ইদ্রিস জবাব দিয়েছিল, ওঁর ছাত্র ছিলাম। ওঁর সঙ্গেই আছি।
বেশ, বেশ। তা একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন? বলবেন পতিদহের হাজি সাহেব এসেছেন।
সেকেণ্ড ইয়ারের একটা ছেলে তখন বসেছিল। সে বলল, আমি স্যারের বাসায় যাচ্ছি খবর দিতে।
হাজি সাহেবের নাম শুনে তখুনি এলেন ডাঃ খান। হাজি সাহেব তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে দুজনে মোসাফা করলেন। কুশল বিনিময় হলো। সারাক্ষণ সসম্ভ্রমে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো ইদ্রিস। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে অতিথি সাধারণ কেউ নন এবং প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাঁকে অসীম শ্রদ্ধাভক্তি করেন।
হাজি সাহেব বললেন, সময় কম। কথাটা বলেই ফেলি। আমার একজন ডাক্তার দরকার।
ডাক্তার দিয়ে কী করবেন?
লোকে ডাক্তার দিয়ে কী করায় শুনি, আঁ?
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব লজ্জিত হেসে বললেন, তাতো বটেই।
হ্যাঁ, একজন ডাক্তার আমাকে দিতে হবে। কাছারি বাড়িতে দাঁতব্য ডিস্পেন্সরী খুলেছি। জানেন তো, এলোপ্যাথি আমার দুচোখের বিষ। আর হোমিওপ্যাথির ভক্ত হলাম তো আপনার জন্যেই। আপনাকে পতিদহে নিয়ে যাই এতবড় সৌভাগ্য আমার হবে না। তাছাড়া কলকাতায় আপনার কলেজ আছে, ছাত্র তৈরি করছেন; পতিদহে চেরিটেবল ডিস্পেন্সরীর মেডিক্যাল অফিসারের চেয়ে এ অনেক বড় কাজ। আপনার কোনো পাশ করা ভালো। চরিত্রবান ছাত্র থাকলে তাকে সাথে করেই নিয়ে যেতাম।
একই সঙ্গে দুজনের চোখ পড়ল দুজনের দিকে। ইদ্রিস আর প্রিন্সিপ্যাল খান। ইদ্রিস চোখ নামিয়ে নিয়ে সরে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব কুঞ্চিত করে ভাবতে লাগলেন।
কী, আছে তেমন কেউ?
প্রশ্ন করলেন হাজি সাহেব।
ভাবছি।
সাথে করেই নিয়ে যাবো। কাল থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট। থাকা–খাওয়া ফ্রি। মাইনে দেবো চল্লিশ টাকা।
হুঁ।
অবশ্য পতিদহ বড় ব্যাকওয়ার্ড জায়গা। সে কথাটাও পরিষ্কার বলা ভালো। সেই জন্যেই চল্লিশ টাকা দিচ্ছি। ডাক্তার হলেই শুধু চলবে না, দেশ গাঁয়ের মানুষকে ভালোবাসে, আল্লা রসুলের পাবন্দ এমন ছেলে চাই। আর জানেন তো, দিতে আমি কার্পণ্য করি না। নিজের ছেলেপুলে নেই। এই নিয়েই থাকি। পতিদহে গেলেই যে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এমন নয়। আমিও তার ভবিষ্যৎ দেখব।
সে আমি জানি। জানি বলেই ভাবছি, কাকে দেওয়া যায়।
হাজি সাহেব বসে বসে তার দাঁতব্য ডিস্পেন্সারীর বর্ণনা দিতে লাগলেন। বললেন, ওষুধপত্তর যা দরকার হবে তারও একটা লিস্ট চাই। সাজসরঞ্জামেরও।
ডাঃ খান ইদ্রিসকে ডাকলেন। বললেন, পতিদহে যাবে?
