একটু পরেই আনু দেখতে পায় ছোট দারোগার বউ বেরিয়ে গেলেন তাদের বাসা থেকে। তার মুখটা গম্ভীর, আঁধার। অবাক হয়ে যায় আনু। একটু আগেই তো কী ডগমগে দেখাচ্ছিল বউটার মুখ।
ইয়াসিন বলে, কি খোকাবাবু। কুস্তি শিখবেন নাই?
ভুলেই গিয়েছিল আনু। সোৎসাহে সে বলে ওঠে, হ্যাঁ, শিখবো। কালকে। কাল তুমি ভোরে আমাকে ডেকে নিয়ে যেও ইয়াসিন।
রাতে রান্নার ছিল দেরি। আপাদের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিল আনু। ঘুম নয়, জাগরণ আর তন্দ্রা মেশানো একটা কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়েছিল আনু। এমন সময় ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। আর নরোম একটা স্পর্শে সে আবিষ্ট হয়ে যায়। চোখ খুলে দেখে, বড় আপা তার পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছেন। তার পায়ের কাছে সেজ আপা বালিশে ওয়াড় পরাচ্ছেন। চোখ বুজে পড়ে থাকে আনু। তার এত ভালো লাগে, মনে হয় শূন্যে মেঘের ভেতরে ভেসে আছে সে। ভেসে ভেসে কোথায় কোন্ অজানা দেশে চলে যাচ্ছে। তার কান্না পায়। বড় আপা, মেজ আপা কত ভালো। কিন্তু সবাই মুখ আধার করে থাকে, ফিসফিস করে কথা বলে। আনু ছাড়া কেউ ভালোবাসে না তাদের। আনু সারাজীবন এভাবে শুয়ে থাকতে পারে। কোথাও যাবে সে, কিচ্ছু করবে না।
মেজ আপা তার পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলেন, ভাত খাবি না?
উঁ। না। খাবো না।
মেজ আপা তখন তাকে আদর করতে থাকেন খুব।
ওঠ না মনি, তোকে আজ একটা সুন্দর গল্প বলবো। ওঠ। ভাত খেতে খেতে বলব।
আদরটা এত মিষ্টি লাগছিল! আনু ইচ্ছে করেই জেদ করে, অনেকক্ষণ ধরে করে। বড় আপা তাকে কাধ ধরে উঠিয়ে দেন। বলেন, বাব্বাঃ, কি ভার হয়েছিস তুই আনু। আমি তুলতেই পারি না।
সে রাতে মেজ আপা ভাত মেখে দিল, ডিমের মতো মুঠো পাকিয়ে দিল, মুখে তুলে দিল, তবে খেল আনু।
রাতে শুয়ে শুয়ে আনু ভাবে তার চাচার কথা যাকে সে কখনো দেখেনি। সন্ধ্যের সময় বাবা আর মা–র কথাগুলো, মা তাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে বলছিলেন, সেই সব ঘুরে ঘুরে ধূসর প্রজাপতির মতো মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। ও পাশের চৌকিতে বাবা শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। বাবার জন্যে ভারী মায়া করে আনুর। বালিশে মুখ গুঁজে সে পড়ে থাকে।
অন্যদিন হলে কোথাও যাবার নাম শুনে লাফিয়ে উঠতো আনু। আজ তার কী হয়েছে, বুকের মধ্যে কেমন টিপটিপ করছে, এখান থেকে, এ বাসা থেকে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তার। বড় আপার ফর্সা চেহারাটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাথায় একটি ছোট্ট টিপ। চিবুকের কাছে একটুখানি ভাজ। আনু আয়নায় দেখেছে তার চিবুকেও ওরকম ভাজ আছে। তার মায়েরও আছে। বড় আপা যখন হাসেন ভাজটা ছড়িয়ে যায়, কী সুন্দর লাগে! ইয়াসিনের কাছে কাল থেকে সে কুস্তি শিখবে। পিন্টু যদি তাকে মারতে আসে, এবার এমন একটা ঘুসি দেবে তাকে যে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে শয়তানটা।
