কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তাকে আবাখোঁজাখুঁজি করতে লোক বেরুবে। পা চালিয়ে ফিরতি পথ ধরে ইদ্রিস।
মাঠের পারে গাঁয়ের পথ যেখানে আরেক গাঁয়ের দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেখানে একটা জটলা চোখে পড়ে ইদ্রিসের। কান্নার শব্দও যেন শোনা যায়। ব্যাপার কি?
কাছে এসে দেখে কচি বৌ নিয়ে ঝাঁকড়া চুল বর দাঁড়িয়ে আছে মাথা হেঁট করে। তাদের ঘিরে বুড়োবুড়ি আত্মীয়স্বজন মরা কান্না করছে। বড় দূরে বিয়ে দিলে বুঝি?
না গো না। ঐ যে দুটো অশ্বথ গাছ ঐ হোথায় দেখা যায়। তারপরে পাথার। পাথারের পরে শিমূলকলি গ্রাম। সেই গ্রামে মেয়ে বিক্রি করে কপাল চাপড়াচ্ছি।
মেয়ে বিক্রি কী রকম? চোখ কপালে তোলে ইদ্রিস। তাও জানো না। এ দেশে মেয়ের বিয়েকে মেয়ে বিক্রি করা বলে। মাইয়া বেচেয়া খাইছং। অদ্ভুত তো। গাঁয়ের পিঠে গায়ে বিয়ে দিয়েছ, এত কাঁদতে আছে? বলেন কী। গাঁয়ের পিঠে গাঁ বই কী! ভিন্ গাঁ মানেই বিদেশ। বৈদ্যাশে মাইয়া চলি যায়, বুক ফেটে কান্না আসে না?
অবাক হয়ে যায় ইদ্রিস। দুক্রোশ দূরও হবে না, একে বলে দূর বিদেশ। আসলে বোধ হয় বাপ মার এক মেয়ে গোয় না তাও না। আর পাঁচ মাইয়া আছে ঘরৎ।
হাজি সাহেব তাকে দেখেই বললেন, খুব ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেমন ঠিক বলি নি, রংপুরের মতো দেশ হয় না।
জি, তাই দেখছি। খুব ভালো লাগছে।
এই যে এলেন এদেশে, আর যেতে মন চাইবে না।
দেখি!
আমি বলি, দুদিন পরে পরিবার নিয়ে আসুন, মাকে নিয়ে আসুন। আমি জমি করে দেব, ঘর তুলে দেব, রংপুরের লোক আপনাকে মাথায় করে রাখবে।
ইদ্রিসের মন রঙিন হয়ে উঠে মুহূর্তে। তার নিজের বাড়ি হবে, সংসার হবে। এই রকম জলার পারে শালুক ফুটে থাকবে। কদমের মিষ্টি ঘ্রাণে বাতাস মম করবে। খুব ভালো হয়। একটা বাইসাইকেল কিনবে ইদ্রিস। দূর দূরান্তে রোগী দেখতে যাবে। কলকাতায় বাইসাইকেল দেখত আর তৃষিতের মতো চেয়ে থাকত ইদ্রিস। আহা, অমন যদি তার একখানা থাকত! ছেলেবেলায় চৌবাড়িতে কে একজন বাইসাইকেল চড়ে এসেছিল। সে কী কাণ্ড! দল বেঁধে ক্লাশ ভেঙে ছেলের দল গিয়েছিল অদ্ভুত সেই দুই চাকার যন্ত্র দেখতে। মানুষটা কী যাদু জানে? এমনি দাঁড় করিয়ে রাখো, কাৎ হয়ে ধপাস করে পড়ে যাবে। মানুষটা উঠলো কী তেজি একটা খরগোশের মতে বাই বাই করে ছুটতে লাগল। তাজ্জবই বটে। ছেলেরা গবেষণা করে, বাই বাই করে ছোটে বলেই বাইসাইকেল নাম। কে একজন বলে, ধ্যাৎ, সাইকেলে আবার শব্দ হয় নাকি। আসলে এটা বাইছাগল। দেখছিস না ছাগলের মতো দুটো শিং। ইদ্রিসের মনে পড়ে হ্যাঁণ্ডেলের কালো দুটো গ্রীপ দেখে সেদিন তারও বিশ্বাস হয়েছিল এ নিশ্চয়ই কলের ছাগল।
খেয়ে দেয়ে জোহরের নামাজ পড়ে আবার পালকিতে উঠল ওরা। হুমহাম কোরাসের তালে তালে পালকি চলল রাজার হাট ছাড়িয়ে। এই যায় পলাশবারী, এই গেল শিমুলকলি, এই এলাম কালীরবাজার। হুমহাম হুমহাম। জোরে চলো ভাই জোরে চলো। পা চালিয়ে চলা। বেলাবেলি কুড়িগ্রামে পৌঁছুতে হবে। নইলে খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
ইদ্রিস বলল, আজ এক ঘটনা দেখলাম হাজি সাহেব।
কী ডাক্তার?
