পানি খেতে খেতে ইদ্রিস ভাবল, না হয় নাই এলো এলোপ্যাথি পড়া। হোমিওপ্যাথিই বা মন্দ কী। দামে শস্তা। খেতেও ভালো। কোনো বদ ক্রিয়া করে না। দেশ গায়ের লোকেরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পায় না। এলোপ্যাথির পয়সা জোগাবে তারা কোত্থেকে। হোমিওপ্যাথি শিখলে সবার সেবা করতে পারবে ইদ্রিস। গায়ের অবস্থা তার চেয়ে ভালো তো আর কেউ জানে না। বরং আল্লার ফজলে এই ভালো হলো। সে হোমিওপ্যাথি পড়বে।
মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো। এ–কী আকাশ কুসুম সে বানাচ্ছে? তার তো কলকাতায় একবেলা থাকবার মতো সঙ্গতি নেই। আজ দেড় দিন পেটে ভাত পড়ে নি। মেসওলা বলে দিয়েছে কাল পর্যন্ত টাকা দিতে না পারলে সে যেন সীট ছেড়ে দেয়। এত সৌভাগ্য কি তার হবে যে সে হোমিওপ্যাথিই পড়তে পারবে? না হয় কিছু সুবিধে করে। দেবেন ডাঃ খান। কিন্তু তাতে তো আর খাওয়া পরার সমস্যা সমাধান হবে না। মনটা একেবারে নিভে যায় ইদ্রিসের। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
তা কলকাতায় এতদিন কী করছিলে?
ডাঃ খান প্রশ্ন করেন।
ক্যামবেলে পড়তাম।
ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন ডাঃ খান। বললেন, ক্যামবেল?
জ্বি হ্যাঁ।
তারপর?
সব খুলে বলল ইদ্রিস। শুনে ডাঃ খান চোখ বন্ধ করলেন। চেয়ারের পেছনের দুপায়ে শরীরটাকে ঠেলে ভর দিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রোগী এলো আরেকজন। তখন আবার সোজা হয়ে বসলেন। সব শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন তার। তারপর ইদ্রিসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আমার এখানে যারা পড়ে তারা সবাই প্রায় তোমার মতো। আমার কিছু বাধা রোগীপত্র আছে। তাদের কেউ খানসামা, কেউ রাজমিস্ত্রী, কেউ বই বাঁধানোর বা ছাপাখানার কাজ করে। নিজেরা গরিব হলেও ওরা বাড়িতে থেকে ছেলে পড়িয়ে নিজেরা পড়াশোনা করে। পারবে তুমি?
আগ্রহে দুহাত জড়ো করে উজ্জ্বল চোখে ইদ্রিস উত্তর করে, হ্যাঁ পারবো। খুব পারবো। কিন্তু কলেজের মাইনে?
সেটা? সেটা না হয় তুমি আপাতত নাই দিলে। আমার ডিস্পেন্সারীতে আরেকজন লোক দরকার লেবেল কাটা, শক্তি লেখা, কর্কের মাথায় ব্লকের ছোপ দেবার জন্যে। কিন্তু প্রথম বছরের পরীক্ষায় যদি ফল খারাপ হয় তাহলে এ সুবিধে আর পাবে না। মোট চার বছর পড়তে হবে।
আমি পড়ব স্যার। আমি চেষ্টা করব ভালো ফল করতে স্যার।
প্রথম বছরেই পড়াশোনায় ইদ্রিস এত ভালো করল যে ক্লাশের ভেতরে প্রথম হলো সে। ছকু খানসামা লেনে জায়গির পেয়েছিল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বৌবাজার আসতো সকাল নটায়। ক্লাশ করতো। পড়াতেন ডাঃ খান নিজে। আর কোনো প্রফেসর ছিল না কলেজে। নিজেই অর্গানস, ফিজিওলজি, অ্যানাটমি, মেটিরিয়া মিডিকা, প্র্যাকটিস অব মেডিসিন সব সাবজেক্ট পড়াতেন। ক্লাশ শেষে ইদ্রিস গিয়ে বসতো ডিস্পেন্সারীতে। সেখানে সন্ধ্যে পর্যন্ত ওষুধ ঢালা, লেবেল লাগানো, প্যাক করা, পয়সা গুণে রাখা, মেমো কাটা এই করত সে। সন্ধ্যের পর যখন বাসায় ফিরত প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে আসত ডাঃ খানের লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি। রাত জেগে নকল করে দিত ইদ্রিস। বই ছাপাতেন ডাঃ খান নিজেই। সে বই তার নিজের কলেজেই পাঠ্য ছিল। আর কিনত মফস্বলের মুসলমান হবু হোমিওপ্যাথরা।
এক বছর পরে একদিন ডাঃ খান ইদ্রিসকে ডেকে বললেন, আমার বাসায় তো বাইরের ঘরটা পরেই থাকে। চলো এসো।
মানে স্যার?
