পাশ করেছিল ভালোভাবে, কলকাতায় গিয়াছিল ডাক্তারী পড়তে। চৌবাড়িতে একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল তার। বড় ভাই যে বাড়িতে জায়গির থাকতেন সে বাড়ির মিয়া সাহেব দয়াপরবশ হয়ে টাকা খরচ করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন। সেই ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ভালো হয়েছিল ইদ্রিস।
ভারী ভালো লেগেছিল ডাক্তারকে তার। লম্বা নল দিয়ে বুক পরীক্ষা করছেন। চোখ কপালে তুলে জিভ একটু বের করে নাড়ি টিপে দেখছেন। খসখস করে লিখে দিচ্ছেন ব্যবস্থা। মনের মধ্যে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল সেই ছবিগুলো। আজরাইলের সঙ্গে লড়াই করা সে কি সহজ!
ইদ্রিসের যেন মনে হয়েছিল, লেখাপড়া শিখে যদি কিছু হতে হয় তো ডাক্তার হবে সে। আজরাইলকে কাবু করার ফন্দি সন্ধি জানার চেয়ে চূড়ান্ত আর কী দিতে পারে ইংরেজি শিক্ষা? সে ডাক্তার হবে।
বাবা এন্তেকাল করার পর টাকার অভাবে যখন তার পড়াশোনা বন্ধ হলো, তখন একবার এক ঝলক মনে হয়েছিল বেঁচে থেকে কী লাভ? মনে হয়েছিল, এক ফুয়ে কে যেন বিরাট এক ঝলমলে ঝাড়বাতি নিবিয়ে দিল। কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে চলমান মানুষগুলোকে তার মনে হয়েছিল অন্য জগতের মানুষ, কত সুখী তারা, কত সজীব, পায়ের নিচে শক্ত মাটি তাদের। আর একমাত্র সে–ই এদের মধ্যে দলছুট। তার মনে হচ্ছিল যেন, রাস্তার লোকেরাও তা জেনে গেছে; তাকে ভারী অদ্ভুত আর বেখাপ্পা দেখাচ্ছে সবার ভেতরে। এখুনি যেন সবাই হা হা করে হেসে উঠবে।
দুহাতে মুখ ঢেকে দৌড় দিতে যাবে, এমন সময় চোখের সম্মুখে এক দৃশ্য চোখে পড়ল। দেখল কয়েকজন যুবক একটা দরোজা দিয়ে সার বেধে বেরিয়ে আসছে। হাতে তাদের বই খাতা। দরোজার ওপরে সবুজ সাইনবোর্ড। তাতে সূর্যোদয়ের ছবি আঁকা। সেই সূর্যের ওপরে আধখানা বৃত্তের আকারে লেখা প্রিন্সিপ্যাল খানস সানরাইজ হোমিও কলেজ। তার নিচে লাল কালিতে লেখা দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
আল্লাহরই কুদরত বলতে হবে। নইলে এই বৌবাজার দিয়ে কত কত দিন সে গিয়েছে, কিন্তু কই, আগে তো এ সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি। ঐ যে বড় বড় করে লেখা দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়—-লেখাটা টকটক করছে; এত বড় লাগছে যে তার রীতিমত বিস্ময় হয় সে কি তবে এতকাল চোখ বুজে পথ চলত?
সোজা সে ঢুকে গিয়েছিল দরোজা দিয়ে। প্রিন্সিপ্যাল খান তখন ক্লাস ছুটি দিয়ে ডিস্পেন্সারীতে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী চাই তোমার?
গরিব আর মেধাবী ছাত্রদের কী সুবিধা দেওয়া হয় তাই জানতে এসেছি। সালাম না আদাব না, কোনো ভনিতা নয়, এমনকি দ্বিধা বা ভয়ও নয়—- একেবারে সরাসরি এ রকম প্রশ্ন ডাঃ খান আগে শোনেন নি। স্মিত হেসে বললেন, তুমি পড়তে চাও?
জানি না।
অবাক হয়ে এক মুহূর্তের জন্য ঐ তুললেন ডাঃ খান। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি কোথায়?
