আস্তে আস্তে শোনা গেল সব। তালুকদার সাহেব নিজের জন্যে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছেন এ গায়ে সে গাঁয়ে। খাঁটি সোনা চান তিনি। রূপে যেন জাহাঙ্গীর বাদশার বেগম মেহেরুন্নিসাকেও হার মানাতে পারে সে মেয়ে। গরিব হোক ক্ষতি নেই। নিচু বংশ হোক পরোয়া নেই। ঘরে বৌ এলে স্বামীর পরিচয়ে পরিচিতা হবে সে। আছে তেমন?
হেড মোদাররেস সাহেব জাফরান রাঙানো দাড়ি ঝাড়লেন বার কয়েক মাথার টুপি হাপরের মতো উঠানামা করিয়ে শীতল করলেন চাঁদি। তারপর হাসিতে বিগলিত হয়ে বললেন, আছে, অবশ্যই আছে। দুবেলা কোরান পড়ান তাকে তিনি। কিন্তু এত কথা তো ঘোড়ায় জিন দিয়ে থাকলে হয় না! নামতে হবে, বসতে হবে, দশ দিক বুঝে শুনে কথা চালাতে হবে।
সেদিন মগরেবের আগেই মেয়ে দেখে পছন্দ করলেন তালুকদার সাহেব। সাতদিনের মাথায় বিয়ে হয়ে গেল। লোকে বলাবলি করল, বাপের ভাগ্য ছিল বটে! নইলে এত বড় ঘরে এ মেয়ে যায়!
ইদ্রিস আর তার ভাই বোনের বিয়েতে খরচ করল সাধ্যাতীত। একমাত্র বোন ছিল সে। চলে যেতেই বাড়িটা যেন খাঁখা করতে লাগল।
মা ধরে বসলেন, এবারে তোরা বউ আন ঘরে। নইলে একবস্ত্রে আমি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।
বড় ভাই বললেন, সংসারে মন দিয়েছি বলে মনটা তো সংসারী হয়ে যায় নি। আমি সেই ফকিরই আছি। আমার হুজুর বলেছেন, সংসার সাধনার পথে বাধা। বিয়ে আমি করবো না। মা যদি আত্মত্যাগী হন তো ইদ্রিসের একগুয়েমির জন্যেই হবেন।
অতএব ইদ্রিসকে রাজি হতে হল। পদ্মার ওপারে শিবালয়ের মেয়ে পছন্দ হলো। পছন্দ করে এলেন ওদের বাপের চাচাতো ভাই। দিন–ক্ষণ দেখে ইদ্রিস বড় ভাই আর চাচাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিয়ে করতে। এখনো মনে আছে ইদ্রিসের বিয়ে করতে বেরুনোর সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়েছিল। মা বললেন, দাঁড়িয়ে যা। ইদ্রিস দাঁড়িয়ে গেল খানিকক্ষণ।
তারপর যে কাণ্ড হলো, ইদ্রিসের মনে পড়লে এখনো গায়ের রক্ত টগবগ করে ওঠে। সে কথা আর কোনদিন ভাবতে চায় না সে। বিয়ে করা নতুন বৌ ফেলে ভোর রাতে কারো মুখদর্শন পর্যন্ত না করে সোজা চলে এলো ডাঃ খানের কাছে।
তিনি তখন ডিস্পেন্সারীতে কেবল এসে বসেছেন। সকাল বেলায় একঘণ্টা বিনি পয়সায় ওষুধ দেয়া হয়। ভিড়ে থইথই করছে এক ফালি বারান্দাটা। ইদ্রিস এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়াল।
কী ব্যাপার? ঔষুধ কিনতে এলে? প্রাকটিস কেমন? আছো কেমন? খুশিতে একের পর এক প্রশ্ন করে চললেন ডাঃ খান। এতদিন পরে কৃতি ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেন আনন্দ আর ধরছে না।
ইদ্রিস বলল, থাকতে এসেছি স্যার।
থাকতে মানে?
