হাজি সাহেবের স্ত্রী ইদ্রিসকে ডেকে পাঠাতে বলেছিলেন। বছির এসে দেখে, ইদ্রিস রোগী দেখতে বেরিয়ে গেছে। সেই থেকে বাড়ির সবাই পথ চেয়ে তার জন্যে। এক্ষুণি তাকে ওষুধ দিতে হবে।
ইদ্রিস বলে, চল বাবা, দেখি কী হয়েছে।
সাইকেল রেখে সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াল ইদ্রিস। মৌলবি সাহেব সঙ্গী হলেন। বলতে লাগলেন, দাওয়াইর কাম ন ডাক্তার ছাব। আঁই ভালা দোয়া জানি, আঁই কই পারি, দোয়া পড়ি ঝাড়ি দিলে ভালা হই যাইতো।
অন্দর মহলের বার দরোজায় এসে থামলো ইদ্রিস। বছির ভেতর থেকে এক চট্কা ঘুরে এসেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অন্দরে। বসবার ঘরে চেয়ার টেনে দিল তাকে। মৌলবি সাহেব নিজেই একটা আসন টেনে বসে পড়লেন।
ভেতরে এর আগে আর কখনো আসেনি ইদ্রিস। চোখ যেন জুড়িয়ে গেল তার। মেহগিনি কাঠের কী সুন্দর নকশা তোলা সব আসবাব! গালিচা বিছানো। দেয়ালে বাঁধানো ফটোগ্রাফ। এক পাশে লেখাপড়ার টেবিল। মোটা মোটা বই তাতে সাজানো। মাথার ওপরে জ্বলছে ঝকঝকে চোদ্দ ল্যাম্প।
হাজি সাহেবের স্ত্রী পর্দার ওপাশে এসে দাঁড়ালেন। কথা হতে লাগল বছিরের মারফৎ। নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। বছির আগে যা বলেছিল তাই আরেকবার বললেন উনি। ইদ্রিস বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে
ইতস্তত করল সে। সে যা বলতে চাইছিল তা হচ্ছে, রোগিনীকে একবার দেখা দরকার। কিন্তু কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না। এতদিন সে আছে এখানে, মনে হয় এরা পর্দা মানেন ষোলআনা। পর পুরুষকে ঘরের মেয়ে দেখতে দেবে না।
এদিকে মৌলবি সাহেব সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তিনি আম্মা বলে এক লম্বা হাঁক পেড়ে নিবেদন করলেন, ডাক্তারের ওষুধ তারা নিতে পারেন, কিন্তু রোগিনী ভালো হবে না। কারণ, তিনি স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন, জ্বীন আছর করেছে। জ্বীনের দাওয়াই আল্লার কালাম। বুবুজানের হাল শুনেই তিনি ছুটে এসেছেন। এখন যদি তারা অনুমতি করেন তো তিনি গিয়ে। ঝাঁড়ফুক করতে পারেন। সবশেষে তিনি আরেকবার বললেন, এবং বেশ জোরের সঙ্গেই, ওষুধে কিছু কাজ হবে না।
অন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা হাজি সাহেবের স্ত্রীর মনোভাব চট করে বাইরে থেকে টের পাওয়া গেল না। ইদ্রিস এটুকু অনুভব করতে লাগল। এর প্রতিবাদ করা দরকার। কিন্তু হাজি সাহেবের স্ত্রী কী বলেন সেটা আগে শোনা ভালো।
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন দুপক্ষ।
মৌলবি সাহেব আবার হাঁক দিয়ে উঠলেন, আম্মা। ইয়ে জরুর জ্বীন কা কাম হ্যাঁয়। আপ বড়া দেখকে তামাকা এক বর্তন লাইয়ে পানি ভরকে। হাম দো মিনিট মে জ্বীন কো ভাগ্যা দেবতা হু।
আর বছিরকে বললেন, খাড়া খাড়া কেয়া দেখতা হ্যয়? জলজি করো।
