- বইয়ের নামঃ আরেকটা কলকাতা
- লেখকের নামঃ সুপ্রিয় চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০. ভূমিকা – আরেকটা কলকাতা : সুপ্রিয় চৌধুরী
রসিকজোড় শ্রীসত্যবান মিত্র ও সুন্দর মুখোপাধ্যায়কে
ভূমিকা
এ বইয়ের বিষয় অথবা উপজীব্য— কলকাতা। শিরোনামেই সেটা স্পষ্ট। তবে কলকাতা কিন্তু একটু অন্যধরনের। যে-কোনও লেখার পিছনেই একটা পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। এ বইয়েরও আছে। কীভাবে এবং কেন বইটি লেখা হল, সে প্রসঙ্গেই সামান্য দু-চারটি কথা বলি এবার। সেই ছেলেবেলা থেকেই চিরকেলে অবাধ্য আমি। একইসঙ্গে বেশ খানিকটা বাউন্ডুলেও বটে। অক্লান্ত আড্ডাবাজ বলে বন্ধুমহলে খ্যাতি এবং পরিবারে কুখ্যাতি আছে। সঙ্গে খানিকটা ছিটগ্রস্থের দুর্নামও। তবু এরই মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন কোথায় ভীষণরকম একটা একা হয়ে যাই নিজেই নিজের মধ্যে। আর যখনই সেটা ঘটেছে, নরেনদার চায়ের দোকান, রক-চাতালের আড্ডা, তুরীয় আনন্দের আসর, নিজের অথবা সংসারের কাজকম্মো ফেলেছেড়ে ঘোরলাগা উদ্ভ্রান্তের মতো হঠাৎ হঠাৎই নেমে পড়ছি রাস্তায়। ঘুরে বেড়িয়েছি কারণে-অকারণে আমার এই ভীষণ চেনা অথচ অচেনা আর প্রিয় শহরটার ফুটপাতে, অলিতেগলিতে। বহু জানা-অজানা, উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে, কিঞ্চিৎ বেয়ারা আর বিপদজনক সব রঙরুটে। নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। এই ঘুরচক্করের ঘুরপাকে পাক খেতে খেতেই চোখ আটকে গেছে এমন অনেক কিছুতে যা সাধারণত কেজো, একইসঙ্গে সদাব্যস্ত সহনাগরিকরা হয়তো খানিকটা আলগোছে দেখেন অথবা দেখেও দেখেন না। সেসবেরই বেশ কিছুটা অংশ লেখা হয়ে উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যক্তিজীবন অথবা কর্মসূত্রে লব্ধ কিছু অভিজ্ঞতা এবং উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাবলি। লেখক লিখেই খালাস, পড়ে কেমন লাগল সে মতামত একান্তভাবেই পাঠকের। সফল কদ্দুর হয়েছি অথবা আদৌ হয়েছি কি না সে বিষয়েও মন্তব্যের অধিকারী একমাত্র তারাই।
সবশেষে জানাই, বইটিতে আমার লেখাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে অন্য প্রমা, প্রাত্যহিক খবর, প্রতীচী, দুর্বার ভাবনা, দুকূল, ৩৬৫ দিন রবি সংখ্যা, বাংলা LIVE.Com, আলতামিরার মতো একাধিক পত্র-পত্রিকায়। আমি কৃতার্থ আমার মতো একজন অজ্ঞাতকুলশীল কলমচিকে তাঁদের পত্র-পত্রিকায় লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁরা। ধন্যবাদ আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃপক্ষকে তাঁরা আমার লেখাগুলিকে বই আকারে প্রকাশের জন্য মনোনীত করেছেন। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। ঋণের শেষ নেই আরেকজনের কাছেও। তিনি কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষ মহাশয়। তাঁর কবিতা ‘বাবুমশাই’-এর একটি লাইন এ বইয়ের শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন এই অধম প্রতিবেদককে। সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল তাঁর উদ্দেশে।
—লেখক
০১. কালো কলকাতা
উনিশশো ছেচল্লিশ, ষোলোই আগস্ট, মহম্মদ আলি জিন্নার ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ নীতিকে মান্যতা দিয়ে কলকাতার বুকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লিগ প্রধান সঈদ সুরাবর্দী। উদ্দেশ্য একটাই ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে কলকাতার অন্তর্ভুক্তি তার মধ্যে অবশ্যম্ভাবী। জিন্না, লিয়াকৎ আলি, নেহরুজি, সর্দার প্যাটেলরা রাষ্ট্রক্ষমতা নামক কেকের ভাগ বাঁটোয়ারার স্বপ্নে মশগুল। গাঁধীজি, কালাম আজাদ, বাদশা খানের মতো নেতারা ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন অসহায় দর্শকে আর ইংরেজরা তো চাইছিলই— ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। এর ফল যা হবার তাই হল। ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ থেকে কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যা পরবর্তীতে ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে কুখ্যাত। শুধু কলকাতা নয় ক্রমে ক্রমে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার বরিশাল, নোয়াখালি এবং অচিরেই রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অসম এবং পাঞ্জাবে। হাজারে হাজারে লাশ পড়ল। ছড়িয়ে পচে রইল রাস্তায়। অলিতে গলিতে। সরাসরি সরকারি মদতে কলকাতা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল চিৎপুর কলুটোলার মীনা পেশোয়ারি, হাফিজ খানদের মতো গুন্ডার দল। এরা মূলত পাঠান। আদি নিবাস আফগানিস্তান। প্রাথমিক স্তরে হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন বেশি। ঠিক এই সময় মূলত মধ্য কলকাতার একদল যুবক নিজেদের মতো করে সংগঠিত হচ্ছিল এর বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ক্রিক রো-র ভানু বোস, প্রভাত, সত্যেন, বুলু, জগা বোস। জেলেপাড়ার গোবর্ধন বাগ, চিত্ত বাগ, চন্দননগরের রাম চ্যাটার্জি। এদের নেতৃত্বে বউবাজারের গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় যিনি পরবর্তীতে গোপাল পাঁঠা নামে বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) হন। মীনা পেশোয়ারিদের ‘পাঠান গ্যাং’ এদের সামনে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ব্যাপারটা আর একতরফা থাকে না মোটেই। ফলে হত্যা-পালটা হত্যা চলতেই থাকে। এদিকে প্রায় দু’মাস ধরে চলতে থাকা এই দাঙ্গায় লক্ষাধিক মানুষ খুন হয়ে যান গোটা দেশ জুড়ে। বেলেঘাটায় স্বয়ং গাঁধীজি অনশনে বসেন এই নারকীয় গণহত্যার প্রতিবাদে। অবশেষে দাঙ্গা থামে। এর ঠিক এক বছর বাদে দেশ স্বাধীন হয়, তবে দু’টুকরো হয়ে। যার নিট ফল ভারত ও পাকিস্তান। রাজনীতির ভাগ বাঁটোয়ারা শেষ। সুরাবর্দীর স্বপ্ন সফল হয়নি। মানে কলকাতা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কেন্দ্র এবং রাজ্যে নব গঠিত কংগ্রেস সরকার।
দাঙ্গা তো শেষ। কিন্তু হাতে রয়ে গেছে প্রচুর অস্ত্র, ক্ষমতা আর লোকজন। অচিরেই কলকাতা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্রও এই মস্তান বাহিনীর ক্ষমতার রথ ছুটতে থাকে জেট গতিতে। নেতৃত্বে অবশ্যই সেই গোপাল পাঁঠা, তত্কালীন কলকাতার ‘আনক্রাউনড কিং’।
ওঁর এই বিচিত্র পদবির পিছনে অবশ্যই একটা কারণ ছিল। গোপালবাবুর কাকা অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন অগ্নিযুগের প্রখ্যাত বিপ্লবী। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা, অস্ত্রশস্ত্রের আদানপ্রদান এবং লুকিয়ে রাখা, শেল্টারের ব্যবস্থা, গোপন মিটিং/সভা আয়োজন মূলত এগুলোই ছিল অনুকূলবাবুর কাজ। এক কথায় উনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। কলেজ স্ট্রিট আর প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে একটা পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল ওঁর। সামনে মা কালীর ছবি আর দেয়ালে ঝোলানো একটা বিশালাকার বলির খাঁড়া। অনুকূলচন্দ্রের এই দোকানেই ছিল বিপ্লবীদের যোগাযোগ, খবর আদানপ্রদানের গোপন কেন্দ্রগুলির অন্যতম। ওঁর অবর্তমানে দোকানের মালিকানা বর্তায় ভাইপো গোপালের ওপর। সেই থেকেই ওঁর নামের পিছনে এই বিচিত্র পদবিটা জুড়ে যায়।
গোটা শহর জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দাপট দেখানোর আরও দুটি মঞ্চও প্রস্তুত হতে থাকে দ্রুত। পুজো আর জলসা। সে সময় সারা কলকাতায় বিখ্যাত ছিল বৌবাজারে গোপাল পাঁঠার সরস্বতী আর ক্রিক রোয়ে ভানু বোসের কালীপূজা। পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সারারাতব্যাপী জলসা। স্থানীয় এবং বহিরাগত অসংখ্য মধ্যবিত্তের বিনোদন। নিখরচায়। উইদাউট টিকিট। মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে শুরু করে হেমন্ত-মানবেন্দ্র-শ্যামল-ধনঞ্জয় সহ কলকাতা বম্বের অন্যান্য নামী দামি শিল্পীদের ক্রিক রোয়ের বিচিত্রানুষ্ঠানে হাজিরা ছিল মাস্ট (কলকাতা এবং শহরতলিতে আজকাল যে সব বাহুবলী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের পুজোর জাঁকজমক দেখতে আমরা অভ্যস্ত তার গোড়াপত্তন কিন্তু সেই সময় থেকেই)। ভানু-গোপালদের ওপর শাসকদলের কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। বাজারে চালু আছে তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিধানচন্দ্র রায় একবার যখন ইলেকশনে বামপন্থী প্রার্থী মহম্মদ ইসমাইলের কাছে প্রায় হারতে বসেছিলেন, শেষ মুহূর্তে কাউন্টিং বুথে হামলা চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মানরক্ষা করে ‘ভানু-গোপাল অ্যান্ড কোং।’
সবকিছুরই একটা শেষ থাকে। চল্লিশের দশক থেকে শুরু হওয়া মস্তানদের আধিপত্যে প্রথম ধাক্কা লাগে ষাটের দশকে, জঙ্গি বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের হাত ধরে। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় সোর্ড, চাকু, ডান্ডা, সাইকেলের চেন (মস্তান নেতাদের কারও কারও হাতে পিস্তল), বায়রনের সোডার বোতলের বদলে আসরে নামল পেটো। সোজা বাংলায় হাতবোম। আকাশ বাতাস কাঁপানো বজ্রগর্জন। মুহূর্তে এলাকা ফাঁকা। ছিটকে যাওয়া জালকাঠি, পেরেক, ভাঙা কাচের টুকরো, স্প্লিন্টার। ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করলে সোজা হাসপাতাল। মাসখানেক কমপ্লিট বেডরেস্ট। আর কপাল খারাপ হলে নিমতলা বা ক্যাওড়াতলার ইনসিওরেন্স স্কিম একেবারে পাক্কা। মূলত সেই সময়কার কলেজগুলোয় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির সদস্য রসায়নবিদ্যার ছাত্রদের আবিষ্কার এই পেটো। মাস্তানদের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে তখন কলকাতার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক যুব-ছাত্র নেতা-কর্মীর নাম। এরা কেউই তথাকথিত সমাজবিরোধী মস্তান নয়। স্রেফ একটা আদর্শের জন্য জান হাজির। মারতে ও মরতে প্রস্তুত সাহসী, শিক্ষিত এবং লড়াকু একদল যুবক। পেটো আর আদর্শবাদী এক ঝাঁক ছেলে। এই দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমাগত পিছু হটতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী। ‘ভানু-গোপাল বাহিনী অপরাজেয়’ এই মিথটায় কিন্তু চিড় ধরেছিল বেশ কিছুদিন আগেই। যাদবপুর অঞ্চলে একটা উদ্বাস্তু কলোনি দখলে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে মস্তানেরা। সে সময়কার কলোনি আন্দোলনের নেতা আমার এক সম্পর্কিত মামার কাছে শুনেছিলাম গাড়ি থেকে নেমেই নাকি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ভানুবাবু—‘আবে, আমাকে চিনিস? আমার নাম ভানু বোস!’ কিন্তু তিনি ও তাঁর দলবল বোধহয় ‘জার্মান পার্টি’র (তত্কালীন এদেশীয়রা ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এ নামেই ডাকতেন) মানসিকতা বুঝতে একটু ভুল করেছিলেন। একে তো সব ভিটেমাটি চাটি হয়ে এপারে এসেছে। দেশভাগ আর দাঙ্গার ক্ষত তখনও দগদগ করছে মনে। আর একবার আশ্রয় থেকে উচ্ছেদ হবার আশঙ্কা। ভিড়ের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠেছিল— ‘কে হালায় ভাউন্যা, ক্যাডা হালায় গোপাইল্যা? কে কোথায় আছস। বাইরা সব লাঠি-নাদনা লইয়া।’ এরপর শুরু হয়ে যায় যাকে বলে সংঘবদ্ধ ‘ব্লিত্জক্রিগ অ্যাটাক।’ বাঙাল নামক প্যানজার বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের সামনে কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী।
আবার প্রসঙ্গে ফিরি। ছাত্রযুবদের প্রতিরোধের সামনে পড়ে সেই যে পিছিয়ে আসার শুরু সেটা অন্তিম আকার নেয় নকশাল আমলে। পাড়ার মোড়ে, অলিতে গলিতে রাগী রোগা-রোগা চেহারার সবে দুধের দাঁত গজানো বাচ্চা ছেলেগুলো স্রেফ ধমকাচ্ছে না, বেশি বেগড়বাই করলে জানে মেরে দেবে— এ ভয়টা পুরনো বনেদি মস্তানদের মধ্যে চেপে বসল। এরই মধ্যে কোলে মার্কেটের সামনে এলাকার উঠতি বাঙালি ক্রিশ্চান ছেলে রনি গোমস এবং তার দলবলের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে যান ভানু বোস। মাসাধিককাল মৃত্যুর সঙ্গে টানাহ্যাঁচড়া করে ফিরে এলেও পুরনো দাপট আর ফিরে পাননি কোনওদিনই। আশির দশকেও মাঝে মাঝে দেখতাম মৌলালির মোড়ে পেতল কাঁসার বাসনের দোকানগুলোর সামনে টুলে বসে আছেন চুপ করে। হাতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের ভাঁড়। কীরকম একটা উদ্ভ্রান্ত ফাঁকা দৃষ্টি। পরাজিত কোনও সম্রাটের মতো। ভানু বোসের পতনের মধ্যে দিয়েই চল্লিশ থেকে ষাট দশকব্যাপী মস্তান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম তারকেশ্বর-চন্দননগরের রবিনহুড। রাম চ্যাটার্জি। ক্ষমতার খাঁজ-খোঁজ-গলিঘুঁজি এবড়ো খেবড়ো আর পিছল রাস্তা টপকে কীভাবে বাহুবলী থেকে রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে উন্নীত হয়েছিলেন সে এক অন্য ইতিহাস।
সত্যি কথা বলতে কী কলকাতার বুকে মস্তানরা প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিল ওই একবারই। ষাটের শেষ আর সত্তরের গোড়ায়। যাই হোক, বাহাত্তরের গোড়া থেকেই প্রবল সরকারি দমন পীড়নের মুখে পড়ে নকশাল আন্দোলনের আঁচ স্তিমিত হয়ে যায় অনেকটাই। হাজার হাজার যুবক গ্রেফতার হয়ে জেলে, পুলিশি অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান অনেকে। শহিদের সংখ্যাও অগুনতি— ‘এনকাউন্টারে’ অথবা দলীয় সংঘর্ষে। বাহাত্তর সালেই এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বাধীন নব কংগ্রেসি সরকার। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে আবার ফিরে আসে মস্তানতন্ত্র। এই মস্তানদের সরাসরি দু’ভাগে ভাগ করা যায়— এক) যারা পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যক্ষভাবে নকশাল প্রতিরোধ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। দুই) এই সব তরুণ-যুবকেরা, কোনওরকম রাজনৈতিক শিক্ষা বা আদর্শ ছাড়াই নকশাল আন্দোলনে ভিড়ে গিয়েছিল স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারিজম আর শক্তিপ্রদর্শনের মোহে। আন্দোলনে যখন ভাটার টান সেসময় পাড়ায় ফিরে এসে শাসকদলের নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ অথবা মুচলেকা/ বন্ড দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে আনুগত্য বদল করেছিল। প্রথম দলে অবশ্যই আসবে মধ্য কলকাতার কেশব সেন স্ট্রিটের কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত (মুখে বসন্তরোগের একাধিক ক্ষতচিহ্নের জন্য ফাটাকেষ্ট নামেই বিখ্যাত গোটা কলকাতা জুড়ে), গৌরীবেড়িয়ায় হেমেন মণ্ডল, কসবার দেবা দত্ত ওরফে হাতকাটা দেবা, কালিকাপুরে কানাই কুমির, চেতলা কালীঘাটে ভীম-টুপি কাশি-সোনা, মুদিয়ালি প্রতাপাদিত্য রোডে নীরেন চ্যাটার্জি ওরফে চিনা, পণ্ডিতিয়ায় নেলো, চারু মার্কেটে টনি, যাদবপুরে কানা অজিত, চাঁদনি কলুটোলায় মীর মহম্মদ ওমর, হাওড়ায় নব পাঁজা, বেলেঘাটায় রতন ঘোষ, ঘোঁতন মিত্র, বেলঘরিয়ায় ইনু মিত্তির, বরানগরে সত্য দুবে-বুটুন চ্যাটার্জি, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এ জগা মিত্র এরকম আরও অজস্র নাম। দ্বিতীয় দলে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের শঙ্কর সিং, টালিগঞ্জের অমল-সজল-কাজল-পণ্ডিত ইত্যাদি। নকশাল থেকে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরাই সেসময় কংশাল নামে পরিচিত হয়। আগেই বলেছি পুজো অথবা জলসা— স্ট্রংম্যানদের মাস্ল পাওয়ার শো করার অন্যতম সেরা পদ্ধতি। সেই কারণে অচিরেই কলকাতা জুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট আর বেহালায় ফাটাকেষ্ট, শঙ্কর পাইনের কালীপুজো, কসবায় দেবা দত্তর জলসা।
প্রথম দুটি দলের বাইরে তৃতীয় একটি দলও ছিল, প্রথমে যাদের কথা বলতে ভুলে গেছি। এদেরও অধিকাংশই জড়িত ছিল নকশাল আন্দোলনে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরোপুরি ডাকাত বনে যায়। সুদীর্ঘকালীন অস্ত্র নির্ভরতা আর অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা কখনওই পিছু ছাড়েনি এদের। সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ হয়েছিল যেটা— সহজে টাকা কামানোর নেশা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষিকেশ মুখার্জি। একাধিক ট্রেন আর ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আশির শেষাশেষি নদিয়ার হরিণঘাটায় নকশাল আমলের এক ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত হয় হৃষিকেশ। দ্বিতীয় যার কথা এখানে বলব, ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার কারণে তার নামটা উল্লেখ করছি না।
মা ছিলেন সরকারি নার্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়্যাল নার্সিং সার্ভিস কমিশনে যোগ দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানেই আলাপ হয় এক সুদর্শন পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারের সঙ্গে। যুদ্ধে আহত হয়ে কম্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরিচয় প্রেম আর প্রেম পরিণয়ে পরিণত হতে দেরি হয়নি। লন্ডনেই জন্ম হয় আমার পরিচিতের। তীক্ষ্ন মেধা, অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু আর অক্লান্ত পাঠক। ইবসেন থেকে অরণ্যদেব— কিছুতেই অরুচি নেই। হস্তাক্ষর সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখার মতো আর অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেয়ালে ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ লিখে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। একাত্তরের শেষদিকে গ্রেফতার। বছর সাতেক জেল খেটে বেরিয়ে ডাকাত দলে ভিড়ে আর একবার পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ক্রমাগত প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে অবশেষে ধরা পড়ে যায় ডিডি-র হাতে। শ্যাওড়াফুলি না চন্দননগর কোনও একটা স্টেশন থেকে। স্টেশনের বেঞ্চিতে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ার সময় বালিশের বিকল্প হিসেবে মাথায় রাখা ব্রিফকেসের মধ্যে ছিল লক্ষাধিক ক্যাশ টাকা, ভরি দশেক সোনার গয়না আর ছ’ঘড়ার একটা রিভলবার। শোনা কথা লক আপে হাজারো অত্যাচার সহ্য করেও লুঠ করা এবং লুকোনো টাকার হদিশ দেয়নি। পরবর্তী কালে প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দেবী রায় ‘দেশ’ (সম্ভবত) পত্রিকায় বাংলার ডাকাতদের নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ওর নামটাও সেই প্রতিবেদনে ছিল। দ্বিতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা মিত্সুবিসি ক্যান্টার ওয়াগন কিনে ভাড়ায় খাটাতে শুরু করে। কোনও ড্রাইভারের হাতে ছাড়েনি। নিজেই চালিয়ে চষে বেড়ায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড। এই তিনটে রাজ্যের প্রতিটা রাস্তাকে চেনে হাতের তালুর মতো, গাড়ির ক্যাবিনেটে সর্বক্ষণের সঙ্গী দেশি-বিদেশি দু’তিনটে বই আর রামের একটা পাঁইট। বিয়ে থা করেনি। ফুর্তিতে রয়েছে সবসময়। সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতি আর অপরাধ জগৎ দুটোই বর্তমানে ইতিহাস ওর কাছে। গাড়ির গায়ে লেখা ‘দ্য কার ইজ মাই ব্ল্যাক মাদার।’ কোথায় নাকি পড়েছে পৃথিবীর প্রথম মা কৃষ্ণকায়া এবং জন্মেছিলেন আফ্রিকা মহাদেশে।
এই তৃতীয় গোষ্ঠীটিতে এমনও অনেকে ছিল যাদের সরাসরি কোনও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সে অর্থে। একেবারে পেশাদার অপরাধী। এক্ষেত্রে নাম আসবে কাঁকিনাড়া জগদ্দলের বাবু মিত্র আর হুগলির কালিপটলা। রাস্তার ইলেকট্রিক তার কাটা আর ট্রেন ডাকাতিকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এই দু’জন। সাধারণ গুন্ডাদের কাছে যখন একটা ওয়ানশটার পাইপগান বা কান্ট্রিমেড রিভলবারই বিরাট ব্যাপার, তখন বাবু মিত্তিরের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটা মেশিন কারবাইন। পরবর্তীতে দু’জনেই গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘকাল কারাবাসের পর অপরাধ জগতের চালচিত্র থেকে মুছে যায়।
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আর একটি দলেরও উত্থান ঘটে কলকাতার বুকে। এরাও বিশ্বাস করত সশস্ত্র বিপ্লবে। তবে মত ও পথ অনেকটাই নকশালদের থেকে ভিন্ন। দলটির নাম ‘ম্যান মানি গান।’ সংক্ষেপে এমএমজি। নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনখ্যাত অগ্নিযুগের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ওরফে ‘মাস্টারমশাই’। এদের থিওরি হল, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের তেমন একটা প্রয়োজন নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্র চাই, চাই আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ একদল যুবক আর চাই টাকা, বিপ্লবের প্রয়োজনে অবশ্যই। টাকা আসবে কোথা থেকে? সোজা উত্তর— ডাকাতি করতে হবে। এই নীতির অনুসরণে কলকাতা জুড়ে ঘটে চলল একের পর এক ডাকাতির ঘটনা। আজ যারা মধ্য পঞ্চাশ বা তার বেশি, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সদর স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি, পার্ক স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি এবং গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্ক ডাকাতির কথা। এইসব ডাকাতির সূত্র ধরেই গোয়েন্দা অফিসারদের তালিকায় উঠে আসতে থাকে একাধিক নাম-বিপুল বাজপেয়ী, হিরণ্ময় গাঙ্গুলি ওরফে হেনা গাঙ্গুলি ওরফে ‘ঠান্ডাদা’। মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আর অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় কাজ হাসিল করতে পারার জন্য দলের মধ্যে ‘ঠান্ডাদা’ নামে ডাকা হত ওকে। একবার পার্ক স্ট্রিটে ডাকাতি করে পালানোর সময় পিছু ধাওয়া করে পুলিশের গাড়ি। দু’-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী বিপদ বুঝে একশো টাকার একটা বান্ডিল খুলে গাড়ির জানলা দিয়ে বেশ কিছু নোট বাতাসে উড়িয়ে দেন হিরণ্ময়। পথচারী মানুষজন টাকা কুড়োতে রাস্তায় নেমে পড়ে। ভিড়ে আটকে যায় পুলিশভ্যান। সেই ফাঁকে উধাও হয়ে যায় কালো অ্যাম্বাসাডার যা ওই সময় ডাকাতির বাহন হিসেবে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। প্রশাসনকে অনেক ঘোল খাইয়ে অবশেষে বেলেঘাটায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন হেনা। পরবর্তীতে এই দলেরও অনেকে পেশাদার ডাকাতে পরিণত হয়েছিল।
সেটা আশির মাঝামাঝি। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে দলবল সমেত বসে রয়েছেন মীর মহম্মদ ওমর। মধ্য কলকাতার অবিসংবাদিত ডন। এ রাজ্য ছাড়িয়ে সুদূর মুম্বই অবধি যার ক্ষমতার হাত বিস্তৃত ছিল, ওঠা-বসা ছিল হাজি মাস্তান মির্জা আর করিম লালাদের মতো কিংবদন্তী মাফিয়া ডনদের সঙ্গে। হঠাৎই বারের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল একজন। বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারা। হাতে খোলা রিভলবার। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সোজা গুলি চালাল ওমরের কপাল লক্ষ্য করে। সেই কপালই ভাল থাকায়, বুলেট গিয়ে লাগে ইঞ্চি দুয়েক ওপরে। কাচের দেয়ালে। গুলি চালিয়েই দ্রুত বার ছেড়ে বেরিয়ে সামনে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে মিলিয়ে যায় ওই যুবক। কে এই দুঃসাহসী? বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘেরই ল্যাজ মুচড়ে ধরার হিম্মত রাখে? উত্তরটা হল পার্ক সার্কাস এলাকায় জাননগর রোডের জান মহম্মদ ওরফে ‘পাগলা জান’। ঘনিষ্ঠ মহলে পরিচিত ছিল ‘দাদাভাই’ নামে। ওমর যে রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিল সেই দলেই ওমরের বিরোধী গোষ্ঠীর এক নেতার হাত ছিল এর পিছনে বলে অনুমান। মধ্য কলকাতায় ওমরের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে আর একবার সচেষ্ট হয়েছিল ওই গোষ্ঠী। ব্যবহার করেছিল ‘তাড়িবাবা’কে। এলিয়ট রোড রিপন স্ট্রিট অঞ্চলের ছোটখাটো গুন্ডা থেকে হয়ে ওঠা আরেক ডন। ওমর আর তাড়িবাবার দলবলের মধ্যে সংঘর্ষ সে সময় প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল মধ্য কলকাতায়। তবে তাড়িবাবা বা পাগলাজান কারও অপরাধ জীবনই তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পুলিশের তাড়া খেয়ে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয় তাড়িবাবা। প্রায় নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেরই বিশ্বস্ত অনুচর বাঙালি খ্রিস্টান দুই ভাই কেলো ও ভোলার পিস্তলের পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ছোঁড়া বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাগলাজান। এর কিছুদিনের মধ্যে কেলোও খুন হয়ে যায় এ জে সি বোস রোডের একটি কবরখানার ভিতরে।
খুন পালটা খুনের এই খেলার মধ্যেও ওমরের রাজ্যপাট অবশ্য বজায় ছিল আরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু তত্কালীন শাসকদল তাদের বিরোধী দলের অনুগামী ওমরকে কোণঠাসা করতে মদত জোগাতে থাকে বউবাজারের সাট্টা ডন রশিদ খানকে। রশিদ আর তার চ্যালা চামুণ্ডা গুড্ডু, কাট্টা শাকিল, লালাদের দাপটে একটু একটু করে নিজের জমি হারাতে থাকে ওমর। তারপর তো একটা খুনের কেসে ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘকালীন কারাবাস। অবশেষে জামিন পেয়ে ফেরার বিদেশে। আর কোনও দিনই ফেরা সম্ভব হয়নি। ওমর-পাগলাজান-তাড়িবাবা পরবর্তী সময়েও অনেক মস্তানি, ক্ষমতার দাপট, অস্ত্র আর টাকার ঝনঝনানি দেখেছে সংখ্যালঘু মহল্লা। ফুলবাগান, মেহেদি বাগান, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আওরঙ্গজেব, সোলজার, বুইয়া, স্টিলবডি। রাজাবাজারে ছক্কা মনোয়ার। দারাপাড়ায় বড়কা, কাদের, জাহাঙ্গীর। তিলজলায় লুলা বাপি। আনোয়ার শা রোডে রাজেশ, শেখ বিনোদ, শাহজাদা। নিত্য গ্যাংওয়ার নিজেদের মধ্যে ড্রাগ, মেয়ে পাচার, অবৈধ বেআইনি নির্মাণ, মদ ও জুয়া সাট্টার ঠেক আরও একাধিক বেআইনি ব্যাবসার থেকে লব্ধ অর্থের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। তবে এদের সবার অপরাধজীবনও স্বল্পমেয়াদী। গ্যাংওয়ার, পুলিশি এনকাউন্টার আর জেলের দেয়াল এদের বৃহদংশকেই অপরাধ জগতের মানচিত্র থেকে মুছে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। যদিও এদের মধ্যে কেউ কেউ জেলের মধ্যে বসেই দিব্যি রাজ্যপাট চালিয়ে যাচ্ছে একথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায় প্রিন্ট বা ভিশন মিডিয়ার দৌলতে।
এবার যে দুটি ঘটনার কথা বলব ভয়াবহতা আর হাড় হিম করা নৃশংসতায় তা হার মানাবে যে-কোনও বলিউডি ক্রাইম থ্রিলার সিনেমাকে। সেটাও আশির দশক। গোষ্ঠী সংঘর্ষে আহত হয়ে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে গোরা মিত্তির। সে সময় হাওড়ায় ত্রাস সঞ্চারকারী নাম। বেডের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা বাঁ হাত। পাশে বসা একজন পাহারাদার কনস্টেবল। দুপুরবেলা। ওয়ার্ড মোটামুটি ফাঁকা। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতে অনেক দেরি। একটু ঢিলেঢালা ভাব চারদিকে। ঠিক এই সময় কয়েকজন যুবক। হাতে হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। ওয়ার্ডে ঢুকেই দ্রুত চলে এল বেডের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল গোরার দেহ। হাত বাঁধা থাকায় পালানোর চেষ্টাটুকুও করতে পারেনি। গার্ড কনস্টেবলও এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কারা মারল গোরাকে? কেনই বা মারল? এর উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে খানিকটা। হাওড়া, যাকে ইংরেজরা বলত—‘শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া।’ শেফিল্ড ইংল্যান্ডের শিল্প নগরী, হাওড়াও তাই। শুধু দেশটা অন্য। অসংখ্য লোহালক্করের কারখানা থেকে বেরোনো লোহার ছাঁট বা স্ক্র্যাপ। চালু ভাষায় ‘বাবরি’। এর দখল নিয়ে মারামারি দু’দলে। একদলের পান্ডা গোরা মিত্তির। অপর দলের নেতৃত্বে নব পাঁজা। সে সময় গোটা হাওড়ার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা জল নেমে যেত এ দুটো নাম শুনলে। স্ক্র্যাপের ধান্দা থেকে ক্রমে ক্রমে রেলের টেন্ডার বা নিলামে ছড়িয়ে পড়ে এই দু’দলের প্রভাব। এদের কমিশন না দিয়ে কোনও ব্যবসায়ীর ঘাড়ে দুটো মাথা ছিল না স্বাধীনভাবে নিলামে অংশগ্রহণ করে। বাবরি আর টেন্ডার। এই দুয়ের দখল নিয়ে দুটো দলের মধ্যে চলতে থাকা নিরন্তর গ্যাংওয়ারের পরিণতি ঘটে গোরার মৃত্যুতে। এর বছরকয়েক পর নবও খুন হয়ে যায়। সেই নব পাঁজা। এক্স মিলিটারি পার্সোনেল। সত্তর একাত্তরে প্রবল পরাক্রান্ত নকশালরা বার বার এলাকা আক্রমণ করেও যাকে বাগে আনতে পারেনি। সেই নবকে কিনা খুন হতে হল অপরাধজগতে সদ্য পা রাখা এক নবাগতের কাছে। শিকারি। সামান্য রিকশাচালক থেকে হয়ে ওঠা পেশাদার খুনি। এই নামটাই উঠে এসেছিল বারবার পুলিশের কাছে। সাময়িক গ্রেফতার হলেও প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় শিকারি।
সকাল দশটা সাড়ে দশটার টিকিয়াপাড়া রেল ইয়ার্ড। লাইনের ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে একটা ছেলে। বয়স বছর কুড়ি বাইশ। হাতে খোলা স্টেইনগান। পিছনে ধাবমান বিশাল পুলিশ বাহিনী। চলছে গুলির লড়াই। চালাচ্ছে দু’পক্ষই।
অবশেষে লড়াই থামল। পরপর ছুটে আসা বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তত্কালীন হাওড়ার আতঙ্ক হুলাই। প্রতিপক্ষের একজনকে খুন করে পালানোর সময় পুলিশের ঘেরাওয়ে পড়ে যায়। ফল এনকাউন্টারে মৃত্যু। রেললাইনের ওপর নিস্পন্দ স্থির হুলাইয়ের দেহ। পাশে শোয়ানো নীরব স্টেনগান… এ ছবিটা ছাপা হয়েছিল প্রায় সবক’টি দৈনিক সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেজে। কভার স্টোরি হয়েছিল একাধিক। আলোচনা বুড়বুড়ি কেটেছিল ক’দিন ধরে। তারপর সব চুপচাপ। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি একটুও। এরপরেও হাওড়ার অন্ধকার জগতে উঠে এসেছে একের পর এক নাম। আপেল-গাম-টুলে, প্রভাত, রাখাল ডেভিড, অমিত, চাল শঙ্কর, মাছ শঙ্কর…। সব মিলিয়ে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। হু হু করে উঠে আসা অন্ধকার জগতে। গলায় মোটা সোনার চেন। নামী কোম্পানির টি শার্ট-জিন্স-পারফিউম। অ্যান্টিকুইটি, স্মিরনফ অথবা ব্লেনডারস প্রাইড, নারীসঙ্গ, দামি মোটরবাইক আর সেলফোন, কোমরে গোঁজা কালো ঘাতক, নেতাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, তারপর একদিন…গরাদের পিছনে নয়তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কানাগলির মোড়ে, রেললাইনের পাশে, নর্দমার ধারে, আবর্জনার ভ্যাটে অথবা চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা পানাপুকুরের পচা জলে। পাল্টায়নি এ ছবিটাও। বোধহয় পাল্টাবেও না কোনও দিন।
সাতাত্তরের নির্বাচনে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ দুনিয়ার ক্যানভাসেও দু’-চারটি পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে থাকল। বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থবাবু— এদেশ শাসনকালে রাজনীতির সঙ্গে পেশিশক্তির সম্পর্ক থাকলেও গুন্ডা মস্তানরা পার্টি অফিসের দরজাটা টপকাতে পারেনি কখনওই। রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রয়োজনে মাস্লম্যানদের ব্যবহার করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা কখনওই নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-নির্ণায়ক কোনওটাই হয়ে উঠতে পারেনি। সাতাত্তর পরবর্তী সময়ে এই সীমারেখাটা মুছে যায়।
দ্বিতীয় যে সমস্যাটি গুরুতর হয়ে দাঁড়াল তত্কালীন শাসকদলের কাছে, সেটা শিক্ষিত এবং লড়াকু জঙ্গি ক্যাডারের আকাল। যারা সারা রাত জেগে পোস্টার মারবে, দেয়াল লিখবে, চে গুয়েভারার ডায়েরি পড়বে, কোট করবে ‘রেড বুক’ বা লেনিনের ‘পার্লামেন্ট অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ থেকে। স্ট্রিট কর্নারে উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠবে ‘ইন্টারন্যাশনাল’, আবার প্রয়োজনে বোমা-পাইপগান হাতে রাস্তায়ও নামবে। নচিকেতার গানের সেইসব ‘অনিন্দ্য সেন’দের অনেকেই সত্তর একাত্তরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিহত অথবা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলেন। বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন কেউ কেউ। যারা তখনও পুরনো দলে রয়ে গেছেন, আশির দশক শেষ হতে না হতেই তাদের একটা বৃহদংশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে গেলেন। নীতিতে না মেলার জন্য বহিষ্কারও করা হল অনেককে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতা মন্ত্রী হলেন। গদি, ঝাঁ চকচকে পার্টি অফিস, এসি কামরা আর স্করপিও ছেড়ে তাদের পক্ষে আর রাস্তায় নামা সম্ভব নয়। ঠিক এই রন্ধ্রপথ দিয়েই প্রবেশ এবং উত্থান দুলাল-হাতকাটা আশিস-লালি-বুল্টন-পলাশ-হাতকাটা দিলীপ-গব্বর-হুব্বা শ্যামল-রশিদ খান বাহিনীর। পেটে ক্রেন নামালে ‘ক’ উঠবে না। আদর্শ— সেটা খায় না মাথায় মাখে জানা নেই। সাট্টার ঠেক চালাও, চুল্লু বেচো, পুকুর বোজাও, গাছ কাটো, জমি দখল করো, গায়ের জোরে গৃহনির্মাণ সংস্থা অথবা মধ্যবিত্ত গৃহস্থকে বাড়ি তোলার সময় নিম্নমানের ইট-বালি-সিমেন্ট সাপ্লাই করো, চমকে ভয় দেখিয়ে তোলা তোলো। নজরানা পৌঁছে দাও সঠিক সঠিক স্থানে নিয়মিত। তারপর বিন্দাস থাকো। শুধু দলের হয়ে ইলেকশনের সময় আর টুকটাক প্রয়োজনে একটু-আধটু রাস্তায় নামো। এই একটু-আধটু রাস্তায় নামাটা যে কী বিষম বস্তু, টের পেয়েছিলেন বউবাজারের মানুষ, আশির দশকের শেষ দিকে পুরসভার নির্বাচনে। মোটামুটিভাবে বিরোধী দল প্রভাবিত এলাকা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বিরোধী প্রার্থীর জয় প্রায় নিশ্চিত। হিসেবটা উলটে গেল ভোটের দিন। সকাল থেকেই হাতে খোলা সোর্ড, বোমা, রিভলবার নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল ‘ডোবারম্যান গ্যাং’। সব হিসেব গুলিয়ে দিয়ে জয়ী হলেন শাসক দলের প্রার্থী। বাহাত্তরের ইলেকশনে রিগিং প্রায় প্রবাদকথায় পরিণত। তাকেও বলে বলে দশ গোল মেরেছিল বউবাজারের পুরসভা নির্বাচন। রাস্তায় খোলা পিস্তল হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্বৃত্ত দল— এ ছবিও ছাপানো হয়েছিল প্রতিটি কাগজের সামনের পাতায়। কিন্তু মস্তানদের কারও টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি। এই নব্য মস্তানবাহিনীর সঙ্গে পুরনো বাহুবলীদের ফারাক একটাই। তাঁরা ছিলেন পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবক। সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় জুলুম একেবারেই না পসন্দ ছিল ওদের। এলাকার মেয়েদের সম্মান ইজ্জত নিয়ে প্রচণ্ড সচেতন। আমার এক আত্মীয়া, শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসিন্দা (এখন বিয়ে হয়ে দিল্লিতে), তার কাছেই শুনেছিলাম গল্পটা। বাড়ি ফিরছেন একটু রাত করে। পাড়ার মোড়ে দলবল সমেত বসে আছেন গোপাল পাঁঠা। রক থেকেই বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার—‘কোথায় গিয়েছিলে মা?’ মিনমিনে গলার উত্তর— ‘মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে।’ আবার প্রশ্ন— ‘রাস্তায় কেউ বিরক্ত করেনি তো?’ নীরবে ঘাড় নাড়া কোনওমতে—‘না।’ ‘ঠিক আছে, বাড়ি যাও।’ সেখানে আজকালকার মস্তানবাহিনী। ন্যূনতম মূল্যবোধের বালাই নেই। যে-কোনও অপরাধ করতে কুণ্ঠা নেই বিন্দুমাত্র। শুধু টাকার অঙ্কটা ঠিকঠাক থাকতে হবে। ষাটের দশকের বাহুবলীরা যদি সামন্ততান্ত্রিক গ্রামপ্রধান হন সেখানে আধুনিক মস্তান বাহিনী—‘হাইলি প্রফেশনাল কর্পোরেট’! যেখানে সবটাই— ‘এন্ড অফ দ্য ডে মানি অ্যান্ড প্রফিট ম্যাটারস।’
আজকাল বিস্ময়ভরে একটা ব্যাপার খেয়াল করছি। মেটিয়াবুরুজে হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং সমাজবিরোধীর গুলিতে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনায় রোজ উঠে আসছে একের পর এক নাম। তাদের সঙ্গে অপরাধ, অপরাধ জগৎ আর রাজনীতির উচ্চতম মহলের যোগাযোগের কথা। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন বিরোধী (পূর্বতন শাসক) দলের নেতারা। যেন মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ এলাকা এই সেদিন অবধিও স্বর্গরাজ্য ছিল! রাতারাতি ব্রাজিল-কলম্বিয়ার অলিগলি, নিউ ইয়র্কের ডাউন টাউন বা মুম্বইয়ের ধারাভি ডোংরির মতো অপরাধের নরকে পরিণত হয়েছে। অথচ বন্দর এলাকায় মাফিয়াচক্রের কাহিনি তো আজকের নয়। স্মাগলিং, ভাঙা জাহাজের অকশন, কাটা কাপড়ের ধান্দা, ড্রাগ পাচার থেকে হালফিলের বেআইনি নির্মাণের ইতিহাস তো প্রায় চার দশকের পুরনো। বন্দর এলাকার দখল নিয়ে গ্যাংওয়ার, এনকাউন্টার আর মৃত্যু। অপরাধ জগতের গ্রাফটা নীচে নামেনি কখনওই। উলটে রাজনৈতিক রং পালটে পালটে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে বাহুবলীরা। অথচ আলোচনার সময় এ সব কথা বেবাক ভুলে যান এইসব নেতারা। এরা ভুলে যান চুরাশি সালে এই মেটিয়াবুরুজেই বাতিকল কাচ্চিসড়ক এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল সৎ এবং সাহসী পুলিশ অফিসার ডি সি পোর্ট বিনোদ মেহতাকে। এই কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত ইদ্রিস মিঞার মৃত্যু হয় পুলিশি হেফাজতে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক সংবাদপত্রে বারবার নাম উঠে আসে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা ও মন্ত্রীর। যথারীতি নমো নমো করে একটা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। ফল? খুদা মালুম। আলোচনার সময় এসব কথা বেমালুম ভুলে মেরে দেন ওইসব নেতারা। এরা ভুলে যান অনিতা দেওয়ানের কথা। বর্বরভাবে ধর্ষণ এবং খুন করেও ক্রোধ মেটেনি জানোয়ারদের। ময়নাতদন্তের সময় জননাঙ্গের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল প্রমাণ সাইজের একটা টর্চ। ক্ষমা করে দেবেন অনিতা দেওয়ান। সেই বিস্মৃতির তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বিজন সেতু আনন্দমার্গী হত্যা। কারা জড়িত ছিল? এই কেসে তদন্তকারী অফিসার তিলজলা থানার ওসি গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের বুকে কে বা কারা মোটর সাইকেল করে এসে গেঁথে দিয়েছিল একের পর এক বুলেট। তদন্ত রিপোর্ট বলছে বুলেটগুলো ছোঁড়া হয়েছিল নাইন এমএম পিস্তল থেকে। ঘাতক অথবা ঘাতকবাহিনীকে কিন্তু ধরা যায়নি কোনওদিনই। ভাববার কথা। ভাবতে হবে। ডান-বাম-লাল-গেরুয়া-তেরঙ্গা সবাইকে। আগের সেদিন আর নেই যে, রাজনীতিকদের অঙ্গুলিহেলনে মস্তানচক্র নিয়ন্ত্রিত হবে। ক্ষমতায় থাকলে সবকিছু চেপে দেওয়া আর ক্ষমতাচ্যুত হলে চেপে যাওয়া আর ভুলে যাওয়া— এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে তাহলে সেদিন আর দূরে নয় যখন রাজনীতি গুন্ডাদের নয় উলটে গুন্ডারাই জার্সি পালটে পালটে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শেষের সেদিন সত্যিই ভয়ংকর! তবু কোথায় যেন ক্ষীণ আলোর একটা রেখা। সিলভারলাইন ভাঙড়, গার্ডেনরিচ কাণ্ডে একাধিক গ্রেফতারির ঘটনায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেটা (দুর্ভাগ্যবশত নন্দীগ্রাম, কেশপুর, আরামবাগ, খানাকুল, নেতাই, গোঘাট, দাসের বাঁধে সেটা দেখতে পাইনি আমরা)। মিলিয়ে না যায়। তা হলেই অন্য একটা কালো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গায়ে আর এক পোঁচ কালো রং লেগে যাবে। লাগতেই থাকবে। বারবার। হাজার প্যাকেট প্রশাসনিক ডিটারজেন্টেও উঠবে না সে রং। অতএব সময় থাকতে, সাধু সাবধান!
০২. কোড কলকাতা
সেটা সত্তরের দশক। টালমাটাল অস্থির সময়। সন্ধে আটটা নাগাদ দুটো ছেলে। গায়ে আলোয়ান জড়ানো, কলেজ স্কোয়্যারের গা ঘেঁষে সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছিল নিচু গলায় কথা বলতে বলতে— ‘লালের স্টক কী রকম?’
‘তা মোটামুটি ভালই’, ‘আর সাদা-র কী খবর?’ ‘সমর তো বলল কালকের মধ্যে সাপ্লাই এসে যাবে।’ ‘তা হলে তো আর চিন্তা নেই, এত পেটো ঝাড়ব যে মাকুরা পুরো এলাকা থেকে সাফ হয়ে যাবে।’
পাঠকবর্গ, এইটুকু বলার পর যদি হেড এগজামিনারের ভাষায় প্রশ্ন করা যায়— ‘উপরোক্ত বাক্যগুলির ভাবার্থ বর্ণনা করো…।’ কী হল? হযবরল-র কাকেশ্বর কুচকুচের মতো হাতে পেনসিল হয়ে গেছে তো? আরে না না, ইয়ার্কি মারছি না একদম, আসলে ওপরের রহস্যময় কথোপকথনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কয়েকটি ছোট্ট শব্দ— ‘কোড’। আসুন আর হেঁয়ালি না করে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি।
প্রথম জন ‘লাল’ এর স্টক জিজ্ঞেস করছে। ‘লাল’ মানে পটাশ। এক ধরনের রাসায়নিক। ‘সাদা’-র অর্থ ম্যাগনেশিয়াম মোমছাল। সেটাও রাসায়নিক। আর এক ধরনের। দুটো রাসায়নিকের ভূমিকাই ‘পেটো’ অর্থাৎ হাতবোমা বাঁধার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই দু’জন যুবক নকশালপন্থী। ‘মাকু’ মানে ওদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুদলের সংক্ষিপ্ত কোডনেম। ওই রাজনৈতিক দলটির সমর্থকরাও নকশালপন্থীদের ‘নকু’ কোডনামে ডাকত।
কোনও রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা মতবাদকে হেয় বা খাটো করার ন্যূনতম প্রয়াস এই প্রতিবেদকের নেই। আসলে সেই সময় কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে কোড বা সাংকেতিক ভাষাগুলো রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রচলিত ছিল তার একটা নিরপেক্ষ এবং নির্ভেজাল বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র। যাই হোক, বহু প্রাণ এবং ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে সত্তর দশক তো বিদায় নিল, কিন্তু পরবর্তীতে কোডগুলো ছড়িয়ে পড়ল অপরাধজগতে। এর মধ্যে ‘মাকু’ আর ‘নকু’ আজকাল আর তেমন শোনা না গেলেও ‘লাল’ ‘সাদা’ আর পেটো কিন্তু স্বমহিমায় বিরাজ করছে আজও।
এ ভাবে কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কোড বা সাংকেতিক ভাষা। যেরকম ‘রামপুরিয়া’ বা ‘কানপুরিয়া’ উত্তরপ্রদেশের দুটো জেলায় তৈরি ছ ইঞ্চি ফলার চাকু। কলকাতায় আগমন ষাটের দশকে। খাপের ভাঁজ থেকে টেনে বা স্প্রিং টিপে খুলতে হত। এদিকে ‘পেটো’ ছাড়াও হাতবোমার একাধিক সাংকেতিক নাম রয়েছে, যেরকম— ‘মাল’ ‘গ্যানা’ অথবা ‘নাড়ু’। বিভিন্ন অস্ত্রের বিভিন্ন কোডনেম। ‘যন্তর’ ‘চেম্বার’, ‘মেশিন’ বা ‘ছোট রড’ আসলে পিস্তল, রিভলবার বা ওয়ানশটার। ‘দানা’ বা ‘ক্যাপসুল’ মানে বুলেট। ‘ন্যাপালা’-র অর্থ ভোজালি বা কুকরি। রাইফেল, মাস্কেট বা বন্দুক যথাক্রমে ‘বড় রড’ বা ‘হনুমান’। গ্রেনেড তো অনেক দেখেছেন হলিউডি বলিউডি সিনেমায়। অপরাধ জগতে এর ছদ্মনাম ‘আতা’। একটু খুঁটিয়ে ভাবুন। আকৃতির অদ্ভুত মিলটা চোখে পড়বে। আশির দশকের গোড়ার সময় থেকে একটি অস্ত্র অপরাধীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষুর— ছোট, হালকা, লুকিয়ে রাখার পক্ষে আদর্শ। কোডনেম ‘আওজার’ বা ‘আস্তুরা’। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছেড়ে চলুন এবার একটু অপরাধীদের ডেরায় ঢুকি।
মল্লিকবাজারের মোড়। দু’দল যুবক। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে— ‘হামলোগকা মিস্তিরি বোল রহা থা কি পার্টি মে দো চার লেবার কম পড় রহা হায়। তেলোগকা পার্টি সে আগর কুছ লেবার মিল যায়ে তো বড়ি মেহেরবানি হোগি।’ আপাতদৃষ্টিতে মনেই হতে পারে খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। একটা শ্রমিকদলে কয়েকজন শ্রমিক কম তাই সেই দলের হেডমিস্তিরি অন্য আরেকটি দলের কাছে ক’জন শ্রমিক ধার চাইছে। আজ্ঞে না মশাই। ব্যাপারটা মোটেই অতটা সোজা নয়। ওরা আসলে দু’দল পকেটমার। এখানে ‘মিস্তিরি’-র অর্থ দলের পান্ডা মানে মূল কাজটা যে করে। অর্থাৎ আমার আপনার পকেট থেকে ট্রামবাসের ভিড়ে মোবাইল বা মানিব্যাগটা তুলে নেয়। এ কাজে ‘মিস্তিরি’-কে যে সাহায্য করে তার কোডনেম ‘সেয়ানা’। এদের কাজ হল ঠাসাঠাসি করে শিকারকে ভিড়ের মধ্যে চেপে ধরা, যাতে সে একদম নড়াচড়া না করতে পারে। দলে সবচেয়ে নিচু পদ ‘লেবার’। গেটের দিকে নজর রাখা এবং যে-কোনও পরিস্থিতিতে দলকে সাহায্য করাটাই এদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। পকেটমার জগতে কোড অজস্র। সামান্য কয়েকটি নমুনা দিলাম এখানে।
মানিব্যাগ—‘কালা তাকিয়া’, মোবাইল—‘রোতা বাচ্চা’ (ক্রন্দনরত শিশু), গলার হার—‘ছল্লি’ অথবা ‘পাক্কি’। মহিলা যাত্রী—‘তরকারি’, কাঁচি বা ব্লেড—‘চিপটেন’, কানের দুল— ‘টিংকা’, একশো, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট যথাক্রমে ‘গজ’, ‘গান্ধি’ এবং ‘লালপান’। পুরোটা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কিছু বিশেষ ধরনের তস্করদের কথা বলি।
হাওড়ায় ট্রেন ধরতে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে অনেকটা দেরি হবে। প্রচুর যাত্রী ওয়েটিং রুমে, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত। অনেকেই মেঝেতে চাদর অথবা কাগজ পেতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। আপনিও কিছু একটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন তাদের পাশে। চোখ লেগে এল, ঘুম ভেঙে দেখলেন সঙ্গের লাগেজ উধাও। এটা ‘পড়িবাজ’-এর কীর্তি। ঘুমন্ত যাত্রীর অভিনয় করে নিরীহ যাত্রীর মালপত্র লুটে নিয়ে পালিয়ে যায় এরা। অপরাধ জগতে ঘুমের কোডনাম ‘পড়ি’। সেটা থেকেই ‘পড়িবাজ’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও তিন ধরনের ‘বাজ’-এর সন্ধান মিলবে আমাদের এ শহরে।
‘কটবাজ’-পাতি বাংলায় চিটিংবাজ। বিভিন্ন কায়দায় লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করাটাই এদের একমাত্র পেশা। মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাস, তালতলা, বউবাজার অঞ্চলে এরকম বেশ কয়েকটা বড় বড় ‘কটবাজ’ গ্যাং সক্রিয় ছিল বা আছে। এদের মধ্যে দু’জন তো ভিন রাজ্য থেকে আসা কোনও অবাঙালি ব্যবসায়ীকে নিজস্ব বাংলো বলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ব্রিগেডকে ধানি জমি দেখিয়ে বেচে দিয়েছিলেন এ রকম প্রবাদ আছে বাজারে।
এবার ‘ঢোলবাজ’। মুটে বা কুলি সেজে ট্রেনের বাঙ্ক থেকে যাত্রীর মাল নামিয়ে দ্রুতপায়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এদের দক্ষতা অপরিসীম।
তবে সেরার সেরা ‘বাজ’ হচ্ছে ‘গাব্বাবাজ’। যে-কোনও ধরনের তালা দু’-এক মিনিটের মধ্যে খুলে বা ভেঙে ফেলা এদের কাছে জলভাত। ক্রাইমের দুনিয়ায় তালার সাংকেতিক কোড ‘গাব্বা’। সেখান থেকে ‘গাব্বাবাজ’-এর উৎপত্তি বলেই মনে হয়। খোলা ছাড়াও নিঃশব্দে যে-কোনও তালা ভেঙে ফেলার ব্যাপারেও এদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাই এদের আর এক নাম ‘গাব্বা ভসকান’। তালা খোলার চাবি একটা সরু লোহার তার। সামনের দিকটা ঈষৎ বাঁকানো। কোডনেম ‘গামছা’। জোর করে ধমকে চমকে টাকা আদায় করার নাম যে ‘তোলা’ বা ‘হপ্তা’ সেটা মিডিয়ার দৌলতে আজকাল অনেকেই জানেন। কিন্তু এর আরও দুটো নাম যে ‘খিরাজ’ বা ‘তোড়িং’ অনেকেই তা জানেন না বোধহয়। লুঠ করা সম্পদের ভাগ বাঁটোয়ারাকে বলা হয় ‘হিস্সা’। এই হিস্সা নিয়ে মামলা অনেক সময় খুনখারাপি পর্যন্ত গড়ায়। যে-কোনও ধরনের অপরাধীর সঙ্গেই যাদের সম্পর্ক অনেকটা ননদ-বউদির মতো তারা হল পুলিশ আর ইনফর্মার। অপরাধ জগৎ এদেরও সাংকেতিক নামকরণ করেছে। পুলিশ—‘মামা’ বা ‘মামু’। আর ইনফর্মার হল গিয়ে ‘খোঁচড়’, ‘টিকটিকি’ বা ‘খবরি’। অপরাধ করেই অকুস্থল থেকে চম্পট দেওয়াই অপরাধীদের মূল লক্ষ্য। ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের ভাষায় এর নাম ‘ঢিল দেওয়া’ ‘নও দো এগারা’ অথবা ‘কালটি’।
ছোট বড় যে-কোনও অপরাধীরই শেষ ঠিকানা জেল। এখানেও রয়েছে একাধিক নিজস্ব ভাষা, যা জেলেই একমাত্র শুনতে পাওয়া যায়। যেমন ‘চৌকা’ মানে রান্নাঘর। ‘লালটোপি’— রেপকেসের আসামি। ‘চিল্লর’-চামউকুন। ‘পাগলি’-র অর্থ বিপদ সাইরেন। ‘পলিতা’-র অর্থ কেরোসিন ভেজানো ন্যাকড়ার সলতে জ্বালিয়ে কোনও বন্দির পায়ের পাতায় ‘ছ্যাঁকা’ দেওয়া। তবে কাউকে হেনস্থা করার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট পন্থাটি হল ‘পোচাড়া’ মানে ন্যাকড়ায় মলমূত্র মাখিয়ে গায়ে ছুড়ে মারা। আরও দুটো কোড বহুল প্রচলিত ছিল জেলে ষাট সত্তর দশকে। তবে অপরাধীদের নয়। রাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে। জেনারেল বডি মিটিং, সংক্ষেপে জিবি, ‘বড় কম্বল’ আর ছোট গ্রুপ মিটিং পরিচিত ছিল ‘ছোট কম্বল’ নামে। অপরাধ জগতের প্যাঁচপ্যাঁচানি তো সেরে ফেলা গেল মোটামুটি। চলুন এবার একটু নেশার দুনিয়ায় ঝিম খাই।
এই গোটা শহরটা জুড়ে, নেশারু আর নেশার উপকরণের ছড়াছড়ি। অলিতে গলিতে অজস্র বার, ঠেক আর জয়েন্ট। তালিকায় ‘র্যাঙ্কিং ওয়ান’ অবশ্যই মদ। এর একাধিক নাম, প্রায় কৃষ্ণের অষ্টতর শতনামের মতো। কত নামে যে রসিকরা আদর করে ডাকে! ‘তেল’, ‘জল’, ‘সাদাজল’, ‘লালজল’, ‘গরমজল’, ‘মাল’, ‘খাট্টু’, ‘পিকআপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি…। ঘরে তৈরি বেআইনি দেশি মদের নাম ‘চুল্লু’ বা ‘চৌ এন লাই’। আবার সরকারি দেশি মদেরও একাধিক কোডনাম রয়েছে সুরাপায়ীদের কাছে। ‘বাংলা’, ‘বাংলু’, ‘ব্যাং ব্যাং’। গাঁজার কোড— ‘তামাক’, ‘থাম’, ‘খাম’, এবং সাহেবি কেতায় ‘গ্রাস’। চরস পরিচিত ‘চেরি’ বা ‘পিচ’ নামে। ডেনড্রাইট ‘আঠা’। ফেনসিডিল বা কোরেক্স জাতীয় কাশির সিরাপের আদুরে নাম ‘জুস’। তবে সবচেয়ে রোম্যান্টিক কোড ম্যানডেক্স কামপোজ বা স্প্যাসমোপ্রক্সিভন জাতীয় নেশার ট্যাবলেটের— ‘চাঁদ কা টুকরা’। শিরায় মাদক নেওয়া নেশাড়ুদের কোড— ‘মেইনলাইনার’। গাঁজার কলকে মানে ‘বন্দুক’ আর কলকে প্যাঁচানোর ন্যাকড়া মানে ‘সাপি’। হেরোইন মানে ‘পাতা’ আর হেরোইনখোর মানে যে ‘পাতাখোর’ সেটা এখন পাড়ার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাও জানে। তাই এগুলোকে আর কোডের পর্যায়ে ফেলছি না।
এবার যে দু’টো দুনিয়ার কথা বলব তাদের ব্যবহৃত কোডগুলো একান্তই তাদের নিজস্ব এবং এক্সক্লুসিভ। সেগুলো হল নিষিদ্ধপল্লী আর হিজড়ে সমাজ। লালবাতি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী যৌনকর্মীদের বলা হয় ‘পার্মেন্ট’ (পার্মানেন্ট)। ঠিক একই ভাবে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘ফেলাইন’ (ফ্লাইং) নামে। বহু জায়গায় মদের একাধিক কোডনেম শুনেছি কিন্তু ‘কেরোসিন’ কোথাও শুনিনি। এটা একান্তভাবেই এ পাড়ার নিজস্ব। এ ছাড়াও এই এলাকায় দেশি মদের আরেক নাম ‘ক্যান্টি’ (কান্ট্রি লিকারের অপভ্রংশ বোধ হয়)। ‘দাল্লা’ বা ‘ভেরুয়া’-র অর্থ এখানে দালাল। ‘ক্যাসেট’ মানে পাচার হতে আসা নাবালিকা। কন্ডোম—‘বেলুন’, আর পুলিশভ্যান— ‘চাক্কা’। উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সুন্দরী এবং হাই প্রোফাইল যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘আগ্রাওয়ালি’ বা ‘বেরিয়া’ বলে। কলকাতায় একমাত্র সোনাগাছিতেই এদের দেখা পাওয়া যায়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বইয়ের বিভিন্ন বার এবং অনুষ্ঠানে নাচতে যাওয়া মেয়েদের ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইডেনটিটি—‘আইটেম’। এই কোড প্রথম মুম্বইয়ে চালু হলেও হালফিল কলকাতায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
কোডের গোপনীয়তায় সবাইকে টেক্কা দিতে পারে হিজড়ে বা বৃহন্নলারা। যা মেইনস্ট্রিম বা সমাজের মূল ধারার কাছে অজানা অচেনা এক শব্দকোষ। এদের ভাষাজগতে বহু শব্দ বা বাক্যের মানে দ্বিমাত্রিক। যেমন— ‘ঝোলকি’ মানে রোজগার বা আয়, ‘থাপ্পু’ মানে টাকা বা নোট। ‘খোবরা’ মানে মাংস। ‘বড় খোবরা’ মানে পাঁঠার মাংস, আর ‘ছোট খোবরা’ মানে মুরগি। ‘আকুয়া’-র অর্থ বহিরঙ্গে পুরুষ কিন্তু হৃদয়ে নারী। ‘ছিবড়ি’— পুরোপুরি পুরুষ কিন্তু জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে হিজড়ে পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ‘ছিন্নি’ মানে খোজাকরণ। ‘গুরুমা’ বা ‘মুখ হিজড়ে’ কথার অর্থ দলপতি বা গোষ্ঠীপতি। প্রায় প্রত্যেক হিজড়েরই এক অথবা একাধিক পুরুষবন্ধু থাকে। এদের বলা হয় ‘পারিক’, ও ‘ডবল ডেকার’। এরা যথাক্রমে সমকামী ও উভকামী। এ ছাড়াও কমপক্ষে শতাধিক কোড রয়েছে উপরোক্ত দুই জগৎ জুড়ে। ‘সো কলড’ শালীনতার সীমা অতিক্রম করবে তাই সেগুলোর উল্লেখ আর এখানে করলাম না।
চলুন এবার একটু সংখ্যালঘু মহল্লায় চক্কর কেটে আসি। এই সব এলাকার নিজস্ব কিছু কোড আছে যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই বললেই চলে, স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষায় গোমাংসের নাম ‘ভক্কর’ বা ‘দো নম্বর’। মোষের মাংস ‘জামসি’। খাসির মাংস ‘এক নম্বর’ আর শুয়োরের মাংস অবশ্যই ‘হারাম’। জবাই করা প্রাণীর মাংসকে বলা হয় ‘হালাল’। অন্যদিকে বলি দেওয়া কোনও প্রাণীর মাংস পরিচিত এবং পরিত্যাজ্য ‘ঝটকা’ আর ‘হারাম’ বলে। খাওয়াদাওয়ার পপুলার কোডনেম ‘জাবরোটি’। বড় বড় কথা বলা বা গুল মারার অভ্যাসকে বলা হয় ‘ফেকফাক’ বা ‘ছোড়মঞ্জন’। অর্থাৎ দাঁতের মাজন বিক্রেতাদের বড় বড় কথায় খদ্দেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাল বিক্রি করার দক্ষতার সঙ্গে উপমাটির মিল টানা হয়। মেয়েলি ধরনের পুরুষ বা হিজড়েদের ‘ছক্কা’ অথবা ‘আট্ঠা’ বলে সম্বোধন করা খুব কমন প্র্যাকটিস এখানে। কিন্তু ফল বিক্রি করা যাদের পেশা তাদের কেন ‘কুঁজড়া’ বলে ডাকা হয় এর কোনও সংগত ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি আজও। এর শেষে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিই আগেভাগেই। সংখ্যালঘু এলাকার রাস্তায় কোথাও মারামারি বাধলে যদি শোনেন কেউ হুঙ্কার ছাড়ছে—‘আবে, লঙ্গি নিকাল…’ সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার চেষ্টা করবেন। কারণ ‘লঙ্গি’ মানে তরোয়াল বের করার কথা বলছে। অতএব সাধু সাবধান।
সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কোড, শহরের অলিতে গলিতে রাস্তায়। শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে যাচ্ছি। পাড়ার রকে ক’টা ছেলে। সিরিয়াস আলোচনা— ‘জানিস তো, গেল রাতে মিত্তিরদের বাড়িতে যে চোরটা ধরা পড়েছিল, সবাই মিলে সেটাকে এমন সেঁকল যে আর একটু হলে খরচাই হয়ে যাচ্ছিল…তা হলে তো বিলা হয়ে যেত মাইরি।’ এই সম্পূর্ণ বাক্যটার মধ্যে অন্তত তিনটে কোড লুকিয়ে রয়েছে। ‘সেঁকল’ মানে প্রচণ্ড মার মারল। ‘খরচা’ হয়ে যাচ্ছিল অর্থাৎ মরে যাচ্ছিল। সবশেষে ‘বিলা’-র মানে ঝামেলা বা গণ্ডগোল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটা কোড অত্যন্ত জনপ্রিয় শহর জুড়ে। ‘মুরগি’। ঠকে যাওয়া বা বোকা বনে যাওয়া মানুষের কোডনেম। এ ছাড়াও ট্যারা কাউকে ‘দেড় ব্যাটারি’ বা মেয়েলি ধরনের পুরুষকে ‘বউদি’ বলে হামেশাই ডেকে থাকি আমরা। কারও ঠকে যাওয়া, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা একটা অন্য ধরনের চালচলন নিয়ে রসিকতা, সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার কাছে বিশেষ প্রাপ্তি বই কী। বলতে ভুলেই গেছি ‘স্যাঁকা’ ছাড়াও পেটানোর আরও চারটে কোড চালু আছে কলকাতায়। সেগুলি হল যথাক্রমে ‘সাইজ করা’, ‘বানানো’, ‘ক্যালানো’, আর ‘বাটামবাজি’। একই ভাবে ঘুসি মারারও তিনটে কোড— ‘টিক’, ‘ঠুসো’ আর ‘হাতোড়া’। এর মধ্যে শেষেরটা শোনা যাবে একমাত্র অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। ‘হাতোড়া’ হিন্দি শব্দটির বাংলা মানে হাতুড়ি। সেক্ষেত্রে হাতুড়ির মতো মুষ্ট্যাঘাত, এ ধরনের একটা সামঞ্জস্য খুঁজে নেওয়াই যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই অধম যখন ক্লাস এইট-নাইন, সে সময় প্রেমিকার দুটি কিউট কোডভাষা চালু ছিল উত্তর কলকাতায়— ‘ছাবি’ আর ‘ভাতি’। বর্তমানে অবশ্য বিলুপ্তপ্রায়। জলদাপাড়ার গন্ডার বা সুন্দরবনের বাঘের মতো সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়।
এবার যে কোডগুলির কথায় আসব তা একেবারেই শহুরে নয় এবং প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে আদৌ খাপ না খেলেও প্রচণ্ড ইন্টারেস্টিং। তাই বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। পেশাগত প্রয়োজনে বসিরহাট সংলগ্ন ঘোজাডাঙা সীমান্ত এলাকায় গেছি। সকাল সাড়ে দশটায় ব্যস্ত ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। ছোপ ছোপ হলুদ জলপাই উর্দির বিএসএফ। সাদা পোশাকের ডিআইবি। সারি সারি মানি এক্সচেঞ্জ স্টল। প্রচণ্ড ভিড় স্টলের সামনে। সীমান্ত পেরিয়ে মানুষজন এপারে আসছেন। ওপারে যাচ্ছেনও অনেকে। রাস্তার ধারে লাইনে দাঁড়ানো অটো। প্রাণপণে হাঁক পাড়ছে ড্রাইভাররা—‘বসিরহাট বসিরহাট…।’ একদম সামনের চালককে পেছনের চালক জিজ্ঞেস করছে— ‘তোর পোকায় কটা ধুর?’ সামনের জন— ‘ছটা’। ‘কটা সাফা, কটা ধাক্কা?’ প্রথমজন— ‘চারটে ধাক্কা দুটো সাফা।’ ‘তা হলে আর চিন্তা কী? তোর তো হয়ে গেল গুড়-রুটি। নে নে পোকা চালু কর, আমাকে ধুর ধরতে দে।’ কথা হচ্ছিল অত্যন্ত নিচুস্বরে। তবু চির-কৌতূহলী কান তার র্যাডারে তুলে নিল এই বিচিত্র কথোপকথন। দ্বিতীয় অটোওয়ালার অটো তখনও ভরেনি। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালাম পাশে। মনে দমচাপা কৌতূহল। দেশলাই চাওয়ার বাহানায় কথাবার্তা শুরু। সিগারেট জ্বালিয়ে ওকেও দিলাম একটা। মিনিট পাঁচেক বার্তালাপের পর উপরোক্ত কথোপকথনের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটিত হল। জানা গেল পোকা আসলে অটো। আর ‘ধুর’ শব্দের অর্থ বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষজন। ‘সাফা’ মানে যাদের কাছে আইনি পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি আছে। আর যারা বেআইনি পথে এপারে এসেছেন, স্থানীয় কোডে তারা ‘ধাক্কা’। এই ‘ধাক্কা’ জাতীয় ‘ধুর’-রা চালকের ‘পোকা’ থুড়ি অটোয় যত বেশি থাকবেন তার তত বেশি ‘গুড়রুটি’ বা পোয়াবারো। কারণ ‘ধাক্কা’দের ক্ষেত্রে অটোভাড়া ‘সাফা’র তুলনায় প্রায় তিনজন। আইনরক্ষকদের দিয়েথুয়েও বেশ ভালই থাকে। বিশ্বাস না হলে স্বগমনে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে চোখ কান একটু খোলা রাখতে হবে।
ফিমেল কোড। এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের। মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মহলে প্রচণ্ড জনপ্রিয়। দু’-এক টুকরো সংলাপ শোনাই। ধরুন দুটি অল্পবয়েসি মেয়ে। একজন অপরজনকে বলছে— ‘তুসপুই কোসমোসপোথায় যাসপাসছিস’, অপরজন— ‘মিসতাসের রাবড়ি’। এবার প্রথমজন— ‘আসফামি যাসপাচ্ছি ফাসনা।’ এটুকু শুনে কারও মনে হতেই পারে— যাঃ বাব্বা! হিব্রু না জুলু কোন ভাষায় কথা বলছে? অবগতির জন্য জানাই হিব্রু-জুলু-নেপচুনগ্রহ বা আলকায়দা কোনওটাই নয়। পাতি বাংলায় কথা বলছে এরা। ঘাবড়ে না গিয়ে ধৈর্য ধরে কথাগুলোকে ডিকোড করার চেষ্টা করুন। দেখবেন ব্যাপারটা একদম জলবৎ তরলং হয়ে গেছে। আসলে এটা আর কিছুই না একেকটা বাক্যের সামনে বা মাঝখানে কিছু অহেতুক অক্ষর জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। প্রকৃত সংলাপ—‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ ‘মিতাদের বাড়ি’, ‘আমি যাচ্ছি না’। ওপরের লাইনগুলোয় আর একবার চোখ বোলালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে সব খেলারই একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। এ খেলার নিয়ম হল একেকটি বাক্যের প্রথম অক্ষরটিকে যথাসম্ভব আর শেষ অক্ষরটিকে অবশ্যই সঠিক অবস্থানে রাখতে হবে। কথার গতিও হওয়া চাই বেশ দ্রুত যাতে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যারা আজ প্রথম এই খেলাটা শিখলেন, আজ থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করে দিন। পরিচিত মহলে সুপার ডুপার হিট হবেই। গ্যারান্টি।
তখন বয়স বাও কি ত্যাও। পুরনো পাড়া গড়পারে একটি মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফাস গলায় দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন—‘সেনবাবু আছেন?’ দোকানি অর্থপূর্ণ চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, মানে আছে। তারপর দোকানের কর্মচারী ছেলেটিকে বলল—‘দাদাকে ভেতর থেকে দশটা সেনবাবু এনে দে।’ কর্মচারী চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এল হাতে একটা প্যাকেট। তড়িঘড়ি খদ্দেরের হাতে গুঁজে দিল। ভদ্রলোক যেন রাজ্য লটারির ফার্স্ট প্রাইজ মেরেছেন এরকম মুখের ভাব, দাম মিটিয়ে চলে গেলেন কোনওদিকে না তাকিয়ে। সেনবাবু কী করে প্যাকেটে থাকেন? দোকান মালিককে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। সন্ধের পর বাবা বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস করে গূহ্য কথাটা জানতে পারি। সেটা ষাটের দশক। অদ্ভুত এক সরকারি নির্দেশে মিষ্টির দোকানে ছানার ব্যবহার বন্ধ করা হয় বেশ কিছুদিনের জন্য। কিন্তু বাঙালি বলে কথা। সন্দেশ রসগোল্লা ছাড়া কি চলে? অনেক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীই লুকিয়ে চুরিয়ে তৈরি করতে শুরু করলেন ছানার মিষ্টি। রাজ্যের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের নামে মিষ্টির কোডনাম হল ‘সেনবাবু’। অনেককাল পরে এই সেনবাবুর মতো আর এক দাসবাবুর আবির্ভাব ঘটেছিল বাজারে। নব্বইয়ের শেষ বা দু’হাজারের গোড়ায়। সঠিক সময়টা ভুলে গেছি। বাজারে রিলিজ করেছে সঞ্জয় লীলা বনশালীর (শরত্চন্দ্রের নয়) দেবদাস। সুপার ডুপার হিট। দর্শক ফেটে পড়ছে হলে। শোয়ের পর শো হাউসফুল। এই সাফল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হল ভিডিও পাইরেসি। পঞ্চাশ-একশো টাকায় জাল দেবদাসে ছেয়ে গেল বাজার। প্রমাদ গুনলেন প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটররা। আইনের দ্বারস্থ হলেন তাঁরা। ভিডিও পার্লার স্টলে শুরু হল রেইড। ফলে দেবদাস নামক সিডি মহোদয় নাম পরিবর্তন করিয়া হইলেন ‘দাসবাবু’। হুবহু গড়পারের সেই ভদ্রলোকের মতো দোকানে গিয়ে স্রেফ ‘দাসবাবু’র খোঁজ করবার ওয়াস্তা। খবরের কাগজ বা কালো পলিপ্যাকে মোড়া কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি চলে আসবে ক্রেতার হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘সেনবাবু’ ‘দাসবাবু’রা বিদায় নিলেও ‘পাকা পেঁপে’, ‘গরমমশলা’ বা ‘পানু’রা কিন্তু বাজারে রয়ে গেছে। পার্মানেন্টলি। আজ্ঞে হ্যাঁ। পর্নোগ্রাফির ভিডিও সিডি বাজারে এ নামেই পরিচিত।
সবশেষে একটু বাজারে ঢোকা যাক। ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে মামাবাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলি। এক রোববারে বাবা-মা’র সঙ্গে গেছি। ঠিক হল মাংস হবে। বাজারের দায়িত্বে মেজোমামা। সঙ্গে থলে হাতে ল্যাংবোট আমি। জগুবাজারে মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পাঞ্জাবি দোকানদার, দাড়িভর্তি মুখে একগাল হাসি— আরে, বাবুরা এসে গেছে। ভেতর থেকে ভাল দেখে দে। এহেন আপ্যায়নে মেজোমামা তো বটেই ভাগ্নেও যারপরনাই পুলকিত। বিজয়গর্বে হাতে থলে ঝুলিয়ে বাড়ি তো ফেরা হল। ধুয়ে পাকলে কড়াইয়ে চাপাতেই সে এক কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড। উৎকট বোঁটকা গন্ধে টেকা দায়। নাকে আঁচল চেপে দিদিমার চিল চিৎকার— ‘ফ্যালায়া দে। ফ্যালায়ে দে… পচা মাংস দিছে…মাগো…।’ নামী কোম্পানির দামি অফিসার বড়মামা—‘পচা নয়। রামপাঁঠা। ইট মাস্ট বি হি গোট।’ হাঁড়ির সামনে বসা মা’র মুখটা অনেকটা স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধে পরাজিত হিটলারের মতো। পাড়ার লোকে তেড়ে এসে মারতে বাকি রেখেছিল। অনেকদিন বাদে মার্কেট ইন্সপেক্টর পদে বদলি হয়ে জগুবাজারে আসা বাবার এক বন্ধুর কাছে জানা গিয়েছিল ‘ভেতর থেকে’ আর ‘ভাল দেখে’ এই দুটো নাকি খাসির বদলে রাম ছাগলের মাংস গছিয়ে দেবার কোড। এ ধরনের অজস্র দুর্মূল্য কোডরত্ন ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বাজারময়। কবজির সূক্ষ্ম মোচড়ে পাল্লা হেলিয়ে দেবার কায়দাকে বলে ‘হ্যাটা’ বা ‘হাতাবাবা’। পচা মাছের সাংকেতিক নাম ‘তেলো’ বা ‘লুসো’। একশো থেকে এককিলো ওজনের কাটা বা জাল বাটখারার একাধিক কোডনেম। যেমন ‘ডাকটাকি’, ‘সিকচাকি’, ‘নেত্যচাকি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ নিয়ে আর বেশি মুখ খুলব না। বুঝতেই পারছেন ছাপোষা মধ্যবিত্ত। ৩৬৫ দিন বাজার করে খেতে হয়। একটা মারও বাইরে পড়বে না। তবে এই সিরিয়ালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এপিসোডটা দেখেছিলাম উত্তর কলকাতার নতুন বাজারে। দুধের হোলসেল মার্কেট। সার সার খড় চোবানো দুধের ড্রাম। লম্বা লম্বা চাতালে লাইন দিয়ে বিক্রেতারা বসে রয়েছেন। ডান হাতটা গামছা ঢাকা। খদ্দেররা এগিয়ে গামছার তলায় হাত ঢুকিয়ে কানে কানে বিজাতীয় ভাষায় কী সব যেন বলছেন। গামছার নীচে আঙুলের নড়াচড়া… বিক্রেতাও ফিসফিস করে উত্তর দিচ্ছেন ওই একই ভাষায়। অত্যন্ত বিনীতভাবে মানে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বোম্বাই ধমক ছাড়া কপালে আর কিছুই জোটেনি। আমার দ্বারা তো হল না। আপনারা একবার চেষ্টা করে দেখুন না। জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। এই অধমের কোড ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আরও কিছু জমা পড়বে।
০৩. ক্যাসিনো কলকাতা
মধ্য কলকাতার একটা সরু গলির মুখে একচিলতে দোকানে আধাখোলা ঝাঁপ। পঞ্চাশ পাওয়ারের টিমটিমে বালবের আলো জ্বলছে। কাঠের ছোট শোকেসের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে সিড়িঙ্গে মতো একটা লোক। মাঝ ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে রাত সাড়ে এগারোটায় দোকানের বাইরে বিশ-পঁচিশজন। ফিসফাস, উৎকণ্ঠা, আলোচনা নিচুস্বরে, পৌনে বারোটা তো বাজতে চলল। খবর আসতে কত দেরি? ক্রিং ক্রিং…দূর থেকে সাইকেল ঘণ্টির আওয়াজ…ওয়ান টু সিক্স— নয়লা। বলতে বলতে পাস দিয়ে চলে গেল সাইকেল আরোহী। দোকানের মধ্যে ঝিমোতে থাকা সিড়িঙ্গে লোকটা মুহূর্তে গা ঝাড়া দিয়ে শোকেসের কাচ সরিয়ে বের করে আনল ছোট একটা শ্লেট। চক দিয়ে খসখস করে কিছু লিখে টাঙিয়ে দিল দোকানের বাইরে। তাতে লেখা— ১২৬/৯। বাইরে অপেক্ষমাণ জনতার প্রতিক্রিয়া এবার সরাসরি দ্বিধাবিভক্ত। একদল ‘বুকি’ নামক খলনায়কের পিতৃমাতৃকুল উদ্ধার করতে করতে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। অপরদল রয়ে গেল ‘পেমেন্ট’ নামক ওয়েসিসের আশায়।
এই অবধি পড়ে যাদের ব্যাপারটা ধোঁয়াটেপানা লাগছে তাদের জন্য ঝেড়ে কাশি এবার। আসলে উপরোক্ত দৃশ্যাবলির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি শব্দ— ‘সাট্টা’। ষাটের মাঝামাঝি মুম্বাইয়ে শুরু হয় এই জুয়াখেলা, স্থানীয় নাম ‘মটকা’, পরবর্তীতে রতনলাল ক্ষেত্রী নামে অন্ধকার জগতের এক বাদশার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে, সত্তরের দশকে, বাংলার জুয়ারসিক মহলে পরিচিত হয় ‘সাট্টা’ নামে। চল্লিশের দশকে আমেরিকান মাফিয়াদের আবিষ্কৃত ‘নাম্বার গেমের’ আদলে এই খেলা। তিনটি নম্বর— জুয়াড়িদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ‘পাত্তি’, ‘পাত্তি’-র যোগফল কখনওই দুটি সংখ্যার বেশি হবে না। সবসময় শেষ নম্বরটি বাজি জেতার মাপকাঠি হিসেবে পরিগণিত হবে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরা যাক ‘পাত্তি’ হল ৪৫৯। এর যোগফল ১৮। শেষ সংখ্যা ৮ই এখানে জয়ের মাপকাঠি যা জুয়াড়িমহলে ‘সিঙ্গল’ নামে পরিচিত। আবার দোকানের গায়ে টাঙানো ১২৬-এর যোগফল ৯-এর বেশি হবে না কোনওমতেই। সেক্ষেত্রে কোনও ঝামেলাই নেই। ওই একটি নম্বরই ‘সিঙ্গল’ হিসেবে ধরা হবে। খেলা হবে দিনে দুবার। নো হলিডে। বিশাল একটি এলাকাভিত্তিক ভাবে যে পুরো ব্যাপারটা কন্ট্রোল করবে তার নাম ‘বুকি’, ‘বুকি’-র নীচে ‘এজেন্ট’। ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করা এলাকার দায়িত্বে। এদের নীচে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পেনসিলার। পাড়ার মোড়ে বেঞ্চি অথবা ছোট পান বিড়ির দোকান এদের ‘অফিস’। গ্রাহকরা খেলতে আসবে পেনসিলারদের কাছে। মুম্বই থেকে রেজাল্টের খবর প্রথমে জানবে বুকি, টেলিফোনে। বুকি থেকে এজেন্ট। এজেন্টের ক্যুরিয়ার সাইকেলে ঘুরে ঘুরে খবরটা পৌঁছে দেবে পেনসিলারের দরজায় দরজায়। আশা করি এতক্ষণে দোকানে অর্ধেক ঝাঁপ ফেলে বসে থাকা সিড়িঙ্গে আর সাইকেল আরোহীর পরিচয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে পাঠকের কাছে। এবার আসি খেলার নিয়ম আর পেমেন্টের কথায়। ছোট ছোট লাল নীল রঙের পাতলা কাগজের প্যাডে লেখা হবে গ্রাহকের পছন্দের নম্বর। প্রতিটি পাতার তলায় লাগানো কার্বন পেপার। অরিজিনাল কপি দেওয়া হবে গ্রাহককে। রেজাল্ট বেরোলে প্যাডের কার্বন কপি মিলিয়ে টাকা দেওয়া হবে জয়ীদের। কেউ যদি একটি নম্বর বা সিঙ্গল-এর ওপর বাজি ধরেন এবং জেতেন তিনি পাবেন এক টাকায় ন টাকা। তিনটে নম্বর বা ‘পাত্তি’ মেলাতে পারলে একে একশো পঁচিশ। আর একদিনে খেলা দুটি ‘পাত্তি’র নম্বর একসঙ্গে মেলাতে পারলে জাস্ট ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার’, মানে এক টাকায় আট হাজার টাকা। খেলার সময় রাত আটটা আর এগারোটা। মুম্বাই থেকে টেলিফোনে বুকি, এজেন্ট, ক্যুরিয়ার হয়ে পেনসিলার অবধি খবর পৌঁছোতে পৌঁছোতে যথাক্রমে নটা এবং বারোটা। প্রথম খেলা ‘ওপেন’ আর দ্বিতীয়টা ‘ক্লোজ’ নামে পরিচিত জুয়াড়িদের কাছে। প্রবল শীতের কামড় উপেক্ষা করে অত রাতে দোকানের সামনে অপেক্ষারত লোকজনের উদ্দেশ্যটাও আশাকরি পরিষ্কার এতক্ষণে। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ের অনুকরণে মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট আর বড়বাজার অঞ্চল থেকে চালু হয় ‘কলাবাগান’, ‘ভূতনাথ’, ‘ফটাফট’ নামের সাট্টা। দিনে চার-পাঁচবার অবধি খেলা, একই সিস্টেমে। যদিও পেমেন্টের হার মুম্বাইয়ের তুলনায় অনেকটাই কম। কলকাতা জুড়ে সাট্টার ফলাও কারবার অনেকটাই ধাক্কা খায় তিরানব্বই সালে বউবাজার বোমার মামলায়। মধ্য কলকাতার সাট্টা তথা অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট, ‘বুকি’ রশিদ খান ছিল বিস্ফোরণে ভেঙে পড়া বাড়িটার মালিক। অবধারিতভাবেই শ্রীঘরে যেতে হয় রশিদকে। বিস্ফোরণে শুধু বাড়ি বা একাধিক মানুষের প্রাণ নয় ভেঙে টুকরো হয়ে যায় শহরজোড়া রশিদের সাট্টা সাম্রাজ্য। এখনও বন্ডেল গেট আর আনোয়ার শা রোডের কয়েকটা জায়গায় লুকিয়ে চুরিয়ে চললেও সাট্টার সে বোলবোলা আর নেই। হুবহু সাট্টার অনুকরণে রীতিমতো সরকারি ট্যাক্স দিয়ে শুরু হয় ‘প্লে উইন’, ‘সুপার লোটো’, আরও সাতসতেরো নামের জুয়া, নব্বইয়ের শেষদিকে। কোনও পেনসিলার, বুকির প্রয়োজন নেই। একটা দোকান বা একফালি ঘরে সিকিওরিটি ডিপোজিট জমা করে যে-কেউ নিতে পারেন লাইসেন্সড সাট্টার এজেন্সি। সর্বনাশা সুপারলোটোর পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান বহু মানুষ, আত্মহননে বাধ্য হন অনেকে। অবশেষে দু’হাজার বারো সালে পরিবর্তনের পর সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় এই মারণখেল।
মাল কোম্পানিকা
একটা প্লাইউডের হালকা আর ছোট ফোল্ডিং টেবিল। ওপরে সাদা চাদর বিছানো, তিনটে ক্যারামবোর্ডের স্ট্রাইকার সরলরেখায় সাজানো। চালকের দক্ষ হাতের পরিচালনায় স্থান পরিবর্তন করছে ঘুঁটিগুলো, এদিক থেকে ওদিক। দুটো স্ট্রাইকার বিলকুল ফাঁকা। কেবলমাত্র একটা ঘুঁটির একদিকে গোলাপফুলের স্টিকার সাঁটানো। ঘুঁটি চালাচালি বন্ধ করে চালক যেইমাত্র হাঁক পাড়বে ‘লাগাও,’ ওমনি পছন্দের ঘুঁটির ওপর টাকা চেপে ধরবে জুয়াড়ির দল। ঘুঁটি উলটে যদি দেখা যায় গায়ে গোলাপ-স্টিকার সাঁটানো তা হলে লগ্নীকৃত টাকার পরিমাণের দ্বিগুণ ফেরত পাবে খেলুড়ে। ফাঁকা স্ট্রাইকারের ওপর বাজি ধরা টাকা ঢুকে যাবে চালকের পকেটে। ফুটপাথ ধরে চলেছেন। কমবেশি টাকাও রয়েছে পকেটে। এরকম দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে গেলেন। দাঁড়িয়েও পড়লেন কৌতূহলে। একটু দূর থেকে খেয়াল করলেন কিছুক্ষণ। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোক। পছন্দের ঘুঁটির ওপর টাকা লাগাচ্ছে, জিতছেও। হাতের সঙ্গে সঙ্গে মুখও চলছে চালাকের… ‘লাগাইয়ে লাগাইয়ে…পাঁচ কা দশ, দশ কা বিশ, পচাশ কা শও… ঘুঁটি মে গুলাব তো মাল খিলাড়িকা…ঘুঁটি খালি তো মাল কোম্পানিকা…’ লোভ হল। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে এবং ফাঁসলেন। প্রথম অল্প টাকা লাগালেন ভয়ে ভয়ে— দশ। কী আশ্চর্য! আপনি জিতেছেন মানে গোলাপ লাগানো স্ট্রাইকারেই টাকা লাগিয়েছেন। আরও দু’-একবার এরকম হল। আপনার লোভও বাড়ল। পাশ থেকে অন্য খেলোয়াড়দের ক্রমাগত প্ররোচনা— ‘উফ্! কী লাক আপনার! আরে দাদা বড় অ্যামাউন্ট লাগান…মালামাল হয়ে যাবেন আজ…।’ সম্মোহিত আপনার পকেট থেকে বেরোতে লাগল পঞ্চাশ, একশো এমনকী পাঁচশোর নোট। ব্যস! এরপর আর মিনিট দশেকও লাগবে না ট্যাঁক ফাঁকা হতে। কুলকুলে ঘাম, পালস রেট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ, ভিড় থেকে বেরিয়ে এলেন আপনি। দু’চোখে নির্বোধ চাহনি, ঠকে যাওয়ার কষ্ট। দুঃখ করবেন না। আসলে কখনওই জেতেননি আপনি। আপনাকে জিততে দেওয়া হয়েছিল। লোভ বাড়তেই বেশি করে টাকা লাগিয়েছেন। হেরে যাওয়া টাকা উদ্ধারের প্রচেষ্টায় আরও বেশি এবং নিপুণ হাত সাফাইয়ের খেলায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন মুহূর্তে। ওই যে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে উত্সাহ প্রদানকারী খেলুড়ের দল? শতকরা নিরানব্বই ভাগই নিজেদের লোক। মানে একটা সংগঠিত জুয়া কাম প্রতারণা চক্রের হাতে এইমাত্র প্রতারিত হলেন আপনি। শহরের বুকে আরও দুটি কায়দায় চলে এই একই ধরনের লোকঠকানো খেলা। পরিবর্তন শুধু খেলার সামগ্রীতে। ঘুঁটির জায়গায় তাস অথবা চায়ের ভাঁড় আর লুডোর ছক্কা। মূলত সদর স্ট্রিটের মোড়, কলকাতা মিউজিয়ামের ফুটপাথ, কার্জন পার্ক থেকে হাওড়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় দেখা মিলতে পারে এদের। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। এক দেড়ঘণ্টা বাদে বাদেই হালকা ফোল্ডিং টেবিল গুটিয়ে হাওয়া হয়ে যায় সাত-আট জনের ‘কোম্পানি’।
লাল বাদাম সাদা বাদাম
খেলাটা চলে টেরিটি বাজার-চুনাগলি-কলুটোলা অঞ্চলে। মাছের বাজারের সাইজ ছোট একটা থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে একজন। থলির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের গুলি। লাল আর সাদা রঙের। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ‘বাদাম’, খেলার নিয়ম হল খেলোয়াড় ঝুলির মধ্যে হাত ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝুলির মুখটা খেলোয়াড়ের কবজির ওপর চেপে ধরবে চালক। মুঠো ভর্তি করে ‘বাদাম’ বের করে আনবে খেলোয়াড়। মুঠোর মধ্যে লাল বাদামের সংখ্যা বেশি হলে জিত জুয়াড়ির। বিপরীত ফলাফলে লাভ চালকের। ‘বাদাম’ পিছু পয়সা অথবা টাকার বাজি ফেলে চলে এই খেলা। খেলা শুরুর আগে থলের মুখ খুলে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেখানো হবে খেলোয়াড়কে। সাধারণ চোখে মনে হবে লাল বাদামের সংখ্যা অনেক বেশি। হাত ঢুকিয়ে থলের মুখ বন্ধ হওয়ার পর সূক্ষ্ম, প্রায় টের না পাওয়া একটা ঝাঁকুনি। হাত বের করে আনার পর মুঠো খুললে দেখা যাবে কোনও জাদুমন্ত্রবলে বেশির ভাগ লাল বাদামের রং সাদা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাঁকখালির জমিদার হয়ে স্থানত্যাগ করতে হবে জুয়াড়িকে। যেহেতু এই সব এলাকা পাইকারি বাজারের একটা বড় ঘাঁটি, ফলে কেনাকাটা করতে আসা ব্যবসায়ী আর বিবাদী বাগ থেকে বউবাজার দিয়ে এগারো নম্বর বাসে পায়ে হাঁটার কোডনেম শর্টকাট মারা শেয়ালদাগামী অফিসবাবুরা প্রায়ই এদের শিকার হন। পুজোর ঠিক আগের মাস পয়লায় এই বর্গীচক্রের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত এক অফিসবাবুকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাপুসনয়নে কাঁদতে দেখার দৃশ্যটা প্রতিবেদকের আজও মনে আছে।
কি অফ লাক
একটা সাদা বোর্ড, চওড়ায় ফুট দুয়েক। স্ট্যান্ডে হেলান দিয়ে ফুটপাথে দাঁড় করানো। বোর্ডের দু’প্রান্তে মারা দুটো পেরেকের গায়ে টান টান করে বাঁধা সরু গালভানাইজড তার। ডানদিকে পেরেকের ওপর আটকানো ছোট একটা টুনিবালব। বাঁদিকে তারের গায়ে ঝুলছে একটা চাবি। চাবির ফুটোটাকে তারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাঁদিক থেকে ডানদিকে। তার স্পর্শ না করে, চাবির অংশ তারকে স্পর্শ করলেই পিঁইই শব্দে জ্বলে উঠবে টুনি। তার মানে আপনি হারলেন। আবার চেষ্টা। আবার হার। আবার, আবার। আপনি তো ততক্ষণে রবার্ট ব্রুসের আত্মীয় হয়ে উঠেছেন। ব্রুস যুদ্ধটা শেষমেশ জিতেছিলেন। আপনি জিতবেন না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতে পারে। মেছুয়া, বড়বাজার অঞ্চলে সন্ধের মুখে চলে এই জুয়া। চালকের হাতে বাজির টাকা অ্যাডভান্স গুঁজে দিয়ে জিতলে ডাবল অ্যামাউন্ট অফ মানি রিটার্ন— এটাই খেলার নিয়ম। লাকট্রাই করবেন নাকি একবার?
