কাল দুপুরের কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে তার মনে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বৌবাজারের ডিস্পেন্সারীতে বসে তখন রোগী দেখছিল সে। এমন সময় চাকর এসে খবর দিল দুপুরে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাসায় ডেকেছেন খেতে।
এ রকম তো কত দিন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ডেকেছেন। তাঁর হোমিওপ্যাথিক কলেজে পড়াশোনা করেছে ইদ্রিস। ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় এসেছিল সে, এলোপ্যাথি পড়বে বলে। ক্যামবেল পাশ ডাক্তার হবে বলে। কিন্তু এক বছর পড়বার পড় সামথ্যে আর কুলোলো না। বাবার এন্তেকালের পর বড় ভাই সংসার দেখতে এগিয়ে এলেন না। তিনি তখন মহম্মদী হয়েছেন। লম্বা লম্বা চুল রাখেন, চোখে দেন সুরমা, মাথায় বিরাট সাদা পাগড়ি বাঁধেন। চেহারা ছিল এমনিতেই নুরানি। এই লেবাসে মনে হতো বড় ভাইকে যেন ইরান তুরানের বাদশাহর ছেলে স্বপ্নাদেশে ফকিরি নিয়ে পথে বেরিয়েছে। ঘর–ছাড়া বড় ভাই মাঝে মাঝে ঘরে আসতেন টাকার জন্যে। বাবার কাছে তা পাওয়া যেত না। রাত দুপুরে বাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় মাকে ডাকতেন। মা বেরিয়ে এসে আঁচল আড়াল দিয়ে তাকে রান্নাঘরে বসিয়ে খেতে দিতেন। ঘুমন্ত স্বামীর বালিশের নিচ থেকে চাবি চুরি করে টাকা বের করে দিতেন। বড় ভাই সেই রাতেই গ্রাম ছেড়ে আবার চলে যেতেন মাস দুমাসের জন্যে। কোথায় কোন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে থাকতেন, কোন মাজারে বসে জেকের করতেন, হানাফিদের সঙ্গে বিবাদ পাকিয়ে তুলতেন তার সঠিক খবর কেউ জানতো না।
বাবা মারা যাবার পরও সে আদত গেল না বড় ভাইয়ের। সংসার ভেঙ্গে পড়তে লাগল। মার পক্ষে সম্ভব হলো না সব জমিজমা থেকে ধান আদায় করা, তার বিলি বন্দোবস্ত করা। গাছের আম–কাঁঠাল পাড়া পড়শি পেড়ে খেতে লাগল, চুরি হতে শুরু করল, মা কিছু করতে পারলেন না। ঘরে এক সোমত্ত মেয়ে আর তিনি, আর তো কোনো ব্যাটা ছেলে নেই। বড় ভাইকে কতবার বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন মা, তবু তিনি ফিরলেন না। মা বললেন, বাবা তোর ফকিরি করতে হয়, জেকের করতে হয়, বাহাস করতে হয় ভিটেয় এসে কর। কেউ তোকে বাধা দেবে না। তোর বাবা তুই মুহম্মদী হয়েছিস বলে বাড়িতে উঠতে না দিলেও আমি কিছু বলব না। তুই যেমন চাস তেমনি হবে।
কিন্তু বড় ভাইর মনে যেন তখন ঘোর লেগেছে। কঠিন হাতে মার বাড়ানো হাত সরিয়ে দিয়ে বলতেন, সংসারের লোভ আমাকে দেখিও না মা। যে সংসারের সন্ধান আমি পেয়েছি তার খবর তুমি কী জানো?
