- বইয়ের নামঃ একটি পেরেকের কাহিনী
- লেখকের নামঃসাগরময় ঘোষ
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বিরাট মহীরুহের অকস্মাৎ পতন
মা-কে
.
স্বীকৃতি
এই কাহিনী রচনার কৃতিত্ব যদি কিছু থাকে তা কথক বিশুদার প্রাপ্য, অকৃতিত্বটুকু লেখকের। বিধানচন্দ্রের জীবনের কিছু ঘটনা উদ্ধৃতির জন্য কয়েকটি সংবাদপত্র, বিশেষ করে ‘দেশ’ পত্রিকার ‘সাংবাদিক’-এর কাছে লেখক ঋণী। ১৩৬১ বঙ্গাব্দের শারদীয় ‘জলসা’য় এ-কাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ তারই পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রুপ।
.
॥ এক ॥
উনিশ শ বাষট্টি সাল, পয়লা জুলাই।
পশ্চিমবাংলার বুকের উপর দিয়ে গত পনেরো বছর যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে সেই ঝড়ে বিরাট মহীরুহের অকস্মাৎ পতন ঘটল।
পয়লা জুলাই, রবিবার। সূর্য তখন মাথার উপর। নির্মেঘ নীলাকাশ। বিনা মেঘে বজ্রপাত যদিও হয়নি কিন্তু বিদ্যুতের চেয়েও সূক্ষ্ম এক অদৃশ্য শক্তিতরঙ্গে প্রচারিত একটি সংবাদে কলকাতা মহানগরী স্তম্ভিত।
নতুন বাংলার রূপকার কর্মযোগী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় অপ্রত্যাশিত ভাবে মৃত্যুর কোলে চির বিশ্রাম নিলেন তাঁরই জন্মজয়ন্তী উৎসবের দিনে। তড়িতাহত হওয়ার মতই তীব্র অতর্কিত সে সংবাদের আঘাতে অসংখ্য সমস্যাপীড়িত দেশকে এক মুহূর্তে এক অখণ্ড সত্তায় বিচলিত হয়ে উঠতে দেখলাম। এই মহীরুহের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত ছিল আঘাত-সংঘাতে জর্জরিত পশ্চিম বাংলার সাড়ে তিন কোটি নরনারী। আজ তারা আশ্রয়হীন, শোকবিহবল। তাদের নীরব ক্রন্দন আমি শুনেছি, আমি দেখেছি মহানগরীর উদ্বেল জনতাকে শান্ত হয়ে নম্র হয়ে তাদের মহানায়ককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
পরদিন সকালে বিষণ্ণ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ডাঃ রায়ের কর্মজীবনের ঘটনাবলী ও আলোকচিত্র দেখতে দেখতে একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরছে—এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি আমার শেষ প্রণতি কী ভাবে নিবেদন করব। জনতার ভিড়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেই আমি তৃপ্তি পেতাম। কিন্তু ভিড় আমি চিরকাল ভয় করি। কোলাহল থেকে দূরে থাকাই আমার স্বভাব।
সেদিনের প্রায় সবগুলি দৈনিক সংবাদপত্র আমার সামনে খোলা। বাংলার এই মহানায়কের বিদায়-দিনে প্রত্যেকটি কাগজের প্রথম পাতায় অষ্টকলমব্যাপী হেড লাইনে লেখা হয়েছে—
“নবীন বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্রের তিরোধান”
“অমিতবীর্য প্রবীণতম মহানায়কের ত্যাগ ও কর্মদীপ্ত জীবনের অবসান…”
“জন্মদিন মৃত্যুদিন; একাসনে দোঁহে বসিয়াছে, দুই আলো মুখোমুখি মিলেছে জীবন প্রান্তে।”
তাঁর আবির্ভাব-দিনেও এমনি ‘হেড লাইন’ নিয়েই তিনি এসেছিলেন। বাংলার রাজনৈতিক জীবনে প্রথম অবতীর্ণ হলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ১৯২৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর।
আনন্দবাজার পত্রিকায় হেড লাইন বেরোলোরঃ
“নির্বাচনের ফলাফল
মন্ত্রীদের কেল্লাফতে
সুরেন্দ্রনাথ কুপোকাত…”
সারা ভারতের সংবাদপত্রেই সেদিন ডাক্তার বিধানচন্দ্র ছিলেন এক বিস্ময়কর শ্রেষ্ঠ সংবাদ। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাব্যাপী বড় বড় অক্ষরে ছিল চারটি লাইনঃ
“Sri Surendranath Banerjee Defeated.
An object lesson to Supporters of Bureaucracy.
Dr. Bidhanchandra Roy Elected.
People’s Victory in Barrackpore.”
ব্যারাকপুরে স্বরাজ্য দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিধানচন্দ্র সেদিন যাঁকে পরাজিত করে প্রথম আইনসভায় প্রবেশ করেছিলেন তিনি ছিলেন বাংলার মুকুটহীন রাজা রাষ্ট্রগুরু স্যার সুরেন্দ্রনাথ।
রেডিওটা খোলা। ধারাবিবরণীর ঘোষক আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলে চলেছেন শোকযাত্রার মর্মস্পর্শী দৃশ্য। রাস্তায় রাস্তায় উত্তাল জনসমুদ্র, ফুলের তোড়া আর ফুলের মালা শবাধারকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বেতার ঘোষণায় বলা হল বেলা ১১টায় শবাধার রাসবিহারী অ্যাভিনিউর মোড়ে এসে পৌঁছবে। বাড়ির সবাই চলে গেছে। এক পরিচিত ভদ্রলোকের গাড়ি-বারান্দার ছাতে দাঁড়িয়ে তারা ডাঃ রায়কে শেষ দেখা দেখবে। একা বাড়িতে বসে খবরের কাগজের পাতাগুলির উপর চোখ বুলিয়ে চলেছি। বিদায় নেবার আগের দিনের একটি কৌতুককর ঘটনার বিবরণ বেরিয়েছে সংবাদপত্রে।
শনিবার রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু এসেছেন অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে। তিনি বললেন—‘কাল আপনার জন্মদিন, অনেক লোকের ভিড় হবে। আপনি কিন্তু কারও সঙ্গে দেখা করবেন না আবার।’
—‘কেন?’ কারণ জানতে চাইলেন বিধানচন্দ্র।
—‘কারণ, স্বাস্থ্য।’ রাজ্যপাল ধীরস্বরে জবাব দিলেন।
—‘আপত্তি যদি স্বাস্থ্যগত কারণেই হয় তবে সম্ভবত আমি তোমার চেয়ে যোগ্যতর বিচারক। নয় কি?’ ডাঃ রায় লঘুভাবে বিতর্কের উদ্বোধন করলেন। শ্ৰীমতী নাইডু জানেন, তর্কে ডাঃ রায়ের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাঃ রায়ের ভ্রাতুস্পুত্র সুবিমল রায়।
রাজ্যপাল অসহায়ের মতো তাঁর দিকে তাকালেন।
—‘আপনি তো একজন মস্তবড় ব্যারিস্টার মিঃ রায়। আচ্ছা আপনিই বলুন এ-বিষয়ে আমাদের শাসনতন্ত্র কি বলে? কোনো রাজ্যের চীফ মিনিস্টার কি সে রাজ্যের গভর্নরের আদেশ অমান্য করতে পারেন?’
এবার হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন ডাঃ রায়। হাসতে হাসতে বললেন— ‘আচ্ছা, তাই হবে। মাননীয় রাজ্যপাল যখন আদেশ করছেন—’