আধঘণ্টা পরেই সেই কল্লিদার টুপি পরা লোকটার সঙ্গে এলেন চাচা মিয়া। বড় ভাইকে দেখা গেল না।
তারা দুজন এসে ইদ্রিসের দুদিকে বসলেন চৌকির পরে। লোকটা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে কৌতুককণ্ঠে বলল, কী রে পোলাপান, দুলা পছন্দ অইছে?
হি হি করে হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে আর কী!
যাহ, ভাগ এহান থনে। শীগগীর বাইরা। গেলি!
হুড়মুড় করে ছেলেদের দল চলে গেল। একটু পরে আরো কয়েকজন মুরুব্বি এসে সমস্বরে সালাম আলাইকুম দিয়ে বসে গেলেন চৌকির ওপর। চৌকিতে মানুষ আর ধরে না।
সদালাপ হলো খানিকক্ষণ। তারপর এক প্রৌঢ় এক বুড়োকে ঠেলা দিয়ে বললেন, কথাডা কইয়া ফালান চাচা। সময় নষ্ট কইরা লাভ কী?
চমকে উঠল ইদ্রিস। বিয়ের বর, মাথা তুলতে নেই। মাথা নিচু করেই সে রইলো। কিন্তু কানটা সজাগ হয়ে উঠলো, কঠিন হয়ে এলো হাত পা। কী কথা বলতে এসেছেন ওরা?
অনেকক্ষণ কেউ কিছু বললেন না। থমথম করতে লাগল ঘর। সবাই অস্বস্তিতে উসখুস করতে লাগলেন।
অবশেষে একজন বললেন, দুলামিয়া, আমরা দশজনে আপনের কাছে একড়া কথা কইবার চাই। কথাডা কিছু না। দ্যাহেন, হায়াত মউত রিজিক দৌলত আল্লার হাতে। বিয়ে শাদি যার। যেহানে লেখা আছে আল্লার খাতায়, আল্লা ভিন্ন কেউ তারে খণ্ডাতি পারে না। তা আপনে। এই বাড়ির দুলাহ্ অইবেন। আমরা কিন্তুক, খালি আপনেরে না, আপনের মিয়া ভাইরেও দুলাহ্ কইরা রাইখতে চাই।
অবাক হয়ে ইদ্রিস তাকাল চাচা মিয়ার দিকে।
চাচা মিয়া মাথা নামিয়ে নিলেন।
মুরুব্বিদের আরেকজন বললেন, কথাডা ভাইঙ্গাই কওনা ছোট মিয়া। দুলামিয়া শিক্ষিত লেহাপড়ি জানা মানুষ, হে খুশিই অইবো শুইনা। দুই ভাই এক জোটে দুই বৌ নিয়া দ্যাশে যাবি অ্যারচে খুশির কথা আর কী অইবার পারে!
ইদ্রিস নিচু গলায় চাচাকে জিজ্ঞেস করল, মিয়া ভাই কেনে? এনারা কইতাছেন কী?
চাচা মাথা নিচু রেখেই কম্পিত গলায় বললেন, আমি কিছু জানি না ইদ্রিস। আমার মতই আছিল না। কিন্তু হঠাৎ এই কথা হইয়া গেল। এহন কী করি? তুমিই কও। বিয়া না কইরা যদি ঘরে যাও মাইনষে ছি ছি কইরবে, ছ্যাব দিবে, তোমার মায়ে যে কী কইরা বইসবে তা আল্লাই জানে।
এসব কথার একবর্ণ ইদ্রিসর বোধগম্য হলো না। সব অসম্বন্ধ; অসম্ভব বলে মনে হলো তার। বড় ভাইকে এরা দুলাহ্ করতে চায় অর্থ কী? এই তো সেদিন পর্যন্ত তাকে কত বোঝানো হলো তিনি রাজি হলেন না। এখন হঠাৎ কিসের গুণে কী হয়ে গেল?
