ও এই কথা। আমি ভাবলাম সত্যি কিছু হয়েছে বুঝি।
যদি চেপে ধরো, তাহলে অসুখ যে একেবারে নেই তা বলব না।
কী রকম?
পারবে তার ওষুধ দিতে?
বিবরণ বললে সাধ্যমতো চেষ্টা করব। বাকি আল্লাহর হাতে।
ঠিক বলেছ। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। বলেন, ঠিকই বলেছ। বাকি আল্লাহর হাতে। বাকিই বা বলছ কেন, সবটাই তাঁর। সেই গল্প শোনোনি? তোমরাও শোনো হে।
পাত্রমিত্র ঘন হয়ে বসে।
হাজি সাহেব বলেন, একবার এক লোক এসেছে বড়পীর সাহেবের কাছে। সে বললে বাকিটুকু আল্লাহর হাতে তা আমাকে বুঝিয়ে দিন। বড়পীর সাহেব তখন বললেন, তোমার ডান পাটা ওঠাও তো বাপু। ওঠালো লোকটা। বড়পীর সাহেব বললেন, এবার বা পা ওঠাও। তাও হলো। লোকটা বলল, এবার? বড়পীর সাহেব তখন হেসে বললেন, এবার দুটো পাই একসঙ্গে ওঠাও দেখি। লোকটা বলল, বাহ্ তা কী করে হয়? দুপা এক সঙ্গে কেউ ওঠাতে পারে নাকি? লোকটা শুনে বেকুব। মাথা নিচু করল। হুজুর বললেন, ঐটুকু আল্লাহর হাতে।
মারহাবা, মারহাবা।
পাত্রমিত্রেরা সমস্বরে বলে উঠল। ইদ্রিস তাদের সঙ্গে ঠিক যোগ দিতে পারল না। সে নিজে আল্লাহকে বিশ্বাস করে। কোরান রসুল মানে। নামাজ পড়ে। কিন্তু তাই বলে আল্লাহর। অস্তিত্বের প্রমাণ এভাবে গ্রহণ করতে সে রাজি নয়। চমকা গল্প দিয়ে কি আল্লাহকে ব্যাখ্যা করা যায়! কিন্তু গল্পটার সঙ্গে বড়পীর সাহেবের নাম জড়িত রয়েছে বলে সে কিছু বলল না। হাজি জয়েনউদ্দিন রহস্যময়ভাবে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
ইদ্রিস জিজ্ঞেস করল, কই রোগের কথা বললেন না?
বলব, আরেকদিন বলব। আজ নয়। বলতেও হবে না। তুমি নিজেই বুঝে নিতে পারবে। দাওয়াইপত্র অনেক করেছি। তুমি যদি একবার চেষ্টা করতে চাও, দেখতে পারো। ফল হবে আশা নেই।
হঠাৎ গা মোড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
যাক চলি। বাইরে কজন রোগী এসেছে দেখছি। কাল বিকেলে হাটে ঢোল সহরৎ করে দেয়া হয়েছিল?
পার্শ্ববর্তী একজন বলল, হ্যাঁ হুজুর হয়েছিল।
তা লোক এত কম দেখছি যে!