শের-ফুল
জুয়া খেলার সহজতম পদ্ধতি। একটা পুরনো আমলের সিকি বা আধুলি। একপিঠে বাঘের ছবি। অন্যপিঠে ফুলের তলায় পয়সার সংখ্যা। ইভেন স্টেকে টস করে করে খেলে যেতে হয় ক্রমাগত যতক্ষণ না দু’জনের মধ্যে এক তরফের পকেট খালি হয়ে যায়। সংখ্যালঘু মহল্লা এবং চটকল শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। অপরিমিত মদ্যপানের পর রাত আটটা নাগাদ খেলতে বসে বারোটার মধ্যে বউ খুইয়ে ফেলার নজিরও রয়েছে জগদ্দলে।
খেলার আড়ালে
ক্লাবঘর অথবা ফুটপাতের ধারে টাঙানো ছাউনির নীচে ম্যাচবোর্ডের ওপর ঝুলন্ত ঢাকনা লাগানো বালব। পাকা হাতের মারে লাল সাদা কালো ঘুঁটিগুলো আশ্রয় নিচ্ছে গর্তের জালে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে এ তো সাধারণ ক্যারাম খেলা। কথাটা অনেকটা সত্যি হলেও পুরোটা নয়, বিশেষত পার্কসার্কাস-রাজাবাজার-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে। সিঙ্গলস্ (একটি বোর্ডে দু’জন প্রতিযোগী) আর ডাবলস্ (এক বোর্ডে চারজন) সিস্টেমে রমরমা জুয়ার আসর বসে আপাত নিরীহদর্শন এই খেলার আড়ালে, প্রতি সন্ধ্যায়। মূলত বোর্ড পিছু বাজি ধরে চলে এই খেলা। আসর ভাঙতে ভাঙতে মধ্যরাত্রি, ফুটপাতের চক্রগুলো কন্ট্রোল করে অন্ধকার জগৎ থেকে অবসর নেওয়া মাঝবয়সি দাদারা। বোর্ড এবং খেলোয়াড় পিছু কমিশন বরাদ্দ থাকে দাদাদের জন্য। এটাকে তাদের রিটায়ারমেন্ট পেনশন স্কিম বলা চলে।
ভাগ্যের চাক্কাটা তো ঘুরছে…
প্লাস্টিকের নীল রঙের চাদরের ওপর আটটা খোপে আঁকা পশুপাখির ছবি। হাতি, বাঘ, পায়রা, ময়ূর…। পাশে ঘূর্ণায়মান বোর্ড। বোর্ডের গায়ে ওই একই ছবির হুবহু রেপ্লিকা। প্রতিটি ছবিকে ভাগ করা হয়েছে বোর্ডের কেন্দ্রবিন্দু থেকে শেষ পর্যন্ত আঁকা লাইনের সাহায্যে। লাইনগুলোর শেষপ্রান্তে মারা রয়েছে একটা করে ছোট পেরেক। বোর্ডের ঠিক পাশে একটা ছোট ডান্ডার গায়ে আটকানো জিভ ছোলা, প্লাস্টিকের খড়কে। অপর প্রান্তটা ছুঁয়ে গেছে পেরেকগুলোকে। ‘খেলা চালু’ বলে পরিচালক যেই বোর্ডটাকে ঘুরিয়ে দেবে ওমনি চাদরের গায়ে আঁকা খোপগুলোয় পছন্দের ছবিতে টাকা লাগাবে জুয়াড়িরা, বোর্ডের গতি কমার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই খড়কেটা আটকাবে পেরেকের সীমানা তোলা কোনও না কোনও ছবির খোপে। চাদরের গায়ে সেই একই ছবির ওপর টাকা লাগিয়েছে যে খেলোয়াড় সে পাবে লগ্নিকৃত অর্থের দ্বিগুণ। পরাজিতদের লাগানো টাকার ওপর হক পরিচালকের। এটাই খেলার প্রচলিত নিয়ম। তবে ছবির ক্ষেত্রে পশুপাখির জায়গা নিতে পারে ভগবান, নম্বর, মহাপুরুষদের ছবি। নলহাটি বাজারের সামনে বোর্ডের খোপে খোপে রামকৃষ্ণদেব, বাবা লোকনাথের ছবিও দেখেছিলাম বছর সাতেক আগে। সঠিক কারণ জানা নেই, তবে বছর দশেক হল কলকাতায় অনেকটাই কমে গেছে বোর্ডের জুয়ার দাপট। কিন্তু শহরতলি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেলাগুলোয় এখনও অবাধে ঘোরে ভাগ্যের চাকা।
তাসের দেশ
বব দাস, বিকে, ফৈয়াজ, গান্ধি…। নামগুলো চেনা? স্বাভাবিক উত্তর—‘না।’ পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি এরা সব বিখ্যাত জুয়াড়ি। হাতের জাদুতে থুড়ি তাসের জাদুতে প্রায় হারতে বসা খেলাকে জিতে পালটে দিতে পারতেন। কলকাতার বুকে রাজত্ব করেছেন ষাট থেকে আশির দশক জুড়ে। শেষতক অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে অনেক ‘ফার’-এ এদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ‘ফার’ শব্দটায় হোঁচট খেলেন তো? আসলে ‘ফার’ মানে পেশাদার জুয়ার আড্ডা যেখানে বোর্ডে টাকা ফেলে মোটা বাজির জুয়া খেলা হয়। গোটা কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এরকম একাধিক ‘ফার’। তাসের জুয়ার ধরন অনেক রকম। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ফিশ’ ‘কল ব্রে’ ‘রামি’ আর টুয়েন্টি নাইন। কার্ডপিছু পয়সা বাজি রেখে খেলা হয় দুই পদ্ধতিতে— ‘সিন’ আর ‘ব্লাইন্ড’, ‘সিন’ মানে প্রতি দানের শেষে প্রতিযোগীরা হাতের তাস ‘শো’ করবে অর্থাৎ একে অপরকে দেখিয়ে দেবে এবং পয়েন্ট বা তাস পিছু বাজি ধরা পয়সার হাতবিনিময় ঘটবে, গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড় করিয়ে দেবার মতো উত্তেজনাকর খেলা ‘ব্লাইন্ড’। দানের পর দান, চালের পর চাল কোনও প্রতিযোগী একে অপরের তাস দেখতে চাইবে না। বোর্ডের ওপর জমতে থাকবে টাকার পাহাড়। খেলা চলাকালীন যাদের কলজের জোর কম তারা ‘প্যাক’ বলে সরে যাবে। অনেক সময় এমনও দেখা যায় মাত্র দু’জন প্রতিযোগীই শেষ অবধি খেলায় টিকে আছে, অবশেষে কেউ একজন ‘শো’ মানে হাতের তাস দেখাতে বলবে, যার হাতে সেরা তাস সে-ই বাজি জিতবে আর বোর্ডের ওপর রাশিকৃত টাকা ঢুকে যাবে বিজেতার পকেটে। তাসের জুয়ায় সেরা প্রাপ্তি ‘তিন টেক্কা’ মানে ইংরেজি এ লেখা তিনটে তাস। যার হাতে থাকবে তার জয় নিশ্চিত। এ তো গেল বহু সময় ধরে চলতে থাকা খেলার কথা। খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের টাকা পকেটে ঢোকাতে চাইলে ‘অন্দর বাহারের’ জুড়ি নেই। মূলত দু’জন প্রতিযোগী থাকে এই খেলায়। এক সেট তাস শ্যাফল করে এক প্রতিযোগী রেখে দেবে অপর জনের সামনে। সে তাসের বান্ডিলটাকে আধাআধি কেটে রেখে দেবে বাকি অর্ধেক বান্ডিলের নীচে। এরপর শুরু হবে বান্ডিল থেকে একটি করে তাস তুলে নেওয়া, যে প্রথম তাস শ্যাফল করেছিল তার তোলা তাস ‘অন্দর’। অপরজনের তোলা তাস ‘বাহার’। তাস পছন্দ করার অধিকার ‘বাহার’ওয়ালার। ধরা যাক সে কল করল ‘লালপান বিবি বাহার।’ এরপর থেকে যতক্ষণ না লালপান বিবি ‘অন্দর’ অথবা ‘বাহার’ না হবে ততক্ষণ খেলা চলবে। বোর্ডে রাখা থাকবে বাজি ফেলা টাকা। খেলা চলাকালীন উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে বাজি ধরা টাকার পরিমাণ বাড়তে পারে। একেকটি দান শেষ হতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগে না। খেলার নিয়ম নিয়ে আর বেশি জ্ঞান না ফলিয়ে আসুন এবার জুয়াড়ি আর ‘ফার’ মালিকদের প্রসঙ্গে আসি। এই পরিচ্ছেদের প্রথমেই যাদের নাম করেছিলাম তাদের মধ্যে গান্ধিদার হাতের কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার, পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে। এক বান্ডিল তাস নিয়ে মিনিট তিনেক শ্যাফল করে (ফেটে) রেখে দিল আমাদের সামনে। হাতে তুলে নিয়ে দেখা গেল লাল আর কালো রঙের তাস জাস্ট আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে। ফারের মধ্যে বিখ্যাত কালাবাবুর ফার, বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে। লাখলাখ টাকার ডিল হত প্রতি রাতে। লগ্নিকৃত টাকাপিছু কমিশন বরাদ্দ কালাবাবুর জন্য। এই নিয়ম অবশ্য অন্য ফার মালিকদের জন্যও প্রযোজ্য। বহুদিন ধরে খেলতে আসা জুয়াড়িদের মধ্যে কেউ খেলতে বসে পুরো টাকা হেরে বসলেও টাকা ধার দেওয়ার রেওয়াজ আছে অনেক ফারে। আর একটি নামী ফার, পার্ক-সার্কাস-বালিগঞ্জ সীমানা সংলগ্ন অঞ্চলে। মালিকের নাম বি কে। সন্ধ্যাবেলা ফারের সামনে ফুটপাতে গাড়ি রেখে খেলতে বসে ভোরবেলা ট্যাক্সি খুইয়ে পথে নেমেছে গাড়ির মালিক, এ ঘটনাও ঘটেছে বি কে-র আড্ডায়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি দুটি ফারই বন্ধ হয়ে গেলেও কলকাতা জুড়ে আজও রমরমিয়ে চলছে একাধিক জুয়ার ঠেক। এ ছাড়া বহু নামী-দামি ক্লাবেও প্রতিরাতে জমিয়ে বসে জুয়ার আসর। বিতর্ক বাড়বে তাই নামগুলো আর করলাম না এখানে।
কুইনালা— টানালা— জ্যাকপট
কথাগুলো বহুল প্রচলিত। রেসকোর্সে অর্থাৎ কলকাতায় ঘোড়দৌড়ের ময়দানে। প্রতি সপ্তাহে শনি ও রবিবার বসে এই দৌড়ের আসর। মাঝে মাঝে বুধবারেও হয়। তবে রেসের সেরা রেস ‘ডার্বি’, বছরে মাত্র একদিন। জানুয়ারি মাসের যে-কোনও সময়। সারা ভারতবর্ষ থেকে বাছা বাছা ঘোড়া আর তাদের জকিরা আসে ‘ডার্বি’-তে অংশ নিতে। চালকদের বলা হয় ‘জকি’। এ ছাড়াও ঘোড়ার দেখভালের দায়িত্ব ট্রেনারের। ঘোড়ার দৌড়ে বাজি ধরা হয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে, ‘ফেভারিট’ মানে বংশানুক্রমিক ভাবে বনেদি ঘোড়ার পিছনে লগ্নি করা টাকায় জেতা অর্থের পরিমাণ কম। ধরা যাক দশ টাকায় পনেরো টাকা। ‘আপসেট’ বা অনামী ঘোড়ায় টাকা লাগিয়ে জিতলে লাভের অঙ্ক অনেকটাই বেশি। যে ঘোড়া যত কম ‘ফেভারিট’ হবে, জেতা অর্থের পরিমাণ তত বেশি হবে তার ক্ষেত্রে, সেটা দশ টাকায় দেড় লাখেও গিয়ে দাঁড়ায়। একটি মাত্র ঘোড়ায় বাজি ধরে জেতাকে বলে ‘সিঙ্গল উইন,’ একদিনে পরপর দুটো বাজি জেতার নাম ‘কুইনালা,’ টানা তিনটে—‘টানালা’। তবে সেরার সেরা ‘জ্যাকপট’। পরপর পাঁচটি জয়ী ঘোড়ার নাম অগ্রিম মিলিয়ে দিতে পারা বাজির নাম। জেতা টাকার পরিমাণও এতে অনেক বেশি। তার ওপরে সেগুলো যদি ‘আপসেট’ ঘোড়া হয় তা হলে তো কথাই নেই। শুধুমাত্র রেস নিয়ে লিখতে গেলে শ-খানেক পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে। তারচেয়ে একটা ঘটনার কথা বলে রেসপর্ব শেষ করি।
যা একই সঙ্গে মজার এবং বেশিরভাগ দুঃখের। আমাদের বন্ধু সালাউদ্দিন, অগাধ ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। রেসের নেশা প্রবল। সঠিক সময়টা মনে নেই, মোটামুটি আশির দশকের মাঝামাঝি রয়্যাল চ্যালেঞ্জ নামে বিখ্যাত ঘোড়ার ওপর হাজার তিরিশেক বাজি ধরেছিল। প্রাণীটির ট্র্যাক রেকর্ড মারাত্মক— দেশের সব কটা ডার্বিতে জয়ী। রেস শুরু হওয়ার পর দেখা গেল ‘রয়্যাল চ্যালেঞ্জ’ দৌড়োচ্ছে রাজাবাজারের মোড়ে দাঁড়ানো ছ্যাঁকড়া গাড়ির ঘোড়ার চেয়েও ঢিমেতালে। ডেডলাস্ট, স্বাভাবিকভাবেই। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে গ্যালারিতেই মুখে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান সালাউদ্দিন। বাজি জেতার টাকায় আনন্দ করার বদলে বন্ধুকে নিয়ে ছুটতে হয় পি জি। হাসপাতালে দিন তিনেক কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। মাঠমুখো আর হয়নি কোনওদিন।
দ্য এন্ড…
কথাটা বলার আগে জানিয়ে রাখি-আরও দু’-এক ধরনের জুয়া চলে এ শহরে। দিওয়ালির রাতে অবাঙালি শ্রেষ্ঠীদের তাসের বাজিতে কোটি কোটি টাকার পকেটবদল ঘটে যায় ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে। এ ছাড়াও আছে ‘হাউজি’, উচ্চবিত্ত মহিলারা এক-একটি নম্বর বা ঘরের ওপর টাকা লাগিয়ে খেলাটা খেলে থাকেন। তবে এগুলো এতটাই সাময়িক আর নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে কলমের খাপ বন্ধ করলাম। ঠিক আছে?
০৪. ময়দান-ই-কলকাতা
“বুঝলি তো, নেক্সট সিজনে বাবুদা বলেছে এরিয়ানে সাইন করিয়ে দেবে। তিরিশ হাজার অ্যাডভান্স… থোক হাতে হাতে। পেলেই নাইকের সি আর সেভেন বুটটা কিনে ফেলব। ওই তোর ময়দান মার্কেটের আলি জালি মাল নয়। এ্যাক্কেবারে অরিজিনাল। গ্র্যান্ডের তলায় কাচের শোকেসে সাজানো রয়েছে। সাত হাজার মতো পড়বে। আসতে যেতে রোজ দেখি একবার করে। অনেক দিনের ইচ্ছে মাইরি… শুধু একবার সাইনটা হয়ে গেলেই…।” “হবে হবে গুরু, চিন্তা করবি না একদম। চোখের সামনে মেহতাবকে দ্যাখ। বাসুদেবকে দ্যাখ… বাসুদেব, কালীঘাটের ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান ছিল ওর বাবার। সেখান থেকে উঠে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান হয়ে ইন্ডিয়া ক্যাপটেন। ভাবা যায়! ওদের যদি হয় তা হলে আমাদের হবে না কেন?… চ চ, তাড়াতাড়ি পা চালা… ওদিকে আবার প্র্যাকটিসে দেরি হয়ে যাবে।”
ভোরবেলা। কুয়াশাঘেরা ময়দান। কথা বলতে বলতে মেয়ো রোডের মোড় পার হচ্ছিল ছেলে দুটো, রোগা, কালোকালো চেহারা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ময়দান মার্কেটের সস্তা জার্সি, মোজা, অ্যাংক্লেট, বুট, নিক্যাপ…। চোখ-ভরতি স্বপ্ন। বাসুদেব মণ্ডল, মেহতাব হোসেন হয়ে ওঠার। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো সাত হাজারি বুট পরে মাঠে নামার… তারপর ব্যাঙ্ক বা মেট্রোরেলে একটা চাকরি। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, চার্চিল, ডেম্পো, ইন্ডিয়ার জার্সি, হালিশহর বা চাকদায় পুরনো ধচাপচা টালির বাড়িটা ভেঙে দোতলা বাড়ি একটা। ই এম আইয়ে কেনা বাইক, স্মার্ট ফোন… জন্মে ইস্তক দেখে আসা খাটতে খাটতে কোলকুঁজো মেরে যাওয়া দোকান কর্মচারী বাবার একটু অবসর। সাত সকালে উঠে কয়লার উনুনে ফুঁ দিতে দিতে গলার শিরা নীল হয়ে যাওয়া মা’র জন্য একটা গ্যাসওভেন। দিদিটার বিয়ে… তাবৎ স্বপ্ন চোখে পুরে ওই দুটো ছেলের মতো আরও হাজার হাজার ছেলে লোকাল ট্রেন আর কলকাতা-মফস্সল বাসে চেপে ভোরের ময়দানে পাড়ি জমায় রোজ। শুধু কি ছেলেরা? ঠিক একইরকম সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা মেয়ের দল, পরনে রং চটে যাওয়া মলিন ট্রাকসুট, তার চেয়েও মলিন চোখমুখের চেহারা, দৌড়োচ্ছে রেড রোডের ধারে ঘাসজমিতে, মোহনবাগান ক্লাবের গায়ে ফুটপাত ধরে। প্রাণ আর ইজ্জত হারানোর ভয়কে নিত্যসঙ্গী করে। এই তো কয়েক বছর আগে কিছু ধনীর দুলাল চলন্ত গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে ওদের মতো একজনকে ধরে ফেলেছিল খপ করে। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেছিল দুশো মিটারখানেক। তারপর আহত অবস্থায় ফেলে দিয়ে খ্যা খ্যা হায়না হাসি হাসতে হাসতে চলে গেছিল গাড়ি চালিয়ে। তবু মেয়েগুলো আসে। কারণ ওই যে স্বপ্ন। বুট-জার্সি কাঁধে রাস্তা পেরোনো ওই ছেলেদুটোর মতো। শুধু স্বপ্নের নামগুলো বদলে গেছে। বাসুদেব, মেহতাবদের জায়গায় জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সোমা বিশ্বাস, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার… বাকিটা হুবহু এক।
কলকাতা ময়দান। সেই ব্রিটিশ আমলেরও আগে থেকে শহরের বুকে বড় একটুকরো সবুজ। কলকাতার ফুসফুস। সারা দেশে আর কোনও শহরে একলপ্তে এতটা ফাঁকা সবুজভূমি রয়েছে বলে এই প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় এই ময়দান। একে ঘিরে গড়ে ওঠা কত মিথ, কত রহস্য, কত স্বপ্ন গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার কাহিনি। কাকভোর থেকে গভীর রাত— পরতে পরতে রং বদলায় এর। বদলে যায় চরিত্র। সকালের প্র্যাকটিস সেরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের গায়ে গায়ে লেগে দুপুর নেমে আসে ময়দানে। সি এ বি ক্লাব হাউসের উলটোদিকে বিখ্যাত বটতলা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান আর মহামেডান মাঠের ফাঁকা গ্যালারি আর আশপাশের ফাঁকা জমিতে, রেড রোডের পাঁচিলে, কার্জন পার্কের আনাচেকানাচে, ইডেনে প্যাগোডার ছায়ায় ছোট ছোট জটলা। কতরকম আড্ডা। কতরকম মানুষ। ভবঘুরে, চিটিংবাজ, বেকার, নিত্যরোজ অফিসের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া চাকরি খোয়ানো মানুষ, গেঁজেল, তাসের জুয়াড়ি, ক্লাব টেন্টের ধারে বসে সেই কবে হাবিব, পরিমল দে, সুধীর কর্মকার, আর ফুটবলের স্বর্ণযুগ চর্চায় ব্যস্ত ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারার লোকজন, চোলাই মদ, ড্রাগ আর রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ফোলা ফোলা ফ্যাকাসে চোখমুখের পেশাদার রক্তদাতা। ফোর্ট উইলিয়ামের দেয়াল ঘেঁষা ঝোপঝাড়ে ভর দুপুরবেলায় খদ্দেরকে হাতছানি দেয়া সস্তা বেশ্যা, আধময়লা ফাটাফুটো শাড়ি, ময়দানের পুকুরে কঞ্চির ছিপে কেঁচো গেঁথে ত্যালাপিয়া ধরা কাঙালি, ছাগল ভেড়া চরানো হাটুরে, উনুনের ওপর কেটলি বসিয়ে এ আড্ডা থেকে ও আড্ডায় ঘোরাফেরা করা চাওয়ালা… বেমতলব গরিব মানুষজন সব। নবারুণের ভাষায় ফ্যাতাড়ু। সারপ্লাস পিপল, অলস দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে ময়দানে। দুপুরের নিঝুম অলস ভাবটা একঝটকায় মুছে যায় ময়দানের মুখ থেকে। বিশেষত ফুটবলের মরশুমে। হাওড়া, তালতলা, বাগবাজার, দমদম, বেলঘরিয়া, যাদবপুর, চিৎপুর, কলুটোলা, রাজাবাজার থেকে দলে দলে ময়দানমুখো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান সমর্থক আর তাদের জঙ্গিপনাকে সামাল দিতে ঘোড়সওয়ার পুলিশ। যদিও আই পি এল, আই এস এল আর ফি শনি-রোববার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দাপটে কলকাতা ফুটবলের সে রমরমা আর নেই, একইসঙ্গে সমর্থকদের মধ্যে ষাট-সত্তরের সেই উগ্র জঙ্গিপনার ভাবটা অনেকটাই অন্তর্হিত এখন, তবুও রোজ সকাল বিকেল দু’বেলা ময়দানে মাউন্টেড পুলিশের উপস্থিতি ইংরিজিতে যাকে বলে— ‘মাস্ট,’ ময়দানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আজও অনেকখানি ওদেরই হাতে। এ ছাড়া ফুটবলের পাশাপাশি ময়দানের সর্বত্র বিরাজমান বাঁধাকপি, টমাটো বা ধনেপাতার মতো বারোমেসে হয়ে যাওয়া ক্লাব ক্রিকেট, ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং ক্যাম্প আর বাঁশের খুঁটিতে জাল টাঙিয়ে নেট প্র্যাকটিস। নেটে অনুশীলনরত কচি কচি মুখ। গ্রীষ্মের তপ্ত অপরাহ্ণে ঘেমে পুড়ে লাল। মাঠের একধারে রাখা ইয়া ঢাউস কিটসব্যাগ আর হাতে হেল্থ ড্রিংকসের বোতল, উদ্বিগ্ন মায়ের দল। সবাই ছেলেকে সৌরভ বানাতে চান, এই সর্বগ্রাসী ক্রিকেট ম্যানিয়ার দাপটে পিছু হটতে হটতে প্রায় দেয়ালে পিঠ ঠেকার জোগাড় গরিবগুর্বো ময়দানি ফুটবলের। অতীতে ফুটবলের আঁতুড়-ঘর একাধিক বিখ্যাত সব ক্লাব এরিয়ান, রাজস্থান, খিদিরপুর, উয়াড়ির তাঁবুগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত চেহারা দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। কংকালসার কাঠামো জীর্ণ তেরপলের ছাদ, ফুটো দিয়ে জল পড়ে বর্ষাকালে। অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও ময়দানের বুকে। ক’দিন থাকবে জানা নেই, ভাবলেই ভারী হয়ে যায় মনটা। যাকগে, আপাতত এই মনখারাপের এলাকা থেকে বেরিয়ে চলুন একটু অন্যদিকে নজর ঘোরানো যাক। সারাবছর প্রায় নিয়মিত খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলোর পাতা ওলটালেই বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ দোকান এমনকী ফুটপাতের খাবার নিয়েও প্রচুর লেখা দেখতে পাওয়া যায়। কেন জানি না ময়দান সেই তালিকায় ব্রাত্য অদ্ভুতভাবে। অথচ সকাল থেকে রাত অবধি কতরকম খাবারের যে আনাগোনা উপস্থিতি গোটা ময়দান জুড়ে। যার মধ্যে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ— ‘ডান্ডাপানি’ এ রাজ্য তো বটেই, সারা দেশে তথা বিশ্বের আর কোথাও এ বস্তুটি পাওয়া যায় বলে জানা নেই। একমাত্র এই ময়দান চত্বর ছাড়া। দু’চাকার ঠেলাগাড়িতে বসানো একটা বড় টিনের ড্রামে ভরতি জল। এটা ডান্ডা-লাগানো পাত্রে তুলে চোঙার মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করা হয় গেলাসে গেলাসে। প্রয়োজন মতো লেবুর রস, বরফ, জলজিরা, বিটনুন বা স্যাকারিন সিরাপ মিশিয়ে। স্বাদে লা-জবাব, অত্যন্ত সস্তা, সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত। দীর্ঘদিন ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতা ময়দান চত্বরে। ডান্ডাপানি খেয়ে কারও পেট খারাপ হয়েছে বলে শুনিনি কোনওদিন। তবে সবকিছুর ওপরে থাকবে বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুতে ক্যান্টিনের খাবার। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ভেজিটেবল চপ আর ঘুগনি, হাওড়া ইউনিয়ন টেন্টের ফ্রিশফ্রাই। ছাঁকা তেলে ভাজা সোনালি কুইজিন! এককথায় দেবভোগ্য। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু সেরার সেরা অবশ্যই কাস্টমস বা সেন্ট্রাল এক্সাইজ টেন্টে বাটার টোস্ট, চিকেন অথবা ভেজিটেবল স্টু। দুধসাদা পিরিচে পেঁপে, গাজর, আলু আর আর তাজা মুরগির মাংস, ফ্রেশ ক্রিমের মাধুরী মিশিয়ে, গরম গরম। সাহেবি কেতায় যাকে বলে ‘পাইপিং হট’। এককথায় অলৌকিক এক পাকপ্রণালী। সঙ্গে কড়া লিকারের চা, সঠিক পরিমাণে দুধ মিশিয়ে। জাস্ট কোনও কথা হবে না।
এই চত্বরে যাদের বহুদিনের আনাগোনা তাদের অবশ্যই মনে থাকবে আনন্দবাজার তাঁবু ক্যান্টিনে গরম ঝরঝরে সরু চালের ভাত আর কাটাপোনার ঝোল। ধোঁয়া ওঠা থালার একপাশে আধ টুকরো পাতিলেবু আর পেঁয়াজ। মনে পড়তেই অ্যাতোদিন বাদেও স্যালাইভার নিঃসরণ জিভের ডগায়। আসলে সময় তখন অনেক অলস, সহজ সরল আর নিরুপদ্রব ছিল। সেই পুরনো ইডেন গার্ডেন। পাঁচ দিনের টেস্টম্যাচ। চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েসলি হলের বাম্পার বল (বাউন্সার নয়), চন্দ্রশেখরের বিষ মেশানো স্পিন আর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের লেটকাট দেখে লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে অনেকেরই ঠিকানা সোজা আনন্দবাজার ক্যান্টিন। টেস্ট ক্রিকেট থেকে পুরনো ইডেন গার্ডেন— সময়ের করাল গ্রাস অনেক কিছুই খেয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী সময়ের থাবা এড়িয়ে আনন্দবাজার ক্যান্টিনের মাছের ঝোল ভাত আজও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা জানা নেই। আপাতত স্মৃতিসরণি থেকে বেরিয়ে একটু অন্য পথে হাঁটা যাক। ময়দানের এ অঞ্চলটা ছেড়ে রেড রোড টপকে শহিদ মিনারের তলায় পড়ন্ত বিকেলে রচিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্যপট। মিনার লাগোয়া ময়দান জুড়ে বসে গেছে বিকিকিনির হাট। শেকড়বাকড় আর হেকিমি তেলের পশরা সাজিয়ে বসা বেদে-বেদেনি, ঢোলক বাজিয়ে খনখনে যৌন আবেদন মাখা গলায় আদি রসাত্মক গান গাওয়া যাযাবরী মহিলারা, দড়ির ওপর দিয়ে বাঁশের পোল হাতে ব্যালান্স করে হেঁটে যাওয়া বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে। অ্যালুমিনিয়ামের ত্যাড়াব্যাঁকা থালা নিয়ে দর্শকদের কাছে পয়সা চাওয়া ছোট ভাইটা, একটু আগে টায়ারের রিঙের ফাঁক দিয়ে গলে যাবার খেলা দেখিয়েছে, জটপাকানো চুল, চোখে তিনদিনের পিচুটি… দড়ি বেয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। শতচ্ছিন্ন নোংরা ফ্রক, মুখে চাপ চাপ ময়লা, জটপড়া চুল, চোখে অপার ক্লান্তি। দড়ি টাঙানোর বাঁশের এক কোণে অপেক্ষারত সতর্ক বাবা মা। এ প্রান্তে এসে বাঁশটা ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পড়া মাত্র লুফে নেবে মেয়েকে। একটা গোটা সার্কাস পরিবার। এর থেকে হাত দশকে দূরে ছোট টুল পেতে বসে সান্ডার তেল আর শিলাজিৎ বেচছেন জাঁদরেল চেহারার খান সাহেব। পরনে পাঠান স্যুট। মাথায় বিশাল পুশতুনি পাগড়ি। পাশে দাঁড়ানো তাগড়াই চেহারার তিন ছেলে। সহকারী। বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার ছাড়ছেন খান সাহেব, “ইয়ে বাঙালি! মুড়ি খাকে বাড়ি বনাতা হায়। লেকিন জওয়ানি কে উপ্পর ধ্যান নহি দেতা… মেরি বাত মানো, ইয়ে খান কা শিলাজিৎ লো। রাত কো অ্যায়সা খেল খেলোগে কি বিবি পুছেগি— ‘ওয় মেরি জান, তুমনে আজ ক্যা খায়া?’ তব তুম বিবিকো বতানা— ‘হাম খান কা শিলাজিৎ খায়া’…” গলা চড়ছে খান সাহেবের। ভিড় বাড়ছে খান সাহেবকে ঘিরে। দুর্বল বাঙালি জাতিকে পুরুষ বানানোর ইজারা নিয়েছেন খান সাহেব। বরাবর খেয়াল করেছি যারা খান সাহেবের আসল খদ্দের, তারা কখনওই বক্তৃতা চলাকালীন কেনাকাটা করবেন না। ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকবেন ভিড়ের পিছনে। ভাষণ শেষ হবার পর আনকা পাবলিকের ভিড় হালকা হয়ে গেলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে খানসাহেবের সামনে ঝুঁকে পড়ে মিনিট দুয়েক গুজগুজ ফুস ফুস। জেনে নেওয়া ব্যবহারের নিয়মকানুন। মানিব্যাগ থেকে দ্রুত বের করে আনা কয়েকটা দশ বিশ টাকার নোট। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতে পাওয়া মাত্র টুক করে কেটে পড়া অকুস্থল থেকে। কোনওদিক না তাকিয়ে। খান সাহেবের প্রায় গা ঘেঁষে ইয়াসিন। মেটিয়াবুরুজে বাড়ি। সঙ্গে ভুল্লু। হাড় জিরজিরে নেড়ি কুকুরছানা। ইয়াসিনের নির্দেশে একটা ডালডার কৌটোর ওপর উঠে দাঁড়াবে ভুল্লু। ফের নেমে আসবে। আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট আরেকটা কৌটো চড়ানো হবে ডালডার কৌটোর ওপর। ফের চড়ে বসবে ভুল্লু। এভাবে ক্রমাগত কৌটোর আকার ছোট হতে হতে একটা জর্দার কৌটো। ভুল্লুর দাঁড়াবার শেষ আশ্রয়স্থল। চারপাশে ফটাফট হাততালি আর ছুঁড়ে দেয়া একটাকা। দু’টাকা… ইয়াসিন আর ভুল্লুর পেটের ভাত। সেই ছোটবেলায় দেখা রাশিয়ান সার্কাস থেকে নিয়ে জেমিনি সার্কাস, কমলা সার্কাস… বাঘ, সিংহ, হাতি, শিম্পাঞ্জি, কুকুর… এক সে না মানুষি খেলোয়াড়ের কসরৎ আর কেরামতি দেখেছি। ভুল্লুর তুল্য খিলাড়ি চোখে পড়েনি আজ অবধি। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কথাটা।
আসুন এবার খানসাহেব, ইয়াসিন আর ভুল্লুর থেকে নজর সরিয়ে আরেকটু সামনে এগোনো যাক। স্পোর্টিং ইউনিয়ন আর কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের তাঁবুর মাঝখানে একটুকরো ঘাসজমিতে একটা জলচৌকির ওপর রামচরিত মানস রেখে দুলে দুলে পড়ে চলেছেন কথকঠাকুর— “বন মে চলে রামচন্দ্রজী/পিছে সীতা, লছমন ভাই…” পরনে শ্বেতশুভ্র ধুতি-ফতুয়া, কপালে চাল-চন্দন আর সিঁদুরের টিকা, গানের গলাটি ভারী মিঠে। সামনে বসা নিম্নমধ্যবত্তি অবাঙালি ভক্তের দল। সপরিবারে। প্রতিটি দোঁহা শেষ হবার পর হেঁকে উঠছেন কথকঠাকুর— “জয় সিয়া বোলো রামচন্দ্রকি…” “জয়!” সমবেত গলায় সাড়া দিচ্ছে ভক্তরা। পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাঠিতে টাঙানো বেলুনওয়ালা, চিনেবাদাম, ঝালমুড়ি, কাটা শাঁখালু, বাচ্চাদের জন্য সস্তা ছিটের ফ্রক-জামা বিক্রেতার দল। প্রবচনসুধা পানের পাশাপাশি কেনাকাটাও চলছে টুকটাক। কথকতা শেষ। রামচরিতমানস বন্ধ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন কথকঠাকুর। মিষ্টি হেসে নমস্কার করছেন। ভক্তরা যে যার সাধ্যমতো পাঁচ টাকা, দশ টাকা নামিয়ে রাখছেন সামনে। প্রণাম করছেন সাষ্টাঙ্গে। কথকঠাকুর তাতেই খুশি। যতবার দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে— ‘আরে, এটাই তো আমার দেশ। ভারতবর্ষ ছড়িয়ে রয়েছে এই একফালি ময়দানে।’
ছায়ামূর্তিরা আসে জীবিকার সন্ধানে
অতঃপর সন্ধে নামে ময়দানে। নিঝুম হয়ে আসা ক্লাবতাঁবু। টিম হারার দুঃখে ম্লানমুখ সমর্থক, যাযাবরি মেয়েরা, মাদারি পরিবার, খানসাহেব, ইয়াসিন, ভুল্লু, কথকঠাকুর, ক্লান্ত খেলোয়াড় আর রেফারির দল… সবাই ঘরমুখো আজকের মতো। ময়দান মার্কেটে জামাকাপড় আর খেলার সরঞ্জামের দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়তে থাকে। একটু দূরে বাসগুমটি থেকে ভেসে আসা ‘মালদা, রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ি…’ হাঁক। দিনের বেলা ময়দানের চরিত্ররা প্রায় সবাই চলে গেলেও থেকে যান ঝালমুড়ি, বাদামওয়ালার দল। এদের সঙ্গে এসে যোগ দেন আরও কিছু বিক্রেতা যাদের দিনের বেলা কখনওই দেখা যাবে না ময়দানে। যেমন বিমলদা। গামছার বিড়ে বাঁধা মাথার ওপর গরম ঘুগনির ডেকচি। শালপাতার বাটিতে করে ধরিয়ে দেন খদ্দেরদের হাতে হাতে। বিমলদা একসময় ডানলপে চাকরি করতেন। সব খুইয়ে ডেকচি মাথায় এই রাতের ময়দানে। বন্ধ কারখানার দরজা কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। শুধু কাড়তে পারেনি ঠোঁটের কোণে কখনওই হার না মানা জেদি নাছোড় হাসিটা। সেলাম বিমলদা। বিমলদা ছাড়াও রাতের ময়দানে অবশ্যই দেখা মিলবে নরহরিদার। নরহরি বেহড়া। আদি নিবাস ওড়িশার জগত্সিংহপুর। গলায় ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে কুলফি মালাই। ভারী মিঠে গলায় ‘কুলফিইই… কুলফি মালাইইই…’ ডাকটা শুনলে খাওয়ার আগেই প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। নরহরিদার মূল আকর্ষণ গাঢ় সবুজ রঙের সিদ্ধিমেশানো কুলফি। রসিকজনেরা তেমনভাবে চাইলে কুলফির সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাওয়া যায় খানিকটা কাঁচা সিদ্ধিবাটা। অলৌকিক এক দুনিয়ায় পৌঁছে যাবার চাবিকাঠি।
রাত বাড়ে ময়দানে। অন্ধকারে হাতে ছোট ছোট তেলের শিশি ঝুলিয়ে তেলমালিশওয়ালার চাপা কণ্ঠস্বর— ‘তেলমালিশ…’। মোটামুটিভাবে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে কার্জন পার্ক থেকে নিয়ে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড— এই পুরো ময়দান চত্বরটা চলে যায় ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের দখলে। এদের মধ্যে একটা অংশের সঙ্গে রাতের বেলা ময়দান পাহারাদার পুলিশদের একাংশের নিবিড় ব্যবসায়িক সম্পর্ক। সিক্সটি-ফর্টি পার্সেন্টেজ। অনভিজ্ঞ খদ্দেরকে ফুসলে ফাসলে নিয়ে ময়দানের অন্ধকারে বসা মাত্র চুপিসারে যমদূতের মতো মাটি ফুঁড়ে উদয় হয় নগরকোটালের দল। এর পরের অঙ্কটা অত্যন্ত সোজা। পুলিশরা ঘিরে ফেলা মাত্র নিপাট নিরীহ মুখে উঠে চলে যাবে মেয়েটি। অতঃপর কড়া ধমকধামক, গালাগালি, প্রয়োজনে হালকা দুয়েকটা চড়চাপড়… পকেটের শেষ কড়িটুকু খুইয়ে ভয়ে, লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে খদ্দেরের ময়দান থেকে বেরিয়ে আসা। এই একই ছকে খেলাটা চলে আসছে বহুদিন ধরে। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার সেটা হল এই ময়দান এলাকায় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যৌনকর্মীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পুরুষ। এরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। ছোট ছোট তিন চারজনের দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়ায় খদ্দেরের সন্ধানে। মূলত রেড রোড আর কার্জন পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে এদের অবাধ বিচরণ। অনেকেরই শাড়ি অথবা সালোয়ার কুর্তার ভাঁজে লুকোনো থাকে ক্ষুর। বেগতিক বুঝলে ধাঁ করে চালিয়ে দিতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না। অতএব রাতের ময়দানে সাধু সাবধান! তবে সর্বত্রই যে ছবিটা একইরকম সেটা বলা যাবে না কিছুতেই। ময়দানের ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা অধিকাংশই আসেন একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত গরিবগুরবো ঘর থেকে। সন্ধে থেকে শুরু করে ভাগ্য ভাল থাকলে আর কোনওমতে দেড় দুশো টাকা রোজগার হয়ে গেলেই দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে ময়দান ছেড়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেন প্রত্যেকে। কারণ রাতের ময়দানে ওদের ভাষায় ‘কাজ’ করাটা প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরাফেরার সামিল। এই ত্রাসের অন্যতম কারণ আশপাশে হেস্টিংস, রিপন স্ট্রিট, কলিন লেন, মার্কুইস স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলের লুম্পেন বাহিনী। যখন তখন এরা হানা দেয় রাতের ময়দানে। একবার কাউকে ধরতে পারলে যৌন কর্মীদের নিজস্ব ভাষায় পাঁচ সাতজন মিলে ‘বসে’ (পড়ুন ধর্ষণ করে) চলে যাবে। একটি পয়সাও ঠেকাবে না। চাইতে গেলে কপালে জুটবে চড়থাপ্পড়, লাথি ঘুষি এমনকী গালে ক্ষুরের দাগ। তাই সেধে কে আর বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়। একদিকে রাতপাহারাদার পুলিশের একাংশ অন্যদিকে দলবদ্ধ নেকড়ের মতো হিংস্র লুম্পেনবাহিনী— এই দুয়ের মাঝখানে পড়ে শাঁখের করাতের মতো খণ্ডিত হতে থাকেন রাতের ময়দানে যৌনকর্মীরা। পিষে যান জুলুমের জাঁতায়। ময়দান অঞ্চলে যে-কোনও যৌনকর্মীকে জিজ্ঞেস করলে একথার সমর্থন মিলবে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম একবার। আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগেকার কথা। সময়টা শীতকাল। রাত আটটা মতো হবে, এই অধম প্রতিবেদক ও তার এক অনুজপ্রতিম সিনেমা সমালোচক ও ডকু-ফিল্মমেকার বন্ধু (ইদানীং কিঞ্চিৎ স্বনামধন্য হওয়ায় নামটা আর এখানে উল্লেখ করলাম না), সদর স্ট্রিটে কাইয়ুমের ঠেক থেকে কেনা বাবা ভূতনাথের প্রসাদে ঝিমঝিম নেশায় বুনুয়েল, ঋত্বিক, আইজেনস্টাইন নিয়ে গুরুগম্ভীর তর্ক চালাচ্ছি গ্র্যান্ডের উলটোদিকে মনোহরদাস তরাগের রেলিঙে বসে। সামনে প্রেসক্লাবের গায়ে লাগা ময়দান। সেসময় এখনকার মতো ঘেরা ছিল না জায়গাটা। অন্ধকার মাঠে ইতিউতি ঘোরাফেরা করা যৌনকর্মীরা। মাঝেমাঝে সামনে এগিয়ে আসা খদ্দের। দরদামে পটলেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মিলিয়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে। হঠাৎই তীব্র হেডলাইটের আলোয় রাতকে দিন করে দিয়ে ময়দানে ঢুকে পড়ল মিলিটারি পুলিশের জোঙ্গা জিপ। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামা জওয়ানের দল। ভারী বুটের দাপাদাপি ময়দান জুড়ে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও এক হতভাগিনী ধরা পড়ে গেল। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসা হল জিপের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে, গাল লক্ষ্য করে বিরাশি সিক্কার চড়টা নেমে আসার আগের মুহূর্তে কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা— “মারবেন না বাবুগো! পেটে বাচ্চা আছে,” বনেটে হেলান দেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখে জান্তব হাসি। হিসহিসে গলায় আদেশ উচ্চারিত হল— “শালিকা সিনা দাবাকে দেখ, দুধ হায় কি নেহি,” মুহূর্তের মধ্যে হুকুম তামিল অক্ষরে অক্ষরে। অন্ধকারে ব্লাউজ ছেঁড়ার পড়পড় শব্দ। হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বালিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটার ওপর নজর চালিয়ে তবে নিশ্চিন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। “ছোড় দে শালিকো,” অতঃপর রেহাই হতভাগিনীর। পুকুরের ধারে রেলিঙের ওপর বসা ঝিমঝিমে নেশা ফেটে চৌচির এক মুহূর্তে! খালি মনে হয়েছিল ঠান্ডা ঘরে নারীমুক্তির সেমিনার, গুরুগম্ভীর বক্তৃতা, পাতার পর পাতা ভারী ভারী প্রবন্ধ উওমেনস লিব-এর ওপর… এ সবের আওতা থেকেই ময়দান এলাকাটা কতদূর?
রাতের ময়দান। বিপদসংকুল, রহস্যময় আর একইসঙ্গে তীব্র আকর্ষণীয়। একবার যাকে ধরেছে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো বারবার সে ফিরে যাবে ময়দানে। মনে পড়ছে ফোর্ট উইলিয়ামের একদম শেষপ্রান্তে প্রিন্সেপ ঘাটের ঠিক উলটোদিকে জোকারের ব্ল্যাক মদের ঠেক। বিয়ার থেকে শুরু করে রাম, হুইস্কি, ভোদকা, জিন… যা চাও সব মিলবে এখানে। রাতের বেলা বিশেষ করে ন’টার পর শহরের আইনি মধুশালাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ভিড় বাড়ত জোকারের ঠেকে। জোকার কালো, বেঁটে খাটো, পেটা চেহারা। টিপটপ, ফ্লামবয়েন্ট। মুখে সর্বদা লেগে থাকা দুর্দান্ত স্মার্ট একটা হাসি। যে-কোনও চাহিদা অথবা প্রশ্নের জবাবে একটাই উত্তর— “নো প্রবলেম,” পুলিশের সঙ্গে মাসোহারার পাকা বন্দোবস্ত আর যেখানেই যা কিছু হোক না কেন জোকারের ঠেকে রেইড হবে না কিছুতেই। ঠেকের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করত বোম্বাইয়া। দু’হাতে আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো তিন চারটে করে জালি থামস আপ, কোকাকোলার বোতল, পৈলান, বজবজ আর মেটেবুরুজের কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি। মোটামুটি সকাল দশটা থেকে নিয়ে সন্ধে সাতটা, সাড়েসাতটা অবধি ঘোরাঘুরি করত গঙ্গার ঘাট, ময়দান আর ইডেন গার্ডেন চত্বরে। গাছের ছায়ায় বসা প্রেমিক-প্রেমিকা আর তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত উপভোগকারী ঝোপঝাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা ‘পিপিং টম-’দের কাছে বিক্রি করত খানিকটা জোরজুলুম করেই। বোম্বাইয়া। মুখে সবসময় মহম্মদ রফি। রাত সাড়ে আটটা বাজলেই চলে আসত জোকারের ঠেকে। আকাশে চকচকে চাঁদ। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া। ঘাসের ওপর পলিথিন বিছিয়ে বসে দু’নম্বরি কোল্ড ড্রিংকস সহযোগে জোকার মদিরা। সঙ্গে ফেরিওয়ালাদের থেকে টকঝাল আলুকাবলি-চুড়মুড়, মশলা আর পাতিলেবুর রসে মাখা চানাচ্যাপটা-ঘটিগরম, বিটনুনের টাকনা দিয়ে খোসাভাঙা চিনেবাদাম আর প্রচুর কাঁচা লঙ্কার কুচি মেশানো ঝালমুড়ির চাট। সে এক অলৌকিক, অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। যার হয়নি তাকে বলে বোঝানো যাবে না। তবে এই অভিজ্ঞতা চূড়ান্ত স্বর্গীয় রূপ নিয়েছিল একবারই। গঙ্গার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাদাবোটগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জোকারের নিয়মিত খদ্দের। ওদের দু’-একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বাড়বার পর বৃদ্ধসাধুর পেটমোটা দুটো বোতল সমেত পৌঁছে যাওয়া গেছিল গাদাবোটে। ওদের ডিঙিনৌকোয় চড়ে, গঙ্গার একদম মাঝখানে। ওদেরই মধ্যে একজনের রাঁধা গরম গরম কষা শুয়োরের মাংস, লাল টকটকে রং। সঙ্গে জোকার ম্যাজিক! নিস্তব্ধ নিশুতি সারারাত, গাদাবোটের খোলা ডেক। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে মাথার ওপর দিয়ে ‘ট্রি ই ই ই’ শব্দে উড়ে চলে যাওয়া রাতচরা পাখি, চাঁদের আলোয় গঙ্গার জলে ঘাই মেরে ওঠা শুশুক… কোথায় লাগে শ্যামল গাঙ্গুলি, নবারুণ বা মার্কেজের ম্যাজিক রিয়্যালিজম।
শম্ভুভাই, ময়দানে শুকনো নেশার কারবারি। বয়স আশির কোঠায়। সর্বক্ষণ গাঁজার নেশায় রক্তলাল দুটো চোখ। গুঁড়িগুঁড়ি করে ছাঁটা চুল। হাতে মোটা তামার বালা। পেশিবহুল চেহারা বয়সের কারণে একটু ভারীর দিকে। তবে দেখলেই বোঝা যায় একসময় প্রচণ্ড তাগদ রাখত শরীরে। শম্ভুভাই। লুঙ্গির গেঁজে সবসময় দশ বারোটা গাঁজার পুরিয়া। লোকাল আর মণিপুরি। মণিপুরির দাম বেশি। ময়দানে ফিসফাস জনশ্রুতি ছিল লোকটা আসলে নাকি একসময়ের উত্তরপ্রদেশের কুখ্যাত ডাকাত। বহু খুন আর ডাকাতির কেসে ফেরার হয়ে পালিয়ে এসেছে এখানে। অতঃপর অগতির গতি এই গাঁজার কারবার। সত্যিমিথ্যে যাচাই করে দেখা হয়নি কোনওদিন। এই অধম প্রতিবেদক আর তার কয়েকজন বন্ধুকে খুব ভালবাসত শম্ভুভাই। মাঝেমধ্যেই তুরীয় আনন্দের সন্ধানে ঢুঁ মারতাম ওর কাছে। মনে আছে তীব্র গরমকালের এক রাতে শম্ভুপ্রসাদ প্রাপ্ত হয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম মোহনবাগান মাঠের পিছনে র্যামপার্ট ঘেঁষা রাস্তাটা ধরে। গা ছমছমে পরিবেশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ চারপাশ। মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে মৃদু শাড়ির খসখস। হালকা চুড়ির আওয়াজ। ফিসফিসে গলার আহ্বান— ‘বসবে?’ ইতিউতি ঘোরাফেরা করা সন্দেহজনক চেহারার সব ছায়ামানুষ। এবড়ো খেবড়ো মেঠো অসমান রাস্তা। টাল খেতে খেতে রেড রোডের মোড় টপকে ঢুকে পড়েছিলাম ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের গা ঘেঁষে। লোহার ব্যারিকেডে ঘেরা জীর্ণ প্যাটন ট্যাঙ্ক। ঘাসে ঝিঁঝির ডাক। কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির আঙুলডোবা জলে কুনো ব্যাঙের কটকট। গাছের আড়াল থেকে রোজগারের ধান্দায় রাত জাগা বৃহন্নলাদের খোনাখোনা গলার ডাক, ফটাফট হাততালি… অনেকটা দূরে মায়াবী আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল… ঘোরলাগা চোখে দেখতে দেখতে অনেকটা হেঁটে এসে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম বিশাল বিশাল বট, অশথ আর পাকুড় গাছে ঘেরা ঘাসজমিটার সামনে। ধক্ করে উঠেছিল বুকটা! যে ময়দান নিরাশ্রয়, বেকার, বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষজনের মাথার ওপর ছায়া জোগায়… রুটিরুজির ব্যবস্থা করে কতজনের… সেই ভোর থাকতে উঠে ময়দানে চলে আসা হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে স্বপ্ন দেখায় রোজ… সেই ময়দানেই আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে… সেই সত্তরের দশকে এক কাকভোরে এক কবির স্বপ্নদর্শী চোখদুটোকে বরাবরের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল ঘাতকেরা। ঠিক এই গাছগুলোর নীচে। সেই স্বপ্ন হননের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এইসব আদিম মহাবৃক্ষরাজি। বহু প্রেম, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের আবাসভূমি হয়ে শহরের বুকে জেগে রয়েছে কলকাতা ময়দান। আজও।
০৫. পেডোফাইল কলকাতা
সময়টা উনিশশো তিরানব্বই কি চুরানব্বই। বম্বে হেডকোয়ার্টার থেকে কলকাতার অফিসে এসেছিল প্রজেক্টটা। একদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই সোস্যাল রিসার্চ ডিভিশনের ব্রাঞ্চ চিফ ড. অর্না শীল, ডেকে পাঠালেন ওনার ঘরে। “পেডোফাইল সম্পর্কে কিছু জানো?” পেডোফাইল? জীবনে প্রথমবার শুনলাম শব্দটা। অগত্যা ঘাড় নেড়ে জানাতেই হল অজ্ঞতার কথা। “বসো” সামনে চেয়ারটার দিকে ইশারা করলেন অর্নাদি। অতঃপর সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন ব্যাপারটা।
পেডোফাইল মানে বিকৃতকাম এক ধরনের মানুষ, যারা শিশুদের তাদের বিকৃত যৌনলালসার শিকার বানায়। এদের অধিকাংশই এদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি এবং স্বভাবতই ধনী। ভারতে এদের মূল বিচরণক্ষেত্র গোয়া। সেখানে রীতিমতো একটা অপরাধচক্র গরিবগুর্বো ঘরের বাচ্চাদের অভিভাবকদের পয়সার টোপ ফেলে, ফুসলেফাসলে, প্রয়োজনে জোর খাটিয়ে তুলে এনে চালান করে দেয় স্থানীয় হোটেল, রিসর্ট আর ফার্ম হাউসগুলোয়। এর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে গোয়ার শৈশব। একটা আন্তর্জাতিক শিশুকল্যাণ সংস্থা সমগ্র গোয়া জুড়ে কাজ করছে এর বিরুদ্ধে। তারাই আমাদের সংস্থাকে বরাত দিয়েছে চারটে মেট্রো শহর সমেত হায়দ্রাবাদ আর বেঙ্গালুরুতে এ বিষয়ে একটা সমীক্ষা চালানোর জন্য। মনে রাখতে হবে যে সময়ের কথা বলছি তখনও পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকরের ‘পেজ থ্রি’ (পেডোফাইল চক্রের কার্যকলাপ বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছিল সিনেমাটিতে) মার্কেটে রিলিজ করতে অন্তত বছর পনেরো বাকি। গুগুল সার্চ তো কোন দূরের গ্রহ। অর্নাদির দেওয়া এতটুকু তথ্যের ভিত্তিতে কতদূর এগোনো সম্ভব? কিন্তু কিছু করার নেই। নামী ফান্ডিং এজেন্সির প্রজেক্ট কনসাইনমেন্ট। রিপোর্ট তো পাঠাতেই হবে। কাজটা হাতে নিয়েই টার্গেট এরিয়া হিসেবে প্রথমেই বেছে নিলাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, মার্ক্যুইস স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলকে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদর স্ট্রিট এলাকা। কলকাতা জাদুঘরের গা ঘেঁষে সোজা গিয়ে মিশেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। ছোট, বড়, মাঝারি… প্রচুর হোটেলের ছড়াছড়ি গোটা এলাকা জুড়ে। শয়ে শয়ে বিদেশির আনাগোনা নিত্যরোজ। কিছুক্ষণ ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করলেই চোখে পড়তে বাধ্য দৃশ্যটা। ফুটপাথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দরিদ্র শ্রেণির মহিলা। পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। প্রত্যেকের কোলে কাঁখে একটা দুটো করে বাচ্চা। কিন্তু স্বদেশি মানুষজনের কাছে ভিক্ষে চাইতে তেমন একটা উত্সাহী নয় কেউই। সেই আপাতনিস্পৃহ ভাবটাই মুহূর্তে কেটে যাচ্ছে বিদেশি-বিদেশিনীদের দেখামাত্র। বিগলিত হেসে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদেশিদের কোলে তুলে দিচ্ছে বাচ্চাদের। আশেপাশে দাঁড়ানো খুদেগুলোও ছুটে গিয়ে হাতজামার খুঁট ধরে ঝুলে পড়ছে সাহেব মেমসাহেবদের। ওরাও কোলে তুলে নিচ্ছেন, খুনসুটিতে মাতছেন বাচ্চাদের সঙ্গে। দামি এস এল আর ক্যামেরায় ছবি তুলছেন ঘনঘন। প্রথম দু-তিনদিন স্রেফ নজর করেছিলাম ব্যাপারটা। লক্ষ করেছিলাম ভিখারিনিদের প্রায় সবাই খানিকটা ভাঙাচোরা ইংরেজি জানেন যেরকম— ‘হাই’, ‘হ্যালো’, ‘গুড মর্নিং’, ‘হাউ (আর বাদ) ইউ?’ ‘ভেরি পুওর’, ‘টু মেনি চিলড্রেন’, ‘হাংরি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিটা বোঝানো হচ্ছে হাত-পা নেড়ে, শরীরী ভাষায়। আরেকটা ব্যাপারও গুরুত্বপূর্ণভাবে লক্ষণীয়, বলার কায়দা বা অ্যাকসেন্টটা অবিকল বিদেশিদের মতো। হয়তো দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফল। দিনকয়েক অনুসরণ করার পর একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলাম। ঘনিষ্ঠতা বলতে বাচ্চাগুলোকে টুকটাক লজেন্স-টফি কিনে দেয়া, মায়েদের সঙ্গে এটা সেটা গল্পগাছা করা… এইসব আর কী। যারা এতে একটু আধটু খুশি হচ্ছিল অর্থাৎ সোশ্যাল রিসার্চের ভাষায় ‘পজিটিভ রেসপন্স’ জানান দিচ্ছিল, তাদের মধ্যে দু’জনকে টার্গেট বা ‘কী রেসপনডেন্ট’ (মুখ্য উত্তরদাতা) হিসেবে বেছে নেয়া হল। অতঃপর শিপ্রার পালা।
শিপ্রা বিশ্বাস। অফিসে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। অসমসাহসিনী এবং বুদ্ধিমতী। আরও দুয়েকদিনের চেষ্টায় টুকটাক কথাবার্তা চালাতে চালাতে বিশ্বাস অর্জন করে ফেলল উত্তরদাতাদের। কথাবার্তার ফাঁকে উঠে আসা টুকরো টুকরো তথ্যগুলোকে একত্রিত করে সাজানোর পর যা উঠে এসেছিল সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক এবং চিন্তায় ফেলে দেবার মতো। যেসব বিদেশিরা এখানে আসেন, বাচ্চাদের কোলে তুলে আদর করেন, দামি দামি চকলেট আর বিস্কুটের প্যাকেট উপহার দেন, মায়েদের হাতে গুঁজে দেন বিশ-পঞ্চাশ-একশো টাকার নোট, তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্য দরিদ্র দেশের গরিবগুর্বো মানুষ আর পথশিশুদের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছি ভেবে সন্তুষ্টি লাভ করা হলেও সবার উদ্দেশ্য কিন্তু অতটা সহজ সরল নয়। ওইসব অঞ্চলের বেশকিছু হোটেলে মোটা অর্থের বিনিময়ে রমরমিয়ে চলে পেডোফাইল চক্র, হোটেল মালিক ম্যানেজার কর্মচারী এবং ওই অঞ্চলের অপরাধ জগতের কুশীলবদের সহায়তায়। কিছুদিন সমীক্ষা চলার পর কোনও কারণ না দর্শিয়ে হঠাৎই মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় প্রজেক্টটা।
কেন?— সেটা আজও অপরিসীম দুর্জ্ঞেয় রহস্য এই অধম প্রতিবেদকের কাছে। পরবর্তীতে বিষয়টা নিয়ে কলকাতায় আর কখনও কোনওরকম কাজ হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। ফলে এই বিষবৃক্ষের চারা এতদিনে মহীরুহে পরিণত হয়েছে কিনা জানা নেই সেটাও। সবচেয়ে মর্মান্তিক যেটা, শিপ্রা যার উপস্থিত বুদ্ধি আর দুঃসাহস ছাড়া এ কাজটা করা সম্ভব হত না কোনওমতেই, মারাত্মক বোন-ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। তাই সম্ভবত একমাত্র আমিই বেঁচে আছি আজও এ শহরে, এক ভয়ংকর এবং একই সঙ্গে হাড় হিম করে দেওয়া ঘটনাক্রমের সাক্ষী হয়ে।
০৬. সুমন কলকাতা
সালটা উনিশশো তিরানব্বই। ছোট বোন সবে কলেজে পড়ানোর চাকরিটা পেয়েছে। পোস্টিং মেদিনীপুরে। উইক এন্ডে বাড়ি ফেরে। এমনিতে প্রতি সোমবার ভোরের ট্রেনে কাজের জায়গায় ফিরে গেলেও সেবার কোনও একটা জরুরি কাজে আটকে পড়ায় সকালে আর ফেরা হয়নি। ফলে যে করে হোক সন্ধ্যার ট্রেন ধরে কর্মস্থলে ফিরে পরদিন জয়েন করাটা অত্যন্ত জরুরি। সেদিন সন্ধে থেকেই আকাশের মুখ গোমড়ানো। মাঝে মাঝেই হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। এই দুর্যোগে ওকে একা ছাড়ার ভরসা না পেয়ে ট্রেনে তুলে দিতে হাওড়ায় যাওয়া। তুলে দিয়ে ফেরার পথে বৃষ্টিটা আরও ঝাঁপিয়ে কাঁপিয়ে নামল। সঙ্গে প্রবল দমকা হাওয়া। এর মধ্যেই কোনও মতে বাড়ি ফেরার বাসটা পেয়ে গেলেও হঠাৎ মাঝপথে ধর্মতলায় নেমে পড়লাম। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই কাজের জায়গায়… চেনাজানা মহলে… বন্ধুদের আড্ডায় টুকরো টুকরো সংলাপ, কিছু মন্তব্য এবং প্রশ্ন…-র গান শুনেছিস?… একদম অন্যধরনের… অনুষ্ঠান দেখেছিস?… টিকিটই পাওয়া যায় না! এই ধরনের কথাবার্তা এবং তার ফলে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা কৌতূহল… সব মিলিয়ে একটা বেদম বেহাল অবস্থা আমাকে কীরকম একটা ঘোর-লাগা, ভূতগ্রস্থ অবস্থায় ওই প্রবল বর্ষণের রাতে মাঝপথে নামিয়ে দিল। মেট্রো সিনেমার ঠিক পাশেই ব্যাপক পরিচিত মিউজিক ক্যাসেটের দোকানটিতে কাকভেজা বললেও কম বলা হয় এমন অবস্থায় গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সাধারণ অবস্থায় ওই দোকানটিতে খদ্দেরের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা থাকে না। কিন্তু সেদিন একেবারে ফাঁকা। বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাড়ি ফেরার চিন্তায় উদ্বিগ্ন কাউন্টার সেলসম্যানরা আমাকে দেখে কিছুটা চমকেই গেলেন। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, সুমনের গানের ক্যাসেট আছে? তখনও ক্যাসেটের টাইটেল জানি না। ওদের মধ্যে একজন বিনা বাক্যব্যয়ে আমার হাতে ক্যাসেটটি এনে দিলেন। অন্ধকারের মাঝখানে আবছা মায়াবী নীল আলোয় গিটার হাতে শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত মুখ। ক্যাসেটের নাম ‘তোমাকে চাই’। তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। ফলে ওই অবস্থায় বেশ দেরিতে বাড়ি ফিরে মাতৃদেবী ও অর্ধাঙ্গিনীর চোখা চোখা বাক-মিসাইলের ঝাঁকের মধ্যে দিয়ে কোনওমতে বাথরুমে গিয়ে-বেরিয়ে এসে এবং নিজেকে ডিফেন্ড করার ন্যূনতম প্রচেষ্টা না করে মিউজিক সিস্টেমের মধ্যে ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে যখন প্লে-বাটনে আঙুলটা চাপলাম তখন উভয় প্রতিপক্ষই খানিকটা হতভম্ব এবং বাকরুদ্ধ। এরপর কী ঘটল এটা এককথায় বলতে গেলে আমাকে তারাপদ রায়ের কাছে একটি লাইন ধার করতেই হচ্ছে— ওই বর্ষণমুখর কালো রাতেও ‘নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক!’ হালকা তরঙ্গের মতো সিন্থেসাইজারের সুর। মেঘমন্দ্র ব্যারিটোন ভয়েস। আর গানের কথা— আমার মতো পাতি মধ্যবিত্তর গান শোনার অভিজ্ঞতার অ্যাকোয়ারিয়ামটা যেন কোন সাংঘাতিক কালাপাহাড়ের আঘাতে নিমেষে ভেঙে চুরমার। এ যেন মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়া। কিছুই মিলছে না আবার যেন খুব কাছের। যখন শুনছি— ‘চৌরাস্তার মোড়ে-পার্কে দোকানে/শহরে-গঞ্জে-গ্রামে-এখানে ওখানে/স্টেশন-টার্মিনাস-মাঠে-বন্দরে/অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে/বালিশ-তোষক-কাঁথা-পুরনো চাদরে/ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে’— আমার ভীষণ পরিচিত এই শহরটা কখনও না পড়া একটা বইয়ের মতো পাতায় পাতায় খুলে যাচ্ছিল চোখের সামনে। মনে হচ্ছিল এ তো আমারই কথা, কী ভয়ংকর রকম চেনা অথচ কখনও শুনতে পাইনি অথবা বলতে পারিনি। অন্য কেউও শোনাতে অথবা বলতে পারেননি। সেই রাতে দুটো ঘটনা ঘটেছিল— এক) তুচ্ছ কারণে স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরে চলা ঝগড়ার কিঞ্চিৎ প্রেমময় সমাপ্তি। দুই) ওই একটাই গান বারবার বাজিয়ে চলেছিলাম যতক্ষণ না পাশের ঘর থেকে মা তার পেটেন্ট পূর্ববঙ্গীয় টানে মৃদু ধমক দেন— ‘অরে, এইবার বন্ধ কর। ক্যাসেটটা তো খারাপ হইয়া যাইব’— ‘তোমাকে চাই’ বন্ধ হয়নি। রাতের ঘড়ি তখন দুটোর কাঁটা ছাড়িয়েছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার— ওই একটা গানই বারবার বাজিয়ে শুনছিলাম কারণ পরেরগুলি শুনে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছিলাম না। কী জানি যদি এইরকম ভাল না হয়। যদি মোহভঙ্গ ঘটে। কারণ একটি অথবা দুটি মহৎ সৃষ্টির পর মান পড়ে গেছে এমন উদাহরণ অন্তত সাহিত্যে অথবা চলচ্চিত্রে কম নেই। যাইহোক এক-আধদিনের জড়তা-ভয় কাটিয়ে সেই বিশাল সাংগীতিক মহাসমুদ্রে ডিঙি নামিয়েছিলাম। অনেকটা সেই হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’-র নায়কের মতো। আর জালে উঠে এল একের পর এক— ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’, ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’, ‘কখনও সময় আসে’, ‘গড়িয়াহাটার মোড়’-এর মতো অতিকায় সব প্রাগৈতিহাসিক মাছ। ততদিনে বাইশ গজের পিচে দাঁড়িয়ে ভিভ রিচার্ডসের অনায়াস ভঙ্গিতে রাজকীয় ছয় মারার মতো শ্রোতাদের গ্যালারিতে এসে পড়ছে ‘বসে আঁকো’, ‘ইচ্ছে হল’-র মতো জাদুমাখানো বল। শুরু হচ্ছে আরও নতুন আরও সাম্প্রতিক কিছুর জন্য প্রতীক্ষা।
ক্যাসেটে গান শোনার পাশাপাশি লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়তে লাগল অনুষ্ঠান দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। যার কাছে কোথায় লাগে সের্গেই বুবকা। অবশেষে সুযোগ এল। কানোরিয়ার সংগ্রামী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে শিল্পীর একক অনুষ্ঠান। নজরুল মঞ্চে। প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা এইরকম— অন্তত আমার কাছে। চিড়িয়াখানার পিছনদিকের অন্ধকার ঘরটা থেকে কখনও কোনও বাঘকে হঠাৎ সামনের বড় জাল লাগানো খাঁচায় বেরিয়ে আসতে দেখেছেন? অথবা পুরী স্টেশন থেকে রিকশায় চড়ে স্বর্গদ্বারে বাঁক নেওয়ার মুখে প্রথম শোনা এবং দেখা বিশাল সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার ধড়াম শব্দ! আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হুবহু সেইরকম। দ্রুতপায়ে মঞ্চে প্রবেশ। কী-বোর্ডের সুইচটা অন করে দিয়ে দৃপ্ত পদচারণা। পরিধানে ব্লু-ডেনিম। হাতে অনায়াস গিটার। কণ্ঠে ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’। মুহূর্তে স্টেজ হাতের মুঠোয়! নির্বাক-মুগ্ধ-সম্মোহিত দর্শক। অনুষ্ঠান তো নয়। যেন এক আন্তর্জাতিক-মহাজাগতিক প্যাকেজ। গান চলছে। সেই সঙ্গে মেসমারাইজিং কথা। যেন এক অদ্ভুত ফাঁসে চেপে ধরছেন। আবার হালকা করে দিচ্ছেন। গানে কথায় উঠে আসছেন— সুকুমার রায়— প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়— আর্নেস্তো চে গেভারা— আখতারউজ্জামান ইলিয়াস— আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ— ফ্রানত্জ বেকেনবাওয়ার— আমির খান— শ্যামল মিত্র— পীট সিগার— নোয়াম চাম্স্কি। উচ্চারিত হচ্ছে অপার প্রকৃতি প্রেম— প্যারিসের ছাত্র সংগ্রাম অথবা আণবিক বোমার বিরুদ্ধে জেহাদ। গান-কথা চলছে ঘুরছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। প্রতিটি স্তরেই অনায়াস বিচরণ করছেন শিল্পী। ঘরে বসে নাক নেড়ে নেড়ে অনেক ‘সো-কলড্ সুশীল’ অনেক কথাই বলতে পারেন কিন্তু মনে মনে একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে এরকম ম্যাজিক-রিয়্যালিজম তাঁরা কস্মিনকালেও প্রত্যক্ষ করেননি। অন্তত মঞ্চে তো নয়ই। এ যেন জন লেননের Nowhere land। যেন এক অতিপ্রাকৃতিক ক্যালাইডোস্কোপ। শত সহস্র রঙিন নকশা প্রতি মুহূর্তে ভাঙছে, জুড়ছে, আবার পুনর্গঠিত হচ্ছে। এ যেন— ‘তার অন্ত নাই গো নাই।’ আসলে যে কথা বলছিলাম— শিল্পী মঞ্চে গাইছেন, বলছেন। শুধু গাইছেন বা বলছেনই না সেগুলো বিশ্বাস করছেন। আর বিশ্বাস করছেন বলেই দেখতে পাচ্ছি মানুষটা ছুটে যাচ্ছেন— দাঁড়াচ্ছেন কানোরিয়ার সংগ্রামী শ্রমিকদের পাশে, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন জমি দখলের বিরুদ্ধে রাজারহাট-সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে। গানের দুনিয়ায় তিনিই প্রথম যিনি তাঁর কথায় বাংলা গানের সঙ্গে শুয়েছেন। এই তীব্র প্রেমই সম্ভবত (সম্ভবত শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণেই যে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই) জন্ম দিয়েছে বিপুল সাংগীতিক জ্ঞানের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে বলে যেতে পারেন— রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরী, গোপাল উড়ে থেকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম থেকে অজয় চক্রবর্তী, পীট সিগার থেকে স্টিভি ওয়ান্ডার— বলে যেতে পারেন এঁদের গান এবং আরও বহুবিধ সংগীতের ধারা প্রসঙ্গে। একটা প্রশ্ন রাখাই যেতে পারে যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের এতবড় জীবন্ত আর্কাইভ আমার এই পোড়া দেশে আর দেখা গেছে কি? অন্তত আমার চোখে তো পড়েনি। এরপর যদি তাঁর নিজের গানের কথাই ধরি তা হলে এত বিপুল বৈচিত্র্যও তো আর কোথাও চোখে পড়েনি যেখানে প্রেম-প্রকৃতি-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সমকাল-সমাজ সচেতনতা— রাজনীতি-ব্যঙ্গ-শ্লেষ-ক্রোধ-আশাবাদ এমনকী আমার পাশের বাড়ি-চিলছাদও মিলে মিশে একাকার। আবার অনায়াস দক্ষতায় তিনি নিজেই আলাদা করে দিতে পারেন একেকটি গানকে। নির্মাণ হয় ‘সন্ধে হলো’ বা ‘মোমবাতিটা কোথায় গেল’-র মতো নিখাদ অসাধারণ প্রেমের গান। ‘চাঁদের কাস্তে’ ‘বিভূতিভূষণে’ জড়াজড়ি করে আটকে থাকে প্রকৃতি। ‘হাল ছেড়ো না’ ‘কখনও সময় আসে’ জন্ম দেয় এক চিরন্তন আশাবাদের যেখানে ‘গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইনস’ আর ‘ফুলমণি’ হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক। আর উপরোক্ত সমস্ত বিশেষণগুলিই যেন কোন ম্যাজিক টাচে এক হয়ে মিলেমিশে যায় ‘তোমাকে চাই’ বা ‘জাতিস্মরে’।
শুধু কি গান, কুড়ি বছরের সুমন-যুগে আমরা জন্ম হতে দেখলাম এক নতুন ঘরানার— যা প্রথা ভাঙার, যা নিয়মানুবর্তিতার। আগে বাংলা গানের অনুষ্ঠান বলতেই আমরা বুঝতাম কোঁচানো ধুতি পাঞ্জাবি পরে গায়কের মঞ্চে প্রবেশ, বহুক্ষণ ধরে তবলার ঠুকঠাক, হারমোনিয়ামের প্যাঁ-পোঁ, অতঃপর গায়কের নীরস গম্ভীর বদনে একের পর এক গান গেয়ে চলা। এবার আমরা কী দেখলাম? সুমন স্টেজে ঢোকা মাত্রই নমস্কার অথবা আদাব এবং তত্ক্ষণাৎ অনুষ্ঠান শুরু। গান দিয়েই যে শুরু হবে তার কোনও মানে নেই। কখনও কথা, কখনও গান। আগে আমরা এ দৃশ্য প্রায়শই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, গায়ক গান গেয়ে চলেছেন আর সামনের সিটে— ‘মণি মাসির ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে গলার সেটটা কীরকম দিয়েছে’ অথবা ‘রিলায়েন্সের বাজার দরটা কি এ মাসে চড়বে?’ এ জাতীয় আলোচনা অনর্গল চলেছে। সুমনই প্রথম, যিনি বোঝালেন, শুধু বোঝালেন-ই না বিশ্বাস করতে শেখালেন গানকে শ্রদ্ধা করতে হবে। দিতে হবে তার প্রাপ্য মর্যাদা। দর্শকরাও শিখলেন অনুষ্ঠান চলাকালীন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার অভ্যাসকে বর্জন করতে। একই সঙ্গে গায়কের সঙ্গেও তাদের একটা যোগাযোগ গড়ে উঠল। কথার পৃষ্ঠে কথা, সরল যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যের ধারা গড়ে উঠল। উভয় তরফেই। শুরু হল গানের সঙ্গে কোরাসে গলা মেলানো, অদ্ভুতভাবে সাপোর্ট দিয়ে ধরতাইটা বেঁধে দিলেন ওই একা একটা মানুষ মঞ্চে দাঁড়িয়েই। যা অভিনব আন্তরিক সর্বোপরি সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয়বহনকারী। বন্ধ হল বিপন্ন বিড়ম্বিত সব ঘোষক আয়োজকদের ঘোষণা— ‘আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, শিল্পী এখনও এসে না পৌঁছনোয় অনুষ্ঠান শুরুতে একটু দেরি হচ্ছে’। সুমনের অনুষ্ঠান সাড়ে ছ’টা মানে সাড়ে ছ’টা। এক ইঞ্চি নড়চড় নেই। এই অসাধারণ নিয়মানুবর্তিতার নাম সুমন। এটা আস্তে আস্তে শ্রোতাদের মধ্যেও চারিয়ে গেল। তৈরি হল একটা আদ্যন্ত সিরিয়াস এবং কমিটেড দর্শকমণ্ডলী। যাদের মধ্যে, খুব সমস্যায় না পড়লে কেউ সুমনের অনুষ্ঠানে দেরিতে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকেন না। আর একটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করলে অত্যন্ত ভুল হবে— তা হল নাগরিক কবিয়ালের অসামান্য রসবোধ। যারা তাঁর অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে দেখেন অথবা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত উভয়েরই মানুষটির এই গুণটির সঙ্গে সবিশেষ পরিচয় আছে।
সুমন এলেন। বাংলা গানের মরা গাঙে জোয়ার এল। ইতিহাস সৃষ্টি হল— এসব এখন বহুচর্চিত, বহুব্যবহৃত বিশেষণ। অনেকেই বলে থাকেন। টিভি-র অ্যাঙ্কর থেকে বোদ্ধা। যেটা প্রায় কখনওই চর্চিত হয় না গানটা তিনি কতটা ভালবেসে গান। কতটা শারীরিকভাবে। তিন ঘণ্টা, গিটার, সিন্থেসাইজার, অর্গ্যান হারমোনিকা বাজিয়ে পাথর ভাঙা মজদুরের মতো পরিশ্রম করে। একা হাতে এবং সম্পূর্ণ একা। এ উপমহাদেশে তো বটেই সারা বিশ্বে এর নজির ক’টা আছে? একটা মানুষ গান এবং কী উদ্দেশ্যে গান করছেন সে ব্যাপারে এতটা কমিটেড হতে পারেন?
