সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ডিস্পেন্সরীতে রোগী দেখে। দুপুরে গোসল করে চারটি খেয়ে নিয়ে নামাজ পড়ে। তারপর লিখতে বসে রিপোর্ট। রিপোর্ট শেষ হতে না হতেই কল আসে। বেরুতে হয় এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে রোগী দেখতে।
গাঁয়ের লোক ডাকতে আসতো ঘোড়া নিয়ে। ঘোড়ার পিঠে যাবেন ডাক্তার। কিন্তু ইদ্রিসের ভারী অস্বস্তি হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে। কথাটা হাজি সাহেব জানতে পেরে সাইকেল কিনে দিয়েছেন তাকে। ঝকঝকে নতুন, তিন বন্দুক মার্কা বি–এস–এ সাইকেল। রডের সঙ্গে পাম্প মেশিন আঁটা। সাইকেলের ত্রিভুজাকৃতি পেটে কাপড়ের থলে লাগিয়ে নিয়েছে সে। তাতে থাকে স্টেথসকোপ, ওষুধের বাক্স, নামাজ পড়বার জন্যে টুপি গামছা। সিটের পেছনে চামড়ার খাপে লিক মেরামতের সাজসরঞ্জাম। বিকেল হতে না হতেই এখন কুয়াশা নেবে আসে। থোকা থোকা কাশফুলের মতো ভেসে বেড়ায় মাঠের ওপর, ঝুলে থাকে গাছের নিচু ডালে, খড়ের চালায়। কেমন শান্ত স্তব্ধ মনে হয় চারদিক। মনে হয়, খুব ভালো, খুব মিষ্টি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরে। গলা পর্যন্ত বোম লাগিয়ে হাঁটতে বেরোয় ইদ্রিস। একা লাগে আরো বেশি করে পথের ওপরে উদ্দেশ্যহীন চলতে গিয়ে। একাকীত্বটুকু নেশার মতো জড়িয়ে ধরে ইদ্রিসকে। মনটা ক্ষমাশীল হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে সব মিথ্যে মনে হয়। যত বিরোধ, যত দ্বন্দ্ব সব তুচ্ছ হয়ে যায় তার কাছে। ক্ষমাই এই মুহূর্তের মূল সুর হয়ে ওঠে তার মনে। কোথায় কোন্ ছেলেবেলায় শীত রাতে এক যাত্রা শুনতে গিয়ে গানটা ভারী ভালো লেগেছিল। অতল অতীত তোলপাড় করে কথাগুলো মনে পড়ে তার। একটু একটু। আবার মনে পড়ে না। খানিকটা স্মৃতি থেকে, খানিকটা নিজে বানিয়ে ইদ্রিস গুণগুণ করে, নিশি না পোহালে মন অভাগিনীর ভরসা কী? তারপর সন্ধ্যে হয়। আকাশটা নীলাক্ত লাল দেখায়। ডানা ঝটপট করে পাখিরা বাসায় ফেরে। এক দুই তিন চার। কালো কালো পাখিরা কোন্ মাঠঘাট পেরিয়ে তাল সুপারির বনের পাশ দিয়ে চলেছে। কোথা থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। মনে হয় কোনো মানুষ নয়, প্রকৃতিই যেন ডাক দিচ্ছে যোজন দূর থেকে। পথের পাশে কারো বাড়িতে হাঁক দেয় ইদ্রিস। নামাজটা। সেখানেই সেরে নেয় সে। তারপর ঘরমুখো হয়।
ঘরে এসে বারান্দায় কড়ি কাঠ থেকে ঝোলানো লণ্ঠন নাবিয়ে চিমনি সাফ করে। সলতে টেনে তোলে। আলো জ্বালে। দূরে শেয়ালের আনাগোনা শুরু হয়। দুদ্দাড় করে এক আধটা দৌড়ে মাঠ পেরোয়। কোনদিন ইদ্রিস চিঠি লেখে বসে বসে, ডাক্তারি বই পড়ে কোনদিন, আবার এক একদিন অমিয় ধারা খুলে মনে মনে আবৃত্তি করে।
এশার নামাজের আগেই বছির এসে হাঁক দেয়, ভাত দেইম গো ডাক্তারের ব্যাটা?