গর্ধব কোথাকার। মানে আবার কী? আমার বাসায় থাকবে আজ থেকে।
ডাঃ খানের প্রিয় ছাত্র ইদ্রিস সম্মানের সঙ্গে ফাইন্যাল পাশ করল। ডাঃ খান নিজের খরচে তার ছবি ছাপিয়ে দিলেন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী আর শিক্ষা–সমাচারে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ইদ্রিস বিদায় নিল। ফিরে এলো তার গায়ে। ততদিনে বড় ভাই মহম্মদী নাম ঘুচিয়ে আবার হানাফি হয়েছেন। সংসার করছেন। ইদ্রিস ফিরে এলে বললেন, এবার বিয়ে করে সংসারী হ।
সে কেমন করে হয়? বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই আগে বিয়ে করবে সে কী কথা?
কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝানো গেল না। আর ইদ্রিসেরও পণ বড় ভাই বিয়ে না করলে সেও বিয়ে করবে না। ইতিমধ্যে বোনের বিয়ে ফরজ হয়ে পড়েছে।
এক বিকেলে কাণ্ড হলো একটা। গায়ে ঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। কে এক দিব্যকান্তি তরুণ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধীরে ধীরে মাঠ ঘাট ভেঙে গাঁয়ের ভেতরে ঢুকেছে।
মকতবের হেড মোদাররেস কাঁপতে লাগলেন থরথর করে। বোধহয় স্কুল ইনেসপেক্টর এসেছে মকতব দেখতে, খাতা দেখতে। কোথায় তাকে বসায়, কী দিয়ে খাতির করে ভেবে না পেয়ে গলদঘর্ম হলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, ধাম জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করেন।
কিন্তু একটু পরেই হেড মোদাররেস সাহেবের কেমন সন্দেহ হলো। স্কুল ইনেসপেক্টরের মতো রুক্ষ মেজাজ নয়, ধমক দিয়ে কথা বলেন না। খাতাও দেখতে চাইলেন না, এ আবার কে বটে?
তাই বলো শাজাদপুরের উত্তর পাড়ার তালুকদার বাড়ির বড় ছেলে। বাপ মরার পরে গদিতে বসেছেন।
তা হুজুর কী মনে করে? ওরে শরবৎ আন। পাখা আন। হারামজাদাগুলো গেল কোথায়? তালুকদার হাসলেন। বললেন, অনর্থক কেন তালবেলেমদের হারামজাদা বলছেন মৌলবী সাহেব। ব্যস্ত হবেন না। আমি দুদণ্ডের জন্যে এসেছি। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামবও না।
কেন? কেন? হাঁ হাঁ করে উঠলেন হেড মোদাররেস। খাতিরদারিতে কোনো কসুর হবে না। দয়া করে এসে পড়েছেন যখন, বসবেন না, সে কী কথা?