লণ্ঠনের আলোয় মোহময়ী হয়ে উঠেছিল আয়েশা। অচেতন হয়ে পড়ে আছে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর নেই তাই শাসন বারণ। বৃদ্ধারা খানিকটা ঢেকেঢুকে দিয়েছিল বটে কিন্তু তাতে আরো রহস্য সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। চকিতে একটা শুভ্র গোড়ালি দেখা গিয়েছে। দেখেছে ফিকে গোলাপি আভা বাহুমূলের। ভেতরের সুপ্ত যন্ত্রণায় আর জ্বরের উত্তাপে বিযুক্ত হয়ে আছে দুই ঠোঁট একটা লীলায়িত ভঙ্গিতে কঠিন হয়ে আছে আয়েশা। বালিস ডুবিয়ে বিছানার ওপর ঢলে পড়েছে একরাশ কালো রেশমি চুল। নিটোল গালে নীল শিরা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তার। একটি মাত্র মুহূর্ত। তার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। আগুন জ্বলতে তো এক মুহূর্তের বেশি লাগে না। আর আগুন সবভুক। নীতি, আদর্শ, চেতনা, বিবেক সব সে পোড়ায় যেমন পোড়ায় কাঠ, মাংস, অরণ্য, মৃত্তিকা।
তার ব্যর্থ বাসরে এই এলায়িত যুবতাঁকেই সে কল্পনা করেছিল। সে রাতে যদি এমন হতো! সে রাতে যদি সাত বছরের কুশ্রী সেই বালিকার বদলে থাকত আয়েশা!
নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে ইদ্রিসের। উপুড় হয়ে দুহাতে মাথা চেপে সে শান্ত হবার চেষ্টা করে। দূরে ফেউ ডেকে ওঠে আবার। অন্ধকার বিলে যেন ঢিল পড়েছে—-তরঙ্গ কাঁপতে কাঁপতে সুদূরে মিলায়, আবার ফিরে আসে, আবার মিলায়।
শরীরটাকে ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে শোয় ইদ্রিস। উঠে বসে। না এ তার ভাবা উচিত নয়। অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করে, এতক্ষণ যাকে এড়িয়ে চলেছে, তার হাতেই সে বন্দি। সে আয়েশার কথা ভাবছে।
আয়েশার কথা ভাবা তার উচিত নয়। আয়েশা তার রোগী, সে চিকিৎসক। যে নারীকে মাতৃজ্ঞান করতে না পারবে, তার চিকিৎসা কোরো না। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ভ্রূকুটি স্পষ্ট দেখতে পায় ইদ্রিস। সে মনে মনে তওবা করে। এক থেকে একশ পর্যন্ত গোনে। আবার একশ থেকে উল্টো দিকে গুনতে গুনতে একে ফিরে আসে। অতীতে যখন তার মনে হয়েছে। নিজেকে শাসনে রাখতে পারছে না, চেতনা গুলিয়ে যাচ্ছে, সংকটে অবশ হয়ে যাচ্ছে চিন্তা, তখন এমনি সংখ্যা গণনা করে শান্তি পেয়েছে সে।
আজ সে সংখ্যা গণনা কোন কাজে এলো না।
জীবনে যে পূর্ণিমা সে কামনা করেছে, সে পূর্ণিমা কি এভাবে এলো?
এ পূর্ণিমা স্নিগ্ধ করে না, পোড়ায়। ছোবল দেয়। শরীর নীল করে দেয় বিষে।
ইদ্রিস একবার ভাবল, পতিদহ থেকে চলে যাবে সে। হাজি সাহেব ফিরে এলে পদত্যাগপত্র পেশ করবে তার কাছে। জীবনে এই প্রথমবারের মত পরাজিত মনে হয় নিজেকে, ধিকৃত মনে হয়। এই ধিক্কার, এই পরাজয় বাইরের কেউ জানুক বা না জানুক তাতে কী? সে নিজে কী করে বহন করবে এই অপরিসীম গ্লানি। তাকে বড় হতে হবে, ছেলেবেলা থেকে এই কথাটা কানে শুনতে পেত নদীর স্রোতে, অরণ্যের মর্মরে, বাতাসের প্রবাহে। কিন্তু কীভাবে বড় হবে, সেটা আজো জানা হয় নি তার। আজ এই নিশুতি রাতে মনে হলো, সত্য যদি তার সঙ্গে থাকে, নিজের কাছে নিজেই যদি মাথা উঁচু করে থাকতে পারে তবেই সে বড়। তক্ষুণি উঠে সে বাতি জ্বালিয়ে পদত্যাগপত্র লিখল।
লেখার সঙ্গে সঙ্গে অসীম শান্তিতে ভরে উঠল মন। এতক্ষণ চাঁদর ছিল না গায়ে। তবু শীত করছিল না। এখন শরীরে আবার টের পেল বাতাসের স্পর্শ। গায়ে চাঁদর জড়িয়ে নিল ইদ্রিস। বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল সে।
খোলা জানালা দিয়ে এক ঝলক দুরন্ত বাতাস কখন অস্থির করে তুলল তার পদত্যাগপত্র। এক সময়ে ঝটপট করে কাগজটা পড়ে গেল মেঝেয়। চৌকির নিচে ঘুমিয়ে থাকা বেড়ালটা সজাগ হয়ে তাকাল চারদিকে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাগজটার পরে। তীক্ষ্ণ নখরে কুটিকুটি করে পদত্যাগপত্রটা ছিঁড়ে ফেলল লাওয়ারিশ ক্রুদ্ধ বেড়ালটা।
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ১৯৬২