মাস্টার সাহেব হঠাৎ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, আজ ছুটি। ঈদে মিলাদুন্নবী। কলেজ নেই আমার।
তাই তো! আনুরও মনে ছিল না, আজ তার স্কুলও বন্ধ। বড় আপা আরো এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন তখন। মাস্টার সাহেব এতক্ষণ বইয়ের পাতায় মনোযোগ রেখেছিলেন, চোখ তুলে খুব ঝরঝরে গলায় বললেন, পড়ো আনু পড়ো। সময় নষ্ট করতে নেই।
বাবা চলে গেলেন বেলা দশটা নাগাদ। যাবার সময় আজ আনুকে ডেকে আস্ত একটা সিকি দিয়ে গেছেন। সিকি! অন্যদিন হলে বাসার সবাইকে একবার করে না দেখিয়ে ছাড়ত না। আজ তার সেই যে মনটা ম্লান হয়ে গেছে সকাল বেলায় আর কিছু ভালো লাগছে না। আজ সে সিকিটা পেয়ে চকোলেটের দোকান থেকে দুটো চকোলেট কিনে ফিরে এলো।
বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চুষতে লাগল চকোলেট। ভাবল, তাকে অবহেলায় শুয়ে থাকতে দেখে সবাই এসে আদর করবে! কিন্তু কেউ তাকে তাকিয়েও দেখল না। তখন অভিমান হলো আরো। তার চোখের সামনে দেয়ালটা শাদা—বাঁশ ছেচে তার ওপর সিমেন্টের পলাস্তরা করে চুনকাম করে দিয়েছে। একেক জায়গায় ভেঙে বাঁশ বেরিয়ে পড়েছে। ভারী বিশ্রী লাগছে; আনু উঠে দাঁড়াল। পেন্সিল নিয়ে দেয়ালে, তার পড়ার টেবিলের ওপরে একটা হাঁস আঁকলো। তারপর পাশে বড় বড় করে লিখল আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ, মেস ম্যান হ্যাঁপি অ্যান্ড ওয়াইজ। লিখতে লিখতে ক্ষয়ে গেল পেন্সিলটা। তাতে কী? আনুর এখনো তিন আনা আছে, সে নতুন একটা পেন্সিল কিনে নেবে।
বড় আপা এ ঘরে এলেন। আনু বলল, একটা জিনিস খাবি আপা?
কিরে?
মুঠো করে চকোলেটটা তার হাতে গুঁজে দেয় আনু। কেমন লজ্জা করে। বড় আপার মুখটা হাসিতে রাঙা হয়ে ওঠে। নিয়ে চলে যেতে চান তিনি। আনু তার আঁচল ধরে টানে।
বাইরে গেলে ওরা সবাই দেখবে। আমার কাছে যে আর নেই।
আচ্ছা, আচ্ছা।
চৌকির কোনায় বসে বড় আপা মোড়কট খুলে মুখে পুরে দেন। চুষতে গিয়ে বুড়িদের মনে গাল বসে যায় তার। আনু হাসে। বড় আপা বলেন, খুব মিষ্টিরে! তুই খেয়েছিস?
