ইদ্রিস একটা বেঞ্চের দিকে লক্ষ্য করে এগুতেই কিসের সঙ্গে হোঁচট খেল প্রচণ্ড। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা টনটন করে উঠলো। ইস। বেঞ্চের ওপর বসে পায়ে হাত বুলোতে লাগল সে।
হঠাৎ মনে পড়ল, সে যখন বিয়ে করতে যাচ্ছিল হোঁচট খেয়েছিল এমনি। খুব দূরে কেউ ডেকে উঠল। শীতে এখানে কখনো কখনো বাঘ দেখা যায়। কান পাতল ইদ্রিস। অনেকক্ষণ পর ফেউটা আবার ডাকলো। মনের মধ্যে কেমন ভয় ভয় করল একবার। তবু সে বসে রইল সেখানে।
মা তাকে বলেছিলেন, শুভ কাজে বাধা পড়ল, একটু দাঁড়িয়ে যা।
আগে এই সব কথা মনে করে ভারী রাগ হতো তার। একটা কিছু প্রতিশোধ নেবার জন্যে নিসপিস করত হাতটা। পতিদহে এসে অবধি সে ভাবটা কী করে যেন কেটে গেছে। আজ সন্ধ্যেই তার মন কাঁদছিল বড় ভাইয়ের জন্য। দুঃখ হচ্ছিল তিনি একটা চিঠি দিলেন না বলে। গল্পের মতো মনে হয় সব।
ব্ৰহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে শিবালয়ে পৌঁছুতে হবে। শিবালয় থেকে গয়নার নৌকোয় রহিমগঞ্জ। রহিমগঞ্জে সম্বন্ধ ঠিক হয়েছে ইদ্রিসের। বরযাত্রী বলতে বড় ভাই আর চাচা মিয়া।
চাচা মিয়া পথঘাট চেনেন। জানেন গয়নার নৌকো কখন ছাড়ে। শিবালয়ে এসে ভোর হলো। সারি সারি মিষ্টির দোকান আছে ঘাটে। সেখানে পেট পুরে মিষ্টি খেল ওরা। ইদ্রিস ভাল করে কিছু খেতে পারল না। হাজার হোক, বিয়ে করতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটা কী হয় কী হয় ভাব। পাকস্থলী একেবারে কঠিন হয়ে আছে উদ্বেগে।
আগ বাড়িয়ে নেবার জন্যে শিবালয়ে লোক আসার কথা ছিল। কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না। চাচা মিয়া অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন তাকে। বাজারের কয়েকটা দোকানে জিগ্যেসাবাদ পর্যন্ত করলেন। কিন্তু কোনো সন্ধানই মিলল না।
কেমুন কথা বাজান।
চাচা মিয়া চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
আমরাই রওয়ানা দেই গা। কইছিল লোক পাঠাইবো। অবশ্য সঠিক কইরা কিছু কয় নাই। আল্লা ভরসা। দেরি করমু না আর। আসো। রহিমগঞ্জে কোন্ গয়না যায় গো?
পারে দাঁড়িয়ে চাচা হাঁক পাড়েন।
এক নাও থেকে মাঝিরা আওয়াজ দেয়, আসেন, এই নায়ে আসেন। তারপর ভালো করে এক মাঝি নিরিখ করে তাদের। বলে, মিয়া সাবরা রহিমগঞ্জে কার বাড়িতে যাইবেন?
ক্যান, তা দিয়া কী দরকার?
না, জিগাইলাম। বরযাত্রী মনে অয়।
তাই বাপু।
তাইলে আসেন। আপনাগো লইয়া যওনের লিগা এক ব্যাটা আইছিল। কাইল রাইত ভরা নায়ে বইসা গাঞ্জা টানছে। আহেন, এই নায়েই বেহুঁশ অইয়া পইড়া আছে হে।
কও কী?
