে আলু–পটল চালের বস্তা নিয়ে, কুমড়ো কাঁধে ঝুলিয়ে, মুরগিগুলো ঠ্যাং জড়ো করে বেঁধে। আবার সরষের তেল যাচ্ছে ভাড়ে করে। থানার কাছে অফিসার জলচৌকি পেতে বসেছে। সেখানে সব তেলওলা এসে ভঁড় রাখছে আর তাদের তেল খাঁটি কিনা পরখ করে দেখছে অফিসারটা। একেকজনের কাছ থেকে এক পো আধসের তেল আবার তুলে রাখছে আলাদা একটা টিনে। হাত জোড় করে মাফ চাইছে একজন।
আনুর মনে পড়ে যায়, পয়লা দিন দেখেই মেজ আপা না সেজ আপা বলেছিল বেশ্যার মতো। হোক খারাপ কথা, ঠিক বলেছে। ছোট দারোগার বউ তাছাড়া কি? কী বিচ্ছিরি কথা বলে আর পি পিচ্ করে হাসে। আবার রাতে একেকদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। চেরা গলা, একটুও মিষ্টি লাগে না শুনতে, তার কত ঢং। একটা কথাই বারবার করে ঘুরে ফিরে গায়—-প্রিয়, মধুরাতে সাজিল মন। গানের আওয়াজ পেলেই বাবা কেমন অস্থির হয়ে ওঠেন। আনুকে বলেন, ঘুমো, ঘুমোসনি কেন?
আনু ভাবে, দূর ছাই, তারচে বিয়ে হয়ে যাক তার আপাদের। তাহলে খুব শিক্ষা হয় সবার। কেউ আর কিছু বলতে পারবে না তখন আনুকে। তখন আনু সবার সামনে বুক ফুলিয়ে যাবে। তখন কেউ কিছু বললে আর ছেড়ে দেবে না আনু। ইয়াসিনের কাছে চমৎকার কুস্তি সে শিখে নিয়েছে। তখন আর কেউ কিছু বলতেই সাহস পাবে না আনুকে।
কিন্তু বিয়ে দিতে গেলে যে অনেক টাকা লাগে। এত টাকা কোথায় পাবেন বাবা? চাচার কাছে গিয়েছিলেন, চাচাও ফিরিয়ে দিলেন খালি হাতে। ফিরে এসে বাবা কী রাগ করলেন মা–র ওপর! তারপর নিজেই বললেন, নাহ, তোমার আর দোষ কি?
সেদিন আপারা ভয়ে লজ্জায় কেউ আর বাবার সামনে আসেননি।
কদিন আগে মহিমপুর থেকেই দুটো বিয়ের কথা এলো বড় আপা মেজ আপার জন্যে। একজনের একটা সাইকেলের দোকান আছে। আনু ইস্টিশানের কাছে তার দোকানটা দেখেছে, আর একজন টাউন ক্লাবের লাইব্রেরিয়ান, বাড়িতে নাকি বিস্তর ধানের জমি আছে। মেজ আপা আই. এ. পরীক্ষা দেবে প্রাইভেটে সামনের বছর, পড়াশোনার খুব শখ ওর। বিয়ের কথা শুনে কেঁদে সারা হলো। বড় আপার কিন্তু কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। আগের মতোই রানা নিয়ে ব্যস্ত, উঠোন ঝাড় দিচ্ছেন, বিছানা পাতছেন বিকেল বেলায়। যেন তার নয়, অন্য কারো বিয়ের কথা চলছে।
সাইকেলের দোকানটা দেখেছে আনু। ঝকঝকে দুটো নতুন সাইকেল রাখা, শো–কেসে পার্টস সাজানো আর সামনে মেরামতি হয়। লোকটা ভারী ফুলবাবু। ফিনফিনে জামা গায়ে সারাক্ষণ আশেপাশের দোকানে বসে আড্ডা মারছে। আবার ট্রেন এলে খামকা প্ল্যাটফরমে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী যেন খোঁজে, চারদিকে পাতিপাতি করে দেখে ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ঝুলিয়ে। আবার ফিরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানে গেলাশে চা খায়। আবার লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকটি রোজ বিকেলে টাউনক্লাবের দরোজা খোলেন কোথা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে। দারোয়ান ঘর ঝাড় দেয়। হ্যাঁজাকটা বার করেন তিনি। তেল ভরে দিলে নিজ হাতে জ্বালান। রেডিওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান ধরেন! আনু মাঝে মাঝে রেডিওর গান শুনতে আসে এখানে। লোকটা যা কালো আর মোটা। মুটা সেই আন্দাজে কচি, একেবারে দশবারো বছরের ছেলের মতো! হাসি পায় দেখলে। এদের সঙ্গে বিয়ে হবে নাকি আপাদের? মা-র কিন্তু একটু পছন্দই হয়েছে।
সেদিন অনেক রাতে কি করে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আনুর। চারদিকে অন্ধকার থইথই করছে। প্রথমে ভয় পেয়ে আতকে উঠেছিল আনু, কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই ফিরে এসেছে সাহসটা। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে। বাবার বিছানার পাশে এসে বসেছেন মা। পান খাচ্ছেন বুঝি। কুটকুট করে সুপুরি ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা মাকে বলছেন, না তা হয় না। ঐ অপদার্থ দুটোর সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া ঢের ভালো। বুঝেছ?
মা আহত স্বরে বললেন, কত তুমি জামাই আনছো রোজ! এক পয়সা দাবি নাই, বাড়ির অবস্থা ভালো, আর কি চাও? এক সাথে দুই কাজ হতো, ঝামেলা কত কম।
বাবা সে সব কিছুই শুনলেন না। বললেন,তার চে মেয়েদের গলা টিপে মারবো। কী বংশ কী লেখাপড়া—-সবদিক থেকে দেখবে না তুমি?
বাবার এমন কঠিন কণ্ঠস্বর আনু কোনদিন শুনেছে বলে মনে পড়ল না। অন্ধকারে তার গাও ছমছম করে উঠল। পাত্র দুটো যে বাবার পছন্দ হয়নি, এত খুশি হয়েছে আনু—-কিন্তু সে খুশিটাও কেমন যেন ভয়ের মতো দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে রইলো তার বুকের ভেতরে। মা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর এক সময়ে বললেন, এতগুলো টাকা ঢালতে পারবে না, কোন্ জজ ম্যাজিস্টার এসে তোমার জামাই হবে তুমিই জানো।