পথে বেরিয়ে আনুর ভারী ভালো লাগল শীতসকালের আমেজ ভরা শহরটিকে। মাত্র কয়েকমাস হলো ওরা এসেছে মহিমপুরে। এটা নাকি মহকুমা সদর। কিন্তু হলে হবে কী, শুনতেই যা। বর্ষাকালে কাদায় যদি ঘর থেকে এক পা বেরুনো যায়। যেদিকে তাকাও শুধু পানি আর কাদা। আবার যখন গরম পড়ে তখন পথে এত ধুলো ওঠে যে, আনুদের কোয়ার্টার থেকে থানা এক মিনিটের পথ, এইটুকু হেঁটে যেতেই হাঁটুভর্তি ধুলো হয়ে যায়। আনুর শুধু ভালো লেগেছে এই শীতকালটা। লেপ মুড়ি দিয়ে মিটমিট করে চোখ খুলে জানালা দিয়ে পথটাকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। কেমন পাথরগুলো ভিজে গিয়েছে শিশিরে। লালমাটি বিছিয়ে রয়েছে পুরু কাঁথার মতো। আর থানার পেছনে বড় শিউলি গাছটা অ্যাতোগুলো ফুল ছড়িয়ে রেখেছে ঘাসের ওপর। সালু আপার সাথে রোজ ফুল কুড়োতে আসে আনু। এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে গাছটার দিকে। ডালগুলো বুড়ো হয়ে গেছে, পাক ধরেছে, বাকল উঠে গেছে, তবু তারি গায়ে চিকন চিকন ডাল বেরিয়েছে, সেই ডালে ফুল। সালু আপা ধমক দেয় একেকদিন, হাঁ করে গাছ দেখলে কি আর ফুল কুড়োনো যায়? নিশ্চয় পোকা এখুনি এসে পড়বে। তখন নিসর্গে ফুল।
আবার তখন দুহাতে ফুল কুড়োতে শুরু করে আনু। ও আবার বলে, আনু গাছে উঠতে পারবি?
একবার গাছটায় চোখ বুলিয়ে নেয় অনু! পরে বলে, হুঁ।
তবে ওঠ। উঠে ডানদিকের বড় ডাল ধবে ঝকালে কিন্তু মেলা ফুল ঝরবে। তুই ওঠ।
তারপর ঝুরঝুর করে, ডাল থেকে নাড়া পেয়ে, আরো কত শিউলি যে ছড়িয়ে পড়ত তার আর হিসেব নেই।
একেকদিন বাবা আসতেন আনুদের সাথে। অনুরা ফুল কুড়িয়ে তখন জমা করত তাঁর কাছে। তারপর তিনজন একসঙ্গে ফিরে আসতে বাসায়। বাসায় এসে চা–মুড়ি খেতে খেতে মালা গাথতো সালু আপা, আনু একটা একটা করে ফুল তুলে দিত তার হাতে। বাবা কিন্তু আনুদের আসবার অনেক আগেই শিউলি গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেখানে গিয়ে পায়চারি করতেন আর আনতস্বরে সুর করে সুরা পড়তেন। ভারী মিষ্টি গলা ছিল বাবার। কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করত আনুর। আকাশ থেকে আসা অশরীরি গানের মতো মনে হতো তার।
কোনো কোনো ভোরসকালে ঘুমের ঘোরে আনু শুনতে পেত, বাবা নামাজ পড়ছেন। দীর্ঘ কোন এক সুরা করুণ সুরে আবৃত্তি করে যেতেন তিনি। আনু তন্ময় হয়ে যেত শুনতে শুনতে। কেন যেন তার পানি এসে যেত চোখে। বালিশে মুখ গুঁজে নিস্পন্দ পড়ে থাকত সে।