হ্যাঁ সুমন পারেন। আর পারেন বলেই কানোরিয়া থেকে অর্চনা গুহনিয়োগীর মামলা— জীবনে নিজের করা অনুষ্ঠানের একটা বৃহদংশই বিনা পারিশ্রমিকে করেছেন। ক’জন বলেন একথা? যাঁর অনুষ্ঠানের ইঞ্চি দুয়েক সাইজের একটা বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে ভিতরের পাতায় বেরুলে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে যায় নিমেষে, এখনও— তাঁকেই দেখেছি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় মেট্রো চ্যানেলের সামনে ঘ্যাড়ঘেড়ে আওয়াজের মাইকে কোনওরকম যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় গান গাইছেন। রাস্তায় অথবা ভাড়ার ম্যাটাডোরের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই সুমনের ‘তোমাকে চাই’-এর বয়স হল মাত্র কুড়ি। এটা আর যে কেউ বিশ্বাস করুন আমি অন্তত করি না। আসলে এ গান তো ছিলই। আমাদের মধ্যে। বহু বহু যুগ ধরে। ছিল আমাদের শহর কলকাতায় পাড়ায়-প্রেমে-প্রতিবাদে। ছিল স্যাঁতস্যাঁতে গলির নোনাধরা দেওয়ালে। বাজারের ব্যাগে। গলির মোড়ে হাবুর রোল সেন্টারে। এলাকার এজমালি পাহারাদার ভুলির একগাদা ছানাপোনাকে দুধ খাওয়ানোর পরম আনন্দে। ছিল রোজ রোজ হারতে হারতে অন্তত একদিন জেতার নাছোড় মানসিকতায়। ছিল গুপ্তযুগের কোনও প্রাচীন ঢিপি অথবা অতিকায় টিরেনোসোরাস-রেক্সের ফসিলের মতো মাটি চাপা পড়া আমাদের মনের অন্দরে। আমরা তাকে আবিষ্কার করতে পারিনি। পারেননি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ-রৌপ্যযুগের সেইসব প্রত্নতাত্ত্বিক খলিফারাও। সুমন পেরেছেন। তাই তিনি মায়েস্ত্রো, অনন্য, ইতিহাস। সব শেষে জয় কবির ভাষায় বলি— “আগুন ছেলেমেয়ে আমাদের/আকাশ আমাদের দখলে/যে যার বঁধুয়াকে ডেকে নাও/সুমনে দেখা করো সকলে।” দেখা করো কলকাতা।
* সুমনের গানের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল আলতামিরা পত্রিকায়।
০৭. না-মানুষী কলকাতা
কলকাতায় কি বসন্ত আর আসে? নমো নমো করে কোনওমতে লক্ষ্মীপুজোর পুরুতের যজমান বাড়িতে হাজিরা দেওয়ার মতো কয়েকদিনের জন্য ঢুঁ মেরেই উধাও শীত। তারপরই কাঠফাটা গরম নয়তো প্যাচপ্যাচে বর্ষা। গত কয়েক বছর ধরে শহরের আবহাওয়ার হাল হকিকত অনেকটা এই রকম। মাঝখানে সন্ধেবেলা ফুরফুরে মিঠে হাওয়া বয়ে যাওয়া বসন্তকালটাই বিলকুল বেপাত্তা কলকাতা থেকে। তবে বসন্ত না এলেও হলুদ বসন্ত কিন্তু আসে। পার্ক সার্কাসের ঘিঞ্জি সংখ্যালঘু মহল্লা। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল। গাছ গাছালি নিশ্চিহ্ন প্রায়। তবু হলুদ বসন্ত আসে। আমার পুরনো ফ্ল্যাটের সামনে ছোট্ট একফালি বাগানে। বিশেষ করে শীতকালে। হলুদ বসন্ত মানে হলুদ বসন্ত পাখি (ব্ল্যাক হেডেড ওরিঅল/ গোল্ডেন ওরিঅল)। বাংলায় বসন্ত বউরি, বেনেবউ নামেও ডাকা হয়। উজ্জ্বল হলুদ শরীরে কালো ডানা আর মাথা। থেকে থেকে ‘চিয়াক চিয়াক’ জাতীয় ডাক ছাড়ে। মাঝে মাঝে— ‘পি ও ও’ ধরনের সুরেলা শিস। বহুবার চেষ্টা করেছি ক্যামেরাবন্দি করার। পারিনি। চোখাচোখি হওয়ামাত্র পালিয়েছে। লক্ষ করে দেখেছি বাগানের সামনে শিমুল গাছটার মধু খুব প্রিয় পাখিটার। ফুলের একেবারে গোড়ায় বসে মাথা ঝুঁকিয়ে খাওয়ার সে কী তরিবত। ইদানীং বুড়ো হয়েছে গাছটা। ক্রমশ হেলে পড়ছে একদিকে, শীতের শেষে আর তুলো ওড়ে না তেমন। ভয় লাগে কোনওদিন যদি পড়ে যায়… আর আসবে তো হলুদ বসন্ত? বাড়ির সামনে এই একফালি বাগানে?
শুধু কি হলুদ বসন্ত? আরও কত রকমের পাখি যে আসে বাগানটায়। তার মধ্যে অন্যতম খঞ্জন (লার্জ পাইড ওয়াগটেইল)। এই এতটুকু ইঞ্চিতিনেক লম্বা চেহারা। কালচে ধূসর গায়ের রং। পেটের কাছটা দুধসাদা। শরীরের চেয়ে বড় লেজ। সবসময় খাড়া আকাশের দিকে। মাঝে মাঝেই দেখি নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাদে। ইতি-উতি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে কী সব। মানুষ দেখে তেমন একটা ভয়টয় পায় বলে মনে হয় না। তবে খুব কাছে গেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বাগানে শিউলি গাছটার ডালে বসে। খঞ্জন ছাড়াও মাঝেমধ্যেই কলকে ফুলের গাছটায় এসে বসে মৌটুসি (পার্পল সানবার্ড)। আকারে চড়াইয়ের চেয়েও ছোট। মধুকুয়া বা মধুচুয়া নামেও ডাকা হয় বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চলে। চোখ ঝলসে দেওয়া ময়ূরকণ্ঠী নীল রং। হেলিকপ্টারের প্রপেলারের চেয়েও বিদ্যুত্গতিতে ডানা নাড়িয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে উড়ন্ত অবস্থায় কলকে ফুলের মধু খায় বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে। অবিকল দক্ষিণ আমেরিকান জ্ঞাতিভাই হামিংবার্ডের কায়দায়। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এদেরই আরেক জ্ঞাতিগুষ্টির দেখা পেয়েছিলাম বাগানে। বছর কয়েক আগে। মাঝে মাঝেই বাগানে গাছগাছালির আড়াল থেকে তীক্ষ্ন ‘চিক চিক’ শব্দ শুনতে পেতাম। প্রথমে ভাবতাম বোধ হয় কাঠবেড়ালী (কমন ইন্ডিয়ান চিমপাক)। তারাও দু’-চারজন রয়েছেন যে বাগানে। রোঁয়া ফোলানো লেজ আর পিঠে তিনটে কালো ডোরা। সর্বদা ব্যস্ত ঘোরাফেরা। ভাতের দানা থেকে ছোলাভাজা, সবই রয়েছে খাদ্যতালিকায়। ওদের ডাকও অনেকটা ওই একইরকম। ক’দিন কান খাড়া রেখে ভাল করে শোনার পর মনে হল তীক্ষ্ন হলেও কাঠবেড়ালীর তুলনায় স্বরটা অনেক মৃদু এবং মিহি। ভাল করে নজর চালাতেই রহস্যের পরদা ফাঁস। চড়াই এমনকী মৌটুসির চেয়েও সাইজে ছোট একরত্তি একজোড়া পাখি। লালচে মেটে গায়ের রং। ফুড়ুক ফুড়ুক নেচে বেড়াচ্ছে ডালপালার আড়ালে। টুনটুনি। ইংরেজিতে ‘টেলার বার্ড’ ‘দর্জি পাখি’ নামে অমর হয়ে আছে রুইয়ার্ড কিপলিঙের লেখায়, উপেন্দ্রকিশোরের বইয়ে। সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। গাছের আঁশ, পাতার টুকরো ইত্যাদি ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে অসাধারণ ঘর বানায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোটখাটো পোকামাকড় আর ফুলের মধু। ঘর বানাতে দেখিনি কখনও তবে মধু আর পোকামাকড় খেতে দেখেছি হামেশাই। মৌটুসির মতোই প্রচণ্ড ভীরু, লাজুক এবং সতর্ক। কাছাকাছি উপস্থিতির আঁচটুকু পেলেই ফুড়ুৎ একনিমেষে। হলুদ বসন্ত, খঞ্জন, মৌটুসি, টুনটুনি ছাড়াও আসে শা-বুলবুলি (রেড ভেন্টেড বুলবুল)। পালিশ কালো নতুন জুতোর মতো পালকের রং। পেটের কাছটা টকটকে লাল। চারপাশে সাদা বর্ডার। টুনটুনির মতো এরাও থাকে জোড়ায়। পুরুষ পাখির মাথায় তেকোনা ঝুঁটি। চালের দানা, ভাঙা বিস্কুট বেশ তরিবত করে খেলেও মূল খাদ্য পোকামাকড়। স্বভাব চঞ্চল। মানুষকে তেমন একটা ভয় পায় না, মাঝে মাঝে তো উড়ে এসে জানলায় বসে পড়ে। সামনে মুড়ি বা ভাঙা বিস্কুট ছড়িয়ে দিলে প্রাথমিক সন্দেহের বশে উড়ে পালালেও পরমুহূর্তেই এসে খুঁটে খেয়ে যায়। ছোট থেকে পোষ মানালে খুব ভাল পোষ মানে। উত্তর কলকাতার গড়পাড়ে আমার জন্ম। ছেলেবেলায় দেখতাম অনেকেই একে পোষ মানিয়ে আঙুলে বসিয়ে ঘুরে বেড়াত। শুনেছি একসময় পুরনো কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে বুলবুলির লড়াই হত। সেসব দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে কৈলাস বোস স্ট্রিটে কালোয়ার পট্টির ছোট মাঠে বুলবুলির লড়াইয়ের আসর বসত। বন্ধুবান্ধব মিলে দল বেঁধে দেখতে যেতাম। লড়াইয়ের কুশীলব সবসময় নর অর্থাৎ পুরুষ বুলবুলি। লড়াইয়ের আগে পাখিটিকে উত্তেজিত করার জন্য খাওয়ানো হত মাংসের কিমা আর ব্র্যান্ডি মেশানো ছাতুর মণ্ড। কালোয়ার মানে লোহার ব্যবসায়ীদের অনেকেরই প্রচণ্ড শখ ছিল এই খেলায়। প্রাইজ মানি ছাড়াও বিজেতা পেতেন সুদৃশ্য ট্রফি। ব্যবসায়ীদের অনেকের গদির সামনেই রাজকীয় ভঙ্গিমায় দাঁড়ে বসে রয়েছে শা-বুলবুল, আমহার্স্ট স্ট্রিট, কৈলাস বোস স্ট্রিট, চালতাবাগান, এ সব অঞ্চল ধরে হেঁটে গেলে এটি বড় পরিচিত দৃশ্য ছিল সেসময়। পাখিগুলোকে বাগানে ওড়াউড়ি করতে দেখলে আজও সেই ছেলেবেলায় ফিরে যাই মাঝে মাঝেই।
আজ থেকে বছর দশেক আগেও দেখেছি ওদের। ভর দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝেই এসে ঢুলুঢুলু চোখে গম্ভীর দার্শনিকের মতো মুখ করে বসে থাকত ভেন্টিলেটরের গর্তে। লক্ষ্মী-প্যাঁচা। ইংরেজিতে মিল্কি আউল। দুধসাদা গায়ের রং। মুখটা হালকা বাদামি। থ্যাবড়া বাঁকানো ঠোঁট। দেখলে মনে হয় সব সময় ঢুলছে নয়তো ঘুমোচ্ছে। মোটেই তা নয়। আসলে চোখের আকারটাই অন্যরকম। সরু আর চেরা ধরনের। ফলে ওরকমটা মনে হয়। এসে বসতে দেখলেই দুনিয়ার কাকের দল উড়ে এসে কা কা শব্দে পাড়া মাথায় তুলে ব্যতিব্যস্ত করত পাখিটাকে। শোনামাত্র একতলার ফ্ল্যাটের জেঠিমা প্রচণ্ড চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করতেন— “ভাগা, ভাগা, কাউয়াগুলিরে ঢ্যালা মাইরা ভাগা… লক্ষ্মী উইড়্যা যাইব।” নামে লক্ষ্মী হলেও কাজে যে মোটেই লক্ষ্মী নয় সেটা টের পেয়েছিলাম গরমকালের এক রাতে। জানলার ধারে শুতাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল একদিন। জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম। এখনও মনে আছে রাতটা ছিল পূর্ণিমা। চোখ গেল নীচে বাগানে। একটা ধেড়ে ইঁদুর। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে, বোধহয় খাবারের সন্ধানে। হঠাৎই সামনে শিমুল গাছটার ডাল থেকে কী যেন একটা উড়ল ইঁদুরটাকে তাক করে। শরীরের দু’পাশে সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে দেওয়া দুধসাদা এক জোড়া ডানা। ঝকঝক করছে পূর্ণিমা চাঁদের আলোয়। উড়ে এল না বলে যেন ভেসে এল বলা ভাল। দক্ষ পেশাদার গ্লাইডারের মতো। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল দুই ছড়ানো ডানা আর শরীরের তলায় ঢেকে গেল ইঁদুরটা। ‘ক্রিচ!’— একটা আর্ত চিৎকার। সামান্য ঝটাপটি। ঘাড় ধরে দুয়েকটা মোচড় আর ঝাঁকুনি। ঠোঁটের ডগায় শিকার নিয়ে ফের শিমুলগাছের মগডালে গিয়ে বসল লক্ষ্মীপ্যাঁচা। বোধহয় আশি সালের কথা। মোবাইল ফোন তখনও দূর গ্রহের কোনও প্রাণী। হাতের কাছে ক্যামেরাও নেই, তাই ধরে রাখতে পারিনি দৃশ্যটা। সে আফশোস যায়নি আজও।
অনেকদিন হল লক্ষ্মীপ্যাঁচারা আর এসে বসে না ফ্ল্যাটের ভেন্টিলেটারে। তবে বেহালায় মামাবাড়িতে শুনেছি এখনও তেনাদের দেখা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। শুনলেই একটা চরম স্বস্তি অনুভব করি মনে মনে— ‘যাক! সবকিছুই তা হলে’ ‘হারানো প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের’ তালিকায় চলে যায়নি এখনও। আশার কথা এইটুকুই।
তবে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে বাড়ির সামনে এই বাগানেই। সকালবেলা। দশটা সাড়ে দশটা মতো হবে। বাজার সেরে ফিরছি। বাগানের সামনে ছোটখাটো একটা জটলা। আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছেন উদ্বিগ্ন মুখে। সামনে উপুড় করে রাখা বড় একটা বেতের ঝুড়ি। ঝুড়ির ওপর চাপা দেওয়া একটা আধলা ইট। আমাকে দেখেই উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলেন— “দ্যাখো তো কী একটা পাখি, গায়ে কালো ছিট ছিট মতো… উড়ে এসে পড়েছে বাগানে। মনে হয় ঠিক মতো উড়তে পারছে না। কী করব বুঝতে না পেরে ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছি। অর্ধাঙ্গিনীর হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়লাম ঝুড়ির সামনে। বেতের ফাঁক দিয়ে চোখ চালালাম। আধো অন্ধকার ভেতরটা। আবছা দেখা যাচ্ছে ধূসর পালকে ঢাকা একটা কিছু, সারা গায়ে ছিট ছিট দাগ। কাছাকাছি কারও উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র ‘ফ্যাঁস্ স্!’ ভয়ংকর বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ গর্জন ভেতর থেকে। সতর্ক হয়ে গেলাম মুহূর্তে। ঝুড়ির মধ্যে যিনি রয়েছেন, আর যাই হোক খালি হাতে তেনাকে ধরতে গেলে যে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা সেটা বুঝে ফেলতে সময় লাগল না একটুও। ঝুড়ির সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম এন্টালিতে বার্ড লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য রাজুদাকে। একাধিক ডানা ভাঙা চিলকে শুশ্রূষা করে ফের ছেড়ে দিয়েছে মুক্ত আকাশে। বাড়ি থেকে পালানো কাকাতুয়াকে (পোষ মানা ও কথা বলার জন্য বিখ্যাত হলেও ক্রুদ্ধ অবস্থায় প্রচণ্ড ধারালো ঠোঁটের আঘাতে ফালা ফালা করে দেওয়ার কুখ্যাতিও রয়েছে সমপরিমাণে) ফের পাকড়াও করে খাঁচায় ঢোকাতে দেখেছি নিজের চোখে। অতএব একমাত্র ভরসা রাজুদা। ফোন পেয়ে হাজির আধঘণ্টার মধ্যে। এসেই চেয়ে নিল একটা বড় মোটা কাপড়। অতঃপর হাতে কাপড় পেঁচিয়ে ঝুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কী দুঃসাহসিক দক্ষতায় প্রাণীটার ঘাড় চেপে ধরে পুরনো পাখির খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, ভাবলে হাড় হিম হয়ে যায় আজও। কারণ খাঁচায় ঢোকানো মাত্র পালক ফুলিয়ে লড়াকু যোদ্ধার কায়দায় ফ্যাঁস করে উঠেছিল প্রাণীটা। একটা প্যাঁচা। কিন্তু সাধারণ লক্ষ্মীপ্যাঁচার মতো দেখতে নয় মোটেই। ধূসর গায়ে কালো ছিট ছিট। বাঁকানো হাঁসুয়ার মতো ধারালো ঠোঁট। ফুটখানেকের মতো উচ্চতা। লড়াকু মোরগের চেয়েও মোটা দুটো পায়ে ছুরির মতো ধারালো আর বাঁকানো চারটে করে নখ। বড় মার্বেল গুলির মতো হলুদ একজোড়া চোখ। আড়াআড়ি সরু আর চেরা দু’চোখের মণি। রক্ত জল করে দেওয়া দৃষ্টি। (প্রিয় পাঠক, সত্যজিৎ রায়ের এক ডজন গল্পে ‘বৃহচঞ্চু’র সেই প্রাগৈতিহাসিক অ্যান্ডাল গ্যালার্নিস পাখির চোখ দুটোর কথা স্মরণ করুন। ধারণাটা পরিষ্কার হবে)। কোণঠাসা গুলবাঘের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাঁচার এককোণে। মাঝে মাঝেই একশো আশি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে সামনে পিছনে, পাক্কা মার্শাল আর্ট যোদ্ধার কায়দায়, কোনওদিক থেকে কোনও আক্রমণ নেমে আসছে কি না, কী লড়াকু, হিংস্র আর রাজকীয় দাঁড়াবার ভঙ্গি। ধরবার সময় হিসেবের একচুল এদিক ওদিক হলে রাজুদাকে যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাজুদা, যেন কিছুই হয়নি এরকম একটা নিস্পৃহ মুখে খাঁচার ভেতরে চোখ চালিয়ে বলল— “বাঁদিকের ডানায় একটু চোট লেগেছে। তাই মাটিতে পড়ে গেছে… তেমন কিছু নয়। সামান্য চুন-হলুদ আর মাংসের কিমার সঙ্গে মিশিয়ে দু’-তিনটে পেইনকিলার… তা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা নেই। চিন্তা তো নেই কিন্তু আপাতত কী গতি হবে এই ক্ষণিকের অতিথির। একমাত্র সমাধান সল্টলেকে বন্যপ্রাণী দপ্তর। কিন্তু তাদের ফোন নম্বর তো হাতের কাছে নেই। হঠাৎই মনে পড়ল ক’দিন আগে ওদের একটা হোর্ডিং চোখে পড়েছিল গুরুসদয় দত্ত রোডের মোড়ে। রাজুদারই স্কুটারে চেপে দেখে আসা হল হোর্ডিংয়ের তলায় লেখা ফোন নম্বর দুটো। ফোন করা হল দপ্তরের অফিসে। এবং কিমাশ্চর্যম! সরকারি কাজকর্মের ধীরগতি এবং গয়ংগচ্ছ মনোভাবের প্রবাদপ্রতিম সমস্ত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে মিনিট চল্লিশের মধ্যে বাড়ির দরজায় হাজির বন্যপ্রাণী দপ্তরের গাড়ি। তিন-চারজন কর্মী। ওদের মধ্যে একজন মহিলা। হাতে পুরু মজবুত অ্যাসবেসটাসের গ্লাভস। ছোট খাঁচাটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে এনে নিজেদের বড় খাঁচায় ঢুকিয়ে দিলেন পাখিটাকে। জানালেন চিকিত্সার পর সুস্থ করে ফের ছেড়ে দেওয়া হবে প্রকৃতিতে। কথাবার্তার মাঝখানে গিয়ে বুক সেল্ফ থেকে নামিয়ে এনেছিলাম ড. সেলিম আলির ‘কমন বার্ডস’ আর অজয় হোমের ‘বাংলার সাধারণ পাখি’ বই দুটো। বই বলছে পাখিটার নাম ‘খুরলে প্যাঁচা’ বা ‘কুটরে প্যাঁচা’ (বার্ন আউল/স্পটেড আউলেট)। ঘন ঝোপঝাড় আর গাছের কোটরে থাকে। নিশাচর শিকারি পাখি। সম্পূর্ণ মাংসাশী। ব্যাঙ, ইঁদুর, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখির বাচ্চা এমনকী ছোটখাটো সাপও রয়েছে খাদ্যতালিকায়। অতঃপর অতিথি বিদায়ের পালা, গাড়িতে ওঠার আগে ওই একই কায়দায় পুরো ঘাড়টা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল পিছনে। শ্যেনদৃষ্টিটা চোখে লেগে রয়েছে আজও।
এফ-সিক্সটিন
কলকাতার পুরনো পাড়া বিশেষ করে উত্তরে অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য এটা। পুরনো বাড়ির ছাদে বাঁশের খুঁটিতে মাথা উঁচিয়ে থাকা পায়রার ব্যোম (বসবার জায়গা) আর ছোট ছোট খোপওয়ালা কাঠের বাক্স। বিকেলবেলা, নীল আকাশে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে শয়ে শয়ে পায়রা। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন পায়রাদের মালিক। পুরনো কলকাতার ভাষায় ‘লক্কাবাজ’, ‘পায়রাবাজ’ বা ‘কবুতরবাজ’। হাতের মুঠোয় লম্বা বাঁশের লাঠি। লাঠির ডগায় বাঁধা কাপড়ের লাঠিটা জোরে জোরে নাড়াচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক। ‘হ্যা ট্যা ট্যা’ চিৎকার করছেন, তীক্ষ্ন শিস ঠোঁটে। উত্সাহ পেয়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে পায়রার ঝাঁক, হঠাৎই ছন্দপতন! ছাদে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল একটি পায়রা। নরম বুকটা ধারালো নখের আঘাতে ফালাফালি নয়তো কণ্ঠনালি চিরে গেছে তীক্ষ্ন ঠোঁটের আঘাতে। দেখামাত্র পারাবত পালকের তীব্র অভিসম্পাত মিশ্রিত হাহাকার— “নির্ঘাৎ শালা শিকরে মেরেছে! ওর…” বাকিটা অশ্রাব্য গালাগাল। যার উদ্দেশে এই পিতৃমাতৃকুল উদ্ধারকারী গালিবর্ষণ, সে আসলে একটি ছোট পাখি। আকারে পায়রারই সমান। কিন্তু পৃথিবীর সবক’টি শিকারি প্রজাতির পাখির মধ্যে সাহস ও ক্ষিপ্রতায় অন্যতম— শিকরে বাজ! কমন এশিয়ান ফ্যালকন। পিঠের রং নীলচে ধূসর। পেটের কাছে সাদার ওপর বাদামি ডোরা আর বাদামি লেজের ওপর ছিট ছিট দাগ। বাসস্থান মূলত গ্রামাঞ্চলে গাছপালা ভরতি নির্জন জায়গা হলেও লোকালয়ে হানা দেয় প্রায়ই। আক্রমণ বা শিকারের মূল লক্ষ্য পায়রা। উপরোক্ত যে দৃশ্যটির কথা এখানে বর্ণনা করলাম সেই পায়রার মালিক অত্যন্ত ভাগ্যবান, তিনি তবু তাঁর মৃত পোষ্যটিকে চোখের দেখাটুকু দেখতে পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবার কপালে সে সুযোগটুকুও জোটে না। নিরীহ পায়রাটিকে আকাশেই হত্যা করে নখের ডগায় গেঁথে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় শিকরে বাজ। তারপর কোনও নির্জন গাছের ডালে বসে ধারালো ঠোঁটের সাহায্যে ছিঁড়ে খায়। গ্রামাঞ্চলে পায়রা ছাড়াও মুরগির বাচ্চা এদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। পাখি ছাড়াও খাদ্যতালিকায় রয়েছে ইঁদুর, গিরগিটি, সাপ, ব্যাঙ, গঙ্গাফড়িং বা পঙ্গপালের মতো বড় পোকামাকড়। এদেরই একজনের শিকার ধরার অনবদ্য কৌশল দেখেছিলাম আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে। সালটা ঠিক মনে নেই। বাইপাসের ধারে জলাভূমি ও কৃষিজমি বুজিয়ে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক নগরায়ণ। গড়িয়ার কাছে হাইল্যান্ড পার্কের আকাশ ঝাড়ু দেওয়া বহুতলগুলো সম্পূর্ণ হয়নি তখনও কিন্তু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেছে। মনে আছে বহুতলের আশেপাশে বেশ কিছু গরিবগুরবো ঝুপড়িবাসী মানুষজনের বসবাস ছিল, তখনও হয়তো বা তাদেরই কারও একটা মুরগি তার গোটা পাঁচেক ছানাপোনা নিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল দুটো বহুতলের মাঝখানে এবড়ো খেবড়ো জমিতে। এটা ওটা খুঁটে খাচ্ছিল এদিক ওদিক। এর মধ্যে একটা ছানা দলছুট হয়ে মায়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল কয়েক পা। ঠিক এই সময় বহুতলের ছাদ থেকে একটা কিছু ঝাঁপ দিল আকাশে। এফ সিক্সটিন বম্বার প্লেনের মতো গোৎ খেয়ে তিরবেগে নেমে আসতে লাগল দুটো হাইরাইজের মাঝখান দিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম চিল। পরমুহূর্তেই ভুল ভাঙল। চিলের চেয়ে আকারে অনেক ছোট, প্রায় একটা পায়রার সমান। শিকরে বাজ! ডানা জোড়াকে শরীরের সঙ্গে প্রায় মুড়ে ফেলে কী অনায়াস দক্ষতায় অতটা উঁচু থেকে সোজা নেমে আসছিল পাখিটা। হুবহু F-১৬ বোমারু বিমানের কায়দায়। পলক ফেলার আগেই ছানাটাকে নখের ডগায় উঠিয়ে একই কায়দায় পাক মেরে ফিরে গেল ঠিক যেভাবে নেমে এসেছিল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল আজ সেখানে আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে বিশাল সব হাইরাইজ, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স… শিকরে বাজরাও পরিস্থিতির সামনে হার মেনে পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। এখনও মাঝেমধ্যে দুয়েকটাকে উড়তে দেখা যায় বাইপাসের ধারে যেখানে আজও খানিকটা সবুজ টিকে আছে। তবে চিনতে হলে চাই বন্যপ্রাণ সম্পর্কে অপরিসীম আগ্রহ আর অবশ্যই খানিকটা পর্যবেক্ষণ শক্তি। তবু আর কতদিন শহরের বুকে মুক্ত পরিবেশে দেখা যাবে পাখিটাকে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ শুধু প্রকৃতিপ্রেমিক এবং ঈষৎ খ্যাপাটে মানুষজন ছাড়াও আরও একদলের আনাগোনা রয়েছে ওইসব অঞ্চলে। আঠা-সুতোর ফাঁদে ফাঁসিয়ে ধরে এনে বাজারের থলেয় ভরে বিক্রি করা হয় গ্যালিফ স্ট্রিট, গড়িয়া আর বানতলার পাখির হাটে। বন্যপ্রাণ দপ্তর থেকে মাঝে মাঝে রুটিন রেইড হয়। তবে ওই অবধিই। কাজের কাজ কিছু হয় না। এরকম চলতে থাকলে শহরের আকাশ থেকে এই দুর্দান্ত সুন্দর শিকারি পাখিটার হারিয়ে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
ওৎ পেতে ওই আছি বসে…
দৃশ্যটা চোখে পড়েছিল বছর পনেরো আগে। ইডেন গার্ডেনের মাঝখানে পাকা রাস্তাটা ধরে চলেছি হাইকোর্টের দিকে। হঠাৎই চোখ আটকে গেল হাতের বাঁদিকে প্যাগোডার সামনে পুকুরটার ওপর ঝুঁকে পড়া একটা গাছের ডালে। একটা মাছরাঙা (লেসার ব্লু কিং ফিশার), পালকে উজ্জ্বল ভেলভেট নীল আর লাল রঙের অপূর্ব মিশেল। পার্পল রঙা লম্বা ঠোঁট। আকারে ল্যাজসুদ্ধ বড়জোর ইঞ্চিছয়েক। পাথরের মতো স্থির, বসে রয়েছে গাছটার সরু ডালে। দৃষ্টি নিবদ্ধ পুকুরের জলে। চোখে পড়া মাত্র দাঁড়িয়ে পড়লাম কী ঘটে দেখতে। এভাবে কাটল মিনিট পাঁচেক। হঠাৎই গাছের নীচে পুকুরের জলে ছোট্ট দুয়েকটা বুড়বুড়ি। চোখের পলক পড়ার আগে সেটাকে তাক করে বিদ্যুত্গতিতে জলে ঝাঁপ দিল মাছরাঙা। বৃত্তাকারে একটা ছোট আলোড়ন সৃষ্টি হল জলে। সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যে জল ফুঁড়ে উঠে এল পাখিটা। ডানা ঝটপটিয়ে ফের গিয়ে বসল গাছের ডালে। লম্বা ঠোঁটের আগায় ছটফট করছে এই এতটুকু একটা ল্যাটা মাছের বাচ্চা। মাটিতে পা জমিয়ে দেবার মতো দৃশ্য। ব্যস! ওই শুরু। প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণের আকর্ষণে এরপর থেকে বারবার ফিরে গেছি ইডেন গার্ডেনে। একবারও আমাকে নিরাশ করেনি দেড় শতক পেরিয়ে যাওয়া এই স্বর্গোদ্যান। পরবর্তীতে এই বাগানেই একাধিক বার দেখা পেয়েছি মাছরাঙার আরেক জাতভাইয়ের। স্পটেড বা পাইড কিংফিশার। সাধারণ মাছরাঙার চেয়ে আকারে অনেকটা বড়। পায়রার চেয়ে সামান্য ছোট। সারা গায়ে সাদার ওপর অজস্র ছিটছিট দাগ। এদেরও শিকার করে মাছ খেতে দেখেছি ইডেনের পুকুরে। শিকার ধরবার কায়দাটাও হুবহু সাধারণ মাছরাঙার মতো।
মাছরাঙা ছাড়াও পুকুরের জলে রয়েছে অজস্র ঢোঁড়া সাপ (চেকারড কিলব্যাক স্নেক)। গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের ওপর কালো কালো ডোরা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে, নির্বিষ এই প্রাণীটির উপস্থিতি গোটা পুকুর জুড়ে। ডাঙায় প্রায় ওঠে না বললেই চলে। আবার জলের গভীরেও যায় না তেমন একটা। ছোটখাটো মাছ বা ব্যাঙ ধরবার জন্য পাড়ের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে বেশিরভাগ সময়। পাড়ের ধারে দাঁড়ালে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। একটু বাদেই দেখা মিলবে এদের। নিঃশব্দে জল কেটে কেটে কী রাজকীয় ভঙ্গিমায় বিচরণ করছে। অকারণে বিরক্ত না করলে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণেও কোনও বিপদ নেই। প্রয়োজন শুধু সামান্য ধৈর্য আর সহমর্মিতার। আগে গ্র্যান্ড হোটেলের উলটোদিকে মনোহরদাস তরাগ সহ কলকাতার বহু পুকুরেই দেখা মিলত। আজকাল আর দেখা যায় না তেমন একটা। ব্যাপক হারে পুকুর বোজানো আর সিমেন্টে বাঁধিয়ে ফেলা পাড় প্রায় অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে এই অসামান্য সুন্দর এবং নিরীহ সরীসৃপটিকে শহরের বুক থেকে।
বাগানের দেয়ালটা যেখানে গিয়ে স্টেডিয়ামের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে, ঘন ঝোপঝাড় আর আগাছার জঙ্গলে ঘেরা টুকরো টুকরো ঘাসজমিতে প্রায়ই দেখেছি বেজি-মা (কমন ইন্ডিয়ান মংগুজ), তার একগাদা ছানাপোনাকে নিয়ে ঘুরঘুর করছে এদিক ওদিক, চোখে সদা সতর্ক দৃষ্টি। খুদে খুদে ছানাগুলো। একরত্তি তুলোর বলের মতো। মায়ের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে বাধ্য ছাত্রের মতো। শিখে নিচ্ছে বেয়াড়া রকম নির্দয় এ শহরে টিকে থাকার কলাকৌশল। আর বেশিদিন পারবে কি? ভরসা হয় না তেমন একটা। কারণ বাগানের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ওই তালগাছগুলো ছিল শকুনদের আস্তানা। ছিল মানে আজ আর নেই। শকুন (বেঙ্গল ভালচার)। একদা এ শহরে বিনেমাইনের মুদ্দোফরাস। পচামড়া পশুর শবদেহ, আবর্জনা খেয়ে পরিষ্কার রাখত কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে। ইডেনের তালগাছ ছাড়াও কুৎসিত দর্শন অথচ অসম্ভব নিরীহ এই পাখিটির দেখা মিলত ধাপার মাঠে, শহরের এখানে ওখানে আবর্জনার স্তূপে। মৃত গবাদি পশুর শরীরে মৃত্যুর পরও মিশে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যকৃৎ অকেজো হয়ে বছর পনেরো হল চলে গেছে বেবাক খরচার খাতায়। এখনও মনে আছে বিশাল দুই ডানা মেলে গ্লাইডারের ভঙ্গিমায় শহরের আকাশে রাজকীয় সেই ভেসে বেড়ানো। এখন চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখতে হয়, নয়তো ডুয়ার্সের সংরক্ষণ কেন্দ্রে। এর চেয়ে মর্মান্তিক এবং দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে কি?
বাগানের সীমানা ছেড়ে ফের প্যাগোডার দিকটায় পিছিয়ে এলে চোখে পড়বে বিশাল বিশাল সব মেহগনি, পাকুড়, অশত্থ গাছগুলোর গুঁড়ির গায়ে একাধিক ছোট বড় গর্ত। ওগুলো আসলে টিয়াপাখির (রোজ রিঙ্গড প্যারাকিট) বাসা। কলাগাছের পুরনো পাতার মতো গাঢ় সবুজ গায়ের রঙ। গলায় লাল-গোলাপি গোল রিঙের গায়ে কালো বর্ডার। টুকটুকে লাল ঠোঁট, নিশ্চিত দেখা পাওয়ার সময় শীতের শেষ। ডিম পাড়ার মরশুমে। একেকটা গর্তে একজোড়া করে থাকে। বাসার দখল নিয়ে প্রচণ্ড মারামারিও হতে দেখেছি নিজেদের মধ্যে। আগে কলকাতার আকাশে, বিশেষত সন্ধের মুখে ‘টি টি’ আওয়াজ তুলে উড়ে যেতে দেখা যেত ঝাঁকে ঝাঁকে। দিনে দিনে কমে আসছে সংখ্যাটা। উঁচু উঁচু বহুতলের বাধা, কেটে ফেলা গাছের পর গাছ আর চোরাশিকারির আঠা সুতোর ফাঁদ… ধরা পড়ে সোজা চালান রথের মেলা আর গালিফ স্ট্রিটের পাখির হাটে, অতঃপর ঠিকানা গেরস্ত বাড়ির দেড়-দু ফুটের গোল খাঁচা। একটু একটু করে হারিয়ে ফেলা ডানা মেলে আকাশে ওড়ার শক্তি। করুণ, দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা। খাঁচার বাইরে প্রিপারেটরি স্কুলে পড়া বাচ্চার পাশে গর্বিত মা। “সি হানি, দিস ইজ পি ফর প্যারট…।”
মনে আছে আজ থেকে প্রায় বছর বিশেক আগে ইডেনে নৈশালোকে কোনও একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে মাঠে ঢুকে পড়েছিল একটি অদ্ভুত দর্শন প্রাণী। মুখটা ছুঁচোলো। অনেকটা শেয়ালের মতো। ধূসর পাটকিলে গায়ের রং। অথচ পাগুলো ছোট ছোট। গুলির মতো গোল গোল চোখ। রোঁয়াফোলানো মোটা লেজের গায়ে কালো কালো ডোরা। ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের মধ্যে। মাঠভর্তি দর্শক, খেলোয়াড় আর ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তও বুঝিবা। আম্পায়ার, কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, মায় হাজার আশি দর্শক, তারাও সবাই ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন কিছুটা। তবে এই হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। মিনিট পাঁচেক ইতিউতি ঘোরাঘুরি করে ময়দান থেকে বিদায় নিয়েছিল অবাঞ্ছিত আগন্তুক। স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন মাঠসুদ্ধ সবাই। পরদিন খবরের কাগজ আর টিভিতে এ নিয়ে বেশ খানিকটা হৈ চৈ-ও হয়েছিল মনে আছে। রহস্যভেদ করেছিলেন প্রাণী বিজ্ঞানীরা। ময়দানে অনুপ্রবেশকারী আগন্তুকের নাম-ভাম। ইংরেজিতে কমন পাম সিভেট। বাংলার অনেক অঞ্চলে একে সরেল বা গন্ধগোকুল নামেও ডাকা হয়। আমেরিকান রেকুনের জ্ঞাতিভাই, ফলমূল থেকে শুরু করে মাছ, পাখি, ব্যাঙ, গিরগিটি, ছোটখাটো সাপ এমনকী রান্না করা খাবার অরুচি নেই কিছুতেই। গ্রামাঞ্চল তো বটেই, পূর্বতন শহরতলি, অধুনা শহরের আওতায় এসে পড়া কসবা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ সহ একাধিক অঞ্চলে মাঝেমধ্যেই হানা দেয় গৃহস্থের রান্নাঘরে, পাখি আর মুরগির খাঁচায়। বাড়ির আশেপাশে এলে গা থেকে পাকা মহুয়া বা আতপ চালের গন্ধ পাওয়া যায়। ধূর্ত, জাতশিকারি নিশাচর এই প্রাণীটি এমনিতে নিরীহ এবং লাজুক হলেও বিপদে পড়লে কিন্তু ভয়ংকর হিংস্র। সরু করাতের মতো দুপাটি দাঁত আর ক্ষুরের চেয়েও ধারালো নখ। বেশি সাহস দেখাতে গেলে সাংঘাতিক রকম আহত হবার সম্ভাবনা। যথেচ্ছ নগরায়ণ দিনে দিনে শহরের বুক থেকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে ভয়ংকর সুন্দর, ছোটখাটো এই শিকারি প্রাণীটিকে। বছর পাঁচ ছয়েক আগে এদেরই একজনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল খোলা পরিবেশে। ইডেন গার্ডেন আর বিধানসভার মাঝখানে রাস্তার ওপরে। তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায়। কোনও কারণে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে বেচারা। ওরকম একটা প্রাণী, কী অপূর্বদর্শন! দ্রুততম স্তন্যপায়ীদের মধ্যে অন্যতম। হেরে গেল যান্ত্রিক গতির কাছে। মর্মান্তিক! বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব হয়নি দৃশ্যটা। দ্রুত পা চালিয়ে চলে এসেছিলাম সামনে থেকে।
ছিল রুমাল…
প্রথম দেখেছিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঝখানে বাঁধানো পুকুরটায়। প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল সাপ বোধহয়। ঠিক যেন ফণা উঁচিয়ে রয়েছে জলের মধ্যে থেকে। হঠাৎই গোৎ খেয়ে জলের মধ্যে ডুব মারল প্রাণীটা। ভেসে উঠল মিনিট দুয়েক বাদে, ঠোঁটে গাঁথা একটা ছোট মাছ। ছটফট করছে ঠোঁটের আগায়। এরকম বার তিনেক চলার পরই চরম বিস্ময়! অনেকটা সেই সুকুমার রায়ের হযবরল-র ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল-এর মতো। আপাতদৃষ্টিতে যাকে সাপ ভেবেছিলাম সে-ই হঠাৎ পাখি হয়ে জল থেকে উড়ে গিয়ে বসল পুকুরের পাড়ে একটা গাছের ডালে। রোদ পোয়াতে লাগল দু ডানা মেলে। আগ্রহ বাড়ল। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম গাছের নীচে। একটা পাখি। কুচকুচে কালো পালিশ করা পালকের রং। ঈষৎ বাঁকা আর ছুঁচোলো ঠোঁট। বড়জোর একটা দাঁড়কাকের সাইজের হবে। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো বাঁকানো গলাটা অনেকটা ফণাতোলা সাপের মতো। বোধহয় গাছের তলায় আমার উপস্থিতি টের পেয়ে একটু বাদেই উড়ে গেল পাখিটা। বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমেই গেলাম বুক সেল্ফের কাছে। কালবিলম্ব না করে শরণাপন্ন হলাম তাবৎ যত পক্ষীকুলের সিধুজ্যাঠা ড. সেলিম আলি আর অজয় হোম মহাশয়ের। দুজনেই বলছেন পাখিটার নাম পানকৌড়ি। ইংরেজিতে লেসার কমোর্যান্ট। বিহার উত্তরপ্রদেশে পানকৌয়া নামেও ডাকা হয়। এরপর থেকে যতবার গেছি ততবারই এদের দেখা পেয়েছি ভিক্টোরিয়ার পুকুরে। নিরাশ হতে হয়নি একটিবারের জন্যও।
পানকৌড়ি ছাড়াও ভিক্টোরিয়ার বাগানে আমার আকর্ষণের আরেকটি মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাদুড় (কমন ইন্ডিয়ান ফক্সব্যাট)। কমলা আর ধূসর বাদামি গায়ের রং। ছুঁচোলো মুখটা অনেকটা খ্যাঁকশেয়ালের মতো। শয়ে শয়ে ঝুলে থাকত বড় বড় গাছের ডালে। আদ্যম্ত নিশাচর। সন্ধে নামলেই ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে পড়ত ফলমূল, খাবারের সন্ধানে। পরবর্তীতে যাযাবর শ্রেণীর একধরনের মানুষের খাদ্য হিসেবে পালে পালে শিকার হয়ে পুরনো বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে আলিপুর চিড়িয়াখানার বড় বড় গাছগুলোকে। পয়সা খরচ করে টিকিট কাটতে হবে না। তাজ বেঙ্গলের উল্টোদিকে আদি গঙ্গার ব্রিজটার ওপরে দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন যে-কোনওদিন। শয়ে শয়ে ঝুলে রয়েছে গাছের ডালে। পড়ন্ত বিকেলে বাসা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া খাদ্যান্বেষণে। রোজ সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। সারারাত উড়ে উড়ে ফলপাকুড়, পোকামাকড় খেয়ে কাল ভোর ভোর আবার ফিরে আসবে এই ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে…এখনও টিকে থাকা একটুকরো বাসায়। ভাবলেই মনে মনে অদ্ভুত আনন্দ আর স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে একটা।
নীরব উচ্ছেদ
বছর দুয়েক আগে, রবিবারের দুপুর। ঈষৎ ভালমন্দ খেয়ে চোখ বুলোচ্ছি গল্পের বইয়ে। এমন সময় আদ্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী, অনুজপ্রতিম বন্ধু বিমলের ফোন। “তাড়াতাড়ি এসো বাপিদা! পাড়ায় সাপ ধরা পড়েছে” কথার মাঝখানে যান্ত্রিক গোলযোগে কেটে গেল লাইনটা। আর দেরি না করে জামাটা গলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাস ধরব বলে।
এন্টালি তালতলা অঞ্চলের পুরনো পাড়ায় বিমলদের বাড়ি। গিয়ে দেখি ওদের বাসা থেকে সামান্য দুরে একটা ছোটখাটো জটলা। বিমল আমাকে দেখামাত্র বেরিয়ে এল ভিড়ের মধ্যে থেকে। উত্তেজিত চোখমুখের চেহারা। ওর কাছেই শুনলাম ঘটনাটা। এলাকার একটা পুরনো বনেদি বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল কদিন ধরেই। ফ্ল্যাট উঠবে। আজ সকালে ভাঙতে এসে প্রোমোটারের মিস্ত্রি-মজুররা ইটের পাঁজার আড়ালে সাপটাকে দেখতে পায়। ওরা তো তখনই মেরে ফেলতে যাচ্ছিল। নেহাতই ভাগ্যক্রমে বিমলের চোখে পড়ে যাওয়ায় সেরকম কিছু ঘটেনি। শুনতে শুনতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম সামনে। পাশে ভাতের হোটেল থেকে চেয়ে আনা একটা গামলা উপুড় করে তার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে প্রাণীটাকে। গামলার ওপর চাপানো বড়সড় একটা থানইট। বসে পড়ে ছোট্ট একটা টোকা দিলাম গামলার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে ভয়ংকর ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি। গর্জন আর চেহারার বর্ণনা শুনে যা মনে হচ্ছিল সেটা আর ভাঙলাম না বিমলের কাছে। মুখে প্রশ্ন করলাম বনদপ্তরে খবর দিয়েছিস?” “প্রায় আধঘণ্টা হতে চলল…।” জবাব দিল উদ্বিগ্ন বিমল। অতঃপর অপেক্ষার পালা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে বাড়ির সামনে হাজির দপ্তরের গাড়ি। নিজের বাড়িতে প্যাঁচা উদ্ধারের অভিজ্ঞতা থেকে ওদের কাজের ধরন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই সামনের ভিড়টাকে হালকা করে দিতে বললেন পাড়ার ছেলেদের। প্রত্যেকের হাতে মোটা ধাতব দস্তানা। একজনের হাতে দুমুখো সাপধরা লাঠি। এগিয়ে গিয়ে ইট তুলে গামলাটা সরাতেই বুঝতে পারলাম আমার ধারণাটা একদম সঠিক। ফুট চারেকের মতো লম্বা। উজ্জ্বল হালকা বাদামি রঙের ওপর কালচে বাদামি রঙের মতো ছোপ সারা গা জুড়ে। গোখরো, কেউটে বা দাঁড়াশের তুলনায় মোটা, ভারীসারি চেহারা। চওড়া, থ্যাবড়াটে মাথা। চন্দ্রবোড়া। ইংরেজিতে রাসেল ভাইপার। ঝোপজঙ্গল, খড়ের গাদা ছাড়াও পুরনো বাড়ির ইটের ফাঁকফোকরে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও থাকতে পছন্দ করে। পাড়ার লোক বিশেষ করে বাড়ির বাসিন্দাদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অ্যাতোদিন ধরে রয়েছেন এবাড়িতে অথচ কাউকে কামড়ানোর কথা শোনা যায়নি কোনওদিন। অতএব এ নিশ্চয়ই বাস্তুসাপ। কথাবার্তা শুনে হাসছিলাম মনে মনে। আসলে ওসব কিছু নয়। সাপ এমনিতেই ঠান্ডা রক্তের নিরীহ প্রাণী। আগে থেকে মানুষের পায়ের আওয়াজ বা উপস্থিতি টের পেলে পত্রপাঠ সরে পড়ে সেখান থেকে। নেহাতই আক্রান্ত বোধ করলে বা গায়ে পা না পড়ে গেলে সাধারণত কামড়ায় না কাউকে। আর সেটাও সেই ভয়ের কারণেই। বনদপ্তরের কর্মীরা মোটা ঝোলায় ভরে সাপটাকে নিয়ে যাবার সময় একটাই প্রশ্ন জাগছিল মনে। একজন তো রক্ষা পেল। উচ্ছেদ হলেও পুনর্বাসনের একটা ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা হবে আশা করি। কিন্তু ওর আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি —তারা কি কেউ এখনও থেকে গেল ভাঙা বাড়িটার ইটের পাঁজায়? তাদের ভবিষ্যৎ কী? উচ্ছেদ তো হতে হবেই। কিন্তু হওয়ার পর যাবেটা কোথায়? আরেকটা পুরনো বাড়িতে? সেরকম আস্তানাই বা আর ক’টা টিকে রয়েছে শহরে? প্রায় সবই তো হাইরাইজের গর্ভে। যদি বা কোনওমতে এক-আধটাকে খুঁজে পাওয়া যায় আদৌ সেখানে গিয়ে পৌঁছোনো যাবে কি? পাকা রাস্তা, নিয়নের চোখ ধাঁধানো আলো, ধেয়ে আসা নির্দয় গাড়ির টায়ার, সভ্য এবং হিংস্র চোখের শ্যেন নজর আর শরীর লক্ষ্য করে নেমে আসা নির্মম উদ্যত লাঠি…এতসব এড়িয়ে বুকে হেঁটে আদৌ পৌঁছনো যাবে কি কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়? উত্তর অজানা।
জলে হাঁটা
শুনেছি হঠযোগী সিদ্ধপুরুষরা নাকি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন। সচক্ষে দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি। বাস্তবে আদৌ সম্ভব কি? পরীক্ষা করে দেখার সুযোগও পাইনি কোনওদিন। মানুষ কেন কোনও প্রাণীই যে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে না এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। আর এই জানাটাই চরম বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল একবার। পার্ক সার্কাস কানেক্টর ধরে যাচ্ছি। হঠাৎই চোখ গেল সায়েন্স সিটির গায়ে বিশাল ঝিলটার পাড়ে। একটা পাখি। মুরগি আর বকের মাঝামাঝি চেহারা। আকারে বড়জোর একটা দেশি মুরগির মতো। চোখধাঁধানো উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী গায়ের রং। লাল টুকটুকে ঠোঁট। লম্বা লম্বা বকের মতো ঠ্যাঙ ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে জলের ওপর। অবাক বিস্ময়টা কাটিয়ে একটু কাছে যেতেই ভুল ভাঙল। আসলে জল নয়, জলের ওপর ভেসে থাকা বনকলমি আর কচুরিপানার ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে পাখিটা। অথচ গাছগুলো একটুও ডুবে যাচ্ছে না। এতটাই নিঃশব্দ আর হালকা পদচারণা। পরে জেনেছিলাম পাখিটার নাম জলপিপি। ইংরেজিতে পার্পল মুরহেন। এ ছাড়াও কামপাখি, জলমুরগি, ডাহুক ইত্যাদি একাধিক নামেও পরিচিত বাংলার গ্রামাঞ্চলে। পরবর্তীতে এদের আরও দুই জ্ঞাতিভাইয়ের দেখা পেয়েছিলাম বাইপাসের ধারে ভেড়িগুলোয় আর সেই ইডেনের পুকুরে। ধূসর আর সাদা রঙের হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন। দ্বিতীয়টি ব্রোনজ উইঙ্গড জাকানা। উজ্জ্বল কালো মাথা, গলা আর বুক। পিঠ আর ডানার রং সবুজাভ ব্রোঞ্জের মতো। লালচে বাদামি লেজ। সব মিলিয়ে সে এক রাজকীয় রঙের সমাহার। ইডেনের পুকুর আর বাইপাসের ভেড়ি ছাড়াও পরে আরও বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ হয়েছে বন্ধু গৌতম কুমার দে-র নিউ গড়িয়ার বাড়ির পাশের ডোবায়। জলে হাঁটার মতো ডুব সাঁতার বা ভেসে বেড়ানোতেও সমান দক্ষ কিন্তু ওড়ার ব্যাপারে ততটা নয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া উড়তেও চায় না তেমন একটা। খাদ্য বলতে জলজ ঘাসপাতা আর ছোটখাটো পোকামাকড়। বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এখনও নিয়মিত উড়ে আসছে কল্লোলিনী তিলোত্তমায়। এখানেও বিপদ তো সেই একটাই। পুকুর ক্রমাগত কমে আসছে শহরে। ফলে আর কতদিন দেখতে পাওয়া যাবে রূপসী (নাকি রূপবান?) জলপিপিদের তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশটা কিন্তু থেকেই গেল।
উত্তরসূরি
বছর কয়েক আগে সল্টলেক থেকে ফিরছিলাম এক বন্ধুর গাড়িতে চড়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে। মাঝরাস্তায় হঠাৎই বিগড়াল গাড়িটা। দাঁড়িয়ে পড়ল চিংড়িহাটা থেকে সামান্য দূরে বিশাল পুকুরটার পাড়ে। ড্রাইভার নেমে বনেট তুলে খুটখাট কীসব পরীক্ষা করতে শুরু করল। পাশে দাঁড়ানো উদ্বিগ্ন বন্ধু। যেহেতু যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান নেই তাই পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম জলাশয়ের ধারে। আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। দূর থেকে ভেসে আসা হোর্ডিংয়ের হালকা আলোয় একটা প্রাণী। আকারে সাধারণ বেড়ালের প্রায় তিনগুণ। ধূসর গায়ে লম্বাটে গোল গোল ছোপ। পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল জলের ধারে। পাথরের মতো নিশ্চল, স্থির হয়ে ওত পেতে বসে রইল কিছুক্ষণ। মিনিট দুয়েক এভাবে কাটল। হঠাৎই বিদ্যুত্গতিতে জলে থাবা মারল একটা। মুহূর্তের মধ্যে একটা মাছ, থাবার ঝটকায় ছিটকে এসে পড়ল পুকুরপাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে তরিবত করে মাছটাকে খেল প্রাণীটা। তারপর ধীরে সুস্থে উঠে ফের মিলিয়ে গেল ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আগে যেহেতু চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েকবার দেখেছি তাই আলো আঁধারিতেও চিনতে অসুবিধে হয়নি। মেছো বিড়াল, ইংরেজিতে ফিশিং ক্যাট। বাঘঢাঁশ, বাঘঢাশা বা বাঘেলা নামেও পরিচিত। বন্দি অবস্থায় দেখে থাকলেও মুক্ত প্রকৃতিতে শিকার করতে দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা এই প্রথম (সেটাই একমাত্র এবং শেষ) আর সেই ঘোরেই বুঁদ হয়ে রয়েছি। এমন সময় গোঁ গোঁ যান্ত্রিক আওয়াজ। সচল হয়েছে গাড়ি। ফিরতে ফিরতে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ উপন্যাসটির কথা। প্রবাসী জেনেটিক বিজ্ঞানী পরিতোষ কুণ্ডুর স্কটিশ সহধর্মিণী এলসা টিচবোর্ন (নিজেও বিজ্ঞানী)। কলকাতায় সংহতি কলোনির স্বামীর বাড়িতে এসে মাঝরাতে বাড়ির পাশে প্রায় মজে যাওয়া পুকুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল এমনই একটি বাঘঢাশাকে। এ এমনই এক প্রাণী যা শেয়াল, খটাশ, বাঘরোল বা বনবেড়ালের মতোই মুছে গ্যাছে শহর আর শহরতলির মানচিত্র থেকে। এলসার মনে হয়েছিল এ যেন সেই কোটি কোটি বছর আগে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের কোনও উত্তরসূরি, আজও টিকে রয়েছে সংহতি কলোনির পুকুরপাড়ে… হু হু করে গাড়ি ছুটছে। গাড়ির মধ্যে আমি। এলসার ভাবনা রথের সহযাত্রী। পটভূমি—সংহতি কলোনির পুকুরের জায়গায় বাইপাসের জলাভূমি। তফাত শুধু এটুকুই।
উলট পুরাণ
ঠিক তাই। একদিকে যেমন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পেরে শহর থেকে একে একে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানকার না-মানুষি বাসিন্দারা, আর ঠিক তখনই এর একদম উলটোটাও ঘটে চলেছে প্রকৃতিতে। জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাবার নেই তাই জঙ্গল ছেড়ে লোকালয় চলে আসছে বন্যপ্রাণীরা। সুন্দরবনের বাঘ থেকে ডুয়ার্সের লেপার্ড হয়ে দলমার হাতি—কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের শহরেও কিন্তু এরকমটা ঘটে চলেছে মাঝে মধ্যেই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে অথবা বাড়ির পাশেই আপনাদেরও অনেকের নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। বাড়ির ছাদ, টালির চাল, জানালার আলসে, জনবহুল বাজার এলাকা…সর্বত্র এদের অবাধ উপস্থিতি। রাস্তা ধরে বাজার ভরতি থলে হাতে চলেছেন অসতর্ক সহনাগরিক। হঠাৎই একটা আওয়াজ—হুপ! সরু সরু নখর আঙুলের হ্যাঁচকা টানে বাজারের ব্যাগ ছিটকে মাটিতে। ছিনতাই হয়ে গেল কলাটা মুলোটা। ফলের ডালা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানি। খদ্দেরের সঙ্গে কথাবার্তায় মজে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়েছেন এদিক ওদিক। টুকরি থেকে উধাও পুরুষ্টু আপেল। কে এই দুর্দমনীয় ছিনতাইবাজ? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। হনুমান (কমন ইন্ডিয়ান লেঙ্গুর)। মাঝে মাঝেই দেখা যায় একা অথবা গুষ্টিসুদ্ধ আন্ডাবাচ্চা নিয়ে বসে আছে বাড়ির ছাদে, গাছের মগডালে অথবা খোলা রাস্তায়। গম্ভীর কালো মুখ, ইয়া লম্বা লেজ। মুখে একটা দার্শনিক ভাবভঙ্গি সবসময়। খাবার দাবার যা টুকটাক ছিনতাই করছে সেটা নেহাৎই পেটের জ্বালায়। কারণটা তো সেই একই। জঙ্গলে খাবার নেই। তার ওপর ব্যাপকভাবে চলছে বৃক্ষনিধন। কী করবে বেচারারা? কথায় বলে ‘পাপি পেট কা সওয়াল’। তাই বাধ্য হয়ে প্রকৃতির জঙ্গল ছেড়ে কংক্রিটের জঙ্গলে। ভয় নেই, ওরা আপনার টাকাকড়ি, গয়নাগাঁটি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিছু চুরি করবে না। এটিএম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করারও মতলব নেই বিন্দুমাত্র। শুধু সামান্য খাবারদাবার। পেটি ক্রাইম কেস। তা ছাড়া আমাদেরই তো পূর্বপুরুষ। খেতে না পেলে আর যাবেটা কোথায়? শুধু এটুকু ভেবে এই সামান্য অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া যায় না কি?
খাদের কিনারে
বাবুঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট, শোভাবাজার, বাগবাজার…কলকাতার যে-কোনও গঙ্গার ঘাটে দাঁড়ালেই হরবখত চোখে পড়ত দৃশ্যটা। পিঠে কুঁজমতো, সরু পাখনাওয়ালা কালোমতো কী একটা, ঘাই মেরেই গোৎ খেয়ে ফের ডুবে গেল জলে। ফেরি স্টিমারের নিত্যযাত্রীরা প্রায়ই দেখতে পেতেন খুব কাছ থেকে। অনেকদিন হল প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে কলকাতায় গঙ্গার বুক থেকে। শুশুক। সাধু বাংলায় শিশুমার। ইংরেজি নাম পরপয়েজ বা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন, সামুদ্রিক ডলফিনের মিঠেজলতুতো জ্ঞাতিভাই। ‘প্রায় অবলুপ্ত’ বাক্যটা ব্যবহার করলাম অত্যন্ত সচেতনভাবেই। কারণ প্রখ্যাত প্রাণী বিশেষজ্ঞ শ্রীঅজয় হোম মহাশয় উনিশশো চুরাশি সালে তাঁর প্রকাশিত বই ‘বিচিত্র জীবজন্তু’-তে শুশুক সম্পর্কে লিখেছিলেন— ‘এককালে কোলকাতার হুগলী নদীতেও দেখা যেতো, এখন আর চোখে পড়ে না গঙ্গার জল অতিরিক্ত দূষিত হবার ফলে’। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাই কথাটা বহুলাংশে সঠিক হলেও সর্বাংশে নয়। দু হাজার চোদ্দো সাল, হাওড়া থেকে ফেরিলঞ্চে ফিরছি বাবুঘাটে। প্রায় মাঝগঙ্গায় এসে পড়েছে নৌকা। দাঁড়িয়ে রয়েছি ডেকের ধারে। হঠাৎই মাত্র হাত বিশেক দূরে জলে আলোড়ন তুলে ডিগবাজি খেয়ে ডুবে গেল একটা শুশুক! চোখের পলক ফেলার আগেই ঘটে গেল পুরো ঘটনাটা। দক্ষ পেশাদার ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নই। তাই লেন্সবন্দি করে রাখতে পারিনি দৃশ্যটা। তবে প্রচণ্ড উল্লসিত হয়েছিলাম মনে মনে। এটা ভেবে যে যাক! এখনও তা হলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তবে সেই উল্লাস মিলিয়ে যেতেও লাগেনি বেশিক্ষণ। কারণ ওই যে একটু আগেই লিখেছিলাম—‘কথাটা বহুলাংশে সঠিক।’ আগে আধঘণ্টা গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালেই অন্তত দু’-তিনবার শুশুকের দেখা পাওয়া যেত। আর এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকী পুরো একটা দিন অপেক্ষা করলেও অনেকসময় দেখা মেলে না। কলকারখানার বর্জ্য, মানুষের ফেলা আবর্জনা, থার্মাল পাওয়ার স্টেশনগুলোর টারবাইন জেনারেটর থেকে উৎপন্ন হওয়া উষ্ণ জল….এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল গঙ্গাদূষণ অবলুপ্তির কিনারায় ঠেলে দিয়েছে বিশ্ব বন্যপ্রাণ সংস্থা থেকে ‘মোস্ট এনডেজারড স্পেসিস’-এর তকমা পাওয়া সম্পূর্ণভাবে মত্স্যভোজী নিরীহ এই প্রাণীটিকে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা কিছু ভাবছেন কি?
