কী ব্যাপার?
রান্না হয়ে গেছে। হুজুর আপনার জন্যে বসে আছেন।
তাই তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সেই সময়ে একটা কুকুর কেঁদে উঠল কোথাও। গা–টা শিরশির করে উঠল তার। অকারণে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিয়ে করতে বেরুবার সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়েছিল সে। অর্থহীন এই মনে পড়া।
দূর, দূর।
কিছু বললেন?
হুকুমবড়দার প্রশ্ন করল।
না, কিছু না। চলো।
এসে দেখে, হাজি সাহেব জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ছেন। পাশে খাবার সাজানো। ধোঁয়া উঠছে গরম ভাত থেকে। সে বলল, এখানে পানি কোথায়? আমিও নামাজ পড়ে নি। সালাম ফিরিয়ে হাজি সাহেব বললেন, কোথায় ছিলেন? আপনাকে না দেখে জামাতের জন্যে আর দেরি করলাম না।
ভারী লজ্জিত হলো ইদ্রিস। সে এককোণে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে শুরু করে দিল।
২. ভোরে উঠে দেখে প্ল্যাটফরমে
ভোরে উঠে দেখে প্ল্যাটফরমে আট বেহারার পালকি দাঁড়িয়ে আছে। জামাতে নামাজ আদায় করে নাশতা করে নিল ওরা। হাজি সাহেব বললেন, কুড়িগ্রাম পৌঁছে যাবো বিকেল চারটে নাগাদ। পতিদহে পৌঁছতে রাত দুপুর হয়ে যাবে।
ইদ্রিস শুনেছিল পতিদহ অনেক দূরে। ব্যাকওয়ার্ড প্রেস যাকে হাজি সাহেব বলেছিলেন। এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পেল সে।
স্টেশনের ওপাশে এসে সে দেখল লাইট রেলওয়ের যাত্রীরা জটলা করছে। খেলনার মতো খোলা বগি আর এই এতটুকুন ইঞ্জিনটা দাঁড়িয়ে আছে।
এ গাড়ি কোথায় যায়?
কুড়িগ্রাম।
অবাক হলো ইদ্রিস। কুড়িগ্রাম যায়! তবে যে হাজি সাহেব পালকি আনিয়েছেন! ব্যাপারটাই কেমন গোলমেল মনে হলো তার। একজন যাত্রীকে আবার শুধালো, কুড়িগ্রাম যায় এ গাড়ি?
হা।
জিগ্যেস করে জানতে পারলো, যাত্রী আর কিছু হলেই গাড়ি ছাড়বে। কুড়িগ্রাম পৌঁছে যাবে দুপুর নাগাদ।
দ্রুত পায়ে হাজি সাহেবের কাছে এসে ইদ্রিস বলল, আমরা ট্রেনে যাচ্ছি না কেন?
কোন্ ট্রেন? ঐ যে খোলা বগি, ওতে?
অবজ্ঞা এবং অনুকম্পা মেশানো গলায় হাজি সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
জি। ওরা বলছে এ গাড়ি নাকি দুপুর নাগাদ কুড়িগ্রাম পৌঁছে যাবে।
তা যেতে পারে।
তাহলে পালকিতে খামোকা দেরি করে লাভ কী?
হেসে ফেললেন হাজি সাহেব। বললেন, ডাক্তার, সময়টাই শুধু দেখলেন, আর কিছু চোখে পড়ল না আপনার?
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইদ্রিস।
হাজি সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন হঠাৎ? বললেন, ঐ খোলা গাড়িতে যেতে বলেন আমাকে?
কেন, দোষ কী?
কী, বলছেন কী আপনি?
নিজেকে সংযত করে ফেললেন পতিদহের বড় তরফ হাজি জয়েনউদ্দীন, ভাইসরয় কাউন্সিলের মেয়র। আবার হাসলেন। পিঠে একটা মৃদু থাবড়া বসিয়ে দিলেন ইদ্রিসের। বললেন, সবার পক্ষে ও গাড়িতে সোয়ার হওয়া সাজে না। হলোই বা দু ঘণ্টায় পৌঁছে যাবো। তাতে কী? খোলা বগিতে কাঠের বেঞ্চে বসে সাধারণ মানুষের সাথে গা ডলতে ডলতে তাড়াতাড়ি পৌঁছুনোর বদলে পালকিতে তিনদিন লাগলেও তা ভালো। বুঝেছেন ডাক্তার?
