দুই বোনে এত পার্থক্যও হয়?
গুম হয়ে বসে রইলো সে সারারাত। না, চৌকিতে না। ঘরের কোণে জলচৌকি ছিল একটা তাতে।
পরদিন ভোরে কাক ডাকার আগে বেরিয়ে পড়ল ইদ্রিস। সঙ্গে কিছু টাকা ছিল। ঘাটে এসে শুনলো গয়নার নৌকো ছাড়বে বেলা এক পহর হলে। একটা ছোট্ট নৌকা এক টাকায় ভাড়া। করে এলো শিবালয়। সেখান থেকে গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা। কলকাতায় নেবে সোজা প্রিন্সিপাল খানের কাছে। মাকে একটা চিঠি দিয়েছিল পরদিন। কিন্তু গায়ে ফিরে যায় নি। পতিদহে আসবার আগে পর্যন্ত মায়ের কাছে দ্বিতীয় চিঠিও লেখেনি সে। পতিদহে কাছারি বাড়ির বারান্দায় রাত দুপুরে অতীত পরিক্রম করে এলো ইদ্রিস ডাক্তার। কার কপালে কী। লেখা আছে কেউ বলতে পারে না। কোথায় পতিদহ, ইহজীবনে এখানে আসা দূরে থাক নাম। পর্যন্ত জানার কথা নয়। অথচ পতিদহই এখন তার কাছে একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছে।
বারান্দা থেকে নেমে এসে আবার হাঁটতে লাগল ইদ্রিস। নাহ্, শীত জোর পড়েছে। চাঁদর টেনে কানমুড়ি দিল সে। ভারী ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। চোখ জড়িয়ে আসছে। এবার বোধহয় ঘুম আসবে।
হঠাৎ রাতের অন্ধকার যেন খানখান হয়ে গেল নারী কণ্ঠের চিৎকারে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইদ্রিস। কান থেকে নামিয়ে দিল চাঁদর। তারপর প্রায় দৌড়ে অন্দর মহলের বার দরোজায় এসে চিৎকার করে ডাকল, বছির, বছির।
সঙ্গে সঙ্গে বছির এসে তার গায়ের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বলল, কই ডাকেন? তোমরাই? মুই তোমার আগোৎ যাবার ধরছিনু। আম্মা তোমাক বোলায়।
কেনে? তোমার বুবুজান চিরি উঠিল কেনে?
কাঁই কবার পায়। আইসেন তোমরা। ওমরা কত ঝাড়ন ঝাড়িল, কিছুই হইল না। বুবু আরো দাপেয়া ওঠে থাকি থাকি।
আয়েশার চিৎকারটা যেন তখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে। ইদ্রিস বলে, চল দেখছি।
ভেতরে এসে দেখে মৌলবি সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তার দিকে দ্বিতীয় বার আর তাকাল না ইদ্রিস। বছিরকে বলল, খবর দে। মুই রোগী দেখি। ফির ওষুধ দিম্।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেতরে ডাক পড়ল তার। প্রকাণ্ড উঠোন পেরিয়ে পুবের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। ঢুকে দেখে বিছানার ওপর এক তরুণীকে ঘিরে কয়েকজন বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। তরুণী আপাতত সঙ্গাহীন। মেঝের ওপরে পানি ভর্তি তামার ডেক রয়েছে একটা। এক পাশে মাটির হাঁড়িতে খানিকটা আগুন তখনো ধিকিধিকি করে জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে। প্রথমেই সে বছিরকে বলল, এসব বাইরে নিয়ে যেতে! জানালাটা খুলে দিতে। জানালা খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধোঁয়া পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে গুমোট ভাবটা কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল শীতল স্নিগ্ধতা।
ইদ্রিস প্রশ্ন করতে লাগল বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য না করে।
পুকুরঘাটে সঙ্গে কেউ গিয়েছিল?
বৃদ্ধাদের ভেতর একজন ইতস্তত করে উত্তর দিল,। এর পরে সে–ই মুখপাত্রী হিসেবে অন্যান্য প্রশ্নেরও উত্তর দিতে থাকল। সব শুনে ইদ্রিসের মনে হলো, আসলে ভয় পেয়েছে আয়েশা। সন্ধ্যার অন্ধকারে একাকী পুকুরঘাটে একটা বেড়াল দেখেও ভয় পাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
ইদ্রিস বলল, নাড়িটা দেখতে হবে।
ওরা একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
আয়েশার হাত তুলে নিল ইদ্রিস। শরীরে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হয়ে গেল তার। আর কোন দিন কোনো নারীকে স্পর্শ করে এরকম অনুভূতি তার হয় নি। শীতল, অবিশ্বাস্য কোমল, অসহায় একটি হাত। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, এমন রূপও মানুষের হয়! গোলাপের মতো অবিকল বর্ণ। ছিপছিপে নাক, সুগঠিত চিবুক, পাতলা ঠোঁট, দীর্ঘ গ্রীবা। ভরা একটা নদীর মতো স্বাস্থ্যের সম্ভার। ইতিহাসের বই পড়ে নূরজাহান, মমতাজমহল এদের ছবি যেমন কল্পনা করা যায়, ঠিক তেমনি। মোহগ্রস্তের মতো হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ইদ্রিস। চোখ ফেরাতে পারে না। অথচ সে চোখে যেন সে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। যেন একখণ্ড স্বপ্নের সঙ্গে বেহেস্তের সঙ্গে আজ মধ্যরাতে তার হঠাং সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। পরমুহূর্তে গ্লানিতে ভরে উঠল তার মন। ছি, ছি, এ কী হলো তার। এ কেমন মন নিয়ে সে অসুস্থের শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে আছে! সচকিত হয়ে উঠল তার শরীর। কঠিন হয়ে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, মাতৃজ্ঞানে পর–রমণীর চিকিৎসা করবে। তা যদি না পারো তাহলে তার চিকিৎসাই কোরো না।
জীবনে এমন মতিভ্রম তার হয় নি।
ইদ্রিস সমস্ত ইন্দ্রিয়কে কঠিন শাসন করে নাড়ি দেখল আয়েশার। অত্যন্ত ক্ষীণভাবে বইছে। বছিরকে থার্মোমিটার স্টেথসকোপ আনতে বলল। তুমুল জ্বরের ঘোরেই অচেতন হয়ে পড়ে আছে আয়েশা।
স্টেথসকোপ দিয়ে এবারে বুক দেখল তার।
সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে প্রবল লড়াই চলতে লাগল ইদ্রিসের। এ রকম সমস্যায় জীবনে সে পড়ে নি। ডাক্তার হয়ে মাতৃজ্ঞানে নারীকে দেখতে পারছে না, এই সত্যটা ছুরির মতো তার বুকে বারবার বিদ্ধ হতে লাগল। সে বেরিয়ে এলো।
এসে ডিস্পেন্সরী খুলে ওষুধ পাঠিয়ে দিল বছিরের হাতে।
মৌলবি সাহেব একবার কী বলবার জন্যে কাছে এলেন। কিন্তু ইদ্রিসের কঠিন মুখভাব এবং চিন্তান্বিত ভ্রূকুটি দেখে সাহস পেলেন না।
ইদ্রিস এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
অন্ধকারে ভেতরের অস্থিরতা যেন শতগুণ হয়ে উঠল তার। কেবলি এপাশ ওপাশ করতে লাগল সে। একদিকে নিষিদ্ধ আকর্ষণ, আরেক দিকে চিকিৎসকের কর্তব্য। একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল আয়েশার মুখ, শরীর; আরেকবার মনে পড়তে লাগল প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।