তার সে ভাব গোপন রইলো না হাজি সাহেবের কাছে। তিনি হেসে বললেন, আরে ডাক্তার যে একেবারে ভয় পেয়ে গেলেন।
ম্লান হাসলে ইদ্রিস। বলল, কই না।
ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি রয়েছি কী করতে! ভাটির লোক হলেই যে বাঘ ভালুক হবে তা নয়। ওরা হচ্ছে শিশুর মতো। একটু আদর চায়, আন্তরিকতা চায়। ব্যাস, দেখবেন আপনার পায়ে পায়ে ঘুরছে পতিদহের মানুষ।
হাজি সাহেব যথাসম্ভব চেষ্টা করেন ইদ্রিসের মনের মেঘ দূর করতে। বলেন, দোষ এদেশের লোকেরই বা কী দেব। তাহলে এক গল্প বলি শুনুন।
ইদ্রিস বাইরের দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে আনে।
হাজি সাহেব বলতে থাকেন, শুনুন তাহলে। নাম ধাম বলব না। দুদিন বাদে নিজেই বুঝতে পারবেন কার কথা বলছি। যার কথা হচ্ছে সে এদেশেই আছে। বিরাট জমিজমা সহায়। সম্পত্তি, টাউনে চার পাঁচখানা পাকা বাড়ির মালিক। বাড়ি ঢাকায়। আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে এসে পড়ে কুড়িগ্রামে। লোকটা ম্যাজিক জানতো কিছু কিছু। দলবল কিছুই নেই। একাই খেলা দেখায়। খেলা দেখাতে এলো এ অঞ্চলে। হাটে হাটে যায়, ম্যাজিক দেখায়। লোকে হাঁ করে দেখে আর ভাবে না জানি কত বড় দৈবশক্তি আছে তার। বলছিলাম না, আমার দেশের মানুষের মতো সরল মানুষ আর হয় না। সেই ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখিয়ে নিরীহ লোকজনের ওপর এমন প্রভাব করে ফেলল যে, দুদিন বাদে তারা সব তার কথায় ওঠবোস করতে লাগল। এই করে, বলব কী ডাক্তার, পাঁচ টাকা বিঘে দরেও জমি হাতাতে লাগল সে। অপুত্রক যারা তারা জমি লিখে দিয়ে যেতে লাগল সেই ম্যাজিশিয়ানের নামে। ম্যাজিশিয়ানই বটে! ইদ্রিস বলল। নইলে লোকজন এত বোকাও হয়! কিছু বুঝতে পারে না?
এই হচ্ছে আমার দেশের মানুষ। হাজি সাহেব খেদের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন। তারপর শুনুন। বছর পাঁচেকের মধ্যে এ অঞ্চলের মধ্যে কেউকেটা হয়ে পড়ল লোকটা। এখন পাটের কারবার করে। গঙ্গার পাড়ে নিজের গুদাম করেছে কয়েকটা। লাখপতি। আর যাদের জমি যাদের টাকা ঠকিয়ে নিয়েছিল তারা না খেয়ে মরছে। বলুন, এরপরও ভাটির মানুষকে বিশ্বাস। করবে এরা? এতো একটা শুনলেন। এ রকম কত ঘটনা হয়েছে খাস রংপুরে, গাইবান্ধায়, নীলফামারীতে।
হঠাৎ ইদ্রিস প্রশ্ন করে বসল, আমিও তো ভাটির লোক। আমাকে বিশ্বাস করলেন কী করে? হাতের পাঁচ আঙুল কি আর সমান হয় ডাক্তার?
সমান না হলেও পাঁচটাই আঙুল তো বটে। আমিও যে ওরকম হবে না তার গ্যারান্টি কী? হাজি সাহেব ঐ কুঞ্চিত করে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, না, মানুষের গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। এ কী আর ওয়েস্ট এণ্ড কোম্পানির ঘড়ি?
বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। সে হাসির সঙ্গে অস্বস্তি বোধ করল ইদ্রিস। হাজি সাহেব বললেন, প্রিন্সিপ্যাল খান তোক চিনতে ভুল করেন না। তিনি যখন আপনার নাম করেছেন, তখনি জানি মনের মত লোক পেয়েছি আমি। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাংলার গৌরব, মুসলমান সমাজের জন্যে তার যে দান তা আজ কারো চোখে না পড়ুক কাল পড়বে।
বেলা পড়ে আসছে। আরো জোরে পা চালাও ভাই। টোগরাইহাটের শ্মশান দেখা যায়। শ্মশান বাঁয়ে রেখে আবার বড় সড়কে উঠল পালকি।
ইদ্রিস লক্ষ্য করছিল লাইট রেলওয়ে আর ডিস্ট্রিকট বোর্ডের এই রাস্তা যেন জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। এই একটা আরেকটাকে কেটে সরে যাচ্ছে, আবার কাছে আসছে, বেশ খানিকটা সমান্তরালে গেছে, এক সময়ে আর দেখা গেল না, আবার দেখা গেল। কত রং বেরংয়ের পাখি, গাছ–গাছালি। বড় বড় আমের ছায়ায় ঢাকা ডিস্ট্রিকট বোর্ডের পথ। কোথাও বুঝি হাটবার আজ। দলে দলে হাটুরেরা ঘাড়ে পিঠে বাকে করে শাক–সবজি চাল–ডাল তেলের কলসি দুধের ভাড় নিয়ে চলেছে। তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, রাস্তা ছাড়া রাস্তা দাও।
বেহারারা সুর করে বলে আর তালে তালে পা ফেলে এগোয়।
ঐ যে দূরে কুড়িগ্রামের ডাক–বাংলো দেখা যায়। লাল টিনের ছাদে অপরাজিতা লতিয়ে উঠেছে।
বেলাবেলিই পৌঁছুনো গেছে। ধরলার পাড়ে মসজিদ। সেখানে মাগরেবের নামাজ পড়ল ওরা। নামাজিরা অনেকেই হাজি জয়েনউদ্দীনকে সালাম দিল, কুশল জিজ্ঞেস করল।
কোত্থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে। ডাক্তার নিয়ে যাচ্ছি আমার ডিস্পেন্সারীর জন্যে। এই যে ডাক্তার। ইদ্রিসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন তিনি। ইদ্রিসকে তারা গভীর চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
বাড়ি কোথায় আপনার?
সিরাজগঞ্জ।
ইদ্রিস যেন দেখতে পায় সন্দেহের কালো ছায়ায় আঁধার হয়ে আসে প্রশ্নকর্তার চোখ। হাজি সাহেব বলছিলেন ভাটির মানুষকে এরা ভয় করে। কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়।
একজন হাজি সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, রেললাইন কদ্দুর? নতুন ইটিশন কবে হবে?
এই হলো বলে। সামনের মাসে দিল্লি যাচ্ছি আবার।
হবে তো?
হবে না মানে? যে বুদ্ধি দিয়েছি! বলেছি নতুন করে সড়ক বাঁধতে হবে না লাইনের জন্য। এখন যে ডিস্ট্রিকটু বোর্ডের রাস্তা আছে তার ওপরই লাইন বসানোর পরামর্শ দিয়ে এসেছি।
লাইনটা দিতে পারলে হাজি সাহেব আপনার একটা নাম থেকে যাবে।
হাজি জয়েনউদ্দীন হাসেন ছোট্ট করে। নিজের প্রশংসা শোনতে অভ্যস্ত তিনি। ইদ্রিস লক্ষ্য করে, প্রশংসা গ্রহণ করেন এমন সুন্দরভাবে যে নিলজ্জিত মনে হয় না তাকে। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যে হাজি সাহেব বলেন, ডাক্তার পছন্দ হয়েছে?