যুক্তিটা কিছুতেই বুঝতে পারল না ইদ্রিস। কোথায় যেন খটকা লাগছে তার। কলকাতায় মানুষটাকে যেমন মনে হয়েছিল ঠিক তেমনটি মনে হলো না এখন। কৃষক নেতা ফজলুল হকের সঙ্গে ওঠবোস করেন, গায়ের লোকের সুবিধের জন্যে দাঁতব্য ডিস্পেন্সারি খুলেছেন, তার মুখে এ কথা শুনতে হবে এ আশা করেনি ইদ্রিস।
ইদ্রিসের একরোখা স্বভাবটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে বলল, তাই বলে সুবিধের কথা ভাববেন না?
কিসের সুবিধে?
তাড়াতাড়ি পৌঁছুচ্ছেন। তাছাড়া মিটার গেজ ব্রড গেজের গাড়িতে তো চড়েন না এমন নয়। লাইট রেলওয়েতে আপার ক্লাশ নেই দেখছেন না।
ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়িয়ে রইল ইদ্রিস
হাজি সাহেব বললেন, কী তৰ্কই করবেন, না পালকিতে উঠবেন? অনেকটা পথ যেতে হবে। ইদ্রিস ভাবলো, কাজটা বোধ হয় সে ভালো করছে না। যার চাকরি করতে যাচ্ছে তার সঙ্গে তর্ক করাটা অন্যায় হচ্ছে। কী দরকার তার এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে। সে যখন পতিদহে যাবে বলেই কলকাতা থেকে পা বাড়িয়েছে, তখন আর পালকি বা লাইট রেলওয়ের প্রশ্ন তোলা কেন? তার পৌঁছুনো দিয়ে কথা।
তবু মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে লাগল। হাজি সাহেবও গম্ভীর হয়ে গেছেন। তার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মুখটা থমথম করছে বোশেখ মাসের হঠাৎ মেঘের মতো। হাজি সাহেবের পেছন পেছন সেও পালকিতে গিয়ে উঠল। পালকিতে চড়ার অভ্যেস নেই। উঠতে গিয়েই মাথায় একটা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল দরোজার সঙ্গে। কপালে হাত বুলোতে বুলোতে ইদ্রিস এক পাশে পা ভাঁজ করে বসলো।
দুলে উঠল পালকিটা। তারপর আট বেহারার হুমহাম কোরাসের তালে তালে চলতে লাগল কুড়িগ্রামের দিকে।
এই ইঞ্জিনের পানি খাবার কল পেরুলো . সিগন্যাল পেরুলো। চৌবাচ্চার পাশ দিয়ে প্রাইমারি স্কুলের সমুখ দিয়ে, গায়ের ভেতর দিয়ে পাকি গিয়ে মাঠে পড়ল।
ভোরের রাঙা আলো আস্তে আস্তে সোনার মতো হয়ে গেল। উজ্জ্বল সূর্যালোকে খেতখামার যেন হাসতে লেগেছে। ঘাসের ওপর, ফসলের ডগায়, পথের পাশে বুনো ফুল আর কন্টিকারির ঝোঁপের মাথায় শিশির দেখা যাচ্ছে এখনো। একটু পরে আর থাকবে না। রোদ টেনে নেবে সব সিক্ততা। ইদ্রিসের মনে পল এই তো সেদিনও গাঁয়ের বাড়িতে শিশির ভেজা মাঠে খালি পায়ে হেঁটেছে সে। খালি পায়ে ভোরের শিশির লাগলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। মনটা প্রসন্ন হয়ে এলো ইদ্রিসের। একটু আগে হাজি সাহেবের সঙ্গে তর্ক করে মনটা অস্বস্তিতে ভরে ছিল। শিশিরের মতোই সে অস্বস্তিটুকু একেবারে উবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।