- বইয়ের নামঃ অচিন্ত্য পূর্ণিমা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আজকাল কত সুবিধে
আজকাল কত সুবিধে। তিস্তা থেকে মিটার গেজ লাইন বেরিয়ে গেছে। সকালে একটা আর রাতে একটা লোক্যাল ছাড়ে। চলে যাও সোজা শেষ স্টেশন কুড়িগ্রাম পর্যন্ত। স্টেশনের পরেই। নদী। খেয়া পেরোও। পেরিয়ে বাস। বাস একেবারে পতিদহ পর্যন্ত যায়। ব্যাস, পৌঁছে গেলে গন্তব্যে।
কিন্তু তখন এ সব কিছুই ছিল না। মার্টিন কোম্পানির লাইট রেলওয়ে ছিল বটে কুড়িগ্রাম অবধি, কিন্তু তার সময়সূচি বলতে কিছু ছিল না। যাত্রীতে বগি ভরে উঠলে গাড়ি ছাড়ত, নইলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। বংশ গরিমায় আর ধনের মহিমায় যারা টগবগ করত তারা নাইট ট্রেনে চড়তেন না। নাক সিটকোতেন। তাদের জন্যে পালকি আসত, বেহারা আসত, তাজি ঘোড়া মওজুদ থাকত।
তিস্তা তখন দার্জিলিং মেলের পথে ছোট্ট একটা স্টেশন মাত্র। তিস্তা নদীর ব্রীজ পেরোবার আগে একটা লম্বা সিটি দিতে হয় মাত্র। স্টেশন মাস্টার রাতে হলে সবুজ বাতি দেখান, দিনে ছেঁড়া নিশান। এক ঝলক উদ্দাম স্বপ্নের মতো হুহু করে বেরিয়ে যায় কলকাতার গাড়ি, আসামের গাড়ি।
তবে হ্যাঁ, প্ল্যাটফরমের দুই মাথায় যে দুটো বুড়ো শিমুল গাছ এখনো দেখা যায়, দেখা যায় মৌসুমের সময় আগুন রং ফুলের কিরীট পরে থাকতে, সে গাছ দুটো তখনো ছিল। একেবারে এইটুকুন। কাটিহারের কোন্ এক ঘরবিরহী কুলি সর্দার শখ করে লাগিয়েছিল চারা দুটো।
সেই সেদিনের তিস্তায় এসে নাবলেন ইদ্রিস ডাক্তার আর পতিদহের বড় তরফ হাজি জয়েনউদ্দিন।
স্টেশন ঘরের সামনে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে কাঁচের ড্ডামের ভেতর। তাতে স্টেশনের নাম লেখা। পেছনে বাঁশের জঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। যেন মহোৎসব লেগে গেছে তাদের রাজত্বে। চারিদিকে জনমনিষ্যির সাড়া শব্দ নেই।
পার্বতীপুরে মিটার গেজ গাড়িতে চড়বার পর থেকে দুজনের মধ্যে প্রায় কোনো কথাই হয়নি। এবারে গলা সাফ করে ইদ্রিস ডাক্তার বলল, এই বুঝি তিস্তা?
হা, সন্ধ্যে হয়েছে। নইলে নদীটাও দেখতে পেতেন। বর্ষার সময় ভীষণ মূর্তি হয়ে ওঠে। তাই নাকি?
নিজের কাছেই নিজের গলার স্বর কেমন অদ্ভুত ঘরঘরে শোনায়। ইদ্রিস ডাক্তার আবার গলা সাফ করে। সেটা লক্ষ্য করে হাজি সাহেব আবার বলেন, ইচ্ছে করলে এখনো ফিরে যেতে পারেন। রাত দুটোয় একটা ফিরতি ট্রেন আছে।
কোথায়?
কেন, কলকাতায়। ইচ্ছে করলে সিরাজগঞ্জেও যেতে পারবেন। সেখানেই আপনার দেশ বলেছিলেন না?
হ্যাঁ।
যাবেন ফিরে?
স্টেশন ঘরের বাতিতে ইদ্রিস ডাক্তারের ঘন শ্যামল মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। লজ্জিত হয়ে হাসে সে একবার। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ফেরৎ যাবার কথা ভাবলে তো আর বেরুতামই না।
তবু
তবু কী?