ওই যে আকাশের গায়…
…দূরের বলাকা ভেসে যায়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কালজয়ী গান। বলাকা মানে যে বক সে কথা তো সবাই জানেন। সন্ধের আকাশে আজও দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেতে। কত কবিতা আর গানের উপজীব্য হয়ে চিরকাল বেঁচে রয়েছে এই পাখিটি আর তাদের উড়ে বা ভেসে যাওয়া। যাকে নিয়ে এত কবির কল্পনা, এত গান বাঁধা তাকে আপনারা অনেকেই দেখেছেন মাটিতে চরে বেড়াতে। গো-বক বা গাই বগলা, ইংরেজিতে ক্যাটেল ইগ্রেট। দুধবরণ পালকের রং আর লম্বা হলুদ ঠোঁট। আকারে মুরগির সমান। শহরের বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, যার মধ্যে অন্যতম কলকাতা ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম আর টলি ক্লাবের গল্ফ কোর্সে একা, জোড়ায় জোড়ায় অথবা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় খুঁটে খায়। লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘুরে বেড়ায় গরুমোষের পিছু পিছু। উদ্দেশ্য সেই একই। গবাদি পশুর ক্ষুরের চাপে উঠে আসা মাটি থেকে কেঁচো, ছোটখাটো কীটপতঙ্গ ধরে খাওয়া। আগে গরুমোষের খাটাল-সংলগ্ন কাদাজমিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত প্রচুর পরিমাণে। ইদানীং কলকাতা থেকে খাটাল উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমতে শুরু করেছে শহর থেকে। পরবর্তীতে দেখেছি ময়দানে ঘোড়ার পিছুপিছু ঘুরে বেড়াতে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে খুব দ্রুত পালটে নিয়েছে নিজেকে। সারাদিন খুঁটে খেয়ে উড়ে যাওয়া সন্ধের মুখে কোনও বড় জলাশয় (মূলত রবীন্দ্র সরোবর) বা ময়দানের কোনও ঝাঁকড়া গাছে যেখানে কাক বা অন্য শিকারি পাখির উত্পাত তুলনামূলকভাবে কম। এদেরই আরেক জাতভাই আকারে সামান্য ছোট তবে গো-বকের মতো পতঙ্গভোজী নয় মোটেই। ফিকে হলুদ বা বাদামি গায়ে লম্বা লম্বা ছিট। কোঁচ বক (পন্ড হেরন)। ধান পাখি নামেও ডাকা হয় গ্রামবাংলায়। পুকুরের ধারে ঘাড় গুঁজে বসে থাকে চুপটি করে। পাথরের মতো নিশ্চল। খুব ছোটখাটো মাছ নাগালের মধ্যে এলেই বিদ্যুত্গতিতে গেঁথে তোলে লম্বা সরু ঠোঁটের আগায়। মাছ ছাড়াও খাদ্যতালিকায় রয়েছে কেঁচো, ব্যাঙ ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় মাথা ও মূল শরীরের মধ্যে গলা নামক বস্তুটির কোনও অস্তিত্বই বোধহয় নেই। কিন্তু শিকার ধরা বা উড়ে যাওয়ার সময় বোঝা যায় ঈষৎ বাঁকা, অনেকটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো গলাটা বেশ লম্বা। এমনিতে সাদামাটা চেহারা। তবে প্রজননের সময় রূপ একেবারে ভুবনভোলানো। তখন পুরুষদের সারা পিঠ জুড়ে তামাটে লাল চুলের মতো লম্বা লম্বা পালক গজায় আর মাথা থেকে ঘাড় অবধি ঢেকে যায় দীর্ঘ দুধসাদা ঝুঁটিতে। আগে কলকাতা সহ শহরতলির সবকটা জলাশয়ে আকচার দেখা যেত। ইদানীং নগর সৌন্দর্যায়নের নামে পুকুর বাঁধানোর ধুম লেগে গেছে শহর ও শহরতলি জুড়ে। ফলে পাড়ে দাঁড়ানোর জমিটুকুও হারাচ্ছে কোঁচবক, শুধু কি ওরাই? সৌন্দর্যায়নের ঠেলায় পড়ে দ্রুত অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে শামুক, ঝিনুক, গেঁড়িগুগলি, কেঁচো, ব্যাঙ আর ঝাঁঝি পানা সহ একাধিক জলজ গাছগাছালি। পুকুরের ধারে মাটির পাড়কে ঘিরেই যাদের প্রজনন, বেড়ে ওঠা আর বিচরণক্ষেত্র। অন্যদিকে কংক্রিটে বাঁধানো পুকুর দ্রুততার সঙ্গে স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে পরিণত হচ্ছে দূষিত কালো জলের বদ্ধ জলাশয়ে। মরে ভেসে উঠছে মাছ। কদিন আগেই বাঘাযতীনে এরকমই একটা পুকুরের ধারে মরে ভেসে থাকতে দেখলাম কেজি তিনেক ওজনের গোটা দুয়েক কাতলাকে। পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কুকুর বেড়াল টানাহ্যাঁচড়া করছে। পল্লীবাসী নির্বিকার, নীরব প্রশাসন চুপ! সৌন্দর্যায়ন চলছে।
দিনকাল ভাল নয় নৈর্ঋৎ
‘জোড়া শালিখ দেখলে দিন ভাল যায়।’—এহেন প্রবাদ বাক্যটি শুনে আসছি সেই ছেলেবেলা থেকে। শালিখ অথবা শালিক। ইংরেজি নাম স্টারনিডি। উজ্জ্বল আর কালচে বাদামি গায়ের রং। হলুদ কালো চোখ। অসামান্য সুন্দর দেখতে এই পাখিটি। একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে অথবা জোড়ায় জোড়ায় নেচে বেড়াত শহর জুড়ে। বাসা বাঁধত গেরস্থবাড়ির ঘুলঘুলি অথবা কড়িকাঠে। শালিখ দেখলে কারও দিন ভাল যায় কিনা জানা নেই তবে শালিখের দিনকাল যে ইদানীং মোটেই ভাল যাচ্ছে না সেটা বোঝা যায় শহরে উপস্থিতির হার দেখলে। ‘ড্রপ আউট’ হতে প্রায় বেপাত্তা একেবারে। ঝাঁকে বা জোড়ায় তো দূরের কথা, কালেভদ্রে এক-আধটার দেখা পাওয়া গেলেও দিন ভাল গেল বলতে হবে। উধাও হবার কারণটাও প্রায় সেই একই। অবাধ, অসুস্থ এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ নগরায়ণ। এখনও মোটামুটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দেখা যায় কলকাতা ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম, ভিক্টোরিয়ার বাগান, টালিগঞ্জ গল্ফ কোর্স আর শহরতলি অঞ্চলে যেখানে এখনও কিছুটা সবুজ টিকে রয়েছে।
আয় রে পাখি লেজঝোলা…
বাংলাভাষার নার্সারি রাইমস। মা-ঠাকুমার অবাধ্য ছেলেপুলেকে ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়ানো বা ঘুম পাড়ানোর কলাকৌশল। সে সব পাট চুকেবুকে গেছে অনেকদিন। কবিতার সেই লেজঝোলা পাখিটা, ছিপছিপে চেহারা, কুচকুচে কালো গায়ের রং, ছটফটে আর প্রচণ্ড ঝগড়ুটে। শরীরের চেয়েও বড় চেরা লেজটা কাস্তের মতো দুদিকে বাঁকানো। আজ্ঞে হ্যাঁ, ফিঙের কথাই বলছি। সাহেবি নাম ব্ল্যাক ড্রংগো। আগে হাওড়া বা শেয়ালদা লাইনে লিলুয়া বা উলটোডাঙ্গা ছাড়ালেই দেখা যেত টেলিগ্রাফের তারে লম্বা লেজ ঝুলিয়ে কেতা নিয়ে বসে আছে। এখন নিদেনপক্ষে বৈদ্যবাটি বা ব্যারাকপুর না ছাড়ালে দেখা মেলে না। তবে ক’দিন আগে শহরেই দেখতে পেলাম কয়েকজনকে। সল্টলেক স্টেডিয়ামের চার নং গেটের উলটোদিকে। বসে আছে এ এম আর আই হসপিটালের সামনে ল্যাম্পপোস্টের তার আর গাছগুলোর ডালে। সন্ধের মুখে জ্বলে ওঠা ভেপার ল্যাম্পের আলোয় পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা এলাকা বাঁধা। একটু বেচাল, এক ইঞ্চি অনধিকার প্রবেশ… অমনি কর্কশ ‘ক্রি ই ই চ্’ শব্দে পালক ফুলিয়ে তেড়ে যাচ্ছে একে অন্যকে। দেখে ভাল লাগল—যাক! ঝগড়াঝাটি করেও এখনও তো টিকে আছে এ শহরে। এটাই কম প্রাপ্তি নাকি।
স্টেডিয়ামের ওপারেই বেলেঘাটা সুভাষ সরোবর। শীতের সময় গেলে দেখতে পাবেন জলাশয়ের মাঝখানে গোল দ্বীপের মতো জঙ্গুলে জমিটায় পানকৌড়ি আর বকেদের পাশে গাছের ডালে ভাঙা কাঠকুটো দিয়ে থালার আকারে বাসা বেঁধেছে শামুকখোল সারস (ওপেন বিলড স্টর্ক)। আকারে অন্যান্য প্রজাতির বড় সারসের সমান। ধূসর সাদা গায়ের রং। ডানার শেষপ্রান্তে কালো রঙের শেড। মাছ, ব্যাঙ, ঢোঁড়া সাপ, গেঁড়িগুগলি… অরুচি নেই কিছুতেই। প্রায় সর্বভুক বলা চলে। লম্বা মজবুত ঠোঁটে শামুকের খোলা ভেঙে খাওয়ার দক্ষতার জন্যেই বোধ হয় শামুকখোর বা শামুকখোল নামটির উৎপত্তি। আগে রবীন্দ্র সরোবরের দ্বীপটিতেও দেখতে পাওয়া যেত। ইদানীং আর দেখা মেলে না তেমন একটা। বর্তমানে সুভাষ সরোবর ছাড়া শহরে মুক্ত প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়ার একমাত্র ঠিকানা আলিপুর চিড়িয়াখানার ঝিল।
স্বর্গোদ্যান
গার্ডেনরিচে বি এন আর অধুনা সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ের সদর দপ্তর। অফিসের চারপাশ ঘিরে বিশাল খোলা মাঠ আর বাগান। অফিস চত্বরের পিছনেই বহমান গঙ্গা। পাড় ভর্তি গাছগাছালি। এককথায় সবুজের সমারোহ। আমার নিজের ভাষায় স্বর্গোদ্যান। প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণকে এত কাছাকাছি আর এত ভালভাবে দেখার জায়গা এই শহরে আর কোথাও নেই। অন্তত এই অধম প্রতিবেদকের ধারণা তাই। কত রকমের পাখি যে দেখেছি এখানে। টুনটুনি, বক, পানকৌড়ি, টিয়া, ছাতারে, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, কোকিল… এসব তো আছেই, এ ছাড়াও এমন দুটি পাখি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এখানে যা মুক্ত প্রকৃতিতে আর কোথাও দেখতে পাইনি, অন্তত এই শহরবৃত্তে। ময়দান, লেক, চিড়িয়াখানা, ফোর্ট উইলিয়াম আর টলিগঞ্জ গল্ফ ক্লাবের কথা মাথায় রেখেই একথা বলছি। এবার প্রথম পাখিটিকে দর্শনের অভিজ্ঞতা বলি। হাসপাতালের পিছনে গঙ্গার পাড় ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা পাখি। আকারে দাঁড়কাকের চেয়েও বড়। লেজটা শরীরের চেয়েও লম্বা। পালিশ কালো গায়ের রং। উজ্জ্বল বাদামি ডানাজোড়া, ঘুরে ঘুরে কী সব খুঁটে খাচ্ছে গাছের ছায়ায়। আমাকে দেখেও তেমন একটা ভয় পেল বলে মনে হল না। খুব কাছে এগিয়ে যেতে ‘কুব্’ জাতীয় একটা শব্দ করে উড়ে গিয়ে বসল গাছের ডালে। বাড়িতে ফিরে বইপত্তর ঘেঁটে পাখিটার নাম জেনেছিলাম। কুকো। কুকা বা কুবোপাখি নামেও ডাকা হয় বাংলার অনেক অঞ্চলে।
দ্বিতীয় পাখিটিকেও দেখেছিলাম মাটিতেই তবে গাছের ছায়ায় নয়। খোলা ঘাসজমিতে। রেল হাসপাতাল লাগোয়া ফুটবল গ্রাউন্ডের ঘাসজমিতে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খুঁজছে একমনে। প্রথমে মনে হয়েছিল কাঠঠোকরা বুঝি। একটু বাদেই ভুল ভাঙল। কাঠঠোকরারা এতক্ষণ জমিতে থাকে না। চেহারাটা চোখে পড়ার মতো। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল খয়েরি। কাঠঠোকরার চেয়েও সরু ছুঁচলো ঠোঁট। ডানার ওপর ত্রিভুজাকৃতি সাদা-কালো নকশা। লম্বা বাঁকানো ঝুঁটির ওপর গোটা পাঁচেক কালো ফুটকি। এককথায় অপূর্ব। আকারে কাঠঠোকরার চেয়ে সামান্য বড় আর স্বভাবে বেশ ভিতু। কাছাকাছি কেউ নজর রাখছে টের পেতেই উড়ে গেল ফুড়ুৎ করে। এর পরিচয় জানতেও শরণাপন্ন হতে হয়েছিল ড. সালিম আলির ‘কমন বার্ডস’-এর। মোহনচূড়া। ইংরেজিতে উপুপা।এখনও বহুল পরিমাণে দেখা যায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবন ঘেঁষা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়।
উপরোক্ত দুটি পাখিকেই পরবর্তীতে গ্রামের দিকে বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ ঘটলেও শহরবৃত্তে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ওই একবারই। সেই বি এন আর-এর বাগানে। এখানেই দেখেছি ধূসর ছিট ছিট আর পাকা পাতিলেবু রঙা ডানাওয়ালা দু’ধরনের প্রজাপতি। পুজোর আগে থেকে শুরু করে পুরো শীতকালটা জুড়ে উড়ে বেড়াত গোটা কলকাতায়। বহুদিন হল ‘নিরুদ্দেশ’ শহর থেকে। ‘হারানো-প্রাপ্তি’-টা ঘটতে পারে একমাত্র এই বি এন আর-এর বাগানে এলে।
বন্যপ্রাণ নিয়ে টুকটাক শহুরে অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার সাক্ষীও এই বাগান। একটা মাদি হনুমান। কোত্থেকে যেন পোয়াতি অবস্থায় এসে ডেরা গেড়েছিল এই রেলের বাগানে। কিছুদিন বাদে একটা মৃত বাচ্চা প্রসব করে। বেশ কয়েকদিন বসে ছিল মরা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের সামনে। এরপর হঠাৎই একদিন উধাও বাগান থেকে। দু’-চারদিন বাদে ফিরে এসেছিল খালি হাতে। ফাঁকা হয়ে যাওয়া কোলে তুলে নিয়েছিল মা-মরা দুটো কুকুরছানাকে। সারাদিন কত না যত্নআত্তি। সরু লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে পোকা বেছে দেওয়া, পেশেন্টপার্টিদের ছুড়ে দেওয়া ভাঙা বিস্কুট, কেক-পাউরুটির টুকরো, আগে ছানাদের মুখে দিয়ে তারপর দু-চার টুকরো দাঁতে কাটত। কিন্তু সমস্যা একটাই। সামান্য বিপদের আঁচ পেলেই ছানা কোলে সোজা মগডালে। অনভ্যস্ত পরিবেশে ছানাদের প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ, কুঁইকুঁই, কেঁউকেঁউ… অমনি লম্বা লম্বা হাতে ঠাস ঠাস চড় গালে বা পিঠে। এই অসম, বিধর্মী অপত্য স্নেহের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল দেখার জন্য ফিরে যাওয়া হয়নি রেলের বাগানে।
ফিরবে না আর কোনওদিন
‘ওরে ভোঁদড় ফিরে চা/খোকার নাচন দেখে যা।’ বাংলার আরেক ছেলেভোলানো ছড়া। খোকার নাচন দেখে ভোঁদড় আদৌ ফিরে চায় কি না জানা নেই, তবে ভোঁদড় ত্রিসীমানায় রয়েছে জানতে পারলে লালবাড়ির বুড়ি জেঠিমা যে ধেই ধেই করে নাচতেন সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি বহুবার। বেহালা সরশুনায় মামাবাড়ির পাশে লালবাড়ি। বনেদি এদেশীয় পরিবার। বিশাল পুরনো বাড়িটা লাল ইটের বলেই এলাকায় পরিচিত ছিল লালবাড়ি নামে। বাড়ির গায়েই ঘাটবাঁধানো পুকুর। দুপুরবেলা শুয়ে আছি। হঠাৎই ‘ঝপ্পাৎ’ শব্দ পুকুরের জলে। সঙ্গে সঙ্গে লালবাড়ির বড় বউ, বুড়ি জেঠিমার তীব্র চিলচিৎকার—“ওরে বিজে! পুকুরে উদ পড়েচে! শিগ্গির শিগ্গির যা…” শোনামাত্র বিজয়দা, বুড়ি জেঠিমার বড় ছেলে। শক্তসমর্থ চেহারা। খালি গা। মালকোঁচা মারা গামছা। নাকের নীচে ক্লার্ক গেবলের মতো সরু গোঁফ… তেড়ে ছুটে যেতেন পুকুরপাড়ে। হাতের মুঠোয় ধরা একটা খেটো বাঁশের লাঠি। দমাদম পিটতে শুরু করতেন পুকুরের জলে আর আশপাশের ঝোপঝাড়ে। সঙ্গে প্রবল হেঁড়ে গলার গর্জন—“অ্যাই শালা উদের বাচ্চা!…” বাকিটা অশ্রাব্য। আমরাও গোলমাল শুনে ছুটে যেতাম পুকুরপাড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা প্রাণী। না কুকুর, না বেড়াল, না শেয়াল… সাইজে হাত দেড়েক। লম্বাটে গোলপানা কালো তেল পিছলোনো চেহারা। চ্যাপটা মোটা লেজ। হাঁসের পায়ের মতো চ্যাপটা বেঁটে বেঁটে পা। থ্যাবড়া মুখ। নাকের দু’ধারে খাড়া খাড়া ঝাঁটা গোঁফ। মুখে কামড়ে ধরা একটা ল্যাটা, চারাপোনা বা এদেশে সদ্য উপনিবেশ স্থাপনকারী ত্যালপিয়া। বিদ্যুত্গতিতে জল ছেড়ে উঠে মিলিয়ে যেত ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে। আসলে ওটা ভোঁদড় (কমন ইন্ডিয়ান অটার)। উদ, উদবিড়াল, বা উদবিলাই নামে পরিচিত সারা বাংলা জুড়ে। ‘পানি কা কুত্তা’ নামেও ডাকা হয় হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলোয়।
আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগেকার কথা। লালবাড়ির সেই বড় পুকুরটা মজে এখন এতটুকু একটা ডোবা। আর ভোঁদড়? লালবাড়ির পুকুর তো বটেই, ক্রমাগত পিছু হঠতে হঠতে মিলিয়েই গেছে গোটা গ্রাম বাংলা থেকে। চলে গেছে বিশ্ব বন্যপ্রাণ সংস্থার ‘চরম বিপদাপন্ন প্রজাতি’-র তালিকায়। সুন্দরবন আর ডুয়ার্সের জঙ্গলঘেরা নদীগুলোয় এখনও নাকি দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সেও শুনেছি কালেভদ্রে। এখন দেখতে পাওয়ার একমাত্র ঠিকানা আলিপুর চিড়িয়াখানা। সিমেন্ট বাঁধানো জলাধার। নোংরা জল। জলে পড়ে থাকা দু’-চারটে পচাফাটা মাছ। একধারে উঁচু বেদিমতন জায়গাটায় চুপ করে বসে রয়েছে বিষণ্ণ বিমর্ষ মুখে। নিঃসঙ্গ একা! যদি মনের কোনও অবচেতন কোণে এখনও এতটুকু প্রকৃতিপ্রেম অবশিষ্ট থাকে, যদি একটিবারের জন্যও মনে হয় যে এই পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়, অন্যদেরও সেখানে বাস করার অধিকার আছে, তা হলে এই বিমর্ষ একাকীত্ব, ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা আপনাকেও ছুঁয়ে যাবে, যাবেই। যেতে বাধ্য।
ডাইনোসরের নাতিপুতি…
গড়িয়াহাট থেকে রুবিমোড়ের দিকে যাবার যে রাস্তাটায় এখন সারি সারি হাইরাইজ, ফ্ল্যাট, মল আর রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি, আজ থেকে বছর পঁয়তিরিশ—ছত্রিশ আগেও জায়গাটা ছিল ধানিজমি আর অজ পাড়াগাঁ। মনে আছে আটাত্তর সালে ভয়াবহ বন্যার কিছুদিন পরে বন্ধু বাপ্পার সাইকেলের কেরিয়ারে সওয়ার হয়ে ঘুরতে গেছিলাম ওদিকটায়। এখন যেখানটায় গীতাঞ্জলি স্টেডিয়াম, চারপাশ তখনও জলে থই থই, হঠাৎই চোখে পড়ল ধানখেতের পাশে আলের ধারে মাটিতে কী একটা শুয়ে রয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল মরা গাছের ডাল বুঝি। একটু এগোতেই ভুল ভাঙল। কালো খড়খড়ে গা। ধারালো নখওয়ালা চার পা। বিশাল লম্বা লেজ। দৈর্ঘ্যে নিদেনপক্ষে ফুট পাঁচেক। কুমির না কি? তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় চমকে উঠে (আসলে ভয় পেয়ে) ধড়মড় করে দৌড়ে পিছিয়ে এসেছিলাম বেশ খানিকটা। আমাদের পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে আল ছেড়ে খেতের জলে লাফ দিল প্রাণীটা। তিরবেগে সাঁতার কেটে মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বেশ খানিকটা আতঙ্ক আর কলকাতার বুকে কুমির আবিষ্কারের উত্তেজনায় দুই বন্ধু যখন থরথর করে কাঁপছি তখন সাইকেল আরোহী এক বৃদ্ধ চাচা, থুতনিতে একটুখানি সাদা দাড়ি, মালকোঁচা মেরে পড়া লুঙ্গি, এগিয়ে এলেন সামনে। আমাদের আতঙ্কের কারণটা শুনে তো হেসেই কুটিপাটি— “আরে ধুৎ খোকাবাবু… কুমুর (কুমির) টুমুর কিছু নয় কো। ও ব্যাটা গোঁয়ারগেল। সাপ, মাছ ধরে খায়।” প্যাডেলে চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন চাচা, চলে যাওয়া মাত্র আমার হাত চেপে ধরল বাপ্পা। —“খবরদার ওসব গোঁয়ারগেল-ফেল নয়। পাড়ায় ফিরে বলতে হবে কুমিরই দেখেছি, বুঝেছিস?”
সে যাই হোক গোঁয়ারগেল নিয়ে আগ্রহটা কিন্তু থেকেই গেল। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার দেখেছি ওই বাইপাস এলাকাতেই, চিড়িয়াখানায় সাপের ঘরে কাচাধারে আর দীপক মিত্রের বাদুর সর্পোদ্যানে। তাঁর কাছেই প্রথম জেনেছিলাম প্রাণীটার নাম। ওয়াটার মনিটর লিজার্ড। সাদা বাংলায় গোসাপ। গোঁয়ারগেল, গুঁইসাপ বা গুইসাপ নামেও পরিচিত। মূলত জলচর সরীসৃপ তবে ডাঙাতেও সমান দ্রুতগামী। দক্ষ মাছশিকারি, প্রয়োজনে বড় বড় সাপ মেরে খেতেও দ্বিধা করে না। এমনিতে নিরীহ কিন্তু বিপদে পড়লে আক্রমণ করতে পিছপা হয় না এতটুকু। মজবুত, ধারালো লেজ আর করাতের মতো দাঁত— এই দুয়ের আঘাতই মারাত্মক। সময়মতো চিকিত্সা না করলে বিষাক্ত সংক্রমণ হতে পারে। বহুদিন হল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। বছরখানেক আগে দেখেছিলাম বারুইপুর স্টেশনের গায়ে লম্বা পুকুরটায়। একটা নয়, দুটো। বিশাল লম্বা লেজটা নাড়িয়ে প্রপেলারের মতো জল কেটে কেটে সাঁতার কাটছে জোড় বেঁধে। রাজকীয় ভঙ্গিমায়। তবে বারুইপুরও তো এখন প্রায় কলকাতা। চারদিকে ধড়াদ্ধড় গজিয়ে ওঠা ফেলাটবাড়ি, দোকানপাট… হয়তো যে-কোনও দিন ঢুকে পড়বে কলকাতার পিনকোডে। তখন এসব পুকুরটুকুর থাকবে তো? কোথায় সাঁতার কাটবে এইসব ডাইনোসোরাসের নাতিপুতিরা?
মিনিমাগনার মুদ্দোফরাশ
‘একদম হাড়গিলের মতো দেখতে।’ কোনও শীর্ণকায় কাঠখোট্টা চেহারার কারও উদ্দেশে আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি উপমাটা। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই জানি না কার সঙ্গে তুলনা করে এই উপমাটা দেওয়া হয়। হাড়গিলে। অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক। মদনটাক নামেও ডাকা হয় গ্রাম বাংলায়। সারস প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আকারে বৃহত্তম গোষ্ঠীদের অন্যতম। কদাকার দর্শন আক্ষরিক অর্থেই। ধূসর সাদা গায়ের রং। মাথা থেকে নিয়ে গলার শেষপ্রান্ত অবধি পালকের লেশমাত্র নেই। গলার নীচে বিশাল গলকম্বল। মৃত পশুর শবদেহ ভক্ষণ করে সাফসুতরো রাখত পুরনো কলকাতাকে। বিশাল লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘুরে বেড়াত শহরময় আবর্জনার স্তূপে। এ ব্যাপারে এদের খ্যাতি এতই সুবিদিত ছিল যে তত্কালীন মিউনিসিপাল কর্পোরেশন তাদের লোগোয় এদের ছবি ব্যবহার করত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ সহ পুরনো কলকাতা-সংক্রান্ত একাধিক বইয়ে পাখিটির উল্লেখ রয়েছে। শকুনের মতোই হাড়গিলেও অবলুপ্ত হয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। শকুনের অনেক আগেই। সেই বিশের দশকে। কলকাতার আরেক বিনে মাইনের মুদ্দোফরাশ।
নগর পুড়িলে কি…
বছর পঞ্চাশ আগে চিড়িয়াখানার চেহারাটা মনে আছে? শীতকালের দুপুর। চিড়িয়াখানার বিশাল ঝিল। এক ইঞ্চি জল দেখা যাচ্ছে না। পরিযায়ী পাখির ভিড়ে থিকথিক করছে জলাশয়। গ্রেটার হুইসলিং টিল, লেসার হুইসলিং টিল, স্পটবিল হাঁসের দল, মানস সরোবর, সাইবেরিয়া… হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে এসেছে শহরে। সুদূর শীতের রাজ্য থেকে। কিচমিচ কলরবে মুখরিত চারপাশ। শীত দুপুরের মিঠে রোদে গা ভাসিয়ে ম্যাগনোলিয়া আর জলি চ্যাপ আইসক্রিম খেতে খেতে ঝিলের ঝোলানো ব্যালকনিতে বসে বসে পাখি দেখা। ওফ! সে এক রূপকথা ছেলেবেলা। মোটামুটি আশির দশকের গোড়া থেকেই এই অলৌকিক দৃশ্যপটের পর্দায় চিড় ধরতে শুরু করে একটু একটু করে। আকাশ ফুঁড়ে ওঠা কুৎসিত দাম্ভিক বহুতল আর চোরাশিকারির লঙ্গর সুতোর বড়শি-ফাঁদে পড়ে ক্রমাগত পথ হারাতে থাকে পরিযায়ী পাখিরা। আর আজ? খাঁ খাঁ চিড়িয়াখানার পুকুর। ইতিউতি কয়েকটা গো-বক, পানকৌড়ি, কোঁচবক আর শামুকখোল… বিলুপ্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে চিড়িয়াখানার ঝিলে। কী বুঝছেন পাঠক? একবারও মনে হচ্ছে না আমি বা আপনি, আমরাই এর জন্য দায়ী? কারণ আমরা তো প্রতিবাদ করিনি কখনও। চিৎকার করে উঠিনি একটিবারের জন্যও— “যা হচ্ছে, অন্যায় হচ্ছে!” তার বদলে আরও, আরও বেশি করে লুকিয়ে পড়ছি সাড়ে সাতশো, হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, ই এম আইয়ে কেনা গাড়ি আর স্মার্টফোনের স্ক্রিনের আড়ালে। কিন্তু এভাবে কি বাঁচা যাবে? সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত মহীরুহ এক জ্ঞানবৃদ্ধ সেই কবে লিখেছিলেন— ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় বাঁচে?’ চিন্তা নেই, এরকম চলতে থাকলে আমরা বাঁচব না, গাছপালা, নদনদী, খালবিল-পুকুর, পাহাড় ঝরনা, কীটপতঙ্গ পশুপাখি… আমাদের অনেক, অনেক আগে থেকে পৃথিবী নামক এই অনন্য আর অসামান্য গ্রহটার বাসিন্দা ওরা। তাই ওরা না থাকলে আমরাও থাকব না— এই সহজ সরল সত্যটা উপলব্ধি করা দরকার সবার আগে। বুঝতে পারলে ভাল। আর না পারলে?—‘শেষের সে দিন (কিন্তু সত্যিই) ভয়ংকর!’
০৮. কলিকাতা খাইবার পাস-১
পুজো তো এসে গেল। হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকদিন। মাসকয়েক আগে থেকেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে দণ্ডায়মান হোর্ডিং-ব্যানারে বড় বড় ক্লাবগুলোর থিম শোভিত জগজ্জননীর মুখ। এই ভ্যাপসা গরমেও ব্লেজার পরা সুদর্শনা ঘোষিকার মিষ্টি ঘোষণা, টিভিতে— আর মাত্র তেইশ দিন। মাঝে মাঝে জুম অথবা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ইনকমপ্লিট মা দুর্গা, ঘর্মাক্ত কুমোর, কুমোরটুলি। আপনি চান বা না চান উপরোক্ত সব ঘটনাক্রম বা দৃশ্যাবলি আপনার ঘাড়ের নড়া ধরে মনে করিয়ে দেবেই, ‘আজি মেগাপূজা জাগ্রত দ্বারে।’
আপনারা যারা বহুকাল যাবৎ ধরেই নিয়েছেন যে, ‘ওফ! ক্যালকাটা ইজ নট আ ওয়ার্থ লিভিং প্লেস ডিউরিং পূজা টাইম’। অথবা যারা সাধারণত এ সময়টায় এই পোড়া শহরেই থাকেন অথচ এবারই এই বিপুল ভিড়ভাট্টা-ক্যাঁওম্যাও থেকে কেটে পড়ার ধান্দা করছেন, তাদের তো প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে। অনলাইন বুকিং ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে ডুয়েল, ভ্রমণ-সংক্রান্ত যাবতীয় পত্রপত্রিকা চেটে ফেলা, কয়লাঘাটে দীর্ঘ লাইন, বুকিং অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, শেয়ালচোখো দালাল, হোটেল, রিসর্ট, হলিডে হোমের তত্ত্বতালাশ পুরী না লোলেগাঁও, আন্দামান না পাটায়া, মানালি থেকে অমৃতসর হয়ে ফেরার টিকিটটা কনফার্মড হবে কি হবে না— এই অজস্র শোয়েব আখতার মার্কা টেনশন-বাউন্সার সামলে আপনার নিট লাভ কিন্তু একটাই—জিরোতে প্যাভিলিয়ন অথবা দাদার লর্ডস মার্কা সেঞ্চুরি। অর্থাৎ টিকিট পাওয়ার তুরীয় আনন্দ নইলে অ্যালজোলাম হতাশা!
উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলি থেকে এই অধম লেখক কি এটা পাঠককুলকে বোঝাতে পারল যে, আপনি সপরিবারে আনন্দ ভ্রমণে যেতে পারুন বা নাই পারুন, প্রাক-উদ্বেগ বা পরবর্তী হতাশার ব্যাপারটাকে কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। ঠিক এইখানে গরিব সৎ ব্রাহ্মণের সুপরামর্শ যদি নেন তা হলে একখান কথা বলি। না, না, আগেই ঠ্যাঙাতে উঠবেন না। অধমের কথাটা মন দিয়ে শুনুন। একটু অন্য ধরনের ভ্রমণ-কথা। খোদ কলকাতাতেই। এই ভ্রমণের একমাত্র শর্তই হল, পাঠক অথবা পরিযায়ীকে হতে হবে ভোজনরসিক (পেটুক নয়)। দ্বিতীয় একটি শর্তও অবশ্য আছে তবে সেটি ততটা কঠোর নয়। এই পরিব্রাজন পদব্রজে হলেই ভাল হয়। কারণ, এতে পরিপাক যন্ত্রটি সক্রিয় থাকবে। একান্তই অপারগ হলে গাড়িই ভরসা। আর খরচ! রোটাং পাস বা জয়সলমির তো দূরের কথা, দীঘা বা বকখালির চারভাগের একভাগে এঁটে যাবে। প্রতিবেদকের গ্যারান্টি!
অতএব হে মহামহিম পরিব্রাজকগণ— সপ্তমীর পুণ্যলগ্নেই শুরু হোক আপনাদের এই ভোজন পরিযায়। ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে হাতের বাঁদিকে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের গায়ে, নিরঞ্জন আগার। কাঠের টেবিল চেয়ার। কোণের দিকে আরেকটি ছোট টেবিলে ক্যাশবাক্স সমেত খোদ মালিক। পাশে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে প্রায় পুরো রসুইঘরটাই দেখা যায়। কোনও রাখঢাক নেই। এদের সব পদই এক কথায় যাকে বলে মহাভারতের কথার মতো ‘অমৃতসমান’। তবে সেরার সেরা ভেজিটেবল চপ। হাতবোমার সাইজ। চামচে দিয়ে কেটে কাসুন্দি লাগিয়ে মুখে পুরলে মনে হবে এতদিন বিস্কুটের গুঁড়ো মাখানো আর ভিতরে লাল বিট-আলুর ঘ্যাঁটকে উপরোক্ত জিনিসটি ভেবে খেয়েছি বলে নিজের গালেই টেনে টেনে থাপ্পড় মারা দরকার। স্বাদগুণের বিশদ বিবরণে গেলাম না। স্ব-জিহ্বায় পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
নিরঞ্জন আগারকে আলবিদা জানিয়ে এগিয়ে চলুন উত্তরমুখী। সোনাগাছিকে পাশ কাটিয়ে এসে পড়বেন যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ আর গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে। মিত্র কাফে। ইতিহাস এখানে ফ্রিজড্ হয়ে গিয়েছে। একসঙ্গে বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ জন বসতে পারে। খেতেই হবে এদের বিখ্যাত ব্রেইন চপ আর পুডিং। কয়েকশো মিটার দূরে উলটো ফুটে আরেক কিংবদন্তি—অ্যালেন রেস্তোরাঁ এবং এদের চিংড়ির কাটলেট। ভিতরে চিংড়ির ফিলে আর মোলায়েম ক্রিম-ব্যাটারে মাখামাখি। খাঁটি ঘিয়ের অ্যারোমা। দেখলে ছ’মাসের খিদে একদিনে পেয়ে যাবে।
অ্যালেন-মিত্র কাফের মায়া কাটিয়ে এবার ঢুকে পড়ুন শ্যামবাজার এভি স্কুলের পাশ ঘেঁষে শ্যামপুকুর স্ট্রিটের গলিতে। ‘চিত্তরঞ্জন’ কোথায়, যদি রাস্তার নেড়ি কুকুরটাকেও জিজ্ঞেস করেন দেখিয়ে দেবে। মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, উত্তম না সৌমিত্রর মতো উত্তর কলকাতাতেও বিতর্ক রয়েছে— চিত্তরঞ্জন না কেসি দাশ, কে নবীনচন্দ্রের আসল এবং সার্থক উত্তরসূরি। চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা খেতে কেমন? দূর! আর এক কথা বারবার ঘ্যান ঘ্যান করতে ইচ্ছে করছে না।
গলি থেকে উত্তরমুখী হয়ে বেরিয়ে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ ধরে সোজা চলে আসুন শ্যামবাজার মোড়। নেতাজির ঘোড়ার ল্যাজ ঘেঁষে ল্যান্ড করুন বাগবাজার মোড়। হাতের বাঁদিকে অধুনা কলকাতায় প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া গাড়িবারান্দার নীচে দ্বারিক ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স। এই দো-আঁশলা ‘ফিট হায় বস’ ‘বিন্দাস’ ‘ঝক্কাস’ সময়ে বাঙালি তো কতই রাম-লক্ষ্মণের লাড্ডু খেল। বলি, দরবেশ খেয়েছেন কখনও? আজকের প্রজন্মের অধিকাংশই এই মহার্ঘ বস্তুটির নামই জানে না, চেখে দেখা তো দূরস্থান। হলুদ সোনালি বোঁদের গোল্লার উপর ছড়ানো খোওয়া ক্ষীরের গুঁড়ো। হ্যাঁ মহাশয়— ইহাকেই, এই রঙিন সুন্দরীকেই দরবেশ বলিয়া ডাকা হয়। এরপরই রয়েছে কেসি দাশ। চিত্তরঞ্জনেই তো একবার রসগোল্লায় মজেছেন। আমি বলি কী, এখানে আপনার ফোকাস হোক রসমালাই। ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু-বাস্তব কথাটা তো অনেক ক্ষেত্রেই শুনেছেন। শিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে। এবার রসনায় উপলব্ধি করুন। এরই ফাঁকে বাগবাজারের মোড়ের প্রবাদ হয়ে ওঠা তেলেভাজার দোকানগুলোয় মোচার চপ আর ছান্তাবড়ার সন্ধানে একবর অন্তত ঢুঁ মারতে ভুলবেন না।
এবার যে একটু পিছিয়ে আসার পালা। ফিরে আসুন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে। যেমনভাবে ছাঙ্গু আর বাবামন্দির ঘুরে আবার ফিরে আসেন গ্যাংটক। পাঁচমাথার মোড় আর গোলবাড়ির কষা মাংস সমার্থক। একটু কালচে রঙের ঘন গ্রেভি। পরোটা সহযোগে, কুচোনো পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে এককথায় স্বর্গাদপী গরিয়সী!
উলটো ফুটেই হরিদাস মোদকের শতাব্দী প্রাচীন লুচি, কচুরির কুইজিন। খাবার ব্যবস্থা আছে কলাপাতায়। এখনও। সঙ্গে আলু, কুমড়োর ছক্কা বা ছোলার ডাল। অত্যুত্তম বললে কম বলা হয়। লুচি হোক বা কচুরি কোনটা কখন ভাজবে তার কোনও ঠিক নেই কিন্তু যেটাই ভাজবে সেটাই এক্সেলেন্সের চরম সীমা অতিক্রম করবে একথা বুক বাজিয়ে বলা যায়।
অতঃপর পরিযায়ীগণ, আমাদের যাত্রার পরবর্তী পর্যায় শুরু হোক বিধান সরণি ধরে গোলবাড়ির পাশ ঘেঁষে কলেজ স্ট্রিট অভিমুখে। পথিমধ্যে যে আরও মণি থুড়ি খাদ্যমাণিক্যের ভাণ্ডার সামনে পড়বে সে কথা বোধহয় এতক্ষণ বাদে আর না বললেও চলবে।
বিধান সরণি ধরে একটু এগোলেই বাঁদিকে ফড়িয়াপুকুর লেন। মিটার বিশেক ভিতরে ঢুকেই হাতের ডানদিকে সেন মহাশয়। এদের অলৌকিক সৃষ্টি কাঁঠাল সন্দেশ। কোনও কৃত্রিম গন্ধ নয়, আসল খাজা কাঁঠালের রস থেকেই তৈরি হয় ওই দেবভোগ্য মিষ্টি। ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ বড়জোর আষাঢ়ের মাঝামাঝি অবধি পাওয়া যায়। পুজোর সময় পাওয়া না গেলেও হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। বিকল্প হিসেবে রয়েছেন ক্ষীরের চপ, গোলাপ সন্দেশগণ। রূপে, স্বাদে, গন্ধে এরাও কিছু কম যান না।
এবার যাত্রাপথ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ, যা থামবে গিয়ে বিডন স্ট্রিট সিমলে অঞ্চলে একেবারে হেদুয়ার সামনে। বেথুন স্কুলের গায়ে চার্চটির পাশের গলি ধরে মিনিট খানেক এগিয়ে গেলেই হাতের বাঁদিকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, আমাজন বা হিমালয়ের মতোই নকুড়চন্দ্র নন্দী। বর্তমানে হিলারি ক্লিন্টনের জন্য মিষ্টি পাঠানো বা ক্যাডবেরির সঙ্গে জোট বেঁধে ফিউশন জাতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা এই দোকানকে খবরের শিরোনামে নিয়ে এলেও আমি সাজেস্ট করব একবার ট্রাই করে দেখুন এদের ‘পারিজাত’ অথবা ছানার মুড়কি। মুখে মাথায় ঘোর লেগে যাবে।
গলি থেকে বেরিয়ে এসে ট্রামলাইন ধরে এগিয়ে বিবেকানন্দ রোডের মোড় আর চাচার হোটেল, সংক্ষেপে চাচা’স। বহু লোভনীয় সব আইটেম এদের মেনু কার্ডে। ‘অল টাইম প্রিমিয়াম’ কিন্তু ফাউল কাটলেট, যার ভক্ত ছিলেন বিবেকানন্দ থেকে উত্তমকুমার হয়ে শিব্রাম চক্রবর্তী। বর্তমানেও এই ভক্তসংখ্যা বেড়েই চলেছে বই কমেনি। তথাকথিত বিশ্বায়নের বাজারেও এরা প্রতিদিন রাত ন’টায় দোকান বন্ধ করেন নিয়ম করে। হিংস্র বাজারি প্রতিযোগিতার আঁচ এদের স্পর্শ করতে পারেনি।
পাঠককুল, এতক্ষণে আমরা এই ‘নাতিদীর্ঘ’ খাদ্যসরণির প্রায় মাঝপথে। এযাবৎ যা কিছু পেটে পড়েছে তার প্রায় সবটাই সলিড। এবার একটু জলবিহারে যাওয়া যাক। নোঙর ফেলা যাক কপিলাশ্রমের বন্দরে। নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। সত্যিই কোনও মা-বাবার আশ্রম নয়। শরবতের দোকান। বিধান সরণি-কৈলাস বোস স্ট্রিটের মোড়ে। দোকান না বলে উঁচুতে একচিলতে খুপরি জানালা বলাই ভাল। ভিতরটা প্রায়ান্ধকার। তার মধ্যে কোলকুঁজো হয়ে বসে অন্তত মাইনাস টেন পাওয়ারের চশমা পরিহিত একটি মানুষ সৃষ্টি করছেন আম, মালাই, আবার খাই নামের অসামান্য সব শরবত জাদু। অমৃত কখনও খাইনি। কিন্তু কপিলাশ্রমের শরবত খাওয়ার পর আধঘণ্টা মনে হতেই পারে চূড়ান্ত গরমেও সুইটজারল্যান্ড নিদেনপক্ষে লোনাভালা-খাণ্ডালায় পৌঁছে গিয়েছি। স্বাদ ও গন্ধের কথা তো বাদই দিলাম। খাওয়ার, থুড়ি পান করার ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে। গরমকালে যে-কোনও সময় কুড়ি-পঁচিশ জনের পিছনে লাইন দিতে হবে।
চরৈবতি, চরৈবতি গন্তব্যস্থল কলেজ স্ট্রিট মোড়। মোড়ের উপরই ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে দিলখুশা আর তাদের সৃষ্ট মটন কবিরাজি। এহেন ভয়ংকর সুস্বাদু এবং গুরুপাক খাবারের নাম কবিরাজি রাখা হয়েছিল কেন আমার জানা নেই (অমিতাভ মালাকার বা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে খোঁজ নিতে পারলে ভাল হত)। পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশক অবধি দাপিয়ে রাজত্ব করেছে দিলখুশা। বর্তমানে শোনা যায় আগের রমরমা আর নেই। তবু একবার ঢুকুন। অর্ডার করুন কবিরাজি, চিকেন অথবা মটন। যা হোক কিছু একটা। ইতিহাসকে তো ছুঁয়ে আসা যাবে। দিলখুশার পাশে বইপাড়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকে সোজা কফি হাউস। জানি না পুজোর সময় খোলা থাকে কি না। কারণ, ওই সময় কোনওদিন যাইনি। খোলা পেলে সোজা উঠে যান দোতলায়। একটু নিরিবিলি চাইলে তিনতলায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে হৈ হট্টগোল আর সিগারেটের ধোঁয়াকে উপেক্ষা করুন বুদ্ধের ঔদার্যে। সবাই কফি হাউসের ‘ইনফিউসন’ আর ‘পাকোড়া, পাকোড়া’ করে হেদিয়ে মরেন। পরিযায়ীরা অর্ডার করুন চিকেন ওমলেট। ওপরটা মাখনে ভাজা হালকা ক্রিসপি, ভিতরে তুলতুলে, মোলায়েম, সুপক্ক কুসুমের মধ্যে আত্মগোপনকারী চিকেনের টুকরো। ধ্যাবড়া বড়ও না আবার একদম ছোটও না। সঠিক মাপে কাটা। স্যস মাখিয়ে, গোলমরিচ ছিটিয়ে কাঁটার ডগায় গেঁথে মুখে তোলার পর উপেক্ষা নয় বুদ্ধের ঔদার্যে হৈ হট্টগোলকে ক্ষমা করে দেবেন। আরেকটা কথা। কফি নেবেন না। তেষ্টা বাঁচিয়ে রাখুন ‘প্যারামাউন্টের’ জন্য।
প্যারামাউন্ট। আরেক শরবত বিপণি এবং কলকাতার পানপিপাসুদের (মদ নয়) কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। এখানে অবশ্য খাওয়ার ব্যবস্থা বসে। শ্বেতপাথরের টেবিল। একেকটায় তিনজন-তিনজন করে ছ’জন বসতে পারেন। তাতেও গরমকালে লোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খায়। আর শরবতই বা কতরকম— গ্রিন ম্যাঙ্গো, লিচি, অরেঞ্জ, ডাব (উপরে শাঁস ভাসানো), গ্রেপস ‘কিন্তু সবার চাইতে সেরা’ (কৃতজ্ঞতা সুকুমার রায়)— কোকো মালাই! কাজি নজরুল থেকে শুরু করে বড়ে গোলাম আলি সবাই এর দিওয়ানা ছিলেন। ক্যাশ কাউন্টারের ঠিক পাশে একটা বাঁধানো ফ্রেমে প্যারামাউন্টের শরবত গুণগ্রাহী সেলিব্রিটিদের নামের একটা লিস্ট টাঙানো আছে। চোখ বোলালে কপালে উঠে যাবে। পুজোর মধ্যে যদি খেয়ে নেওয়ার সুযোগ পান তা হলে বলতেই হবে আপনি সবিশেষ ভাগ্যবান। কারণ, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কলকাতার বুকে স্বর্গসুধা সঞ্চারকারী এই বিপণিটি বন্ধ হয়ে যায় প্রায় চার মাসের জন্য। খুলতে খুলতে মার্চ। এখানে একটা কথা বলা জরুরি। প্যারামাউন্টের পানীয় তৈরির মূল উপকরণ ডাবের জল।
এবার আমরা বিচিত্র খাদ্য-সরণির প্রায় শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি আর চারটি ‘লেজেন্ডারি ফুড শপ’-এর কথা বলেই দাঁড়ি টানব। নবকৃষ্ণ গুঁই, ভীমনাগ, পুঁটিরাম আর কালিকা। শেষ থেকেই শুরু করি, প্যারামাউন্ট থেকে বেরিয়েই মির্জাপুর স্ট্রিটের উপর লম্বা একফালি দোকান। এককোণে বিশাল কড়াইয়ে ক্রমাগত ভাজা হয়ে চলেছে আলুর চপ, পেঁয়াজি, মোচার চপ, ধোঁকা, ডিমের ডেভিল, মাটন চপ মায় ফিশ ফ্রাই। তবে যে জিনিসটির জন্য এদের খ্যাতি কলকাতা থুড়ি জগত্জোড়া তা হল বেগুনি। প্রায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতের পাঞ্জার সাইজ! তেলালো শরীরে পোস্তর ছিটে। বিটনুন ছিটিয়ে একটা কামড় (অবশ্যই গরমটা সইয়ে নিয়ে)। ব্যস! স্বর্গের আগের স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। এরপর চলে আসি পুঁটিরামে। এদের সব প্রিপারেশনই অসামান্য তবে খাস্তা নিমকিটা একবার খেয়ে দেখা অবশ্য কর্তব্য। বাড়ির বাচ্চাদের প্র্যাকটিস করান। নামী কোম্পানির পোট্যাটো চিপ্স ফেলে খাবে। কেসি দাশের স্পঞ্জ রসগোল্লাকে অনেকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেন। আমি এগিয়ে রাখব পুঁটিরামকে। বউবাজারের ভীম নাগকে নিয়ে এত কথা লেখালেখি হয়েছে যে, এদের জলভরা বা অন্যান্য মিষ্টি নিয়ে কথা বাড়ানো বেকার। শুধু দু’টি তথ্য দিয়ে রাখি যে, এদের দোকানের মিষ্টি বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখুজ্জের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে রোজ ভবানীপুরের বাড়িতে ফেরার পথে চ্যাঙাড়ি ভর্তি মিষ্টি কিনে জুড়িগাড়িতে বসে খেতে খেতে যেতেন। ওঁর নামে তো ভীম নাগ কর্তৃপক্ষ একটা মিষ্টির নামই রেখেছিলেন ‘আশুভোগ’। দু’নম্বর তথ্য— এদেরই আবিষ্কার লেডিকেনি। বড়লাট পত্নী ‘লেডি ক্যানিং’-এর নামে, পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে পালটাতে পালটাতে অপভ্রংশ রূপ ধারণ করে লেডিকেনিতে পরিণত হয়েছে।
ভীমনাগের ঠিক পাশেই নবকৃষ্ণ গুঁই। তবে আদি দোকানটি উল্টোফুটে কয়েক পা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে হিদারাম ব্যানার্জি লেনে, গলির মধ্যে। নবকৃষ্ণের অতুলনীয় সৃষ্টি রাম বোঁদে। উপরটা শুকনো কুড়কুড়ে, ভিতরটা রসে টইটুম্বুর। একেকটার সাইজ মার্বেল গুলির মতো। একবার দাঁতে চাপলেই লাল-হলুদ ম্যাজিক। এর আরেকটি মহান সৃষ্টির কথা বলেই খাদ্যতীর্থ ভ্রমণ শেষ করব— ভিক্টোরিয়া সন্দেশ, সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে লোকমুখে কথিত যে, মহারানি ভিক্টোরিয়া যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন, তাঁর সম্মানে এই মিষ্টির নামকরণ হয়। খেতে কেমন এটা বর্ণনা করার মতো কলমের জোর অথবা ধৃষ্টতা, কোনওটাই আমার নেই। শুধুমাত্র এটুকু বলতে পারি আজ অবধি যত ধরনের মিষ্টি খেয়েছি তার মধ্যে সেরার সেরা এটি।
তা হলে, খাদ্য পরিযায়ী থুড়ি রসনা পরিযায়ীদের পরিব্রাজন তো শেষ হল। এবার পথপ্রদর্শক-ছড়িদার-গাইডের তরফ থেকে কিছু টিপস যা আপনার এই পরিযায়কে আরও সুপরিকল্পিত, আনন্দময় এবং সহনীয় করে তুলবে।
টিপসগুলি এই প্রকার
• কখনওই একদিনে পুরো রুটটা কভার করার চেষ্টা করবেন না। পেট-পা গোটা শরীর কোনওটাই ধকল নিতে পারবে না। তার চেয়ে বরং সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিনে গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টার একেকটা স্পেলে গোটা ট্যুরটাকে ভেঙে দিন।
• উত্তর না দক্ষিণ—আপনি কোনদিকে থাকেন তার উপর নির্ভর করবে রুট এবং টাইম প্ল্যান, কাকে অগ্রাধিকার দেবেন এই পর্বে।
• পুরো ট্যুরটাকে দিনে দিনে সেরে ফেলার চেষ্টা করুন। সেরা সময় দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা।
• কোনটার পরে কোনটা খাবেন রুট-প্ল্যানের উপর চোখ বুলিয়ে আগে থেকে ঠিক করে নিন।
• প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার অর্ডার দিয়ে ফেললে ঘাবড়াবেন না। অতিরিক্ত খাবার প্যাক করে দিতে বলুন অথবা সঙ্গে রাখুন ক্যাসারোল। রাতে বন্ধুদের আড্ডায়, সুরাসঙ্গমে—অতিথি আপ্যায়নে জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। শুধু মাইক্রোয় গরম করে নেওয়ার ওয়াস্তা। দুঃখের ব্যাপার, শরবতের ক্ষেত্রে এই ছকটা কাজ করবে না।
• প্রতিটি দলে অন্তত দশ-বারোজন খাদ্য পরিযায়ী থাকলে ভাল হয়। প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী ভাগ যোগ করে খাওয়া যাবে।
• পুজোর সময় বলেই বলছি। প্রতিটি দোকানেই ভিড় হবে। অপেক্ষা করতে হতে পারে। বিশেষত সন্ধের পর থেকে। তাই আবারও বলছি এই ভোজন ভ্রমণ শেষ করার চেষ্টা করুন দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধের আগে। অবশ্য এসব অমৃতভোগের আস্বাদ পেতে একটু-আধটু অপেক্ষা করা যেতেই পারে।
• রাতের আড্ডায় বন্ধুমহলে শেয়ার করুন ভোজন পরিযায়ের সুখস্মৃতি। দল ভারী হবেই। নেক্সট ডে অর নেক্সট পুজো।
• পুজোর আগেই কোনও ছুটিছাটার দিন একটা ট্রায়াল রান দিয়ে নিন না, পরিবার-বন্ধুবান্ধব মিলে। একটা প্র্যাকটিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স কাম প্ল্যান আগে থেকেই ছকা হয়ে থাকবে।
• মা বেনট্যাকেশ্বরী আর বাবা জেলুসিলনাথে অগাধ ভক্তি ও ভরসা রাখতে ভুলবেন না।
• বছরের অন্য সময়ও এই পরিযায় চলতেই পারে, বিশেষত বর্ষা থেকে গোটা শীত। কারণ বাঙালি তো শুধুই পুজোয় বেড়াতে যায় না। তবে শরবত সুধাপানের সেরা সময় কিন্তু গ্রীষ্মকাল।
• টিপসের সঙ্গে সঙ্গে গাইডের মজুরির ব্যাপারটা দয়া করে মাথায় রাখলে ভাল হয়।
এবার বলি, এই পরিযায়ের শেষে উপরি পাওনা বা ফাউ হিসেবে কী কী পাবেন। দেখে নিতে পারবেন বাগবাজার, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, চালতাবাগান (লোহাপট্টি), শোভাবাজার রাজবাড়ির অসাধারণ সব পুজো। দিনের বেলাতেই। কারণ নাম কামানোর জন্য এদের আলোকসজ্জা বা থিমের প্রয়োজন হয় না। আর একটু বেশি উত্সাহী হলে মেন রোড ছেড়ে ঢুকে পড়তে পারেন গলিঘুঁজিগুলোতে, যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দী এখনও থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবু সভ্যতার আমলের বিশালাকৃতি ভগ্নপ্রায় প্রাসাদে, বিলুপ্তপ্রায় গাড়িবারান্দা—পায়রার ব্যোম-রকের আড্ডায়। বেঁচে রয়েছে নোনাধরা ইটের দেয়ালে, গঙ্গার জল আর কুচো চিংড়ি বয়ে নিয়ে আসা চৌবাচ্চার কলে, ছোট ছোট অজস্র তেলেভাজা-ফুলুরি-মালপোয়া-গুঁজিয়ার দোকানে, সন্ধেবেলা শাঁখের আওয়াজ আর বেলফুলওয়ালার ডাকে। বানিয়া আগ্রাসন, মল, মাল্টিপ্লেক্স, স্কাইস্ক্র্যাপার, সুপার মার্কেট, হাইরাইজের যৌথ অভিযান এদের ঘাড়ে ক্রমাগত দাঁত বসালেও একেবারে নিকেশ করে ফেলতে পারেনি। এখনও। তাই দেখে নিন, চেখে নিন এইসব প্রায় ডাইনোসর হয়ে যাওয়া উৎকর্ষতাকে। এই পুজোতেই। সময় থাকতে থাকতে। পরে পরে করলে দেরি হয়ে যেতে পারে।
এই লেখা যখন শেষ হল তখনই খবর পেলাম বাগবাজারে কে সি দাশের দোকানটা উঠে গেছে। হৃদয়বিদারক সন্দেহ নেই। কী আর করা যাবে। ধর্মতলার মোড়ের দোকানটি থেকে শুরু হোক আপনাদের মুসাফির-খানা। দ্বিতীয় তথ্য: প্যারামাউন্ট আজকাল বারোমাসই খোলা থাকে।
০৯. কলিকাতা খাইবার পাস-২
‘কলিকাতা খাইবার পাস’—আমার এই প্রতিবেদনটি পড়ে পাঠকদের অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন—“এ তো আপনার ভয়ংকর একচোখোমি মশাই। গোটা লেখায় আপনি নর্থের খাবারকে প্রশংসায় প্রশংসায় একেবারে ভরিয়ে দিলেন অথচ সাউথের ধারপাশও মারালেন না। দক্ষিণ কলকাতা কি এতটাই এলেবেলে? নাকি সেখানে কোনও খাবারের দোকানই নেই। সেইসব পাঠকদের অভিযোগ কাম ভর্ৎসনার কথা মাথায় রেখেই ফের একবার কলম ধরা। তবে দক্ষিণে পা বাড়ানোর আগে আমাকে একবার ফিরতেই হবে উত্তরে। প্রায়শ্চিত্তের জন্য। প্রায়শ্চিত্তই বলব কারণ আগের প্রতিবেদনে উত্তরের কিংবদন্তী কয়েকটি খাদ্য বিপণির কথা উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। ফলত সেই প্রায়শ্চিত্তের টানেই উত্তরে ফেরা। হে দক্ষিণী পাঠকবৃন্দ, কুপিত হবেন না। একটা ছোট্ট ঢুঁ মেরেই ফিরে আসব। দেরি করব না মোটে। কথা দিচ্ছি।
লালবাজার থেকে চিৎপুর রোড অধুনা রবীন্দ্র সরণি ধরে উত্তরমুখো এগোলে নতুন বাজারে গায়ে লাগা দুটো মিষ্টির দোকান। নলিনচন্দ্র দাস আর মাখনলাল দাস। প্রথমে নলিনচন্দ্রকে দিয়েই শুরু করি। সারাজীবন তো নকুড়ের মনোহরার কথাই শুনে এসছেন। বলি নলিনের মনোহরা চেখে দেখেছেন কখনও? ওপরে চিনি অথবা নলেন গুড়ের ফুরফুরে পলকা বর্ম। হালকা কামড় বসালেই মুখের মধ্যে ভেঙে চৌচির। ভেতরে মিহি ঝুরঝুরে পেটাছানার পুর। এককথায় স্বর্গীয়! নকুড় না নলিন? পেলে না মারাদোনার মতো একটা চিরন্তন তর্কে পড়ে যাবেন নিজের মধ্যেই। তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নলিনের একমাত্র পরিচয় তার মিষ্টি। বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া এই গ্লোবালাইজড সময়েও নিজেদের জন্য একটি লাইনও খরচ করবার প্রয়োজন নেই শতক পেরোনো এই প্রতিষ্ঠানটির।
নলিনের পাশেই মাখনলাল দাস। আরেক মিষ্টান্ন মহীরুহ। সুইট উইজার্ড! পুরনো ঘরানার কাঠের শোকেস। কাঠের আঁচের উনুনে বানানো হচ্ছে মিষ্টি। খোলা ভিয়েন। ক্রেতার চোখের সামনেই। নকুড় বা নলিনের মতো এদেরও কোনও লুকোছাপা, রাখঢাক নেই। এদের বিশেষত্ব হল ক্রেতার চাহিদা বা পছন্দ অনুযায়ী টাটকা মিষ্টি বানিয়ে হাতে হাতে তুলে দেওয়া। কীরকম খেতে? সেটা যে না চেখেছে তাকে বেকার বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। পুরীর সমুদ্র, মাউন্ট এভারেস্ট বা অ্যামাজোন রেইন ফরেস্টের মতো গিয়ে দেখতে থুড়ি চাখতে হবে। তবেই মালুম হবে ব্যাপারটা। তবে বেশি রাত করে না যাওয়াই ভাল। এই দুটো দোকানেই বেশিরভাগ পদ সন্ধের পরে নিঃশেষ হয়ে যায় প্রায়ই। বিলম্বে হতাশ হতে হবে। তাই শুভস্য শীঘ্রম!
নলিন-মাখন পালা শেষ করে সামান্য এগিয়ে কোম্পানি বাগানের (রবীন্দ্রকানন) মুখ থেকে অটো ধরে হেদোর মোড়। এক স্টপেজ হেঁটে হাতিবাগান বাজার। বাজারের গায়েই গদার কচুরি। নামটিই যথেষ্ট। অধিক পরিচিতি নিষ্প্রয়োজন। হিংয়ের কচুরি। সঙ্গে আলুকুমড়োর ঘ্যাঁট। হালকা পাঁচফোড়নের গন্ধটা মনের (নাকি জিভের) মণিকোঠায় গেড়ে বসে যাবে আজীবন। হলফ করে বলতে পারি। গদার গদাঘাতে আক্রান্ত হবার পর কালক্ষেপ না করে সোজা বাগবাজার বাটার মোড়। এতটুকু তো পথ। হেঁটেই মেরে দিন। হজমে সাহায্য হবে। বাটার ঠিক উলটোফুট থেকে বাগবাজার স্ট্রিট ধরে হেঁটে সেই গিরিশ মঞ্চ অবধি রাস্তার দু’ধারে সব মিলিয়ে কমপক্ষে গোটা দশ বারো তেলেভাজার দোকান। জিভে জল আনা স্বাদেগন্ধে এরা সবাই যাকে সেই হিন্দিতে বলে—‘এক সে বঢ় কর এক’। কারও নাম আলাদা করে বলা যাবে না। আলুর চপ, মোচার চপ, ফুলুরি, কাশ্মীরি চপ, বেগুনি, ক্যাপসিকামের চপ, ধোঁকা, ছান্তাবড়া, পলতাবড়া, ভেজিটেবল চপ, ন্যাজ উঁচিয়ে থাকা চিংড়ির চপ, লঙ্কাবড়া, ডালবড়া… কতরকম তেলেভাজা যে ভাজা হয় এসব দোকানে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবেদকের পরামর্শ একটু বিকেলের দিকে যান। পারলে বসন্তকালে। প্রায় সবক’টা দোকানেই মুড়ি পাওয়া যায়। বেশি নেবেন না। জনপ্রতি মাত্র দু’ টাকা। আর তেলেভাজা? একজন হলে গোটা চারেক। দোকা থাকলে আটটা। কোনটা নেবেন অথবা খাবেন? রাইট অফ চয়েস সম্পূর্ণভাবে আপনার। মুড়ি, তেলেভাজা আলাদা আলাদা ঠোঙায় নেবেন। ওপরে সামান্য বিটনুন আর গোটা মশলার ছিটে, ঝালে আপত্তি না থাকলে সঙ্গে একটা কাঁচা লঙ্কা। কিনেই হড়বড় করে খেতে শুরু করবেন না। প্রতিবেদকের গাইডলাইন মেনে চলুন। দু’-দশ কদম এগিয়েই সামনে গঙ্গার ঘাট। দুলকি চালে গিয়ে বসুন ঘাটলার সিঁড়িতে। ফুরফুরে গঙ্গার হাওয়া। সিঁড়িতে ধাক্কা মারা ছোট ছোট ঢেউয়ের ছলাত্ছল। মাঝ গঙ্গায় দুলতে থাকা মেছো নৌকো। পাশে রেললাইন ধরে ভোঁ বাজিয়ে চলে যাওয়া চক্ররেল। অন্ধকার নেমে আসা ঘাটে সন্ধ্যারতি… মুখে ফেলে দেওয়া একমুঠো মুড়ি। কামড় বসানো ধোঁয়া ওঠা পাইপিং হট তেলেভাজায়… পুরনো গঙ্গা আবার নতুন করে আবিষ্কৃত হবে ঘোর লেগে যাওয়া চোখে। গ্যারান্টি।
দক্ষিণপন্থী পাঠকরা নিশ্চয়ই রেগেখেপে কাঁই হয়ে গেছেন এতক্ষণে। একটু আসছি বলে সেই যে নর্থের দিকে গেল লোকটা, ফেরবার নামটি নেই। তাই আর একটুও দেরি না করে বাস বা ট্যাক্সি যা হোক একটা কিছু ধরে সোজা এসে পৌঁছনো যাক ধর্মতলার মোড়ে। একদম মোড়ের মাথায় কে সি দাস। মনে আছে ‘খাইবার পাস’ প্রথম পর্বের প্রতিবেদনটা শুরু করেছিলাম এখান থেকেই। তাই এখান থেকেই শুরু হোক দ্বিতীয় পর্বের খাদ্য পরিযায়। কে সি দাসের গা ঘেঁষে সিধুকানু ডহর ধরে খানিকটা এগিয়েই হাতের ডানদিকে ডেকার্স লেন। চিত্তদার দোকান। বাটার টোস্ট আর ঘুগনি। ওপরে পিঁয়াজকুচি আর বিটনুনের হালকা ছিটে। না খুব পাতলা, না খুব ঘন। একদম ঠিকঠাক। স্বাদে ফাটাফাটি। এর পাশাপাশি এদের স্টু। তিন রকম চিকেন-মাটন-ভেজিটেবল। সঙ্গে আলু-পেঁপে-গাজরের টুকরো। ফ্রেশ ক্রিম, মাখন আর কারি পাউডারের মিশেলে সে এক রূপকথা কুইজিন। সঙ্গে চা। শেষপাতে। দুধ-লিকার-ফ্লেভার, একদম সঠিক পরিমাণে। যেদিনই যান না কেন সেই একই রকম স্বাদগন্ধ। প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকবার কীভাবে এই একইরকম মান ধরে রাখা যায় সেটা আজও বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা এল-ডোরাডোর মতোই এক অপার রহস্য আমার কাছে।
চিত্তদার দোকানকে পিছনে ফেলে আবার ফিরে আসা যাক ধর্মতলার মোড়ে। জওহরলাল নেহরু রোড ধরে মেট্রো আর হোয়াইটওয়ে লেডল বিল্ডিং টপকেই এস এন ব্যানার্জি রোডের মোড়ে অনাদি কেবিন। কলকাতার আর এক কুইজিন ল্যান্ডমার্ক। বিখ্যাত মোগলাই পরোটার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এ দোকানেই। নামে মোগলাই হলেও মোগলাই রান্নার সঙ্গে সাতকুলেও কোনও সম্পর্ক নেই। মোলায়েম খাস্তা পরোটার মধ্যে দেশি হাঁসের ডিম আর মশলায় জারানো মাংসের কিমার পুর। সঙ্গে আলুর তরকারি আর ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ-বিট-গাজরের স্যালাড। ওপরে সামান্য গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে নিন। কাঁটাচামচে কেটে স্যস মাখিয়ে এক টুকরো মুখে পুরুন। মুহূর্তে গোটা ব্যাপারটা জমে ক্ষীর একেবারে। তবে একটু বেশি গুরুপাক। একবারে একজনের পক্ষে একটার বেশি ট্রাই না করাই উচিত। প্রয়োজনে বাড়ি ফিরে রাতের মিলটা অফ করে দিলেও দিতে পারেন।
অনাদি থেকে বেরিয়ে এস এন ব্যানার্জি ধরে একটু এগোতেই রিগ্যাল সিনেমা। দেয়ালে ‘চামেলি কি জওয়ানি’ বা ‘হওয়াসি আত্মা’ টাইপের সিনেমার রগরগে পোস্টার। হলের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সস্তার দেহপসারিনি। মুখে সস্তা প্রসাধন। জ্যালজ্যালে চকমকি শাড়ি। ওসবে নজর না দিয়ে চোখ ঘোরান উলটোফুটে। জোড়া কচুরির দোকান। সামনের কাচের শোকেসে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। ওপরে বড় স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে গুলাবজামুন। তবে এদের আসল প্রসিদ্ধি বিখ্যাত হিংয়ের কচুরির জন্য। ফুলকো পেটের মাঝখানটা আঙুলে টিপে সামান্য ফাটিয়ে দিলেই নিভু নিভু ভলক্যানোর মতো বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার ভাপ। হিং, বিউলির ডাল আর ভাজা মৌরির মাতমাত গন্ধ। নাকে ঢুকলেই এক মাসের খিদে একেবারে পেয়ে যাবে। তবে সেরা আকর্ষণটি অবশ্য আলুর তরকারির পাশে দেওয়া একটুখানি কাঁচালঙ্কার আচার। অকল্পনীয় স্বাদ! কিন্তু কী কী মশলা মেশানো হয় আচারে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা ধরা যাবে না কিছুতেই। জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না, কারণ সেটাই এদের কারবারের টপ সিক্রেট। অনেকটা চেরোনোবিল বা ম্যানহাটান নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টের মতো। এই অধম প্রতিবেদকের অর্ধাঙ্গিনী, যিনি কিনা অন্যের রেসিপি হাতিয়ে নেবার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই পূর্বেকার সমস্ত ক্রাইম ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন, সেই তিনিও বহুবার চেষ্টা করেও এই সিক্রেট ফর্মুলাটি এদের কাছ থেকে হস্তগত করতে পারেননি। অবশেষে ‘উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে…’ মনোভাবাপন্ন হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এ হতাশা রাখার জায়গা কোথায়?
কচুরি পর্ব তো মিটল। কাউন্টারে বিল মিটিয়ে মৌরি চিবুতে চিবুতে ফুটপাতে নামুন। এলিট সিনেমা আর নিউ মার্কেট থানাটা পেরিয়ে সামান্য এগোলেই জানবাজারের মোড়টা যেখানে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দিকে বাঁক নিয়েছে, সুপুরিপট্টি, সার সার মুদিখানা আর পাখির খাবারের দোকানের গা ঘেঁষে রানি রাসমণির বাড়ির ঠিক পিছনদিকে ছোট একফালি দরজার ওপর সাইনবোর্ডে লেখা—‘সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম।’ নাম পড়ে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। নেহাতই ভাতের হোটেল। গলিতে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সে এক এলাহি কাণ্ড। বিরাট এক যজ্ঞিবাড়ি যেন। সামনে টাঙানো লম্বা বোর্ডে চকের টুকরোয় লেখা— ‘আজকের মেনু’। অন্তত তিরিশ বত্রিশটা পদের নাম পরপর সাজানো। দু’পাশে তিন তিনখানা ঘর। সার সার লম্বা টেবিল আর চেয়ার অথবা বেঞ্চি। মাথার ওপর ঘুরন্ত ডিসি ফ্যান। প্রচুর মানুষ বসে খাচ্ছেন। ঢুকেই জায়গা পাওয়ার আশা না করাই ভাল। হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। জায়গা খালি হওয়ামাত্র পরিবেশকরাই ডেকে আদর করে বসিয়ে দেবেন আপনাকে। ঝকঝকে পরিষ্কার থালার ওপর বেছানো কলাপাতা (চার্জ এক্সট্রা)। পাশে লেবুর টুকরো, এক চিমটে নুন। চারাপোনা, কাটাপোনা, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, পাবদা, পমফ্রেট, পারসে, তোপসে, ইলিশ (সিজনে), খাসির মাংস (রেয়াজি এবং কচি) সহ নিরামিষের একাধিক সুপারলেটিভ পদের অসামান্য আয়োজন এখানে। অ্যালার্জি না থাকলে আপনি অর্ডার করুন গলদার মালাইকারি, কাতলার কালিয়া, ভাপা ইলিশ, সঙ্গে সোনামুগের ডাল, সুতোর মতো ঝুরিঝুরি আলুভাজা আর মুড়িঘণ্ট। শেষপাতে আদা আর জিরের ফোড়ন দেওয়া অলৌকিক টম্যাটোর চাটনি। গরমকাল হলে টম্যাটোর বদলে লম্বা ফালি করে কাটা কাটা কাঁচা আম। অলৌকিকত্ব আর এক অন্য মাত্রা পাবে। এক কথায় এদের প্রতিটি পদই যাকে ইংরেজিতে বলে— ‘এক্সক্লুসিভ, মাউথ ওয়াটারিং অ্যান্ড হেভেনলি!’ এসি নেই, গদি আঁটা চেয়ার টেবিল নেই। নেই ফিউশন বা এক্সপেরিমেন্টের লোকদেখানো কায়দাবাজি। সো-কলড কাম অ্যান্ড কুল অ্যাম্বিয়েন্সের প্রশ্নই ওঠে না। আর দাম? অবিশ্বাস্য রকম সস্তা! তবু স্রেফ জাদুমাখা রান্নার গুণেই ইদানীং ব্যাঙের ছাতার মতো শহরে গজিয়ে ওঠা সবকটা ‘বেঙ্গলি কুইজিন’-এর হোটেল রেস্তোরাঁকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে সিদ্ধেশ্বরী। গরমকালে যদি যান তা হলে আপনার শেষপাতে পৌঁছে যাবে আম। পরিপাটি করে তিনফালি মেরে কাটা। পাকা ল্যাংড়া কিংবা হিমসাগর। বর্ষার গোড়ায় ফজলি। অবশ্যই আপনি যদি চান। খাওয়া শেষে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ঘুরতেই সিঁড়ির গোড়ায় দুটো টেবিল। নাকের ডগায় চশমা, দুই ক্যাশিয়ারবাবু, বসে রয়েছেন গম্ভীরমুখে। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র এসে হাজির পরিবেশনকারী। ব্রাহ্মী, হিব্রু, ল্যাটিন বা টোটো ভাষার চেয়েও দুর্বোধ্য কোনও ভাষায় ঝড়ের গতিতে বলে চলেছেন কিছু। ক্যাশিয়ারবাবু কিন্তু ঠিক বুঝে নিচ্ছেন আর খসখস করে লিখে চলেছেন ছোট ছোট কাগজে। কাস্টমার ঠিক যা যা খেয়েছেন হুবহু লিখে নিয়ে বিল ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে হাতে। জাদুবাস্তব এক দৃশ্যের অবতারণা চোখের সামনে। মোবাইলে তুলে নিয়ে ইউটিউব বা হোয়াটসআপে ছড়িয়ে দিন। ভাইরাল হয়ে যাবে বাজি রেখে বলতে পারি।
এবার সিদ্ধেশ্বরীর চরণ ছেড়ে ফের একবার ফিরে আসা যাক জওহরলাল নেহরু রোডের মোড়ে। হাতের বাঁদিকে দুটো বাড়ি পরেই বড় রাস্তার ওপর ঐতিহাসিক র্যালি সিং অ্যান্ড কোং। সংক্ষেপে ‘র্যালিজ’, ‘র্যালিজ’ মানেই এক ঝটকায় এক টুকরো ছেলেবেলা। অনেকখানি মধুর স্মৃতি। বাবার হাত ধরে মেট্রোয় সকাল সাড়ে ন’টার শো। জনি ওয়েসমুলারের ‘টারজান দ্য এপম্যান’, জুলি এন্ড্রুজের ‘মেরি পপিন্স’, ওয়াল্ট ডিজনির ‘ম্যাজিক বয়’…। শো ভাঙার পর অবশ্য গন্তব্য র্যালিজ। শরবত সম্রাট। রোজ, পাইন অ্যাপল, অরেঞ্জ, ম্যাঙ্গো কতরকম শরবত যে পাওয়া যায় শতাব্দীপ্রাচীন এই সুধারস বিপণিতে। সেই ছেলেবেলা থেকে আজও আমার পছন্দ রোজ। গোলাপের গন্ধ আপনার পছন্দ না হলে অর্ডার করুন অরেঞ্জ, পাইনাপল, যা হোক একটা কিছু। ওপরে ভাসমান বরফের ছোট ছোট চৌকো টুকরো। ছোট্ট একটা চুমুক। ঠোঁট হয়ে গলা বেয়ে নেমে যাওয়া সুগন্ধী তরল-রাশি। কলকাতার একচল্লিশ ডিগ্রি গরমেও গোটা শরীর জুড়ে মুসৌরি, কালিম্পং, দার্জিলিং। বাকিটা অবর্ণনীয়! কথাপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল, দোকান ছাড়াও ওদের শরবতের সবক’টা কনসেনট্রেট সিরাপও বিক্রি করে থাকে র্যালিজ। কিনে নিয়ে গিয়ে বরফঠান্ডা জলে বোতলের গায়ে লেখা পরিমাণমতো মিশিয়ে খেতে পারলেই শরবতের ম্যাজিক বাড়িতেও। শরবত ছাড়াও আরও একটি ব্যাপারে বিখ্যাত এরা। সেটা এদের চাট। আলু-পাপড়ি চাট, রাজকচুরি চাট, দহিবড়া চাট, মিক্সড চাট… গোটা একটা চাট সাম্রাজ্য যেন। সঙ্গে কুলচা-নান বা ছোলে-ভাটুরে। অতঃপর সেই অবধারিত প্রশ্ন। খেতে কীরকম? আর কত তুলনা টানব মশাই? উপমার ভাণ্ডার তো বাড়ন্ত প্রায়। অতএব নিজেই না হয় গিয়ে দেখে চেখে নেবেন একদিন। মাঝখানে সমগ্র র্যালিজপ্রেমীদের শোকসাগরে নিমজ্জিত করে বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছিল এই শতাব্দীপ্রাচীন সুধাবিপণি। আশার কথা আপামর প্রেমিকদের বিরহ ভেঙে সুকুমার রায়ের সেই পাগলা দাশুর মতোই ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। আমাদের এ শহরে। স্থান-কাল-পাত্র অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই আর একটুও দেরি নয়। শুরু হয়ে যাক ‘অপারেশন র্যালিজ!’
