ভোলা বললে—‘তা হবে না। ক্যাম্বেলে শুনেছি রুগী ঢুকলে আর জ্যান্ত ফেরত আসে না, পোস্টমর্টেমের পর ডাক পড়ে রুগী ফেরত নেবার জন্যে। দেরি হয় হোক, তবু কারমাইকেলেই চল।’
বেলগাছিয়া ট্রানডিপোর কাছে কারমাইকেল কলেজ, এখন যার নাম হয়েছে আর জি কর মেডিকেল কলেজ, সেদিকেই ট্যাক্সি ছুটল তীরবেগে। পিছনের সিট-এ ভোলার কোলে মাথা রেখে বৈদ্যনাথ অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। ড্রাইভারের পাশে আমি, আমার অবস্থাও প্রায় বৈদ্যনাথের মতো। কোনো কথা বলবার শক্তিও যেন আমার ফুরিয়ে গিয়েছে।
কারমাইকেলে আমরা যখন উপস্থিত হয়েছি বেলা তখন এগারোটা। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রুগী নিয়ে উপস্থিত হওয়া মাত্র হাউস ফিজিসিয়ান সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করেই বৈদ্যনাথকে পাঠিয়ে দিলেন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে। গম্ভীর গলায় আমাদের বললেন—‘বড় দেরি করে ফেলেছেন আপনারা। খুবই সিরিয়স কেস, দেখি কী করা যায়। আপনারা যাবেন না, বাইরে অপেক্ষা করুন।’
বৈদ্যনাথের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। জানি না ওর ভাগ্যে কী আছে। আক্ষেপ থেকে গেল যাবার আগে ওকে দুটো সান্ত্বনার কথা, ভরসার কথাও বলতে পারলাম না। বলবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিলই না, শুনবার মতো অবস্থা কি ওর ছিল?
তখনকার দিনে কারমাইকেল কলেজের রুগী এক-একদিন এক-একজন ডাক্তারের ওয়ার্ডে ভর্তি হবার রীতি ছিল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন কার-মাইকেলের ফিজিওলজির প্রধান শিক্ষক, তাছাড়া প্রতিদিন সকালে একবার করে এসে তাঁর ওয়ার্ডের রুগীদের পরীক্ষা করে যেতেন।
ডাঃ রায়ের ছিল ‘এ’ ওয়ার্ড। প্রতি সোম, বুধ ও শুক্রবার তাঁর ওয়ার্ডে রুগী ভর্তি হত। ডাঃ পি নন্দীর ছিল ‘বি’ ওয়ার্ড, বাকি তিন দিন রুগী ভর্তি হত তাঁর ওয়ার্ডে।
কারমাইকেল কলেজের চত্বরে একটা নিম গাছের ছায়ায় আমি ও ভোলা অনিশ্চিত আশংকা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। থেকে থেকে স্টেথস্কোপ গলায় ঝোলানো সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত কাউকে দেখলেই বৈদ্যনাথের খবর জিজ্ঞাসা করি, সঠিক উত্তর মেলে না।
বেলা বারোটা বেজে গিয়েছে। বৈদ্যনাথ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার মতো কোনো হদিস পাচ্ছি না। ভোলাকে কথাটা বলতেই সে ধমকে উঠল— ‘তুই থাম দেখি। বৈদ্যনাথের একটা কিছু খবর না নিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত হবে না। তাছাড়া ডাক্তার যখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলেছেন।’
হঠাৎ নজরে পড়ল সেই হাউস ফিজিসিয়ানকে। যিনি প্রথম বৈদ্য-নাথকে পরীক্ষা করেছিলেন তিনি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমাদের ডেকে বললেন—‘আপনাদের আর মিছামিছি অপেক্ষা করিয়ে রাখতে চাই না।’
আমার মুখে কোনো কথা নেই। ভোলা বললে—‘তা কি হয় স্যার? বাড়ি ফিরেই বা নিশ্চিন্ত হই কি করে। আমাদের অপেক্ষা করতে কোনো আপত্তি নেই।
ডাক্তার বললেন—‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ডাঃ রায় তো এখনো হাসপাতালে এলেন না। আজ বুধবার, আজ ওঁর ভিজিট করার দিন।’
ডাক্তার রায়ের নাম শুনেই আমার ঝিমিয়ে পড়া মন যেন নিমেষে চাঙ্গা হয়ে উঠল। নিজের ঔৎসুক্য চেপে রাখতে না পেরে বললাম—‘ওঁর কি আসবার সময় পার হয়ে গিয়েছে?’
