তা হোক। এরা বহুদিন ভুগছে। তুমি কুইনিন দাও।
বললাম তো, সেটা আমি পারি না।
তাহলে এসেছ কেন?
যদি আপনি নিজে একটু বলে কয়ে দিতেন! এ চিকিৎসায় ধৈর্য ধরতে হয়।
তুমি বলতে পারো না?
আমি বলেছি, কিন্তু ওরা শুনবে বলে মনে হলো না। কাল একজনও ফেরৎ আসবে বলে ভরসা পাচ্ছি না।
বেশ তো। কুইনিনই দাও না। ডিস্পেশারী খুলে যদি কারো উপকারই না হলো, তাহলে আর খোলা কেন? যাও, যা ভালো বোঝো করো গে। মনে রেখো, মরহুম আব্বাজানের নামে এ ডিস্পেন্সরী দিয়েছি। একেকটা রোগী ভালো হলে দোয়া পৌঁছুবে তার রুহে। বেলা অনেক হয়েছে, গোসল খাওয়ায় অনিয়ম করে কাজ করবে সেটা আমার পছন্দ নয়।
ভীষণ ক্ষুব্ধ মন নিয়ে ইদ্রিস তার ঘরে ফিরে এলো।
ঘর বলতে, কাছারির লাগোয়া মসজিদের পেছনে মাঠ, সেই মাঠ পারে অতিথ–পথিকের জন্যে চারচালা টিনের ঘর। মাঝখানে বেড়ার পার্টিশন করা। একটা কামরা ইদ্রিস ব্যবহার করছে।
বিছানায় এসে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলো সে। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না, হাজি সাহেবের সঙ্গে সেই তিস্তা থেকে কথায় কথায় তার বিরোধ হচ্ছে কেন? তার নিজের দোষ? সে কি একগুয়ে? তাও তো নয়। সে যা ভালো মনে করেছে, যুক্তি দিয়ে যা সঙ্গত মনে করেছে, তাই বলেছে সব সময়। তাতে যদি কেউ ক্ষুণ্ণ হন, রুষ্ট হন, তাহলে কী করতে পারে?
অনেকক্ষণ কড়িকাঠের দিকে গুম হয়ে তাকিয়ে রইল ইদ্রিস ডাক্তার। অন্দরমহল থেকে চাকর এসে তাড়া দিল গোসলের জন্যে। ইদ্রিস তাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিল। বলল, শরীর ভালো নেই। খাবো না এবেলা।
না, কাজটা বোধহয় ভালো হচ্ছে না। নতুন জায়গায় নতুন কাজে এসেই মনিবের সঙ্গে বিরোধ হলে লোকে তারই নিন্দে করবে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শুনলেই বা কী মনে করবেন? বড় মুখ করে তাকে পাঠিয়েছেন তিনি। আজ রাতেই প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে একটা চিঠি দেবে সে। হ্যাঁ তাই ভালো। তার কাছে পরামর্শ চাইবে ইদ্রিস। তিনি যদি কুইনিন ব্যবস্থা করতে বলেন তো হোক শাস্ত্র বিরুদ্ধ ওস্তাদের কথা শিরোধার্য করে সেকুইনিনই দেবে।
আর মাকেও চিঠি দেয়া হয় নি। তাকেও আজ লিখবে ইদ্রিস। বরং এখনই বসা যাক। সকালের রিপোর্ট লেখাও পড়ে আছে। ও বেলা যদি কেউ কল দিয়ে বসে তো আর সময়ই পাওয়া যাবে না।