আজ তাড়াতাড়ি শিউলি তলায় আনু সালু আপাকে নিয়ে গিয়ে দেখে, বাবা সেই কখন থেকে সেখানে পায়চারি করছেন। পথের দুধারে নিবিড় গাছপালা আর বড় বড় আমগাছ। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাবা সুরা পড়ছেন। চোখ দুটো তাঁর প্রায় বুজে এসেছে। ওদের দেখে তিনি আনমনে একটু হাসলেন। তারপর আরো কিছুক্ষণ সুরা পড়ে কাছে এসে বললেন, কিরে, এতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গলো তোদের? আরো:সকাল করে উঠবি। খুব সকালে উঠবি। শুধু ফুল কুড়োনোর জন্যেই কি এত ভোরে ওঠা?তারপর বিশেষ করে আনুকেই যেন তিনি বলেন—-বড় বড় লোক, তারা সব খুব ভোরে উঠতেন। এক্কেবারে ভোরে। কাকপাখির নামগন্ধ নেই পর্যন্ত তখন।
সালু আপা আনুর হাত ধরে টানে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। ক্রমেই থালার মতো সূর্য জেগে উঠছে আকাশে। আর তারই লাল আলোয় বাবার মুখখানা রাঙা দেখাচ্ছে। তিনি বলে চলেছেন, আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ, মেকস ম্যান হ্যাপি অ্যান্ড ওয়াইজ।
আনু ঠিক বুঝতে পারল না কথা কটির অর্থ। বাবা তাকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, যাও ফুল কুড়োওগে তাড়াতাড়ি। নইলে বাসায় আবার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
ফুল কুড়োতে কুড়োতে আনু ভাবে, বাবা কত ভোরে ওঠেন। নিশ্চয়ই বাবা অনেক বড়। বাবার মতো বড় কেউ নেই।
বাসায় ফিরে এসে দেখে বড় আপা আর মেজ আপা তখন চায়ের জোগাড় করেছেন। সেজ আপা রাতের বিছানাগুলো ঝাড়ছেন। লেপগুলো ভাজ করে তুলে রাখছেন। মেজ আপাকে তার নাম ধরে একেকসময় আনু ডালু আপাও বলে ডাকে। ডালু আপা বলতে ভারী মিষ্টি লাগে আনুর।
আর মিনু আপার শুধু শুধু শয়তানি মতলব। কাজকর্ম কিছু করবে না, কিন্তু ভাব করে যেন কত কী রাজকার্যে ব্যস্ত। আনু গিয়ে রান্নাঘরে বড় আপার আঁচল ঘেঁষে বসে পড়লো। তিনি ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এ দেখেছ আনু এখনো মুখ ধোয়নি, চা খেতে এসেছে। যা শীগগীর করে মুখ ধুয়ে আয়।
কী আর করে আনু। বাবা শুনলে খুব রাগ করবেন। শীতকালে মুখ ধুতে যা কষ্ট! গাল–মুখ চোখ ঠাণ্ডা পানিতে যেন কেটে যেতে চায়। গুটি গুটি পায়ে কুযযার পাড়ে আসে আনু। এসে দেখে, মা কাপড়ে সাবান দিয়ে রাখছেন। এতে দুপুরবেলায় যখন ধোওয়া হবে, ময়লা কাটবে ভালো। মাকে অত সকালে কাপড়ের স্থূপ নিয়ে কুয়োর পাড়ে বসতে দেখে কেমন মায়া করলো আনুর। মনিরের মা–র কথা মনে পড়ল। তাদের মতো ঝি থাকলে মার আর কোন কষ্ট ছিল না।
মনিরের কথায় সেই অবাক করা খেলনাটার কথা মনে পড়ে গেল। চোং–এর ভেতরে চোখ রেখে ঘুরোলেই ভাঙা চুড়ির টুকরোগুলো নতুন নতুন নকশা হয়ে ওঠে। বড় আপার খুব পছন্দ হয়েছিল ওটা। বড় আপা একেকদিন আনুর হাত থেকে খেলনাটা নিয়ে বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ ধরে নকশার খেলা দেখতেন। তখন তার মুখে ফুটে উঠত আবছা একটা হাসি, যে হাসিটা কোনদিন ভুলতে পারবে না আনু। অস্পষ্ট এক চিলতে একটা হাসি, ঈদের চাঁদের মতো, দেখা যায় কিনা, আনু একটু চোখ বুঝলেই একেবারে স্পষ্ট দেখতে পায়। হাসিটা তার মনকেও অজান্তে কখন প্রসন্ন করে তোলে।