ভালোই তো। দশ বিশ ক্রোসের ভেতরে ডাক্তার নাই। গরিব আমরা দোয়া করি আপনাকে।
ধরলা পার হতে বেশিক্ষণ লাগল না! অদ্ভুত এই নদী। এখন পড়ে আছে সুতোর মতো চিকন চাকন। বর্ষায় ফুলে ওঠে, বাদামি রংয়ের পানি টগবগ টগবগ করতে থাকে, একেকদিনে বিশ তিরিশ হাত পাড় ধ্বসিয়ে খলখল করে হাসতে হাসতে ছোটে।
ওপারে ঘোড়া এসেছে হাজি সাহেবের। মনিবকে দেখে ঘোড়া মাটিতে পা ঠুকতে থাকে। হাজি সাহেব ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন। বললেন, ডাক্তার আমি যাচ্ছি। ওরে তোরা দেরি করিসনে বাবা। জোর পায়ে পালকি দিয়ে আসবি।
অন্ধকারের ভেতরে এক নিমিষে হারিয়ে গেলেন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে পতিদহের বড় তরফ। ইদ্রিস দাঁড়িয়ে রইল পালকির সামনে। কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে নদী। দূরে বিন্দুর মতো চলমান এক ফোঁটা আলো দেখা যাচ্ছে। এক গা থেকে আরেক গায়ে যাচ্ছে কেউ। কয়েকজন লোক খেয়ার আশায় বসে ছিল, তারা উঠে গেল নৌকোয়। চারদিকে নিস্তব্ধ, শান্ত, স্থির। আকাশে ঝকঝক করছে তারা, যেন কেউ একটা বিরাট সুজনী পেতে রেখেছে।
এতক্ষণ হাজি সাহেব সঙ্গে ছিলেন, সে ছিল একরকম। এখন একা, সে আরেক রকম। দুর দুর করতে লাগল বুকের ভেতরটা। আল্লাহ যা করেন তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই। ইদ্রিসের মনে পড়ল কোরানের সেই আয়াতটা ওঠ হে বাচ্ছাদিত মানব, তোমার প্রভু তোমাকে পরিত্যাগ করেন নাই। তিনি কি তোমাকে এতিম হিসেবে পান নাই? এবং সেখান থেকে বর্তমান অবস্থায় উন্নীত করেন নাই?
মনটা দৃঢ় সংযত হয়ে এলো তার। আপনা থেকেই নুয়ে পড়া মাথা খাড়া হয়ে উঠলো। এই বরং ভালো হয়েছে। নতুন করে সে শুরু করবে জীবন, স্কুলে যাবে অতীত। এ মাটিকে সে আপন করে নেবে। এখানে সে তার স্বপ্ন রচনা করবে। এই যে মানুষগুলো তার চারদিকে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে, এদের মুখ সারাজীবন ধরে পরিচিত হয়ে থাকবে তার। তাই নতুন করে আবার সে সবার দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর পালকিতে বসে বলল, বেরিয়ে পড় ভাই।
পালকি চলল অন্ধকার মাঠঘাট পেরিয়ে। টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ইদ্রিস। মায়ের কথা মনে হলো। মা তার নাম ধরে ডাকছেন। কতদূর থেকে মিহি হয়ে ভেসে আসছে তার গলার আওয়াজ। ই–দ্র–ই–স।
