আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমি কুস্তি লড়বো। গায়ে জোর করবো। শেখাবে তুমি?
হাঁ, খুব। লেকিন খোকাবাবু, খুব ফজরে উঠতে হবে, ফের কাচ্চা চানা খাইয়ে লড়তে হবে।
ইয়াসিন খুব খুশি হয়ে যায়। সে সবে, আনু দারোগা হবে, বড় সাহেব হবে, থানায় বসবে। তাই কুস্তি শিখতে চায়। সে বলে, ফের খোকাবাবু, আপনাকে ঘোড়ায় সোওয়ারি ভি শিখিয়ে দেব। এহি তো মরদ কা মাফিক কাম আছে। কেতাব ভি পড়বেন ই সব ভি শিখে লিবেন। হাঁ।
বলতে বলতে বাসার কাছে এসে যায় তারা। বাসার কাছে এসে হঠাৎ একটা দৌড় দেয় আনু। এক দৌড়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে বড় আপা বারান্দায় বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। তাকে দেখেই চিরুনি নামিয়ে উজ্জ্বল চোখ করে বললেন, এলি?
মা কোথায়?
বেড়াতে গেছে। তোর জন্যে দুধ–লাউ রেঁধেছি। মুখ ধুয়ে আয়। ইস্কুল কেমন রে?
আনু তার কোলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুলে-ওঠা গলায় বলে, এখানকার ছেলেরা এত খারাপ বড় আপা!
কেন, কী করেছে তারা?
খুব খারাপ। আমি কারো সঙ্গে মিশবো না।
আচ্ছা, আচ্ছা।
বড় আপা কোল থেকে ওকে নামিয়ে ওর রাঙা ক্লান্ত মুখখানা দেখেন।
০৪. এত সুন্দর দোতলা বাড়ি
এত সুন্দর দোতলা বাড়ি তার চাচার, যেন আনুর বিশ্বাসই হতে চায় না। আর কী চওড়া তকতকে সিঁড়ি। সারাদিন দৌড়ে দৌড়ে উঠেও ক্লান্তি হয় না আনুর। চাচাতো ভাই মনির তার বয়সী, তার সঙ্গে ভাব হয়ে যায় এক মিনিটে। মনিরের সঙ্গে ছাদে উঠে সে ঘুরে ঘুরে শহর দেখে।
বাবার সঙ্গে আনু বেড়াতে এসেছে তার চাচার বাড়িতে, সিরাজগঞ্জে। তার আপন চাচা নয়, বাবার চাচাতো ভাই। বাবা নাকি ছোটবেলায় মানুষ হয়েছে এই চাচার মায়ের কাছে।
এসব কিছুই জানতো না আনু। মহিমপুর থেকে রওয়ানা দেবার কদিন আগে শুনেছে। কদিন থেকেই মা বাবাকে বারবার বলছিলেন এখানে আসতে। বলছিলেন, যাও না একবার ছোট মিয়ার কাছে। হাজার হোক নিজের মানুষ, তার কাছে শরম কিসের?
বাবা প্রতিবাদ করেন, শরমের কথা না। সে বড়লোক মানুষ, আমি কোনদিনই তার সাথে বেশি ওঠ–বোস রাখিনি। পছন্দই করিনি এসব। আজ কোন মুখে যাই! আর গেলেই বা কি ভাববে বলো?
