এ চাচাও যে এতদিন কোথায় ছিলেন কে জানে। এই সেদিনই আনু প্রথম শুনলো, ওর এক চাচা আছেন, বাবার চাচাত ভাই; বাবার কোনো আপন ভাই নেই। একজন ছিল, বসন্তে মারা গেছে সেই ছোটবেলায। বাবা তাকে নিয়ে যখন ছোটবেলায় স্কুলে যেতেন, বাবা একবার গল্প করেছিলেন, পথে একটা খাল পড়ত, সেই খালটা ভাইকে কাঁধে করে পার হতেন। বাবা বলতেন, আমি দুঃখ কষ্ট করে একাই মানুষ হয়েছি। কেউ তো আর আমাকে দেখেনি। এখন আমার কি দরকার সেধে সেধে তাদের সাথে আত্মীয়তা করবার?
চাচার কাছেও আসতে চাননি বাবা। মা বারবার করে বলাতে এসেছেন। তাদের রিকশাটা দুপাশে লাইব্রেরী, স্টেশনারী, ওষুধের দোকান, ছাপাখানা, চায়ের স্টল পেরিয়ে চলেছে। সকাল বেলা বড় বড় মাছ উঠেছে বাজারে। বাজারের কাছে এসে রিকশা থামাতে বলল বাবা। আনুকে বললেন, বোস আমি আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে বাবা একটা প্রকাণ্ড রুই মাছ নিয়ে ফিরলেন। দড়ি দিয়ে তার কানকোর ভেতরে ফোড় করে বাঁধা। কানকো দেখাচ্ছে লাল টকটকে। আনু অবাক হয়ে যায়। বাবা বলেন, কারো বাড়িতে খালি হাতে যেতে নেই মাছটা বেশ বড় না?
হ্যাঁ।
রিকশা আবার চলতে লাগল। বাবাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। আনু চুপ করে দুধারের অচেনা বাড়িঘর দেখতে থাকে। একটা উঁচু ব্রীজের নিচে এসে পৌঁছলো ওরা। ব্রীজটার ওপরে রিকশা টেনে টেনে পার করতে হবে। বাবা নেমে গেলেন। আনু রইলো রিকশায়। বাবা পাশে পাশে হেঁটে এলেন। তারপর ও–মাথায় গিয়ে আবার রিকশায় ওঠে বসলেন তিনি। এ ব্রীজটার নাম এলিয়ট ব্রীজ। এইটুকু হেঁটেই যেন হাঁফিয়ে গেছেন বাবা। মুখ ঘামে ভিজে গেছে। চকচক করছে তার সুন্দর করে ছাঁটা দাড়ি। বাবা দুহাতে মুখ মুছলেন অনেকক্ষণ ধরে।
বাসায় এসে চাচাকে পাওয়া গেল না। চাচা ঢাকায় গেছেন কাজে, কাল ফিরবেন। চাচি বিরাট ঘোমটা টেনে বাবার সামনে এসে সালাম করতে গেলেন, বাবা বললেন, থাক, থাক। মনির এক লাফে কোথা থেকে এসে মোরব্বার বোয়ামটা কেড়ে নিয়ে গেল আনুর হাত থেকে। বাবা হেসে বললেন, ও তোর ভাই। মনির।
সিঁড়ির পাশে ছোট্ট ঘরটায় থাকবার ব্যবস্থা হলো তাদের। আনুর ভারী ইচ্ছে করছিল, দোতলায় যদি থাকতে পারতো। দোতলায় কোনোদিন থাকেনি সে। না জানি, কেমন ভালো লাগে দোতলায় ঘুমোতে। মনির থাকে দোতলায়।
ভারী ভাব হয়ে গেল মনিরের সঙ্গে। আনু তার সব বই উলটে পালটে দেখল, সেও তার মতো ফোরে পড়ে। তার খেলার বন্দুকটা নিয়ে শিখে নিল কেমন করে ছুঁড়তে হয়। বলল, আমার বাবার সত্যিকার রাইফেল আছে, পিস্তল আছে। আমাকে গুলি মারতে শেখাবে বলেছে।
তারপর মনিরের সঙ্গে বেরিয়ে গেল টাউন দেখতে। এলিয়ট ব্রীজের ওপর হেঁটে হেঁটে পার হতে ভারী মজা লাগল আনুর। আহা, এরকম একটা ব্রীজ মহিমপুরে যদি থাকতো!