ইদ্রিস কোনো উত্তর দিল না। এ রকম আকস্মিক প্রশ্নের উত্তর চট করে তার মাথায় এলো না। যখন বুঝল হাজি সাহেবও তাকিয়ে আছেন তার দিকে, তখন উত্তর না দেয়াটা অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছে বিবেচনায় সে বলল, আপনি বললে নিশ্চয়ই যাবো স্যার।
তখন ডাঃ খান হাজি সাহেবকে বললেন, ওর সামনে বলেই বলছি না। আমার কলেজ থেকে এরকম ছেলে বেরোয়নি। ওর চেয়ে যোগ্য আর কাউকে দেখি না। শুধু গরিব বলে এতদিন কিছু করতে পারে নি, আমার এখানেই পড়ে আছে। আপনি সুযোগ দিলে ওর একটা বড় উপকার হয়।
হাজি সাহেব তখন ইদ্রিসের নাম পরিচয় জিগ্যেস করলেন। তারপর হাজি সাহেব ডাঃ খানকে বললেন, ওষুধপত্র যা যা লাগে আর সাজ–সরঞ্জাম আপনিই দিয়ে দিন।
কিন্তু আজ রাতের ভেতরে তো সব তৈরি হয়ে উঠবে না। তাছাড়া কলকাতায় এসেছেন আমার গরিবখানায় দাওয়াত কবুল করবেন না, সে হতেই পারে না।
বেশ তো। কাল সকালের মেলে যাতে রওয়ানা হতে পারি সে রকম ব্যবস্থা করে নি। আমি এখন বেরুচ্ছি। ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।
সেখানে গেলে কি আর রাতে আমার গরিবখানায় আসতে পারবেন?
খুব পারবো। রাত দশটা হোক এগারোটা হোক আসবোই। আর ডাক্তার– ইদ্রিসকে লক্ষ্য করে হাজি সাহেব বললেন, আপনি তৈরি হয়ে নিন। যা যা লাগে সব দেখে শুনে নিন। এখন তো আপনি আমারই লোক। ভালো কথা, বিশটা টাকা রেখে যাচ্ছি। নিজের কিছু কেনাকাটা থাকলে এ থেকে করে নেবেন।
আপত্তি করাবার আগেই দশ টাকার নোট দুটো তিনি গুঁজে দিলেন ইদ্রিসের হাতে।
তিনি চলে গেলে ইদ্রিস ডাঃ খানকে বলল, স্যার!
কী?
কিছু বলতে পারল না ইদ্রিস। অনেকক্ষণ পরে শুধু উচ্চারণ করল, কিছু না স্যার।
হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফরমের শেষ মাথায় চলে গিয়েছিল ইদ্রিস। সেখানে কাঠের ফলকে বড় বড় করে নাগরী, বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা তিস্তা। অনেকক্ষণ যেন বোধগম্য হলো না, এ কোথায় আছে সে? তিন ভাষাতেই লেখাটার আলাদা আলাদা অক্ষর পড়ল সে। তারপর সম্মুখে তাকিয়ে দেখল অন্ধকারে মাটির ওপরে লাল একটা বড় তারা যেন নেমে এসেছে। তিস্তা ব্রীজের ওপর জ্বলছে লাল বাতি।
হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ করে। একটু ঠাণ্ডা করছে। মাথার চাঁদিতে হাত দিয়ে দেখল হিমে বরফ হয়ে আছে চুলগুলো। সে ফিরল।
প্ল্যাটফরমের এক কোণায় বেহারি কুলিরা বসে জটলা করছে। পিঠের সঙ্গে ভাঁজ করা হাঁটু গামছা দিয়ে বাঁধা। চমৎকার একটা ছবি বিশ্রামের। একজন হেড়ে গলায় চোখ বুজে গান করছে। বাকি সবাই শুনছে তন্ময় হয়ে। তার সে উচ্চ কণ্ঠ বহুদূর পর্যন্ত শোনা যেতে লাগল।
সব কিছু কেমন আপন মনে হতে লাগল ইদ্রিসের।
সে দূরে দাঁড়িয়ে গান শুনলো খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ দেখল হাজি সাহেবের হুকুমবরদার যেন অন্ধকার ফুড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।