চৌকির ওপর চুপ করে বসে রইলো সে। অবাক হয়ে দেখল কুইনিন নিয়ে মনের মধ্যে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তার লেশমাত্র আর নেই। এ রকম কেন হলো, বুঝতে পারল না সে। দুপুরে খাবে না বলেছিল তখন সে রাগ করে। এখন এক বাটি দুধ খেয়ে খিদেটা যেন আরো চাগিয়ে উঠল।
হাসল ইদ্রিস। রাগ করে ভারী লাভ হলো তো?
আরে, রাগ সে করেছিলই বা কার ওপর?
এখানে সে চাকরি করতে এসেছে। কাজ নিয়ে কি রাগ করতে আছে? না সে রাগ চাকরি যে করে তার পোষায়?
হঠাৎ মনে পড়ল হাজি সাহেব তার কী এক অসুখের কথা একসময়ে বলবেন বলেছিলেন। বছিরের কথায় চোখ খুলে দিয়ে গেল তার। ছেলেপুলে হয় না—- এই অসুখ। সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলো হয়ত হাজি সাহেব।
কিন্তু সে তো এরকম কেস এর আগে কখনো হাতে পায় নি। তার বইতেও কিছু লেখা নেই। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে লিখলে হয়। হাজি সাহেবের জন্যে মনটা তার সহানুভূতিতে ভরে। উঠল। ইদ্রিস যখন বিয়ে করবে না বলে গো ধরেছিল তখন মা প্রায়ই বোঝাতেন, দ্যাখরে, ছাওয়াল না থাইকলে ঘরের আন্ধার যায় না।
ইদ্রিস তখনি কাগজ টেনে চার ভাঁজ করে ছিঁড়ে নিল। তারপর আসবার সময় শখ করে কেনা রাজা কলমটা বের করে চিঠি লিখতে বসল প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে।
কুইনিন নিয়ে যে বিরোধটা হয়েছিল তার আভাস দেবার ইচ্ছে ছিল চিঠিতে। এখন ভাবল, সে কথা থাক। শুধু জিগ্যেস করলেই হবে, কুইনিন তিনি অনুমোদন করেন কিনা। আর জিগ্যেস করবে—-নিঃসন্তান হাজি সাহেবের রৌদ্রতপ্ত চেহারাটা তার সামনে ভেসে উঠল।
৪. শীত পড়তে শুরু করেছে
শীত পড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে চার পাঁচটা মাস কেটে গেল। এর ভেতরে অনেক কিছু হয়ে গেছে। ইদ্রিস এখন এদের ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারে। তার কথা শুনে বুঝবার উপায় নেই সে ভাটির দেশের মানুষ। গোড়াতেই সে বুঝেছিল এদের মন জয় যদি করতে হয়, বিশ্বাস জন্মাতে হয় তাহলে এদের ভাষা শিখতে হবে। ভাটি থেকে আগে যারা এসেছিল, তাদের উদ্দেশ্যও খুব ভালো ছিল না, এদের ভাষা শেখার দরকারটাও তারা টের পেত না। বরং হাসাহাসি করত ভাষা শুনে।
ইদ্রিসের এখানে এক নাম চালু হয়ে গেছে। কলা খাওয়া ডাক্তার। একদিন হাটে গিয়ে দেখে সোনার টুকরোর মতো কড়ে আঙ্গুল সাইজের কলা বিক্রি হচ্ছে। নাম কী বাহে এই কলার?
চিনিচাম্পা।
বাহ, ভারী সুন্দর নাম তো।
কী দর দিছেন তোমরা?
সুকি সুকি পণ।
অর্থাৎ এক পণ এক সিকি। আশিটা চার আনায়।
আধ পণ ধরি দে মোক।
চল্লিশটা কলা নিয়ে সেখানেই একটা ছাড়িয়ে মুখে দিল ইদ্রিস। ভারী মিষ্টি আর তেমনি সুঘ্রাণ। কর্পূরের মতো মাতাল করা। খেতে খেতে কলার খোসার স্থূপ জমে গেল পায়ের কাছে।
তাকিয়ে দেখে ছোট খাটো একটা ভিড়ও জমে তার চারদিকে। গায়ের লোকেরা সওদা করতে এসে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে এই কাণ্ড দেখে! মুখ টিপে হাসছে। ফিসফিস করছে এ ওর কানে। ভারী মজা লেগেছে তাদের।
কী হে?