এমন সময় জোহরের আজান পড়ল। দুপুরের তপ্ত মাঠ পেরিয়ে ভেসে আসা সেই আজানের ধ্বনিটাকে মনে হলো মড়ক লাগা গ্রামে কেউ আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করে বুকফাটা আর্তনাদ করছে। ধড়াস্ করে উঠলো ইদ্রিসের বুকের ভেতরটা। তওবা, তওবা। এ সব কী ভাবছে সে? অমঙ্গল ভাবতে নেই। অমঙ্গল ভাবলে নিজের অমঙ্গল হয়।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে পুকুরে নাইতে গেল ইদ্রিস। ফিরতি পথে নামাজটাও সেরে নিল সে। জামাত তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কাছারির কর্মচারীরাই জামাতের সামিল। নোয়াখালীর এক গাঢ় সুরমা পড়া মৌলবি ইমামতি করেন মসজিদে। তিনি ততক্ষণে হাত বেধে ফেলেছেন। ইদ্রিস প্রায় দৌড়ে এসে জামাতে সামিল হয়েছিল।
নামাজ শেষে মৌলবি সাহেব বললেন, আঁরে দয়াই দিবেন আপনে।
কাল আসবেন ডিস্পেন্সারীতে। সকালে।
আঁর লাইন। আঁর বিবি সাব হায়েজ লই বহুৎ তকলিফ পায় তারি।
খ্যা খ্যা করে মৌলবি সাহেব হাসলেন খানিক। আরো কী বলবার জন্যে ঘনিষ্ঠ হতেই ইদ্রিস বলল, আচ্ছা কাল শুনব।
নাহ, আজ সত্যি সত্যি মেজাজটা তার ভালো নেই। নইলে যে যা বলছে তা–ই অসহ্য লাগছে। কেন? হতেও তো পারে, মৌলবি সাহেব তার স্ত্রীর অসুখের জন্যে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ইদ্রিসের যেন মনে হলো, অসুখের কথাটা গৌণ, আসলে লোকটা রোগ বর্ণনার ছলে নিজের ক্ষুধার্ত কামচেতনায় সুড়সুড়ি দিতে চাইছে।
ফিরে এসে দেখে, অন্দর মহলের চাকরটা কাসার ঢাকা জামবাটি নিয়ে তার অপেক্ষা করছে। এ আবার কী?
তোমরা খাবার নন শুনি বুবুজান মোর হাতোৎ দুধ পাঠেয়া দিল। জামবাটিটা মেলে ধরল বছির।
ন্যান, টপাটপ পান করি ন্যান।
ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল ইদ্রিসের। যেন এক ঝলক আনন্দ বহুদূর থেকে এসেই ঝাপটা দিয়ে চলে গেল।
বাটিটা হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, বুবজান কেরে বছির?
তাও জানেন না?
বল্ না শুনি?
হুজুরের বড় বইনের মাইয়া। তাই মরি যাবার পর একে যে মাইয়া তা আনি আইখছেন হুজুর।
ও।
দুষ্কের কথা কী কমো তোমরার আগেৎ। হুজুরের ছাওয়া–পোয়া নাই। ইয়া আপন হতে আপন মাইয়া বুলি পালেন ওমরায়।
দুদিনেই এদেশের কথা বেশ শিখে ফেলেছে ইদ্রিস। সে যে আজ দুপুরে খাবে না, এই কথাটা নিশ্চয়ই হাজি সাহেবের ভাগনির কানে গেছে। বড়লোকের হঠাৎ এই প্রীতিটা তাকে কৌতূহলি করে তুলল। এদের ভাষাতেই সে কথা বলতে চেষ্টা করল।
ডাঙর হইছে তোর বুবু?
হয় নাই বলে? কন্ কী তোমরা? ছাওয়া–পোয়ার জননী হয়্যা যাইত এতখনে।
কেনে, বিয়াও হয় নাই কেনে?
না কন সে কথা। বেচেয়া খাইছলো তা তার বাপোমায়। সে ঘর ভাঙ্গি গেইছে। বজ্জাতের ঝাড় আছিল সে মানুষকোনা।
তাই নাকি?
মুই অ্যালায় যাও।
বছির যাবার জন্যে পা বাড়ায়। ইদ্রিস পিছু ডাকে, শোন শোন। তুই আবার তাকে বলেছিস কেন, কিছু খাবো না।
পুছ কইরেলে যে।
কাঁই?
এদের ভাষা অজান্তেই বেরিয়ে পড়ে ইদ্রিসের আবার।
কাঁই পুছ কইরলে রে!
কাঁই আবার? কাঁই দুধ পাঠাইলে। নিদ্রা যান তোমরা। মোর মেলা কাম পড়ি আছে। বছির চলে গেল।