লাল হয়ে যায় আনু। বাবা বলেন, আমি আর কী? আমার চেয়েও বড় হোক সেই দোয়াই করি। পুলিশের চাকরি আবার চাকরি? লোকে মনে করে পয়সাই পয়সা। দারোগারা লাল হয়ে গেল। এদিকে খবর নিয়ে দেখ, আমার একদিক দেখতে আরেকদিক কানা হয়ে যায়। এইরকম আক্ষেপ করে চলেন বাবা। একা একা। চাচা চুপ করে শোনেন। পরে বলেন, কী যে বলেন মিয়াভাই। আপনাদের অভাব? এই তো সেদিন সিরাজগঞ্জে এক বাচ্চা দারোগা এলো, তার…।
তাকে শেষ করতে দিলেন না বাবা। বাধা দিয়া বললেন, সবাই কি আর একরকম? ধর্ম যদি পানিতে ফেলা যায়, তাহলে আলাদা কথা।
রাখেন আপনার ধর্ম! আপনি সেই পুরনো কালের ধ্যান নিয়ে আছেন। যুগ এখন অন্য রকম। এখন ও–সব চলে না।
প্রায় তর্ক লেগে যায় বাবা আব চাচার। ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে সরে আসে আনু। বাবার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠেছে একমুহর্তে, চেনাই যাচ্ছে না আর। আর চাচার ফর্সা চেহারা লাল হয়ে গেছে উত্তেজনায়। আনু চুপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। নামলে রান্নাঘর দেখা যায়। দুজন কাজের মেয়ে সনার জোগাড় করছে। চাচি একটা মোড়ায় বসে পাখা হাতে তদারক করছেন। আনুকে দেখে ডাকলেন তিনি। বললেন, এই ছেলে, শোন।
কাছে এলো আনু। আনুর খুব খারাপ লাগলো তখন। তার মা আর বড় আপা রোজ নিজ হাতে রান্না করেন। গরমে, কালিতে, ধোঁয়ায় কী বিচ্ছিরি দেখায় তাদের। এরকম কাজের মেয়ে যদি থাকতো, তাহলে আর কষ্ট হতো না। চাচিকে কী সুন্দর ছিমছাম দেখাচ্ছে! মাকে বলবে।
চাচি তাকে কাছে ডেকে তার মায়ের তার বোনদের গল্প শুনতে লাগলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করলেন কত কথা। কে দেখতে কেমন, কে কত বড়, কোথা থেকে বিয়ের কথা আসছে। আনু তার অত কি জানে সে ভাল করে কিছুই বলতে পারল না। বলতে ইচ্ছে করল না। আনু খুব বিব্রত বোধ করল, লজ্জা করল তার। সে তো জানে বাবা তার আপার বিয়ে দেবেন বলে টাকা চাইতে এসেছেন চাচার কাছে।
সেরাতে অনেকক্ষণ ধরে আবার আলাপ করলেন বাবা আর চাচা। ভাত খাবার পর আনু দোতলায় মনিরের পড়ার টেবিলের পাশে বসে রইলো। মনিরকে একটা ফুলের তোড়া এঁকে দিল আনু। মনির অবাক হয়ে আঁকাটা দেখল, তারপর আরো এঁকে দেবার জন্যে বায়না ধরলো। তখন পাতা, লাটিম, কলম একে দিল আনু। সবশেষে একটা ছবি আঁকলো সে–একটা বাড়ি, পাশে নদী বয়ে যাচ্ছে, তালগাছ কাৎ হয়ে পড়েছে, আকাশে মেঘ, মেঘের মধ্যে সূর্য।
বলল, রং নেই তোর?
না।
রং থাকলে কী সুন্দর রং করে দিতাম।
না হোক। এমনিই ভালো।
মনিরের একটা মজার খেলা ছিল। চোং–এর মধ্যে ভাঙা চুড়ির অনেকগুলো টুকরো আর একটা ঘষা কাঁচ বসানো। একদিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে চোংটা ঘোরালে নতুন নতুন নকশা তৈরি হয়! এমন অদ্ভুত খেলা জীবনে দেখেনি আনু। সেইটে অবলীলাক্রমে মনির দিয়ে দিল তাকে।
ঠকঠক করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন চাচা। তাকে ভারী গম্ভীর দেখাচ্ছে। আনু ভয় পেয়ে খেলাটা মনিরকে ফিরিয়ে দিল, বলল, কাল নেবো ভাই।
তারপর নেমে এলো নিচে। এসে দেখে বাবা এশার নামাজ পড়তে বসেছেন। চোখ বোজা, ঘরে আলোটা ছোট করে রাখা। নিবিড় একটা ছায়ার মতো মনে হচ্ছে বাবাকে। নিঃশব্দে আনু গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
পরদিন সকালে ফিরে যেতে চাইলেন বাবা। চাচা বললেন আরো একদিন থেকে যেতে। আরো একদিন থেকে গেল ওরা। তারপর দুপুর এগারোটার গাড়িতে উঠল।
গাড়িতে উঠে আনু জিগ্যেস করল, টাকা দেয়নি বাবা?
বাবা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। তুই শুনলি কোত্থেকে?
আনু চোখ নামিয়ে নিল। থতমত খেয়ে গেল সে। তার জিগ্যেস করাই উচিত হয়নি। বাবা টের পেয়ে গেলেন, সেদিন সন্ধ্যেয় মার সঙ্গে বাবার কথাগুলো সব সে শুনেছে।
বাবা কিছু বললেন না আর। তার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আনুর মনে। হলো, সে মাটিতে মিশে যায়। বাবাকে ক্লান্ত, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আনুর কেন যেন মনে হলো, টাকা দেয় নি চাচা। কিন্তু বাবার মুখের দিকে আর তাকাতে সাহস পেল না সে। ট্রেন ছুটে চলেছে চাকায় চাকায় ছড়া কাটতে কাটতে। আনু সেইটে কান পেতে শুনতে লাগল—- ঢাকা যাবো, টাকা পাবো—-ঢাকা যাবো, টাকা পাবো—-ঢাকা যাবো, টাকা পাবো।
০৫. সকালবেলার লাল আলো
সকালবেলার লাল আলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মহিমপুরের নির্জন পথে এখনও এখানে ওখানে লেগে রয়েছে অন্ধকার।
আনু ঘুমিয়েছিল। সালু আপা তার চোখে ফোঁটা ফোঁটা পানি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে আনু জিগ্যেস করল, কী?
কিন্তু তার বিরক্তি চোখেই পড়ল না সালু আপার। বরং খুশিতে ডগমগ হয়ে সে বলল, ফুল কুড়োতে যাবিনে? দেখ তো বেলা কত হয়েছে?
আরে তাই তো! ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নিম গাছটার নিচে, রান্নাঘরের পেছনে বিরাট লাল সূর্য আস্তে আস্তে ভেসে। উঠছে আকাশে। তার অভিমান হলো সালু আপার ওপর। বলল, তুমিই তো বেলা করলে! আমাকে আরো আগে ডাকলে না কেন? ঠিক ও বাড়ির খোকা এসে সব ফুল এতক্ষণে নিয়ে গেছে।
তবু ঘর থেকে বেরোয় আনু। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করে তার। আর একটু সকালে উঠলেই কেমন তাজা শিউলি পাওয়া যেত। শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে ফুল কুড়োতে যা মজা! এত বেলা করে গিয়ে শুধু শুধু বাসি ফুল কুড়োনো বইত আর কিছু নয়।