বিকেলে ফুটবল খেলতে নিয়ে গেল মনির। সেনবাবুদের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলে। চরদীঘির রাজা নাকি সেনবাবু। এখন কলকাতায় চলে গেছে। বিরাট বাড়িটা, মাঠটা, পুকুরটা পড়ে আছে। কেমন ফাঁকা ফাঁকা, ভুতুড়ে বাড়ির মতো। ছেলেরা তাকে দেখে ঘিরে দাঁড়াল। সে তো নতুন, তার কেমন লজ্জা করতে লাগল তখন। ফুটবলের মাঠে একটা বলও সে কিক করতে পারল না। বল তার সামনে দিয়ে চলে যায়, ভাবে ওরাই কেউ কিক করুক, আনুর সংকোচ আর কাটে না। মনির দমাদম দুটো গোল করে। তারপর খেলা শেষে সবাই একসঙ্গে চিৎ হয়ে শুয়ে গল্প করতে থাকে। আনু পাশে বসে ঘাস ছেড়ে একটা একটা করে। ওদের একটা কথাও সে বুঝতে পারে না। কাকে যেন জব্দ করবে সেই বুদ্ধি আঁটছে ওরা। কাল স্কুলে গেলে যে ছেলেটা জব্দ হবে তার কথা ভেবে আনুর বড় মায়া করে। রাতে বাবার পাশে শুয়ে আর ঘুম আসে না। অচেনা সব শব্দ উঠতে থাকে দূর দূরান্তর থেকে, অন্ধকারে ভেতর শেয়াল ডাকে, ঝি ঝি পা ঘষে ঘষে কান অবশ করে ফেলে, কোথায় কে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়, সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ নামে, ওঠে, আবার নামে; মা–বড় আপা–মেজ আপা–সালু আ৮ ছোট আপা–মিনু আপা কি করছে এখন? এখন ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে না, গল্প করছে। আনুর কথা বলছে। আনু বেড়াতে গেছে সেই কথা বলছে। কদিন আগে বাবা একটা কলেজ পড়া ছেলেকে জায়গীর রেখেছেন সেই মাস্টার সাহেব বোধহয় ল্যাম্প জ্বেলে মোটা মোটা বই পড়ছেন। মাস্টার সাহেবের জন্যে ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে, অনেক রাতে খান। আনুকে একটা ছবির বই এনে দিয়েছিলেন মাস্টার সাহেব। আবার একসঙ্গে অনেকগুলো শেয়াল ডেকে ওঠে। তন্দ্রার ভেতর থেকে চমকে ওঠে আনু। এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর তলিয়ে যায় ঘুমে।
চাচা ভোরবেলায় এসে পৌঁছুলেন। বাবাকে দেখে ভারী খুশি হলেন তিনি। না, আনু যেমন ভেবেছিল, খুব রাগী হবেন চাচা, তেমন একটুও না। গোলগাল মুখ, ফর্সা, ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরনে আর লাল পাম্পশু পায়ে, হাতে মস্ত বড় একটা আংটি। ট্রেন থেকে নেমে এসে আর কাপড় বদলালেন না, হাত মুখ ধুলেন না, বাবার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করতে লেগে। গেলেন। ডেকে বললেন, এই কি আনু? শোনো বাবা, দেখি, দেখি।
আনু এসে সামনে দাঁড়াল। বাবা বললেন, সালাম কর।
করলো সে। চাচা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভারী সুন্দর হয়েছে। বাপের মতো বড় হওয়া চাই, বুঝলে আনু? খালি সুন্দর চেহারায় কিছু হয় না।