এইবার। দক্ষিণীদের চূড়ান্ত বিরক্তি আর অধীর আগ্রহের অবসান ঘটিয়ে সত্যিসত্যিই পা রাখা খোদ দক্ষিণে। ভবানীপুর জগুবাজারের গা ঘেঁষা গলিটা ধরে হাত পঞ্চাশেক এগিয়ে খালসা স্কুলের ঠিক উলটোফুটে বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিক। সন্দেশ উইজার্ড! এদের অজস্র ধরনের সন্দেশ আর মিষ্টি নিয়ে কিছু বলার নেই মানে বলার থাকতে পারে না। এতটাই দেবভোগ্য। তবে আমার ফোকাস অন্য ধরনের দুটো ডেলিকেসির দিকে। এদের আমদই আর আতার পায়েস। জমাট লালচে দইয়ের ক্যামুফ্লেজে লুকিয়ে থাকা ঘন পাকা আমের রস। বাকিটা আর জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না। আমদইয়ের সুযোগ্য দোসর আতার পায়েস। ক্ষীরজমাট দুধের মধ্যে চোবানো তুলতুলে নরম আতার শাঁস। একবারটি জিভে ছোঁয়ালেই নন্টে ফন্টের সেই কেল্টুদার ভাষায় বলে উঠতেই হবে—‘উলস!’
মিষ্টি ছাড়াও আর একটি কারণে অনন্য এই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। বছরে একবার দোকানপত্তর গুটিয়ে হপ্তাখানেকের জন্য তল্পিতল্পা বেঁধে সমস্ত কর্মচারীদের নিয়ে বেড়াতে যান দোকান মালিকরা। জানি না এই প্রথা আজও তাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন কিনা। না হলে ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক।
জগুবাজারের পরের বাসস্টপ। আশুতোষ মুখার্জি রোডের ওপর পূর্ণ সিনেমা। মাল্টিপ্লেক্সের দাপটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন। ভাঙা জংধরা কোলাপসিপল গেট। ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলে অন্ধকার হল। ধুলোভর্তি মেঝে। ছেঁড়া কালচে পর্দা। ঘুণ লেগে পচে যাওয়া কাঠের দর্শকাসন। প্রজেক্টর হোলে পুরু মাকড়সার জাল। এখানেই মেজমামার হাত ধরে ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, ‘বর্ন ফ্রি…’ জায়গায় জায়গায় ইটের দাঁত বেরিয়ে পড়া দেয়াল ফুঁড়ে মাথা তুলেছে বট-অশত্থের চারা। জরাজীর্ণ অবস্থা। কোথায় গেলেন কর্মচারীরা? ভাবলেই বুকের মধ্যে কীরকম একটা করতে থাকে। অদূরেই বনফুল। পুরনো কলকাতার রেস্তোরাঁ কালচারের অন্যতম প্রতিনিধি। বনফুল মানেই অদৃশ্য কোনও টাইম মেশিনে চড়ে পিছিয়ে যাওয়া অনেকটা সময়। বনফুল মানে উত্তমকুমারের প্রিয় ব্রেস্ট কাটলেট। বনফুল মানেই পাশে রূপচাঁদ মুখার্জি লেন। মামাবাড়ির পুরনো পাড়া। দিদিমার আমূল কৌটোর ব্যাঙ্ক খুঁচিয়ে বের করে আনা পাঁচ নয়া, দশ নয়া, সিকি… এক ছুটে রাস্তায়। তারপর বনফুল। স্বপ্নের ব্রেস্ট কাটলেট! আর এখন। করুণ অবস্থা। পুরনো রঙ চটে যাওয়া টেবিল চেয়ার। ধুলোপড়া টিউব লাইট। অযত্ন আর অসচ্ছলতার ছাপ চারদিকে। সময়ের কাছে হেরে গিয়ে সস্তার রোল আর চাউমিন বেচে টিকে আছে টিমটিম করে। বড় মন খারাপ করা সময়। এক ঢোঁকে দুঃখটাকে গিলে ফেলে চলুন আরেকটু সামনে এগোনো যাক। বিজলী সিনেমার উলটোফুটে শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সংক্ষেপে শ্রীহরি। ঘিয়ে ভাজা লুচি, হিংয়ের কচুরি, সঙ্গে ছোলার মিষ্টি ডাল আর আলুকুমড়োর তরকারি। এই দুই পদের জন্য নাম কলকাতাজোড়া। আর অবশ্যই ল্যাংচা। বিঘতখানেক লম্বা। লালচে বাদামি খোসার নীচে মধুর মোলায়েম ছানার আবাসভূমি। সারা গায়ে ভুরভুরে ঘিয়ের গন্ধ। চুপচুপে রসের আধার। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পরবর্তী রসনার ঠিকানা সন্ধানে বেরোনোর আগে ধ্যানস্থ হয়ে দোকানের বেঞ্চিতেই বসে থাকুন দু’-চার মিনিট। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করুন অসম্ভব এই ভালোলাগাটুকুকে।
‘আপনজন’। আপামর চপ কাটলেট প্রিয় বাঙালির জন্য একটা দোকানের নাম, এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছুই হতে পারে না। কালীঘাট ট্রামডিপোর উলটোদিকে যে রাস্তাটা সোজা কালীঘাট মন্দিরের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে সামান্য এগুলেই হাতের বাঁদিকে সদানন্দ রোড। দ্বিধা না করে ঢুকে পড়ুন। মিনিট তিনেকের রাস্তা। বাঁ ফুটে আপনজন। চপ কাটলেটের স্বর্গদ্বার! দুটো মানুষ পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে না এতটাই সরু এক ফালি দোকান। ফুটে দাঁড়িয়ে অথবা টুলে বসে খেতে হবে ফিশ ফ্রাই থেকে শুরু করে ডিমের ডেভিল, ফিশ ওরলে হয়ে চিকেন কাটলেট… আজকের ভাষায়—‘মাইন্ডব্লোইং’! মনে আছে প্রথম পর্বে কলেজ স্ট্রিটে দিলখুশা কেবিনের বিখ্যাত কবিরাজি কাটলেটের মান পড়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিলাম। আপনজনে এলে আপনার সে আক্ষেপ মিটে যাবে। ওপরে ফুরফুরে ডিমের পরত। মধ্যে চাপ চাপ মাংস অথবা মাছের পুর। পিঁয়াজ-আদা-রসুনকুচি আর ঝিরঝিরে কাটা ধনেপাতার অ্যারোমা… লিখতে গিয়ে কলম থেমে যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন। ফিশ, চিকেন অথবা মাটন কবিরাজী-আর একমুহূর্তও দেরি না করে অর্ডার করে ফেলুন এর মধ্যে যে-কোনও একটা। সস বা কাসুন্দিতে (কাসুন্দিই বেটার) চুবিয়ে পরপর দু’-তিনটে কামড়। দিলখুশার পুরনো সেই স্বাদ হুবহু পুনরুদ্ধার হবে, জোর দিয়ে বলতে পারি।
হালফিলে আপনজন তাদের আরেকটি শাখা খুলেছে ওই একই রাস্তার ওপর, তপন থিয়েটারের উলটোদিকে। ভিড় এড়াতে সেখানেও যেতে পারেন। খাবারের স্বাদ এবং মান একইরকম থাকবে এটা নিশ্চিত।
এই রে! কথায় কথায় ‘ক্যাফে’-র কথাটাই তো ভুলে মেরে দিয়েছি একেবারে। প্রতিবেদকের এই সামান্য অপরাধটুকু ক্ষমাঘেন্না করে দিয়ে পিছিয়েই না হয় গেলেন একটু। হাজরা মোড়ে যতীন দাস পার্কের উলটোদিকে ‘ক্যাফে’। মেট্রো স্টেশনের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকা ভেজ চপ, ফিশ কাটলেটের ‘গেরিলা জোন’। সঙ্গে একটু কড়া লিকারের দুধ-চা। আগে না হোক রসাস্বাদন করে বেরিয়ে আসার পর সাত খুন মাফ হয়ে যাবে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
অতঃপর আমাদের ডেস্টিনেশন হোক তরুণ নিকেতন। রাসবিহারী মোড় থেকে গড়িয়াহাটের দিকে ঘুরে গিয়ে পুরো একটা স্টপেজও যেতে হবে না। হাতের বাঁদিকে পুরনো ভাতের হোটেল। প্রিমিয়াম আইটেম তেল-চিতল, চিতল মুইঠ্যা, কাতলার ঝোল আর জিরে ফোড়নের সামান্য পাতলা মুসুরির ডাল। চাইলে এবং থাকলে পেয়ে যাওয়া যেতে পারে সুগন্ধি কাগজি লেবুর ছোট একটা টুকরো (অন্যথায় পাতিলেবুতেই কাজ চালাতে হবে)। সঙ্গে ঝুরো ঝুরো আলুভাজা নইলে থকথকে পোস্তয় ডুবুডুবু আলুপোস্ত। ওপরে ছড়িয়ে যাওয়া কাঁচা সরষের তেলের হালকা ভাপ… নাঃ, বাকিটা আর বলা যাচ্ছে না। জিভ জুড়ে স্যালাইভার নিঃসরণ বলাকওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। অতএব নিজ জিহ্বায় পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে একটা কথা এখানে জোর দিয়ে বলাই যেতে পারে যে সিদ্ধেশ্বরী, ইয়ং বেঙ্গল (খিদিরপুরের মোড়ে আরেক অসামান্য পাইস হোটেল) আর তরুণ নিকেতনের হাত ধরে অন্তত এই একটা ব্যাপারে উত্তরকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে মধ্য আর দক্ষিণ কলকাতা। আজ থেকে দশক তিনেক আগেও উত্তর কলকাতায় এরকম বেশ কয়েকটা পাইস হোটেল ছিল শোভাবাজার, গড়পার আর শেয়ালদা অঞ্চলে। যার মধ্যে অন্যতম শ্রীমানি বাজারে চণ্ডীর হোটেল বা শেয়ালদা স্টেশনের গায়ে হোটেল ব্যারন। ইদানীং এদের মধ্যে অনেকগুলিই উঠে গিয়েছে আর বাকিগুলোর মান এতটাই পড়ে গিয়েছে যে তাদের নিয়ে আর কিছু লেখার কোনও মানেই হয় না।
তরুণ নিকেতনের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে লেক মার্কেট। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম আদি বাজার। ইদানীং তার মাথার ওপর ধাঁ করে ঝাঁ চকচকে একটা মল চাপিয়ে দেওয়ার ফলে হাতিমি বা বকচ্ছপের মতো একটা বিটকেল কদর্য চেহারা নিয়েছে। কী আর করা। অগত্যা গতস্য শোচনা নাস্তি বলে ঢুকে পড়া যাক লেক মার্কেটের গায়ে লাগা রাস্তাটায়। জনক রোড। নামে রোড হলেও চওড়া একটা গলি ছাড়া আর কিছুই নয়। গলি ধরে হাত বিশেক এগিয়েই ডানফুটে রাধুবাবুর (মতান্তরে রাদুবাবু) দোকান। আপনজনের মতো না হলেও আকারে বেশ ছোটই। তবে সুবিধে একটাই। উলটোদিকের ফুটপাতটা বেশ চওড়া। দোকানের এক কোণে দাঁড়ান চুপটি করে। মনোযোগ সহকারে চোখ বুলিয়ে নিন দোকানের একপাশে টাঙানো মেনুবোর্ডে। হরেকরকম চপ কাটলেট আই ফ্রাইয়ের নাম লেখা রয়েছে। ফের একবার প্রতিবেদকের অ্যাডভাইস মানলে অর্ডার করুন চিকেন কাটলেট আর ঠিকঠাক লিকার-ফ্লেভারের চা। এদের বৈশিষ্ট্য। হাতে পাওয়া-মাত্র নিয়ে সেঁটে যান ওপারের ফুটপাতে। চা-টা অবশ্য পরেও অর্ডার করতে পারেন, কারণ প্রথম কাটলেটটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপোড়েন শুরু হবে। দ্বিতীয়টা অর্ডার করবেন কি না। এতটাই অমোঘ এই কাটলেটের আকর্ষণ। সঙ্গে কাসুন্দিটা চেয়ে নিতে ভুলবেন না যেন। কলকাতার সব ক’টা চপ কাটলেটের দোকানের মধ্যে রাধুবাবুর কাসুন্দিটাই সেরা। কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা বলছি। বিশ্বাস করলে ঠকবেন না।
লেক মার্কেটের পরের স্টপেজ দেশপ্রিয় পার্ক। তাই বাসে-ট্রামে না চড়াই ভাল। পার্কের ঠিক উলটোদিকে সুতৃপ্তি। চোখে পড়ামাত্র বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস! বেশ কিছুদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। সুতৃপ্তি মানেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চাটুজ্জে, ঋত্বিক ঘটকদের ধুন্ধুমার আড্ডা… চা আর ফিশফ্রাই। ডিমের ব্যাটারে মাখামাখি, ওপরে ব্রেডক্রাম্বের মিহি মুচমুচে আস্তরণ। মাছখানে শুয়ে থাকা পিওর ভেটকির পুর। ধনেপাতা, জায়ফল, জয়িত্রি আর আদা-রসুন-পেঁয়াজ কুচির সেই নিওলিথ সুবাস… সব চলে গেল! চেখে দেখতে পারলেন না। তবু হেরে যাওয়া ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করুন এক মিনিট। বাঙালি হিসেবে লজ্জিত হন। আত্মগ্লানিতে ফালাফালা করুন নিজেকে। যে শহরে ভুজিয়াওয়ালা, ফিউশন ফুড সংস্কৃতি দাপিয়ে বেড়ায় আর সুতৃপ্তি বন্ধ হয়ে যায়। এ লজ্জা রাখার জায়গা কোথায়? দেশপ্রিয় পার্কের অদূরে গড়িয়াহাট অঞ্চলে এবং ধর্মতলায় সুতৃপ্তির মতোই আরও তিনটি রেস্তোরাঁ আছে অথবা ছিল। কাফে-ডি-মনিকো, স্যাঙ্গুভ্যালি এবং সাউথ পোল। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের আড্ডা, বাটার টোস্ট, ভেজিটেবল চপ আর চায়ের জন্য বিখ্যাত। ছিল বলছি কারণ এখনও আছে না কি জেট স্পিড সময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পাততাড়ি গুটিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখা হয়নি অনেকদিন। আপনারা চেষ্টা করলেও করতে পারেন।
গড়িয়াহাট এলাকায় দুটি মিষ্টির দোকানের কথাও এই প্রতিবেদনে না বললে বোধহয় অন্যায় হবে। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে যাদব চন্দ্র দাস আর হিন্দুস্থান রোডের মোড়ে মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। যাদবের কড়াপাক আর মহাপ্রভুর আইসক্রিম সন্দেশ। বহুদিন হল ঢুঁ মারা হয়নি ওদিকটায়। তবে স্বাদ আজও জিভে লেগে রয়েছে।
ইদানীং গড়িয়াহাট, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, গড়িয়া আর বেহালা অঞ্চলে বেশ কয়েকটা নতুন নামীদামি মিষ্টির দোকান হয়েছে। সুখ্যাতিও হচ্ছে প্রচুর। কারও নাম আলাদা করে করতে চাই না। তবে এদের প্রায় প্রত্যেকের মিষ্টিই চেখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনবদ্য বা দুর্দান্ত কিছু মনে হয়নি। কিন্তু একটি দোকানের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হবে। স্রেফ তাদের দইয়ের জন্য। বেহালা ট্রামডিপোর উলটোদিকে ব্রাহ্মসমাজ রোডের মোড়ে পান্না সুইটস্। বহু নামীদামি দোকানের দই বাড়িতে এনে ফ্রিজে রেখে দেখেছি। দু’-তিন দিন বাদে কেটে নেওয়া জায়গাগুলোয় জল ছেড়ে যায়। স্বাদও যায় ফিকে হয়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম পান্না। এনে ফ্রিজে রেখে দিন। দু’-তিন দিন বাদেও জল কাটবে না এতটুকু। আর স্বাদেও অটুট। পান্নার দইয়ের বিশেষত্ব এখানেই।
দইয়ের কথা যখন উঠলই তখন ফের একবার মধ্য আর উত্তর কলকাতায় ফিরতেই হবে। কিছু করার নেই। মিঠাই। মধ্য আর দক্ষিণ কলকাতার একদম সীমান্ত ঘেঁষা এই মিষ্টান্ন বিপণি। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর পরবর্তী স্টপেজ বেকবাগান মোড়ে। পাঁচ দশকের এই সুইট শপ আর তাদের তাক লাগিয়ে দেওয়া দই। যদিও একটু বেশি মিষ্টি তবুও স্বাদে গন্ধে অনন্য। দই ছাড়াও আরও অনেকরকম মিষ্টান্ন পদ বানিয়ে থাকেন এঁরা। তবে সিঙাড়া আর খাস্তা কচুরির কথাটা আলাদা করে বলতেই হবে। খাঁটি তেলে ভাজা, চুড়মুড়ে। সিঙাড়ার ভেতর আলুর পুরটা বোধহয় কলকাতার সেরা। এ রকমটা আর কোথাও খাইনি। বিশেষ করে শীতকালে পুরের মধ্যে ফুলকপি আর ভাজা চিনেবাদামের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় স্বাদটা যে সর্বোচ্চতায় ওঠে সেটা বলাই বাহুল্য। অতঃপর আসি মিহিদানার কথায়। আধভেজা রসে টইটুম্বুর তারামণ্ডল যেন। গায়ে জড়ানো খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের মসলিন। বর্ধমান, বর্ধমান তো অনেক করলেন। একদিন মিঠাইয়ের মিহিদানা টেস্ট করে দেখুন। কোনও অংশে খাটো পড়বে না, বাজি রেখে বলতে পারি।
শেয়ালদায় সত্যনারায়ণ সুইটস আর এদের দই। বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে এদের কথা। অধিকাংশ বিখ্যাত মিষ্টির দোকানেই দইয়ের রঙটা লালচে ধরনের। ব্যতিক্রম সত্যনারায়ণ। এদের বৈশিষ্ট্য সাদা চিনিপাতা দই। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাওয়া যেত কলকাতার দোকানে দোকানে। সেই ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে সত্যনারায়ণ। গাদাগুচ্ছের কিড়কিড়ে মিষ্টি নয়। বরং একটা অম্লমধুর ভাব। প্রিয় পাঠক, একবার হিমসাগরের সঙ্গে ল্যাংড়ার স্বাদের পার্থক্যটা কল্পনা করুন মনে মনে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে জলের মতো। টকমিষ্টি সাদা দই। জানি না আর কেউ এই বৈশিষ্ট্যটি বাঁচিয়ে রেখেছেন কি না আজও এ শহরে। জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন দয়া করে।
ফড়িয়াপুকুরে সেন মহাশয়ের গা ঘেঁষে অমৃত সুইটস। নলিন বা মাখনলালের মতো এর কথাও উল্লেখ করতে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রথম পর্বে। নতুন করে এদের সম্পর্কে কিছু বলার নেই। শ্রবণ এবং জিহ্বার বিবাদভঞ্জন করতে একদিন পৌঁছে যান ফড়িয়াপুকুর। একটু বিকেল-বিকেলই যান। কারণ সন্ধের পর বেশিরভাগ সময়ই দোকানের একপাশে ছোট শেলেট ঝোলানো থাকে। তাতে চক দিয়ে লেখা— ‘দধি নাই।’ খাঁটি উত্কৃষ্ট দই আর অমৃত, দুটো নাম সমার্থক। অমৃতর দই অমৃতই। অন্য কোনও তুলনা বাতুলতা মাত্র।
এবার যে দোকানটির কথা বলে এই প্রতিবেদন পর্বে দাঁড়ি টানব তার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সীমানাতেও দাঁড়িটা পড়ে যাবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই। কারণ উলটোফুটে বহমান পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে। আর গঙ্গা টপকালেই হাওড়া। হ্যারিসন অধুনা মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে সোজা এগিয়ে বড়বাজারের মোড়ে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কলকাতায় একমাত্র নবকৃষ্ণ গুঁই আর গাঙ্গুরাম ছাড়া আর কোথাও এত ভাল রাধাবল্লভি পাওয়া যায় বলে আমার অন্তত জানা নেই। আপাদমস্তক খাঁটি ঘিয়ে ভাজা। দু’ আঙুলের চাপে তবকের চেয়েও পাতলা ওপরের আস্তরণটা ছিঁড়লেই কলাইয়ের ডাল আর ভাজা জিরে মৌরির মন পাগল করা সুবাস। মিষ্টি ছোলার ডাল (মাঝে মাঝে জিভে এসে আটকে যাওয়া ফুলোফুলো কিশমিশ) অথবা নিরামিষ আলুর তরকারি। দুটোর সঙ্গেই সমান যায়। তবে প্রতিবেদকের মতে ফটো-ফিনিশে ছোলার ডাল সামান্য হলেও এগিয়ে থাকবে। রাধাবল্লভির পাশাপাশি নিতেই হবে আট প্যাঁচের অমৃতি। আদরের নাম অমিত্তি (আহা!)। পাকা সোনার রং পিছলে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। ওপরটা খাস্তা কুড়কুড়ে। ভেতরটা রসে টইটুম্বুর। শেষপাতে কাঁচা হলুদ রঙা কেশরভোগ। বলি রাজভোগ বা কমলাভোগ তো অনেক খেয়েছেন। একবার দেশবন্ধুর কেশরভোগটা খেয়ে দেখুন। তারপর এসে বলবেন।
আর কী? অনেক তো হল। এরপর আর এগোলে তো গঙ্গায় থুড়ি হাওড়ায় গিয়ে পড়তে হবে। শিবপুর, রামরাজাতলা… হাওড়ার পর হুগলি। রিষড়া, চন্দননগর, জনাই… বাঙালি মিষ্টির আদি জন্মভূমি… আর এক রূপকথার শুরু। সময় সুযোগ হলে শোনানো যাবে আরেকদিন। আজ এই পর্যন্তই।
সংযোজন: এই দেখুন! এত লেখার ভিড়ে গড়পারে সুকিয়া স্ট্রিটের গায়ে শ্রীমানি বাজারের ভেতর এ ডি কেবিনের নামটাই করতে ভুলে গেছি বেমালুম। কলকাতা রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির আরেক উজ্জ্বল নাম। ততোধিক উজ্জ্বল এদের ফাউল কাটলেট আর মাটন স্টু। যারা খাননি, চেখে দেখার সুযোগ আর নেই! মাত্র বছর দুয়েক আগে এই অমৃত পদ বিপণি বন্ধ করে দিয়েছেন বৃদ্ধ কর্ণধার। পরবর্তী প্রজন্ম ব্যাবসা চালাতে রাজি না হওয়ায়। ভাবা যায়!
১০. মোগলাই কলকাতা
‘যব ছোড় চলে লক্ষ্নৌ নগরী…।’ ১৮৫৬ সাল। ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর অন্যায়ভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করলেন লখনউয়ের শেষ স্বাধীন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে। সাধের লখনউ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন ভগ্নমনোরথ নবাব। শহরের দক্ষিণপ্রান্তে মেটিয়াবুরুজের ভূতঘাট, আজকের গার্ডেনরিচ অঞ্চলে, গঙ্গার ধারে হাজারখানেক একরের ওপর জমিতে গড়ে তুললেন বিশাল সুরম্য প্রাসাদ। সে এক মিনি লখনউ। আক্ষরিক অর্থেই। উপমাটা ব্যবহার করলাম কারণ নবাব তাঁর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বিশাল পরিবার, হাতিঘোড়া, অগুনতি বেগম-বাঁদী-হারেমসুন্দরী-তওয়াইফ (বাঈজী)—গাইয়ে-বাজিয়ে-লোকলস্কর-পাত্রমিত্র-অমাত্য-পরিষদ-মোসাহেব-কবি-নোকর-খানসামা-বাবুর্চি মায় একটা আস্ত চিড়িয়াখানা পর্যন্ত। নবাবের সঙ্গে সঙ্গে লখনউ ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বহু আমির ব্যবসায়ী আর রহিস, জ্ঞানীগুণী মানুষজন। অচিরেই মেটিয়াবুরুজের বিস্তীর্ণ অঞ্চল-জুড়ে গজিয়ে উঠল আরেকটা ছোটখাটো লখনউ। কলকাতার নব্য বাবুসমাজের গণ্যমান্যদেরও নিয়মিত আনাগোনার পীঠস্থান হয়ে উঠল মেটিয়াবুরুজে নবাবের প্রাসাদ। নৃত্যগীত-শিল্পকলা-কবিতা-শেরশায়েরি, খানাপিনা, তহেজিব… সব মিলিয়ে নতুন এক মিশ্র সংস্কৃতির তত্কালীন ভরকেন্দ্রের নাম মেটিয়াবুরুজ।
আসলে নবাবের মেটিয়াবুরুজ তথা কলকাতায় আগমনের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে বড়লাটবাহাদুরের কাছে দরবার করা। প্রয়োজনে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিল অবধি যাওয়া। সেই উদ্দেশে নিজের মা, ভাই ও ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন লন্ডনে। কিন্তু লাভের লাভ বলতে প্রায় কিছুই হল না। রাজমাতা আর ভাই প্রবাসেই দেহত্যাগ করলেন। হতাশ শাহজাদা। একা। নিঃসঙ্গ। ফিরে এলেন মেটিয়াবুরুজে, নবাবের কাছে।
‘খোয়াব থা যো কুছ ভি দেখা/যো শুনা আফসানা থা…’ (যা দেখেছি সবই স্বপ্ন/শুনেছি যা কিছু সবই গল্পকথা…)। ১৮৮৭। জীবনের শেষ শায়েরিটি লিখে বরাবরের মতো দুনিয়াদারি ছেড়ে চলে গেলেন ভগ্নমনোরথ মেটিয়াবুরুজের নবাব। অন্য কোনও শেরশায়েরির দেশে। নাচগানের আসর, শিল্প-কবিতা-সংস্কৃতি, জাঁকজমক, কোলাহলমুখর হর্ম্যপ্রাসাদ… সময়ের কালগ্রাসে অতীত হয়ে গেল। কেবল একটি জিনিস ছাড়া। নবাবি খানা। লখনউ ছেড়ে চলে আসার সময় নবাব তার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন শতাধিক পাচক বা বাবুর্চিকে। তাদের হাতের রান্না, এককথায় অমৃতসমান। কতরকম যে পদ তার ইয়ত্তা নেই। বিরিয়ানি, চাঁপ, কাবাব, কোফতা, কোর্মা, খুশকা পিলাও, জর্দা পিলাও, দালগোস্ত, ফিরনি… এক সে বাঢ় কর এক উমদা রন্ধনশিল্প সব। নবাব চলে গেলেন। রয়ে গেল নবাবি খানা। নবাবি রসুইখানা থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শহরের কোনায় কোনায়। ঢুকে পড়ল সাধারণের হেঁশেলে। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় একনম্বরে অবশ্যই বিরিয়ানি। ঘি-জাফরানস্নাত সুগন্ধী বাসমতী চাল আর মাংসের স্বর্গীয় দমপোক্ত কুইজিন। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল একমাত্র কলকাতাতেই বিরিয়ানিতে আলু এবং কোথাও কোথাও ডিম দেবার রেওয়াজ রয়েছে। সারা দেশে আর কোথাও এই নজির নেই। এরও একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। আগেই বলেছি মেটিয়াবুরুজে নবাববাড়ির রান্না, মূলত বিরিয়ানি দ্রুত সাধারণের মধ্যে বিশেষভাবে মুসলমান এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্রশ্রেণির মানুষ। মাংস জোগাড় করে ওঠা সবসময় সম্ভব হত না সবার পক্ষে। ফলে মাংসের বিকল্প হিসেবে আলু এবং ক্ষেত্রবিশেষে ডিম দেওয়ার প্রচলন হয়। পরবর্তীতে মাংস থাকলেও সঙ্গে আলু এবং ডিম দেওয়ার রেওয়াজটা কিন্তু রয়েই গিয়েছে কলকাতার বিরিয়ানি রন্ধনপ্রণালীতে।
এই মোগলাই রসনা সংস্কৃতির হাত ধরেই পরবর্তীতে কলকাতার বুকে গজিয়ে উঠতে থাকে একের পর এক মোগলাই খানার হোটেল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং বনেদিয়ানায় সেরা চিৎপুর রোডের ‘রয়্যাল’। নাখোদা মসজিদের কাছে। মোগলাই কুইজিনের সেরা ঠিকানা। এদের রান্নার প্রতিটি পদই যাকে বলে সত্যিই রাজকীয়। নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই। তবে সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘কিন্তু সবার চাইতে সেরা’ অবশ্যই—চাঁপ। দোকানের মুখেই কাচাধারের আড়ালে বিশাল তাওয়ায় ভাজা হয়ে চলেছে সবসময়। তাওয়ার চারধারে চুপচুপে তেল-ঘি-মশলায় স্নানরত মাংসখণ্ড। থেকে থেকে রোগনের ছিটে। সঙ্গে সঙ্গে গর্বিত অভিমানে ফ্যাঁস করে উঠছে তাওয়ায়। রেয়াজি খাসির পাঁজরা ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করা হয় না আক্ষরিক অর্থেই ‘রয়্যাল’ এই চাঁপে। ধীরেসুস্থে প্রবেশ করুন দোকানে। গুছিয়ে বসুন টেবিলে। ‘ফরমাইয়ে সাহাব’। সামনে এসে দাঁড়াবেন পরিবেশনকারী। শ্বেতশুভ্র পোশাকের কাঁধে ততোধিক সাদা তোয়ালে। চিকেন আর মাটন—দু’ধরনের চাঁপই পাওয়া যায় এখানে। কোলস্টরেলের আতঙ্ক না থাকলে আপনি অর্ডার করুন মাটন চাঁপ। অনেকেই চাঁপের জুড়িদার হিসেবে বিরিয়ানি অথবা পরোটার কথা বলেন। প্রতিবেদকের পরামর্শ মানলে আপনার পছন্দ হোক নান। মানে নানরুটি। বাটার অথবা প্লেন। যে-কোনও একটা। একপাশটা ছিঁড়ে নিয়ে এক টুকরো ধোঁয়াওঠা চাঁপের সঙ্গে… মুখে পোরা মাত্র সমস্ত ইন্দ্রিয় জুড়ে রিনরিন করে ওঠা সুমনের গানের সেই লাইন—‘তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও, বহু ব্যবহার করা কোনও উপমায়…।’
রয়্যাল ঘোর কাটিয়ে এবার এগোনো যাক। চিৎপুর রোড ধরে সোজা এগিয়ে লালবাজার টপকে প্যারাডাইস সিনেমার সামান্য আগে ‘আলিয়া।’ মোগলাই খানার আরেক সাধনস্থল। রয়্যালের মতোই এদেরও সবকটি পদই অনবদ্য এদের নিজস্ব গবেষণাগারে। তবে এদের বিশেষত্ব এমন একটি পদে যা বোধহয় কলকাতার আর কোনও মোগল বিপণিতেই পাওয়া যায় না। ‘থাল্’ অর্থাৎ মুর্গ মুসল্লম। আস্ত জাফরান রঙা ভাজা একটা মুরগির পেটের মধ্যে সুগন্ধী মশলা আর ডিমের পুর। এককথায় লাজিজ্! জনশ্রুতি (সত্যিমিথ্যে যাচাই করবার সুযোগ নেই), দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সবিশেষ প্রিয় ছিল এই পদটি। ডিমের বদলে মুসল্লমের মধ্যে নাকি পুরে দেওয়া হত একটি মুরগিছানা। আলিয়ায় অবশ্য সেরকম কিছু হয় না। পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি অসামান্য এই পদটিতে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণটি কিন্তু বিপুল। বেশিরভাগ মোগলাই আইটেমের মতো বেশ খানিকটা গুরুপাকও বটে। নেহাৎই ভীম, খালি, গামা বা বকরাক্ষসের ভাইভাতিজা না হলে অথবা দলে নিদেনপক্ষে তিন-চারজন না থাকলে একা আস্ত একটা মুর্গ মুসল্লম ট্রাই না করাই ভাল। এরপর পাঠকের ইচ্ছে।
আলিয়া থেকে বেরিয়ে উলটো ফুটে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। রাস্তা টপকে ঢুকে পরুন চাঁদনি চকে। চাঁদনি অঞ্চলের একদম পিছনদিকে সাবির। যাকে জিজ্ঞেস করবেন দেখিয়ে দেবে। এতক্ষণ ধরে মোগলাই রান্নার গুরুপাকের কথাই বলছিলাম। আসুন এবার একটি সুপাচ্য কুইজিনের সন্ধান দিই। সাবিরের রেজালা। গুরুপাক খানা খেতে খেতে একঘেয়েমিতে ভোগা এবং যারপরনাই বিরক্ত বাদশা জাহাঙ্গির তার খাস বাবুর্চিকে একবার একটি সহজপাচ্য পদ বানাতে আদেশ দেন। যার নিটফল রেজালা। সামান্য ঘি, একচিলতে জাফরান, বাকি মশলা বলতে গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা (অল্প), শা-মরিচ, চারমগজ, তালমাকনা, পোস্ত, পেঁয়াজ, রসুন… কোটা, বাটা এবং গোটা। ঘিয়ে সাদা রঙের দইয়ের সুপের মধ্যে ভাসমান গোটা একটা শুকনো লঙ্কা আর মাথা উঁচিয়ে ভেসে থাকা গোল পেঁয়াজ। মাঝখানে তুলতুলে সোনালি মাংসখণ্ড। একটা নলির টুকরো ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। বাকিটা জাদুবাস্তব! দু’রকম রেজালাই পাওয়া যায় সাবিরে। চিকেন এবং মাটন। তবে খেলতে হলে মাটনের ময়দানেই খেলা ভাল। মাটনের পাশে চিকেন রেজালা, যেন হিমালয়ের পাশে অযোধ্যা পাহাড়। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে কিছুদিন আগে আমার দুই খাদ্যরসিক লেখকবন্ধু শ্রীসত্যবান মিত্র ও উল্লাস মল্লিক, সাবিরে খেতে গিয়ে এবং ফিরে এসে বিস্তর অভিযোগ জানিয়েছিলেন। খাবারের মান নাকি ভীষণভাবে পড়তির দিকে। বহুদিন হল যাওয়া হয়নি ওদিকটায়। তবু নিজের চোখে অথবা চেখে না দেখে চূড়ান্ত মন্তব্য করা উচিত নয় কখনওই। কিন্তু বন্ধুদ্বয়ের কথায় ন্যূনতম সত্যতা বা সারবত্তা থাকলেও ব্যাপারটা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক। একই সঙ্গে মর্মান্তিক।
চাঁদনি মার্কেট থেকে একটু দূরেই এলিট সিনেমার উলটোফুটে রাস্তার ওপর আমিনিয়া। আমিনিয়া মানে একটুকরো শৈশব। অনেক অনেক স্মৃতি। বাবা-মা’র সঙ্গে নিউমার্কেটে পুজোর বাজার সেরেই নেক্সট স্টেশন আমিনিয়া। পরতে পরতে খুলে যাওয়া লাচ্ছা পরটা আর ভুনা গোস্ত! দুধসাদা চিনেমাটির প্লেটে চারধারে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে থাকা সোনালি লালচে তেলের সীমারেখা। মাঝখানে চাপধরা জমাট মাংস। সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে লেবুর রসে জারিয়ে রাখা শশা-পেঁয়াজ-গাজর আর টম্যাটোর সালাদ। ভাবামাত্র এই এত বছর বাদেও নাকে সেই স্বর্গীয় সুবাসের ঝাপটা। জিহ্বায় তরল বন্যা। অহো!
সেই চিৎপুর থেকে ধর্মতলা। বলি অনেক তো হল এদিকটায়। চলুন এবার এ চত্বরের মায়া কাটিয়ে এগনো যাক। পকেট বুঝে ধরে ফেলুন ট্যাক্সি অথবা কর্পোরেশনের উলটোদিকে গ্র্যান্ট স্ট্রিট থেকে শেয়ারের অটো। নেমে পড়ুন পার্কস্ট্রিট-মল্লিকবাজারের মোড়ে। দু’পা এগিয়েই নিউ পার্কস্ট্রিটের ওপর সিরাজ। রসিকজনের মতে অওধি বিরিয়ানির সেরা ঠিকানা। জাফরান, গোলাপজল, ক্যাওড়া, জায়ফল-জয়িত্রি আর ঘিয়ের পাঁচমিশেলি বেহস্তের খুশবু। জুঁইফুলের মতো সাদা আর কাঁচাসোনা রঙের আধ আঙুল লম্বা সুগন্ধি বাসমতী চাল। পেল্লায় এক টুকরো নরম মাংস। সঙ্গে বড় একটা জাফরান রঙা আলুর টুকরো আর সেদ্ধ গোটা ডিম। চামচের বদলে হাতই ভাল। মুখে পড়ামাত্র—‘ইরশাদ, ইরশাদ!’
ইদানীং পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্টসের ওপর আরসালান বা ট্রামডিপোর গায়ে জিশান, সিরাজের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাগ বসালেও সিরাজ সিরাজই। বনেদিয়ানার ঠাটবাট নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে মল্লিকবাজারের মোড়ে, ঠিক সেই কবিতার মতো। ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে…।’
তবে রসিকজনেরা যতই সিরাজকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিন না কেন, এই অধমের মতে অওধি অর্থাৎ লখনওভি বিরিয়ানির সেরা ঠিকানা রহমানিয়া। কোনও চ্যালেঞ্জে যাব না। সিরাজ, জিশান, আরসালানের মতো নামীদামি রেস্তোরাঁর দাপটে অনেকটাই ব্রাত্য হয়ে গেছে প্রাচীন এই খাদ্যপ্রতিষ্ঠানটি। এ জে সি বোস রোডের ওপর সিরাজের লাগোয়া এই হোটেল। ‘ওমুক হোটেল তমুক রেস্তোরাঁয় খেয়ে এলুম’—ব্র্যান্ড কনশাসনেসের এই হ্যাঙওভারটা যদি কাটিয়ে উঠতে পারেন, তা হলে সাহস করে একদিন ঢুকেই পড়ুন রহমানিয়ায়। দুধারের দেয়ালে টাঙানো সচিত্র অওধি বিরিয়ানির ইতিহাস। দেখতে দেখতে বিরিয়ানির সঙ্গে অর্ডার করুন এদের বিখ্যাত মাটন কোর্মা। মুখে দিলেই প্রতিবেদকের দাবির সারবত্তা প্রমাণিত হবে। আর হ্যাঁ, শেষপাতে চেয়ে নিন ফিরনি। বাঙালি পায়েসের মোগলাইতুতো বোন। গুঁড়ো আধভাঙা চাল আর জমাট ক্ষীরের তৈরি গোলাপ জলের সুগন্ধ ডেজার্ট। প্রথমবার কাশ্মীর দর্শনের অভিজ্ঞতায় বিস্ময়স্তব্ধ সম্রাট জাহাঙ্গিরের ভাষায় বলে উঠতেই হবে ‘আগর ফিরদওস ওয়া রহি জমিনস্ত্/হামিনস্তু হামিনস্তু হামিনস্ত্’। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানেই, তা এখানেই!
এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি একসময় মোগলাই খানার আরও দু’টি উমদা ঠিকানা ছিল কলকাতায়। বছর দুয়েক হল পুরনো ঠিকানা বদলে উলটোফুটে যেখানে স্থানান্তরিত হয়েছে সিরাজ, সত্তর দশকে ঠিক সেখানটাতেই ছিল সোসাইটি হোটেল। কার চাঁপ সেরা? সোসাইটি না রয়্যাল? এ নিয়ে বিপুল তর্ক ছিল স্পষ্টতই দু’ভাগে বিভক্ত মোগলাই খাদ্যপ্রেমীদের মধ্যে সে সময়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি কোনও অজ্ঞাত কারণে (অনেকের মতে শরিকি বিবাদে) বন্ধ হয়ে যায় মোগলাই খানার বেতাজ বাদশা এই সরাইখানা।
দ্বিতীয়টি আমজাদিয়া। পুরনো কলকাতায় মোগলাই খাদ্যবিলাসের আরেক অবশ্য গন্তব্য তীর্থস্থল। শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে নেমেই ঠিক মির্জাপুর অধুনা সূর্য সেন স্ট্রিটের মোড়ে। সিরাজ, সোসাইটির এ শহরে পা রাখার অনেক আগে থেকে কাচ্চি এবং পাক্কি, লখনউ এবং হায়দ্রাবাদি দু’ ধরনের বিরিয়ানির আঁতুরঘর। ছেলেবেলায় বেশ কয়েকবার গেছি বাবার সঙ্গে। এখনও মনে আছে দোকানের বাইরে এবং ভিতরের দেয়ালজোড়া সাদা চিনেমাটির টুকরোর ম্যুরালে মুগল শিল্পকলার কারিকুরি। বড় বড় থাম। সার সার টেবিল, মার্বেলের স্ল্যাব বসানো। ঘি-জাফরান-চর্বিদার খাসিগোস্তের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। টেবিলে বসলেই পরিবেশক উসমান চাচা, বাবার পরিচিত, সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতেন, “ক্যা দাদা, কাচ্চি না পাক্কি?” অর্থাৎ আমজাদিয়ায় যখন এসেছে তখন কাচ্চি বা পাক্কি, বিরিয়ানি খাবেই। এতটাই প্রত্যয় প্রশ্নের মধ্যে। সমগ্র কলকাতাবাসীর দুর্ভাগ্য ষাটের দশকের প্রায় গোড়ার দিকেই বন্ধ হয়ে যায় আমজাদিয়া। আজকের প্রজন্ম চাখতেই পারল না কাচ্চি আর পাক্কি বিরিয়ানির স্বাদ। আফশোস! কিন্তু শুধুমাত্র অতীতকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলেই তো চলবে না। তাই চরৈবতি চরৈবতি। বলি কি গোমাংসে যদি আপত্তি না থাকে তা হলে আপনার জন্য এ শহরে অপেক্ষা করছে আরও কয়েকটি স্বর্গীয় রসনার ঠিকানা। তার মধ্যে অবশ্যই একনম্বরে আসবে নিজাম। আর তাদের এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড— ‘বিফ রোল।’ কলকাতা কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের ঠিক উলটোদিকে প্রায় নিউমার্কেটের গা ঘেঁষে এই অত্যাশ্চর্য রোল বিপণি। বিফ রোল। কাগজে গোল করে মোড়া মুচমুচে লাচ্ছা পরোটা, খাঁটি বনস্পতিতে ভাজা, মধ্যে নরম শিককাবাবের টুকরো। সঙ্গে ঝিরঝিরে করে কাটা পিঁয়াজের রিং। অল্প কাঁচালঙ্কা কুচি, গোলমরিচের গুঁড়ো আর সামান্য ভিনিগার অথবা পাতিলেবুর যোগ্য সংগত। ব্যস, আজকাল চারদিকে গজিয়ে ওঠা রোল সেন্টারগুলোর মতো হাবিজাবি চিলি বা টম্যাটো সস—নৈব নৈব চ। কামড় বসানোমাত্র মুখ দিয়ে একটি কথাই বেরিয়ে আসতে বাধ্য— ‘সাধু, সাধু!’ বাকিটা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সাধ্যের অতীত। এই বিফ রোলেরও কিন্তু একটা বিচিত্র ইতিহাস আছে। চল্লিশের দশক। ব্রিটিশ আমল। কলকাতা ময়দান কাঁপাচ্ছে দুর্ধর্ষ মহামেডান স্পোর্টিং। কালে খাঁ, বাচ্চি খাঁ, জুম্মা খাঁ, নুর মহম্মদ, হাফেজ রশিদ… বিপক্ষের ত্রাস এক সে এক কিংবদন্তি ফুটবলার সব। গোরাদের হারিয়ে পর পর পাঁচবার কলকাতা ফুটবল লিগ বিজয়ী প্রথম স্বদেশি টিম। আনন্দে আত্মহারা কাজী নজরুল আস্ত একটা কবিতাই লিখে ফেলছেন— ‘এ যে লীগ বিজয় নয় রে ভাই, দিগ্বিজয়’। দলের প্রতিটা খেলা দেখতে সমর্থকদের ভিড় উপচে পড়ত ময়দানে। খেলা ভাঙার পর তারাই দলে দলে এসে ভিড় জমাতেন নিজামে। বিখ্যাত পরোটা আর কাবাবের লোভে। স্বাভাবিকভাবেই দোকানে একসঙ্গে অত লোকের জায়গা করে দেওয়া সম্ভব হত না দোকান মালিকদের পক্ষে। কিন্তু খদ্দেরদের সকলেরই চাই কাবাব-পরোটা। ফলে সময়ও লাগত প্রচুর। সঙ্গে উপরি পাওনা অত্যুত্সাহী এবং উগ্র সমর্থকদের বিশৃঙ্খলা, হৈ হট্টগোল। অবস্থা সামাল দিতে এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করলেন কর্তৃপক্ষ। পরোটাকে গোল করে কাগজের মোড়কে মুড়ে ভেতরে পুরে দেওয়া কাবাব আর পেঁয়াজের টুকরো। ধরিয়ে দেওয়া কাস্টমারের হাতে হাতে। ব্যস! সমস্যার সমাধান এক মুহূর্তে। জন্ম নিল ভুবনবিখ্যাত বিফ রোল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলে আসছে সমানে। তবে বেশ কয়েক বছর হল মালিকানা বদল হয়েছে নিজামের। নতুন কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ে কেমন যেন একটা কর্পোরেট কর্পোরেট চেহারা নিয়েছে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠান। ঝকঝকে এসি রেস্তোরাঁ। কাচের দরজায় টাঙানো ‘নো-বিফ’ প্ল্যাকার্ড। পুরনো কৌলীন্য আর বনেদিয়ানার গৌরব অনেকটাই অতীত এখন। বিফের চেয়ে মাটন আর চিকেনের বিভিন্ন পদকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইদানীং। তবুও পিছনদিকে একফালি জায়গায় পুরনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে এখনও। এসি নেই। পুরনো কাঠের চেয়ার টেবিল। তবু ওখানেই যান। দেখেচেখে নিন প্রায় বিলুপ্ত এই ঐতিহাসিক রোল-সভ্যতাকে। পুরোটা ‘নো বিফ’ জোনে চলে যাওয়ার আগেই।
নিজামের ঠিক গায়েই আরেক আদি বিফ রোলের হোটেল। বিহার। কৌলীন্য বা নামডাকে নিজামের তুলনায় খানিকটা ফিকে পড়ে গেলেও খাবারের মান স্বাদে-গন্ধে কিছুমাত্র কম নয়। জানিয়ে রাখা দরকার শিককাবাব ছাড়াও সুতি-কাবাব, শাম্মী-কাবাব, রেশমি-কাবাব সহ একাধিক প্রাণহরা কাবাবের ঠিকানা এই নিজাম এবং বিহার। তবে সবার সেরা ক্ষিরি-কাবাব। গরম পরোটার মধ্যে গুঁজে দেওয়া ছোট ছোট নরম কচকচে দুঘবাঁটের টুকরো। কাগজের মোড়কটা ছিঁড়ে স্রেফ একটা কামড়। বাকিটা? মাশাআল্লা!
এবার মিশন মধ্য কলকাতা। এন্টালি অঞ্চল। মৌলালি মোড় থেকে সি আই টি রোড ধরে বিরশুলহাট বা ফুলবাগান বাসস্টপ। পুরো ফুটপাত আর গলি জুড়ে বিশাল চামড়ার হাট। জুতো, চপ্পল, ব্যাগ, বেল্ট… আরও কত কিছু। উলটোফুটে মেহদিবাগানের গলি। সংখ্যালঘু মহল্লা। অপরিষ্কার, ঘিঞ্জি, ভিড়ভাট্টা, হই হট্টগোল… ব্যাপারগুলোকে মাথা থেকে ঘণ্টাখানেকের জন্য হাটিয়ে দিতে পারলে ঢুকে পরুন এলাকায়। যে কাউকে জিজ্ঞেস করুন কায়ুম বা জম্জম্ কোথায়। অত্যন্ত সহৃদয়, আন্তরিক মানুষজন সব। যে কেউ বাতলে দেবেন বিশদভাবে। গলি তস্য গলির মধ্যে প্রথমে কায়ুম। শ’দুয়েক মিটার বাদে ইসমাইল স্ট্রিটের গলিতে জম্জম্। বিফ নির্ভর মোগলাই খানার কলকাতা সেরা দুই হোটেল। এদের বিরিয়ানি থেকে শুরু করে চাঁপ, ভুনা, কোফতা, প্রতিটি আইটেমই এককথায় দুরন্ত। তবে র্যাঙ্কিং নাম্বার ওয়ান অবশ্যই জমজমের বিফ-স্টু। স্টু বলতে আমরা সাধারণত ট্যালটেলে ঘোলাটে সাদা রঙের একটা কিছু বুঝি। এদের বিফ-স্টু কিন্তু মোটেই সেরকম নয়। লালচে সুগন্ধী মশলাদার ঘন ঝোল। সঙ্গে নান, তন্দুরি বা রুমালি রুটির যে-কোনও একটা। ঝোলে ডুবিয়ে… জাস্ট কোনও কথা হবে না কাকা।
এছাড়াও কায়ুম বা জমজমের আরেকটা পদের কথা উল্লেখ না করলে এদের রন্ধনশৈলীর প্রতি অবিচার হবে বোধহয়। আরবি হালিম। পাঁচমিশেলি ডাল, ঘি, কাবাবচিনি, এক নম্বর পাঞ্জাবি গম, দালিয়া, অজস্র ধরনের এক্সক্লুসিভ মশলার মিশ্রণে তৈরি হয়ে এই অমৃত পদ। পাওয়া যায় একমাত্র রমজানের মাসে। সারাদিনের উপবাসব্রত বা রোজা ভাঙার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ডেলিকেসি। ক্লান্তি অপহরণকারীও বটে। চিনেমাটির পিরিচভর্তি, গরম গরম, ওপরে ভাসমান লালচে ভাজা পিঁয়াজ, ধনেপাতার কুচি আর রোগনের ছিটে। তবে অতুলনীয় এই খাদ্যবস্তুটি একমাত্র রমজানের মাসেই পাওয়া যায়। তাও আবার সন্ধেবেলায়। চাহিদা প্রচুর। তাই ইচ্ছে থাকলে বিকেল বিকেল পৌঁছে যান মেহদিবাগানে। দেরি করলে চেখে দেখার সুযোগ ফসকে যেতে পারে। এখানে জানিয়ে রাখি আরসালান, সিরাজ, রয়্যাল, জিসান সহ কলকাতার অন্যান্য নামী মোগলাই রেস্তোরাঁগুলোও বছরের এ সময়টা মাটন হালিম বানিয়ে থাকে। সেসবও তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় অনবদ্য। তবে ওই যে বললাম মাংস হিসেবে হালিমের সেরা উপকরণ বিফ। তবে একান্তই আপত্তি থাকলে মাটনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারেন। কী আর করা যাবে।
বছর চল্লিশ আগেকার কথা। কলকাতা শহরে ধুন্ধুমার শীত পড়ত তখন। গ্রিন হাউজ এফেক্ট বা এল-নিনোর নামও শোনেনি কেউ। মনে আছে এইরকম এক শীতের ভোরবেলায় সূর্য ওঠার অনেক আগে অভিন্নহৃদয় বন্ধু হায়দর আলি নস্কর ওরফে কোচনের আধভাঙা স্কুটারের পেছনে চেপে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেছিলাম জাকারিয়া স্ট্রিট। নাখোদা মসজিদের পাশের গলিতে। সার সার হোটেল। আধো কুয়াশামাখা অন্ধকার। প্রতিটা হোটেলের সামনে লাইন দিয়ে রাখা ছোট বড় স্টেইনলেস স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের ক্যান। তীব্র কৌতূহল হল। “ব্যাপারটা কী?” প্রশ্ন করলাম কোচনকে। “সে কথা পরে হবে। আগে এগোই চল।” বলেই হনহন করে হাঁটা লাগাল কোচন। খানিকটা এগিয়েই একটা হোটেলের সামনে পুরনো সাইনবোর্ডে লেখা—‘সুফিয়া’। “এলাকার মধ্যে এটাই বেস্ট। চল সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। এরপর ভিড় বেড়ে যাবে।” কোচনের কথাই সত্যি। ইতিমধ্যেই আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে লোকজন ভিড় জমাতে শুরু করেছে দোকানের সামনে। ক্যানের মালিকরাও এসে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করেছেন লাইনে। ভোরের আজান পড়ামাত্র ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল রোলার গেটটা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই মুহূর্তের মধ্যে চোঁ চাঁ টেনে দৌড় লাগাল দোকানের মধ্যে। হাতে কোচনের হ্যাঁচকা টান। পড়ি কি মরি করে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়া গেল একটা কাঠের বেঞ্চিতে। “এক নাহারি, এক পায়া, আট ডালপুরি।” বেয়ারা এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এক নিশ্বাসে অর্ডার করল কোচন। অর্ডার নিয়ে চলে গেল বেয়ারা। আমি মুখ ঘোরালাম দরজার দিকে। ততক্ষণে গেটের সামনে ঢিমে আঁচের উনুনে এনে বসানো হয়েছে পেল্লায় সাইজের দুটো হাঁড়ি। দু’-দুজন কর্মচারী গোল হাতায় করে লাইনে খদ্দেরদের ক্যানে ঢেলে দিচ্ছে তরল মতো একটা কিছু। ওপরে পাতিলেবু চিপে ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঁচালঙ্কা আর ধনেপাতার কুচি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাদের টেবিলেও বড় বড় দুটো পিরিচে সাজিয়ে এসে পড়ল। ওই একই তরল খাদ্যবস্তু। টকটকে লালচে সুপের মতো চেহারা। ওপরে ভাসমান ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কার কুচি। পাশে একটুকরো পাতিলেবু। আরেকটা প্লেটে ফুলকো ফুলকো আটখানা ডালপুরি। পাতিলেবু চিপে, ধোঁয়াওঠা ঝোলে চুবিয়ে একটুকরো দাঁতে কেটেই বাকরহিত হয়ে গেছিলাম কিছুক্ষণ। সে কি সুতার। জাস্ট হেভেনলি! আর স্বাদ? নোনতা স্বাদের কোনও খাবারকে কি মধুর বলা চলে? কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই এতগুলো বছর বাদেও ‘মধুর’, এই শব্দটা ছাড়া আর কোনও উপমা মাথায় আসছে না। কোচনের কাছেই জেনেছিলাম দুটো পিরিচে একটার নাম নাহারি, অন্যটা পায়া। সারারাত ঢিমে আঁচে ফুটিয়ে বানানো হয় এই বিস্ময় পদযুগল। রান্নার পদ্ধতি আর মশলাপাতি প্রায় একইরকম। ফারাকের মধ্যে পায়ার উপকরণ গোরু অথবা খাসির ঠ্যাং আর নাহারিতে লাগে বাত্তি (পেটের দিক) অথবা করেলির (হ্যামস্ট্রিং) নরম মাংস। ডালপুরির স্বাদও একেবারে অন্যরকম। সাধারণত ময়রার দোকানে আমরা যে ডালপুরি খেয়ে থাকি তার সঙ্গে মেলে না একদম। ভেতরে ডালের বদলে ছাতুর পুরের সঙ্গে মেশানো পিঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কার ছোট ছোট কুচি। ঘি বা ডালডার বদলে ব্যবহার করা হয় সাদা তেল। ফুলকো, কুড়মুড়ে, হাতেগরম। খেতে অন্যরকম কিন্তু স্বাদে অনবদ্য। তবে মোগলাই খানার বারোমাস্যায় হালিমের মতো পায়াও এ শহরে ক্ষণিকের অতিথি। অনেকটা সাইবেরিয়ার পরিযায়ী হাঁসের মতো। শীতকালে মাত্র মাসতিনেকের জন্য দেখা দিয়েই উধাও শহর থেকে। তা হলে আর কী? একপেট খিদে আর এক জিভ জল নিয়ে ‘বদর, বদর’ বলে বেরিয়ে পড়ুন একদিন ভোরে পরিযায়ী পায়া সন্ধানে।
* আসলে মোগলাই কলকাতার বদলে এই প্রতিবেদনের শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল ‘অওধ-ই-কলকাতা’ অথবা ‘লখনওভি কলকাতা’। কারণ কলকাতায় নবাবি খানার জনপ্রিয়তার পিছনে মোগল সভ্যতার অবদান অতি সামান্য। কিন্তু মোগলাই শব্দটার বিপুল পরিচিতির কথা মাথায় রেখেই প্রতিবেদনের উপরোক্ত শিরোনামটিই বহাল রাখলাম।
১১. অন্য খাবার: কেয়ার অফ কলকাতা
অন্য খাবার। সত্যিই অন্যরকম। সবসময় নামী পরিচিত দোকান বা হোটেল রেস্তোরাঁ নয়, এরকম কত যে চেনা অচেনা খাবারের ঠিকানা মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে রয়েছে এ শহরের ফুটপাতে, ছোট ছোট হোটেলে, দোকানে, রাস্তার ধারে স্টলগুলোয়, তার ইয়ত্তা নেই। তাদের সবাইকে যে হাতের মুঠোয় ধরতে পেরেছি এরকম অসম্ভব দাবি করব না কখনওই। তবু যেটুকু পেরেছি তাই বা কম কী? সেইসব জানা অজানা রত্নভাণ্ডারগুলো থেকে খানিকটা নয় আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগই করে নিলাম। ক্ষতি কী?
‘ঝাল চানাচুর টাটকা হলে মুখের কথা বলা বন্ধ হয়…।’ সেই নব্বইয়ের দশকে লেখা অমোঘ এই গানের লাইনটা। একশো শতাংশ সত্যি। আজও। মুখের কথা বন্ধ করে দেবার মতো কয়েকটা চানাচুরের ঠিকানা আজও রয়েছে এই তিনশো টপকানো শহরে। মানিকতলার মোড়ে ছায়া সিনেমার গায়ে মোহন সাউয়ের দোকান। ঝাল, মাঝারি ঝাল, কম ঝাল, টকমিষ্টি …অজস্র ধরনের চানাচুর, চিপস, কচুভাজা, গাঁঠিয়া, ঝুরিভাজা আর ভুজিয়া পাওয়া যায় এ দোকানে। তবে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ডালমুট। চিপস, গাঁঠিয়া, বাদামের অনধিকার প্রবেশ নেই। স্রেফ ঝালঝাল মশলায় চান করা, ছাঁকা তেলে ভাজা, সোনার বরন মুচমুচে কুড়মুড়ে ছোলার ডাল। অপেক্ষা করে রয়েছে আপনার জন্য কাচের বয়ামে। ওপরে সামান্য পাতিলেবুর রস দু’-চার ফোঁটা, একচিমটে বিটনুন, ঠোঙাটা একবার ঝাঁকিয়ে নেওয়া ভাল করে… ব্যস! শুরু হয়ে গেল ঠাকুমার ঝুলি কিংবা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড! স্ন্যাকস আর টিটবিটস্ সর্বস্ব শহরে মোহন সাউ অ্যান্ড সন্স আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রায় বিলুপ্ত হতে বসা এই ডালমুট নামক সভ্যতা ও তার দলিল-দস্তাবেজকে। কতদিন পারবেন জানা নেই। তাই আজ যাচ্ছি, কাল যাব করলে শেষমেশ হয়তো হতাশ হতে পারেন। সুতরাং চটজলদি পৌঁছে যান মানিকতলার মোড়ে। এক ঠোঙা রূপকথা কিনে আবেশে আধবোজা চোখে চিবোতে চিবোতে হাঁটা লাগান শেয়ালদামুখো। পরের স্টপেজ শ্রীমানি বাজার। শ-দেড়েক বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়া এই বাজারের নীচে, সুকিয়া স্ট্রিটের ওপর তেলেভাজার দোকান। আলুর চপের মধ্যে পুরটা যদি ঠিকঠাক না হয় তা হলে চপের মজাটাই মাটি। কলকাতার বহু দোকানেই এই পুরটা ঠিকঠাক বানাতে জানে না। শ্রীমানি মার্কেটের আলুর চপ খেলে বুঝতে পারবেন আলুর সঙ্গে সঠিক মশলার মিশেল এই স্বাদকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আলুর চপের পাশাপাশি একই আসনে বসার যোগ্য এদের ধোঁকা আর বেগুনি। ওপরে পোস্ত ছেটানো মুচমুচে বেসনের আস্তরণ। ভেতরে ঢাকাই মসলিনের চাইতেও পাতলা করে কাটা লম্বা বেগুনের ফালি, যে শিল্পকর্ম অনেক নামী পাঁচতারা হোটেলের শেফদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে। একমুঠো মুড়ির সঙ্গে বর্ষাকালে… নাঃ থাক। লেখা গুলিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর বাকি রইল ধোঁকা। আধবাটা আর ফেটিয়ে ফেটিয়ে পেঁজা তুলোর মতো করে ফেলা ছোলার ডালে তৈরি হবে এই অসামান্য পদটি। ভাজা মৌরির মনোরম সুগন্ধ। ওপরটা অমসৃণ। দাঁতের চাপে ভেঙে কুচিকুচি মুড়মুড়ে ডালের কণা… বাকিটা পল সাইমনের ‘সঙ অফ সাইলেন্স!’ সন্ধের মুখে গেলে দেখবেন রামমোহন রায় রোড, দিনেন্দ্র স্ট্রিট, গলি গড়পার, হরিনাথ দে রোড, পীতাম্বর ভটচাজ লেন, বাদুড়বাগান, যুগিপাড়া, বৃন্দাবন মল্লিক লেন, ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন স্ট্রিট, কালু ঘোষ লেন, বলদেপাড়া… পাড়ার গিন্নিরা এসে ঠোঙায় করে ধোঁকা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। রাতে ডালনা হবে। ঘি, গরম মশলা আর সামান্য হিং দিয়ে। বেটার হাফের যদি রান্নার তাগবাগ থাকে তা হলে একঠোঙা কিনে নিয়ে সোজা পৌঁছে যান বাড়ি। ছুটিছাটার দিনে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের নেমন্তন্ন করে সত্যি সত্যিই ধোঁকা খাইয়ে দেওয়া যাবে।
তেলেভাজার দোকানের ঠিক উলটোফুটেই নন্দলাল ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স। নামজাদা সব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশে নামটা একটু মলিন হয়ে গেছে ঠিকই তবে উত্কৃষ্টতা আর গুণমানে কখনওই নয়। সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন। এখানে আপনার পছন্দের আইটেম হোক হিংয়ের কচুরি, সঙ্গে পাঁচফোড়নের সুগন্ধি মেশা নিরামিষ আলু কুমড়োর লাবড়া। শেষ পাতে রাজভোগ অথবা কমলাভোগ। ভেতরে ছোট্ট এতটুকু একটা তুলতুলে নরম ক্ষীরের পুর। আর কোনও বিশেষণের প্রয়োজন নেই। তবে সেরা মিষ্টির দোকানগুলোর তালিকায় মুহূর্তের মধ্যে আর একটা নাম যে যোগ হয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত। হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
এই দেখুন চানাচুর দিয়ে শুরু করে এ কোথায় চলে এলাম। তবে এরকম বারবারই হবে। প্রতিবেদনের শিরোনাম যেহেতু ‘অন্য খাবার’, তাই অন্যরকম একটা ছকভাঙা কায়দাই চলবে। ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাবে, চেনা রুট বদলে যাবে বারবার। কিচ্ছু করার নেই। সুকিয়া স্ট্রিট থেকে ফের শেয়ালদামুখো এগোলে শ্রীমানি বাজারটা যেখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার গা ঘেঁষে বাদুড়বাগান লেন। এখানেই একদম গলির মুখেই ছিল তিনকড়ি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ছিল মানে এখন আর নেই। তিনকড়ি মানে শুধুই কড়াপাকের সন্দেশ। আর কিচ্ছু না। বেশি নয় মাত্র আট দশ রকমের মিষ্টান্ন পদ। সব কড়াপাক। তার মধ্যে গোল মন্ডা, বরফি, গুঁজিয়া, আতা আর আম সন্দেশের স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে। বিজয়া দশমী, লক্ষ্মী পুজো আর ভাইফোঁটার দিন তৈরি হত চন্দ্রপুলি আর রাতাবি সন্দেশ। তিনকড়ি স্পেশাল। প্রতিদিন সন্ধে ছ’টা-সাড়ে ছটার মধ্যে শোকেস খালি। এলাকায় এতটাই চাহিদা ছিল তিনকড়ির মিষ্টির। শুধুমাত্র কড়াপাক সন্দেশের দোকান। শুধু কলকাতা নয় গোটা রাজ্যে আর কোথাও আছে অথবা ছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই। ষাটের দশকের শেষভাগে বন্ধ হয়ে যায় তিনকড়ি। এখানেও কারণ বাঙালির সেই চিরন্তন ব্যাধি: শরিকি বিবাদ।আজও যদি ওই এলাকায় প্রবীণ মানুষদের এ ব্যাপারে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেন তা হলেই তিনকড়ি উঠে যাওয়ার হা-হুতাশটা ভালরকম অনুভব করবেন। নিশ্চিত এ ব্যাপারে।
তিনকড়ির প্রায় গা ঘেঁষেই হিন্দুস্থানি চানাচুর ভুজিয়ার দোকানটা। নামগোত্রহীন। দাঁড়িয়ে পড়ুন দোকানের সামনে। লম্বাটে একটা টিনের একদিক খোলা পাত্রে থরে থরে সাজিয়ে রাখা জুঁইফুল রঙা সাদা ছাঁকা তেলের চিঁড়েভাজা। ওপর থেকে ফোকাস মারছে তিনশো ওয়াটের একটা সি এফ এল লাইট (আগে বাল্ব জ্বলত)। চিঁড়েভাজার রঙটা জুঁইফুলের মতো লিখলাম বটে, আসলে ওটা হবে কুমোরটুলি থেকে সদ্য নিয়ে এসে মণ্ডপে অথবা বাড়িতে বসিয়ে দেওয়া বীণাপাণি ঠাকরুনের গাত্রবর্ণের মতো। সঙ্গে কারিপাতা, কড়া ভাজা বাদাম, ঝুরিভাজা আর একচিমটে বিটনুনের সঠিক মিশেল। চাইলে দোকান থেকে সেলোফেনের প্যাকেটে ভরে মোমবাতির আগুনে প্যাক করে দেবে কিন্তু আপনি ঠোঙাতেই নিন। তখনই খাওয়া শুরু করবেন না, প্লিজ। ঠোঙা হাতে ট্রামলাইন পেরিয়ে এপারে আসুন। সামনেই বিন্তুদের বাড়ির রোয়াক। পাড়ার বাকিগুলো সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে কবেই হারিয়ে গেছে। বিন্তুদেরটা কিন্তু টিকে আছে আজও। এই ছোট্ট একফালি রোয়াক জুড়ে কত স্মৃতি। বাড়ির সামনে হারিয়ে যাওয়া পাড়ার ছোট্ট পার্ক। কুমিরডাঙ্গা, চোর চোর… একটু বড় হয়ে চার দশ হাইটের ফুটবল। বিন্তু দুরন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ড। কাইজার স্ট্রিটের রেলমাঠে দ্রোণাচার্য বাঘা সোমের প্রিয় ছাত্র। পাড়ায় সবাই বলত বড় হয়ে ইন্ডিয়া খেলবে। একদিন মাঝরাত্তিরে গলায় দড়ি বেঁধে সিলিংয়ে ঝুলে গেল। বিন্তুদের দোতলায় ছোনুদা, পিন্টুদা, তপুদি… ছোনুদা স্কটিশ চার্চ স্কুল থেকে ন্যাশনাল স্কলার হয়েছিল। এখন ঘোর অপ্রকৃতিস্থ। একগাল সাদা দাড়ি। সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় আর ফিজিক্সের থিয়োরি আওড়ায়। মেজ ভাই পিন্টুদা। সত্তরের দশকে পিন্টুদার খোঁজে এলাকার পর এলাকা তোলপাড় করে ফেলেছিল গোটা উত্তর কলকাতার ছ’-সাতটা থানার পুলিশ। বীরভূমের কোনও একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ধরা পড়ে বছর সাতেকের কারাবাস। ঘেঁটে যাওয়া জীবনটা আর ঠিকঠাক হয়নি কখনওই। ছোট বোন তপুদি। বাগবাজারে ডাকের সাজের দুগ্গাঠাকুর দেখেছেন কখনও? তপুদিকে দেখতে হুবহু ওইরকম। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড দাপট আর প্রখর ব্যক্তিত্ব। লাল স্কার্ট আর সাদা শার্ট পড়ে দুটো কলাবিনুনি দুলিয়ে যখন ব্রাহ্ম গার্লসে যেত, পাড়ার সব লক্কার দল রক থেকে বেমালুম হাওয়া। পাড়ায় সমবয়সি বন্ধুদের রক্ষাকবচ ছিল তপুদি। এই অধমকে খুব ভালবাসত। মণিমেলার পিকনিকে চূড়ান্ত অবাধ্য আর ভয়ংকর রকম ব্যাদড়া এই এতটুকু একটা ছেলেকে ধমকে ধামকে জোর করে খাইয়ে দেবার দায়িত্বটা সর্বদাই বর্তাত তপুদির কাঁধে। সেই তপুদি শেষমেশ কিনা সাধিকা হয়ে গেল। পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ইয়া লম্বা সিঁদুরের টিকা কপালে। প্রতিদিন প্রচুর ভক্তসমাগম হয় বাড়িতে। কী একটা মা নামে যেন তপুদিকে ডাকে ভক্তরা। অবাক হয়ে মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে তপুদিকেই ডেস্টিনি এরকম একটা অবস্থানের জন্য নির্বাচিত করল!
যাকগে, হটান এসব পুরনো কথা। ফুটপাত পেরিয়ে সোজা হয়ে এসে বসে পড়ুন বিন্তুদের রোয়াকে। ভয় নেই, উত্তর কলকাতার রোয়াকে এখনও অচেনা কেউ এসে বসলে বাড়ির লোকেরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় না। তাই জুত করে বসুন। ঠোঙা খুলে তারিয়ে তারিয়ে খান দুনিয়ার সেরা চিঁড়েভাজা। কোনও নামী ব্র্যান্ডের ঝলমলে প্যাকেজিং বা অমুক তমুক ভুজিয়াওয়ালার দোকান এর ঠিকানা দিতে পারবে না। রোয়াকে বসেই খান, কারণ আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে একটা বাচ্চা ছেলে এই রোয়াকে বসেই তার বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেত দুনিয়াসেরা এই চিঁড়েভাজা। বিন্তুদের রোয়াকে বসে খেলে স্বাদটা যে আরও কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
একটু এগিয়েই রাজাবাজার। রাস্তার ওপর দাঁড়ানো সার সার ঘোড়ার গাড়ি। মোড়ের ওপর সস্তা মুসলমান হোটেল। সামনে লম্বাটে মাটির উনুনে কুচো কয়লার গনগনে আঁচে ঝলসানো হচ্ছে শিককাবাব। মশলা মাখানো আধপোড়া মাংসের সুবাসে ম ম করছে চারপাশ। দাম মাত্র সাত পয়সা। সেটা সত্তর কি একাত্তর সাল। মনে আছে প্রথম নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণের জিভেখড়ি এখানেই। তখন নিয়মভঙ্গের পর্ব চলছে চারদিকে। এতদিনে অনেককিছু পালটেছে। সেই টালি খোলার দোকানের সামনে আজ ঝকঝকে গ্লো-সাইনবোর্ড। কাবাবের দাম সাত পয়সা থেকে বেড়ে আট টাকা। তবু সেই নিয়মভঙ্গের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে হোটেলটা।
উত্তরের মায়া কাটিয়ে চলুন এবার যাওয়া যাক মধ্য কলকাতায়। লেনিন সরণি ধরে সোজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের মোড়। হাতের বাঁদিকে মোড়ের মাথায় ছোট্ট দোকান। তাকে সাজানো রকমারি ছোলাভাজা, বাদাম আর চানাচুরের বয়াম। তবে প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট পট্যাটো চিপস। দোকানের সামনে বিশাল লোহার কড়াইয়ে ফিনফিনে পাতলা করে কাটা আলুর চাকা, গনগনে আঁচে, ডুবো তেলে ভাজা হয়ে চলেছে অনবরত। ভেজে তোলার পর প্রত্যেকটা চাকা দেখতে ঠিক হলুদ ডানা ছোট ছোট প্রজাপতির মতো। বহুকাল আগে পুজোর মুখে মুখে আসত আমাদের শহরে। প্রত্যেকবার দোকানটার সামনে দিয়ে গেলেই পুরীর ঢেউয়ের মতো লাফ দিয়ে ফিরে আসা কৈশোর যৌবন। সে এক অলৌকিক সময়। পঁচাত্তর কিংবা নব্বই পয়সায় ‘ফাইভ মেন আর্মি’, ‘ড: জিভাগো’ বা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’। মেট্রো, গ্লোব, লাইট হাউস, নিউ এম্পায়ারে। ষাট পয়সায় ময়দানের সবুজ গ্যালারিতে ফুটবল। পিন্টু, শ্যাম, সুরজিৎ, হাবিব, মজিদ বাসকারের সোনা বাঁধানো বুটের জাদু। দেখে ফেরার পথে অবধারিত স্টপেজ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। কাগজের ঠোঙায় চিপস। ওপরে ছড়ানো বিটনুন আর লঙ্কাগুঁড়োর ছিটে। চার-পাঁচজনের চাঁদা মেলানো পয়সায়। ভাগযোগ করে খেতে খেতে বাড়ি ফেরা। তখন কলকাতার দোকানগুলোর সামনে অমুক কুড়কুড়ে, তমুক মুড়মুড়ের ঝাঁ চকচকে লাল-নীল-সবুজ প্যাকেটগুলো ঝোলানো থাকত না। সুতরাং পটাটো চিপস মানেই সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। সমার্থক দুটো শব্দ। বিশ্বায়নের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সটান দাঁড়িয়ে আছে আজও। টম্যাটো, তন্দুরি বা চিলিসস মার্কা নকল স্বাদগন্ধের প্রলোভন বা হাতছানি নেই। নেই বিজ্ঞাপনের চমক বা জাগলারি। উপকরণ বলতে খাঁটি তেল আর টাটকা আলু। ‘যে চিনবে সে কিনবে’—শুধুমাত্র এই আপ্তবাক্যটিকে সম্বল করে আজও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পুরনো ক্রেতার দল। সেটাই বা কম কিসে।
হাজরা মোড় থেকে রাসবিহারীমুখো এগোলে পরের স্টপেজ উজ্জ্বলা সিনেমা। সিনেমা হল উঠে গেছে কবেই, রয়ে গেছে উজ্জ্বলার চানাচুর। ছোট্ট এতটুকু পায়রার খোপের মতো দোকান। যখনই যাওয়া যাক না কেন নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে পঁচিশজনের লাইন দোকানের সামনে। ওজন করে বাদামি রঙের ঠোঙায় পুরে তুলে দেওয়া হচ্ছে হাতে হাতে। নো পলিপ্যাক বিজনেস। পিয়োর বাদাম তেলে ভাজা। মোটা সেঁউভাজা, চিনেবাদাম আর ডালের সঠিক মেলবন্ধন। খাওয়ার পরমুহূর্তে পোয়াপাত্তি দুধের চা বা এক গ্লাস জল যে-কোনও একটা খেয়ে ফেলুন ঢকঢক করে। একফোঁটা অম্বল হবে না। আর ঠিক এই কারণেই আমার সোমরসিক কিছু বন্ধুর কাছে আজও উজ্জ্বলার চানাচুরের কোনও বিকল্প নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই মহার্ঘ খাদ্যপদটির আকর্ষণ কিছুটা কম। ঝালমশলাহীনতার কারণে। অবশ্য তাতে উজ্জ্বলার মাহাত্ম্য এতটুকুও কম হচ্ছে না। অতএব শুভস্য শীঘ্রম। ডেস্টিনেশন উজ্জ্বলা।
চানাচুর তো অনেক হল। এবার ‘একটু ভাল চা পাওয়া যায় কোন দোকানে।’ চা মানে লাল চা। কালীঘাট পার্কের গায়ে যোগেশ মাইমের সামনে ফুটপাতে ছোট্ট চায়ের দোকান। চা-পাতা, গরম জল আর চিনির পারফেক্ট ব্লেন্ড। চাহিদা অনুযায়ী লেবু আর মশলা মিশিয়ে দেওয়া হয়। তবে খেতে হলে প্লেন লিকারের বিকল্প নেই। যদিও এটা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত মতামত। এবার আপনার মর্জি। কালীঘাট ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা লাল চায়ের ঠেক রয়েছে পাশাপাশি ভবানীপুর আর লেক মার্কেট অঞ্চলে। এর মধ্যে সামথিং স্পেশাল দেশপ্রিয় পার্কের গায়ে দাদাবউদির লাল অথবা লেবু চা। না খেলে সত্যিই মিস করবেন।
বালিগঞ্জ বিজন সেতু ধরে সটান নেমে এসে গড়িয়াহাটের দিকে এগোতে না এগোতেই হাতের বাঁ পাশে একটা হাতে ঠেলা গাড়ির ওপর বিশাল ঝুড়ি। ওপরে আধখোলা প্লাস্টিকের চাদরের আড়াল থেকে উঁকি মারছে গোল গোল ফুচকার ঘিয়ে-রঙা মাথা। পাশে চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের হাঁড়িতে গোলা তেঁতুল জল (আগে স্টিলের জায়গায় থাকত মেটে হাঁড়ি)। একপাশে ডাঁই করে রাখা সেদ্ধ মটর আর আলু। কুচোনো কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা আর অন্তত পাঁচ-সাত রকম মশলার বাটি। গাড়ি ঘিরে ভিড়। বেশিরভাগই মহিলা। আট থেকে আশি। সবার হাতে ছোট ছোট শালপাতার বাটি। দোকানি, মাঝবয়েসি। আলু-মটর, বিটনুন, মশলা, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা সবকিছু নিপুণ হাতে মেখে হাঁড়ির তেঁতুলগোলা জলটা ঘুলিয়ে নিচ্ছেন ফের একবার। কে বেশি ঝাল, কার ঝাল কম, জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন ওর মধ্যেই। অতঃপর ঝুড়িতে হাত গলিয়ে বের করে আনা ফুচকার পেটে আঙুলের চাপে ছোট্ট একটা ফুটো। ভেতরে পুরে দেওয়া মশলামাখা আলুমটরের পুর। অবিশ্বাস্য দ্রুত হাতে তুলে দিচ্ছেন পাতে থুড়ি শালপাতার বাটিতে। কিমাশ্চর্যম! ক্রেতারা সবাই আলাদা আলাদাভাবে তাদের পছন্দের স্বাদটা পাচ্ছেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের চূড়ান্ত নমুনা। অভিযোগের কোনও জায়গাই নেই। ক্রেতাদের চোখমুখের চেহারাই বলে দিচ্ছে অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলেছেন প্রত্যেকে। শেষপাতে একটা পুরঠাসা ফুচকা, তেঁতুলজল ছাড়া, ফাউ হিসাবে। চিবিয়ে শেষ করামাত্র শালপাতায় ঢেলে দেওয়া একটু তেঁতুলজল, ওপরে বিটনুন মশলার ছিটে (রিকোয়েস্টে রিপিটও করা হয়)। ‘সুরুৎ’—পরম পরিতৃপ্তির চুমুক একটা। অম্লায়েন সমাপয়েৎ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই পেট্রল পাম্প ছাড়াও আরও অন্তত কুড়ি থেকে পঁচিশটি সেরা ফুচকার ঠিকানা রয়েছে এ শহরে। গোলপার্ক, গড়িয়াহাট, রবীন্দ্র সরোবর, যাদবপুর, মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, থিয়েটার রোড আর বড়বাজার অঞ্চলে। সাধারণ ফুচকা ছাড়া দই-ফুচকা, বুঁদিয়া ফুচকা বা দহিবড়া ফুচকাও বানিয়ে থাকেন অনেক বিক্রেতা। সঙ্গে আরেক অমোঘ আকর্ষণ—চুরমুর। আধচটকানো ঝাল ঝাল মশলাদার আলুর সঙ্গে শুকনো ফুচকার পাপড়ির যুগলবন্দি। প্রতিটি মহিলার হার্টথ্রব। কোথায় লাগে উত্তমকুমার বা শাহরুখ খান। তবে সেরার সেরা ফুচকা আর চাট তথা চুরমুরের সেরা ঠিকানাটি কিন্তু উত্তর কলকাতায়, হেদোর মোড়ে। বৃথা বাক্যব্যয়ে অযথা সময় নষ্ট। সন্ধের মুখে মুখে পৌঁছে যান একদিন। শ্রবণ আর জিহ্বার বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাবে।
ঝালমুড়ি আর আলুকাবলি। অমর হয়ে আছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার গল্পে। এক সময় পাওয়া যেত পাড়ায় পাড়ায় বিশেষ করে উত্তর কলকাতায়। সন্ধেবেলায়, গলির মোড়ে মোড়ে। আজ বিলুপ্তপ্রায়। দু’-একটা ভাল ঠেকের কথা জিজ্ঞেস করলে অনেকেই মাথা চুলকোবেন। সে আলুকাবলি খেতাম বটে তিন-চার যুগ আগে হৃষিকেশ পার্কের গায়ে। লম্বাটে বেতের মোড়া ধরনের স্ট্যান্ডের ওপর চ্যাটালো ডালায় উঁচু করে সাজানো চাক চাক করে কাটা আলু আর সেদ্ধ মটর। গোল গোল, নিটোল। পাকা তেঁতুলের রস আর মশলায় জড়ানো, সামান্য একচিমটে বিটনুন আর লঙ্কাকুচি ছিটিয়ে, ‘চেরি অন কেক’-এর মতো আলুর মাথায় গোঁজা একটা ছোট কাঠি। শালপাতা আর তেঁতুল-মশলার গন্ধ মিলেমিশে একাকার… যেন স্বপ্ন। তারপর ‘সময় গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার’… পার্কের মাঠে কেষ্টিদার ফুটবল কোচিং ক্যাম্প, বুকসমান হাইটের লোহার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝালমুড়ি আর আলুকাবলিওয়ালা… সবকিছু মিলিয়ে গেছে ভোরবেলার অলীক স্বপ্নের মতো। কেষ্টিদার স্বপ্নের এবং মিনিমাগনার কোচিং ক্যাম্পে এখন ছেলেকে শচীন-সৌরভ বানানোর স্বপ্ন ফিরি করা হয়। চড়া দামে। গেটের সামনে আলুকাবলি আর ঝালমুড়িওয়ালার জায়গায় দাঁড়ানো গাড়িঠেলা ফুচকাওয়ালা। ক্রেতারা চাইলে তিনিই আলুকাবলি বানিয়ে দেন। কিন্তু ওই যে কথায় বলে—‘যার যেটা কাজ।’ ফুচকাওয়ালার বানানো আলুমটর মাখা কখনওই আলুকাবলির হাজার আলোকবর্ষের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারে না। তবে আমি হাল ছাড়িনি। গোটা কলকাতা তিল তিল করে ঢুঁড়ে বের করে ফেলেছি এক্সক্লুসিভ আলুকাবলি আর ঝালমুড়ির ঠিকানা। আর প্রদোষ সি মিটারের মতোই লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠেছি সোল্লাসে—“আছে! আছে!”
