দূর, দূর! এ সব কী ভাবছে! কদিন হলো দেখছে ইদ্রিস, তার ভেতরটা যেন তার কাছেই অচেনা হয়ে উঠেছে। সে তো অনেক দিন থেকেই একা; কিন্তু আগে সেটা চোখে পড়ত না, এখন পড়ে। কদিন থেকে বাড়ির কথা মনে পড়ে কারণে অকারণে। পৃথিবীতে অসম্ভব অবাস্তব যা কিছু হতে পারে সব যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কিংবা হতে চায়। নিজেকে মনে হয় দুর্বল, অসহায়।
মনে হয়, খুব প্রবল একটা স্রোতে ভেসে চলেছে সে। তার নিজের যেন করণীয় কিছু নেই। যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যাবে সে।
কৃষ্ণপক্ষ চলছে। পথ–ঘাট ভালো করে কিছু দেখা যায় না। প্রায় সবটাই আন্দাজের ওপর সাইকেল চালাতে হচ্ছে। তার দরুণ এক ঘণ্টার পথ পেরুতে লাগছে দুঘণ্টা। এই হরিরামপুরের শ্মশান পেরুলো। চিতা জ্বলছে একটা। অন্ধকারের একটা পাড়ে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। সেদিকে তাকাতে যাচ্ছিল ইদ্রিস। হঠাৎ দেখে, দুটো লোকের ঘাড়ে সাইকেল তুলে দিচ্ছিল সে। এ অঞ্চলে সাইকেল আছে, একমাত্র তার। কাজেই অন্ধকারেও তারা চিনতে পারল তাকে। হেঁকে বলল, কাই বাহে, কলাখাওয়া ডাক্তার?
হা। তোমরা?
হরিরামপুরের অছিমদ্দি আর হাগুরা খাও।
ছাওয়া ভাল আছে তোমার?
এককোণা আসেন না কেনে হামার বাড়ি? ছাওয়াক দেখি যাইবেন। গুয়া পানও খাইবেন। অছিমদ্দির ছেলেটা কৃমিতে ভারী কষ্ট পাচ্ছিল। তার ওপরে ম্যালেরিয়া তো আছেই। এক বাঁক পরেই তার বাড়ি। এত কাছে যখন একবার দেখে গেলে হয়। সাইকেল ফেরাল ইদ্রিস। জাম গাছের সঙ্গে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল সে। বলল, তাড়াতাড়ি করো ভাই অছিমদ্দি। অছিমদ্দি ভেতরে যাবার পরেই ভেতর থেকে তার কুদ্ধ গলা শোনা গেল। আর পরক্ষণে প্রহারের আওয়াজ। অছিমদ্দির ছেলেটা কেঁদে কঁকিয়ে উঠল।
ডিবে এক হাতে, আরেক হাতে ছেলেটাকে টানতে টানতে অছিমদ্দি এলো সামনে।
ব্যাপার কী?
কন কেনে ডাক্তারের ঘর। মুই মানা করি গেছং গুড় খাবু না, আসি দ্যাঁহো গুড় খাবার নাইগছে জানোয়ার কোন্টেকার।
ইদ্রিসই মানা করেছিল ছেলেটাকে মিষ্টি কিছু দিতে। সে বলল, আহা ছেলেমানুষ তো। ছাওয়া পোওয়াক তাই বুলি মারেন তোমরা?