মা এখন কী করছেন? হয়ত হাঁস–মুরগির খোপ বন্ধ করে ডিবে হাতে এ দুয়োর সে দুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাতে হাতে তুলছেন উঠোনে কী পড়ে আছে না আছে। একটু পরে নামাজ পড়তে বসবেন মা। নামাজ শেষে বার বাড়িতে বাবার কবর জিয়ারত করতে আসবেন। পায়ের কাছে ভাঙা ইটের উপর ডিবেটা জ্বলতে থাকবে, কাঁপতে থাকবে বাতাসের দাপটে। ইদ্রিসের একেক সময় মনে হয় মা বোধ হয় সারাদিন পরে এই সময়টাতে বাবার কবরের কাছে আসেন কথা বলতে। ঠিক যেমন বাবা বেঁচে থাকতে মা রাতে পানের বাটা নিয়ে বসতেন বাবার পায়ের কাছে। রাত হবে আরো। রমজান চৌকিদার জাগো হো হাঁক দিয়ে দাওয়ায় চেপে বসে এক টুকরো আগুনের আবদার করবে। আগুন আছে তো তামাকও দাও। তামাক টানবে আর বলবে, আপনার কোনো ভয় নাই মা জননী। দুয়োরে ঝাঁপ দিয়া শুইয়া থাকেন গা।
মার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে কে জানে? কাল একটা চিঠি লিখবে ইদ্রিস।
৩. ডিস্পোরীটা পছন্দ হয়েছে ইদ্রিসের
ডিস্পোরীটা পছন্দ হয়েছে ইদ্রিসের। কাছারির পাশে জামরুল গাছের নিচে ছোট্ট একটা ঘর ভোলা হয়েছে উঁচু ভিটের পরে। এই ডিস্পেন্সরী। নতুন আলমারি, চেয়ার, টেবিল এসেছে। কাঁঠাল কাঠের গন্ধটা ভারী মিষ্টি। তার ওপরে রং করা হয়েছে কাঁচা সোনার।
ঘরের মাঝখানে রোগী দেখবার টেবিল। এক পাশে ডিসপেনসিং টেবিল। পরিষ্কার শাদা কাপড় বিছানো। মাঝখানে নিকেলেছ নিক্তি রাখা ওষুধ মাপবার জন্যে। পাশে এক কৌটো চুন। চুন আবার কেন? শিশিতে ওষুধ ঢেলে গায়ে চুনের দাগ দিয়ে কাঠি টেনে মাত্রাভাগ দেখানো হয়।
থরে থরে ওষুধ সাজানো আলমারিতে। আছে ডাক্তারী বইপত্র, স্টেথসকোপ, সুগার অব মিলক। আর ডিস্পেন্সরীর রেজিস্টার, রিপোর্ট বুক। ইদ্রিসের তোরঙ্গে কবে থেকে মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু আর কায়কোবাদের অমিয় ধারা ছিল। সে বই দুটোর গায়ে নতুন মলাট চড়েছে। ঠাই পেয়েছে আলমারিতে।
প্রথম দিন পাত্রমিত্র নিয়ে হাজি সাহেব এসেছিলেন ডিস্পেন্সারীতে। বসতে দেয় কোথায়? তবে ভাবনা কী? হুকুম বরদার পেছনে পেছনে চেয়ার আনছে। হেলনা বেঞ্চ আসছে আর দুজনের মাথায়।
হাজি সাহেবকে দেখেই ইদ্রিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আপনি বসুন এখানে।
আরে না, ও হলো ডাক্তারের চেয়ার। এ ধরগে তোমার কাছারি। তোমার গদিতে আমি বসতে পারি। তা আজ রোগী আমিই! নাড়িটা দেখোত ডাক্তার।
হাজি জয়েনউদ্দিন তুমি বলতে শুরু করে দিয়েছেন ইদ্রিসকে। সেটা লক্ষ্য করে খুব খুশি হতে পারল না ইদ্রিস। চেষ্টা করল মুখভাব স্বাভাবিক রাখতে। চাকরি করি বলেই একেবারে কেনা হয়ে গেছি নাকি?
ইদ্রিস বলে, নাড়ি দেখব, বুক দেখতে হলে বুক।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। আচমকা আবছা হেসে বললেন, ঠিক ঠিক। পার্শ্ববর্তীকে শুনিয়ে বললেন, এই না হলে ডাক্তার? তারপর ইদ্রিসকে আবার বললেন, তুমিও তো তেমনি। ঠাট্টা করছিলাম। তাও বোঝে না। এরা ধরেছে আমাকে দিয়েই নাকি ডিস্পেন্সারীর কাজ শুরু করতে হবে। তা দ্যাখোই না নাড়িটা।