শেয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিটের আগের স্টপেজ কলেজ স্কোয়ার। বঙ্কিম চাটুয্যে স্ট্রিট ধরে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের মোড়ে রোজ বিকেলে এসে দাঁড়ান একজন। সেই লম্বাটে ধরনের মোড়া আর চওড়া গোল ঝাঁকা। চাক চাক সেদ্ধ আলু আর মটর… কোনও এক্সট্রা কায়দাবাজি নেই। সিম্পল, ওল্ড ফ্যাশনড, এথনিক অ্যান্ড এক্সক্লুসিভ আলুকাবলি। ঠিক সেই ছেলেবেলার মতো। আর কী চাই? তা হলে একদিন বেরিয়ে পড়ুন সেই ছেলেবেলা থুড়ি আলুকাবলির সন্ধানে।
এখনও পাওয়া যায়। চৌকোনা টিনের ঘেরাটোপে খোপে খোপে সাজানো সেদ্ধ আলু, সেদ্ধ ছোলা, কাঁচা ছোলা, কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ-শশা-টম্যাটো কুচি, সেঁউভাজা, বাদামভাজা আর চানাচুর, শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো আর দু’-চার রকম মশলা। ঘেরাটোপের মাঝখানে ফুঁড়ে ওঠা টিনের ড্রামভর্তি মুড়ি। পাশে দুটো শিশিতে তেঁতুলগোলা জল আর সরষের তেল। চাওয়া মাত্র মিলিয়ে মিশিয়ে, নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে তৈরি হবে সেই পুরনো ঝালমুড়ি। ঝাঁকানোমাত্র নাকে মশলা মাখা মুড়ির প্রাণকাড়া সুবাস! গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন যেখানটায় রবীন্দ্র সরোবরের গায়ে শেষ হচ্ছে, তারপর থেকে পুরো লেক চত্বরের রেলিং ঘেঁষে এরকম দু’-চারজন আছেন যারা বাপ-পিতেমোর ছেড়ে যাওয়া রিলে রেসের ব্যাটনটাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন আজও। অনেকটা সেই লাস্ট অফ দ্য টাইটানসের মতো। হালফ্যাশনের কায়দায় চাট-ভেলপুরির সঙ্গে ঝালমুড়ি নয়। শুধু শুধু এবং শুধুমাত্র ঝালমুড়ি। আদি এবং অকৃত্রিম। অভিযোগ শুধু একটাই। ঠোঙার বদলে যদি সেই সাবেকি কায়দায় কাগজের মোড়কে মুড়িয়ে দিতেন। বিক্রেতারা একটু ভেবে দেখবেন কথাটা।
ঝালমুড়ি নয়। মুড়িমাখা। ঝালমুড়ি গোত্রের হলেও স্বাদে অনেকটাই স্বতন্ত্র। মূলত বাদাম, সেঁউ, ছোলাভাজা আর দুর্দান্ত সুগন্ধি একটা চাটমশলা মিশিয়ে বানানো হয় এই মুড়িমাখা। একমাত্র অল্পস্বল্প সেদ্ধ আলুর টুকরো সরষের তেল ছাড়া পেঁয়াজ-শসা-টম্যাটো বা তেঁতুলজল কিছুই মেশানো হয় না। ফলে অনেকটা বেশি শুকনো আর ঝরঝরে থাকে। প্রত্যেকটা পদের স্বাদ আলাদা আলাদাভাবে অনুভূত হয় মুখে, বানানোর কায়দাটাই এরকম। মুড়িমাখার সেরা ঠিকানা এ শহরে মাত্র কয়েকটি। লর্ড সিনহা রোড আর এজেসি বোস রোডের মোড়ে ক্যাথলিনের গায়ে, লাইটহাউস-নিউমার্কেটের মাঝখানে গলির মোড়ে আর পার্কস্ট্রিট, বিবাদী বাগের খাবার পাড়ায়। বিক্রেতারা সবাই অবাঙালি। তবে বারবার খেয়ে একটা কথাই মনে হয়েছে মুড়িমাখার আসল ম্যাজিকটা লুকিয়ে রয়েছে ওই চাট মশলায় (বিক্রেতারা বলেন ‘কুটা মশালা’)। প্যাকেটে আলাদা করেও বিক্রি হয়। বাড়িতে কিনে নিয়ে গিয়ে বানিয়ে দেখেছি। ফুটপাতের সেই সু’তারটা পাইনি কখনও। হাতের গুণে কি? কে জানে?
চানাচুর আর ঘটিগরমের কথাই যখন উঠল তখন ঘটিগরম আর চানাচ্যাপটাই বা বাদ থাকে কেন? প্রথমে ঘটিগরম দিয়েই শুরু করা যাক। মোটামুটি পড়ন্ত বিকেলের মুখে মুখে উত্তর চব্বিশ পরগনার গুমা, বিড়া, চাঁদপাড়া, মছলন্দপুর, ঠাকুরনগর, বনগাঁ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতায় নেমে পড়েন এই ঘটিগরম বিক্রেতার দল। ছড়িয়ে পড়েন শহরের এদিক ওদিক। গলায় ঝোলানো অ্যালুমিনিয়ামের বালতি ভর্তি চানাচুর। মাঝখানে জ্বলন্ত কাঠকয়লার আঙড়া ভর্তি একটা ছোট ঘটি। চানাচুরকে টাটকা, মুচমুচে, গরম রাখার জন্য। চানাচুরের জুড়িদার হিসেবে পিঁয়াজের বদলে ফিনফিনে কাটা কাঁচা আম বা বিলিতি আমড়ার কুচি। সিজন অনুযায়ী। যখন যেটা পাওয়া যায়। অতঃপর হালকা করে ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া সামান্য বিটনুন আর মশলা। ব্যস, তাতেই অসামান্য হয়ে ওঠে কম ঝালমশলার সস্তা চানাচুর। শহরের অনেক জায়গাতেই সন্ধের মুখে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলেও দেখা পাওয়ার শিয়োর শট কলকাতা ময়দান। কমপক্ষে দশ-পনেরো জনের দেখা তো মিলবেই। ভীষণ সরল, দরিদ্র আর দলিত মতুয়া সম্প্রদায়ের এই মানুষরা, মুখে সর্বদা একটা মিঠে হাসি নিয়ে আজও ঘটিগরম বিক্রি করে যাচ্ছেন বাবুদের এ শহরে।
চানাচ্যাপটা, চালু ভাষায় মিক্সচারওয়ালা। কলকাতার ফুটপাতে দেখা মিলবে এদেরও। এরা সবাই উত্তরপ্রদেশ নিবাসী। প্রত্যেকের কমন ইউনিফর্ম সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, মাথায় গান্ধিটুপি। কাঁচাছোলাকে খলনোড়া কিংবা হামানদিস্তেয় পিটে পিটে চ্যাপটা করে খোলার আঁচে ভাজা হয়। তেল ছাড়া। হলদে কালো ছোপ ছোপ, গা-টা অমসৃণ, এবড়ো খেবড়ো। ঘটি গরমের মতো এদের ঝুড়ির মাঝখানেও বসানো থাকে একটা কাঙড়ার পাত্র। তবে ঘটিগরমের মতো ধাতুর নয়, মাটির। উদ্দেশ্য একই। খাবার গরম রাখা। দু’-চার ফোঁটা লেবুর রস। সামান্য মশলা আর বিটনুন। তাতেই পুরো ব্যাপারটা টেনিদার বয়ানে—‘ডিলা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস!’ শুধুমাত্র এই কারণেই মুড়িমাখা-চাট-চুরমুর-ঝালমুড়ির চেয়ে চানাচ্যাপটা আর ঘটিগরমকে অনেকটা এগিয়ে রাখব আমি। হাজার রকম মশলার কারিকুরি নেই। নেই নানা ধরনের আনাজপাতির ঝক্কি। বেসিক প্রোডাক্ট একটা। সামান্য দু’-একটা উপকরণের যোগ্য সংগত। ব্যস তাতেই কেল্লাফতে। অনেকটা ঠিক সেই উনিশশো ছিয়াশির বিশ্বজয়ী আর্জেন্তিনা টিমের মতো। সেরকম তারকা কোনও খেলোয়াড় নেই। কিন্তু একা সেই ফুটবলের ঈশ্বর! পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির লোকটা। দশনম্বর সাদা-নীল জার্সি। দলের মূল গায়েন। এক থেকে এগারো নম্বর—সব ক’জনই দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। আর তাতেই গোটা ফুটবল দুনিয়া পদানত। ঘটিগরম আর চানাচ্যাপটাও হুবহু ওই একরকম। মূল পদটা জিনিয়াস। সঙ্গে মামুলি কিছু উপকরণের ক্ষুদ্র কিন্তু আন্তরিক সহযোগিতা। ঠিক এখানেই বাকিদের দশ যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে এই দুই ফুটপাত ডেলিকেসি। এই প্রতিবেদকের অন্তত মত তাই।
মনে আছে আগের প্রতিবেদন ‘মোগলাই কলকাতা’-য় লিখেছিলাম আরবি হালিম পাওয়া যায় একমাত্র রমজানের মাসে, শহরের বেশ কয়েকটা নামজাদা মুসলিম হোটেলে। কথাটা আংশিক সত্যি হলেও পুরোটা নয়। অনেকটাই ওই ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’-র মতো। আসলে হালিম সম্বত্সরই পাওয়া যায় কলকাতায়। তবে হোটেলে নয়, ফুটপাতে। চাকা লাগানো গাড়িতে ধোঁয়া ওঠা ফুটন্ত হালিমের হাঁড়ি। নীচের পাটাতনে বসানো জ্বলন্ত উনুন। বাটিতে বাটিতে ঢেলে কড়া লাল পেঁয়াজ ভাজা, রোগন তেল, পাতিলেবুর রস আর লঙ্কাকুচি ছড়িয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে খদ্দেরের হাতে, এরকম ঠেক শহরে বেশ কয়েকটা রয়েছে খিদিরপুর মোড়, পার্ক সার্কাস ময়দানের গায়ে আর ধর্মতলার মোড়ে স্টেটসম্যান বিল্ডিংয়ের উলটোদিকে। কিন্তু সবার সেরা ঠেকটি বেকবাগান মোড়ে কোয়স্ট মল ঘেঁষা সামসুল হুদা রোড ধরে এগিয়ে ব্রাইট স্ট্রিটের মোড়ে। সামুভাইয়ের ফুটপাত স্টল। গাড়ির সামনে সবসময় খদ্দেরের ভিড়। ঘন ডালের সমুদ্রে সাবমেরিনের মতো আত্মগোপন করে থাকা পাতলা মাংসের সর আর দু-চারটে টুকরো। সে কী সুগন্ধ। অহো! স্বাদে আর খাদ্যগুণে যে-কোনও একনম্বরি মোগলাই রেস্তোরাঁর সঙ্গে পাল্লা দেবে একমুহূর্তে ক্লান্তি অপহরণকারী এই হালিম। দীর্ঘ সময় আমেরিকা প্রবাসী, বর্তমানে সেক্টর ফাইভে এক বহুজাতিক সফটওয়ার সংস্থায় উচ্চপদে আসীন আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সৌমিত্র বসু ওরফে ক্ষ্যাপা (চেহারাটা অনেক ডব্লু ডব্লু ই অথবা সুমো পালোয়ানকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে) যখনই এ ঠেকে হানা দেয়, অন্তত পাঁচ থেকে ছ’ বাটি পরপর না খেয়ে থামে না। তবে আপনারা ভুল করেও সে চেষ্টা করবেন না। হালিম স্বাস্থ্যকর এবং একই সঙ্গে প্রচণ্ড সুস্বাদু হলেও খানিকটা গুরুপাক তো বটেই। একবাটি দু’বাটিতে যা ‘রিফ্রেশিং’, চার-পাঁচ বাটিতে সেটাই সমস্যায় ফেলতে পারে। ক্ষ্যাপার পক্ষে যা সম্ভব অন্যদের পক্ষে সেটা কখনওই নয়। রাতবিরেতে ঝামেলা হলে হ্যাপা কে সামলাবে? আর অসামান্য কোনও সৃষ্টি পরিমিত পরিমাণে চাখলেই রসনার সঠিক তৃপ্তি হয়। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত অবশ্যই ক্ষ্যাপা। তবে ব্যতিক্রমটা ব্যতিক্রমই। নিয়ম নয় কখনওই। স্টলের মালিক সামুভাই। ফরসা ছিপছিপে হ্যান্ডসাম চেহারা। দুর্দান্ত স্মার্ট। ঠোঁটের কোণে সর্বদা লেগে থাকা আন্তরিক একটা হাসি। নিজে অসামান্য পাচক। এখন নিজে হাতে আর না রাঁধলেও দাঁড়িয়ে থেকে পুরো প্রক্রিয়াটার ওপর কড়া তদারকি চালান রোজ। বহু ফ্র্যাঞ্চাইজি আর নামী হোটেলে রাঁধুনির চাকরির অফার পায়ে ঠেলে দিয়ে এই আরবি হালিম ভাণ্ডার আজও চালিয়ে যাচ্ছেন সামুভাই। সামসুল হুদা রোড আর ব্রাইট স্ট্রিট মোড়ের ফুটপাতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, রমজানের একমাস বিফের পাশাপাশি চিকেন হালিমও বানিয়ে থাকেন সামুভাই অ্যান্ড কোং। গোমাংসে আপত্তি থাকলে রমজানের মাসে যে-কোনও একদিন সন্ধের পর আপনার অবশ্য গন্তব্য হোক সামুভাইয়ের স্পেশাল আরবি হালিম। তবে দোকানে প্রচণ্ড ভিড় হয় এ সময়টায়। টালা টু টালিগঞ্জ, বাবুরা গাড়ি হাঁকিয়ে এসে ঘটিবাটি ভর্তি করে কিনে নিয়ে যান। মোটামুটি সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে পেল্লায় চেহারার চার-পাঁচটি হাঁড়ি চেঁচেপুছে সাফ একেবারে। দেরি করলে হতাশ হবার সম্ভাবনা প্রবল।
শুধু কি হালিম? আরও কত ধরনের সুস্বাদু খাবার যে ছড়িয়ে রয়েছে সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলো জুড়ে তার লেখাজোখা নেই। কলকাতার আর কোথাও এসব খাবারের দেখা মেলে না। তার মধ্যে অন্যতম পানতারাস। ছোট ছোট মুসলমান হোটেলে বা খাবারের দোকানগুলোয় পাওয়া যায়। এনভেলাপ বা খামের মতো করে চারপাশটা মোড়া। চৌকোনা আকারের। ময়দার পাতলা আস্তরণের মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আলুর টুকরো (মাখা বা চটকানো নয়), পেঁয়াজ-রসুনকুচি আর মশলা মাখানো মাংসের কিমার পুর। ডুবো তেলে ভেজে তোলা হয়। স্বাদ আর কুড়মুড়ে ক্রিসপি ভাবটা আচ্ছা আচ্ছা নামী কনফেকশনারির প্যাটিসকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যে-কোনও দিন। সামান্য সসের সঙ্গে… ইরশাদ! ইরশাদ! আর দাম? শুনলে মনে হবে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরে গেলুম নাকি? মাত্র আড়াই টাকা পার পিস। ভাবা যায়! আশ্চর্যজনক যেটা প্রতিদিন বেলা এগারোটা, বারোটা নাগাদ বানানো শুরু হয় এই অনন্য খাদ্যবস্তুটি। একটা দেড়টার মধ্যে খতম। ফলে খেতে চাইলে ভরদুপুর ছাড়া গতি নেই। এরকম একটা বেখাপ্পা সময়েই কেন? বহুবার জিজ্ঞেস করেছি একাধিক হোটেলওয়ালা বা দোকান মালিককে। “অ্যায়সা হি হোতা হায়”—নিস্পৃহ আর নির্লিপ্ত উত্তর পেয়েছি প্রতিবারই। মাইক্রোওভেনে ফের গরম করে নিলে স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকবে কি? জানা নেই কারণ সে চেষ্টা করিনি কোনওদিন।
সামোসার বাংলা মানে তো সিঙ্গারা। কিন্তু সংখ্যালঘু মহল্লায় সামোসা মোটেই সেরকম নয়। বরং অনেকটা সেই মা-ঠাকুমার বানানো পুলিপিঠের মতো আকারে। ভেতরের পুরটা অবিকল পানতারাসের মতো। স্বাদও প্রায় একইরকম। এখানে উল্লেখ্য যেটা, যে দোকানে সামোসা তৈরি হবে সেখানে পানতারাস বানানো হবে না কখনওই। উলটোদিকে পানতারাস নির্মাতাদের ক্ষেত্রেও ওই একই কানুন প্রযোজ্য। কারণটা কী? আগের প্রশ্নের মতো এ প্রশ্নেরও উত্তর পাইনি কখনও।
পওয়া বা পোয়া। এ নামেই ডাকা হয় মুসলিম মহল্লায়। খেতে অবিকল মালপোয়ার মতো। এলাকার ফুটপাত স্টলগুলোয় পাওয়া যায়। মৌরির বদলে গোলাপজলের সুগন্ধ। আর মিষ্টির পরিমাণটা মালপোয়ার তুলনায় খানিকটা কম। যারা কম মিষ্টি পছন্দ করেন তাদের জন্য আদর্শ এই ‘পওয়া’। পড়ন্ত বিকেলে গরম গরম ভেজে তোলা হয়। এর দামও মাত্র তিন টাকা। সত্যিই অকল্পনীয়।
নানখাটাই। এর আদি উৎপত্তিস্থল নাকি আফগানিস্তান। সুজি, ডালডা আর ঘিয়ের তৈরি এ বিস্কুট সত্যিই অমৃত সমান। তৈরি হয় পার্ক সার্কাস, রিপন স্ট্রিট, মল্লিকবাজার অঞ্চলের ছোট ছোট বেকারিগুলোয়। বহু নামী বেকারির নামী দামি কুকিজ তো খেয়েছেন। একবার নানখাটাই ট্রাই করুন। মুখে ফেলামাত্র ঝুরঝুর করে ভেঙে মিলিয়ে যাবে। সঙ্গে মিলিয়ে যাবে অন্য কোনও কুকিজ খাওয়ার ইচ্ছেটাও। চ্যালেঞ্জ। সম্বত্সর পাওয়া যায় মল্লিকবাজারের দোকানগুলোয়। তবে সেরা নানখাটাই পাওয়া যায় মহরমের দিন। হালকা ঝুরঝুরে, হাতেগরম। ঘি-ডালডার যুগলবন্দি। ভেবে দেখুন মহরম অবধি অপেক্ষা করবেন না কি আজই রওয়ানা দেবেন মল্লিকবাজারের দিকে।
শিককাবাবের গল্প তো আগেই করেছি। কিন্তু কাবাব ফ্রাইয়ের কথা বলা হয়নি। সন্ধের মুখে বানিয়ে শিকসুদ্ধু নামিয়ে একআধটু তুতিয়ে পাতিয়ে অনুরোধ করলে চাঁপের তাওয়ার একপাশে এক-আধ চামচে ডালডা আর চাড্ডি পেঁয়াজ ফেলে ভেজে দেয় যে-কোনও চুলিয়া হোটেলে (সংখ্যালঘু এলাকায় সস্তার হোটেলগুলোকে এ নামেই ডাকা হয়)। দাম টাকা দুয়েক বেশি পড়ে। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে কাবাব ফ্রাইয়ের সেরা ঠিকানা ছিল যমুনা সিনেমার গায়ে নুরি হোটেল। দোকানের বাইরে বিশাল লোহার তাওয়ায় চাঁপের পাশাপাশি সবসময় ভাজা হত কাবাব। ডিমান্ডও ছিল প্রচুর। সে সময় কাবাবপ্রেমীদের কাছে পরিচিত ছিল ‘যম্নাফ্রাই’ নামে। যমুনায় ইন্টারভেলের সময় অথবা গ্লোব, লাইটহাউসে ম্যাটিনি শো সেরে ফেরার পথে থামতেই হবে নুরি হোটেল। আজ যমুনা নেই, লাইট হাউস নেই, নেই সেভেন্টি এম এম পর্দার সেই গ্লোব। সব সিনেমা এখন মাল্টিপ্লেক্সে নয়তো পেনড্রাইভের সুড়ঙ্গ বেয়ে ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল আর এল ই ডি-র পর্দায়। এদিকে বয়সও বেড়েছে। অনেকদিন যাইনি ওদিকটায়। জানি না ‘যমনাফ্রাই’ আজও বহমান কিনা?
নুরি হোটেলের মতো আরেক অমৃতলোকের ঠিকানা পেয়ে গেছিলাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের পিছনে তালতলা লেনের একটা সরুস্য সরু গলিতে। টালির চালের নামগোত্রহীন চুলিয়া হোটেল। ভাঙাচোরা কাঠের বেঞ্চি আর টেবিল। আধো অন্ধকার ভেতরটা। কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে কয়েকটা। প্রচুর লোক খাচ্ছে। মলিন জামা আর লুঙ্গি পরিহিত বেয়ারাদের ব্যস্ত পদচারণা। হাঁকডাক। একদম সাদামাটা চেহারা। কিন্তু রান্নার মান— এককথায় অসামান্য! কবি বীরেন চাটুজ্জের ভাষায়— ‘কোন উপমাটুপমা চলবে না।’ তো খেয়েছিলাম বটে সেই হোটেলে। খুস্কা পোলাও। বিরিয়ানি নয় মোটেই। গাত্রবর্ণ অনেকটা হলুদ পোলাও-এর মতো। জাফরানের ঝাঁঝটা প্রায় নেই বললেই চলে। বড় একখণ্ড মাংসের বদলে ছোট ছোট সুপক্ব মাংসের টুকরো। আলু বা ডিমের কোনও গল্প নেই। ‘একবার খা কে তো দেখিয়ে’—পরিবেশনকারীর এহেন অনুরোধে সঙ্গে নিতে হয়েছিল হাফপ্লেট ‘পাগলা ভুনা।’ ওই হোটেলের ‘ইসপেশাল’ নাকি। এক টুকরো দাঁতে কাটামাত্র বুঝতে পেরেছিলাম না নিলে কি ভুলটাই না করতাম। এমনিতেই যে-কোনও ছোটখাটো চুলিয়া হোটেলের ভুনা গোস্ত (কষা মাংস) যে-কোনও নামী দামি রসাকষাদের বলে বলে ইনিংস ডিফিট দেবে তায় আবার ‘পাগলা ভুনা’। তা খেয়েছিলাম বটে কবজি ডুবিয়ে। খাওয়া তো নয় যেন একটা প্লেটনিক জার্নি থ্রু দ্য স্টমাক। খাওয়া সেরে ময়লা বেসিনে হাত ধুয়ে কাউন্টারের ওপর রাখা জর্দার কৌটো থেকে মৌরি তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বিল মেটাচ্ছি, সামনে এসে দাঁড়ালেন পরিবেশনকারী বৃদ্ধ চাচা। বৃদ্ধ মানুষ। একগাল সাদা দাড়ি। মলিন লুঙ্গি আর গেঞ্জি। কিন্তু হাসিটা ভারী সরল আর তরতাজা। কাঁধে একটা আধময়লা তোয়ালে (নিশ্চয়ই অনেকে মুখ মুছে গেছে ওই একই তোয়ালেতে)। এগিয়ে দিয়েছিলেন মুখ মোছার জন্য। না করতে পারিনি স্রেফ ওই ভনিতার লেশমাত্র না থাকা হাসিটার জন্য। খাবারের দামের সঙ্গে এগিয়ে দিয়েছিলাম সামান্য দু’-পাঁচটা অতিরিক্ত টাকা। কতটুকুই বা মানে রাখে? মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠে সারা মুখ জুড়ে আরও চওড়া হয়েছিল হাসিটা। আর তাতেই আলোয় আলোময় সংখ্যালঘু মহল্লার ঘুপচি আধো অন্ধকার গরিব হোটেল। পরবর্তীতে বহুবার ওই এলাকার অলিতে গলিতে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি হোটেলটাকে। পাইনি। উঠে গেল? নাকি প্রোমোটারের থাবায় পড়ল? নাকি আদৌ কখনও ছিলই না বাস্তবে? অনেকটা সেই জন লেননের ‘নো হোয়ার ল্যান্ড’-এর মতো। ভোরবেলার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া সুখস্বপ্নের মতো মিনিট পনেরো-কুড়ি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে। উত্তরটা পাইনি বাস্তবে।
একটা কথা ভেবে দেখেছেন কখনও? কলকাতা শহরে রান্না করা শুয়োরের মাংস বা পর্ক পাওয়া যায় কি না? পাঁচতারা হোটেলের ব্যাপারস্যাপার জানি না। তবে আমরা মানে সাধারণ শহরবাসীরা কুকড পর্ক বলতে বুঝি চিনে রেস্তোরাঁর খাবার আর বাড়িতে খেতে হলে দোকানের মাংস বা শপিং মল থেকে কিনে আনা হ্যাম-সালামি-সসেজ-বেকন ইত্যাদি ইত্যাদি। অবগতির জন্য জানাই তার বাইরেও দু’-চারটে কুকড পর্কের ঠিকানা রয়েছে কলকাতায়। যেখানে তৈরি হয় আদি অকৃত্রিম পর্ক কারি। লাল ঝাল, ধনেপাতার সুবাস ছড়ানো শুয়োরের মাংসের ঝোল। পাওয়া যায় গড়িয়া রেল স্টেশনের গায়ে ছোট্ট দোকানে। মাংসের এই পদটি রাঁধার জন্য সবিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। কখন ঠিক তাক করে কড়াইয়ে ছাড়তে হবে যাতে মাংসের ওপরে চর্বির অংশটা গলে না যায়, তীক্ষ্ন নজর রাখতে হবে সেদিকে। আর সেই কৌশলটাই জানেন দোকান মালিক হরিদা। দোকানে মাংসের পাশাপাশি হাতে গড়া রুটিও পাওয়া যায়। লাল লাল ঝোলে চুবিয়ে মাংসসুদ্ধ একটা কামড়। মোটা চর্বিওয়ালা বাদিতে দাঁত কেটে বসার ‘কচ’ মৃদু শব্দ। বাকিটা— পুরো শিল্প।
এরকম আরও বেশ কয়েকটা পর্ক কারির ঠেক রয়েছে ট্যাংরায় বৈশালি সিনেমা হলের আশেপাশে। এছাড়া দক্ষিণ কলকাতার গরচা রোডে বাংলা মদের দোকানের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে করে নিয়ে বসতেন একজন। টকটকে লাল ঝোলে মাথা উঁচু করে থাকা আধ ইঞ্চি পুরু বাদিওয়ালা চর্বিদার মাংসের টুকরো। প্রতিটি টুকরো চৌকোনা আর নিখুঁত সমান মাপে কাটা। ঝোলের ওপর ভাসমান তেলে ইতিউতি সন্তরণরত কুচোনো ধনেপাতা। স্বাদে মারকাটারি। অনেককাল ঢুঁ মারা হয়নি ওদিকটায়। ফলে আজও পাওয়া যায় কিনা জানা নেই।
সত্তরের শেষভাগ। পার্ক লেন। পার্ক স্ট্রিটের গায়ে সরু ত্যারচা গলিটা তখন গোটা কলকাতায় বিখ্যাত মূলত দুটো কারণে। বব ডিকস্টার শুকনো নেশার ঠেক— ‘ববস্ প্লেস’ আর লিন্ডা গোমস মানে লিন্ডা আন্টির পর্ক কারি জয়েন্ট। গোটা সত্তর-আশির দশক জুড়ে রাজত্ব চালিয়েছিল শহরে। দুটো আড্ডা। কত স্মৃতি, অনভ্যস্ত কানে শুনে ফেলা কত-শত গান। জিম মরিসন, ন্যাট কিংকোল, বিটলস্, ন্যানসি সিনাত্রা, বব ডিলান, জোন বায়েজ, পিঙ্ক ফ্লয়েড, জন লেনন, ব্রুস স্প্রিং স্টিন, নীল ডায়মন্ড, বব মার্লে, জিমি হেনড্রিক্স, রোলিং স্টোন… গিটারে উথালপাথাল ঝোড়ো স্ট্রোক… ‘আই মিস ইউ বেবি’… বব ডিকস্টা, বহুদিন হল এ শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে বউবাচ্চা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া… লিন্ডা আন্টি, বছর বিশেক আগে চলে গেছেন তারাদের পথে। সঙ্গে চলে গেছে ভুবনমোহিনী পর্ক কারির সেই জাদু ফর্মুলা। আর ঠিক সেই কারণেই ওরকম পর্ক কারি আর কোনওদিন রাঁধা হবে না তিনশো পেরোনো এই তিলোত্তমায়।
স্মৃতিমেদুর ভারাক্রান্ত মন। একটু চাঙ্গা হতে চলুন ফের একবার ফিরে যাওয়া যাক সেই গড়িয়ায়। তবে স্টেশনের দিকটায় নয়, গড়িয়া মোড়ে। মোড়ের মাথায় মহুয়া সিনেমা হল। মহুয়া-বান্টি-মালঞ্চ-মধুবন। একসময় শহরতলির গর্ব। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সেভেন্টি এম এম স্ক্রিন। বান্টি, মধুবন বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন হল। মালঞ্চ আর মহুয়া, টিমটিম করে টিকে আছে কোনওমতে। নোংরা পর্দা, জায়গায় জায়গায় তাপ্পি মারা… অস্পষ্ট আওয়াজের সাউন্ডবক্স, গদি ছিঁড়ে গিয়ে চেয়ারের কাঠ বেরিয়ে পড়েছে অনেকদিন। দর্শক হয় না হলে, হতাশ মুখ সিনেমা হল কর্মচারী। হালকা হতে চাওয়া মন ভারী হয়ে আসছে ফের। এই ভীষণ মনখারাপের রেশটা কাটাতে ঢুকে পড়ুন মহুয়ার উলটোফুটের গলিটায়। সোজা গিয়ে যেখানে গড়িয়া মেট্রো স্টেশনের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে রাস্তাটা, তার দু’-চার পা আগেই তেলেভাজার দোকানটা। জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার মতো এ দোকান ভ্রমণের সেরা সময় শীতকাল। কারণ বাজার-সেরা ঠাসবুনোটের ফুলকপি আর পেঁজা তুলোর মতো হালকা নরম তুলতুলে জাম্বো সাইজের বেগুন একমাত্র এ সময়টাতেই পাওয়া যায়। যার মানে ফুলকপির বড়া আর আধ হাত লম্বা বেগুনি। এ দোকানের ডেলিকেসি। এত ভাল ফুলকপির বড়া কলকাতার আর কোনও দোকানে পাওয়া যায় না। বেসনের উষ্ণ আবরণে ভেবে ওঠা তাজা ফুলকপির সুবাস। মুখের মধ্যে থেকে থেকেই ফুটফুট করে ফুটতে থাকা ভাজা ডালের কুচি আর বিটনুনের সোঁদাটে গন্ধ। আবেশটা ধরে রাখতে খেতে খেতেই বেরিয়ে আসুন গলি থেকে। উলটোফুটে মহুয়ার প্রায় গা ঘেঁষেই ছোট চায়ের দোকানটা। গম্ভীরমুখো দোকানি। লাল বা দুধ, দু’ধরনের চায়ের ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ। দ্রুত চামচ চালাচ্ছেন গ্লাসে। মাটির ভাঁড় বা কাগজের কাপেও দেওয়া হয়। দোকানের আয়তন ছোট কিন্তু দুধ বা লাল, শহরে ভাল চায়ের অন্যতম সেরা ঠিকানা এটি। চুমুকে পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
গড়িয়া থেকে গোটা পাঁচেক স্টপেজ। বাঘাযতীন মোড়। বাস থেকে নেমেই ভাঙা টিনের বেড়ার দোকান। লাল আর দুধ—দু’রকম চা-ই পাওয়া যায়। লালটাই বেশি ভাল। দোকানি। দুর্দান্ত রসিক। অসম্ভব হিউমার সেন্স। দু’-চারটে টুকটাক রসিকতার মধ্যেই বেছে নিন প্লেন লিকার অথবা লেবু, মশলা—যে-কোনও একটা। প্রতিটি উপকরণ একদম সঠিক পরিমাপে। অজস্রবার খেয়েছি। মানের উঠতি পড়তি দেখিনি কখনও।
উলটোফুটে বাঘাযতীন স্টেশন রোডে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে পরানদার চায়ের দোকান। পরানদা। সর্বদা হাসিমুখ। কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির লড়াকু ইউনিয়ন কর্মী ছিলেন। লক আউট হতে হতে একদিন বন্ধই হয়ে গেল কারখানা। গ্লাস কিন্তু পিছু ছাড়ল না পরানদার। উলটে কেটলি-চামচ-উনুন-ছাঁকনি-চা পাতা আর মিল্ক পাউডারকে সঙ্গে নিয়ে উঠে এল ফুটপাতের ধারে একফালি দোকানে। পরানদা। প্রায় সত্তর। একদা একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী। অফিসিয়াল বামপন্থীদের রকমসকম দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন বছর কুড়ি আগেই। নাটকের পোকা। এখনও মুখে মুখে বলে যেতে পারেন টিনের তলোয়ার, কল্লোল, ব্যারিকেড, ফেরারি ফৌজ, সেতু, মারীচ সংবাদ, দেবীগর্জন… এরকম বহু নাটকের সংলাপ। ওর নিজের বয়ানে—“কমিউনিস্ট পার্টিটা যেরকম সততার লগে করতাম, চা-ডাও ঠিক হেইভাবেই বানাইয়া থাকি। আসলে হেই দুইডাই তো আবেগ।” কথাটা যে কদ্দুর সত্যি সেটা পরানদার চা খেলেই প্রমাণিত হবে। শুধুমাত্র তীব্র প্যাশনের কারণে সস্তার চা পাতা আর গুঁড়ো দুধের মিশেল যে কোন উচ্চতায় উঠতে পারে তার একমেবঅদ্বিতীয়ম দৃষ্টান্ত বোধহয় পরাণদা। আশার কথা গোটা শহরটা এখনও ‘ক্যাপুচিনো’ সভ্যতার মেঘে ঢাকা পড়ে যায়নি। কারণ পরাণদা আজও রয়েছেন কলকাতায়।
বাঘাযতীন থেকে ছোট ছোট তিনটে স্টপেজ। চাইলে হেঁটেও মেরে দিতে পারেন। এইট-বি বাসডিপোর উলটোদিকে যাদবপুর বাজার লাগোয়া গলিতে বউদির চায়ের দোকান। সবসময় থিকথিক করছে ভিড়। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে ঘোড়েল বাজারু হয়ে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সুজয় বসু, কে নেই সেই ভিড়ে? আর চায়ের কথা? লিকার, লেবু বা দুধ, বিজ্ঞাপনের ভাষায়—‘চুমুকেই চমক!’ সঙ্গে কম মিষ্টির খাস্তা ‘টোস্ট’ লেড়ো বা ‘এস’ বিস্কুট। অহো, ‘এই তো জীবন কালীদা!’
একটা জরুরি তথ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গ্লাসে চা পাওয়া যায় এখানে। বোধহয় এই দোকানের জন্যই স্পেশালি অর্ডার দিয়ে বানানো। দাম মাত্র তিন টাকা। গ্লাসের নয়, চায়ের।
‘উদ্ভ্রান্ত একঝাঁক যুবক মিলে রাখত ফুটপাত সরগরম/অযথা জ্ঞান দিলে গালিগালাজ গিলে চায়ের দাম দেওয়া শাস্তি চরম…।’ গান বাজছে ছোট সাউন্ডবক্সে। চার দেয়াল ভর্তি নচিকেতার ছবি। ওপরে সাইনবোর্ডে সাদার ওপর নীল লেটারহেডে বড় বড় করে লেখা দোকানের নাম—‘চা ও নচিকেতা। Just for today।’ দুই ভাই পালা করে দোকানটা চালায়, যাদবপুর বাসস্টপেজের গায়ে ফুটপাতের ওপর। বয়স মেরে-কেটে আঠাশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে। আর কী অবাক কাণ্ড! পরানদার থেকে প্রায় প্রজন্ম দুয়েকের ছোট এরাও নাকি সেই চা-টা বানায় প্রচণ্ড আবেগ দিয়ে। দুনিয়ার যত নচিকেতাপ্রেমীদের ফেভারিট জয়েন্ট এই— ‘চা ও নচিকেতা।’ দোকানের দুটি বিশেষত্ব। ১. কড়া লিকারের দুধ-চা ছাড়া আর কোনও ধরনের চা পাওয়া যায় না এখানে। ২. সকাল এগারোটা থেকে রাত দশটা— যতক্ষণ দোকান চলবে, নচিকেতা থামবে না এক সেকেন্ডের জন্য। গান আর কড়া দুধ চায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় উত্সাহী হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের নচিকেতাপ্রেমীরা নাকি ব্রাঞ্চ খোলার প্রস্তাব দিয়েছে বলে শুনেছি। দু’ ভাইয়ের গা নেই তেমন। ওদের মতে ‘এই বেশ ভালো আছি।’
কথায় বলে কলম অশরীরী। সত্যিই তো দেখছি কেবল চায়ের চক্রপথে ঘুরে চলেছে চক্রাকারে। যত অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছি ফের টেনে এনে ফেলে দিচ্ছে সেই চায়ের গাড্ডায়। এভাবে তো চলতে পারে না। শুধু কলকাতার চা আর চায়ের ঠেক নিয়ে লিখতে গেলেই একটা হাজারখানেক পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। তারপরেও লক্ষ লক্ষ চা-তক (আদৌ যদি তারা লেখাটা পড়েন) চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবেন—‘কই মশাই, আমাদের পাড়ার দোকানটার কথা তো লিখলেন না?’ তাই এই মুহূর্তে চা-পর্বে ইতি টানলাম। কত দোকান আর ঠেকের কথা যে বলা হল না। বাদ পড়ে গেল শ্যামবাজার, শোভাবাজার, গড়পার, মানিকতলা, কলেজস্ট্রিট, ভবানীপুর, কালীঘাট। লেক আর অকাদেমি চত্বরের অলৌকিক সব চা-বিপণি। অক্ষমতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আশাকরি সেটা পাব।
‘দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা’—বাংলার প্রবাদে আছে। সাপ আদৌ পোষ মানে কি? আর পোষ মানলেও দুধকলা খায় কি? সাপ সত্যিই দুধ কলা খায় কি না জানা নেই। তবে মানুষ যে দুধ-কোলা খায়, এক পরিচিতের কাছে এহেন অদ্ভুত এবং বিচিত্র তথ্য জানার পর চোয়াল ঝুলে গেছিল মিনিট খানেকের জন্য। বলে কী রে লোকটা। পাগল না পেট খারাপ? কোলা মানে সোডাভিত্তিক একটা ঝাঁঝালো পানীয়ের সঙ্গে দুধের মতো স্নেহজাতীয় পানীয়ের মিশেল? এ তো আদা-কাঁচকলা বা তেল আর জলের মিশ খাওয়ার চাইতেও জটিল ব্যাপার যাকে বলে। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম ইয়েতি বা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের চেয়েও রহস্যময় সেই পানীয়ের ঠিকানা। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন অগ্রজপ্রতিম বন্ধু সত্যবান মিত্রের সঙ্গে পৌঁছে গেছিলাম হরিশ মুখার্জি রোডে পিজি হসপিটাল সংলগ্ন গুরদোয়ারার গায়ে বলবন্ত সিংস ইটিং হাউজ বা বলবন্ত সিং ধাবায়। আর পান করেছিলাম সেই আশ্চর্য তরল। প্রাণ ভরে। দুধ আর কোলার সংমিশ্রণে যে এরকম সুস্বাদু পানীয় তৈরি হতে পারে নিজের চোখে অথবা নিজে চেখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না। এতটাই সুমধুর। দুধ-কোলা ছাড়া দুধ-সোডাও বানিয়ে থাকেন এরা। সেটিও সমান সুস্বাদু। দুধ কোলা বা সোডার পাশাপাশি এখানকার চিকেন তড়কা ফ্রাই আর বাটার নান, সঙ্গে মিক্সড সালাড—জাস্ট অ্যামেজিং! খাবারদাবার ছাড়া ঐতিহাসিক কারণেও এ হোটেল বিখ্যাত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এটি ছিল পাঞ্জাবের গদর পার্টির বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল। বর্তমান মালিকদের পূর্বপুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আশ্রয় দিতেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের। টেবিলে বসে খেতে খেতে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলাম খুব। হয়তো এই টেবিলে বসেই ভবিষ্যৎ বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন ভগৎ সিং, আসফাকুল্লা খান, রাজগুরু, বটুকেশ্বর দত্তরা। পিকরিক বোমার মশলা আবিষ্কার করেছিলেন শুকদেব, যতীন দাস, চন্দ্রশেখর আজাদ। শুধু ভাল খাওয়া নয়, একইসঙ্গে ইতিহাসকে ছুঁয়ে ফেলার তৃপ্তিটা মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে আজও।
ধাবা বা পাঞ্জাবি হোটেলের কথা যখন উঠলই তখন বলি এরকম আরও কয়েকটা ধাবা রয়েছে এই শহরে যারা নিজগুণেই স্বনামধন্য। শংসাপত্র বা স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই তেমন একটা। যার মধ্যে অন্যতম বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ধাবা আর তাদের অজস্র ধরনের পাঞ্জাবি ঘরানার খাদ্যসম্ভার। এই তালিকায় প্রথমেই থাকবে মক্কি (মকাই/ভুট্টা) দি রোটি আর সর্ষোঁ দা শাক। শহরের খুব বেশি পাঞ্জাবি হোটেলে সবসময় এই পদ দুটো পাওয়া যায় না। গরমাগরম মকাইয়ের রুটির সঙ্গে ওপরে ‘মাঠ্ঠা’ (তাজা ক্রিম) ছড়ানো ঘন সবুজ সরষে শাকের যুগলবন্দি। আহা! মুখের মধ্যে যেন রবিশঙ্কর আর আলি আকবরের ডুয়েট কনসার্ট। পাশে একপ্লেট সালাড আর একটুখানি পাঁচমিশেলি আচার। যোগ্য সংগত আল্লারাখা বা জাকিরের মতোই। বুঁদ হয়ে যান মূর্ছনায়! কথা না বাড়িয়ে।
দ্বিতীয় ঠিকানাটা রাসবিহারী মোড়ে আজাদ হিন্দ হোটেল। এলাকায় বেশি পরিচিত বচন সিংয়ের ধাবা নামে। কালীঘাট শ্মশানের দিকে যাবার রাস্তাটায় হাতের বাঁদিকে। এখানে আপনার পছন্দের তালিকায় অবশই থাকুক দাল মাখানি, চিকেন বাটার মশালা আর ফিশ অমৃতসরি। সঙ্গে রুমালি রুটি অথবা বাটার নান, যে-কোনও একটা। এমনিতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে এখানে। ফলে খাবার দিতে একটু দেরি হয়। তাই টেবিলে এসে নামামাত্র আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে চালু হয়ে যান। এক এক মুহূর্ত দেরি করা মানে এক-এক ফোঁটা অসম্ভব ভাললাগা স্বাদু উষ্ণতা আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া। মনে রাখবেন কথাটা।
একটা ছোট্ট ফুডি কুইজ। বলুন তো কলকাতা শহরে কোন খাবার হোটেল সবচাইতে বেশি রাত অবধি খোলা থাকে? চোখ বুজে উত্তর— বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এএইআই ক্লাবের পাশে শের-ই-পাঞ্জাব ধাবা (কালীঘাট বা নিমতলা শ্মশানের পাশে দোকানগুলো এর মধ্যে ধর্তব্য নয়)। রাত তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ বন্ধ হয়ে ফের খুলে যায় ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। দু’ শিফটে হোটেল চলে। কর্মচারী বদলে যায়। রাতবিরেতে কোথাও খাবার না পেলে আপনার অবশ্যগন্তব্য হোক শের-ই-পাঞ্জাব। বিশ্ববরেণ্য চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনের প্রিয় খাবারের ঠিকানা ছিল এই ধাবাটি। কলকাতায় এলে নামীদামি পাঁচতারা হোটেলের লাঞ্চ-ডিনার ফেলে খেতে চলে আসতেন এখানে প্রায়ই। হুসেনের নামে এদের একটা পদের নামই হয়ে গেছে ‘হুসেনস্ স্পেশাল চিকেন।’ দুয়েকবার খেয়ে দেখেছি। আহামরি কিছু লাগেনি। খেতে যদি হয় সেটা এদের চিকেন ভর্তা আর এগ তড়কা ফ্রাই। ফুলকো ফুলকো চাপাটির সঙ্গে জমাট, হালকা আঠালো, মাসকালাই-কসৌরি মেথি-ডিমের মেলানো মেশানো ফাটাফাটি সুগন্ধি তড়কা। পাশাপাশি অফুরন্ত মাখনে সাঁতলানো ছিলেকাটা মুরগির টুকরোর ভর্তা। শেষে একগ্লাস লস্যি। ওপরে মোটা ননীর পরত। তলানিটা আর প্রায় চুমুক দেওয়া যায় না। চামচে করে তুলে খেতে হয়, এতটাই ঘন। আজ থেকে বছর বিশ-পঁচিশ আগেও হোটেলের বাইরে বসেই খাওয়া চলত। সঙ্গে ফ্রি—মুক্ত বাতাস। অবিকল হাইওয়ের ওপর এথনিক ধাবা বা লাইন হোটেলের স্টাইলে। শোনা কথা, এখানে এলে হোটেলের মধ্যে ভিড়ভারাক্কার চেয়ে বাইরে খাটিয়ায় বসে খেতেই বেশি পছন্দ করতেন হুসেন সাহেব। হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কটা এতটাই নিবিড় আর আন্তরিক জায়গায় এসে পৌঁছেছিল যে এঁকে উপহার দিয়েছিলেন প্রমাণ সাইজ গজগামিনীর একটি ছবি। ধর্মের ষাঁড়ের গুঁতোয় বিধ্বস্ত, অপমানিত হয়ে প্রথমে চলে গেলেন প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে। পরবর্তীতে এমন কোথাও যেখানে ধম্মো, জাতপাত এসব নিয়ে বেকার, বেফালতু, বেমতলব কোনও লড়াই নেই। হুসেন চলে গেছেন। ফুটপাতের খাটিয়াপত্তর কবেই তুলে দিয়েছেন মালিকরা। গজগামিনীর ছবিটা কিন্তু আজও টাঙানো রয়েছে হোটেলের দেয়ালে। ক্যাশ কাউন্টারের মাথার ঠিক ওপরে। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে গিয়ে দেখে আসতে পারেন একদিন।
এবার কলকাতার শেষ দুটি ধাবার কথা বলেই এই ধাবা প্রসঙ্গে ইতি টানব। রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে কর্তার সিংয়ের ধাবা। কনক বিল্ডিংয়ের ঠিক পিছনে। চিকেন, মাটন অথবা এগ, যে-কোনও তড়কাই এখানে যেন অনেকটা সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জামাইকার শর্ট ডিসট্যান্স অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান দৌড়বাজদের মতো। ফটো-ফিনিশে একচুল এগিয়ে পিছিয়ে থাকবে। এখানে আপনার মর্জিমাফিক অর্ডার করা তড়কার সঙ্গে থাকুক প্লেন চাপাটি। সিংজির ধাবায় নান বা তন্দুরি রুটির সঙ্গে কম্পিটিশনে এটাই সেরা। শীতকালে শসা-পেঁয়াজ-টম্যাটোর সঙ্গে মুলোও দেওয়া হয় সালাডে। এত মিষ্টি আর ঝাঁঝহীন মুলো যে কোন স্বর্গীয় আবাদভূমিতে উৎপন্ন হয় কে জানে? কথার সত্যমিথ্যে যাচাই করতে একদিন না হয় চলেই যান রাসেল স্ট্রিটে সিংজির ধাবায়।
ভি আই পি রোড এয়ারপোর্ট হোটেল থেকে ঠিক যেখানটায় উত্তর চব্বিশ পরগণার দিকে বাঁক নিয়েছে, সেই মোড়ের মাথার ধাবাটায় খেয়েছেন কখনও? অনবদ্য সব পঞ্চনদের দেশের পঞ্চব্যঞ্জনের পর নিতেই হবে মোষের দুধে ফোটানো বড় এক গেলাস সরভাসা পোয়াপাত্তি চা। সঙ্গে এলাচের মাতচমাত সুগন্ধ। দাম দশটি টাকা মাত্র। খাওয়ার পর মনে হবে আরও টাকা দশেক বেশি নিলেও কোনও সমস্যা ছিল না। এতটাই স্বাদু আর তরতাজা করে দেওয়া অনুভূতি। এর বেশি আর কিছু বলার নেই।
আরেকটি প্রশ্ন। কলকাতার সেরা জিলিপি কোথায় পাওয়া যায়? এককথায় উত্তর: ফুটপাতে। ফুটপাত বলতে অফিসপাড়ার ফুটপাত। সেই ক্যামাক স্ট্রিট থেকে শুরু করে বিবাদি বাগ চত্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত হয়ে এর বিস্তৃতি। অফিস পাড়ার খাবার— বিষয়টা নিয়ে এতবার লেখা হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর ম্যাগাজিনে যে এ নিয়ে নতুন করে আর কিছু লেখার অবকাশ থাকে না। ডাল ভাত থেকে শুরু করে বিরিয়ানি হয়ে রুটি-লুচি-তরকারি মায় খিচুড়ি-পাপড়-চাটনি এমনকী দই চিঁড়ের ফলার, কী না পাওয়া যায় এখানে। এককথায় একটা ওপেন এয়ার কমপ্লিট ফুড হাব। তবু দুটো পদের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। এক) জিলিপি। পাওয়া যায় কিরণশঙ্কর রায় রোডে হাইকোর্টের ঠিক উলটোফুটে। দ্বিতীয় ঠিকানাটি জওহরলাল নেহরু রোডের ওপর মেট্রো রেল অফিসের সামনে। উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরের কোনও ময়রার দোকানের জিলিপি স্বাদে-গন্ধে এর ধারেকাছেও আসবে না। অনেকটা মারকাটারি সেই গানটার মতো। ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না…।’ যখনই যাবেন তখনই হাতে গরম, রসালো মুচমুচে। কামড় বসানো মাত্র অফিসপাড়ার ভিড়, হই-হল্লা, বাস আর ট্যাক্সির প্যাঁ পোঁ… সব কর্পূরের মতো উবে গিয়ে একটা ঘোরলাগা ভাব গোটা শরীরে। এবার পাঠকের করণীয় বলতে বাকি রইল ঘটনাস্থলে গিয়ে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করা। দুই) ঘুগনি। চায়ের দোকান বা চাটওয়ালার হড়হড়ে আর পেঁয়াজ রসুনের ঘ্যাঁট নয়। তেঁতুল জল বা লেবুর রসের কোনও গপ্পো নেই। ট্রেসিং পেপারের মতো পাতলা ছিলেকাটা নারকোলের টুকরো দেওয়া। জমাট এবং খাঁটি নিরামিষ ঘুগনি। শালপাতা বেয়ে একটুও গড়িয়ে পড়বে না। ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া এক চিমটে জিরে ভাজার গুঁড়ো আর বিটনুন। ব্যস! তাতেই কিস্তিমাত। মনে আছে ঠিক এইরকম ঘুগনি পাওয়া যেত ছেলেবেলায়, গড়পারে। একটু রাতের দিকে। এই সাড়ে আটটা নাগাদ চাকা লাগানো টিনের গাড়ি ঠেলে আসত সনাতনকাকা। আদতে ওড়িশার বারিপদা নিবাসী। ছোটখাট সৌম্য চেহারা। গলায় কণ্ঠির মালা আর টানা সুরেলা একটা ডাক। ঈষৎ নাকিসুরে—‘ঘুঁ উ উ উ নি।’ শোনামাত্র পাড়ায় একটা হুলুস্থূল পড়ে যেত যেন। পাড়ার ছেলেবুড়ো, মেয়েবউ, সবাই রোয়াক, ঝুলবারান্দা অথবা জানলায়। গাড়ির মধ্যে চৌকোনা একটা পাত্রে চাপ বেঁধে থাকা ঘুগনি। শালপাতার বাটিতে করে। সঙ্গে আইসক্রিমের কাঠ চামচ। ঘুগনির সঙ্গে আরও একটা জিনিস বিক্রি করত সনাতন কাকা। নকুলদানা। খই মুড়ির দোকানে চিনির তৈরি ছোট ছোট অমসৃণ গোলাকার যে বস্তুটিকে আমরা সাধারণত নকুলদানা বলে জানি সেরকমটা নয় মোটেই। ফুরফুরে চিনির আঁশে মাখানো টাটকা খোলাভাজা বাদাম। ঘুগনির পর সেই নকুলদানা। রসনা, স্বাদ এবং স্মৃতি, তিনটেকেই আলোড়িত করে রেখেছে আজও। হুবহু সেই একরকম ঘুগনি আজও পাওয়া যায় অফিসপাড়ায়। লালবাজারের উলটোদিকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ে। ভরাপেটেও ওদিকটা দিয়ে গেলেই একপাতা ঘুগনি মাস্ট। একদিনের জন্যও সে নিয়মের অন্যথা হয়নি অদ্যাবধি।
বাখরখানি। বাখরখণ্ডি নামেও ডাকা হয় পুববাংলা অধুনা বাংলাদেশের কোথাও কোথাও। সনাতন কাকার ঘুগনির মতো এটিও পাওয়া যেত ছেলেবেলায়। সেই উত্তর কলকাতাতেই। ময়দার বানানো অপার্থিব এক খাস্তাভাজা। নুন মিষ্টি দুটোই কম। বেকিং সোডার হালকা গন্ধ। মুখে দিলেই বাক্যহারা, মানে হতে বাধ্য। এতটাই অপ্রতিরোধ্য এর টান। এখন প্রায় অবলুপ্ত। সুন্দরবন, সরিষ্কা বা বান্ধবগড়ের বাঘের মতোই। শুনেছি খিদিরপুর, মার্ক্যুইস স্ট্রিট আর রিপন লেনের দুয়েকটি বেকারিতে এখনও তৈরি হয়। কালেভদ্রে রাস্তাঘাটে দেখা পেয়েছি দুয়েকজন বিক্রেতার। চারদিকে কাচ লাগানো টিনের বাক্স কাঁধে নিয়ে হাঁক পাড়ছেন গলির মোড়ে—“বাখরখানি আছে, বাখরখানি-ই-ই…”। চোখে পড়ামাত্র কিনে ফেলেছি। নিদেনপক্ষে আড়াইশো গ্রাম। ভোরবেলা ভাল ফ্লেভার আর পাতলা লিকারের লাল চায়ের সঙ্গে দু’-চার পিস বাখরখানি মানে বাকি দিনটা ভাল কাটতে বাধ্য। হাতে পেলে মিলিয়ে নেবেন।
দরবেশ বা লাড্ডু তো অনেক খেয়েছেন। বলি আলাউদ্দিনের লাড্ডু চেখেছেন কখনও? ভীম নাগ, নকুড় বা বলরামের মতোই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ডেলিকেসি। প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে চিৎপুর রোডে নাখোদা মসজিদের নীচে প্রাচীন এই দোকান। নামে লাড্ডু হলেও মিল কিন্তু অনেকটা সেই দরবেশের সঙ্গেই। আপাদমস্তক জমাট ক্ষীরের গোল্লার মধ্যে বোঁদের টুকরো। দরবেশের মতো শুধুমাত্র ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া খোয়া ক্ষীরের গুঁড়ো নয়, আলাউদ্দিনের লাড্ডুর মূল উপকরণই খোয়াক্ষীর। লাড্ডু বা দরবেশের তুলনায় মিষ্টি খানিকটা কম। ফারাক শুধু এতটুকুই। এদের আরেকটি অসামান্য মিষ্টান্ন পদের নাম আফলাতুন। দুধ মেরে মেরে কালচে বাদামি হয়ে যাওয়া ক্ষীরের বরফির মধ্যে কাজু, পিস্তা, কিশমিশ আর কাঠবাদামের (আলমন্ড) টুকরো। দিল্লি কা লাড্ডু না খেলে পস্তাতে হয় কিনা জানা নেই তবে আলাউদ্দিনের লাড্ডু আর আফলাতুন না খেলে যে সত্যিই পস্তাবেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কলকাতার বুকে আজ যারা নিদেনপক্ষে পঞ্চাশ-ষাটের হার্ডল টপকে গেছেন তাদের মনে থাকার কথা ছেলেবেলায় বাড়ির দরজায় দরজায় কালো ট্রাঙ্ক মাথায় ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালাদের। বেশি হাঁকডাক নেই। শুধু ‘কেক চাই’—মৃদু একটা আহ্বান। তাতেই কাজ হয়ে যেত। ‘কেকওয়ালা, এদিকে এসো’… দরজার সামনে গুছিয়ে উবুর হয়ে বসে মাথা থেকে ট্রাঙ্কটা নামাতেন বিক্রেতা। ঢাকনাটা খোলা মাত্র চকলেট-স্ট্রবেরি-অরেঞ্জ-বাটারস্কচ-ভ্যানিলার সে কী দুর্দান্ত মিশ্র সুগন্ধ। থরে থরে সাজানো রঙবেরঙের ছোট ছোট পেস্ট্রি। প্রত্যেকটার তলায় ট্রেসিংপেপারের মোনক। ট্রাঙ্কের ওপর লেখা বেকারির নাম—‘মিসেস সালদানাস কেক’, ‘রেইনবো বেকারি’… ইত্যাদি ইত্যাদি। অনির্বচনীয় সেইসব পেস্ট্রির স্বাদ। মুখে দিতে না দিতেই কোঁত করে গিয়ে সোজা পেটের মধ্যে। পেস্ট্রির ডালাটা সরালে তলায় আরেকটা কম্পার্টমেন্ট। দুভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখা প্যাটিস। চিকেন আর ভেজিটেবল। ওপরের পরতটা সোনালি-বাদামি। মুচমুচে, খাস্তা। ভেতরে আলু-পিঁয়াজ-গাজর আর মুরগির মাংসের সুগন্ধি পুর। ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী তুলে দেওয়া হত হাতে হাতে। যে সময়ের কথা বলছি তখন বাড়ির নীচে পাড়ার মোড়ে মোড়ে কেক পেস্ট্রির দোকানের গাদা লেগে যায়নি। নিউ মার্কেট, গ্রেট ইস্টার্ন আর ফ্লুরিজের বাইরে আর কোথাও এসব জিনিস পাওয়া যেত না। একমাত্র বড়দিনের সময় স্টেশনারি দোকানে সাজানো বড়ুয়ার কেক ছাড়া। ফলে রেইনবো বেকারি আর মিসেস সালদানারাই ছিলেন সেসময় মধ্যবিত্ত বাঙালির পেস্ট্রি ভরসা। বহুদিন হল হারিয়ে গেছেন শহর থেকে। সঙ্গে হারিয়ে গেছে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো সেই সুরেলা ডাক— ‘কেক চাই।’
কেক-পেস্ট্রি-প্যাটিসের কথা যখন উঠল তখন তো একবার যেতেই হবে নিউমার্কেটে। মানে কেক গলিতে। সরু গলিটা জুড়ে রঙবেরঙের কেক, পেস্ট্রি আর ক্যান্ডির মেলা। ম ম করছে সুগন্ধে। ছুটিছাটায় বাবার সঙ্গে ওদিকটায় গেলেই বায়না করতাম ‘জুজুপ’ কিনে দেবার জন্য। না লজেন্স, না চকলেট। থরে থরে সাজানো থাকত দোকানের সামনে কাঠের ডালায়। চিনির আবরণের তলায় স্ট্রবেরি-গোয়াভা-অরেঞ্জ জেলির ছোট ছোট তুলতুলে টুকরো। কোন বেহেস্তের বেকারিতে তৈরি হয় কে জানে? আজও ওদিকটা দিয়ে গেলে টুক করে কিনে ফেলি এক ঠোঙা। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে টুপ করে একটা মুখে ফেলে দিয়ে চারপাশটা ভাল করে দেখে নিই একবার। চেনাশোনা কেউ দেখে ফেলল না তো? বাড়িতে কমপ্লেন করে দিলেই চিত্তির। ‘ছি ছি… বুড়ো বয়সে… লজ্জা করে না? তোমার না সুগার?…” হোম ফ্রন্টের বাক-মিসাইলের আঘাতে আঘাতে জেরবার হয়ে যেতে হবে একেবারে।
কেক গলি ধরে মিটার পঁচিশেক এগোলেই আর এক কেক কিংবদন্তী নাহুমের গা ঘেঁষেই ম্যাক্স-ডি-গামা। হালফিলে নামীদামি দেশি বিদেশি সব বেকারির ভিড়ে হারিয়ে গেছে নামটা। পুরনো কলকাতায় কেক-পেস্ট্রির সমার্থক পাঁচটি নাম। নাহুম-গ্রেট ইস্টার্ন-ফিরপো-ফ্লুরিজ আর অতি অবশ্যই ম্যাক্স-ডি-গামা। কনফেকশনারির পঞ্চপাণ্ডব। ম্যাক্স-ডি-গামা। সময়ের কালগ্রাসে তার অতীত জৌলুস হারিয়েছে অনেকদিন। তবু একবার যান। (যদি বন্ধ না হয়ে গিয়ে থাকে এখনও)। পুরনো কাঠের দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়ুন ভেতরে। অরেঞ্জ, চকলেট, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি… কলকাতা সেরা অ্যাসর্টেড পেস্ট্রি এখানেই পাওয়া যায়।
কেকের কথা যখন উঠলই তা হলে তো একবার যেতেই হবে বো-ব্যারাকে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউর গায়ে বউবাজার থানার পাশে। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের থাকার প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল এই ব্যারাক। দু’পাশে লম্বা লাল ইটের দুটো ব্যারাকবাড়ি। মাঝখানে প্রশস্ত রাস্তা। কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের একটা উল্লেখযোগ্যঅংশের বাস এখানে। এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা। তবু যারা রয়ে গেছেন তাদের মধ্যে বিশেষ করে প্রবীণাদের হাতে আজও রয়ে গেছে এক জাদু-রসুইঘরের চাবিকাঠি। কেক আর ওয়াইন। আমাদের পৌষপরবের পুলিপিঠের মতো। বানানো হয় শীতকালে, বিশেষত বড়দিন আর নববর্ষের সময়। তা ছাড়া শীতকালটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিয়ের মরশুমও বটে। এই সময় চাহিদা তুঙ্গে ওঠে কেক আর ওয়াইনের। মদিরা রন্ধন-পটীয়সী ঠাকুমা-দিদিমাদের দরজার সামনে ভিড় বাড়ে। সঙ্গে উইন্টার থুড়ি ক্রিসমাস স্পেশাল কেক। আপনিও যান। কিনে ফেলুন প্লাম, ফ্রুট অথবা প্লেন কেকের মধ্যে যেটা খুশি। নামীদামি বেকারির কেক তো সবসময়ই খাচ্ছেন। বো-ব্যারাকের কেক একবার ট্রাই করুন। চেনা রুট বদলে ফেলবেন। একদম সিয়োর। অতঃপর মদিরা পর্ব। গ্রেপস, জিঞ্জার, বানানা আর লিচি— এই চার ধরনের ওয়াইন বানানো হয় এখানে। আমি চিরকেলে অম্বুলে রুগি। সাধারণত টক স্বাদের ওয়াইন খেলে গ্যাস অ্যাসিডিটির সমস্যা হয় একটা। ব্যতিক্রম বো-ব্যারাক আর এদের টকমিষ্টি ঝাঁঝালো স্বাদের ওয়াইন। মদিরা জাদুকরীদের অন্যতম দু’জন, জর্জিনা আর সুজানা আন্টি। বহু বছর ধরে উত্কৃষ্ট হোম মেড ওয়াইন বানিয়ে চলেছেন এই শহরে। এরপর আর একটাও কথা নয়।
ফের সেই ছেলেবেলা। আর ছেলেবেলা মানেই টিফিনের সময় আর ছুটির পর ইস্কুলের গেট। মাস্টারমশাইদের প্রবল চোখরাঙানি আর ‘পেটখারাপ হবে!’ ধরনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছোট ছোট লাল পুঁতির মতো মশলা মাখানো বুনোকুল, হজমি, কাঠির আগায় লাল নীল বরফগুঁড়ো আর সরবতের তীব্র আকর্ষণ। সেটা যে কত তীব্র হতে পারে যারা ইস্কুলে গিয়েছেন তাদের কাউকে নতুন করে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। মনে মনে ভাবতাম ওসব বোধহয় আমাদের মতো বুড়ো হাবড়াদের নস্টালজিয়ার কচকচানি। এতদিনে নিশ্চয় চুকেবুকে গেছে ওসব। এহেন ধারণাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত করে সেদিন চোখ গেল মধ্য কলকাতার নামী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গেটে। ইস্কুল ছুটির পর গেটের সামনে নামীদামি ব্র্যান্ডের আইসক্রিম আর চিপসের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফেরিওয়ালারা। সেসবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেটের একপাশে রঙিন শরবতের ঠেলাগাড়ি আর হজমির ডালার সামনে ভিড় জমিয়েছে সম্পন্ন ঘরের খুদে পড়ুয়াদের দল। জোগান দিতে দিতে হাঁফিয়ে উঠেছেন বিক্রেতা। হাতের কাঠিতে গোঁজা রামধনু রঙা জমাট বরফের কুচি। ঠোঁটে, গালে, ইউনিফর্মে লেগে যাওয়া লাল, নীল, সবুজের ছোপ। কচি মুখে গোটা একটা পৃথিবী জিতে ফেলার হাসি। দেখামাত্র মনে হল সবকিছুকে এক ছাঁচে মুড়ে ফেলতে চাওয়া বিশাল এই বিশ্বায়নের বাজার কোথায় যেন গো-হারা হেরে গেছে ছোট্ট ওই একটুকরো হাসির সামনে। অন্য খাবারের শেষপর্বে পৌঁছে এটুকুই তো পাওনা এই অধম প্রতিবেদকের।
* লেখাটা শেষ করার কিছুদিন পর জানতে পারলাম কোনও অজ্ঞাত কারণে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ধাবা বন্ধ হয়ে গেছে। কলকাতার সেরা খাদ্য নক্ষত্রমণ্ডলীর একটি তারকার পতন ঘটে গেল। এছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি।
১২. এসকর্ট কলকাতা
এসকর্ট সার্ভিস, এসকর্ট গার্ল। বছর কয়েক আগে বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের সময় ভিশন মিডিয়ায় আর খবরের কাগজে, একাধিক নামী দামি ব্যক্তিত্বের মুখে বারবার উঠে এসেছিল শব্দগুলো। বেশ কিছু প্রতিবেদনও লেখা হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে। এই এসকর্ট সার্ভিস ব্যাপারটা আসলে কী? পাঠকরা জেনেছিলেন এসকর্ট সার্ভিস মানে হাই প্রোফাইল প্রসটিটিউশন। সমাজের উঁচুস্তরে নারীমাংসের কারবার। এদের মধ্যে কেউই নিষিদ্ধপল্লীর দরজায় অথবা রাস্তার ওপর রংচঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকেন না। খোলা চোখে এদের দেখা পাওয়াটা অসম্ভব। সম্পূর্ণভাবে দালাল থুড়ি এজেন্ট নির্ভর। ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত মহিলারা সকলেই কমবেশি শিক্ষিত, বিশেষ করে ইংরেজি সহ আরও দুয়েকটি ভাষায় কথোপকথনে সবিশেষ দক্ষ। পড়তে পড়তে মনটা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল বছর পঁচিশেক আগে। তখন এসকর্ট সার্ভিস কথাটা শোনেনি কেউ। সমাজের উঁচুতলায় এ ধরনের মহিলারা পরিচিত ছিলেন ‘কলগার্ল’ নামে। ঘটনাচক্রে এরকম কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল বিভিন্ন সময় এবং পরিস্থিতিতে। সেই অভিজ্ঞতারই কিছুটা শোনাব এখানে।
উনিশশো একানব্বই কি বিরানব্বই সাল। টুলুদার সঙ্গে বসেছিলাম অলিপাবে। দুটো জাম্বো সাইজের বিফস্টেক আর তিনটে লার্জ পেগের পর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে থাপ্পড় লাগাল টুলুদা— “চল, আজ একবার লিলির ফ্ল্যাটে যাব।’ টুলুদা। বেহালা অঞ্চলে বিশাল বনেদি পরিবারের সন্তান। ওই এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি। পেশায় একটি বহুজাতিক চা-কোম্পানির টি-টেস্টার। যখনকার কথা বলছি তখনও ইএমআই স্কিমের দৌলতে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে গাড়ি ঢুকে পড়েনি। গাড়ি চড়াটা তখনও বেশ রহিসি ব্যাপারই ছিল। ইন্ডিয়া হবি সেন্টারের সামনে পার্কিং লটে দাঁড় করানো টুলুদার হিলম্যান গাড়িটা। “আব্দুল, থিয়েটার রোড চলো।” গাড়িতে বসে গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল টুলুদা।
থিয়েটার রোডের মোড় থেকে বাঁদিক ঘুরে গলির মধ্যে পুরনো সায়েবি কেতার বাড়ি। দোতলা। কাঠের সিঁড়ি। ওঠার সময় ধমধম আওয়াজ হচ্ছিল। দোতলায় বিশাল মজবুত কাঠের দরজা। বেল টিপতেই ভেতর থেকে অল্পবয়েসি বামাকণ্ঠের আওয়াজ— “কে?” “টুলুদা, খোল।” শোনামাত্র “ও, আপনি…।” খুলে গেল দরজা, সামনে দাঁড়ানো একটি মেয়ে। বছর বিশ-বাইশেক। পরনে পরিষ্কার কাচা শাড়ি। “আপনারা বসুন, দিদি চানে ঢুকেছে। বেরোবে এক্ষুনি।” চলে গেল মেয়েটা। “বোস।” দৃশ্যতই হতভম্ব এবং অপ্রস্তুত আমার দিকে তাকিয়ে বলল টুলুদা। তারপর নিজেই ধপ করে বসে পড়ল সামনে সোফাটায়। ইতস্তত করে বসে পড়লাম আমিও। সাজানো গোছানো ছিমছাম ফার্নিশড ফ্ল্যাট। হালকা এসি চলছে। সুদৃশ্য ছোট একটা ট্রে-তে করে দু’গ্লাস জল নিয়ে ঢুকল মেয়েটা। “কী খাবেন? চা না কফি।”
“এখন না, লিলি আসুক আগে, তারপর…।” বলল টুলুদা।
মিনিট পাঁচেক বাদে ড্রইংরুমে যিনি ঢুকলেন ওরকম ধারালো চেহারার সুন্দরী অদ্যাবধি খুব কমই দেখেছি জীবনে। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ যা কিছু একটা হতে পারে। হাইট কমপক্ষে পাঁচ ফুট সাত কি আট। পালিশ করা তামাটে গায়ের রং। কোমরে দড়ি বাঁধা কিমানো টাইপের একটা নাইট গাউন পরনে। মুখে ঝকঝকে হাসি— “আরে টুলুদা! হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ… অনেকদিন বাদে…।”
“এই ফিরলে?” মুচকি হেসে প্রশ্ন করল টুলুদা।
“আর বোলো না, একটা শর্ট এ্যাসাইনমেন্ট ছিল…।” একটা নামী পাঁচতারা হোটেলের নাম করলেন মহিলা। “তারপর কী নেবে বলো, হার্ড না সফট্?”