‘ডাক্তার রায়ের কোনো বাঁধাধরা টাইম নেই। তবে সাধারণত বেলা দশটা থেকে বারোটার মধ্যেই ওয়ার্ড ভিজিট করতে আসেন। আজ যখন বারোটা বেজে গিয়েছে তখন কখন আসবেন তার কোনো স্থিরতা নেই।’
আমি কাতরভাবে বললাম—‘ডাক্তার রয় না এলে কি বৈদ্যনাথের কোনো ট্রিটমেণ্ট হবে না?’
হাউস ফিজিসিয়ান এবার হেসে ফেললেন। বললেন—‘এসব কেস-এ কি রুগী ফেলে রাখা চলে? ইনজেকশন যা দেবার তা দিয়েছি। কঠিন সার্জিক্যাল কেস। অ্যানেসথেশিয়া রুগী সহ্য করতে পারবে কি না, সেটুকু ডাক্তার রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করে নেওয়া দরকার ছিল। ডাক্তার রায় এসে পড়েন তো ভালই। অপারেশন আমাদের আজই করে ফেলতে হবে। বিকেল চারটের পর এসে খোঁজ নেবেন।’
এ কথা বলেই ডাক্তার যেমন তড়িঘড়ি এসেছিলেন তেমনি ব্যস্ত হয়েই চলে গেলেন। মনে মনে জেনে গেলাম যে একটা কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে বৈদ্যনাথকে পার হতে হবে, সেই সঙ্গে আমাকেও। আরো আধ-ঘণ্টা সময় গাছতলায় আমরা দাঁড়িয়ে। ফিরে যাবে কিনা সেই কথাই তখন ভাবছি।
সহসা হর্ন বাজিয়ে একটি গাড়ি গেটের ভিতর ঢুকল। গাড়ি থেকে স্টেথস্কোপ হাতে নামলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। সাধারণত ডাক্তার রায় ওয়ার্ড ভিজিট করতে এলে সুপারিন্টেণ্ডেট থেকে শুরু করে হাউস ফিজিসিয়ান, অ্যাসিস্টেন্ট সবাই ভিড় করে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে ওয়ার্ডে ঢুকতেন। কারণ প্রত্যেক রুগী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তার সঠিক উত্তর না পেলে ডাক্তার রায় বকাবকি করতেন এবং কেউই রেহাই পেতেন না।
সেদিন বোধহয় সবাই ধরে নিয়েছিল ডাঃ রায় আর আসছেন না। গাড়ি থেকে নেমে ডাঃ রায় প্রতিদিনের অভ্যাসমত আর জি করের স্ট্যাচুর সামনে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়ালেন। তারপর নিঃশব্দে ঢুকে গেলেন বাঁ দিকের একতলায় অ্যালবার্ট ভিকটর ওয়ার্ডে।
হঠাৎ ভোলা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে—‘দ্যাখ বিশে, এই সুযোগ। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সেই ডাক্তারকে তো দেখছি না। আমরা গিয়ে ডাক্তার রায়কে বৈদ্যনাথের কথাটা বলি।’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভোলা আমাকে টানতে টানতে ‘এ’ ওয়ার্ডে গিয়ে ঢুকে পড়ল। ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি ডাক্তার রায় এক প্রত্যেক রুগীর মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, দু-একজনকে শুধু ছোট্টো প্রশ্ন—‘কেমন বোধ করছ।’