আপনার কাছে। যদি জায়গা দেন আপনার ডিস্পেন্সারীতে বসব। যদি যোগ্য মনে করেন কলেজে ছাত্র পড়ানোয় সাহায্য করব। দেশে আর ফিরে যাবো না।
ও।
স্যার, আপনাকে একটা কিছু কথা দিতেই হবে।
আচ্ছা তুমি বোসো তো।
কথা না পেলে বসবো না স্যার।
কী পাগলামো করছ? বোসো বোগী বিদেয় করে নি, পরে তোমার কথা শুনব। উঠেছ কোথায়?
ধমক খেয়ে নরম হয়ে গিয়েছিল ইদ্রিস। বিনীত গলায় উত্তর করল, শেয়ালদা থেকে সোজা এখানে এসেছি।
বেশ করেছে। বাসায় যাও। গোসল করে কিছু খেয়ে নাও। দুপুরে কথা বলব।
ইদ্রিস বহুদিন পরে প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসায় গেল। দেখল, আরেক ছাত্র জায়ণির রয়েছে সেখানে। তার সঙ্গে গল্প করল খানিক। ভেতর থেকে বিবি সাহেবা—-তাকে আম্মা বলত ইদ্রিস—- সে এসেছে শুনেই নাস্তা পাঠিয়ে দিলেন। ইদ্রিসের মনে হলো অনেকদিন পরে নিজের বাড়িতে যেন ফিরে এসেছে সে।
সেদিন কলেজ ছিল ছুটি : ক্লাশ পড়ানো ছিল না প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের। দুপুরে ইদ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলেন তিনি। বললেন, হ্যাঁ এবার বলো, কী হয়েছে?
পিড়াপিড়ি করেও একবর্ণ বার করতে পারলেন না প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ইদ্রিসের পেট থেকে। সে শুধু এক কথা বলে, আপনার এখানে জায়গা দিন, দেশে আর ফিরে যাবো না।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, সে তুমি যতদিন খুশি থাকো এখানে। কিন্তু এভাবে নিজেকে নষ্ট করবে কেন?
নষ্ট করবার কী আছে স্যার? আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিস করবো। কলেজ দেখবো।
ফাইন্যাল ইয়ারে যখন পড়ত ইদ্রিস, ডাঃ খান তাকে মাঝে মাঝে নতুন ছেলেদের ক্লাশ নিতে বলতেন। মন ঢেলে পড়াতো সে। আম্মা সাহেবার কাছে একদিন ইদ্রিস শুনেছে, স্যার বলেছেন, চমকার পড়ায় ছেলেটা। সেই প্রশংসার ভরসায় ইদ্রিস কলেজে সাহায্য করার প্রস্তাব দিচ্ছিল বারবার।
প্রিন্সিপাল সাহেবকে হঠাৎ বড় করুণ এবং অসহায় দেখালো। বললেন, তোমার কাছে লুকিয়ে রাখব না ইদ্রিস। কলেজের অবস্থা সুবিধের নয়। আমার বিরুদ্ধে জোর প্রচার। চালিয়েছে ডাঃ সেন আর ডাঃ চক্রবর্তীর দল। ছাত্র কমে গেছে আমার। এবার মাত্র পাঁচজন ভর্তি হয়েছে।
অবাক হয়ে গেল ইদ্রিস।
সে কী স্যার!
সেন আর চক্রবর্তীর দোষই বা কী দেব? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব খেদের ভঙ্গিতে হাতের পিঠ ঘষতে লাগলেন। দোষ আমাদেরই। আমার কলেজে হিন্দু ছেলে পড়তে আসবে এ আশা কোনদিন করিনি। ওদের জাতপ্রীতিটা বড় কঠিন। কিন্তু মুসলমান ছেলেরাও আজকাল কি বলে জানো?
কী স্যার?
বলে, হিন্দুর কলেজে পড়লে ডাক্তার হিসেবে নাম পোক্ত হয়। একে হোমিওপ্যাথি পড়ছি। তাও যদি মুসলমান প্রিন্সিপ্যালের কাছে পড়ি তো আর রোগী দেখে পেটের ভাত জুটাতে হবে না।