ইদ্রিস হেসে বলল, সে কী কথা! দেশে রোগ না থাকা তো খুশির কথা।
হে না, তুমি জানে না। এখানে ঘরে ঘরে রোগী। ডাক্তার কোন দিন ছিল না বলে চাড় বোঝে না। এছাড়া বিলেতি ওষুধ, কলকাতার ডাক্তার, ভাটির মানুষ—-ম্যালা গেরো আছে। এদের মনে একটু বিশ্বাস এনে দাও, ওষুধে একটু ফল হোক, দেখবে তোমার বারান্দা থইথই করবে রোগীতে।
হাজি সাহেব চলে গেলেন। পাত্রমিত্রের দল পেছনে গেল। রোগী দেখতে বসল ইদ্রিস। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কথা একবার মনে করল। মনে মনে বলল, নাম যেন থাকে। আল্লাহু শাফি, আল্লাহু কাফি। রোগী হয়েছিল কুল্যে পাঁচজন। সবারই এক ব্যামো। ম্যালেরিয়া। ভারী মুশকিলে পড়ল ইদ্রিস। হোমিওপ্যাথিতে ম্যালেরিয়া চট করে সারে না। সময় লাগে। কিন্তু সময় নিলে তার বদনাম হবে। বলবে, এ কেমন ডাক্তার? ওষধ দিল, জ্বর গেল না। সে রকম জ্বর ধামাচাপা দিতে পারে কাঁচা সিঙ্কোনা, কুইনিন। মরে গেলেও সে নীতিভ্রষ্ট হতে। পারবে না; কুইনিন দিতে পারবে না।
পানিতে গুলে ওষুধ দিল সবাইকে সে। বলল, কাল আবার আসবে। আর এর পর যারাই। আসবে বলে দিও খালি শিশি ভালো করে গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে যেন আনে। শিশি তো আর জমিদার সাহেব মাগনা দিবেন না।
দুপুর পর্যন্ত রোগী দেখার সময়। বিকেলে ডাক্তারকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারো। চার আনা ভিজিট। আর যাতায়াতের ব্যবস্থা তোমাদের। হাটবারে বিকেল বেলাতেও ডিস্পোরী থাকবে বিনি পয়সায় ওষুধ দেয়া হবে।
এসব নিয়মকানুন হাজি সাহেবই বেঁধে দিয়েছিলেন।
সেদিন দুপুরে ডিস্পেন্সারী বন্ধ করে কাছারিতে গেল ইদ্রিস। হাজি সাহেব দরবার নিয়ে ছিলেন তখনো। এক পাশে চুপ করে বসল ইদ্রিস। বসে বসে বিচার–আচার দেখতে লাগল। মহাল থেকে পাইক প্রজা দর্শনপ্রার্থীরা এসেছে। তাদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। সে আলাপের কিছুই সে মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। সব আবেদন নিবেদনের পেছনে পূর্ব ইতিহাস রয়েছে, সেটা জানা না থাকলে উটকো শুনে কিছু ঠাহর করা মুশকিল।
একে একে বিদায় নিল সবাই। বেলা তখন মাথার পর থেকে চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই জোহরের আজান পড়বে।
কী ডাক্তার, কথা ছিল কিছু?
জি।
আজ যা দেখলাম সবই ম্যালেরিয়ার রোগী।
হুঁ।
হোমিওপ্যাথি তো সঙ্গে সঙ্গে জ্বর কমায় না। সময় লাগে। রোগীরা যদি তা না বুঝতে চায়? একদিনে ফল না পেয়ে আর ওষুধ নিতে না আসে?
কোনো উপায় নেই?
আছে। কুইনিন দিতে হয়।
দাও কুইনিন। মানা করছে কে? না থাকলে আনিয়ে নাও!
জি, কুইনিন তো দেয়া যায় না।
কেন?
হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সেটা।
চুপ করে গেলেন হাজি সাহেব। ভ্রু গভীরভাবে কুঞ্চিত হলো তাঁর।
চোখ তীক্ষ্ণ করে শুধালেন, কী রকম?
সে এক কথায় বলা যাবে না। পুরো অর্গানস পড়তে হবে।
অর্গানস আবার কী?
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সংজ্ঞা পদ্ধতি তাতে লেখা আছে।
একটু রুক্ষ মেজাজেই হাজি সাহেব বললে, সে বই পড়ে আমি কী করব? আর তুমিও বেশ কথা বলছ দেখি। রোগী মারা যাচ্ছে, তবু যে ওষুধে কাজ হয় সে ওষুধ দেবে না। থাকবে তোমার অর্গানস নিয়ে?
জি, কুইনিনে কাজ হয় ওপরে ওপরে। ভেতরে রোগ যেমনকার তেমনি থাকে। হোমিওপ্যাথিতে সময় লাগলেও সমূলে রোগ দূর হয়।