সন্ধ্যায় বাতি জেলে আনু পড়ছিল। বারান্দায় বসে গলা নিচু করে আলাপ করছিলেন বাবা আর মা। বাবা নামাজ পড়ে জলচৌকি থেকে আর ওঠেননি। মা থাম ধরে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আনু উৎকর্ণ হয়ে ওঠে তাঁদের চাপা গলায় আলোচনা শুনে।
ভাবাভাবি আর কি? মেয়েগুলো কত বড় হলো একেকজন? তুমি তো বাসায় থাকো না, থাকি আমি। জ্বালা হয়েছে আমার।
মার গলা বুঝি ধরে এসেছিল। বাবা বিব্রত হয়ে বললেন, আহা, সে তো বুঝলাম।
অনেকক্ষণ পরে মা বলেন, আনুকে নিয়ে তুমি একবার সিরাজগঞ্জে যাও। ভিক্ষে তো আর আমরা চাই না। আস্তে আস্তে শোধ করে দেব, বলবে।
আচ্ছা, দেখি।
বাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যায়। অস্পষ্ট একটা গুঞ্জন ধ্বনি ওঠে। আনু বুঝতে পারে বাবা দরুদ পড়তে শুরু করেছেন।
পড়ায় আর মন বসে না আনুর। জোর করে সে তাকিয়ে থাকে বইয়ের পাতার দিকে। অক্ষরগুলো যেন তার চোখ পোড়াতে থাকে। চোখে পানি এসে যায় তার। সে সচকিত হয়ে এদিক–ওদিক তাকায়।
ছোট দারোগার বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় তার। সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। তেমনি সারা গা গয়নায় মোড়া, মুখে পাউডার, ঠোঁটে পানের পাতলা লাল রং, পায়ে হিলতোলা সোনালি স্যাণ্ডেল। আনু উঠোনে গাঁদা ফুলের গাছগুলো বাঁশের চিকন বাতা দিয়ে ঘিরে দিচ্ছিল তখন।
বারান্দায় বসে বসে মা–র সঙ্গে গাল ঠেসে ঠেসে পান খেলেন ছোট দারোগার বউ। বললেন. বুবু, একটা কথা কই। মেয়েদের বিয়ে দেন নাই যে, শেষে মুখে না কালি দেয়। শুনে অপ্রতিভ হয়ে যান মা। আমতা আমতা করেন। কিছুই বলতে পারেন না। ছোট দারোগার বউ পিচ্ করে পানের পিক ফেলে আনুকে একবার আড়চোখে দেখে গলা নামিয়ে বলেন, কিশোরগঞ্জে দেখেছি, এক ডাক্তার, তার যোয়ান মেয়ে, আপনার বড় মেয়ের মতো, বাপ মা খায়দায়, মনে করে মেয়ে আমার এখনো বাচ্চা। সে সর্বনাশী বাড়ির চাকরের সাথে, বুবু, ঘর ছাড়লো একদিন, আমার চক্ষের সামনে।
আনু তখন ভারী অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কী একটা ছুতো খুঁজে সে বেরিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এ কথা শোনা তার ঠিক হচ্ছে না। ভীষণ রাগ হয় ছোট দারোগার বউয়ের ওপর। তার এত মাথাব্যথা কেন? সে বুঝতেই পারে না বড় আপা মেজ আপা এদের বিয়ে দেবার জন্যে সবাই এত ভাবনা করে কেন? এমন কি তার বাবা–মাও বাদ যান না। তবু তাদের কথা শুনে খারাপ লাগে না আনুর, যতটা খারাপ লাগলো ছোট দারোগার বউয়ের কথা শুনে। আর পিন্টুর কথাও মনে পড়ে।
মনটা কালো হয়ে যায় আনুর। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতের বেতটা দিয়ে ঝোঁপঝাড়গুলো পেটাতে থাকে। কচি কচি বুনো গাছগুলো ভেঙে গিয়ে ঝাপালো একটা গন্ধ উঠতে থাকে। গন্ধটা ভারী ভালো লাগে আনুর। সে আরো পেটাতে থাকে। নেশার মতো তাকে পেয়ে বসে গন্ধটা।
ইয়াসিন কোথা থেকে এসে বলে, খোকাবাবু, হুঁশিয়ার থাকবেন, ই সব জঙ্গলে সাপ ভি থাকতে পারে।
আরে বাপ।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় আনুর খ্যাপা হাতটা। মুখে বলে, যাঃ।
কিন্তু চোখ তার সন্ধানী আলোর মতো দ্রুত ঘুরতে থাকে, কী জানি সত্যি সত্যি যদি সাপ টাপ বেরিয়ে পড়ে।