চল্লিশটার শেষ কলাটা মুখে পুরতে পুরতে ইদ্রিস বলে।
না, কিছু নোয়ায়।
দে, মোক আরো আধ পণ দে।
আরো চল্লিশটা কিনল ইদ্রিস।
চোখ কপালে উঠল জনতার। ইদ্রিস আরো গোটা দশেক খেল। মাথা দুলিয়ে বলল, অমৃত বুঝিস?
তাক আবার কী?
বুঝিস না। কী বুঝিস তাহলে? তোমরার চিনিচাম্পা অমৃত লাগিল আমার।
কী বুঝল, খুব হাসল সবাই।
সেই থেকে ইদ্রিসের নাম ছড়িয়ে পড়ল কলা খাওয়া ডাক্তার।
দূর দূরান্তে রোগী দেখতে গেলে, গাঁয়ের লোক তাকে এখন কলার ছড়া দেয়। বলে, খান তোমরা।
ইদ্রিস টের পায় ভেতর বাড়ির বৌ–ঝিয়েরাও উঁকি দিয়ে দেখছে তার কলা খাওয়া। খুব আমোদ লাগে তার।
আগে রোগী বাড়ি গেলে কিছু খেত না। চিড়ে মুড়ি মুড়কি দৈ ধরে দিত। ফিরিয়ে দিত। তাতে মনে কষ্ট পেত কেউ কেউ। কলার কথাটা চাউর হয়ে যাওয়ার পর সুবিধে হয়েছে। বাড়িওলাও ক্ষুণ্ণ হয় না, খিদেটাও যায়।
এদিকে তিস্তা থেকে কুড়িগ্রাম মিটার গেজ লাইন বসছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে। হাজি সাহেব মাঝে মাঝেই যান দেখতে। বলতে গেলে তাঁর একার চেষ্টায় এত বড় একটা কাজ হচ্ছে এ অঞ্চলে। তার রাত দিনের ভাবনা এখন—- রেললাইন। রেললাইন ছাড়া মুখে কোনো কথা নেই। ভাইসরয় কী বললেন, রেল কোম্পানির লাল মুখো আইরিশ এঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাকে রেলপথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে শুনে কী রায় দিয়েছিলেন, তার আপত্তি কোন কোন যুক্তিতে খণ্ডালেন হাজি সাহেব—- এইসব কথা এখন পতিদহের কাঁচারি বাড়ি গরম করে রাখে।
এঞ্জিনিয়ার বলেছিল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বড় এঁকেবেঁকে গেছে। তার ওপরে রেললাইন পাতা মানেই রেলও যাবে এঁকেবেঁকে। এতে গাড়ি খুব স্পীডে যেতে পারবে না। বড় জোড় ঘন্টায় পনেরো কুড়ি মাইল।
তা হোক।
হাজি সাহেব বলেছিলেন, নতুন পথ কাটতে সময়ও লাগবে, টাকাও লাগবে। এ অঞ্চলে মিটার গেজ লাইন আশু হওয়া দরকার। হাজার হাজার মণ উদ্বৃত্ত ধান চাল পাট শুপারি মহকুমার বাইরে যেতে পারছে না শুধু এই লাইনটার জন্যে। সরকারের কত বড় ক্ষতি। দেশের কতখানি অপচয়।
শেষ অবধি সেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ওপরেই রেললাইন বসছে। ইদ্রিসের বড় ইচ্ছে ছিল একবার দেখে আসবে কী করে রেল বসায়। কিন্তু সময় পায় না। আজকাল রোগী এত হচ্ছে যে একদণ্ড বিশ্রাম নেবার ফুরসৎ হয় না তার।