“তুমি তো জানো… সন্ধের পর আই ডোন্ট গো ফর সফট্…..।”
“মালতী…।” টুলুদার কথা শেষ হবার আগেই হেঁকে উঠলেন ভদ্রমহিলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্রে-তে বোতল-গেলাস-স্ন্যাক্স, সবকিছু সাজিয়ে এনে সামনে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখল মেয়েটা।
“ওহো, এর সঙ্গে তো আলাপই করিয়ে দেয়া হয়নি। এ…।” আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল টুলুদা। মনে আছে জীবনে ওই প্রথমবার স্কচ খাওয়ার অভিজ্ঞতা… প্রায় ঘণ্টা-তিনেক তুমুল আড্ডার পর প্রায় বারোটা নাগাদ রাস্তায় নামলাম আমরা। “কিরে, কিছু জিজ্ঞেসটিজ্ঞেস করলি না?” গাড়িতে আমাকে প্রশ্ন করল টুলুদা।
“কী জিজ্ঞেস করব?” ঘুরে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম।
“যা ব্বাওয়া! অ্যাতোক্ষণ থাকলি। ভরপুর আড্ডা হল। একবারও তো জানতে চাইলি না লিলি কে?” টুলুদার ঢুলুঢুলু চোখে হালকা বিস্ময়।
“জানবার কী আছে? উনি তোমার পরিচিত। খুবই ক্লোজ… সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।”
“তা তো বটেই।” আমার কথায় মুচকি হাসল টুলুদা “বাট দ্যাট’স ওনলি আ পার্ট অফ দ্য হোল স্টোরি।” অতঃপর টুলুদার কাছেই জেনেছিলাম লিলিদি (আড্ডার মাঝখানেই কখন যেন সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গেছিল) আসলে এই শহরের একজন অভিজাত নগরনটী। টুলুদার ভাষায়— “ওয়ান অফ দ্য মোস্ট সফিস্টিকেটেড অ্যান্ড হাই প্রোফাইল কলগার্ল ইন দ্য সিটি। এক সে এক রহিস ক্লায়েন্ট। বড় বড় হোটেল আর পার্টিতে হরবখত আনাগোনা। পার নাইট চার্জ…” টাকার অঙ্কটা শুনে চোখ কপালে উঠে গেছিল। এসি গাড়ির মধ্যেও ঘেমে উঠেছিলাম দরদর করে। টুলুদার কাছে আরও জেনেছিলাম খদ্দেরকে কাস্টমার নয়, ক্লায়েন্ট বলে ডাকা হয় এই লাইনে। কারও সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক অথবা পুরো একটা রাত কাটানোর সাংকেতিক নাম ‘শর্ট’ অথবা ‘লং অ্যাসাইনমেন্ট’। পুরো ব্যাপারটাই এজেন্ট নির্ভর। কোথায়, কবে, কার সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট— সব দায়িত্ব এজেন্টের ওপর। অ্যাসাইনমেন্টের কাজে প্রায়ই অন্য রাজ্যে এমনকী বিদেশেও যেতে হয়। এত কিছু জানার পরেও জিজ্ঞেস করিনি টুলুদার সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলা মানে লিলিদির সম্পর্কটা কী? ইচ্ছেও করেনি কারণ সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি আমার কাছে। পরবর্তীতে একাধিকবার গেছি লিলিদির ফ্ল্যাটে। টুলুদার সঙ্গে। ওখানেই আলাপ হয়েছিল শুভ্রা আর ভেরোনিকার সঙ্গে। দু’জনেই লিলিদির থেকে বয়সে বেশ খানিকটা ছোট। লিলিদির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দু’জনেই এবং একই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে প্রথমজন শুভ্রা। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর কাছে অভিজাত এলাকার একটা ফ্ল্যাটে থাকত। সিঙ্গল মল্ট হুইস্কির ভক্ত। চেইন স্মোকার। ঝড়ের মতো ইংরেজি বলত। দুর্ধর্ষ রন্ধনপটীয়সী। গীতা দত্ত, ন্যাট কিংকোল আর টিনা চার্লসের উন্মত্ত ফ্যান। বাড়িতে থাকলে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে এক সে এক রান্না করা ছাড়া সর্বক্ষণের সঙ্গী বলতে দুটো পিকিনিজ কুকুর। নিজে প্রচণ্ড বেপরোয়া। অ্যাসাইনমেন্ট না থাকলে নিজের লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ উইলিস জিপটা নিয়ে একশো, একশো কুড়ির স্পিডে বেরিয়ে পড়ত লং ড্রাইভে— দীঘা, পুরী বা মুকুটমণিপুর। সঙ্গে দু’-চার ক্রেট বিয়ার আর প্রিয় দুই সারমেয়। তত্কালীন কলকাতার দুটি বিখ্যাত সিনেমা হলের এক মালিক (বাংলা সিনেমার এক নামী অভিনেত্রীর স্বামীও বটে) আর স্যানিটারি গুডস ব্যাবসার এক নামজাদা ব্যবসায়ী— দু’জনের মধ্যে নিয়মিত প্রতিযোগিতা চলত কে শুভ্রার মনোযোগ বেশি করে আদায় করবে। অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলত শুভ্রা। পালা করে বছরে দু’বার বিদেশ ভ্রমণে যেত দু’জনের সঙ্গেই। ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসত দুর্দান্ত সব ওয়াইন আর বিদেশি চকলেট। জুয়ার নেশা ছিল প্রচণ্ড। কলকাতার বেশ কিছু অভিজাত ক্লাবের জুয়ার আড্ডায় দেখা যেত প্রায়ই। সিনেমা প্রযোজনাতেও হাত লাগিয়েছিল একবার। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ। সিনেমার উঠতি এক পরিচালককে বিয়েও করেছিল। মাস তিনেকের বেশি টেকেনি। ফিরে এসেছিল পুরনো পেশায়। পরিণতিটা ছিল মর্মান্তিক। একরাত্তিরে নিজের ফ্ল্যাটে মদের নেশায় চুর হয়ে সিনেমা হল মালিকের লাইসেন্সন্ড কোল্ট রিভলবারটা টেনে নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে পরপর দুটো বুলেট ঠুকে দেয় প্রেমিকের কপালে। তারপর নিজের মাথায় গুলি চালায়। মৃত্যু মুহূর্তের মধ্যে, দু’জনেরই। প্রিয় পোষ্যদুটিকে নিয়ে গেছিল পশুপ্রেমী এক সংস্থা। সেসময় সংবাদপত্রগুলোয় এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছিল কয়েকদিন।
দ্বিতীয় জন ভেরোনিকা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে। বাড়ি ছিল রয়েড স্ট্রিট অঞ্চলে। প্রচণ্ড হুল্লোড়বাজ, প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি সবসময়। দুর্দান্ত পসার ছিল। পরবর্তীতে নিজেরই সম্প্রদায়ের একটি ছেলেকে বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়ায়। ফলে খবর পাওয়া বা যোগাযোগের সুযোগ হয়নি স্বাভাবিকভাবেই।
শুভ্রার মতোই করুণ পরিণতি হয়েছিল লিলিদিরও। বেশি বয়সে অল্প বয়সি হ্যান্ডসাম এবং প্রতারক এক প্রেমিকের পাল্লায় পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে রাস্তায় নামেন। পরবর্তীতে অনেকদিন দেখেছি নোংরা, ছেঁড়া আলুথালু পোশাকে, উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে। শীর্ণকায় চেহারা। কোটরে বসে যাওয়া সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ দুটো চোখ। ফাঁকা বোধশূন্য দৃষ্টি। মুখে সস্তা চোলাই মদের গন্ধ। চিনতে পারছেন না কাউকে। এরকম চলেছিল বছর খানেক। অতঃপর এক শীতের ভোরে রাস্তা ঝাঁট দিতে আসা ঝাড়ুদাররা ক্যামাক স্ট্রিটের ফুটপাতে লিলিদির মৃতদেহটা দেখতে পায়। থিয়েটার রোডের মোড়ে রেখা বারের (এখন নেই) স্টুয়ার্ট কৃষ্ণান ভাই দিন তিনেক বাদে আমায় খবরটা দেন।
অনেকদিন আগের ঘটনা। তবু এই তিনজনের কথা আমি ভুলিনি আরও একটা কারণে। নব্বই দশকের শেষের দিকে দিল্লির একটি নামী সোশ্যাল রিসার্চ সংস্থার থেকে কলগার্লদের ওপর কাজ করার কনসাইনমেন্ট পাই। একাজে লিলিদি, শুভ্রা আর ভেরোনিকা যেভাবে আমাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিল সেটা কখনওই ভোলার নয়। ওদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা না পেলে কাজটা আদৌ করা সম্ভব হত না আমার পক্ষে। ওদের রেফারেন্সেই পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম আরও একজনের কাছে যে এই পেশায় তুলনামূলকভাবে নবাগতা। বালিগঞ্জ এলাকায় একটা ফ্ল্যাটে মা’র সঙ্গে থাকত। নাম ঠিকানা কখনওই উল্লেখ করা যাবে না— এই শর্তে রাজি হয়েছিল কথা বলতে। আগে একটা নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিতে রিসেপশনিস্টের চাকরি করত। ছেড়েছুড়ে এই পেশায়। “কেন?” প্রশ্ন করায় “কারণ এটাও আর দশটা কাজের মতো আরেকটা কাজ অ্যান্ড এন্ড অফ দ্য ডে ইট মিনস্ মোর মানি”—
উত্তর দিয়েছিল নির্লিপ্ত মুখে। আদ্যোপান্ত পেশাদার। লিলিদিদের মতো প্রেমে পড়ে কেরিয়ার খারাপ করার কোনও বাসনাই নেই। নেই ফালতু আড্ডা বা বেকার হইহুল্লোড়ে সময় নষ্ট করার বাতিক। ভয়ংকর রকম ফিগার কনশাস। নিয়মিত একটি পাঁচতারা হোটেলের জিমে ওয়ার্কআউট করত। চর্বি বা তেল মশলাদার জাতীয় খাবার। নৈব নৈব চ। মদ্যপানে তেমন একটা আসক্তি নেই। ক্লায়েন্ট ভিজিটের সময় মেরেকেটে বড়জোর দু-এক গ্লাস দামি ওয়াইন। তিন-চারজন অত্যন্ত দক্ষ, শিক্ষিত এবং পেশাদার এজেন্ট রয়েছে। পুরো কারবারটাই চলে ইন্টারনেটে, আজকালকার ভাষায় ‘অনলাইনে’। পেশার প্রয়োজনে মুম্বাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু যেতে হয় হরবখত। এ ছাড়াও মাসে একবার দুবাই যাওয়া বাঁধা। দু-তিন দিনের ট্রিপ। পার্মানেন্ট ক্লায়েন্ট। মাসিক লাখ দেড়েকের প্যাকেজ (প্রিয় পাঠক সাতানব্বই-আটানব্বই সালে টাকার অঙ্কটা চিন্তা করুন একবার)। উত্তরদাত্রীর কাছেই শুনেছিলাম এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের ‘কলগার্ল’ নামে আর ডাকা হয় না এখন। লিলিদি, শুভ্রা, ভেরোনিকাদের মতো পুরনো, আমুদে, হুল্লোড়বাজ, সুখ-দুঃখ মেশানো কলগার্লরা চলে গেছে বেবাক বাতিলের খাতায়। তার বদলে শহরের উঁচুতলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসকর্ট সার্ভিস। ‘এন্ড অফ দ্য ডে ইট মিনস্ মোর মানি’টাই একমাত্র বেদবাক্য যেখানে।
* প্রতিবেদনটিতে সব চরিত্রের নামই পরিবর্তিত।
৩. কলকাতার হারিয়ে যাওয়া মেলা
আজ যাঁরা চল্লিশ এমনকী পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই তাঁরাও কল্পনাতেই আনতে পারবেন না দৃশ্যটা। ষাটের দশকের গোড়ার কথা। একটা অন্যরকম, রূপকথামার্কা কলকাতা। রাস্তায় বাঘ-ছাপ লাল রঙের দোতলা বাস। মোড়ের মাথায় ট্র্যাফিক সিগনালে হাফপ্যান্ট পরিহিত কনস্টেবল। ভোরবেলা করপোরেশনের রাস্তা ধোয়া গাড়ি। ময়দানে চুনি-পিকে-বলরাম-আমেদকে দেখার জন্য কাঠফাটা দুপুর আর কাদা মাখামাখি লম্বা লাইন। ঘরের সিলিঙে আড়াআড়ি টাঙানো এরিয়ালের নীচে টেবিলে সাজানো গাম্বাট সাইজের জি ই সি কিংবা মারফি রেডিয়ো, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার, কমল ভটচায, পিয়ারসন সুরিটা…। মাংসের দোকানে টাঙানো লাল শালু— ‘খাসির মাংস— ৫ টাকা Kg’। ব্রয়লার চিকেন বাজারে খেলতে নামেনি তখনও। বেশিরভাগ গেরস্ত বাড়িতে মুরগি তখনও ‘রামপাখি’ এবং নিষিদ্ধ। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়িতে কালেভদ্রে দেশি মুরগির মাংস তখনও বাঙালির ‘ডেলিকেসি’। লোয়ার সার্কুলার রোড তখনও ঠিকঠাক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড হয়ে ওঠেনি। আজও মনে আছে শ্রীমানি বাজারের উলটোদিকে রামমোহন লাইব্রেরির গা ঘেঁষে আমাদের বাড়ির সামনে ফুটপাতের ওপর দিয়ে একটা রেললাইন সোজা চলে গেছিল শেয়ালদার দিকে। রেলগাড়ি যেতে দেখিনি কোনওদিন তবে পাড়ার কাকা জ্যাঠাদের কাছে শুনেছিলাম মার্টিন বার্ন না করপোরেশন কার যেন একটা ময়লা ফেলার ওয়াগন গাড়ি নাকি হুইসল বাজাতে বাজাতে চলে যেত ধাপায়, ফি দুপুরবেলা। আমাদের পাড়ার সামনে লাইনটা পিচের ফুটপাতে বসে গেছিল প্রায়, দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ার ফলেই হয়তো বা। তবে শেয়ালদার কাছে প্রাচী সিনেমার উলটোদিকে লাইনটা মাথা উঁচিয়ে ছিল তখনও অবধি। স্পষ্ট মনে আছে এন আর এস হাসপাতালের দুটো গেটের মাঝখানে আজ যেখানটায় ছাউনি দেয়া বাসস্টপ ঠিক সেখানে একটা জং ধরে যাওয়া ভাঙাচোরা ওয়াগন দাঁড় করানো ছিল দীর্ঘদিন। আর সেখানেই রেললাইন ঘেঁষে ফুটপাতের দু’ধার জুড়ে বসত অদ্যাবধি কলকাতার সবচেয়ে বড় মেলা। শেয়ালদার রথের মেলা। রথের দিন থেকে শুরু হয়ে চলত টানা এক মাস। জানি, এই অবধি পড়েই অনেকে হই হই করে উঠবেন— “সবচে বড় মেলা? গুল মারবার আর জায়গা পাননি মশাই? আমাদের বুক ফেয়ার, শিল্প মেলা… এগুলো সব কী তা হলে?” ধীরে বন্ধু ধীরে, আগে আমার কথাটা শেষ করতে দিন, তারপর না হয় মন খুলে গালাগাল করবেন। প্রথমে মেলার দৈর্ঘ্যের কথাটা বলি তা হলেই বোধ হয় আমার দাবির সত্যতা প্রমাণিত হবে। শেয়ালদা ফ্লাইওভার তখনও সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে। অতএব মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করুন একবার। বেলেঘাটা রেলব্রিজের নীচ থেকে শুরু হয়ে বাঁক খেয়ে পুরো এন আর এস চত্বর, আর আহমেদ ডেন্টাল হসপিটাল হয়ে মৌলালী যুবকেন্দ্রের (তখনও হয়নি) গা ঘেঁষে লালমোহন ভট্টাচার্য রোডে ঢুকে যেত মেলাটা। শেষ হত সি আইটি রোডের মোড়ে ফিলিপস বাস স্টপেজের সামনে। কম সে কম কিলোমিটার দেড়েক তো হবেই। শুধু কি বিশালত্ব? বৈচিত্রের দিক থেকেও অনন্য ছিল এই মেলা। বেলেঘাটা রেলব্রিজ থেকে নেমে শেয়ালদামুখো যে রাস্তাটায় আজ ফুটপাতের দু’পাশে সারি সারি স্থায়ী গাছের স্টল, সেগুলো স্থায়ী ছিল না তখন। তার বদলে রথের একমাসই বসত, ওই একই জায়গায়। তখন ক্লাস ফোর। ওখান থেকেই কিনে এনেছিলাম নাইন-ও-ক্লকের চারা। ছোট্ট টব। এতটুকু লতানে গাছে ঠিক সকাল ন’টাতেই ফুল ফোটে— এই অপার বিস্ময়ের ঘোরটা কাটেনি আজও।
মোড় ঘুরেই এন আর এসের প্রথম গেটটার দু’ধারে পশুপাখির হাট। আজকে অবিশ্বাস্য মনে হবে (হয়তো বা গুলও), বড় বড় মোটা জালের খাঁচায় ভরে অবাধে বিক্রি হত ভালুকছানা, বাঁদর, চিতল হরিণের বাচ্চা, অধুনা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির তালিকায় চলে যাওয়া ডাঙার তারা কচ্ছপ (স্টার টরটয়েজ), দেশি টিয়া, তোতা, ফুলটুসি, ডিউস বলের মতো বড় মাথা আর ইয়া লম্বা ল্যাজঝোলা পাঞ্জাবি চন্দনা, আসামি ময়না, কুচকুচে কালো গা, গালে গাঢ় কমলা রঙের গালপাট্টা, কথা নকল করার ওস্তাদ, বেনে বউ, শ্যামসুন্দর, লালমুনিয়া, চিনে বুলবুল, ধানচড়াই, চোখ বাঁধা ময়ূর (আজ বুঝতে পারি কেন প্রকৃতির এইসব না-মানুষি সন্তানরা এত দ্রুত পা বাড়িয়েছে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার রাস্তায়)… একচুলও বাড়িয়ে বলছি না। বিশ্বাস করুন। এর পাশাপাশি বিদেশি পাখিও বিক্রি হত প্রচুর পরিমাণে। নীল সবুজ সাদা রঙের বদ্রিকা, আকারে চড়াইয়ের চেয়েও ছোট টুকটুকে লাল ঠোঁট আর দুধসাদা রঙের ফিঞ্চ, সর্বদা জোড় বেঁধে থাকা লাভবার্ড, ক্যানারি— উজ্জ্বল হলুদ গায়ে কালো কালো ছিট ছিট, বড় লোহার দাঁড়ে বসে থাকা গম্ভীরমুখো কাকাতুয়া, চিনে মুরগি, রাজহাঁস… এককথায় পাখির স্বর্গোদ্যান! আর আসত কুকুর। মূলত টিবেটিয়ান লাসা অ্যাপসো সিডনি সিল্কির বাচ্চা। এক গা ভরতি সোনালি লোম। মিহি খেউ খেউ চিৎকার… অধুনা ভোডাফোনের পাগ আর ল্যাব্রাডরের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে গেছে কলকাতার পোষ্য মানচিত্র থেকে। পশুপাখির স্টলের গায়েই বসত রঙিন মাছের বাজার। সারি সারি অ্যাকোয়ারিয়াম আর কাচের শিশিতে অ্যাঞ্জেল, সোর্ডটেইল, ব্ল্যাকমলি, ফাইটার, কিসিং গোরামি, টাইগার বার্ব… এ যেন সেই ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে’ ফুটপাতের পাশে কাচাধারে। মুগ্ধচোখে দাঁড়িয়ে দেখত ক্লাস থ্রি ফোরের একটা বাচ্চা ছেলে, বাবার হাত ধরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই যে পশুপাখি পোষার শখটা ঝিলিক মেরে উঠেছিল মাথার মধ্যে তার শুরুয়াতও কিন্তু হাতিবাগান হাট আর ওই শেয়ালদার রথের মেলায়। ষাট-ষাটটা বসন্ত পেরিয়ে এসেও আজও সেই শখটা মরে যায়নি ছেলেটার মনের মধ্যে।
পশুপাখির মেলার উলটোদিকেই টগর কুমারের ম্যাজিক শো। ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া, করাতে মানুষ কাটা আর পরমুহূর্তেই জুড়ে দেওয়া… শ কিসিমের ভানুমতীর খেল। ম্যাজিক স্টলের গায়েই লম্বাটে তাঁবু। তাঁবুর সামনেই বাইরে একটা মাচামতো। মাচার সামনে ক্লাউন সেজে নেচে কুঁদে ভিড় জমাত একটা লোক। হাতে একটা বাঁকাত্যাড়া চোঙা। ঘন ঘন অ্যানাউন্সমেন্ট— ‘আসুন, আসুন। এক্ষুনি শো চালু হয়ে যাবে… স্পাইডার গার্ল, ইলেকট্রিক গার্ল, দু’মাথাওয়ালা মেয়ে, জীবন্ত রাক্ষস মানুষ— জ্যান্ত হাঁসমুরগি ধরছে আর গপাগপ গিলছে… জলদি করুন! আর মাত্র কয়েকটা টিকিট পড়ে আছে। মূল্য মাত্র উনিশ পয়সা…।’ পিছনে টাঙানো লম্বা চওড়া একটা ক্যানভাস। অপটু হাত আর চড়া রঙে আঁকা উদ্ভিন্নযৌবনা স্বল্পবসনা বিদ্যুত্সুন্দরী, মাকড়সা কন্যাদের ছবি। দেহাতি মানুষজনের ভিড়। টিকিটের চাহিদাও মন্দ না। সেটা কতটা ক্লাউনের কথার জাগলারি আর কতটা পরদায় আঁকা ছবির আকর্ষণে সেটা বলা মুশকিল। তাঁবুটার গায়ে লেগে আরেকটা তাঁবু। আকারে একই রকম। ছোট চিড়িয়াখানা। আগের তাঁবুটার সঙ্গে তফাত একটাই। সামনে টাঙানো ক্যানভাসে মাকড়সা কন্যাদের বদলে পাহাড়, জঙ্গল, ঝরনা, নদী… চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর সব বন্যপ্রাণী। সোঁদরবনের বাঘ থেকে শুরু করে ঝকঝকে করাতের মতো দাঁত খিঁচিয়ে থাকা টিরেনসোরাস রেক্স— কে নেই সেই ছবির লিস্টে! পরদার দু’পাশে টাঙানো দুটো মাইক থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে হিংস্র বাঘের গর্জন— ‘উঁউম্ম্ম্ উঁউম্ম্ম্।’ টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলে দেখা যেত ওপর নীচ সার সার দশ-বারোটা ছোট ছোট খুপরি খাঁচা। ভাল করে উঠে দাঁড়ানোই অসম্ভব, চলাফেরা তো দুরস্থান। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, দুর্গন্ধময় খাঁচার খোপে একটা রুগ্ন লোমওঠা চিতাবাঘ। দাঁতভাঙা, পাঁজরের হাড় ঠেলে বেরোনো হায়না একটা। বিষণ্ণ চোখে গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকা বুড়ো বাঁদর, শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে যাওয়া অজগর, ঘুমন্ত এবং অভুক্ত বনবেড়াল… কেন জানি না ওই ছেলেবেলাতেই মনটা খুব ভারী হয়ে গেছিল দেখার পর। আর কোনওদিন ঢুকিনি ওই ‘মিনিয়েচার জু’-র তাঁবুটায়।
চিড়িয়াখানা-তাঁবুর পাশে অনেকটা উঁচু এবং গোলাকৃতি টিন ঘেরা জায়গা। টিনের গায়ে আঁটা সাইনবোর্ড— ‘মরণকূপের খেলা’। টিকিট কেটে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হত ওপরে। একটা গোলাকার গভীর কুয়ো। একটা ফাইভ হানড্রেড সি সি ডাবল সিলিন্ডার রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট মোটরবাইক নিয়ে মৃত্যুকূপের খেলা দেখাতেন চুঁচুড়ার তপনকুমার কুণ্ডু ওরফে তপনকুমার। একশো চল্লিশ-পঞ্চাশ স্পিডে কুয়োর দেয়ালে কাত হয়ে যাওয়া বাইকে চড়ে চক্রাকারে ওপর থেকে নীচ, নীচ থেকে ওপর প্রদক্ষিণ করতেন ভীমগতিতে, দেখতে দেখতে পেটের মধ্যে খামচে ধরত ভয়। কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ। দম আটকে আসত আতঙ্কে। পরবর্তীতে সার্কাসে গ্লোব প্যাটার্নের খাঁচায় বহুবার দেখেছি খেলাটা। অনেকটা দূর থেকে। কিন্তু রথের মেলার সেই হাড় হিম করে দেয়া অনুভূতিটা অনুভব করিনি কখনও।
মরণকূপের পর থেকেই লাইন দিয়ে শুরু হয়ে যেত মাটির খেলনার দোকান। এক ছাঁচের ঢালে গড়া কালীয় দমন, তারকা রাক্ষসীর বিশালকায় স্তনে রক্তপানরত শ্রীকৃষ্ণ, বাসুকিনাগের ফণার ছাতায় কৃষ্ণকোলে যমুনা পার হওয়া বাসুদেব, গলায় স্প্রিং-এর মাথা নাড়া বুড়ো, ইয়া মোটা আর সদা হাস্যময় কৃষ্ণনগরের জোড়া বুড়োবুড়ি, আলখাল্লা পরিহিত দাড়িওয়ালা রবিঠাকুর… মাটির খেলনা বহুদিন হল হারিয়ে গেছে শহর থেকে কিন্তু বাকি সব মূর্তি রঙিন হওয়া সত্ত্বেও রবিঠাকুর কেন আপাদমস্তক সাদা, এ ব্যাখ্যাটা পাইনি আজও। অধুনা এই চিনে খেলনা অধ্যুষিত শহরে।
রথের মেলা বলতেই সবাই বোঝে পাঁপড়ভাজা। এরকম একটা অদ্ভুত ধারণা, প্রায় মিথের পর্যায়ে, কীভাবে গড়ে উঠল বোঝা দায়। অথচ পাঁপড়ের পাশাপাশি জিলিপি, খাজা, লাঠিগজা আর তেলেভাজাও মেলার অন্যতম মূল আকর্ষণ। অথচ সেসবের কথা বলা-ই হয় না প্রায়। একটা দুটো নয় অন্তত দশ-বারোটা এরকম অস্থায়ী খাবারের দোকান বসত শেয়ালদার রথের মেলায়। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিলিপি আর খাজার ওপর প্রথম উড়তে দেখা মৌমাছি… দৃশ্যটা গেঁথে রয়েছে মনের মধ্যে, আজও।
এর পাশাপাশি জৈন শিল্প মন্দিরের আচারের দোকানে গোটা পাঁচেক লম্বা লম্বা র্যাকে সাজানো রকমারি আচারের বয়াম। কুল থেকে শুরু করে আম হয়ে চালতা, আদা, রসুন, তেঁতুল মায় ফুলকপি, বাঁশের কোঁড় (ব্যাম্বুশুট) অবধি। এক কথায় বিরাটাচারও বলা চলে। জৈন শিল্প মন্দিরের গায়ে লাইন দিয়ে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র আর এয়ারগানে বেলুন ফাটানোর স্টল। স্টলের পিছনে চাঁদমারিতে গোলাকার বৃত্তে সাজানো লাল, নীল, সবুজ বেলুন। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাক করে ফাটাতে হত বাঁশে কনুই ভর দিয়ে। পার শট দু’-নয়া পয়সা। ক্লাস এইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সেটা বেড়ে চৌকোনা পাঁচ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। তবে পাকা নিশানাবাজদের কাছে বেলুনের চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল সুতোয় ঝোলানো পয়সা। অব্যর্থ টিপে নড়ে উঠত বন্দুকবাজের গর্বিত হাসিটা আরেকটু চওড়া করে।
বেলুন স্টলের উলটো ফুটপাতে মাটিতে উলকির পসার সাজিয়ে বসত যাযাবরী মহিলারা। আঁটসাঁটো চেহারা, খাটো ব্লাউজ, পেঁচিয়ে টাইট করে পরা শাড়ি, কনুই অবধি ঢাকা অজস্র চুড়িতে। নিজেদের গায়েও অসংখ্য উলকি। যখনকার কথা বলছি, তখনও উলকি ‘ট্যাটু’ হয়ে উঠতে প্রায় অর্ধশতক বাকি। মূলত দেহাতি ঝি-বহুরিরাই ছিলেন এই উলকিওয়ালিদের প্রধান গ্রাহক। উলকিওয়ালি, সামনে বিছানো একটা আধময়লা কাপড়ে আঁকা উলকির নমুনা। বিষয় নানাবিধ। এক হাতে গন্ধমাদন অন্য হাতে গাম্বাট সাইজের গদা নিয়ে ফ্লাইং বজরঙ্গবলী, বংশীবাদনরত কেষ্টঠাকুর, ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্ট, হিন্দি লেটারহেডে লেখা ‘রাম’… ইত্যাদি ইত্যাদি। সামনে হাত পেতে বসা দেহাতি বউ। হাতের কবজিতে পেতল-তামা-রুপো আর দস্তা মেশানো চারধাতুর ইয়া মোটা খাড়ু। কানের ফুটো ঝুলে ইঞ্চিখানেক হাঁ হয়ে গেছে ভারী পেতলের মাকড়ির টানে। তুঁতে রং মাখানো অপরিশোধিত সুচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে উলকি এঁকে দিচ্ছে যাযাবরী উলকিওয়ালি (ভাগ্যিস তখন এইচ আই ভি জুজুর ভয় ছিল না)। রঙের সঙ্গে ফুটে উঠছে বিন্দু বিন্দু রক্ত। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও পরম পরিতৃপ্তির ছাপ দেহাতি বহুরির মুখে। মরদের নাম লেখাচ্ছেন যে। দিনেকালে উলকির সঙ্গে সঙ্গে কানঝোলা মাকড়ি আর মোটা খাড়ুর দেহাতিনিরাও যে কোথায় হারিয়ে গেলেন এই ‘ট্যাটু’ শহরে কে জানে।
চারটে খেলনা। স্টলে নয়, ঘুরে ঘুরে বিক্রি হত রথের মেলায়। মোটা বাঁশের লাঠির ডগায় ঝোলানো রং বেরঙের বেলুনের সঙ্গে পেপার পাল্পের মুখোশ, মুখোশের চরিত্র মূলত দুটি। ভল্লুক আর রাক্ষস। প্লাস্টিকের ব্যাটম্যান, মিকিমাউস আর ছোটা ভীম মুখোশের দাপটে এরাও বহুদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে শহর থেকে। এর পাশাপাশি বিক্রি হত কাঠির ডগায় ল্যাগবেগে হাত পা ছোঁড়া তালপাতার সেপাই, কাঠির ডগায় পাতলা দেশলাই কাঠের লিভারের চাপে লাফ দিয়ে ওঠা শোলার কাঠবেড়ালী আর সরু তারের স্টিক আঁকড়ে থাকা প্লাস্টিকের বাঁদর। তারটাকে উলটে ধরেই ফের সোজা করে দিলে থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে নেমে আসত নীচে। এরাও সবাই নিরুদ্দিষ্ট অনেকদিন। এদের মধ্যে তালপাতার সেপাই, বছর দুয়েক আগে বিক্রি করতে দেখেছিলাম একজনকে বইমেলার গেটে। দু’-চারটে কিনে নিয়ে উপহারও দিয়েছিলাম পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনের ভাইপো ভাইঝি নাতিপুতিকে। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাওয়া, বার্বি আর কমপিউটার গেমস প্রজন্ম সব। হাত পেতে নিল বটে তবে তেমন একটা উত্সাহ দেখাল বলে মনে হল না।
আজ যেখানে মৌলালি যুবকেন্দ্র, ঠিক সেখানটায় তখন বড় একফালি ফাঁকা জমি। ইলেকট্রিক নাগরদোলার জন্ম হয়নি তখনও। ওই ফাঁকা জমিটায় বসত কাঠের নাগরদোলা। মজবুত কাঠের চারটে ঘেরাটোপ। একেকটায় চারজন করে বসতে পারে দু’জন শা-জোয়ান চালকের হ্যাঁচকা হাতের টানে ওপর থেকে নীচ ঘুরে যেত বনবন করে। কিন্তু পাঁচতলা বাড়ি সমান উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলার বিদ্যুত্গতিতে নীচে নেমে আসার সময় সেই পেট খামচে ধরা আতঙ্ক আর অসম্ভব গা গোলানো ভাবটা ছিল না একদম। তার বদলে হালকা শিরশিরে মজাদার একটা অনুভূতি। হাতে কাঠি আইসক্রিম বা পাঁপড়ভাজা… অলৌকিক একটা ছেলেবেলা। সেটা যারা কাঠের নাগরদোলা না চড়েছেন তাঁদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
মেরি-গো-রাউন্ড। নাগরদোলার পাশাপাশি তত্কালীন মেলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ। মাথার ওপর গোল ছাতার মতো রঙিন চাঁদোয়া। নাগরদোলার মতো এটিও কাঠের তৈরি এবং সম্পূর্ণভাবে হস্তচালিত। বাহন হিসেবে রডে আটকানো কেশর ফোলানো কাঠের ঘোড়া এবং হাতি। একদম খুদেদের জন্য কাঠের বাক্স। হুবহু নাগরদোলার মতোই। তবে চাহিদার তুঙ্গে সবসময় হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা বাঘ। কয়েকপাক ঘুরে এসে থামলেই নতুন সওয়ারিদের মধ্যে রেষারেষি বেধে যেত বাঘের পিঠে কে সওয়ার হবে এই নিয়ে। তবে চালকদের মধ্যস্থতায় অধিকাংশ সময় মোটামুটি একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানই হত বলা চলে।
এই মেরি-গো রাউন্ডেরই আর একটা ক্ষুদ্র সংস্করণও আসত মেলায়। তলায় চাকা লাগানো মোটা লোহার পাইপের ওপর আঁটা গোল একটা লোহার রিং। রিঙের গায়ে ফিট করা চারটে ছোট ছোট চেয়ার। সবে মুখে বোল ফুটেছে অথবা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে এরকম খুদেদের জন্য। বেশি লোকজনের প্রয়োজন নেই। একজন চালকের হাতের টানেই ঘুরত রিংটা এবং বড় মেরি গো রাউন্ডের চেয়ে অনেক আস্তে। চড়বার দক্ষিণাও তুলনামূলকভাবে কম। ঘোরানোর সময় কট কট শব্দ হত একটা। তলায় চাকা লাগানো থাকায় ঠেলে নিয়ে যাওয়া যেত এদিক ওদিক। বিকেলের দিকে পাড়াগুলোতেও আসত মাঝে মাঝে। চোখে পড়া মাত্র বাপ-মায়ের ওপর বায়নায় হামলে পড়ত কচিকাঁচার দল। পরবর্তীতে গ্রামের মেলাগুলোয় কাঠের নাগরদোলা আর মেরি-গো-রাউন্ডের দেখা মাঝেমধ্যে মিললেও এই মোবাইল মিনিয়েচার মেরি-গো-রাউন্ড চোখে পড়েনি একটিবারের জন্যও। আপনাদের মধ্যে কারও পড়েছে কি? পড়ে থাকলে জানাবেন।
মৌলালি থেকে হাতের বাঁদিকে ঘুরেই রাস্তার দু’পাশে আর অধুনা বিলুপ্ত বুলেভার্ডের নীচে সার সার সস্তা ফার্নিচারের দোকান। সেগুন, বার্মা টিক বা মেহগনির বদলে কমদামি কাঁঠাল, পেয়ারা বা কেরোসিন কাঠের আলমারি, খাট, চেয়ার ড্রেসিং টেবিল, ঠাকুরের আসন… পুরনো সেই রথের মেলায় সেসময় নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মেলা থেকে কেনা সস্তা কাঠের আলমারি বা ড্রেসিং টেবিল হাতে টানা রিকশায় চাপিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন সদ্যবিবাহিত নিম্নবিত্ত দম্পতি— এ অতি পরিচিত দৃশ্য পঞ্চাশ-ষাট দশকের কলকাতায়। আসবাবপত্রের চত্বরটা টপকেই শুরু হয়ে যেত কাঠ, বেত আর লোহার জিনিসপত্রের বিশাল বাজার। হাঁড়ি, কড়াই, ছুরি, কাঁচি, দা, কোদাল, বেলচা, বেতের ধামা-কুলো-ঝুড়ি, কাঠের বারকোশ এমনকী লাঙলের ফাল, কী না পাওয়া যেত এখানে। সেসময় কারা এসব কিনত সেটা আজও এক অপরিসীম রহস্য আমার কাছে। মোটামুটি সত্তর দশকের প্রথমভাগ থেকেই গড়ে ওঠা ফ্লাইওভার, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং একই সঙ্গে ফুটপাত সংকোচন— এই ত্রিফলা আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমগত ছোট হয়ে যেতে থাকে বিশাল এই মেলার পরিসর। নব্বইয়ের গোড়াতেই সংকুচিত হতে হতে এসে ঠেকে যায় মৌলালির মোড়ে মাত্র মিটার ত্রিশেক জায়গায়। পরবর্তীতে প্রায় উঠে যেতে যেতে কোনওমতে টিকে গিয়ে স্থানান্তরিত হয় অদূরে রামলীলা পার্কে। মেলার পরিসর ছোট হয়ে গেলেও সময়টা একই আছে। প্রতিবছর রথের দিন শুরু হয়ে চলে টানা একমাস। তবে অতীতের সেই বৈচিত্র্য আর জৌলুস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি কোনওদিনই। নিজের ক্ষুদ্র সংস্করণকে রামলীলা ময়দানে বাঁচিয়ে রেখে বরাবরের মতো এ শহরকে আলবিদা জানিয়েছে কলকাতার সবচেয়ে বড় মেলা। শেয়ালদা রথের মেলা।
১৪. কলকাতার বিচিত্র পেশা
…কিছুই যায় না ফেলা
বেলা একটা, বাইপাস লাগোয়া কলোনি বাজারের একপাশে বাবলুর ‘ব্রয়লার চিকেন শপ,’ দোকানের বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো স্লেটে চক দিয়ে লেখা— ‘গোটা— ৯০’, ‘কাটা— ১৬০’, বড় লোহার খাঁচায় গোটা চারেক মুরগি। পাশে একটা কালো রঙের ড্রাম। জবাই হওয়া মুরগিদের ধড়ফড় করতে থাকা শেষ দু’-এক মিনিটের ঠিকানা। আজ এবেলার মতো বিক্রি বাট্টা শেষ। ছুরি চাকু ধুয়ে খাঁচার ওপর রাখা কাঠের ক্যাশবাক্সটা খুলে হিসেব মেলাচ্ছিল বাবলু। এমন সময় সাইকেলের ‘ক্রিং ক্রিং’। ঘণ্টার শব্দে চোখ তুলে তাকাল। দোকানের সামনে সাইকেল বসা মন্টু। এক পা প্যাডেলে, এক পা মাটিতে। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারের দু’দিকে আংটা দিয়ে ঝোলানো নীল রঙের দুটো প্লাস্টিকের ড্রাম, “কীরে? এত দেরি করলি?” ঈষৎ বিরক্তিমাখা গলায় প্রশ্ন করলো বাবলু। “আর বোলো না, মণ্ডলদার দোকানে অ্যায়সান দেরি করিয়ে দিল…” বলতে বলতে সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে নেমে এল মন্টু। “আজ কতটা হল?” “কত আর হবে? ওই দশ বারো কেজি মতো… বিক্রিবাট্টার যা অবস্থা।” নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল বাবলু “কই দেখি,” বলে বাবলুর পাশ কাটিয়ে গিয়ে কালো ড্রামটার সামনে ঝুঁকে পড়ল মন্টু। ড্রামের একপাশে ডাঁই করে রাখা মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক। মন্টুর হাতে একটা বড় পলিপ্যাক। দ্রুতহাতে সমস্ত বর্জ্যটুকু পুরে ফেলল পলিপ্যাকটায়। পাশে রাখা ঝোলানো ওজনযন্ত্রটায় ঝুলিয়ে ওজন করে হাঁক ছাড়ল— “এগারো কেজি আটশো, বাবলুদা।” বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে এসে পলিপ্যাকটা উপুড় করে দিল সাইকেলের ড্রামের মধ্যে। তারপর সাইকেলে বসে ফের হাঁক পড়ল—“আজ আসি বাবলুদা। সোমবার সব হিসেব-কিতেব কিলিয়ার (ক্লিয়ার) করে দেব।” “কাল একদম দেরি করবি না। তা হলে কিন্তু…।” বাবলুর কথায় হাসল মন্টু। “অ্যাকদম চিন্তা কোরো না। কাল ফাস (ফার্স্ট) তোমার একেনে, তারপর অন্য কথা…।” প্যাডেলে পায়ের চাপ। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল মন্টু।
প্রিয় পাঠককুল, এতক্ষণ ধরে উপরোক্ত বর্ণনাটি পড়ে কিঞ্চিৎ ধন্ধে পড়ে গেছেন আশা করি। মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর কাটা ছেঁড়া পালক দিয়ে মন্টু করবেটা কী? কৌতূহল নিরসনের জন্য জানাই, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’ এই লাইনটা বোধ হয় মুরগির ক্ষেত্রেও সত্যি। মাংস ছাড়াও গিলে, মেটে, কলিজা, মাথা, গলা, ছাঁট সবকিছুই বিক্রি হয়ে যায় খাদ্য হিসেবে। এরপরেও যা পড়ে থাকে, সেই বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক, আমাদের চোখে যা বর্জ্য এবং পরিত্যাজ্য— সেটাই অন্য কারও উদরপূর্তির উপকরণ। সায়েন্স সিটির উলটোদিকে বাইপাসের ধারে যে বাস রাস্তাটা বানতলা, ধামাখালি, ঘটকপুকুর হয়ে সোজা সুন্দরবনের দরজা সন্দেশখালি অবধি চলে গেছে— সেই রাস্তাটা ধরে মাইল পাঁচেক এগোলেই একধারে বিদ্যাধরী নদী, অন্যপাশে অজ পাড়াগাঁ। সারি সারি মাছের ভেড়ি। ভেড়িভরতি মাছ। রাক্ষুসে মাগুর (জায়ান্ট আফ্রিকান ক্যাটফিশ), নাইলোটিকা (ত্যালাপিয়ার জাতভাই), পাকু (আমাজন নদীর হিংস্র পিরানহার নিরীহ জ্ঞাতি)… আরও হরেকরকম প্রজাতি। প্রায় সবই হাইব্রিড। মন্টুরা সব এই ভেড়ি অঞ্চলের মানুষ। সেই কাকভোরে, সূর্যের আলো ঠিকঠাক ফোটার আগেই সাইকেলের পিছনে ড্রাম ঝুলিয়ে এরা বেরিয়ে পড়বে বাড়ি থেকে। চলে আসবে আমাদের এই শহরে। দোকান দোকান ঘুরে সংগ্রহ করবে মুরগির বর্জ্য। চাহিদা আর জোগান অনুযায়ী দাম কিলোপ্রতি পনেরো থেকে কুড়ি টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দোকানদারের সঙ্গে হপ্তা অথবা মাসকাবারি চুক্তি। সওদাপাতি সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। গ্রামে অপেক্ষারত ক্রেতার দল, ভেড়ির মালিকের লোকজন। মাল নামার সঙ্গে সঙ্গে খড়-কুচোনো মেশিনে পালক কুচিয়ে পুরীষমাখানো মণ্ড তৈরি করে ফেলে দেওয়া হবে জলে। মুহূর্তে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে ভেড়ির জল জুড়ে। ড্রামকে ড্রাম বর্জ্য নিমেষে চলে যাবে মাছের পেটে। আর মন্টুরা? ভারী ভারী ড্রাম সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে মাইল মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার হাড়ভাঙা ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যাবে ঘরে। তারপর কোনওমতে নাকেমুখে কিছু গুঁজে গড়িয়ে পড়া বিছানায়। কাল ভোরে উঠে আবার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শহরে পৌঁছতে হবে যে।
শিশুখামার
রাস্তাঘাটে আসতে যেতে আপনাদেরও অনেকের হয়তো মাঝেমধ্যে চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। এক মহিলা। পরনে ছেঁড়াফাটা মলিন শাড়ি। পাশে নোংরা চাদরের ওপর শোয়ানো একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা। অঘোর ঘুমে অচৈতন্য। মুখের সামনে কাত হয়ে থাকা আধখালি জলমেশানো দুধের বোতল। অফিসপাড়া। ব্যস্ত পাড়া। ব্যস্ত জনপদ। ভিড়ভাড়াক্কার মধ্যে দিয়ে জলদি পা চালানো পথচারীদের অনেকেরই নজর চলে যাচ্ছে সেদিকে। একটাকা, দু’টাকা, পাঁচটাকার কয়েন ছুড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। পরক্ষণেই আরও দ্রুত পা চালাচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখতে পেতেন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে ওই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ঠায় একইভাবে বসে আছে মহিলা। বাচ্চাটা তখনও ঘুমিয়ে কাদা। সকালের মতোই থেকে থেকেই টুপটাপ পয়সা পড়ছে চাদরের ওপর। একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা, নড়াচাড়া নেই, দুষ্টুমি নেই, কান্নাকাটি নেই, সকাল থেকে সন্ধে অবধি একটানা ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক হলেও সকাল বিকেল অফিস-বাড়ি-অফিস ব্যস্ত পথচারীদের খটকা লাগছে না প্রায় কারোরই। এই প্রতিবেদকের কিন্তু লেগেছিল। নানা কাজের চাপে খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি সেভাবে। সুযোগটা এসে গেল হঠাৎই একদিন। সেটা নব্বই সালের গোড়ার কথা। একটা নামী সমীক্ষা সংস্থার সোশ্যাল রিসার্চ ডিভিশনে চাকরি করি তখন। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের দীর্ঘমেয়াদি বরাত পায় আমাদের সংস্থাটি। বিষয়— ‘চাইল্ড ট্র্যাফিকিং, অ্যাট্রোসিটি অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেশন।’ দেশের পূর্বাঞ্চলে সমীক্ষার ভার পড়েছিল আমার হাতে। কাজটা হাতে নিয়ে প্রথমেই সমীক্ষা চালাই উপরোক্ত বিষয়টির ওপর। দিনের পর দিন শহরের অলি গলি ঢুঁড়ে ফেলে যে তথ্য (নাকি দৃশ্য?) সামনে উঠে এসেছিল সেটা এককথায় চমকপ্রদ। ওই ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটা আসলে একটা ব্যাবসা। আসলে বাচ্চাটা ঘুমোয় না। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু কীভাবে? প্রশ্নের উত্তরটা পেতে জনাদশেক এরকম ভিখিরিকে খুঁজে বের করেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করে যা উঠে এসেছিল তা এককথায় হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। মোটামুটি দুরকম পদ্ধতিতে এই ব্যাবসাটা চলে। এক— ফুটপাতের ধারে ঘুমন্ত শিশুটিকে শুইয়ে রেখে ভিক্ষে চাওয়া। দুই— ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করা। ব্যাবসাটার নির্দিষ্ট কয়েকটা নিয়মকানুন আছে। কোনও ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাকে কখনওই কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নেবে না এরা যাতে পল্লীবাসীর মনে কৌতূহলের উদ্রেক হয় বা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সামনে পড়তে হতে পারে। সবচেয়ে পছন্দের এলাকা ব্যস্ত অফিসপাড়া এবং বড় বড় ধর্মস্থান যেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়। যেখানে বিশেষ প্রয়োজন অথবা উদ্দেশ্যে সদাব্যস্ত মানুষজনের মধ্যে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা বা এ নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এবং সুযোগ কোনওটাই নেই। অতঃপর ওই ভিক্ষুকদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিয়েছিলাম বিশেষভাবে আমার মূল-উত্তরদাতা অর্থাৎ ‘কী ইনফরম্যান্ট’ হিসেবে। ইয়া তালড্যাঙা চেহারার লোকটা। প্রৌঢ়, একগাল দাড়ি। আদুল গা, সবসময় নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া হেঁটো লুঙ্গি, কাঁধে নেতিয়ে পড়ে থাকা একটা বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। মুখে সর্বদা লেগে থাকা একটা মেকি করুণ হাসি, হঠাৎই এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও ভ্রাম্যমাণ পথচারীর। গলায় কাতর আবেদন— “বাচ্চাটা তিনদিন খায়নি গো বাবু…।” হতচকিত পথচারী। কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিতও। কোনওমতে মানিব্যাগ খুলে তাড়াতাড়ি যা পারে দিয়ে পা বাড়াত গন্তব্যস্থলের দিকে। সপ্তাহের বাকি ছ’দিন এই একই কায়দায় ভিক্ষে করলেও ফির জুম্মাবারে (শুক্রবার) দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও সংখ্যালঘু এলাকার মসজিদের সামনে। জুম্মাবার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। দুপুরের নামাজ সেরে বেরোনো পুণ্যার্থীরা উদার হস্তে দান করেন ওই দিনটায়। মসজিদের একপাশে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো ভিক্ষুকদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ত লোকটা। রোজগারপাতি সবচেয়ে বেশি হত ওই জুম্মাবারেই। প্রায় টানা হপ্তা তিনেক অনুসরণ করে ধরতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা। অতঃপর এক শুক্রবার লোকটার পিছু নিয়ে চড়ে বসেছিলাম সাউথ লাইনের ট্রেনে। বিনা টিকিটের যাত্রী হয়ে। কারণ লোকটা কোথায় যাবে জানা ছিল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে একটা প্রায় নির্জন ছোট স্টেশন। সেখানে নেমে পড়ল লোকটা। পিছু পিছু এই অধম প্রতিবেদক। ট্রেন থেকে নামা সামান্য দু’-চারজন যাত্রী প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বিলকুল শুনশান এলাকা। প্ল্যাটফর্মের একধারে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল লোকটা। তারপর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল ধীরে ধীরে। “মকবুল.. ও মকবুল… এবার ওঠ।” আস্তে আস্তে চোখজোড়া খুলল। মিনিট দুয়েক বাদে ঘোরলাগা চোখে উঠে বসল বাচ্চাটা। কাঁধের ঝোলা থেকে দুটো বিস্কুট বের করে বাচ্চাটাকে খেতে দিল লোকটা। আর একমুহূর্তও দেরি না করে ঝটিতি গিয়ে বসে পড়েছিলাম বেঞ্চিতে বুড়োর পাশে। হাতে একটা একশো টাকার নোট (তখনকার বাজারে অনেক টাকা) গুঁজে দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম রহস্যটা। যা জেনেছিলাম সেটা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন কেন একটু আগে ‘হাড় হিম করে দেওয়া’ উপমাটা ব্যবহার করেছিলাম। বাচ্চাটা আসলে বুড়োর নিজের নয়। ভাড়া করা। এই দখিন লাইনের অগুনতি অজ পাড়াগাঁয়ে এরকম অজস্র হাড়হাভাতে, বেমতলব গরিবগুরবো পরিবার মুখিয়ে রয়েছে তাদের ঘরের বাচ্চাকে ভাড়া খাটানোর জন্য। কারণ একটাই—অপরিসীম দারিদ্র্য। নিজেরা বেশিরভাগই নিজে কাজটা করতে পারে না ঘুম পাড়ানোর কায়দাটা না জানার জন্য। সীমিত সংখ্যক মানুষেরই আয়ত্তে রয়েছে বিদ্যেটা। এই প্রৌঢ় তাদের মধ্যে একজন। ওর বয়ান অনুযায়ী নিশাদলের গাঁট (একধরনের বিষাক্ত মাদক গাছের শিকড়), আফিম, কামপোজ-হিপটোজেন-প্রক্সিভন-ম্যানডেক্সের মতো ঘুমপাড়ানি ওষুধ পরিমাণমতো মিশিয়ে তৈরি করা হয় মিশ্রণটা। জানতে হয় দুধের সঙ্গে কতটা পরিমাণে মিশিয়ে খাওয়ালে কতক্ষণ ঘুমোবে বাচ্চাটা আর কতক্ষণ বাদেই বা সে ঘুম ভাঙবে। পরিমাণে একচুল এদিক ওদিক, সামান্যতম অসতর্কতা, ঘুম পরিণত হবে কালঘুমে। এলাকার অনেক কোয়াক ডাক্তারও অনেক সময় সাহায্য করে থাকেন মিশ্রণটা বানাতে। বুড়োর মতে এক থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি কোনও বাচ্চাকে খাটানো যায় এই লাইনে। মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি কাম্য। এক থেকে দেড় বছর বয়েসি বাচ্চার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ভাড়ার টাকার পরিমাণও। কারণ বয়স যত কম হবে ততই দয়ামায়ার উদ্রেক হবে মানুষের মনে। তবে একটানা এ ব্যাবসায় কখনওই খাটানো যায় না একটি শিশুকে। মোটামুটি ছ’মাস অন্তর অন্তত এক মাসের টানা বিশ্রাম প্রয়োজন অতি অবশ্যই। কিন্তু প্রৌঢ়র কথাতে তা আর হয় কই। ভয়ংকর গরিব সব পরিবার। চাহিদার তুলনায় বাচ্চার জোগান অনেক বেশি। অনেকটা সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের ভাষায়— “এ মহাভারত দাদা, এ মহাভারত/ মাছের মতোই আছে শিশুর আড়ৎ/ জ্বালানির মতো আছে শিশুর জোগান/ মহাভারতের কথা অমৃত সমান…।” সেই জোগানে একবার ছেদ পড়ে গেলেই অন্যের বাচ্চা এসে দখল নিয়ে নেবে জায়গাটার। এর মানে বহুদিন রোজগার থেকে বঞ্চিত থাকা। এদিকে পেটের মধ্যে দাউ দাউ খিদের আগুন। ফলে চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়েও দরিদ্র অভিভাবকেরা তাদের শিশুটিকে ঘুমের হাটে ভাড়া খাটিয়ে যান। টানা বছরের পর বছর। কত টাকায় বাচ্চা ভাড়া পাওয়া যায়? ভাড়া চুকিয়ে কতটা লাভ থাকে হাতে? এর জন্য কাউকে পয়সা খাওয়াতে হয় কি? যারা ভাড়া দেন সেইসব পরিবারগুলোর কারও সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে কি? প্রশ্ন করামাত্র শক্ত হয়ে গেছিল বুড়ো। “সেসব অনেক গভীর বেত্তান্ত বাবু… খামোখা শুধোয়ে বেপদ বাড়াবেন না। চল চল মকবুল। ইদিকে অনেকটা পথ যেতি হবে…।” বলতে বলতেই তাড়া লাগিয়েছিল বাচ্চাটাকে। পরমুহূর্তেই বাচ্চাটার হাত ধরে হেঁটে চলে গিয়েছিল হন হন করে। একবারও পিছনে না তাকিয়ে। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে। হঠাৎই ঘোর কেটে খেয়াল পড়েছিল আসার সময় টিকিট কাটা হয়নি। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটা লাগিয়েছিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। এবার ফেরার পালা।
মাঝখানে এই আমরা আছি…
ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে যেতে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের একটু আগে হাতের বাঁপাশে জটাধারী পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পের ঠিক গা ঘেঁষে সোনাগাছি লেন ধরে দু’-চার পা এগোলে ডানদিকে নীলমণি মিত্র স্ট্রিট। রাস্তার দু’ধারে গিজগিজ করছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী মেয়েরা। গলিতে ঢোকামাত্র কাস্টমারকে ঘিরে ধরবে একদল লোক। প্রায় সবার পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, ফতুয়া আর লুঙ্গি। অনেকটা ইউনিফর্মের মতো। ছিনে জোঁকের মতো পিছনে লেগে যাবে লোকগুলো, ক্রমাগত ফিসফিস করে যাবে কানের কাছে— “আইয়ে সাহাব, মেরা সাথ আইয়ে… অ্যায়সি চোখি চিজ (দুর্দান্ত জিনিস) দিখাউঙ্গা কি দিল খুশ হো যায়গি… একদম ফিল্ম হিরোইন কি তরহা…।” এই ঘ্যান ঘ্যান চলতেই থাকবে যতক্ষণ না কাস্টমার অতিষ্ঠ হয়ে ওদের মধ্যে কারও একজনের সঙ্গে আশপাশের কোনও একটা বাড়িতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়। আসলে ওই লোকগুলো দালাল। সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের মোটামুটিভাবে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত বাজারদর, সৌন্দর্য, ব্যবহার/ ছলাকলা এবং দৈহিক গঠনের ওপর নির্ভর করেই এই ক্যাটাগরির ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করা হয়। সোনাগাছিতে, বিশেষ করে অবিনাশ কবিরাজ রো, নীলমণি মিত্র স্ট্রিট, ডালপট্টি, সোনাগাছি লেনে এরকম বেশ কিছু ‘এ’ ক্যাটাগরি বাড়ি রয়েছে। যেরকম ‘ড্রিম কুইন’, ‘নাইট লাভার্স’, ‘নন্দরানির ফ্ল্যাট’, ‘নীলকমল’, ‘শ্রীকমল’ ইত্যাদি। এলাকায় অনেকদিনের যাতায়াত বা বহু পুরনো খদ্দের না হলে দালালদের সাহায্য ছাড়া ওইসব বাড়িগুলোয় ঢোকা প্রায় অসম্ভব। ওরা কখনওই কাস্টমারের থেকে একটি পয়সাও চাইবে না। যে মেয়েটির ঘরে কাস্টমার ঢুকবে তার কাছ থেকে কুড়ি বা পঁচিশ পার্সেন্ট হারে কমিশন নিয়ে নেবে। ২০০৬-২০০৭, সোনাগাছিতে নিজস্ব এবং স্বশাসিত একটি সংস্থায় পাচার বিরোধী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় ওই এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করার সুবাদে দালালদের (স্থানীয় ভাষায় দাল্লা/ ভারুয়া) অনেকের সঙ্গেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই জানতে পেরেছিলাম এদের কারও রোজগার দিনে সাড়ে সাতশো থেকে হাজার টাকার নীচে কখনওই নয়। ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন থাকলে কখনও কখনও অঙ্কটা পাঁচ হাজারেও গিয়ে দাঁড়ায়। যা অনেক হাই প্রোফাইল কোম্পানি এক্সিকিউটিভকেও রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। এই দালালদের অধিকাংশই আদতে উত্তরপ্রদেশের মানুষ। এর পিছনেও একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা শহরের নিষিদ্ধ পল্লীগুলোয় নব্য বাঙালি বাবুরা ছিলেন যৌনকর্মীদের মুখ্য পৃষ্ঠপোষক। শুধু লাম্পট্যই নয় তাদের রক্ষিতাদের নৃত্যগীত সহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলায় পারদর্শিনী করে তোলাটাও ছিল বাবুদের বিনোদনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই সময় সোনাগাছি নয়, পার্শ্ববর্তী রামবাগান এলাকাই ছিল শহরের সেরা যৌনপল্লি। উনিশ শতকের শেষে থেকে ধীরে ধীরে বাবু সভ্যতার পতন এবং মারোয়ারি শ্রেষ্ঠীদের উত্থানের হাত ধরে রামবাগান দ্রুত তার কৌলীন্য হারাতে থাকে আর একই সঙ্গে সোনাগাছিতে উত্তরপ্রদেশ মূলত আগ্রা থেকে একশ্রেণির যৌনকর্মীর আগমন ঘটে। এলাকায় এরা ‘আগ্রাওয়ালী’ বা ‘বেরিয়া’ নামে পরিচিত। এদের প্রায় সকলেই অসামান্য রূপসী এবং দেহসৌন্দর্যের অধিকারী। বর্তমানে সোনাগাছিতে এরাই সবচেয়ে ‘হাই প্রোফাইল’ যৌনকর্মী। এলাকার প্রায় সবক’টা ‘এ-ক্যাটাগরি’ বাড়ির সিংহভাগই এদের দখলে। এদের হাত ধরেই এই উত্তরপ্রদেশীয় দালালদের কলকাতা তথা সোনাগাছিতে পা রাখা। এলাকার অর্থনীতির একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রক এই উত্তরপ্রদেশীয় যৌনকর্মী এবং দালালেরা। এ ছাড়াও আরেকটি শ্রেণির উপস্থিতি সোনাগাছিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুপুরবেলা কখনও যদি ওই চত্বরে ঢুকে পড়েন নাকে ঝাপটা মারবেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসা মনকাড়া রান্নার গন্ধ। ঘরের পাশে, বারান্দার ধারে প্লাইউডের পার্টিশন ঘেরা একফালি জায়গায় রান্না চড়িয়েছেন একদল মানুষ। এদের সকলেরই আদি নিবাস ওড়িশা অথবা পূর্ব মেদিনীপুর। চাকর না বলে এককথায় এদের সোনাগাছি ‘অল পারপাস জব পারসোনেল’ বলা যেতে পারে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে জল তোলা, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়পোঁছ মায় খদ্দেরদের মদ-চাট-কোল্ড ড্রিংকস এনে দেওয়া, সমস্ত কাজ এরা সামলান অত্যন্ত দক্ষ হাতে। ফলে নিষিদ্ধ পল্লির মালকিন বা বাড়িওয়ালিদের এদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় অনেকটাই। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাড়িওয়ালিরা মাসিক একটা নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে এই চাকরদের হাতে ব্যাবসার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন।
সোনাগাছির বাইরে আরও এক জায়গায় এই দালালদের অস্তিত্ব ছিল। আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও যাদের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, সদর স্ট্রিট, বেড ফোর্ড লেন, মার্কুইস স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলে যাতায়াত ছিল, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সন্ধের দিকে ওইসব এলাকা ধরে হেঁটে গেলে কানের কাছে ফিসফিস ডাক— “চলিয়ে স্যর… কলেজ গার্ল স্যার…।” পাশাপাশি হেঁটে চলা একটা লোক। গলায় ক্রমাগত কাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলা নাছোড় আহ্বান। আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজি হলেই কাস্টমারকে সঙ্গে নিয়ে সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ কোনও একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে লোকটা। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে “খোঃ” (খোল?) জাতীয় হাঁক পাড়বে একটা। ভেতর থেকে খুলে যাবে দরজাটা। একতলায় অথবা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই একটা ড্রইং রুম মতো। সোফায় সার দিয়ে বসা মেয়েরা। কাস্টমারের অপেক্ষায়। কাউকে পছন্দ হলে সঙ্গে নিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া দুপাশের খোপ খোপ ঘরে। এক্ষেত্রেও ধান্দার নিয়মটা হুবহু সোনাগাছির মতোই, কাস্টমারের থেকে টাকা চাওয়ার প্রশ্নই নেই। মেয়েটিকে কাস্টমারের দেয় অর্থের থেকে পার্সেন্টেজ নিয়ে নেবে দালাল। তফাত শুধু একটাই সোনাগাছির দালালরা প্রায় সকলেই হিন্দু আর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অঞ্চলের দালালরা একশো শতাংশ বিহারি মুসলমান। কোনও অজ্ঞাত কারণে নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে ওইসব অঞ্চলের ‘খালি কুঠি’গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে ওই চত্বরে আর একটিও এ ধরনের বাড়ি টিকে রয়েছে বলে এই অধম প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। ফলে একমাত্র সোনাগাছি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর অন্য কোনও নিষিদ্ধ পল্লিতে দালাল বা চাকরের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
কালো পলিপ্যাক রহস্য
এই অভিজ্ঞতাটিও হয়েছিল সোনাগাছিতেই। সেই সকাল থেকে নিয়ে রাত অবধি চানাচুর, ঝালমুড়ি, ঘুগনি, আলুর দম, আখের রস, ছোলাভাজা, বাদাম, চানামশলা, আলুকাবলি, শাড়ি, জামাকাপড়, বেডশিট… কত ধরনের ফেরিওয়ালা যে আসে সোনাগাছিতে তার ইয়ত্তা নেই। এরই মধ্যে একদিন, দুপুরবেলার দিকে চোখে পড়েছিল লোকটাকে। সাইকেলের সামনে পিছনে ঝোলানো স্টেইনলেস স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাটি, হাঁড়িকুড়ি, আরও একাধিক বাসনপত্র। হাতে একটা ডুগডুগি। থেকে থেকে সেটা বাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লোকটাকে দেখামাত্র বাড়িগুলোর দরজায় দাঁড়ানো মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। ফিরেও এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবার হাতে ঝোলানো একটা করে কালো পলিপ্যাক। দৌড়ে এসে ভিড় জমাল ফেরিওয়ালার সামনে। ধীরে সুস্থে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে এক এক করে প্রত্যেকের হাত থেকে পলিপ্যাকগুলো নিয়ে ভেতরে হাত চালিয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করল লোকটা। তারপর ওজন অনুসারে মেয়েদের হাতে তুলে দিতে লাগল থালা, বাটি, গ্লাস, অন্যান্য বাসনকোসন। ওজন নিয়ে একটু আধটু বিতর্ক যে হচ্ছিল না তা নয়। তবে সবটাই মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে। একটা পলিপ্যাকের সর্ব্বোচ্চ ওজন হয়েছিল সাড়ে সাতশো গ্রাম। বিনিময়ে সেই পলিপ্যাকের মালকিন পেয়েছিল ইয়া পেল্লায় সাইজের ছ’বাটির একটা টিফিন বক্স। কিন্তু পলিপ্যাকের মধ্যে আছেটা কী? তীব্র কৌতূহল জেগেছিল মনে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম— মাথার চুল। নকল চুল বা পরচুলা তৈরির কাজে লাগে। এক্সপোর্টও হয় নাকি অত্যন্ত চড়া দামে। তা বলে শুধু কালো পলিপ্যাকেই কেন? মেয়েদের প্রশ্ন করে যে উত্তরটা পেয়েছিলাম তা শুধু অভিনবই নয়, রীতিমতো চমকপ্রদ। কাটা চুল নাকি খোলা দেখাতে নেই। তাতে নাকি অমঙ্গল হয়। শোনার পর বিস্ময়ে ঝুলে যাওয়া চোয়াল বন্ধ হতে সময় লেগেছিল মিনিটখানেক।
ওজন জাদু
সামনে দাঁড়ানো নধর একটা খাসি। খাসিটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন বাহাল ভাই। একদৃষ্টে জরিপ করছেন খাসিটাকে। মিনিটখানেক বাদে নজর আন্দাজি সেরে নিয়ে খাসিটার বুকের মাঝখানে হাত ঢুকিয়ে সামনের পা দুটো জমি থেকে ইঞ্চিছয়েক ওপরে তুলে ফের নামিয়ে দিলেন মাটিতে। ঘুরে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন— “লগবগ (মোটামুটি) বাইশ কিলো গোস্ত হোগা, হাড্ডি চামড়া ছোড়কে।” পিছনে দাঁড়ানো দু’জন। খাসির ক্রেতা। “শুক্রিয়া বাহালভাই,” বলে ঘাড় নাড়ল আশ্বস্তভাবে।
প্রিয় পাঠককুল, আসুন এবার বাহালভাইয়ের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। সত্তরের দশকের একদম গোড়ার দিকে লখনউ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মানুষটি। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর উলটোদিকে বেঙ্গল মিট শপ নামে ছোট একটা খাসির মাংসের দোকান দিয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যাবসা। সেই ছোট মাংসের দোকান থেকে ব্যাবসা বাড়তে বাড়তে পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর গায়ে বিখ্যাত মোগলাই খানার ঠিকানা জিশান হোটেলের মালিক আজ বাহালভাই। তবে মানুষটার এই প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এতখানি ওপরে উঠে আসার গল্প শোনাবার জন্য এ লেখা লিখতে বসিনি আমি। এ সবের বাইরেও এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে বাহালভাইয়ের। যাকে প্রায় অলৌকিকত্বের পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। যে-কোনও খাসির সামনের পা জোড়া মাটি থেকে সামান্য ওপরে তুলে প্রাণীটির নিট মাংসের ওজন প্রায় নিরানব্বই ভাগ সঠিক বলে দিতে পারেন বাহালভাই। যার বর্ণনা একটু আগে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে ওজন করলে মেরেকেটে বড়জোর পাঁচশো গ্রাম থেকে এককেজি এদিক ওদিক হবে। তার বাইরে কিছুতেই নয়। ওয়াটগঞ্জ, রাজাবাজারে খাসির হাটগুলোয় বাহালভাইয়ের মতো মানুষদের ওস্তাদ বা খলিফা নামে ডাকা হয়। সারা শহরে এ রকম খলিফা নাকি মাত্র পাঁচ-ছ’জন রয়েছেন। ফলে খাসির হাটে এই ওস্তাদ বা খলিফাদের চাহিদা প্রচণ্ড। বড় বড় ক্রেতা মহাজনরা চোখ বুজে নির্ভর করেন এদের ওপর। আর এই ভরসার কারণটা সহজেই অনুমেয়। একটা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এই কাজটা করে থাকেন খলিফারা। সেটা হল খাসিপিছু পাঁচশো থেকে এককেজি মাংসের দাম।
বাহালভাই। বৃষস্কন্ধ। ছ’ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা। পালিশ করা হাতির দাঁতের মতো গায়ের রং। চোখের কোণে সুর্মা। অ্যাপোলোর মতো সুদর্শন। ঠোঁটের কোণে চাপা, ভারী মিঠে একটা হাসি সবসময়। ইদানীং ধর্মে কর্মে মন দেওয়ায় মাথায় ফেজ টুপি আর একগাল শ্বেতশুভ্র দাড়ি। শুনেছি ব্যাবসার ব্যস্ততার কারণে আজকাল আর খলিফার কাজটা সেভাবে করতে পারেন না। তবে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কোনও অনুষ্ঠানে জোরাজুরির ফলে এখনও দৌড়োতে হয় মাঝেমধ্যে। কারণ ওই অলৌকিক ওজন-জাদুটা যে আজও ভোলেননি বাহালভাই।
খ্যাপা খুঁজে ফেরে…
বউবাজার স্ট্রিট অধুনা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় বারবার চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। কয়েকজন মানুষ। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা, মলিন পোশাক-আশাক। হাতে ছোট ছোট ঝাঁটা। ঝাঁট দিচ্ছে রাস্তার ওপর সার সার সোনার দোকানগুলোর মেঝে আর সামনের ফুটপাতে। কাজটা করছে খুব ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। প্রতিটি ইঞ্চিতে জমে থাকা ধুলো ঝাড়ু দিয়ে এনে জড়ো করছে একজায়গায়। তারপর সাবধানে কাঁচিয়ে তুলে নিচ্ছে হাতল লাগানো একটা চ্যাটালো পাত্রে যাতে এককণাও মাটিতে না পড়ে থাকে। কাজটা শেষ করে পাত্রটা নর্দমার ধারে চাপাকলের সামনে নিয়ে গিয়ে সমস্ত ধুলোটুকু ঢেলে দিচ্ছে একটা ছাঁকনিতে। অল্প অল্প জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে চলেছে বার বার। আঙুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে সতর্ক চোখে খুঁজে চলেছে কিছু। খুঁজে পেলে দু’নখের ডগায় তুলে রেখে দিচ্ছে ছোট একটা কাপড়ের থলেতে। না পেলে ছাঁকনির ধুলোকাদা ঢেলে দিচ্ছে নর্দমায়।
প্রিয় পাঠক, যত সংক্ষেপে লাইনগুলো লিখলাম ব্যাপারটা আসলে কিন্তু মোটেই সেরকম নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় এই গোটা প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হতে। কিন্তু কী খুঁজছে লোকগুলো? পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই— সোনা। গয়না তৈরির সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সোনার কুচি, খালি চোখে যা দেখতে পাওয়া অসম্ভব, ছিটকে পড়ে মিশে যায় ধুলোয়। ধুলোকাদা ঘেঁটে সেই সোনাই খুঁজছে ওরা। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অণুকণার মতো সোনার কুচিও ধরা পড়ে যাবে ওদের মাইক্রোস্কোপিক চোখে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সোনার দোকানদার অথবা কারিগররা ওদের ‘ঝড়ুয়া’ নামে চেনে। ওরা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘সোনঝড়ুয়া’ নামে। সোনঝড়ুয়া গোষ্ঠী। এরা সবাই ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জীবিকার সন্ধানে এ শহরে চলে আসা হতদরিদ্র হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের একমাত্র জীবিকা এই ধুলোকাদা ঘেঁটে সোনা খুঁজে বের করা। অর্থের বিনিময়ে সোনার দোকান আর সামনের ফুটপাতের ইজারা নেয় এরা। বিশেষ করে লগনশা (বিয়ের মরশুম), ধনতেরাস, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ার মতো উৎসবের সময় সোনঝড়ুয়াদের ব্যস্ততা যায় বেড়ে। দোকানদাররাও মওকা বুঝে ইজারার টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেয় এইসময়টায়। ভাগ্য খুব ভালো থাকলে একজন সোনঝড়ুয়া ধুলোকাদা ঘেঁটে বছরে ভরিদুয়েকের মতো সোনা সংগ্রহ করতে পারে। যদিও সেটা কালেভদ্রে ঘটে। এদিকে সোনার মহাজনরা বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে এদের থেকে সোনা কেনে অর্থাৎ চিরাচরিত সেই ঠকে যাওয়ার গল্পটা কিন্তু থেকেই যায় এই হতভাগ্য, হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবনে। এদের বড় একটা অংশ হাওড়া লাইনে উত্তরপাড়া, বালি রেলস্টেশনের গায়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি বেঁধে সপরিবারে বাস করে। বিদ্যুত্হীন, জলহীন, অশিক্ষা আর দারিদ্রে ভরপুর পশুরও অধম জীবন। তবু কপালে থাপ্পড় মেরে মেনে নিতে হয়েছে সেটাকেই। কারণ কবিতার সেই খ্যাপার মতো পরশপাথর থুড়ি সোনা খুঁজে ফেরা ছাড়া আর কোনও জীবিকার সন্ধান যে জানা নেই মানুষগুলোর।
কালেকশন পার্টি
বড়বাজার এবং ডালহৌসি সংলগ্ন অফিসপাড়ায় দেখতে পাওয়া যাবে এঁদের। মূলত পুরনো ঘরানার মাড়োয়ারি ফার্ম ও গদিগুলোয় ঘোরাফেরা করেন এঁরা। বেশিরভাগই পুরনো কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু বনেদি পরিবারের সন্তান। বাপ পিতেমোরা বুলবুলির লড়াই, বাঈ নাচ, রেসের মাঠে মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েছেন এক সময়। এখন ভগ্নপ্রায় বিশাল বাড়ি, জরাজীর্ণ। গাদাগুচ্ছের শরিক। মামলা মোকদ্দমা, কোর্ট কাছারি। নামে তালপুকুর কিন্তু ঘটি ডোবে না। মোটামুটি সকাল দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ চানটান সেরে, রুটি-আলুকুমড়োর ঘ্যাঁটের ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে এঁরা বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। এঁদের সবারই বয়স মোটামুটি ষাট থেকে পঁচাত্তরের কোঠায়। পরনে ধবধবে কাচা এবং পাটভাঙা বাংলা শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ধুতি অথবা পাজামা। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস অথবা বাসে চেপে পৌঁছে যান গন্তব্যস্থলে। ঢুঁ মারা শুরু করেন গদিগুলোয়। কোন গদিতে কবে যাবেন ডেট বাঁধা আছে। বাঁধা আছে আলাদা গদিও। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে অনেকেরই দানধ্যানে বেশ মতিগতি আছে। এঁরাই এঁদের মূল টার্গেট গ্রুপ। টাকা চাওয়ার বাহানা হাজার রকম। মোটামুটি দশটা থেকে একটা অবধি গদি থেকে গদিতে ঘুরে ঘুরে টাকা সংগ্রহ করেন এঁরা। অতঃপর দ্বিপ্রাহরিক ফ্রি লাঞ্চ বড়বাজার অঞ্চলের কোনও মন্দির অথবা ধর্মস্থানে। এই অঞ্চলে বহু এরকম মন্দির রয়েছে যেখানে রোজই কোনও না কোনও ধর্মীয় সংস্থা বা ধনী গোষ্ঠীর তরফ থেকে ‘ভাণ্ডারা’-র (বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণ) আয়োজন করা হয়। কবে কোথায় কোন মন্দির বা ধর্মস্থানে ‘ভাণ্ডারা’ দেওয়া হবে এই কালেকশন পার্টিদের প্রত্যেকের সেটা নখদর্পণে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে নিয়ে ফের হানা দেওয়া শুরু হয় গদিতে গদিতে। চেয়েচিন্তে (ওদের নিজেদের ভাষায় কালেকশন) দিনের শেষে রোজগার হয় মন্দ না। মাসের শেষে উপার্জনকৃত অর্থের পরিমাণ পনেরো হাজার অবধি পৌঁছোয় অনেকের ক্ষেত্রে। রোজগারের অঙ্কটা নির্ভর করে বাকচাতুর্য অর্থাৎ গোদা বাংলায় দাতাকে পটিয়ে পাটিয়ে যতটা বেশি সম্ভব টাকা খিঁচে নেবার ওপর। এঁদেরই মধ্যে একজন, মিত্তিরদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আজ থেকে বছর বিশেক আগে। উত্তর কলকাতার এক পড়তি বনেদি বাড়ির সন্তান। বয়স সত্তরের কোঠায়। দুধে আলতা গায়ের রং। নীলচে চোখের মণি। দুধসাদা ব্যাকব্রাশ চুল। উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট। গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের মালা। পরনে পাটভাঙা কনুই অবধি গোটানো ফুল হাতা বাংলা শার্ট আর ধুতি। হাতের আঙুলে গোটা চারেক পাথর বসানো আংটি। শার্টের ঝুলপকেটে ছোট একটা নোটখাতা। কবে, কোথায়, কোন ডোনার পার্টির কাছে যেতে হবে তার খতিয়ান। সেই সময় কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলেন মিত্তিরদা। লোকমুখে শোনা দাতাদের কাছে মিত্তিরদার দাপট এতটাই ছিল যে কখনও চাহিদার তুলনায় অর্থের পরিমাণ কম হলে সেই দাতাকে অভিযোগ জানাতেন বেশ কড়া ভাষায়। সেই কড়া ভাষার একটি নমুনা এখানে তুলে দিচ্ছি। বয়ানটি মোটামুটি এইরকম— “তোমার বাপঠাকুরদারা অনেক ভাল যজমান ছিলেন। খোলা হাতে দক্ষিণা দিতেন। তোমরা আজকালকার ছেলেছোকরা, দানধ্যানের মর্মই বোঝো না।” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল যে মিত্তিরদার মতো কালেকশন পার্টিরা সংগ্রহকৃত অর্থকে ‘দক্ষিণা’ আর দাতাদের ‘যজমান’ নামে ডাকেন। ওদের মুখেই শোনা সারা কলকাতা শহরে এরকম সংগ্রাহক প্রায় শ’চারেক রয়েছেন। তবে এঁদের প্রায় সবারই অভিযোগ, পুরনো ঘরানার অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দানধ্যানে বেশ খোলা হাত ছিল কিন্তু তাদের লেখাপড়া জানা পরবর্তী প্রজন্ম এই দান খয়রাতির ব্যাপারটাকে আর মোটেই সেভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। প্রায় বিশ বছর আগে শোনা এসব কথা। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘কালেকশন পার্টি’-রা আজও এই শহরে টিকে আছেন কিনা জানা নেই।
তোমার শখ আমার বাঁচা
কখনও বিকেলের দিকে যদি কলকাতার কালীঘাট, টালিগঞ্জ, শ্যামবাজারের খালপাড়গুলোর দিকে যান, চোখে পড়লেও পড়তে পারে কিছু মানুষ, খালি গা, নিম্নাঙ্গে মালকোঁচা মারা লুঙ্গি, দু’হাতে খালের পাঁক তুলে বড় বড় মাটির চাড়িতে ভরছে। ব্যাপারটা কী? খাল সংস্কার হচ্ছে নাকি? এ ধরনের প্রশ্ন মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারার আগেই জানাই ব্যাপারটা আদৌ সেরকম নয়। ওই লোকগুলো আসলে কেঁচোশিকারি। আমাদের যাদের বাড়িতে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ পোষার শখ রয়েছে তাদের প্রায় সকলেরই জানা যে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রাকার কেঁচো এই ধরনের মাছের মূল খাদ্য। খালের পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে সেই কেঁচো সংগ্রহ করছে মানুষগুলো। আপাতদৃষ্টিতে নজর চালালে চাড়ির মধ্যে থকথকে কালো নোংরা পাঁক ছাড়া আর কিছুই নজরে আসবে না। সেই চাড়ি ভরতি পাঁক মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসা হবে বাড়িতে। তারপর ঢেলে দেওয়া হবে ছড়ানো কোনও পাত্র বা এক ইটের দেওয়াল তোলা ঘেরাটোপে। ওপরে ঢেকে দেওয়া হবে কালো রঙের পলিথিনের চাদর। পাঁকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অযুত-কোটি নিশাচর কেঁচো রাত হয়ে গেছে ভেবে উঠে আসবে ওপরে। আড়াই-তিন ঘণ্টা বাদে চাদর সরিয়ে দক্ষ হাতে কাঁচিয়ে তুলে নেওয়া হবে কেঁচোগুলোকে। একটা লম্বাচওড়া সাদা কলাইকরা পাত্রে ঢেলে বারবার ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হবে বাকি পাঁকটুকু। পড়ে থাকবে জমাটবাঁধা অযুত-কোটি রক্তলাল কেঁচো। বড় বড় পলিপ্যাকে ভরতি করে পৌঁছে দেওয়া হবে শহরের রঙিন মাছের দোকানগুলোয়। গৃহস্থের সাজানো ড্রয়িংরুমে গৃহশোভা বৃদ্ধির উপকরণ অ্যাকোয়েরিয়ামে লাল নীল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্য। মাছের দোকানদার অথবা গৃহস্থ কেউ খবরই রাখবে না তাদের ব্যাবসা অথবা শখের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিদিন কত রকমের বিপদ আর রোগবালাইয়ের ঝুঁকি নিয়ে জলে নামে কেঁচো শিকারিরা। খালের পাঁক কালো নোংরা জলে হাজার রকমের বিষাক্ত জীবাণু। ফলে বারোমাস হাতে-পায়ে জলহাজা সহ একাধিক চর্মরোগে ভোগে মানুষগুলো। এ ছাড়া রক্তচোষা জোঁক, সাপ আর বিষাক্ত পোকামাকড়ের (ওয়াটার স্পাইডার, ওয়াটার বিটলস) কামড়ের বিপদ তো আছেই। সঙ্গে দোসর দিনরাত জল ঘাঁটার ফল— বারোমাসে সর্দিকাশি আর জ্বর। এদিকে বর্ষাকালে খালের জল যায় বেড়ে। গভীর জলে নেমে কেঁচো ধরার কাজটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে সে সময়টায়। এত হাড়ভাঙা পরিশ্রম, রোগবালাই আর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন কাজ করার পরও হাতে লাভ থাকে অতি সামান্যই। ইদানীং সেই লাভেও থাবা বসিয়েছে ড্রাইফুডের বাড়বাড়ন্ত। দেশি-বিদেশি ড্রাইফুডে ভরতি রঙিন মাছের দোকান। সংরক্ষণের ঝামেলা নেই। গৃহস্থের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। ফলে দারিদ্র্যসীমার অনেক নীচে বিচরণ করে এইসব প্রান্তিক মানুষগুলো। আনন্দ পালিত রোডের রেলব্রিজ সংলগ্ন বস্তি আর শিয়ালদা-পার্ক সার্কাস স্টেশনের মাঝখানে রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি বেঁধে বাস করে এরা। ঘরে অপরিসীম দারিদ্র্য। তবু রোজ সকালে উঠে বেরোতেই হয় এই অসম্ভব পরিশ্রমসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ আর বিপদসঙ্কুল জীবিকার সন্ধানে, কারণ দোকানদারের কাছে যা ব্যাবসা, গৃহস্থের কাছে যেটা শখ, ওদের কাছে সেটাই যে পেটের ভাত।
রাম-রথ
জানুয়ারি মাস। রাত সাড়ে দশটা। পৌনে এগারোটা মতো হবে। ইস্টার্ন বাইপাসের গায়ে অজয়নগর বাসস্টপে দাঁড়ানো দুটো ছেলে। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। কথা বলছিল নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে। “কীরে, তোর রাম-রথ তো এখনও এল না।” প্রথম জন জিজ্ঞেস করল দ্বিতীয় জনকে। দ্বিতীয় ছেলেটা, ছিপছিপে স্মার্ট চেহারা, লেদার জ্যাকেটের বুকপকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখল, “চিন্তা করিস না এসে যাবে।” জবাব দিল নিশ্চিন্ত গলায়। মিনিট পাঁচেক বাদে একটা স্কুটার, গতি কমিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বাস স্টপ থেকে হাত দশেক দূরে। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল ছেলে দুটো। স্কুটার আরোহী বেঁটেখাটো পেটা গড়ন। গলা অবধি জিপার টানা কালো জ্যাকেট। “কী বস, অ্যাতো দেরি হল ক্যানো?” জিজ্ঞেস করল দ্বিতীয় ছেলেটা। মাথা থেকে হেলমেটটা খুলল আরোহী, “আরে বোলো না, পাটুলির ওখানে শালা টায়ার ফাঁসল। রিপেয়ার করিয়ে আসতে আসতে…।” বলতে বলতে স্কুটারের সামনের ডিকিটা খুলে বের করে আনল চ্যাপটাপানা একটা রামের পাঁইট। প্রথম ছেলেটা দ্রুত আরোহীর হাত থেকে পাঁইটটা নিয়ে গুঁজে ফেলল কোমরে। তারপর হিপপকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট গুঁজে দিল আরোহীর হাতে। “আসি আরও তিন জায়গায় সাপ্লাই আছে। দরকারে ফোন কোরো।” স্কুটার স্টার্ট দিয়ে গড়িয়ার দিকে চলে গেল আরোহী। বাসস্টপের গায়ে স্ট্যান্ড করানো একটা হান্ড্রেড টুয়েন্টিফাইভ সি সি বাইক। ঝটপট বাইকে চেপে মোড় থেকে সন্তোষপুরের দিকে ঘুরে গেল ছেলে দুটো।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে দৃশ্যক্রমের বর্ণনা দিলাম আপনাদের, সে ব্যাপারে একটু খোলসা করে বলি এবার। ওই স্কুটার চালক আসলে একজন ভ্রাম্যমাণ মদবিক্রেতা। পুরো ব্যাবসাটাই চলে কালোবাজারে। এরকম আরও অন্তত পনেরো-কুড়িজন মোবাইল ওয়াইন সেলার রয়েছে রুবি থেকে গড়িয়া, এই বাইপাস সংলগ্ন এলাকাটা জুড়ে। এ কাজে সবারই বাহন স্কুটার অথবা বাইক। নিপ, পাঁইট আর বোতলপিছু কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি পড়ে। রাত দশটার পর লাইসেন্সড মদের দোকানগুলো ঝাঁপ বন্ধ করার পর কারবারটা শুরু হয়। এই বিক্রেতা অথবা তাদের বাহনদের একাধিক কোডনেম রয়েছে ক্রেতামহলে। যেরকম ‘রাম-রথ’, ‘টান্টু মেল’, ‘বুজ এক্সপ্রেস’, ‘টাল্লাগাড়ি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ছুটিছাটা, উৎসব বিশেষত দুর্গাপুজো, দোল, দেওয়ালি, কালীপুজো, বড়দিন, থার্টি ফার্স্ট নাইট আর গান্ধি জয়ন্তীতে (ওইদিন মদের দোকান বন্ধ থাকে) চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামও যায় বেড়ে। পুরনো এবং পার্মানেন্ট কাস্টমারদের জন্য হোম ডেলিভারিরও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই…
শহর বাড়ছে। যাদবপুর, টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে গড়িয়া টপকে বোড়াল হয়ে সেই কামালগাজি, নরেন্দ্রপুর, সোনারপুর, বারুইপুর… হাইরাইজ, স্কাইস্ক্র্যাপার, সারসার ফ্ল্যাটের জঙ্গল। নগরায়ণের বিষাক্ত থাবায় অবাধে বোজানো হচ্ছে মাইলের পর মাইল পুকুর, জলাভূমি, নির্বিচারে কাটা পড়ছে লক্ষ লক্ষ গাছ। চাষজমিকে পায়ের তলায় থেঁতলে মাথা তুলছে বহুতল। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিপদে পড়ছে সেখানকার মনুষ্যেতর বাসিন্দারা। সাপ, ব্যাঙ, মাছ, প্রজাপতি, কেঁচো, পাখি, ভাম, ভোঁদড়, শেয়াল… আরও কতশত প্রজাতি। কিন্তু ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাবেটা কোথায়। ফলে মরছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দলে দলে। এর মধ্যেই নাছোড় কেউ কেউ, এখনও তাদের সেই কবেকার, আদ্যিকালের ভিটে ছাড়তে নারাজ। তাই কংক্রিটের জঙ্গলে ফ্ল্যাটবাড়ির ভেন্টিলেটরে এখনও খড়কুটো জুটিয়ে এনে বাসা বাঁধছে চড়াই। ডিম, ছানাপোনা বিয়োচ্ছে। জল আর ঝোপঝাড়ের অভাবে পাকা রাস্তার ওপর এসে বসে থাকছে নিঃসঙ্গ কুনো ব্যাঙ। এখনও না কাটা পড়া জামগাছটার ডালে কচিৎ কদাচিৎ উঁকিঝুঁকি মারা হতাশ লক্ষ্মীপ্যাঁচা, রোগা রোগা কাঠবেড়ালী। খাবার নেই, তাই ফ্ল্যাটবাড়ির রান্নাঘরের জানলা গলে হানা দিচ্ছে ভাম। মাঝে মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া জোড়া শালিখ নেচে বেড়াচ্ছে ঝুল বারান্দার কার্নিশে। একগাদা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ভারী বিপদে পড়ে যাওয়া বেজি-মা। দিগ্ভ্রান্তের মতো ঘুরঘুর করছে এদিক ওদিক। বুঝতে পারছে না লুকোবে কোথায়। এদের মধ্যে আরও একদল রয়েছে যারা এই উচ্ছেদ হওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি কিছুতেই। সাপ। সুদৃশ্য ড্রইংরুমে সোফার নীচে, কাবার্ডের তলায়, বেডরুমে আলমারির পিছনে, বাথরুমে কমোড ফ্ল্যাশের ঢাকনার ওপর… সর্বত্র অবাধ বিচরণ এদের। লেজের ডগাটুকু চোখে পড়া মাত্র গেরস্থর তীব্র ভয়মিশ্রিত চিৎকার, চ্যাঁচামেচি… প্রবল আতঙ্ক! আর এই আতঙ্কই দরজা খুলে দিচ্ছে এক অদ্ভুত জীবিকার। সাপুড়ে বা বেদে। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বা বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই যাযাবর শ্রেণির মানুষরা মাঝে মাঝেই এসে হানা দেয় এইসব সদ্য গজিয়ে ওঠা আবাসনগুলোয়। মুখে হাজার রকম বুলি— “ঘরে সাঁপ আছে গোওও… নাগের বাস (গন্ধ) পেতেছি, সাঁপ ধরাবে নাকি গোওওও…” অথবা “ঘর মে সাঁপোয়া ঘুঁস গৈলে। হাম বানজারা, সাঁপোয়া পাকড়বে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই হানা দেওয়ার ব্যাপারটা ঘটে মূলত দুপুরের দিকে। সাধারণত ওই সময়টায় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাড়িতে থাকেন না। সাপুড়েদের ভয়মাখানো বুলিতে চরম সন্ত্রস্থ গৃহকর্ত্রী। ঘরের মধ্যে সাপ! দু’দিন আগে নাকি মিসেস বাসুর ফ্ল্যাটে দেখা গেছিল। লোকগুলো যা বলছে তাতে যদি আমার ঘরেও থাকে? এই ভয়ের রন্ধ্রপথে ঘরে ঢুকে পড়ে সাপুড়েরা। ঢুকেই সন্দেহজনক চোখে চারদিক দেখে নিয়ে নাকটাক শুঁকে শুরু হয় আরেকপ্রস্থ ভয় দেখানোর পালা। “ইয়া বড়কা কোবরা নাগ!… বহোত বিষনি (বিষাক্ত)! পাকড়নেমে বহোত তকলিফ হোগা… পাঁচশ রুপিয়া লাগেগা।” ভয়ে আধমরা গৃহকর্ত্রী। শুরু হয় কাতর গলায় অনুনয় বিনয়— “একটু কমসমে হয় না বাবা।” শেষ অবধি তিনশো কি চারশোয় রফা হয়। এইখানে পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, দুয়েকটি ক্ষেত্রে এর সত্যতা থাকলেও সাপুড়েদের এই ভয় দেখানোর খেলাটা শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ্যে এবং লোকঠকানো। ঢোলা জামা বা পাঞ্জাবির আস্তিনের ফাঁকে লুকোনো থাকে বিষদাঁত ভাঙা চন্দ্রবোড়া, কালাচ, শাঁখামুঠি, গোখরো বা খরিশ কেউটে। নিদেনপক্ষে নির্বিষ ঢোঁড়া, হেলে, দাঁড়াশ, কালনাগিনী বা লাউডগা। নিখুঁত হাতসাফাইয়ের খেলায় সেগুলোকেই আস্তিনের ফাঁক থেকে বের করে এনে দেখানো হয় বাড়ির লোকজনকে। চরম আতঙ্কগ্রস্ত বাড়ির লোকজন। সাপুড়েদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে রক্ষা পান ভয় থেকে। এই একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম সেই ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর। গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছি। ভবানীপুরে পুরনো পাড়া ছেড়ে বেহালার সরশুনায় নিজেদের বাড়িতে উঠে এসেছে মামারা। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। সরশুনা, চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, পুকুর-ডোবা-নালা, মাঝে মাঝে ছিটেবেড়া আর টালির চালের উদ্বাস্তু কলোনি। ইতিউতি দু’-চারটে সদ্য নির্মীয়মাণ ইটের দাঁত বের করা সিমেন্টের প্রলেপহীন বাড়ি। নিঝুম ঘুঘুডাকা দুপুর আর রাত নামলেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার চারদিকে। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুইপাখির সাইজের ভ্যাম্পায়ার মশা। মনে আছে ঠিক এরকম একটা দুপুরে, মামারা সব অফিসে, বাড়িতে হানা দিয়েছিল সাপুড়ের দল। মামিদের ভুজুংভাজুং দিয়ে রান্নাঘরের সিঁড়ির তলায় কয়লা রাখার অন্ধকার খুপরিটা থেকে ধরে নিয়ে গেছিল হাত তিনেক লম্বা একটা দাঁড়াশ, সঙ্গে নগদ পাঁচটা টাকা। তখনকার বাজারে অঙ্কটা অনেক। ভয়ে দুর্গানাম (নাকি মনসা?) জপতে জপতে সাপুড়েদের টাকা মিটিয়ে স্বস্তির হাঁফ ছেড়েছিল মামিরা। আজ এতদিন বাদেও কথাটা মনে পড়লে মনে মনে হাসি আর এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় ভাবি— ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’
খাঁটি বেওসা
ফুটপাতের ধারে বিশেষ করে অফিসপাড়ায় চোখে পড়বে দৃশ্যটা। একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে গোঁজা খেজুরপাতা, বালতিভরতি মধু, ওপরে ভাসছে ভাঙা মৌচাকের টুকরো, মৌচাকের ওপর ইতিউতি উড়ে অথবা ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মৌমাছি। পাশে বসা ফেরিওয়ালা। হাতে বালা, কানে মাকড়ি, গলায় রংবেরঙের পাথর বসানো হার। যাযাবর বানজারা টাইপের চেহারা। থেকে থেকে হাঁক পাড়ছে মধ্যমস্বরে। “মধু লে লো বাবু, আসলি জংলি মধু… জঙ্গল সে তোড়কে লায়া…।” মধু যে কতটা খাঁটি সেটা প্রমাণ করার জন্য একটা দশ টাকার নোটে মধু মাখিয়ে দেশলাই জ্বেলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। নোটটা পুড়ছে না। খাঁটি মধু মাখানো কোনও জিনিস নাকি আগুনে পোড়ে না— দাবি করছে লোকটা। কথার জাগলারিতে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমাচ্ছেন পথচারীরা। বিক্রিবাট্টাও হচ্ছে ভালই। খাঁটি মধু কিনে বাড়ি ফিরছেন পথচারীরা এবং অতি অবশ্যই ঠকছেন। কারণ ওই খাঁটি মধুর বারো আনাই ভেলি বা চিটেগুড়ের রস। দু’আনা লিকুইড গ্লুকোজ, ঘনভাব আনার জন্য, এক আনা নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স আর বাকি একআনা সত্যিই খাঁটি মধু। আর মধুর বালতির ওপর মৌমাছি ওড়াটি কোনও ব্যাপারই না। শুধু মধু নয়, চিনির বস্তা বা ভেলিগুড়ের ঢেলার ওপরেও মৌমাছি ঘুরঘুর করে। যে-কোনও গুড়-বাতাসার দোকানে গেলেই ব্যাপারটা মালুম হবে। এদিকে নোট না পোড়ার রহস্যটা স্রেফ কেমিক্যালের কারসাজি। কিনে নিয়ে গিয়ে দু’দিন বাদেই ভুল ভাঙছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল— ঘরে গৃহিণীর গঞ্জনা, পুত্র-কন্যার পরিহাস। বেচারা মধ্যবিত্ত অফিসবাবু!