ইদ্রিসের গোড়া থেকেই খারাপ লাগছিল বিনা আমন্ত্রণে মৌলবি সাহেবের অন্দর মহলে ঢোকাটা। তার ওপরে তার মুখে উর্দু শুনে তার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সে বছিরকে বলল, আম্মা হুজুরাণীকে বলো যদি ঝাড়ফুক করাতে হয় তো আমি চলি। মৌলবি সাহেব রইলেন। বছির নিবেদন করে জবাব শুনে এলো। বলল, তোমরাও থাকেন ডাক্তারের ঘর। আম্মা কইলে, ডাক্তারের থাকা যাইবে।
ইদ্রিস বুঝতে পারল, ঝাড়ফুকটাই ভালো মনে করছেন হাজি সাহেবের স্ত্রী। তাকে থাকতে বলা শুধু ভদ্রতার খাতিরে। সে উঠে দাঁড়াল। বলল, না বছির, আমি রোগী দেখে ফিরেছি বহুদূর থেকে। ঘরে যাচ্ছি। দরকার হলে খবর দিও। আমাকে একটু পথ দেখাও বাবা। ভেতর থেকে শাড়ির খসখস চুড়ির রিনিঝিনি উঠলো। মৌলবি সাহেব ঠোঁট ফোলানো হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন ইদ্রিসের দিকে। ইদ্রিস বেরিয়ে এলো।
বার দরোজায় দাঁড়িয়ে পড়ে বছিরকে সে বলল, মৌলবি সাহেবকে আগে ডাকলেই পারতি। আমার জন্যে রাত দুপুর করার কী দরকার ছিল?
মুই কী জানো।
আচ্ছা যা, তোকে আর কী বলব। ভাত দিয়েছিস?
আছে তোমার ঘরৎ।
ইদ্রিস মাঠটা লম্বা লম্বা পায়ে অতিক্রম করে এসে হাত মুখ ভালো করে ধুলো। মাথায় পানি দিল। পানি পড়তেই ভারী আরাম লাগলো তার। একটু কষ্ট হলো আয়েশার জন্যে, সেই না দেখা তরুণীর জন্যে, যে তাকে একদিন দুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল শরীর খারাপ শুনে। এতক্ষণে মৌলবি তার কেরামতি দেখাতে শুরু করেছে নিশ্চয়ই।
আয়েশার কথা বারবার মনে হচ্ছিল তার। তাকে সে চোখে দেখেনি কখনো। আয়েশা তার কাছে শুধু একটা নাম। এখন যেন সেই নামটাকে অবলম্বন করে অস্পষ্ট একটা মূর্তি গড়ে উঠতে লাগল। হাজি জয়েনউদ্দিন সুপুরুষ। তাঁর ভাগনি নিশ্চয়ই দেখতে সুন্দরী হবে। একবার বিয়ে হয়েছিল শুনেছে ইদ্রিস। তালাক হয়ে গেছে। কেন হয়েছে? বছিরের কাছ থেকে স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি। আর তারও এর আগে তেমন কৌতূহল কিছু ছিল না।
ঘুম আসে না ইদ্রিসের।
মৌলবি সাহেব অন্দর থেকে এখনো ফেরেন নি। রাত কত হলো! বছির যদি একবার আসতো তাহলে ভেতরের সংবাদ জানা সেত। সে থেকে গেলেই পারত অন্দর বাড়িতে। তাতে অন্তত এই অস্বস্তি ভোগ করতে হতো না।
বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে হাঁটতে লাগল ইদ্রিস। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। কনকন করছে উত্তুরে হাওয়া। গায়ে কাঁপন উঠছে। ভেতর থেকে চাঁদর এনে গায়ে জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইদ্রিস এলো কাঁচারি বাড়ির বারান্দায়। চৌকিদার ঘুমিয়ে আছে একটা হেলনা বেঞ্চে পা গুটিয়ে হাতের ওপরে মাথা রেখে। পরে পরে আরও কয়েকটা বেঞ্চ। অতিথ পথিক রায়ত এলে বসে এখানে। দিনের বেলায় ভারী সরগরম হয়ে থাকে বারান্দাটা।