বাবার যদি অনেক টাকা থাকতো, তাহলে ভাবনা ছিল না। আনু স্পষ্ট বুঝতে পারে, তার বাবার টাকা নেই, মা তাই চাচার কাছে যেতে বলছেন। চাচার কাছ থেকে টাকা আনবে বাবা? চাচা বোধহয় খুব রাগী। নইলে বাবা যেতে চাইলেন না কেন? মা অনেক করে বলতে তবে রাজি হলেন তিনি। আনু যেন বাবার সঙ্গে মিশে যায়। আনু বুঝতে পারে, বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবার যেতে ইচ্ছে করছে না। আনু যদি একলাফে বড় হয়ে যেতে পারতো, তো অনেক টাকা রোজগার করে ফেলত সে। পানু ভাই একটা চাকরি পেলেও হতো। তাহলে আর কোনো ভাবনা থাকত না। আনু বারবার পাশ বদলাতে থাকে বিছানায়, কুণ্ডলি পাকিয়ে শোয়, আবার পরক্ষণেই সোজা হয়।
বাবা ডাকেন, আনু, ও আনু।
তখন ঘোরটা কেটে যায় আনুর। বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। মা ও ঘর থেকে বলেন, কি হলো?
কিছু না, ছেলেটা কেমন কাতরাচ্ছে।
কপালে হাত দিয়ে দেখেন বাবা। না, জ্বর আসে নি। বাবা আবার ডাকেন, আনু, আনু রে।
আনু ঘুমজড়িত গলায় বলে, কী?
ও রকম করছিস কেন?
চুপ করে থাকে আনু।
আয় আমার সঙ্গে শুবি।
আনুকে প্রায় কোলে করে বাবা তার নিজের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেন। বলেন, খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? ভয় কিরে, এই তো আমি এ ঘরেই আছি।
একটু একটু হাসেন বাবা। আনুর তখন ভীষণ ঘুম পায়। বাবার হাতটা ধরে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে। একেবারে সেই ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে তার। সালু আপা বলে, আনু, আজ তোকে নিয়ে বাবা সিরাজগঞ্জে যাবে, চাচার কাছে।
আজ?
আনুর যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। বিছানা ছেড়ে ওঠে না। সালু আপা তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে, আমি মিথ্যে বলছি? যা মাকে জিগ্যেস কর। আমার বয়েই গেছে। গটগট করে বেরিয়ে যায় সালু আপা। তখন যেন বিশ্বাস হয় আনুর।
সেই আসা। আসবার উত্তেজনায় আনু ভুলেই গিয়েছিল বাবা কেন চাচার ওখানে যাচ্ছেন, কেন যেতে চাননি, তার যেতে ইচ্ছে করেনি।
সিরাজগঞ্জ বাজারে এসে ট্রেন থামলো। নামলো ওরা। মা এক বোয়াম মোরব্বা বানিয়ে দিয়েছিলেন চাচাঁদের জন্যে, আনুর হাতে সেটা। বাবা বললেন, সাবধানে আনু। বাড়ির কাছে এসে দেখিস ভাঙে না যেন।
আত্মীয়স্বজন বলতে কাউকে চেনে না আনু। বাবা কোনদিন কারো কথা বলেন না। এক মামা আছেন, তাও মা–র সৎ–ভাই। আনু শুনেছে, সৎ–ভাই নাকি খুব শয়তান আর হিংসুটে হয়। তাই তার বড় একটা টান নেই মামার ওপর। মিনু আপাকে সেদিন মামা নিয়ে গেল। ঘরে এসে মিনু আপা চোখ বড় বড় করে কত গল্প করল মামা বাড়ির, আশ্চর্য সব গল্প—- আনুর বিশ্বাস হতে চায় না।