প্রায় এই একইরকম আর-এক ধরনের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন শহরে। তবে এদের জন্য খাঁটি মধুর জায়গায় খাঁটি ঘি। যার প্রায় ষাট শতাংশ সস্তা বনস্পতি আর ক্ষতিকারক ভেজিটেবল অয়েল। সঙ্গে নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স, যথারীতি, বাকি ব্যাবসার টেকনিকটা মধুর মতোই হুবহু এক। স্রেফ চিটিংবাজি আর বাকচাতুর্যকে মূলধন করে এই ‘খাঁটি’ বেওসাদাররা আজও দিব্যি করেকম্মে খেয়ে যাচ্ছেন আমাদের এ শহরে।
…কত রং বদলায়
শেয়ালদা প্রাচী সিনেমার উলটোদিকে এন আর এস হাসপাতালের গা ঘেঁষে যে সুড়ঙ্গপথটা (সাবওয়ে) সোজা শেয়ালদা স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে কোনওদিন যদি হেঁটে যান, চোখে পড়বে সবজিওয়ালি মাসি আর হরেকরকম পসরা সাজিয়ে বসা ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকের মাঝখানে হাতের বাঁদিকে বসে থাকা দু’-তিনজন। সামনে একটা স্টিলের প্লেটে ছোট ছোট রঙিন পাথর আর পাশে একটা বাটিতে সাদা পাউডার গোলা জল। পিছনে ফ্লাইওভারের দেয়ালে আঁকা কালীমূর্তির ছবি। তলায় ক্যাপশন— ‘এখানে ভাগ্য বিচার করে সঠিক পাথর দেওয়া হয়।’ কৌতূহলী পথচারীরা উঁকিঝুঁকি মারছেন। কেউ একটু বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলা হচ্ছে। কালীমূর্তির ছবির নীচে বসে থাকা একজন, ফর্সামতন, বোধহয় দলটার পাণ্ডা, সম্ভাব্য খদ্দেরকে প্রশ্ন করছে নিচু গলায়— “কিনবেন তো?” খদ্দের রাজি হওয়ামাত্র আঁজলা পাতার মতো করে ডান হাত পাততে বলা হচ্ছে। স্টিলের প্লেট থেকে একটা করে পাথর তুলে খদ্দেরের হাতে রেখে একটা ছোট চামচে দিয়ে পাউডার-গোলা জল ঢালা হচ্ছে হাতে। পরমুহূর্তেই পাথরটা তুলে নিয়ে একটা অন্য পাথর বসানো হচ্ছে। ফের নতুন করে জল ঢালা হচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ প্রক্রিয়াটা চলার পর একটা পাথর বসিয়ে হাতে জল ঢালতেই আশ্চর্যজনকভাবে সাদা পাউডার গোলা জলের রং বদলে লাল হয়ে গেল। হতবাক খদ্দের! বিক্রেতার গলা চড়ছে। “দেখলেন তো কীরকম রং বদলে গেল। আপনার হাতের রেখার সঙ্গে মিলে গেলে তবেই জলের রং বদলাবে। নচেৎ কিছুতেই নয়। তার মানে আপনার দরকার গোমেদ। বাজারে আসল গোমেদ কিনতে গেলে ট্যাঁক থেকে হাজার টাকা খসে যাবে। এই পাথরটা গোমেদের বিকল্প। আপনার ভাগ্য ভাল তাই মাত্র দুশো টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন।” চমকিত খদ্দের। মাত্র দুশো টাকায় গোমেদের বিকল্প! মানে তুঙ্গে বৃহস্পতি। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে বেরিয়ে আসা মানিব্যাগ। ঝটিতি হাতবদল হয়ে যাওয়া করকরে দু’খানা একশো টাকার নোট। কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস, “শনি অথবা মঙ্গলবারে পুজো দিয়ে রুপো বাঁধানো আংটিতে বসিয়ে ধারণ করবেন। ওইদিনটা টক খাবেন না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলকিত খদ্দের। ভাগ্যের রং বদলানোর আনন্দে মোড়কটা পকেটে পুরে পা বাড়াচ্ছেন গন্তব্যস্থলের দিকে।
ভাগ্যের রং কি সত্যিই বদলাল? আরে না মশাই। কিছুই বদলাল-টদলাল না। আসলে এই গোটা ব্যাপারটাই একটা ফক্কিকারির খেল। নির্ভেজাল চিটিংবাজি। দৈবটৈব কিস্যু নেই এর মধ্যে। প্লেটে রাখা ওই পাথরগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটায় হালকা করে ছোঁয়ানো রয়েছে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট। কোন পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো রয়েছে সেটাও বিক্রেতার মুখস্থ। যে পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো নেই প্রথমে সেরকম কিছু পাথর হাতে বসিয়ে জল ঢালা হচ্ছে। খদ্দেরের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার জল। অতপর মওকা বুঝে রাসায়নিক লাগানো পাথর প্রয়োগ করা হচ্ছে। রসায়নের নিয়ম অনুযায়ী পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট জলের সংস্পর্শে এলেই তা লাল অথবা গাঢ় গোলাপি রং ধারণ করে। খদ্দের ভাবেন ভাগ্যের রং বদলাচ্ছে। অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের কী মর্মান্তিক পরিহাস!
অল দ্যা গ্লিটারস ইজ নট…
রাস্তা দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল ফুটপাতের ধারে পলিথিন শিটের ওপর ছড়িয়ে রাখা ঝকঝকে সেলোফেন পেপারে মোড়া দামি দামি শাড়ি, ঢেলে বিক্রি হচ্ছে। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রেতা। বিক্রেতাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। শাড়ি বাছাবাছি করছে। কেনাকাটাও চলছে মন্দ না। আপনার কৌতূহল হল। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ক্রেতাদের ভিড়ের মাঝখানে। শুনতে পাবেন ফিসফাস, টুকরোটাকরা বার্তালাপ। ক্রেতারা নিচুগলায় কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে— “আরে বাবা!… পিওর জরদৌসি… কী করে অত সস্তায় দিচ্ছে!” “সেটাই তো ভাবছি মশাই, এটা তো বালুচরি… বাজারে অন্তত পাঁচ হাজার… এখানে মাত্র দেড় হাজার চাইছে… জাস্ট ভাবা যায় না!” এককোণে দাঁড়ানো বিক্রেতা, জবাব দিচ্ছে কিছুটা দুখী দুখী বিষণ্ণ গলায়— “সবই কপাল স্যার, মহাজন ফেল মেরেছে। কোম্পানিতে লালবাতি জ্বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে…।” শুনেটুনে আপনার কৌতূহল বাড়ল। এত লোক কিনছে। ভাবামাত্র উবু হয়ে বসে পড়লেন ফুটপাতে। বাছাবাছি করে কিনে ফেললেন একটা পাটোলা বা কাঞ্চিভরম। মাত্র হাজার টাকায়। তাড়াহুড়ো করে ভরে ফেললেন ব্যাগে। যুদ্ধজয়ের আনন্দে হাঁটা লাগালেন তড়িঘড়ি, বাড়ি ফেরার বাস ধরবেন বলে। কোন মহাজন ফেল মেরেছে? কোথায় অথবা কেন লালবাতি জ্বলেছে? এত দামি দামি শাড়ি হঠাৎ কেন এত সস্তায় দিচ্ছে? ভেবেও দেখলেন না একবার। আনন্দে প্রায় উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেই গিন্নির ‘স্টিং অপারেশনে’র সামনে সব ঘোটালার পরদা ফাঁস। পচা রদ্দি পাটফেঁসো শাড়ি। অতঃপর সারা সন্ধে একটানা সিরিয়াল ব্লাস্ট, প্রবল গঞ্জনা। গৃহিণী কর্তৃক বিশ্বের সবচেয়ে নির্বোধ মানুষের শিরোপা লাভ। এককথায় হিউমিলিয়েশনের একশেষ। ফলস্বরূপ বিনিদ্র রজনী। হাজার টাকার শোক। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা নাইট ল্যাম্পের আলোয় ঘুরন্ত পাখার দিকে। পরদিন চিরতা খাওয়া মুখে ফের যাত্রা কর্মস্থলের উদ্দেশে। মাঝখানে টুক করে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া ফুটপাতের ওই নির্দিষ্ট জায়গাটায়। কেউ নেই। সব ভোঁ ভোঁ।
মন খারাপ করবেন না। একা আপনি নন, আপনার আগে আরও অনেকে ওই একই দিনে প্রতারিত হয়েছেন একটি সংগঠিত প্রতারক চক্রের হাতে। প্রতারক চক্রই বলব কারণ আপনার চারপাশে ভিড় করে থাকা যাদেরকে আপনি খদ্দের বলে ভেবেছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ওই প্রতারক চক্রের অংশ। শাড়ির অসাধারণত্ব আর অবিশ্বাস্য কম দামের কথা বলে এমনকী কিনে পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে আপনাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল তার জাল কেটে আদৌ বেরনো সম্ভব হয়নি আপনার পক্ষে। নকল খদ্দেরদের বাকচাতুর্যে সম্মোহিত হয়ে প্যাকেটটা খুলেও দেখেননি। আসলে এটাই এই প্রতারক চক্রের কায়দা বা কৌশল। ঝাঁ চকচকে সেলোফেনে মোড়া এবং নিপুণভাবে পাটপাট ভাঁজ করা শাড়ির পসরা সাজিয়ে এরা দাঁড়িয়ে পড়ে ফুটপাতে। নিজেরাই খদ্দের সেজে ব্যস্ত ‘কেনাকাটা’ করতে থাকে। দু’-একটা ‘ধুরুয়া’ (প্রতারকদের ভাষায়) ফাঁদে পা দেওয়ামাত্র কথার কারিকুরিতে ভুলিয়ে ভালিয়ে মালটা গছিয়ে দিয়েই পাততাড়ি গোটায় সেখান থেকে। ফের অন্য কোনওখানে দোকান লাগায়। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার লক্ষ করেছি এদের এই লোক ঠকানো ব্যাবসার কলাকৌশল আর বারবার মনে পড়ে গেছে সেই বহুচর্চিত প্রবাদ বাক্যটা। ‘যা চকচক করে তাই সোনা নয়’। কথাটা এই ব্যাবসার ক্ষেত্রেও একশো শতাংশ সত্যি।
বৃহন্নলা বৃত্তান্ত
দৃশ্য ১: বছর দশেক আগে মুম্বাইয়ের ট্র্যাফিক সিগন্যালগুলোয় চোখে পড়েছিল দৃশ্যটা। ইদানীং কলকাতাতেও পড়ছে। হালফিলে শুরু হয়েছে ব্যাপারটা।
শহরের রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে কোথাও যাচ্ছেন। ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি থামল। হঠাৎই জানলার কাচে ঠুক ঠুক। সামনে দাঁড়ানো একজন। পরনে ঝকমকে সস্তা শাড়ি অথবা সালোয়ার কামিজ। পুরুষালি মার্কা হাতে গাদাখানেক কাচের চুড়ি। বিটকেল ফ্যাটাক ফ্যাটাক শব্দে হাততালি দিচ্ছে। সঙ্গে হেঁড়ে খোনা গলার আবেদন— “কিছু দে রাজা…।” পকেটে হাত ঢোকালেন আপনি। দু’-পাঁচ টাকা যা পারলেন ধরিয়ে দিলেন। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাতটা আলতো করে মাথায় ছুঁইয়েই ভিক্ষাপ্রার্থী দৌড়োল অন্য গাড়ির উদ্দেশে।
দৃশ্য ২: ভর দুপুরবেলা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাড়িতে নেই। এমন সময় দরজায় খনখনে হেঁড়ে গলার ডাক— “কার ছেলে হল গো?” সঙ্গে ফটাফট হাততালির আওয়াজ, দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন। ঢ্যাঙা পুরুষালি চেহারা। পরনে শাড়ি, উৎকট সাজগোজ। কাঁধে ঝোলানো ঢোল। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। দরজা খোলামাত্র নির্দেশ-মিশ্রিত কথাবার্তা। “কই গো, বাচ্চা দেখাও… ছেলে না মেয়ে? ছেলে হলে কিন্তু পাঁচ হাজার নেব।” অতঃপর অনুনয় বিনয়। দরাদরি। দরে না পোষালে কাঁচা গালিগালাজ। কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। সমস্ত ব্যাপারটা একসময় ভয়ংকর ভীতিপ্রদর্শনের জায়গায় পৌঁছে যাওয়া। শেষ অবধি অনেক টেনে হিঁচড়ে চাহিদাকৃত অর্থের পরিমাণ কিছুটা কম হওয়া। সঙ্গে সিধে হিসেবে চাল-ডাল-তেল-প্রায় নতুন শাড়ি। ঢোলক বাজিয়ে হেঁড়ে গলার নাচাগানা— “বেলা গেল ও ললিতে কেষ্ট এল না…।” অবশেষে নবজাতককে আশীর্বাদ করে ঘর ছেড়ে বেরল দলটা। দরজা বন্ধ করে হাঁফ ছাড়লেন গৃহস্থ।
প্রিয় মহানাগরিক, আশা করি আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনে কখনও না কখনও এ ধরনের দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছেন। এ দৃশ্যের মূল কুশীলবরা সকলেই বৃহন্নলা। যারা আমাদের সমাজে হিজড়ে, মওগা, ছক্কা, ডাবলডেকার… এরকম একাধিক নামে পরিচিত। সমাজের এককোণে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে খুব সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করেন এইসব প্রান্তিক শ্রেণির মানুষেরা। একেকটি গোষ্ঠীর গোষ্ঠীপতিকে ‘গুরু-মা’ বলে ডাকে গোষ্ঠীর অধীনস্থ হিজড়েরা। এদের বাসস্থান বা হিজড়ে বাড়িগুলোকে ‘খোল’ নামে ডাকা হয়। হিজড়েদের পেশা মূলত বাচ্চা নাচানো, বিয়ে শাদী, ছটপুজো বা অন্যান্য উৎসবে নাচাগানা, দূরপাল্লার ট্রেন, ট্র্যাফিক সিগন্যাল বা দোকানবাজারে ভিক্ষে করা। গুরু-মার কথাই প্রত্যেকটা খোলে হিজড়েদের কাছে আইন। কঠোর শৃঙ্খলার সাথে সেটা মেনে চলতে হয়। সারাদিনের উপার্জিত অর্থ এবং দানসামগ্রী এনে জমা করতে হয় গুরু-মার কাছে। এরপর গুরু-মার দায়িত্ব প্রত্যেককে তার ভাগ বুঝিয়ে দেওয়া। হিজড়ে সমাজে উপার্জন সংক্রান্ত একাধিক কোডভাষা রয়েছে। যেমন ‘ঝোলকি’ মানে রোজগার, ‘থাপ্পু’, ‘টেংরি’ বা ‘গজ’ মানে টাকা, ‘কোনকি’ মানে পয়সা, ‘বড়া কাগজ’— হাজার টাকা, ‘সবসে বড়া কাগজ’— এক লাখ টাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেই বলেছি হিজড়েদের মধ্যে কে কোন কাজ করবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব গুরু-মায়ের। হিজড়ে সমাজে সুন্দর এবং মেয়েলি গড়নের হিজড়েদের ‘নাগিন’ নামে ডাকা হয়। মূলত এই ‘নাগিন’রাই বাড়িতে বাচ্চানাচানো বা পুজোপার্বণ উৎসবে নাচার মতো সবচেয়ে সম্মানজনক কাজের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর ক্রমে ক্রমে ছলাকলা, সৌন্দর্য, বাকচাতুর্য অনুযায়ী বাকি কাজের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। সবচেয়ে কর্কশ, কাঠখোট্টা আর কুৎসিত দর্শন হিজড়েদের জন্য পড়ে থাকে দোকান বাজারে ভিক্ষে করার কাজ। হিজড়ের সমাজে এরা ‘বিলা’, ‘জেনানা’ ‘জন হিজরা’… একাধিক নামে পরিচিত। এ ছাড়া বহুক্ষেত্রে গুরু-মা বা গোষ্ঠীপতিদের বিরুদ্ধে হিজড়েদের দিয়ে যৌনব্যাবসা, হিজড়ে নিলাম, শিশুপাচার, বর্ডারে চোরাচালান, বাড়িতে বাচ্চা নাচাতে গিয়ে নৃশংস জুলুম অথবা সেই বাড়ির অন্দরমহলের খবর ডাকাত গ্যাংগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো মারাত্মক গুরুতর অভিযোগও উঠেছে অনেক সময়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। নিয়ম কখনওই নয়। হিজড়েদের প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট আলাদা কাজের এলাকা আছে। একদল কখনও অন্যদলের কাজের এলাকায় ঢুকবে না। এলাকা নিয়ে কখনও বিবাদ হলে এবং সাধারণ ভাবে মিটমাট না হলে কোনও নিরপেক্ষ গুরু-মার খোলে পঞ্চায়েত বসানো হয়। প্রতিটি গোষ্ঠীর গোষ্ঠীপতিরা সেই পঞ্চায়েতে আসেন। বিচারে যা ঠিক হবে সেটাকেই আইন বলে মেনে নিতে হবে বিবদমান দুই গোষ্ঠীর গুরু-মা ও তার অধীনস্থ শিষ্যা হিজড়েদের। কলকাতার খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, তালতলা, চেতলা, পার্ক সার্কাসের দারাপাড়া অঞ্চলে একাধিক হিজড়ে বাড়ি বা ‘খোল’ রয়েছে। তবে এখানে আমার আলোচনার বিষয় একান্তভাবেই হিজড়েদের পেশা সম্পর্কিত, তাদের সমগ্র জীবন চর্চা কখনওই নয়। তা ছাড়া সমগ্র হিজড়ে সমাজ এবং তাদের জীবনযাত্রা এতটাই জটিল আর রহস্যময়তায় ঢাকা যে গোটা একটা লাইব্রেরি বা আর্কাইভও এই বিরাট পরিসরকে ধারণ করবার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এখানেই দাঁড়ি টানলাম।
১৬. কলকাতা ও শহরতলির বিচিত্র হাট-বাজার-বিপণি
কথায় বলে তিনশো বছরের কলকাতা। কলোনির বয়স সত্যিই তিনশোর বেশি না কম এ নিয়ে অহেতুক বিতর্কে ঢুকছি না। সেটা আমার প্রতিবেদনের বিষয়ও নয়। যেটা বলতে চাইছি— মোগল সাম্রাজ্যের পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতের শাসনভার গ্রহণ— ঠিক এই সময়টা দেশের মূল শহরগুলির মানচিত্র কলকাতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পরবর্তীতে দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসকবর্গ। তখন থেকেই ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতাতেও গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক কল-কারখানা। এ শহরটা বরাবরই শ্বেতাঙ্গ মহাপ্রভুদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা ছিল। অচিরেই তাঁরা কলকাতাকে ‘মিনিয়েচার লন্ডন’-এর চেহারা দিতে উঠে পড়ে লাগেন। এর ফলে কলকাতা ও তার চারপাশ ঘিরে গজিয়ে উঠতে থাকে অসংখ্য দোকান-বাজার-হাট। ব্রিটিশ শাসন অন্তে, কালগ্রাসে এর বহু কিছু হারিয়ে গেলেও টিকে রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, এখনও। তার মধ্যে বিচিত্র কয়েকটির প্রসঙ্গ অবতারণা করব এই না-গল্পে। ভাল অথবা মন্দ লাগা পাঠকের বিচার্য।
হাট বসেছে শুক্রবারে
বালিগঞ্জ পদ্মাপারে নয়, খোদ কলকাতার বুকেই। বেহালা চৌরাস্তার মোড় থেকে বাস অথবা অটোয় মিনিট সাতেকের রাস্তা সরকার হাট সরশুনা মেইন রোডে। পিন কোড, আজ্ঞে হ্যাঁ— কলকাতা একষট্টি। বাসস্টপের নামকরণও হাটের নামেই। প্রতি শুক্রবার বিকেলে নিয়মিত বসে এই হাট। পত্তনি: ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের আমলে এবং প্রত্যক্ষ সহায়তায়। হাটের বাইরেটা মনিহারি-প্রসাধনী দ্রব্য ও টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান দিয়ে ঘেরা। এর মাঝখানে যে-কোনও গলি দিয়ে সেঁধিয়ে গেলেই হাটের মাঠ। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে, হাঁকডাকে জমজমাট। ঠিকমত তাক করে চোখ চালালে হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন সব এক্সক্লুসিভ পসরা। হিঞ্চে শাক, রস-টুসটুসে কামরাঙা, আঁশফল, ঢেঁকিশাক, তিলের খাজা, জাল লাগানো ঝুড়িতে খলবল করা চিতি কাঁকড়া (গা-মাখা মাখা ঝোলে কষিয়ে রাঁধতে পারলে এক কথায় সুপারলেটিভ!), ছোট কাচের বাক্সে বুড়ির চুল (সাহেবি কেতায় ‘ক্যান্ডিফ্লস’), বেতের বোনা ধামাকুলো, মাটির রাধাকৃষ্ণ— এ রকম আরও অনেক ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েশন, যার নাগাল পায়নি শপিংমল-ফুডবাজার-স্পেন্সার্সের দল। কেনাকাটা করুন প্রাণ খুলে বেরিয়ে আসার আগে মাথায় টালির চাল আর জং-ধরা টিনের দরজা লাগানো কাতুবাবুর দোকানে একবার ঢুঁ মারতে ভুলবেন না। এই সব পেয়েছির দেশ অথবা দোকানে এখনও পাওয়া যায় কাঠের লাট্টু-লেত্তি, কাচের মার্বেল গুলি, রাঙাদিদি তরল আলতা, লক্ষ্মীর পাঁচালি, গোপাল ভাঁড়, মেয়েদের ব্রতকথা। বিকিকিনির ধকলে পেটে টান ধরলে পাশের মদনমোহন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গরম কচুরি-তরকারি আর কমলাভোগ তো আছেই। হেলথ কনসাসরা নয় খনিজ জলের বোতলটা বাইরে থেকেই কিনে নেবেন।
পোষ্য পসরা
এও এক হাট তবে চরিত্রটা অন্যরকম। ‘আলপিন টু এলিফ্যান্টের’ পসরা এ হাটে বসে না। বসে পোষ্যের পসরা নিয়ে। আগে বসত উত্তর কলকাতা হাতিবাগানে। বর্তমান স্থান পরিবর্তিত হয়ে কিলোমিটার দেড়েক দূরে খালধারে, গ্যালিফ স্ট্রিটের ফুটপাথে, বছর দশেক হল। হাতিবাগান-গ্যালিফ স্ট্রিট ধরে এ হাটের বয়সও একশো ছুঁই ছুঁই। বসে রবিবার। কাকভোর থেকে বেলা দুটো আড়াইটে। বাড়িতে যা কিছু পোষেন অথবা পুষতে চান সব পাবেন এখানে। পাবেন পায়রা-হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে লাভবার্ড-বদ্রিকা-ককাটেল ফিঞ্চ এরকম আরও অজস্র নাম-না-জানা বিদেশি পাখি। খরগোশ-গিনিপিগ-সাদা ইঁদুর। খাঁচার ভিতর থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা কুকুর-ছানার দল। স্পিত্জ, লাসা, জার্মান শেপার্ড, ডালমেশিয়ান… দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু একটু সাবধানে। অনভিজ্ঞ খদ্দের বুঝলে গাবলু গুবলু নেড়ির বাচ্চাকে জার্মান শেপার্ড (অ্যালসেশিয়ান) বলে চালিয়ে দিতে এই বিক্রেতাদের জুড়ি নেই। এখান থেকে মাছের লাইনে ঢুকে পড়ার পর মনে পড়েই যেতে পারে ষাট দশকের সেই গান— ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে।’ চোখধাঁধানো রুপোলি রাজকীয় ‘অ্যাঞ্জেল’, রক্তলাল ‘সোর্ডটেল’, সোনালি-কমলা রঙের ‘গোল্ডফিশ’— ল্যাজটা রানির মাথায় দোলানো চামরের মতো, রামধনু রঙের ‘কোবরা গাপ্পি’… কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। হাটের একেবারে শেষপ্রান্তে ক্যাকটাস থেকে রেডিমেড বনসাই হয়ে গোলাপ-গাঁদা-চিনে জবা… সব রকম ফুল ও ফলের পসরা সাজিয়ে বসেন বৃক্ষ ব্যাপারীর দল। এ ছাড়াও গাছ-মাছ-পশুপাখি পুষতে যা যা আনুষঙ্গিক উপকরণ লাগে সব পাবেন এখানে। কলকাতা ও তার আশেপাশে এই একই ধরনের হাট বসে গড়িয়া ব্রিজের কাছে বোড়াল রোড, বাইপাসের ধারে বানতলা আর আক্রা সন্তোষপুরের ব্যানার্জি হাটে— সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবারে। সময় দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল পাঁচটা। তবে গ্যালিফ স্ট্রিটের তুলনায় অর্থনৈতিক লেনদেন বা আয়তনে এগুলি নিতান্তই ছোট। তা সে ছোট হোক বা বড়— অদ্ভুত-সুন্দর-সজীব-রঙিন এই সব হাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালেও চোখ মন ভরে যায়। শুধু দুঃখ লাগে যখন দেখি এই একই জায়গায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে টিয়া-চন্দনা-ময়না-ফুলটুসি-মুনিয়া-নেউল-কাঠবেড়ালী ছোট কচ্ছপ এমনকী শিকরে বাজের (স্প্যারো হক) মতো বিপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী যা ধরা, মারা, বিক্রি ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রশাসন দেখে-শুনে নির্বিকার। নিয়ম মেনে ‘রুটিন রেইড’ করতে হয় করে বন দপ্তর। কিন্তু অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরে। নিত্যদিন খবরের কাগজ-টিভি-ব্যানার-হোর্ডিং-এ এ নিয়ে যত জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনি তার কণামাত্রও কাজে প্রতিফলিত হলে সুন্দরতর হয়ে উঠত এই সব সুন্দর না-মানুষী হাট। এটা প্রতিবেদকের বিশ্বাস।
অ্যান্টিক ফুটপাথ অথবা ‘যেখানে দেখিবে ছাই’…
মধ্য কলকাতায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড ধরে হাজি মহম্মদ মহসীন স্কোয়্যারের দিকটায় কখনও গেছেন সন্ধেবেলা? স্থানীয় নাম গোলতালাও। গেলে দেখবেন গোলতালাওয়ের ঠিক উলটো দিকে মার্কুইস স্ট্রিটের ফুটপাথে বসেছে অ্যান্টিক বাজার। এ লাইনের শৌখিন বা রসিক হলে পেয়ে যেতে পারেন উনিশশো তিন সালের দুষ্প্রাপ্য ওয়াইনের খালি বোতল, পেতলের দোয়াতদানি, হ্যামার মাস্টারের ব্রেড টোস্টার, ফরাসি ইজেল, বেলজিয়াম কাট গ্লাসের মদিরা পাত্র… আরও অনেক অনেক সব ‘অমূল্য রতন’। যেমন পেয়ে গেছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ, গহরজান বাইজির গানের রেকর্ড মাত্র সাড়ে সাত টাকায় সেই সত্তর দশকে। আফশোস একটাই, এই ‘অফিসিয়াল কোক’ আর ‘নাথিং অফিসিয়াল পেপসি’ সময়ে খুব দ্রুত ডাইনোসরে পরিণত হচ্ছেন শৌখিন সংগ্রাহক ক্রেতাকুল। ফলে সংকুচিত হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে মার্কুইস স্ট্রিটের অ্যান্টিক বাজার। এ আক্ষেপ রাখার জায়গা কই।
বাস্তুহারার খুকি…
ফুটপাথের ওপর উপুড় হয়ে বসে ফ্রক বাছছিলেন বৃদ্ধা। অল্প-বিস্তর ছেঁড়া-তালি মারা— রিফু করা আর অবশ্যই, পুরনো কাপড়ের ডাঁই থেকে। অনেক বেছেবুছে কিনলেন একটা। বিস্তর দরদাম করে। আঠেরো টাকায়। বছর পাঁচেকের নাতনির জন্য। দিদিমার পাশেই বসে। পাওয়ার আনন্দ-উত্তেজনায় ধকধক করছে চোখ। পুরনো জামাকাপড়ের ফুটপাথ বাজার। বসে কাকভোরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে লিবার্টি সিনেমার ফুটপাথে। শহর ঠিকঠাক ব্যস্ত হয়ে ওঠার আগে বাজার সাফ। পুরনো জামাকাপড় ছাড়াও বিক্রি হয় ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো— কেজি দরে। কিলো প্রতি তিন টাকা, নাকি কারখানায় মেশিনপত্র পোঁছার কাজে লাগে। দিদিমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, হামিদা বেগম। সাকিন— আমহার্স্ট স্ট্রিট মাড়োয়ারি হাসপাতালের সামনে পলিথিন টাঙানো ফুটপাথের ঘর। মেয়ে পাঁচ বাবুর বাড়ি কাজ করে ফুরসত পায় না। জামাই পালিয়েছে বছর দুই হল। কেনাকাটা সেরে চলে যাচ্ছিলেন নাতনির হাত ধরে। সে তো নাচতে নাচতে চলেছে। মুখে বিশ্বজয়ের হাসি, যে হাসি দেখলে ‘সূর্য লজ্জা পায়।’ সেই কবে নাগরিক কবিয়াল লিখেছিলেন— ‘বাস্তুহারার খুকি মেটায় খেলার সাধ/ ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর পার্কে শিশুর সাম্যবাদ।’ আমি নিশ্চিত নই সাম্যবাদ আসবে কিনা। কিন্তু যার কিড-জি নেই, কার্টুন নেটওয়ার্ক নেই, নেই কমপ্ল্যান গার্ল হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ, নেই ডি পি এস-লা মার্টস— সেই খুকি খেলার সাধ অন্তত পুরনো ফ্রকে মেটাতে পারছে। থ্যাঙ্কস ফুটপাথ বাজার।
বটতলা, ক্ষীরের চপ আর নটি বিনোদিনী
বটতলা, বটতলার সাহিত্য-সাহিত্য করে হেদিয়ে মরেন নস্ট্যালজিক বাঙালি। ‘এখন আর নেই… এক্কেবারে হারিয়ে গেছে।’ এরকম কত কথাই তো শুনি গুণীজনের মুখে-গদ্যে-সাহিত্যে-প্রবন্ধে-সেমিনারে। এই প্রতিবেদক কিন্তু উলটো কথা বলছে। এখনও আছে বটতলা, বটতলার বই। রবীন্দ্র সরণি-নিমতলা ঘাট রোডের মোড় থেকে ট্রামলাইন ধরে সোজা বি কে পাল অ্যাভেন্যুর দিকে এগোলে হাতের বাঁ ফুটে ‘শাঁখা দিও না ভেঙে’, ‘বস্তির মেয়ে রাধা’, ‘রোগা স্বামীর দারোগা বউ’-এর হোর্ডিং-পোস্টার-ব্যানার সম্বলিত চিৎপুর যাত্রাপাড়া আর ঠিক তার উলটো ফুটেই গোটা তিনেক বইয়ের দোকান। এখনও পাওয়া যায়— ‘পতি পরম গুরু’ (বইয়ের প্রচ্ছদ: স্বামী খড়ম দিয়ে পেটাচ্ছে, রক্তাক্ত পতিব্রতা স্ত্রী তবু স্বামীর পা ধরে আছে), ‘রতিশাস্ত্র’, ‘বশীকরণ তন্ত্রসার’, ‘হরিদাসীর গুপ্তকথা’, ‘পঞ্চমুন্ডির আসন’, ‘ভূত পেত্নী শাকচুন্নি’, গোপাল ভাঁড়, গুপ্তপ্রেস-বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত-পি এম বাগচীর পঞ্জিকা আর অসংখ্য যাত্রাপালার বই। কিছু সংগ্রহ করার থাকলে করে ফেলুন তারপর আবার ফিরে আসুন মোড়ের মাথায়। ট্রামলাইন ধরে পেরিয়ে নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ধরে এগোলে মিটার বিশেক দূরে হাতের বাঁদিকে ছোট্ট দোকান। কাচ লাগানো কাঠের শোকেস। বারকোশে সাজানো ক্ষীরের চপ, মালপোয়া, লবঙ্গলতিকা, গুটকে কচুরি, খেতে কেমন? কোনও কথা হবে না। দোকান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব রামবাগান। কলকাতার প্রাচীনতম নিষিদ্ধপল্লী। দোকানের দুই মধ্যবয়সী মালকিনের মধ্যে একজনের কাছে জেনেছিলাম নটি বিনোদিনী, মানদাসুন্দরী দাসীদের মতো কিংবদন্তী শিল্পীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এ দোকানের খাবার। চার পুরুষ ধরে চলে আসছে দোকানটি। আমি বলি কী একবার ঘুরে আসুন। ‘হরিদাসীর গুপ্তকথা’ কিনুন আর নাই কিনুন। ক্ষীরের চপ খান অথবা নাই খান— ইতিহাসকে তো ছুঁয়ে আসা যাবে।
নান কিং থেকে চৈনিক প্রাতরাশ
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট থেকে টেরিটি বাজার। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বা জীবনানন্দের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে এ এলাকা। চিনে পাড়া, সারি সারি জুতোর দোকান, চাইনিজ ডেন্টাল ক্লিনিক। এ এক অন্য কলকাতা। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিনারাও অনেকে এ জায়গা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ট্যাংরা চায়না টাউন, হংকং, তাইওয়ান। তবু যাঁরা এখনও টিকে আছেন তাঁরাই জমিয়ে রেখেছেন ব্রেকফাস্ট বাজার। টেরিটি বাজারের উলটো ফুটে পোদ্দার কোর্টের ঠিক পিছনে। রোজ ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা থেকে চালু হয়ে গুটোতে গুটোতে সাড়ে সাত আট, দু-তিন ঘণ্টার এই হাটে, ফুটপাথের ওপর রঙিন ছাতার নীচে বা খোলা আকাশের তলায় বিক্রি হচ্ছে গরম ধোঁয়া-ওঠা চিকেন-ফিশ-পর্ক স্যুপ। কন্টেনারে ভাপ ছাড়ানো মোমো, পর্ক ডাম্পলিঙ, চিকেন বান, সুইন কর্ন আর এক্লেয়ার নুডল স্যুপ। ভয়ংকর সুস্বাদু আর অবিশ্বাস্য রকম সস্তা। এখান থেকে দু’কুড়ি গজ দূরে কলকাতার আরও দুই ল্যান্ডমার্ক— পও চং আর নান কিং। প্রথমটি সসের দোকান। সস না বলে চিনা রান্নায় যা যা লাগে সেই সমস্ত রকম উপকরণ বিপণি বলাই ভাল। বয়স দেড়শো ছুঁই ছুঁই। এ দোকানে পাওয়া যায় চিলি-গার্লিক-টোম্যাটো সস আর পিউরি, চাইনিজ কুকিং ওয়াইন ও হার্বস… আরও অজস্র নাম না-জানা চিনা রান্নার উপকরণ। পও চংয়ের উলটো ফুটে একটু দূরেই ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে নান কিং। শহরের প্রথম চিনে রেস্তোরাঁ। যখন গড়পড়তা বাঙালি গণহারে চাউমিন-চিলিচিকেন খেতে শেখেনি। এলাকারই এক প্রবীণ সহনাগরিক হংম্যান বলছিলেন ঠাকুর পরিবারের অনেকেরই প্রিয় খাবার জায়গা ছিল এই নান কিং। লাল রঙের চিনা স্থাপত্যের বাড়ি। এখন ভগ্নপ্রায়। জানলা-দরজা খসে গেছে। শেষ দেখেছিলাম টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে এই ঐতিহাসিক সৌধ। শুনেছিলাম হাইরাইজ উঠবে। শহরের অনেক বাড়িকেই তো দেখি আজকাল ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সেরকম একটা কিছু ভেবে দেখা যায় না কি? সরকার বাহাদুর কী বলেন?
সুর-সরণি
ওয়েলিংটন অধুনা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে ধর্মতলার দিকে গেছে লেনিন সরণি। আমি বলতাম সুর-সরণি। আজ আর বলি না। কারণ বছর পনেরো আগেও রাস্তার দু’পাশে ছিল সারি সারি রেকর্ডের দোকান। হার্ডবোর্ড কভারের মধ্যে রেকর্ডবন্দি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়-মহম্মদ রফি-ন্যাট কিংকোল-শ্যামল মিত্র-এলভিস-বিটল্স্-গাইড-জুয়েল থিফ-ফুলেশ্বরী, আবা, ভেঞ্চারস… বাবার কেনা ফিলিপস ফাইভ থার্টি থ্রি রেকর্ড প্লেয়ারটার রসদ জোগান দিতে কতবার ফিরে ফিরে গেছি সুর সরণিতে। তারপর তো বাজারে এল ক্যাসেট-সিডি-ডিভিডি। দাঁত বসিয়ে দিল রেকর্ডের ঘাড়ে। জ্বালা সামলাতে বন্ধ হয়ে গেল একের পর এক দোকান। পুরো বেসুরো হয়ে গেল লেনিন থুড়ি সুর সরণি। দিন কয়েক আগে একবার গিয়েছিলাম ওই চত্বরে। মাত্র দুটি দোকান টিমটিম করে টিকে আছে এখনও। কথা হচ্ছিল ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে। দুটি দোকানের একটির মালিক। কত রেকর্ড কিনেছি এই দোকানে…. গীতা দত্ত… মেরা নাম জোকার… বড়লোকের বিটি লো… সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়… নীল ডায়মন্ডস ডাবল অ্যালবাম… ‘ওহ দিন অওর নহী রহা বেটা। আব চালিশ রুপিয়া কা ডিভিডি মে পাঁচশো গানা শুননে কো মিলতা। কওন আয়েগা মেরা পাস।’ বলছিলেন সত্তর-পঁচাত্তরের ইউসুফ ভাই। শূন্য দৃষ্টি, সামনে ঘোর অন্ধকার। তবু কীসের এক কুহক মায়ায় আজও দোকান খোলেন নিয়ম করে। এরপর আর কথা হয় না। চলে এসেছিলাম। কানে বাজছিল— ‘ওহ দিন অওর নেহী রহা…।’
চোরবাজার
পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার আর শেয়ালদা বউবাজারের মোড়ে। পুরনো শার্ট-প্যান্ট-ঘড়ি-জুতো-কাঠের ফার্নিচার— এরকম আরও অনেক বিকিকিনির পসরা নিয়ে এ বাজার। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যৌবনের অনেকটা স্মৃতি। আজও টাটকা। সেটা সত্তরের শেষ। আশি আসব-আসব করছে। সবাই বেকার তখন। পকেটমানির অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ, গানস অফ ন্যাভারোন আর শোলে তো সে কথা শুনবে না। অগত্যা ভরসা বন্ধুদের একজন। ধনী ব্যারিস্টারের সন্তান। বাড়িতে প্রচুর শার্ট-প্যান্ট। সব ব্র্যান্ডেড, নামী কোম্পানির— ডাবল বুল, চিরাগ দিন। যে সময়ের কথা বলছি তখনও বেয়ার, অ্যালান সলি, ভ্যান হিউজেনরা মার্কেটে খেলতে নামেনি। সে যাই হোক দুপুরবেলা বন্ধুর বাবা কোর্টে। মা ভাতঘুম। সুযোগ বুঝে গোটা পাঁচেক শার্ট-প্যান্ট আলমারি থেকে হাতিয়ে নিয়েই চলো পানসি চোরবাজার। প্রায়ান্ধকার, গলিতে গলিতে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলা সব দোকান। শোকেসে শার্ট-প্যান্ট-পালিশ করা পুরনো জুতো-ঘড়ি, এইচ এম টি-শিকো (দলের এক অভিজ্ঞ সদস্যের মতে ওগুলো সব টানা অর্থাৎ চুরির মাল)। ওখানকার সব মালই চোরাই কিনা জানি না তবে আমাদেরগুলো যে চৌর্যবৃত্তির দ্বারা সংগৃহীত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। ফ্রিকোয়েন্ট সাপ্লায়ার হওয়ার ফলে দামও দিত মন্দ না। শার্ট পিছু পঁচিশ থেকে তিরিশ। প্যান্ট চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। সে বড় সস্তা গন্ডার বাজার ছিল। গ্লোব নিউ এম্পায়ারে ফ্রন্ট স্টল পঁচাত্তর পয়সা। নিজামের রোল এক টাকা কুড়ি। গোল্ডেন ঈগল বিয়ার সাড়ে সাত টাকা। ময়দানে ফুটবলের টিকিট সত্তর পয়সা। ফলে ব্যাবসাপাতি সেরে বাজার থেকে বেরিয়ে আমরাই কে আর বিড়লাই বা কে?… আজ চিরাগ দিন-ডাবল বুল নেই, নেই সেই বন্ধুদের অভিযান। চোরবাজার কিন্তু আজও রয়ে গেছে এক উদ্দাম সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে।
ঋণ স্বীকার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির সুমন, নিখিলচন্দ্র সেন প্রণীত ‘ব্যায়লার কথা’ আর অন্তর্জাল।
১৭. ঝি-স্পেশাল
প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ করছি প্রতিবেদনের এরকম একটা শিরোনাম বেছে নেওয়ার জন্য। কোনও পেশা সম্পর্কে ন্যূনতম অশ্রদ্ধা বা অসম্মানজনক মন্তব্য করার কিছুমাত্র ইচ্ছেও নেই মনের মধ্যে। কিন্তু প্রত্যেকদিন আমরা মানে কসবা, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়া যখন বিছানায় ঘুমে কাদা, সেই কাকভোরে সূর্যের আলো ঠিকঠাক ফোটার আগেই বেশ কয়েকটা ট্রেন ছাড়ে দক্ষিণ লাইনের ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর— এইসব স্টেশনগুলো থেকে। স্থানীয় মানুষ তো বটেই, এ শহরের হাজার হাজার ফেলাটবাড়ির গিন্নিমারাও অনেকেই ওই নামে ডাকেন ট্রেনগুলোকে— ‘ঝি স্পেশাল’। এই ট্রেনগুলোই শহরে ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর জিয়নকাঠি। সংসার নামক দুই অথবা তিনজনের মাইক্রো ফ্যামিলিগুলোকে সচল রাখার জাদুদণ্ড। হাজার হাজার হাড়হাভাতে গরিবগুর্বো ঘরের মেয়ে বউদের প্রতিদিন বাঘাযতীন, গড়িয়া, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, পার্কসার্কাস স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উগরে দেয় ডাউন ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, ডায়মন্ডহারবার লোকাল। এরা সবাই পরিচারিকা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঝাড়ু, পোঁছা, রান্নাবান্নার কাজ করেন শহরে পাঁচ বাবুর বাড়িতে। মোটামুটি সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে কাজে লেগে পড়া। মাঝখানে সময় সুযোগ পেলে বসে বসেই একটু ঝিমিয়ে নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ির বেসমেন্ট অথবা দিদিমণিদের ড্রইংরুমের মেঝেয়। দুপুরে লাঞ্চ বলতে জোটে বাবুদের বাড়ির বাড়তি এবং বাসি এঁটোকাটা অথবা মোড়ের সস্তা দোকানের চা-লেড়ো বিস্কুট নইলে পেটা পরোটা, সঙ্গে ট্যালটেলে ঘুগনি নয়তো আলুর দম। অতঃপর ফের আড়াইটে থেকে সেকেন্ড শিফটের কাজ শুরু করে ফেরার ট্রেন ধরার জন্য মরণপণ দৌড় লাগাতে লাগাতে সেই সন্ধে ছটা-সাড়ে ছটা। ট্রেনে খিদে পেলে ‘মোস্ট পপুলার কুইজিন; ফেরিওয়ালার কাঁচা পাউরুটি আর স্যাকারিন মেশানো সোডাপানি— ‘ফটাস জল।’ বিক্রি হয় নামী পানীয় কোম্পানিগুলোর পুরনো, লেভেল চটে যাওয়া বোতলে ভরে। পাওয়া যায় একমাত্র সাউথ লাইনের ট্রেনেই। প্রতিবারই ওপেনার দিয়ে খোলার সময় ‘ফট’ করে ধানিপটকা ফাটার মতো আওয়াজ হয় একটা। আওয়াজ না হলে কাজের মাসিরা তো বটেই ঝাঁকামুটে, সবজিওয়ালা… কেউই খাবেন না। তাই শব্দটা হওয়া চাই-ই চাই। পাউরুটি-ফটাস জল ছাড়াও লোকাল ট্রেনের আরেকটা চালু এবং জনপ্রিয় খাবার মুড়ি-ঘুগনি। ঠোঙা অথবা থার্মোকলের বাটিতে মুড়ির ওপর একহাতা ঘুগনি ঢেলে নেড়েচেড়ে ছড়িয়ে দেওয়া পেঁয়াজ-লঙ্কাকুচি, সামান্য মশলা আর বিটনুন। সঙ্গে এক চামচ তেঁতুলজল। মুড়ি ঘুগনির ঘ্যাঁট, এটাই কাজের মাসিদের ‘হেভি টিফিন’, অনেক সময় রাতের ডিনারও বটে। ক্লান্ত শরীরে টলতে টলতে বাড়ি ফিরেও রেহাই নেই। ফেরামাত্র সংসারের চুলো জ্বালার উদোম হাড়ভাঙা খাটনি। সঙ্গে চোলাইয়ের ঠেক থেকে ফেরা মাতাল এবং বেশির ভাগ সময় বেকার অকর্মণ্য স্বামীর রামঠ্যাঙানি। এসব সামলে সুযোগ মিললে ঘণ্টা চার-পাঁচেক একটু চোখ বুজে নেওয়া। ফের ভোর থাকতে উঠে সেই ঝি-স্পেশাল ধরতে দৌড়োনো। সেই একই ক্লান্তিকর, একঘেয়ে রুটিন রোজ। দুগ্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, দোল, দেয়ালি, ইদ, বড়দিন, পরব, পার্বণ… কোনও ছুটিছাটা নেই। একমাত্র কঠিন অসুখবিসুখ ছাড়া। সেখানেও শত অভিযোগ ফেলাটবাড়ির বউদিমণিদের। নিশ্চয়ই অসুখের নাম করে ডুব মেরেছে। বাড়িতে বসে হাওয়া লাগাচ্ছে গায়। এবার মাইনে কাটতেই হবে। রোজ সন্ধের মুখে যদি যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের মুখে দাঁড়ান, দেখতে পাবেন শয়ে শয়ে কাজের মেয়ে পিটি উষা বা পিঙ্কি হালদারের স্পিডে দৌড়োচ্ছেন ছটা পঁচিশের ক্যানিং বা সাতটা পাঁচের লক্ষ্মী (লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল) ধরতে। বাড়ি ফেরার সময় প্রচণ্ড তাড়া। কাজে আসার সময় গতিটা কিন্তু তুলনামূলকভাবে রিল্যাক্সড। চার-পাঁচজনের ছোট ছোট দল বেঁধে গল্পগাছা করতে করতে হেঁটে যাওয়া। হাসিঠাট্টা, নিন্দেমন্দ। গল্পের বিষয়ও একাধিক। বাবুদের বাড়ির হাঁড়ির খবর চালাচালি… ‘দাদাবাবু আপিস বেইরে গেলে দুপুরব্যালা অমুক বউদিমণির ঘরে ছোকরাপানা একটা লোক আসে।’… ‘কদিন আগে বউদি বাপের বাড়ি গেসলো সাতদিনের জন্য, দাদাবাবু ফেলাটে একা পেয়ে’… ‘ঘরের মানুষটা, মা-মেগোর ব্যাটা একদম হারামি। কাজকম্মো কিচ্ছুটি করে না। দিনরাত চুল্লু টেনে এসে টাকা চায়। না দিলে মেরে পাটপাট করে। নেতাই খুব ভাল। শ্যালদার ফুটপাতে সবজির ডালা লাগায়। একই টেরেনে আসে। বারবার বলেছে চলে আয় সনকা। ও সেগোমারানির ঘর আর করিস না। আমি তোকে রানি করে রাখব…কিন্তু কোলের দুটোকে ফেলে যাওয়া যাচ্ছে না…।’ ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায় না এসে পড়া অবধি চলতেই থাকে এই সুখদুঃখের বারোমাস্যা। একটার পর একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। একটু একটু করে ছোট হতে থাকে দলটা। একসময় আর কেউ নেই। সব ফেলাটবাড়ির গর্ভে। আর ফ্ল্যাটবাড়ি? সারাদিন ধরে সমস্তটুকু নিঙড়ে নিয়ে সন্ধের মুখে ছুড়ে ফেলে দেবে রাস্তায়। যাতে ভোরবেলার ঝি স্পেশালটা ঠিক টাইমে ধরতে পারে সনকারা।
১৮. তাঁরা বৃদ্ধা হলেন
“বুইলি বাবু, সে এয়চিল বটে কাস্টমার। পালে পালে, যুদ্ধের সময়, নেঙড়ো, ইয়া ল্যাম্পপোস্টের মতো লম্বা, অ্যায়সা বুকের আড়া। গলার আওয়াজ সে কী গুমগুমে। য্যানো চিড়িয়াখানায় বাঘ হুমকোচ্চে। সে কবেকার কতা। আমাদের তকন সোমত্থ কাঁচা বয়েস। তারপর থেকে এই অ্যাদ্দিনে কত কাস্টমার এলো গ্যালো কিন্তু সেই নেঙড়োদের মতো একটাকেও আর দেকতে পেলুম না।”
রামবাগানের ভীষণ পুরনো বাড়িটার ছাদ। ছাদে শুকিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়া গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে বসা বুড়িদি। বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। সামনে রাখা ওল্ড মঙ্কের আধখালি গেলাস। প্লেটে চানাচুর, শশা, পেঁয়াজ। বুড়িদিকে ঘিরে গোল হয়ে বসা আমরা দু’-চারজন। আধখাওয়া গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছোট একটা চুমুক দিল বুড়িদি। ফের শুরু করল— “কিন্তু আপশোস একটাই, বুইলি। এই যে মিনসেগুলো অ্যাতোবার আমাদের ঘরে এলো, বসলো কিন্তু এই গোটা রামবাগান-সোনাগাছি…কোনও আঁটকুড়ির পেটে একটা বাচ্চা দিয়ে গ্যালো না!” হতাশা ঝরে পড়ল বুড়িদির গলায়।
আমি। যৌনকর্মীদের নিজস্ব একটি সামাজিক সংগঠনের ‘অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং’ অর্থাৎ পাচার বিরোধী প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর। কিছুদিন হল জয়েন করেছি। এলাকার ঘাঁতঘোঁত জানি না ভাল করে, তার ওপর বহিরাগতও বটে। ফস করে একটা আনকা প্রশ্ন করে বসলাম, ‘আচ্ছা বুড়িদি, এই নেঙড়োরা কারা?” একে তো পেটে বড় বড় তিনটে পাটিয়ালা পেগ। তার ওপর এরকম নির্বোধের মতো প্রশ্ন। ভয়ংকর বিরক্তি আর হতাশা মেশানো চোখে আমার দিকে তাকালেন, যার একটাই মানে হতে পারে— এটা কে রে? তারপর গলায় বিরক্তিটা ঝরে পড়ল—“আরে মুখ্যু, এটা বুইলিনি? সেই যে যুদ্ধ করতে এয়চিলো সব… যকন হাতীবাগানে জাপানী বোম পড়লো… ইয়া ধুমসো ধুমসো আবলুস কালো চ্যায়রা…।”
এতক্ষণে হৃদয়ঙ্গম হল। টমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শহরে আসা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান সৈন্যদল। বুড়িদির অননুকরণীয় অ্যাকসেন্টে যারা নিগ্রো থেকে ‘নেঙড়ো’তে পরিণত হয়েছে।
প্রজেক্টের কাজটা শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হল। অনেকদিন যাওয়া হয়নি ওদিকটায়। জানি না অসাধারণ সুরেলা গলায় ইন্দুবালা, আঙুরবালা, ছোটটেঁপির ঠুমরি-গজল আর গর্ভে বিশালদেহী, প্রবল বলশালী, ঘোর কৃষ্ণকায় অনার্য সন্তান ধারণ না করতে পারার আক্ষেপ নিয়ে বুড়িদি আজও টিকে আছেন কি না।
“বোঝলেন দাদা, এইবার পোলাডার একডা বিয়া দিমু। বয়স তো হইলো। আঠাইশ ছাড়াইসে এই বৈশাখে।” পাশে দাঁড়ানো প্রতিমাদি বলে চলেছেন ছেলের কথা। প্রতিমাদি পঞ্চাশোর্ধ। কালীঘাট লাইনপাড়ায় তবলাগলিতে একচিলতে ঘুপচি ঘর। পুরনো যৌনকর্মী। সেই কবে এঘাট, ওঘাট, বহুঘাটের জল খেয়ে ভাসতে ভাসতে এসে উঠেছিলেন এই এঁদোখাল থুড়ি বুড়িগঙ্গার পাড়ে। এখন লাইন ছেড়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বাপি। কালীঘাটের গলিতে বেড়ে ওঠা জবালার সন্তান। ওরকম একটা পরিবেশে বড় হয়েও মদ গাঁজা তো দুরস্থান, একটা সুপুরির কুচিও মুখে তোলেনি কোনওদিন। পাড়ায় কখনও কেউ একটা মুখখারাপ করতে শোনেনি ওকে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলত। পজিশন মিডফিল্ডার। বাঁ পায়ে দুরন্ত সোয়ার্ভিং কিক। বাঁক খেয়ে ঢুকে যেত নেটে। ঠিক রোনাল্ডিনহোর মতো। স্বপ্ন দেখত রোনাল্ডিনহো হবে। সাও-পাওলার ঘিঞ্জি বস্তি থেকে উঠে গিয়ে স্বপ্নের ব্রাজিল টিমে। ভাবা যায়! রোনাল্ডিনহো পারলে বাপি পারবে না কেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, তারপর ইন্ডিয়ার জার্সি… সব হবে একদিন। হবেই হবে।
রোজ কাকভোরে উঠে জার্সি, বুট কাঁধে লেকের মাঠে দৌড়োত বাপি। বাবুদা-খোকনদাদের কোচিং ক্যাম্পে। ওরাও ভরসা দিতেন খুব— “তোর হবে, হবেই। খেলাটা কিন্তু ছাড়বি না কিছুতেই। যত কষ্টই হোক।” তা সেই অ্যাতো কষ্টের মধ্যেও কিন্তু পাড়ার স্কুলে মাধ্যমিকটা পাস করে ফেলেছিল বাপি। কিন্তু ওই যে বলে… তরতরিয়ে ছুটতে থাকা রোনাল্ডিনহো হবার স্বপ্নটায় চিড় খেয়ে গেল একদিন। লেক মাঠে ইন্টার স্কুলে টুর্নামেন্টে অপোনেন্টের মারকুটে ডিফেন্ডারের লঙ স্টাড বুটের একটা সলিড চার্জ। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে তিন টুকরো বাঁ পায়ের সিনবোন। সঙ্গে সেই কোন ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা স্বপ্নটাও, খতম ফুটবল কেরিয়ার। ওই সিনেমার ভাষায় যাকে বলে— ‘দ্য এন্ড!’
বাপি এখন বাঁ-পাটা সামান্য টেনে টেনে হাঁটে। দিনের বেলা যৌনকর্মীদের স্বশাসিত সংস্থায় অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করে। আর সন্ধের পর পেঁকো দুর্গন্ধ উঠে আসা খালপাড়ের নাইটস্কুলে পাড়ার পুঁচকেগুলোকে পড়ায়। ওর মধ্যেই কোনটার পায়ে বল একটু বেশি রকম কথা শুনেছে দেখলেই ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয় লেকের মাঠে। বাবুদাদের কোচিং ক্যাম্পে। নিজেও পৌঁছে যায় মাঝেসাঝে। ছুটিছাটার দিনে। সস্তা কেরোসিন কাঠের আলমারি থেকে নামিয়ে আনা রং জ্বলে যাওয়া মলিন ট্রাকস্যুট আর তাপ্পি মারা স্পোর্টস সু। তিন টুকরো হয়ে যাওয়া সিনবোন কেড়ে নিয়েছে বাঁ-পায়ের বাঁক খাওয়ানো ব্যানানা কিক আর রোনাল্ডিনহো হয়ে ওঠার স্বপ্ন। কিন্তু কাড়তে পাড়েনি সবসময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ভারী মিষ্টি হাসিটা আর উজ্জ্বল দুটো চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি এখন মাঝমাঠে। বল নিয়ে দৌড়োচ্ছে কুচোকাঁচাগুলো। ঘামে ভেজা মুখগুলো চকচক করছে ভোরবেলার রোদে। ময়দান মার্কেটের সস্তা জার্সি লেপটে রয়েছে গায়। সেদিকে তাকিয়ে বাপির উজ্জ্বল চোখ দুটো উজ্জ্বলতর। “আমার হয়নি, ওদের হবে না? হবেই। কী বলেন দাদা?”
সেই কবে পরনে জিন্স, একতারা দোতারার বদলে হাতে গিটার মানুষটি গেয়ে উঠেছিলেন ‘আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু-আনা।’ সত্যিই তো, বাকি দু-আনা পেয়ে যাওয়ার আশা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে বাপি।
আর এদিকে প্রতিমাদি। স্বপ্নভঙ্গের পরেও স্বপ্ন দেখে চলেছেন। “বাপিডার বিয়া দিমু। বৌমা আইবো। নাতিপুতি হইবো। আমারে ডাকবো—‘ঠাম্মা, ঠাম্মা,’ ঘরে চিল্লাচিল্লি, দুষ্টামি… হেইসব না হইলে হয়? আপনেই কয়েন। ও দাদা, একডু বোঝান না পোলাডারে। হ্যায় তো ঘাড়ই পাতে না। ঘেঁটি শক্ত কইরা থাকে। কয় ‘ওসব হইবোখান।’ আপনে দ্যাহেন না একডু। যদি…।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা সবাই জীবনে কখনও না কখনও, কোথাও না কোথাও অন্তত একবারের জন্য হলেও প্রতিমাদিদের দেখা পেয়েছেন। না পেলেও হতাশ হবেন না কারণ প্রতিমাদিরা সর্বত্র বিরাজমান। শুধু চোখকান খোলা রেখে খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা।
“দ্যাকো বাপু, রোজ গন্ডা গন্ডা মানুষ চড়িয়ে খাই। তোমার কতবাত্তা শুনলে বোঝা যায় তুমি ঠিক আর পাঁচজনের মতো নও।” নীলমণি মিত্র লেনে প্রজেক্ট সোনাগাছির অফিসে বসে কথাটা আমার উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন মিনুদি। কথাটা আগেও দু’-চারবার বলেছেন, গুরুত্ব দিইনি তেমন। এবার আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “তা হলে কার মতো মিনুদি?” চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে দেখে নিলেন মিনুদি। একসময় সোনাগাছি কাঁপানো ডাকসাইটে সুন্দরী। যৌবন থাকতে থাকতেই ভালমতন গুছিয়েগাছিয়ে নিয়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ষাট টপকেছেন বছর পাঁচেক হল। বর্তমানে সংস্থায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ভালবেসেই কাজটা করেন। দুপুরবেলার কর্মব্যস্ত প্রজেক্ট অফিস। লোকজনের আনাগোনা। আমার প্রশ্নের জবাবে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, “সে একেনে নয়, আমার ফেলাটে এসো একদিন। সব বলবোখন।” কথাকটা বলেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন মিনুদি। আমার কৌতূহলটা বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
দিনতিনেক বাদে অফিসের কাজ সেরে পৌঁছে গেছিলাম অবিনাশ কবিরাজ রোয়ে মিনুদির ফ্ল্যাটে। সচ্ছলতার ছাপ গোটা ঘর জুড়ে। “বসো” সামনে সোফাটার দিকে আঙুল দেখালেন মিনুদি। “এবার বলো, আমি কার মতো।” বাঁধভাঙা কৌতূহল প্রশ্ন হয়ে উঠে এল আমার গলায়।
বলেছিলেন মিনুদি। সে অনেক, অনেককালের কথা। একাত্তর সাল। শ্রাবণ মাস। ঘোর বর্ষা। বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে অবিনাশ কবিরাজ রো, দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট, ইমামবক্স লেন… গোটা সোনাগাছি। সেই দুর্যোগের রাতে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ। গোটা চত্বর জুড়ে সার্চলাইটের আলো, হাঁকডাক আর ভারী বুটের দাপাদাপি। ঠিক তখনই বন্ধ ঘরের দরজায় ‘খুট, খুট’। দরজা খুলেছিলেন সন্ত্রস্ত মিনুদি। না, পুলিশ নয়। অন্য একজন। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। একগাল দাড়ি। বড় বড় দুটো চোখ। মিনুদিরই বয়েসি। পরনের পাঞ্জাবি-পাজামা ভিজে চুপচুপে। কাঁধে ঝোলাব্যাগ। দৌড়জনিত পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে বেদম। হাপরের মতো ওঠানামা করছে রোগা রোগা বুকের খাঁচাটা। যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন মিনুদি। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন ছেলেটাকে। সোজা খাটের তলাটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, “চুপচাপ ঢুকে যাও। নীচে!”
গোটা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ব্যর্থমনোরথ পুলিশবাহিনী ফিরে যাবার পরও দিন-তিনে