- বইয়ের নামঃ শামুকখোল
- লেখকের নামঃ তিলোত্তমা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. অতএব, মৃত্যুকেই সে মনস্থ করল একসময়
অতএব, মৃত্যুকেই সে মনস্থ করল একসময়। জীবনের পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে যা কিছু সম্ভাব্য উপায়ের কথা তার স্মরণে এসেছিল, তার মধ্যে, মৃত্যুই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং মহান। যদিও মৃত্যুকে একমাত্র কল্পনা দ্বারাই অনুভব করা যায়। কেন-না মৃত্যুর আগমন সঙ্কেত কখনও পৌঁছলেও সেই মুহূর্তে মানুষকে আদ্যন্ত যা আলোড়িত করে তার নাম জীবন। এমনকী মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিসমূহ, একেবারে কীটাণুকীট পর্যন্ত এই বোধের অন্তর্গত। সকলকেই ত্রস্ত করে জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা।
তবু, মৃত্যুকেই মনে হয়েছিল তার, এক নিরপেক্ষ আশ্রয়। কিংবা, হতে পারে, মৃত্যু এক নারী, যার ক্রোড়ে কোনও পক্ষাবলম্বন থাকে না, থাকে না কোনও প্রতারণা। এমনটা ভেবেছিল সে। কিংবা অনুভব করেছিল অন্য অনেকের মতে, যারা জীবন সম্পর্কে ক্রমশ হয়ে ওঠে নির্মোহ এবং মৃত্যুর ওপর আস্থাশীল।
জীবন পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই, অন্তত বয়ঃক্রমের প্রাকৃতিক সম্পূর্ণতার আগেই, মৃত্যুকে আরাধ্য করাই মনস্থ করে যারা, তাদের জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে গুরুত্বে ভারসাম্যহীনতা লক্ষ করা যায়। যা কিছুই ঘটল, কোনও কিছুই, হৃদয়ে ঘটিয়ে দিল অসহায় উন্মাদ ধাক্কা—একজন তার সম্পর্কে ভাবতে পারে—হয়, এমন হয়, জীবন মানেই সুখ-দুঃখের গলাগলি, আনন্দ ও যন্ত্রণার সহাবস্থান। অতএব, থামা যাবে না, চলতে হবে। আর একজন ভাবতে পারে বিপরীত। ভাবতে পারে, এ-দুঃখ সহনীয় নয়। ভাবতে পারে, এমনটা ঘটলে জীবন থেমে থাকে নিরবধিকৃত। প্রাণ গড়িয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। এবং তারা মৃত্যুর আরাধনা করে। অতএব, দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে ঘটনার লঘুত্ব বা গুরুত্ব। দর্শনের ওপর নির্ভর করে, ঘটনার অভিঘাতে, পরবর্তী পর্যায় হিসেবে জীবন আরাধ্য হবে, না মৃত্যু।
মৃত্যুকে মনস্থ করার নেপথ্য কারণ হিসেবে স্পষ্টভাবে সে এক নারীকেই নির্বাচিত করেছে। সেই নারীর প্রতি ঘৃণা, যা তাকে প্ররোচিত করেছে এমনই ভাবতে যে পৃথিবীর সমস্ত নারীই ঘৃণ্য। কিন্তু ভাবনার প্রসার ঘটালে সে দেখতে পেত তার চারপাশের আরও অনেক দৈন্যকেও। হয়তো সে জানে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। কেন-না নিজস্ব দৈন্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে থাকে অক্ষমতাও। অক্ষমতাকে স্বীকার করে নিতে নিরন্তর অসুবিধা, কারণ নিজের মধ্যে প্রতিপালন করা অহং ও সান্ত্বনা তাতে ক্ষুন্ন হয়ে থাকে। সে-ও জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিতৃষ্ণার প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে গেছে নারী। যেনারী তার অন্তঃস্থ হয়ে অংশ নিচ্ছে। ভাবনায়। যেনারী তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে নিরবধিকাল। যেনারীকে সে ঘৃণা করেছে আদ্যন্ত। অথচ ভেবে ভেবে এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হল একরকম। মৃত্যু নারী। এবং মৃত্যুর কোনও প্রতারণা নেই।