ডিবেটা ধরে শিউরে উঠল ইদ্রিস। ছেলেটার চোখ কংকালের মতো ভেতরে বসে গেছে। কালি পড়েছে। বুকের সবকটা হাড় গোনা যাচ্ছে। ঝুলে পড়েছে ঢাকের মতো পেটটা। কোমরে ঘুনসি ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। শেষ যখন দেখেছিল প্লীহাটা তখনো এত বড় ছিল না। ছেলেটা তখনো ফুলে ফুলে উঠছে কান্নায়। ঠোঁট গাল দুহাত চটচট করছে আখের গুড়ের রসে।
পেটটা একবার টিপে দেখল তার। নাড়ি দেখল। কিছু জিজ্ঞেসাবাদ করল। তারপর বলল, কাল ডিস্পেন্সরীতে আসেন তোমরা। ওষুধ দেমো ভাল দেখি।
যান কোটে? গুয়া পান মুখোৎ দিয়া যান।
পেছন থেকে অছিমদ্দি ডাকে। কিন্তু সে আর থামে না। অন্য সময় হলে হয়ত দুদণ্ড দাঁড়াতো। আজ ছেলেটাকে দেখেই তার মনে হয়েছে, বাঁচবে না। এ রকম একটা দুধের শিশু মারা যাবে, ভাবতেই ভেতরটা শিউরে উঠেছে তার। এক মুহূর্ত আর দাঁড়াতে পারেনি সে।
কাঁচা সড়ক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরতে ফিরতে তার মনে পড়ে গেল বড় ভাইয়ের কথা। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই কুড়িটা টাকা সে মনিঅর্ডার করে দিয়েছিল। লিখেছিল, বড় ভাই যেন একজোড়া ভালো জুতো কিনে নেন, আর মাকে একটা মখমলের জায়নামাজ কিনে দেন। কুপনটা ফেরৎ এসেছে অনেকদিন। কিন্তু কোনো চিঠি পায় নি সে। বড় ভাইও দেন নি, মাও না। মা তো লিখতেই জানেন না। বড় ভাই যদি লিখে না দেন তো মার হাত পা বাঁধা।
বড় ভাই বোধহয় এখনো তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। দোষ তো তারই। তবু ইদ্রিস সব ভুলে গিয়েছে। পতিদহে এসেই চিঠি দিয়েছে এমনভাবে যেন দুভায়ে কোনোদিনই কিছু হয় নি, আগের মতোই সদ্ভাব আছে। সে চিঠির উত্তরও পায় নি সে।
খুব দুঃখ হলো ইদ্রিসের। ছেলেবেলায় একবার তার জ্বর হয়েছিল, বড় ভাই সারারাত জেগে মাথায় পানি দিয়েছিল তার। সে ভাই বুঝি মারা গেছে। আর কোনোদিন তার দেখা পাবে না সে।
যা কিছু হয়ে গেছে, তার জন্যে তো সে দেশ ছেড়েই চলে এসেছে। এখনো যদি সে কথা মনে রাখেন বড় ভাই, তাহলে অবিচার করা হয়।
ইদ্রিসের ইচ্ছে হয়, বড় ভাই যদি গোঁয়ারতুমি না করে কোনো একটা কাজকর্ম ধরতেন! আজকাল ইংরেজি লেখাপড়া না জানলে বড় হওয়া যায় না। তাই নিজে জেদ ধরে বড় ভাইকে টেনে নিয়ে এসেছিল সে ইংরেজি, ইস্কুলে। কিন্তু কিছুই লাভ হলো না শেষ অবধি। ইদ্রিস মনে মনে ভাবে, সে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, একটু গুছিয়ে নিতে পারে, তাহলে বড় ভাইকে নিয়ে আসবে দেশ থেকে। আর কিছু না হোক, হোমিওপ্যাথি শিখতে বলবে তাঁকে। দেশে ডাক্তারের বড় অভাব। ইদ্রিস একা বড় হতে চায় না, সে যদি বড় হবে তো বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়েই হবে।
এই সব ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে পৌঁছে ইদ্রিস। দেখে মৌলবি সাহেব আর বছির কথা বলছে। তাকে দেখেই মৌলবি সাহেব দৌড়ে এলেন। বললেন, আইলেননি ভাই ছাব!
দেখছেনই তো।
এক কাম হই গেছে।
মৌলবি সাহেবের চোখ চকচক করতে থাকে। কানের কাছে মুখ এনে বলেন, বুবুজানেরে জ্বীনে ধইচ্ছে।
তাকে উপেক্ষা করে ইদ্রিস বছিরকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে রে?
যা শোনা গেল তা এই সন্ধ্যের সময় ওজু করতে পুকুর ঘাটে গিয়েছিল হাজি সাহেবের ভাগনি আয়েশা বিবি। সেখানে কী হয়েছে কেউ বলতে পারে না। এক ঝি গিয়ে দেখে দাঁত কপাটি লেগে ঘাটের ওপর পড়ে আছে আয়েশা। তাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছে ভেতরে। মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। কিন্তু মানুষ চিনতে পারছে না। ভুল বকছে। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছে। তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো। যাচ্ছে। এদিকে হাজি সাহেব বাড়িতে নেই। তিনি দুদিন হলো সদরে গেছেন কী একটা কাজে।