অবশেষে সব কথাই প্রকাশ পেল। যে বাড়িতে ইদ্রিস বিয়ে করতে এসেছে সে বাড়িতে দুই মেয়ে। বাপ নাই, মা আছে। দুঃখে কষ্টে সংসার চলে। বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে ইদ্রিসের। এখন গাঁয়ের লোক বড় ভাইকে দেখে এবং তিনি অবিবাহিত শুনে ঠিক করেছে বড় মেয়ের সঙ্গে বড় ভাইয়ের আর ছোট মেয়ের সঙ্গে ইদ্রিসের বিয়ে দেবে তারা।
শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ইদ্রিস। কী বলবে, কী করবে, কী করা উচিত কিছু বুঝতে পারল না সে। চাচা মিয়া কফ ফেলার নাম করে কাশতে কাশতে বাইরে চলে গেলেন। গাঁয়ের মুরুব্বিরা হাত চেপে ধরলো ইদ্রিসের—- তাদের কথা তাকে রাখতেই হবে। এদের বাপ নাই। জানেনই তো, দুঃখের সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে এক সঙ্গে হয়ে গেলে ঝামেলা যায়। তাছাড়া এই বিয়েতে যে খরচ হচ্ছে তা জোগাতেই মেয়ের মা প্রায় সর্বস্ব বাধা দিয়েছেন। ডাক্তার দুলা বলেই কোন দিকে তাকান নি তিনি। এখন ইদ্রিসেরও তো এ বাড়ির জামাই হিসেবে দায়িত্ব একটা হবে, শালীকে বিয়ে দিতে হবে নিজের খরচে। তার চেয়ে এই ব্যবস্থাই ভালো নয় কি? দুই ভাই দুই বোন। বোনে বোনে ভাইয়ে ভাইয়ে ছাড়াছাড়ি নেই। এক সংসারে গলাগলি হয়ে থাকবে। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে?
ইদ্রিস কিছু বলল না। পাথর হয়ে বসে রইলো।
কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। তাদের ভেতরে একজন বলল, তাইলে সুখবরটা দিয়া দেইগা মজলিশে।
হাজার চেষ্টা করেও ইদ্রিস নিজের কণ্ঠে একটি ধ্বনিও ফোঁটাতে পারল না। জীবনে এত বড় বিস্ময় তার হয় নি।
অভিভূতের মতো বিয়ের মজলিশে গিয়ে বসলো সে। প্রথমে বড় ভাইয়ের বিয়ে পড়ানো হলো। তারপর তার। আলহামদুলিল্লাহর মিলিত ধ্বনিতে বারবার মুখরিত হয়ে উঠল মজলিশ। গোলাপপাশ থেকে গোলাপজলের ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়ে গেল একবার। মিছরির টুকরো হাতে হাতে ফিরতে লাগল।
ইদ্রিসের শুধু দুটি কথাই মনে হয়েছিল। আর সে কথা দুটিই তাকে দুর্বল করে ফেলেছিল। বড় ভাই বাপের অবর্তমানে বাপের মতো–তার ইচ্ছে মান্য করা ছোট ভাইয়ের কর্তব্য। আর মনে হয়েছিল, তাদের বংশে কেউ কখনো বিয়ে করতে এসে ফিরে যায় নি।
চাচা যখন পাত্রী খুঁজতে বেড়িয়েছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন ইদ্রিসকে, তার কিছু বক্তব্য আছে কিনা। উত্তরে ইদ্রিস বলেছিল, আমি টাকা পয়সা চাই না, বড় ঘরও চাই না, তবে মেয়ে যেন সুন্দরী হয়।
রহিমগঞ্জ থেকে ফিরে গিয়ে চাচা বলেছিলেন, পাত্রী যা দেইখা আসছি একশ জনের মইধ্যে একজন। যেমুন রং তেমুন চেহারা। দেইখলে ইরানি বুইলা ধন্দ হয়। পান খাইলে গলা দিয়া পানের পিক নাইমতে দেখা যায়। আর কী চাও?
ইদ্রিস ধরেই নিয়েছিল ছোট বোনও তেমনি সুন্দরী হবে।
বাসর ঘরে ঢুকে দেখে লাল শাড়ি জড়ানো ছোট্ট পুঁটুলির মতো একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে আছে। এ যে একবারে সাত বছরের বালিকা! একে তো সে আশা করে নি। দপ করে আগুন ধরে গেল মাথার ভেতরে। এক হাতে মুখটা তুলে দেখেই আর্তনাদ করে পিছিয়ে এলো ইদ্রিস। কোথায় দুধে আলতা রং, আর কোথায় ছবির মতো চেহারা, ঘোর শ্যামবর্ণ, ঠোঁট পুরু, নাক খাটো, কপাল উঁচু তার।