- বইয়ের নামঃ আরেকটা কলকাতা
- লেখকের নামঃ সুপ্রিয় চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০. ভূমিকা – আরেকটা কলকাতা : সুপ্রিয় চৌধুরী
রসিকজোড় শ্রীসত্যবান মিত্র ও সুন্দর মুখোপাধ্যায়কে
ভূমিকা
এ বইয়ের বিষয় অথবা উপজীব্য— কলকাতা। শিরোনামেই সেটা স্পষ্ট। তবে কলকাতা কিন্তু একটু অন্যধরনের। যে-কোনও লেখার পিছনেই একটা পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। এ বইয়েরও আছে। কীভাবে এবং কেন বইটি লেখা হল, সে প্রসঙ্গেই সামান্য দু-চারটি কথা বলি এবার। সেই ছেলেবেলা থেকেই চিরকেলে অবাধ্য আমি। একইসঙ্গে বেশ খানিকটা বাউন্ডুলেও বটে। অক্লান্ত আড্ডাবাজ বলে বন্ধুমহলে খ্যাতি এবং পরিবারে কুখ্যাতি আছে। সঙ্গে খানিকটা ছিটগ্রস্থের দুর্নামও। তবু এরই মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন কোথায় ভীষণরকম একটা একা হয়ে যাই নিজেই নিজের মধ্যে। আর যখনই সেটা ঘটেছে, নরেনদার চায়ের দোকান, রক-চাতালের আড্ডা, তুরীয় আনন্দের আসর, নিজের অথবা সংসারের কাজকম্মো ফেলেছেড়ে ঘোরলাগা উদ্ভ্রান্তের মতো হঠাৎ হঠাৎই নেমে পড়ছি রাস্তায়। ঘুরে বেড়িয়েছি কারণে-অকারণে আমার এই ভীষণ চেনা অথচ অচেনা আর প্রিয় শহরটার ফুটপাতে, অলিতেগলিতে। বহু জানা-অজানা, উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে, কিঞ্চিৎ বেয়ারা আর বিপদজনক সব রঙরুটে। নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। এই ঘুরচক্করের ঘুরপাকে পাক খেতে খেতেই চোখ আটকে গেছে এমন অনেক কিছুতে যা সাধারণত কেজো, একইসঙ্গে সদাব্যস্ত সহনাগরিকরা হয়তো খানিকটা আলগোছে দেখেন অথবা দেখেও দেখেন না। সেসবেরই বেশ কিছুটা অংশ লেখা হয়ে উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যক্তিজীবন অথবা কর্মসূত্রে লব্ধ কিছু অভিজ্ঞতা এবং উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাবলি। লেখক লিখেই খালাস, পড়ে কেমন লাগল সে মতামত একান্তভাবেই পাঠকের। সফল কদ্দুর হয়েছি অথবা আদৌ হয়েছি কি না সে বিষয়েও মন্তব্যের অধিকারী একমাত্র তারাই।
সবশেষে জানাই, বইটিতে আমার লেখাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে অন্য প্রমা, প্রাত্যহিক খবর, প্রতীচী, দুর্বার ভাবনা, দুকূল, ৩৬৫ দিন রবি সংখ্যা, বাংলা LIVE.Com, আলতামিরার মতো একাধিক পত্র-পত্রিকায়। আমি কৃতার্থ আমার মতো একজন অজ্ঞাতকুলশীল কলমচিকে তাঁদের পত্র-পত্রিকায় লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁরা। ধন্যবাদ আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃপক্ষকে তাঁরা আমার লেখাগুলিকে বই আকারে প্রকাশের জন্য মনোনীত করেছেন। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। ঋণের শেষ নেই আরেকজনের কাছেও। তিনি কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষ মহাশয়। তাঁর কবিতা ‘বাবুমশাই’-এর একটি লাইন এ বইয়ের শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন এই অধম প্রতিবেদককে। সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল তাঁর উদ্দেশে।
—লেখক
০১. কালো কলকাতা
উনিশশো ছেচল্লিশ, ষোলোই আগস্ট, মহম্মদ আলি জিন্নার ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ নীতিকে মান্যতা দিয়ে কলকাতার বুকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লিগ প্রধান সঈদ সুরাবর্দী। উদ্দেশ্য একটাই ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে কলকাতার অন্তর্ভুক্তি তার মধ্যে অবশ্যম্ভাবী। জিন্না, লিয়াকৎ আলি, নেহরুজি, সর্দার প্যাটেলরা রাষ্ট্রক্ষমতা নামক কেকের ভাগ বাঁটোয়ারার স্বপ্নে মশগুল। গাঁধীজি, কালাম আজাদ, বাদশা খানের মতো নেতারা ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন অসহায় দর্শকে আর ইংরেজরা তো চাইছিলই— ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। এর ফল যা হবার তাই হল। ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ থেকে কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যা পরবর্তীতে ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে কুখ্যাত। শুধু কলকাতা নয় ক্রমে ক্রমে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার বরিশাল, নোয়াখালি এবং অচিরেই রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অসম এবং পাঞ্জাবে। হাজারে হাজারে লাশ পড়ল। ছড়িয়ে পচে রইল রাস্তায়। অলিতে গলিতে। সরাসরি সরকারি মদতে কলকাতা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল চিৎপুর কলুটোলার মীনা পেশোয়ারি, হাফিজ খানদের মতো গুন্ডার দল। এরা মূলত পাঠান। আদি নিবাস আফগানিস্তান। প্রাথমিক স্তরে হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন বেশি। ঠিক এই সময় মূলত মধ্য কলকাতার একদল যুবক নিজেদের মতো করে সংগঠিত হচ্ছিল এর বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ক্রিক রো-র ভানু বোস, প্রভাত, সত্যেন, বুলু, জগা বোস। জেলেপাড়ার গোবর্ধন বাগ, চিত্ত বাগ, চন্দননগরের রাম চ্যাটার্জি। এদের নেতৃত্বে বউবাজারের গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় যিনি পরবর্তীতে গোপাল পাঁঠা নামে বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) হন। মীনা পেশোয়ারিদের ‘পাঠান গ্যাং’ এদের সামনে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ব্যাপারটা আর একতরফা থাকে না মোটেই। ফলে হত্যা-পালটা হত্যা চলতেই থাকে। এদিকে প্রায় দু’মাস ধরে চলতে থাকা এই দাঙ্গায় লক্ষাধিক মানুষ খুন হয়ে যান গোটা দেশ জুড়ে। বেলেঘাটায় স্বয়ং গাঁধীজি অনশনে বসেন এই নারকীয় গণহত্যার প্রতিবাদে। অবশেষে দাঙ্গা থামে। এর ঠিক এক বছর বাদে দেশ স্বাধীন হয়, তবে দু’টুকরো হয়ে। যার নিট ফল ভারত ও পাকিস্তান। রাজনীতির ভাগ বাঁটোয়ারা শেষ। সুরাবর্দীর স্বপ্ন সফল হয়নি। মানে কলকাতা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কেন্দ্র এবং রাজ্যে নব গঠিত কংগ্রেস সরকার।