বলছিলাম, এখনো ভেবে দেখতে পারেন। ছিলেন কলকাতায়। সে এক বিরাট শহর। আপনার মতো লোকের একটা না একটা রুজি হয়েই যেত সেখানে। তাছাড়া আপনার প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও খুব স্নেহ করে আপনাকে। আপনি চাইলে তিনি আপনার ভালো ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন কলকাতায়।
সে আমি জানি।
আর ভেবে দেখুন পতিদহ এক গগ্রাম। এখান থেকে ঝাড়া পঞ্চাশ মাইল। বর্ষা শুরু হলে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। থিয়েটার বায়োস্কাপ নেই। গড়ের মাঠের হল্লোড় নেই। রোশনি নেই। মন টিকবে পতিদহে?
কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন বারবার?
এই জন্যে করছি, আপনার মতো শহুরে লোক হুট করে পতিদহের দাঁতব্য ডিস্পেন্সারীতে ডাক্তারী নিতে চাইবে, আমার যেন ভালো করে বিশ্বাস হতে চায় না। আমি যখন ডাক্তারের খোঁজে কলকাতা গিয়ে আপনার প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করলাম তখন এক রকম ধরেই নিয়েছিলাম কেউ রাজি হবে না আসতে।
সে ভুল তো আপনার ভেঙেছে।
হ্যাঁ, তা ভেঙেছে। সেই জন্যেই আরেকবার ভাবতে বলছি। কী জানেন, আমি সবসময়ই খোলামেলা কথা পছন্দ করি। কারো ওপরে জোর করি না। নিজেই ভালো করে জানি, পতিদহে কী আছে? পতিদহে কেন আপনার মতো শিক্ষিত মানুষ যাবে? ক টাকাই বা মাইনে দেব?
আচ্ছা, সে কথা এখন থাক।
ইদ্রিস ডাক্তার থামিয়ে দিল হাজি সাহেবকে। একটু পর বলল, রাতেই কি রওয়ানা দেবেন?
না, এখানে রাতটা কাটিয়ে ভোর বেলায়
পতিদহের বড় তরফ হাজি জয়েনউদ্দিন মাথা দুলিয়ে দাড়ি খেলাল করলেন বার কয়েক। বললেন, পাগল হয়েছেন? এই রাতে রওয়ানা দিতে চান?
ক্ষতি কী?
এটা কলকাতার রাজপথ নয় ডাক্তার সাহেব। সিঙারদাবড়ি হাটের পর থেকে বন শুরু হয়েছে। সে বনে বাঘও আছে বলে লোকে বলে। আমি দেখিনি নিজে। বাঘের মুখে। উৎসাহের তোড়ে প্রাণ দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
ও।
হাজি সাহেবের সঙ্গে এসেছে দুই খানসামা আর এক পাইক। তারা ততক্ষণে স্টেশনের বিশ্রাম ঘর খুলিয়ে বিছানা করে ফেলেছে। রাতের রান্নার যোগাড় দেখছে এখন তারা। একজন বাজারে বেরিয়ে গেছে চাল ডাল কিনতে।
ইদ্রিস ডাক্তার সব শুনে বলল, আমি তাহলে একটু হেঁটে আসি।
রাতে আবার কোথায় হাঁটতে যাবেন ডাক্তার?
প্ল্যাটফরমেহ।
দেরি করবেন না। শীত পড়তে শুরু করেছে। মাথায় হিম বসে গেলে শরীর খারাপ করবে। কথাটা ইদ্রিসের মনে প্রবল নাড়া দেয়। এক মুহূর্তের জন্য অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। এরকম করে কত বছর কেউ তাকে কথা বলেনি। শুনে যেন চমকে উঠতে হয়। ইদ্রিস ডাক্তার ইতস্তত করে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে নুড়ি বিছানো রুক্ষ প্ল্যাটফরমের ওপর জমাট অন্ধকারের ভেতর আনমনে হাঁটতে থাকে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে হিম পড়ছে সত্যি সত্যি।