ভাই বোনদের ভেতরে আনু সবচে ভালোবাসে বড় আপাকে। ওর মনে হয়, ওর মতো তাকে কেউ এত ভালোবাসে নি। আনু শুনেছে, ও যখন কোলে, তখনই বড় আপার স্কুলের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে। তারপর কত জায়গা থেকে বিয়ে এসেছে বড় আপার, কিন্তু কোনটাই বাবার পছন্দ হয় নি। মনের মতো কাউকেই খুঁজে পাননি তিনি। আর যাদের পছন্দ হয়, তাদের সাথে বিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগে। অত টাকা কোথায় পাবেন বাবা? তার বাবার যে টাকা নেই—-এই কথাটা আনু সেই ছোটবেলা থেকে উঠতে বসতে শুনে এসেছে। সেই ছোটবেলা থেকে টাকার প্রতি এক দুর্বোধ্য রহস্যবোধ শেকড় গেড়ে বসেছে আনুর মনে। আলীবাবার গল্পে যখন গুহার দরোজা খুলে যায় আর ঝলমল করে লক্ষ লক্ষ হীরে মণি মুক্তো চুণী পান্না, শুনতে শুনতে আনুর চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে যেত। তার মনে হতো, সে নিজেই যেন সেই গরিব কাঠুরে আলীবাবা। মনে হতো, সে যদি ও–রকম একটা গুহার সন্ধান পেয়ে যেত কোনদিন! তাহলে কী মজাটাই হতো। কার কাছে যেন শুনেছিল, অনেক সময় গাছের কোটরে বুড়ো বুড়ো বটগাছের শেকড়ের ফাঁকে গর্তের মধ্যেও মণি মুক্তো লুকোনো থাকে। কতদিন সে কত গাছের কোটরে উঁকি দিয়ে দেখেছে। একদিন হয়ত পেয়েই যাবে আনু। সেদিন মা আর মুখ কালো করে থাকবেন না, বাবার আর থানায় চাকরি। করতে হবে না, তাদের আর কোনো কষ্টই থাকবে না। একরাতে আনু স্বপ্ন দেখেছিল উঠোন ভর্তি ছড়ানো রাশি রাশি নতুন টাকা, আর তার ওপরে মজা করে লাফাচ্ছে আনু, টাকাগুলো মুঠো ভরে তুলছে, ঢেলে ফেলছে, টুং টুং শব্দ উঠছে মিষ্টি বাজনার মতো।
আনু বুঝতেই পারে না বাবা মা কেন এত অস্থির হয়ে উঠেছেন বড় আপা মেজ আপা সেজ আপার বিয়ে দেবার জন্যে। সবার কাছে সে শোনে, ছোট দারোগার বউ বলে, পিন্টু বলে, কোর্ট দারোগার বুড়ি ফুপু বলে। এত বড় বড় সব মেয়ে। এদের ঘরে রাখে নাকি? ঘরে রাখলে মুখে কালি দেবে একদিন। আনু ভাবতে পারে না, মুখে কালি দেবে কী করে তার আপারা? তার বিশ্বাসই হয় না, না বলে না কয়ে তার বড় আপা কারো সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে। গা শিরশির করে ওঠে আনুর। সেদিন ছোট দারোগাদের বাড়িতে তার ব্যাট বল গিয়ে পড়েছিল। সেইটে আনতে গেছে, তাকে ধরে ফেললেন ছোট দারোগার বৌ। আদর করে বসালেন। আনু উসখুস করছিল, তার খেলা দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বৌটাকে তার একেবারে পছন্দ না। মাকে সারাক্ষণ কী সব বলে আর মা-র মুখ আঁধার হয়ে যায়। আনুকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাস্টার সাহেবের কথা জিগ্যেস করলেন। তারপর হাতে একটা। কাউনের মিষ্টি মোয়া দিয়ে শুধোলেন, তার বড় আপার সঙ্গে মাস্টার সাহেব হেসে হেসে কথা। বলে কিনা, একলা ঘরে দেখা হয় নাকি, মাস্টার সাহেব সারাদিন বাড়ি ছেড়ে একদণ্ড বাইরে যায় না কেন? এই সব। আনু প্রত্যেকটা কথার বিরুদ্ধে সজোরে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে। তখন ছোট দারোগার বৌ তার গালে ঠোনা দিয়ে বলেন, আরে, সেদিন আমি দেখলাম মাস্টার তোর আপার হাত ধরে আছে। তুই না ভাই? তুই ধরতে পারিস না?
আনু অবাক হয়ে যায়। সত্যি দেখেছে নাকি বৌটা? সত্যি বড় আপার হাত ধরে ছিল মাস্টার সাহেব? আনুর চোখ ছলছল করে ওঠে। ফাঁদে পড়া পাখির মতো ছটফট করে সে। মাথা নেড়ে বলে, যাঃ। মাস্টার সাহেব কত ভালো।