ইদ্রিস বলল, চমৎকার দেশ।
হাজি সাহেব গলা সাফ করে বললেন, পছন্দ হয়েছে?
জি, হ্যাঁ।
জীবনে কত দেশ ঘুরলাম ডাক্তার, রংপুরের কাছে কোনটাই লাগে না। বিশেষ করে তিস্তা থেকে এই রাস্তাটা। পতিদহে গেলে আর ফিরে আসতে চাইবেন না আপনি।
পরিবেশ-শোভন হাসি ফুটে উঠল ইদ্রিসের ঠোঁটে।
হ্যাঁ, দেখে নেবেন। আমার জন্মভূমি বলে বলছি না, দেশ বিদেশ থেকে কতজন পতিদহে আমার গরিবখানায় এসেছেন। যাবার সময় সবাই বলে গেছেন, পতিদহের তুলনা হয় না।
সেই হাসিটা বিলম্বিত হলো ইদ্রিসের ঠোঁটে। সে ভাবলো তার নিজের গায়ের কথা। মাঠের কথা। বিরাট বিলের কথা। কালো অতল পানি তার। আড়াআড়ি পাড়ি দিতে সাহস হয়নি কোনো দিন কারো। একবার সে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে কী করে যেন গিয়ে পড়েছিল মাঝ বিলে। লোকে বলেছিল, জ্বীনে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মা কত দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করে দিয়েছিলেন।
ঝমঝম একটা শব্দে চমক ভাঙ্গলো ইদ্রিসের। বাইরে তাকিয়ে দেখে ধোঁয়া উড়িয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে মার্টিন কোম্পানির গাড়ি চলেছে কুড়িগ্রামের দিকে। খোলা বগিতে সার সার কালো মাথা দেখা যাচ্ছে। ছবির মতো মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে কত সুন্দর দৃশ্য আছে দেখার, তার কিছুই সে দেখেনি।
পর মুহূর্তেই সচকিত হয়ে উঠল ইদ্রিস। এই ভোলা গাড়ি আবার সেই তর্কের তিক্ত স্মৃতিটা ফিরিয়ে এনেছে। আড়চোখে সে তাকাল হাজি সাহেবের দিকে।
হাজি সাহেব বললেন, ডাক্তার, এবার দিল্লিতে গিয়ে কথা প্রায় পাকা করে এসেছি।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ইদ্রিস।
হাসলেন হাজি সাহেব। বললেন, এ লাইট রেলওয়ে আর বেশি দিন নেই। মিটার গেজ বসলো বলে। তখন তিস্তা কুড়িগ্রাম করবেন ট্রেনে দুবেলা। খোদ ভাইসরয়ের কানে তুলে। দিয়েছি। জানেন তো ইংরেজের জাত সে এক আজব চীজ। কথা মনে ধরল তো কাজের হুকুম সঙ্গে সঙ্গে। হুকুম হলো তো কাজ হয়ে গেল চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে। এই জন্যেই সান নেভার সেটস ইন ব্রিটিশ এম্পায়ার। আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে ইংরেজের কাছ থেকে।
আপন মনে কথা বলে চলেছেন হাজি জয়েনউদ্দিন। তার কিছু কানে যাচ্ছে ইদ্রিসের, কিছু যাচ্ছে না। সে ভাবছে তার ভবিষ্যতের কথা। কোথায় চলেছে, কী হবে, এই সব সাত সতেরো। ছেলেবেলা থেকেই মনের মধ্যে বড় হওয়ার সাধ, কিন্তু কী করলে বড় হওয়া যায় শুধু সেইটাই জানা নেই।
পাশ করবার পর গ্রামে ফিরে যাবার সময় প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, কলকাতায় থাকলেই বড় হওয়া যায় না। যে বড় হবার গায়ে থেকেও হতে পারে।
কথাটা নতুন করে মনে পড়ল ইদ্রিসের। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব নিজে যখন তাকে পতিদহে পাঠাচ্ছেন তখন তার আর দ্বিধা করবার কী আছে? দেখাই যাক না, ভাগ্য তাকে আর কতদূরে নিয়ে যায়, আর কত ভেলকি দেখাতে পারে ভাগ্য সেইটে এবার পরখ করবে ইদ্রিস।