ভণ্ড, পাষাণ্ড! ইদ্রিস ডাক্তার দাতে দাঁত চেপে তিস্তার প্ল্যাটফরমে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চারণ করল। বলল, তাই যদি হবে তাহলে অনাথা মায়ের কাছে হাত পাততে আসিস কোন লজ্জায়? ফকিরের আবার টাকার দরকার কী? এত যে আল্লাবিল্লা করিস তাও তো আকাশ কুঁড়ে টাকার বৃষ্টি হয় না। টাকার জন্যে তো সেই সংসারেই আসতে হয়। ভণ্ড কোথাকার। নিজের সঙ্গেই এতগুলো কথা বলবার পর ভেতরের উত্তেজনা খানিকটা কমে এলো ইদ্রিসের। মা টাকা পাঠাতে পারেনি বলে যে এলোপ্যাথি পড়তে সে পারেনি তার জন্যে মনটা তেতো হয়ে গেল না আবার। কেমন মমতায় ভরে উঠল বুকটা। এমনকি বড় ভাইয়ের জন্যেও একটু টনটন করে উঠল শরীরের ভেতরে কেথায় যেন।
একবার তো সে ভেবেছিল নাম যখন ক্যামবেল থেকে কাটাই গেল মাইনে আর মেস ভাড়ার অভাবে। সে ফিরে যাবে সিরাজগঞ্জে, তার গণ্ড গ্রামে। সংসার দেখবে। বোনটাকে বিয়ে দেবে। মার সেবাযত্ন করবে। শেষ বয়সে মা যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা করবে। আর তার নিজের ভবিষ্যৎ? হোক না, যা কপালে লেখা আছে, তাই হোক। হালচাষ নিয়ে থাকতে খুব যদি খারাপ লাগে তো গাঁয়ের মকতবে মাস্টারি করবে। মাস্টারি করাটাও একটা বড় কাজ।
আসলে সারাজীবন সে একটা কিছু করতে চেয়েছে, বড় একটা কিছু। কিন্তু সেই বড় কাজটা কী, তা নিজেও কোনদিন ভালো করে বুঝে উঠতে পারে নি। বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ কেউ ইংরেজি পড়েনি। সে জেদ করে, বাবার সঙ্গে বিস্তর ঝোলাঝুলি, কাদাকাটি করে চৌবাড়ির স্কুলে ইংরেজি পড়তে গিয়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার দরুণ বাড়ি এসে চৌবাড়ির সেকেণ্ড টিচার যখন বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, আপনার ছেলেটা লেখাপড়া শিখলে কালে একজন মানুষ হবে, তখন সেই প্রশংসা শুনে বাবার মনটাও বেশ নরোম হয়ে গিয়েছিল।
শুধু সে নিজে ভর্তি হয়েই ক্ষান্ত হয় নি। বড় ভাই পড়তেন মকতবে, তাকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে ইংরেজি স্কুলে টেনে নিয়ে এসেছিলেন। তখন বড় ভাই তার কথা শুনতেন। তখন বড় ভাই ইদ্রিস ছাড়া কাউকে বুঝতেন না।
সেই ছেলেবেলাতেই ইদ্রিস স্বপ্ন দেখত, দুভাই তারা ইংরেজি পড়ে মস্ত বড় হয়ে গেছে। দেশের লোক হাটমাঠ ভেঙ্গে আসছে তাদের দেখতে। জেলার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট খাস হুকুমবরদার পাঠাচ্ছেন বড় চাকরির পয়গাম দিয়ে। ইদ্রিস কল্পনায় দেখতে পেত কলকাতাকে বুড়ি দাদির কিস্সায় শোনা বাগদাদ দামেস্কের মতো ঝলমলে, মণিমুক্তো পথে পথে ছড়ানো, রং বেরংয়ের রোশনাই জ্বলা, বাদ্য বাজনায় ডগমগ করতে থাকা কলকাতা। সেই কলকাতায় যাবে তারা।
তা হলো অন্যরকম। সেকেণ্ড ক্লাশে পড়তে পড়তে বড় ভাই মহম্মদী হয়ে গেলেন। কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল তা জানতেও পারল না ইদ্রিস। তবে কানাঘুষোয় শুনেছিল শাজাদপুরের কোন এক জেলার মেয়ের রূপ নাকি তাঁকে টেনেছিল। তারা ছিল মহম্মদী। বড় ভাইও তাই হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কেন হয়নি তা ইদ্রিস শত চেষ্টা করেও জানতে পারে নি। তাছাড়া তখন চলছিল তার এন্ট্রান্স পাশের পড়া। দম নেবার ফুরসৎ ছিল না। বলতে গেলে।