মাঝিরা দাঁত বের করে হাসে। খুব মজা পেয়েছে তারা। বিয়ের বরকে আগু বাড়িয়ে নিতে এসে গাঁজা টেনে চিৎ হয়ে আছে, আর ওদিকে বর ঘুরছে বোকা বলদের মতো।
আহেন, আহেন মিয়া সাবরা।
কাণ্ড দেখে তো বড় ভাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
শালার এরা ভদ্রলোকই না। গাঁজাখোররে পাঠায় ভদ্রলোক হলে? কেমুন জাগায় সম্বন্ধ করছেন চাচা মিয়া।
ন্যাও বাপু আর দিক কইরো না। ভালো খারাপ দুই জাত নিয়াই দুনিয়া। হের তুমি করবা কী?
বেলা তিনটে নাগাদ নাও এসে ভিড়ল রহিমগঞ্জের ঘাটে। না এখানে কোনো ত্রুটি নেই অভ্যর্থনার। নৌকো থেকেই দেখা যাচ্ছিল পাড়ে কয়েকজন প্রৌঢ় এক পাল ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সবার পরনে পরিষ্কার করে কাঁচা কাপড়, মাথায় টুপি, পায়ে পাম্পশু। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল বর নিতে এসেছে তারা।
তাদের ভেতরে একজনকে চাচা মিয়া চিনলেন। নৌকো থেকেই সালাম বিনিময় হলো। সালামালাইকুম।
অন্যান্য যাত্রীরা নেমে যাবার পর কলিদার টুপি পরা লোকটা পাড় থেকে নৌকোয় উঠে বড় ভাইর হাত ধরে বললে, আসেন।
চাচা মিয়া তড়বড় করে বলে উঠলেন, আরে, হে জামাই না। জামাই ইনি। আর ইনি জামাইর বড় ভাই।
অপ্রস্তুত হয়ে লোকটা বলল, ঐ এ্যাক কথাই অইলো।
ঘাট থেকে কয়েক রশি পরেই বাড়িটা। হেঁটেই চলল সকলে। লোকটা দুঃখ করতে লাগল, বুছ লাইন ভাই সাব। গায়ের সে অবস্থাও নাই, জলুসও নাই। আগে তিন তিনখান পালকি আছিল। এহন একখানও পাইবেন না। বহুৎ কোশিস করছি পালকির জইন্যে। মাফ কইরা দিয়েন।
বাংলা ঘরটাকে সাজানো হয়েছে বিয়ের জন্যে। ঘর থেকে সব কিছু বের করে সারা মেঝে জুড়ে ধবধবে ফরাস পেতে দেয়া হয়েছে। তার মাঝখানে মখমলের জায়নামাজ বিছানো। সেখানে হাত ধরে বসানো হলো ইদ্রিসকে। শরবৎ এলো, পাখা এলো। ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল বৌ ঝিয়েরা।
একটু পরে লোকটা এসে খবর দিল, গোসল করনের ব্যবস্থা অইছে। দামাদ মিয়া আসেন। আপনেরাও চলেন।
গোসল করে পোর্টম্যান্টো খুলে আচকান পাজামা বের করে পরল ইদ্রিস। বড় ভাই মাথায় বাঁধলেন দশ প্যাঁচের পাগড়ি। চোখে ঘন করে সুরমা দিলেন। যুবক দরবেশের মতো ধবধব করতে লাগল তার চেহারা। ছবিটা ইদ্রিসের চোখে এখনো লেগে রয়েছে।
বাংলা ঘরের পাশে এই ঘরটা বরযাত্রী দুজনের জন্যে। সেখানেই কাপড় বদলানো হচ্ছিল। চাচা মিয়া বললেন, ইদ্রিস তুমি বসো বাজান আমরা ঘুরনা দিয়া আসি।
আধ ঘণ্টার মতো একা ছিল ইদ্রিস! ঠিক একা বলা যায় না বাড়ির কিছু ছেলেপুলে ঘিরে রেখেছিল তাকে। গলা জড়াজড়ি করে তাকে দেখছিল ওরা বড় বড় চোখে। ইদ্রিস দুএকজনের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুবিধে হয় নি।
ইদ্রিসের পরে মনে হয়েছে, ঐ আধঘণ্টা যে বড় ভাই আর চাচা মিয়া বাইরে ছিলেন, কথাটা হয়েছে তখনই।