ঢুলুনিতে সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসছিল। এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল ইদ্রিস। হাজি সাহেব তার অনেক আগেই কান্ হয়ে পড়েছেন। মিহি সুরে নাক ডাকছে তার এক পয়সার বাঁশির মতো। ইদ্রিসের আর এখন রাগ হয় না, হাসি পায়। ট্রেন ফেলে পালকি চড়াটা পরম একটা পরিহাসের বিষয় মনে হয় তার। একটু যেন করুণাও হয় তার। সেই করুণা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ঘুম ভাংগে রাজার হাটের কাছে এসে। ঈদগাঁর পাশে বড় বড় কটা কদম গাছ। তারই ছায়ায় পালকি নামানো হয়েছে। বিশ্রাম নিচ্ছে বেহায়ারা। রান্না চড়েছে।
অনেকক্ষণ পালকিতে বসে থেকে পা ধরে গিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত বেড়িয়ে এলো সে। ঈদগা পেরিয়ে টিনের চালায় মাদ্রাসা। মাদ্রাসার পেছনে আম বন। আম বনের তলা দিয়ে ছায়াঢাকা পথ গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। পথের পাশে মুদি দোকান। বাতাসা কিনছে পেট বড় ন্যাংটো কয়েকটা ছেলে। একজনের হাতে একটা শালুক ধরা। শালুকটা নেতিয়ে পড়েছে।
এই ছেলে তোর নাম কী?
ছেলেটা চমকে ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে তার দিকে তাকায়। তারপর ঝেড়ে দৌড় দেয় গায়ের দিকে। চিৎকার করে ডাকে—- চাচা গো। হা হা করে হাসে ইদ্রিস।
ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে ছেলেটার হয়েছে কী?
আরো খানিকটা এগোয়। দেখে জলার ওপরে মেলা শালুক ফুটে রয়েছে। ছেলেরা মাছ ধরছে গামছা পেতে। খিলখিল করে হাসছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কালো কালো মোটা কতগুলো শোল হুটোপাটি করছে জলায়।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের মাছধরা দেখল ইদ্রিস। মাছধরা তো নয় এ যেন পানি ছোঁড়াছুঁড়ির মহোৎসব। আহা, ভারী ঠাণ্ডা নিশ্চয়ই জলার পানি। সবুজ লালা ঘাসে হেলে দুলে নাচছে গলা পর্যন্ত সে পানিতে ডুবে। ইদ্রিস যদি গোসল করতে পারত, ভারী ভালো লাগত। হুস হুস হুস হুস শব্দ ওঠে। ছেলেরা কান খাড়া করে দাঁড়ায়। হাতের গামছা হাতে থেকে যায় তাদের। তারপর একসঙ্গে ছুটতে থাকে সবাই একদিকে।
ঐ তো মার্টিন কোম্পানির ট্রেন দেখা যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে এলো যাত্রী নিয়ে। হাসি পায় ইদ্রিসের। দ্যাখো কাণ্ড, তারা এখনো রাজার হাটই ছাড়াতে পারল না, আর ওরা কুড়িগ্রাম ছুঁয়ে ফের তিস্তায় চলেছে। হাজি জয়েনউদ্দিনের মাথায় বোধ করি ছিট আছে।
কতদিন এ রকম প্রশান্ত স্বচ্ছন্দ মন নিয়ে ইদ্রিস মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতে পারে নি। আজ এত ভালো লাগছে যে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এইখানে জলার ধারে হেলে পড়া বাবলার ছায়ায় সারাজীবন বসে থাকে সে।