এই বিশ্বাসে দীক্ষা নেওয়া ছাড়া তার অন্য উপায়ও ছিল না, কারণ, আজকাল বহু সম্পর্কের বহু নারীকে সে কখনও সুবর্ণমণ্ডিত দেখেনি। দেখেনি নির্ভেজাল। দেখেনি সরল, নিপাট—যেমন তাদের দেখলেই মনে হয়। নারীকে সে দেখেছে প্রতারক। জেনেছে, অনুভব করেছে, প্রতারক। নারী প্রতারক। নারী লোভী। মিথ্যাচারী। কিন্তু তার যুক্তিবোধ কোনও ব্যতিক্রমকে সামনে রাখতে চায়। কেন-না সাধারণের ব্যতিক্রম সাধারণকে প্রতিষ্ঠিত করে। অসত্যে পরিপূর্ণ, মিথ্যার ব্যাধিগ্রস্ত, ঘৃণ্য নারীকুলকে সে, অতএব, প্রতিষ্ঠা করে এই বলেই যে মৃত্যু নারী, এবং মৃত্যুর মধ্যে কোনও অসত্য নেই, মিথ্যা নেই, কোনও প্রতারণা নেই। মৃত্যু অমোঘ, সুন্দর মহান। কিন্তু সহজ নয়।
হ্যাঁ, মৃত্যু সহজ নয়। মৃত্যুকে গভীর আগ্রহে ও নির্ভরতায় গ্রহণ করার পরও তার মনে হয়েছে, মৃত্যু সহজ নয়। দোষ যদি থেকে থাকে কিছু আদৌ, এই মৃত্যুর, তা হল তার সহজ না থাকাই। অথচ, মনের গভীরে, পরম মমতায়, এইটুকুর জন্য সে দায়ী করে জীবনকেই। যেন কারওকে মৃত্যুর কাছে হস্তান্তরিত করা হবে কিনা এ বিষয়ে মৃত্যুই নেয় না শেষ সিদ্ধান্ত। নেয় জীবন। শেষ সিদ্ধান্ত নেয় জীবন, কেন-না জীবন পক্ষপাতী বলে, পক্ষপাতদুষ্ট বলে, নিরপেক্ষ নয় বলেই, যখন-তখন মৃত্যুর হাতে তুলে দেয় সেই সব মানুষকে, যে মৃত্যুকে কামনা করেনি। যে সর্বাঙ্গীণ কামনা করেছে জীবনকে। মৃত্যুবাসনা যে আদৌ সম্ভব তা সে কল্পনাও করে না। এমন মানুষ, হয়তো তার সংসারের প্রতি দায়িত্ব অসীম। হয়তো, যে মারা গেল, তার না থাকায়, অন্যান্য প্রাণীর অন্নজল এক সমস্যার কারণ হল। কিংবা কোনও শিশু, যে সবেমাত্র পৃথিবীতে জীবনের অধিকার বুঝে নিতে শুরু করেছে, জীবনকে যে জানে মাত্র ললিপপ, মাত্র ক্যাডবেরি, রঙিন কাগজের ফুল ও সাদা পাতায় হাতের লেখা ভরিয়ে তোলা, জানে বাবা ও মায়ের মাঝখানে শুয়ে স্বপ্নের ও নির্ভরতার ঘুম। জীবন তাকেও অনায়াসে তুলে দেয় মৃত্যুর হাতে। স্তব্ধ করে দেয় মুখর বাণী যত। ঘুম পাড়িয়ে দেয় চিরঘুমে। এবং, এই জীবনই কোনও মেয়ের গায়ে ঢেলে দেয় কেরোসিন। গ্যাসের সিলিন্ডার খুলে আগুনে জড়িয়ে ফেলে দেহ, যেদেহের সুস্নাত ও সালংকারা হয়ে প্রেমস্নিগ্ধ আঙুলের স্পর্শ পাবার কথা।
কিংবা, সেই স্বাস্থ্যবান যুবক, যাকে দেখলে তার দেহের অন্তঃস্থ যন্ত্রসমূহের সামান্য বৈকল্যের অনুমান করা অসম্ভব, সে এক সন্ধ্যায় ভূগর্ভস্থ পথ দিয়ে হেঁটে চলেছিল রেলস্টেশনের দিকে। শহরের বৃহত্তম রেলস্টেশনটি তার গন্তব্য ছিল না। রেলমাধ্যমে সে যেত দুরান্তরে, কোনও নিকট বন্ধুর বাড়ি। তার সঙ্গে ছিল কাগজপত্র। অফিসের কাগজপত্র। আর অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন-চিঠি। তার প্রথম ও একমাত্র সন্তানের অন্নপ্রাশনে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করতে চলেছিল সে। তার প্রাণে আনন্দ ছিল। তৃপ্তি ও উচ্চাশা। স্বপ্নে পরিপূর্ণ ছিল তার মস্তিষ্ক। এমতাবস্থায় ভূগর্ভস্থ পথে চলতে চলতে হঠাৎ তার শরীর কিছু দুর্বলতা বোধ করে, অসম্ভব স্বেদ নেমে আসে প্রতিটি স্বেদগ্রন্থি থেকে। সে ভাবে, ভূগর্ভস্থ পথে এ কোন বাড়তি উষ্ণতা। কিন্তু সেই উষ্ণতা তাকে ছাড়া অন্য কারওকে বিচলিত করেনি। তার নিজেকে অশক্ত লাগল তখন। সুবেশ, স্বাস্থ্যবান যুবক, স্বপ্নিল যুকক তখন দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়। ততক্ষণে তার বুক থেকে পিঠ বেয়ে, বাঁ হাত বেয়ে নেমে আসছে তীব্র যন্ত্রণা, তার দম ফুরিয়ে আসছে, তখনও, সেই মুহূর্তেও তার বিশ্বাস—ভূগর্ভস্থ পথে অক্সিজেনের অভাব ঘটে থাকবে যা তাকে কিছু অস্বস্তি দিচ্ছে। সে তার হাতের ছোট ব্যাগটি নামিয়ে রাখল ভুয়ে। নামানোর জন্য নিচু হল, তার ওই নিচু অবস্থাতেই দুমড়ে গড়িয়ে পড়ল স্বয়ং। ভূমি থেকে সহস্র মানুষের পদধূলি লেগে গেল তার অসহায় সুবেশে। আর জীবনের হাত থেকে সে অন্তরিত হয়ে গেল মৃত্যুর হাতে। চাইল না—তবু। জানল না—তবু। কোনও প্রয়োজন ছিল না কোথাও–তবু।