রাজারহাটে মেয়ে বিদায় দিতে এসে বাপ মা আর আত্মীয়স্বজনের মরা কান্নার কথা বলল ইদ্রিস।
এই ব্যাপার?
পিঠেপিঠি গাঁ। এত কান্নার কী আছে?
হাজি সাহেবের গলাটা হঠাৎ ভারী নরোম শোনাল। তিনি বললেন, আমার এখানকার মানুষগুলো ভারী সরল ডাক্তার। নিজের গাঁ ছাড়া কিছু বোঝে না। গাঁয়ের বাইরে এক পা ফেলে না। গাঁয়ের বাইরে জীবনে দুচার বারের বেশি এরা যায় না। বুঝলেন?
ইদ্রিসের বিস্ময় তবু যায় না। এ যুগে এরকম মানুষও হয় নাকি। হাজি সাহেব বলে চললেন, সারা বাংলায় এমন সরল এমন ঘরকুনো মানুষ আপনি পাবেন না ডাক্তার। বিদেশীকেও ভারী ভয় করে ওরা। এই যে দক্ষিণ থেকে এলেন আপনি, আপনাকে ওরা বলবে ভাটির মানুষ——–ভাটিয়া। ভাটিয়াকে বড় ভয় করে রংপুরের লোক। ভাবে, তাদের ঠকিয়ে–লুটপাট করতে এসেছি ভাটি থেকে। আমার মনে হয় কী জানেন, এককালে দক্ষিণ থেকে ডাকাতের দল আসতো এ দেশে। এখানকার ফসল ভালো। বীজ বুনলেই সোনা ফলে। দক্ষিণের মতো কষ্ট করে ফসল ফলাতে হয় না। তাই দক্ষিণের মানুষ যে লোভ করবে এতে আর আশ্চর্য কী?
হুঁ তাতো বটেই।
ভালো কথা মনে পড়ল। হাজি সাহেব একটু ঘন হয়ে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, আপনাকে একটু সাবধানে চলতে হবে।
মানে?
না, না, সাবধান মানে প্রাণের ভয়ে সাবধান হতে বলছি না। ঐ যে বললাম ভাটির মানুষকে এরা ভয় করে, অবিশ্বাস করে। আপনাকে একটু বুঝে সমঝে চলতে হবে। ভয়টা ভাঙ্গাতে হবে। অবিশ্বাস দূর করতে হবে। ওদের মন জয় করতে হবে। একবার যদি ওদের মনের নাগাল পেয়ে যান, একবার যদি আপনাকে ওরা নিজদের বলে ভাবতে পারে, তাহলে দেখবেন আপনার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে ওরা গররাজি হবে না।
ইদ্রিস চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে। এতক্ষণ মন বড় চঞ্চল হয়েছিল পতিদহে পৌঁছুনোর জন্যে। মনে মনে সে ছবি দেখছিল কেমন হবে তার ডিস্পেন্সারী, কী ভাবে সাজাবে। সে দেখছিল, ঐতো রোগীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, সে ওষুধ দিচ্ছে, ঐতো সে ব্যাগ ঝুলিয়ে দূরে যাচ্ছে রোগী দেখতে। এখন, হাজি সাহেবের এই কথার পর, ছবিটা যেন মুছে গেল। একটা উদ্বেগ এসে সব ঢেকে দিয়ে গেল। মনের মধ্যে কেমন শিরশির করতে লাগল তার। মনে হলো, হঠাৎ তার কাঁধে এক গুরুভার চেপে বসেছে। সে বাইরের চলমান দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বসে রইল।