সিরাজগঞ্জ।
কী পাশ করেছ?
এন্ট্রান্স।
কলকাতায় কদ্দিন আছো?
দুবছর।
এসো আমার সঙ্গে। ডিস্পেন্সারীতে তিনি নিয়ে গেলেন ইদ্রিসকে। বাইরে তখন বেশ কয়েকজন রোগী অপেক্ষা করছে। খাস কামরায় ঢুকে ইদ্রিসকে একটা টুল দেখিয়ে বললেন, বোসো এখানে।
অভিভূতের মতো বসলো ইদ্রিস। তার সঙ্গে আর একটি কথাও বললেন না ডাঃ খান। রোগী দেখে চললেন একের পর এক। একজন জিজ্ঞেস করল, ভিজিট কত দিতে হবে? ডাঃ খান হেসে বললেন, ভিজিট তো বাড়ি না গেলে নিই না। ওষুধের দাম দিলেই হবে।
রোগী যেন আর শেষ হতে চায় না। বেলা পাঁচের ঘরে এসে পৌঁচেছে। ইদ্রিসের এক সময় যেন সব অবাস্তব বলে মনে হলো। মনে হলো সে এখানে কেন? কী করছে? কোথা থেকে এসেছে? নিজের নামটাও যেন আরেকজনের নাম বলে মনে হতে লাগল তার কাছে। এই তো সে কাল রাতেও ভাবছিল দেশে ফিরে যাবে সংসার দেখবে, বোনটাকে বিয়ে দেবে, মকতবে মাস্টারী করবে। আজ, এখন, এই মুহূর্তে মনে হলো তার, সে সিদ্ধান্ত আর কেউ নিয়েছিল। কেন সে নিজেকে নষ্ট করবে এভাবে? বড় ভাই যদি সংসার না দেখে পার পেয়ে যান তো সে–ই বা কেন পার পাবে না? ছোট হয়ে তারই বা কী এমন দায়িত্ব! আর সে যদি গাঁয়ে ফিরেই যায় তো সংসারের তাতে লাভ হবে কতটুকু? মা না খেয়ে থাকবেন না, সে না গেলেও। বোনটার বিয়ে সে কলকাতা থেকে গিয়েও দিয়ে আসতে পারবে। শুধু ক–টা বছর। এই বছর ক–টা দাঁতে দাঁত চেপে কোন মতে পার করে দিতে পারলেই তার আবাল্য সেই স্বপ্ন সফল হতে পারে, সে ডাক্তার হতে পারে। লোকে হয়ত এ কবছর বলবে, বড় ভাই না হয় ফকির হয়ে গেছে, তুই তো বুড়ি মা আর বোনকে দেখতে পারতিস! তা ডাক্তার হয়ে সে যখন গাঁয়ে ফিরে যাবে তখন—
চমক ভাঙ্গলো ডাঃ খানের কথায়। তিনি বললেন, খাও। তাকিয়ে দেখে গরম জিলিপি পিরিচে করে রাখা। আর ঠাণ্ডা দু গেলাশ পানি। ইতস্তত করল সে। ডাঃ খান বললেন, খাও। আমিও নিচ্ছি।
তবু ইতস্তত করছে দেখে তিনি আবার যোগ করলেন, আহা, তোমার জন্য বিশেষ করে আনাই নি। ক্লাশ শেষে রোগী দেখে এটুকু নাস্তা করি। নাও।
সে একটা জিলিপি নিল। বাবার কথা মনে গড়ে গেল তার। চৌবাড়িতে সে যখন পড়ত বাবা মাঝে মাঝে দেখতে আসতেন। হাতে থাকত খাবারের পুটুলি। রাগ করে সে বলত, কেন আপনি এ সব বয়ে নিয়ে আসেন। বাবা হাসতেন। পরে করতেন কী, খাবার আনতেন ঠিকই; কিন্তু বলতেন না যে তার জন্যে আনা। বলতেন, তোর মা আমারই নাস্তার জন্যে সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল, তা তুইও খা আমিও খাই।