মুখ ধোবার জন্যে পানি তুলে দিলেন মা। বললেন, ফুল কুড়োনো হয়ে গেল এরই মধ্যে? ধন্যি ছেলে, নিত্যি নিত্যি ফুল কুড়োনো চাইই চাই। কী হয় বাপু এত শিউলি এনে?
অভিমান হয় আনুর। বলে, কেন, সালু আপাই তো বলেছে শিউলির বোটা দিয়ে রঙ হয়। সেই রং–এ তুমি নাকি জরদা করবে।
মা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা যা, তুই চা খেয়ে পড়তে বোস। খালি বেড়ানো!
আনু বুঝতেই পারে না, মার মেজাজ আজকাল এত তেতো হয়ে যাচ্ছে কেন। সে আস্তে আস্তে উঠে আসে।
বড় ঘরের বারান্দায় সবাই গোল হয়ে বসেছে চা খেতে। হঠাৎ আনুর নজরে পড়ায় চিৎকার করে ওঠে, দেখেছ বাবা, মিনু আপা কতগুলো দুধ ঢাললো ওর কাপে। দেখেছ?
আহা নিক। তুইও নে।
এত মিষ্টি করে বললেন বাবা যে আনুর মনটা ঝিরঝির করে উঠল। সেও ভাবলো, নিক না। মিনু আপা সারাক্ষণ তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে, জ্বালাতন করে মারে, সে সব কিছুই এখন মনে পড়ল না আনুর। সে এক মুঠো মুড়ি তার কাপে ঢেলে সুড়ৎ সুড়ৎ করে খেতে লাগল। চায়ের সঙ্গে ভারী স্বাদ হয়েছে। ও–রকম চায়ে মুড়ি ঢেলে সালু আপা মিনু আপাও খাচ্ছে। মেজ আপা সঙ্গে বসেননি। তিনি একটা থামে ঠেস দিয়ে খাচ্ছেন। ছবির মতো লাগছে।
চা খেতে খেতে বাবা মাকে বললেন, আমার সুটকেশ গোছানো হয়েছে?
কেন?
উদ্বিগ্ন হয়ে আনু জিগ্যেস করে। উত্বে দেন মেজ আপা, বাবা আজ মফস্বলে যাবে আনু।
সত্যি?
আনুর যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
হ্যাঁ।—বাবা বললেন।
তাহলে কবে তুমি আসবে?
তার কি ঠিক আছে? কাজ যদ্দিনে হয়। এই দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরব আমি।
শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় আনুর। আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। নতুন করে মুড়ি নিতে ভুলে যায়। একেবারে কিছুই আর ভালো লাগে না তার।
কেন যে বাবা বেছে বেছে এই থানার চাকরিটা নিয়েছেন, ভেবেই পায় না আনু। খালি অভাব আর অভাব। তার ওপর একদিনের জন্যে সুস্থির নেই। আজ এখানে কাল সেখানে এই করে। মাসের অর্ধেকটাই বা বাইরে বাইরে কাটান। আর যখন তিনি থানার অফিসে এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে বসে থাকেন তখন কেমন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে আনুর মন। মনে হয় তিনি বুঝি আনুর বাবা নন। কেমন গম্ভীর আর দৃঢ় মুখখানা। দেখে ভয় করে আনুর। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করে। তাই পারতপক্ষে আনু কোনদিন থানার পথ মাড়াতো না। কত ছেলের বাবা কত কী কাজ করে। তার এক বন্ধু ছিল ডাক্তারের ছেলে। তার বাবা কানে স্টেথিসকোপ লাগিয়ে বুক দেখতেন, ইঞ্জেকশন দিতেন, আবার ঘোড়ায় চড়ে রুগী দেখতে যেতেন দূর দুর গাঁয়ে। মাথায় শোলার হ্যাঁট, প্যান্ট পায়ের কাছে জড়িয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, একপাশে। ঝোলানো ওষুধের কালো ব্যাগটা ঘোড়া চলতো আস্তে আস্তে, বেশ লাগতো আনুর। দুপকেট ভর্তি টাকা নিয়ে ফিরতেন তিনি আর আনতেন আম, লিচু, না হলে পাকা পেপে। পিন্টুর বাবাও বেশ। পিন্টুর বাবা বকশীবাবু অস্ট্রেলিয়া বিলাত কত জায়গায় পাট পাঠান, ইচ্ছা করলে নিজেও যেতে পারেন, যান না। মনিরের বাবার কাজও কত সুন্দর। মাসের মধ্যে চারবার ঢাকা যাচ্ছেন। ওদের মিল বসছে সিরাজগঞ্জে, কাপড়ের মিল। মনিরের বাবা কত বড় লোক। দোতলা বাড়ি। মনির রোজ ছাদে উঠতে পায়। ছাদে উঠতে এত মজা লাগে আনুর!