হাঁকটা অভ্যাসবশত দেয় সে। হাতে গামলা ধরাই থাকে। যতক্ষণ সে খায় বছির পাশে। দাঁড়িয়ে গল্প করে। তার গল্পের প্রধান বক্তব্য : বিশ্বসংসারের সবাই পাগল, এত পাগল নিয়ে সে আর পারে না।
আবার কোনো কোনো দিন রোগী দেখে ফিরতে রাত হয়ে যায় ইদ্রিসের। এক প্রহর, দুই প্রহর। ফিরে এসে দেখে লণ্ঠনটা কে জ্বালিয়ে সলতে ছোট করে রেখেছে। টেবিলের ওপর ঢাকা দেয়া আছে ভাত তরকারি। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয় ইদ্রিস। বারান্দায় রাখা বালতির পানিতে মুখ গলা পা ধুয়ে খেতে বসে সে। পাশের ঘর থেকে মসজিদের মৌলবি সাহেব সাড়া দেন, ডাক্তার সাব নি?
জি হ্যাঁ।
একটু পরে মৌলবি সাহেব এসে জাঁকিয়ে বসেন। কী করে যে আলাপটা রোজ জ্বীন পরীর দিকে চলে যায় তা ভেবে পায় না ইদ্রিস। রোজই সে অন্যমনস্কতা থেকে জেগে উঠে দেখে কোথায় কার বৌকে কবে জ্বীন ধরেছিল সেই গল্প শুরু হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে মৌলবি সাহেবের উৎসাহ অসীম। মাথাটাও খুব খোলে। বর্ণনা দেন জীবন্ত ভাষায়। রূপ বর্ণনায় রীতিমত প্রতিভাবান মনে হয় তাকে। সব গল্পের শেষেই মৌলবি সাহেব দেখা দেন উদ্ধার কর্তা রূপে।
অসহ্য, অশ্লীল মনে হয় লোকটাকে। ইদ্রিস হুঁ হাঁ ছাড়া বিশেষ প্রায় কিছুই বলে না। কিন্তু পার পাওয়া যায় না তাতে। লেবি সাহেব প্রতিদিনই হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, জ্বীন পরীতে ইদ্রিসের বিশ্বাস আছে কিনা!
প্রতিদিনই ইদ্রিস বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে মৌলবি সাহেব। কাল আলাপ হবে আবার। মৌলবি সাহেব বিরস মুখে ঘোঁৎ ঘোৎ করতে করতে খড়মের আওয়াজ তুলে পাশের ঘরে চলে যান।
সেদিন এমনি রোগী দেখে ফিরতে রাত দশটা হয়ে গেল। রোগীটাকে বাঁচাতে পারে নি ইদ্রিস। সান্নিপাতিক জ্বর। কিছুদিন থেকে চিকিৎসা চলছিল তার হাতেই। আজ বিকেলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ায় কল দিয়েছিল তাকে।
বেরিয়ে পড়েছিল আছরের নামাজ পড়েই। রোগী বাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। গিয়ে দেখে কান্নার রোল পড়ে গেছে বাড়িতে। খড়ের ঘ্রাণ আর মায়ের কান্না মিলে মিশে ভারী করুণ হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। হাত ধরে বুঝল, নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না রোগীর। একটা ওষুধ দিল সে। মালিশের ব্যবস্থা করল। ঘর থেকে ভিড় সরিয়ে দিল। কিন্তু শেষ অবধি কিছুতেই কিছু হলো না। আটটার দিকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।
হায়াত না থাকলে সে করবে কী? তবু যেন মনে হলো এ তারই পরাজয়। সে দুর্বল বলেই আজরাইল জয়ী হয়ে গেল আজ। মাথা নিচু করে সাইকেল ঠেলে বেরিয়ে এলো সে পথের ওপর। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল তারা ঝকঝক করছে দিগন্তের ওপরে। মা বলতেন, মানুষ মরে আকাশের তারা হয়ে যায়। একটা করে তোক মরলে আকাশে একটা তারা বাড়ে। সদ্য একজনকে মরতে দেখে এসে একাকী অন্ধকারে পথের ওপর দাঁড়িয়ে কথাটা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।