কিন্তু আমাদের সময়ে তো এরকম ছিল না স্যার?
ছিল না, তখন দুদিনের জন্য একটা উদ্দীপ; এসেছিল মুসলমান সমাজে। নেতাই নেই তো সে উদ্দীপনা টিকিয়েই রাখবে কে আর তা কাজেই বা লাগাবে কে? মুসলমান লেখাপড়া করে, টাকা করে, ভেতরে কিছু পার্টস থাকলে সমাজের কাজে তা না লাগিয়ে গভর্ণর ভাইসরয়ের নেকনজরে পড়বার জন্য ঝুলোঝুলি কামড়াকামড়ি লাগিয়ে দেয়। মেম্বার হয়, কাউন্সিলর হয়, করদ রাজ্যের দেওয়ান হয়। এই তো অবস্থা।
এত কথা ইদ্রিস আগে কখনো ভাবে নি, চোখেও পড়েনি তার। গুম হয়ে বসে থাকে সে। পায়ের নিচে যেন মাটি দেখতে পায় না। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলে চলেন, ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। দেখি কী হয়? এদিকে আমার বইগুলোরও সেই এক দশা। মুসলমানের বই পড়ে ডাক্তার হওয়া যায় কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চায় না। কলকাতায় এতগুলো হোমিওপ্যাথির দোকান, কোন একটা দোকান আমার বই রাখতে রাজি হলো না। একবার ভেবেছিলাম সীজন টিকেট করে নিজেই সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াবো, বই ক্যানভাস করব। তা শরীরে কুলোয় না। ইচ্ছে পর্যন্তই, কিছু করতে পারলাম না।
এ যেন এক অন্য মানুষ। এ মানুষকে ইদ্রিস আগে দেখেনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, সত্যি বুড়ো হয়ে গেছেন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব। মুখের চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে। দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে চোখ কুঁচকে তাকান। হাত কাঁপে। গায়ের জামাটাও নুন ময়লা, এখানে ওখানে জ্যালজেলে হয়ে পড়েছে, একটু টান লাগলেই ছিঁড়ে যাবে। অথচ এই প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে সে দেখেছে ধবধবে ধোয়া দুধের মতো শাদা টুইলের শার্ট পরতে, তাতে রূপোর বোতাম লাগানো। তার অনুকরণে ইদ্রিসও টুইলের শাদা শার্ট পরতে শুরু করে দিয়েছিলো। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের চেহারা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে বেরুতো। সে আলো আজ নেই। সারারাত জ্বলবার পর নিভে যাওয়া অপরিচ্ছন্ন সলতের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
ইদ্রিস মাথা নিচু করে রইলো।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শেষ অবধি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মুখে বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে বললেন, থেকে যাও আমার এখানেই। আমি তো কিছু দিতে পারবো না। সে সামর্থ্য নেই। আগের মতো খাবে–পরবে, বাড়ির ছেলের মতো থাকবে।
সেই আমার যথেষ্ট স্যার।
তবু বলি, তোমার মতো গুণী ছেলেকে এভাবে নষ্ট হতে আমি দেখতে পারবো না। সুযোগ পেলে সুযোগ ছেড়ো না, এই একটা উপদেশ তোমাকে দিই।
যে আঘাত ইদ্রিস পেয়েছে তার ফলে মনটাই যেন অসাড় হয়ে গেছে তার। নিজেকে নষ্ট করেছে কী করছে না সে উপলব্ধিটুকু ধরে এমন মন তার আর নেই।
সে বলল, আপনি যদি কখনো কোথাও সুযোগ করে দিতে পারেন তো না হয় যাবো। আমার এমন পয়সা নেই যে নিজে প্র্যাকটিসে নামতে পারি আর আপনার কাছে যদি না থাকতে পারি তো কলকাতাতেই থাকবো না।
থাকো কিছুদিন। দেখি কী হয়।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঐ রকম মানুষ। দেখি কী হয় বলা যেন তার মুদ্রাদোষ। ইদ্রিস জানে, তাকে পেয়ে তিনি খুশিই হয়েছেন। এই ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে তার কাছে থাকতে পেরে সে নিজেও কৃতার্থ বোধ করছে। তাকে সে শুধু শিক্ষক হিসেবেই দেখেনি, দেখেছে পিতা হিসেবে, প্রাণদাতা হিসেবে, তার স্বপ্ন সফলের পেছনে সবল বাহু হিসেবে।
রয়ে গেল ইদ্রিস। সকালে উঠে কলেজে যায়। নিচের ক্লাশে পড়ায়। ছাত্র সাকুল্যে আটজন। ইদ্রিস প্রায় শূন্য ক্লাসঘরে বক্তৃতা করে এমন উচ্চকণ্ঠে যেন পঞ্চাশ একশ ছাত্রে গমগম করছে কক্ষ। প্রাণ ঢেলে পড়ায়। রাত জেগে পড়াশোনা করে পড়াশোনার জন্যে। ডাঃ সেন আর। ডাঃ চক্রবর্তীর কলেজের ছাত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে এমন ছাত্র গড়ে তোলার কাজে যেন প্রাণপাত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে সে। বিকেলে রুগী দেখে ডিস্পেন্সারীতে বসে। ডাঃ খানের দস্তুর মতো সেও পয়সা নেয় না, শুধু ঔষধের দাম ছাড়া।
সে আসার পর থেকে অনেকটা ভারমুক্ত হয়েছেন ডাঃ খান। এখন বেশ অবসর পেয়েছেন। তিনি। ইদ্রিসের অনুরোধে বৃহৎ মেটেরিয়া মেডিকা লিখছেন বাড়িতে বসে।
কিন্তু বই লেখার মতো অবসর পেয়েও ডাঃ খান তেমন উৎসাহ পেতেন না বই লেখার। বিবেক তাকে দংশন করত। ইদ্রিস বিনি পয়সায় তার কলেজ চালাচ্ছে, ডিস্পোরী দেখছে। আর তিনি তার সুযোগ নেবেন এরকম ধাতের মানুষ তিনি নন। গোপনে গোপনে চেষ্টা করতেন কোথাও যদি একটা হিল্লে করে দেয়া যায় ইদ্রিসের। কিন্তু মুসলমান দরিদ্র একজন হোমিওপ্যাথ, হোক না সে যতই প্রতিভাবান, এই কলকাতায় তার প্রতিষ্ঠা খুব সহজে সম্ভব নয়। অথচ একটা ডিস্পেন্সরী করে দেবেন ইদ্রিসকে এমন পয়সাও ডাঃ খানের নেই। যদি তা পারতেন তাহলে কী আনন্দ হতো তার সেই কথাটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে বারবার স্মরণ করেন তিনি আর বিষণ্ণ হন। এভাবেই চলছিল। তারপর গেল কাল এলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। পতিদহের বড় তরফ। ভাইসরয় কাউন্সিলের মেম্বার, উত্তর বাংলার প্রতাপশালী জমিদার প্রৌঢ় হাজি জয়েনউদ্দিন।
তখন ডিস্পেন্সারীতে ছিল ইদ্রিস। হাজি সাহেব এসে ডাঃ খানের খোঁজ করলেন। ডাঃ খান। তখন ছিলেন না। শুনে হাজি সাহেব বললেন, তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই আমি এ যাত্রা কলকাতা এসেছি। আজকেই দেখা হওয়া দরকার। সম্ভব হলে আজ রাতেই কিংবা কাল সকালে আমি পতিদহে ফিরে যাবো। তা আপনি কে?