খুব ভোরে যারা ওঠেন তারা নাকি বড় লোক। বাবাও তো বড় লোক। বাবা তবে কেন অমন বিশ্রী একটা চাকরি করেন? চোর ঠ্যাঙ্গায় বলে ছেলেরা তাকে ঠাট্টা করে। আবার কেউ কেউ বলে দারোগার ছেলে পাজি হয়, মিশতে চায় না তার সঙ্গে।
সেজ আপা একদিন তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যারা বলে আনু, তাদের বলবি, দারোগা না থাকলে তোদের বাড়িতে চুরি হলে কি করবি? একেবারে ফকির হয়ে যাবি।
মুখে মুখে কথার জবাব আনু কোনদিন দিতে পারে না। সেজ আপা শিখিয়ে দিলেও তা আর বলা হয় না।
মাস্টার সাহেবের কাছে পড়ছিল আনু। তিনি বললেন, আজ তোমার কী হয়েছে?
কিছু না।
তো পড়ছ না কেন?
বারে, পড়ছি তো।
বলে আনু মন দেয় বইয়ের পৃষ্ঠায়। এবার সত্যি সত্যি মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে সে। আর মাস্টার সাহেব তার কলেজের বই খুলে নিজেও পড়ছেন। আনুর খুব ভালো লাগে মাস্টার। সাহেবকে। রোজ সকালে সাড়ে নটার ট্রেনে রংপুর যান কলেজ করতে। আবার ফিরে আসেন সন্ধ্যায়। বাবার কাছে সে শুনেছে, মাস্টার সাহেব নাকি খুব গরিব, কষ্ট করে যারা লেখাপড়া করে তারা অনেক বড় হয়। আনু খুব খুশি হবে, যেদিন মাস্টার সাহেব পাশ করে খুব বড় চাকরি করবেন।
আনুকে একটুও বকেন না মাস্টার সাহেব। বাড়িতে থাকলেও মনে হয় বাড়িতে নেই। একটুও সাড়া পাওয়া যায় না। বাইরের ঘরে চুপচাপ পড়ে থাকেন। আনুকে কত অদ্ভুত সব ছবি এনে দেন, বিলিতি ছবি, কাগজ থেকে কাটা ছবি। আনুকে একটা খাতা করে দিয়েছেন; সেই খাতায় ছবিগুলো সেঁটে রাখে আনু। অবসর সময়ে বসে বসে দেখে। কত দেশের ছবি, গম ক্ষেতের ছবি, হ্রদের ছবি, পাহাড়–পর্বতের ছবি। পাহাড় দেখতে এত ভালো লাগে আনুর প্রথম যেদিন ধরলার পাড়ে ভোর বেলায় বাবার সঙ্গে সে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখল, রোদে এক মুহূর্তের জন্যে ঝলমল করে উঠেই আবার নীল হয় চূড়াটা, আনুর মনে হলো জেগে জেগে এক অপূর্ব রঙিন স্বপ্ন দেখছে সে।
বড় আপা ভেতর থেকে দরোজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আনুকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, মাস্টার সাহেবকে ভাত দেব নাকি জিগ্যেস কর।