“হে ক্ষীণ কটি এ তিন অনে নটরাজে শুধু রাজে
এ হিমা প্রতিমা আমারে বরিয়া নাহি যেন মরে লাজে।”
শব্নম আবার সেই প্রথম দর্শনের দীর্ঘ স্মিতহাস্য দিয়ে ঘরের ভিতর চন্দ্রালোকে এনে শুধালে, আমার ‘নূরু-ই-চশম্-আঁখির আভা—কি ভাবছ?’
আমি বললুম, গিরিরাজ হিন্দুকুশকে বলছিলুম তোমার মঙ্গল কামনা করতে।
‘সে কি বুৎ-পরস্তী প্রতিমাপূজার শামিল নয়।‘
আলবৎ নয়। আমি যখন আমার বন্ধুকে বলি, আমার মঙ্গল কামনা কর, তখন কি আমি তার পূজো করি? আমি যখন গিয়াসউদ্দীন চিরাগ-দিল্লীর কবরে গিয়ে বলি, “হে খাজা তুমি আমার মঙ্গল কামনা কর,” তখন কি আমি তাকে খুদা বানাই? অজ্ঞজন যখন মনে করে এই গোরের কোন অলৌকিক শক্তি আছে, অর্থাৎ গোরেই আল্লার অংশ বিরাজ করছে তখনই হয় বুৎ-পরন্তী।
আপন মনে একটু হেসে নিয়ে বললাম, ‘আর এই বুৎ-পরন্তী আরম্ভ হয় তোমাদের দেশেই প্রথম। আজ যে অঞ্চলের নাম জালালাবাদ তারই নাম সংস্কৃতে গান্ধার-’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। মনে পড়েছে। এখনও জালালাবাদের বকরী-ছাগলকে কাবুল বাজারে বলে বুজ-ই গান্ধারী। তার পর বল।
আলেকজাণ্ডারের গ্রীক সৈন্যরা যখন সেখানে থাকার ফলে বৌদ্ধ হয়ে গেল তখন তারাই সর্বপ্রথম গ্রীক দেব-দেবীর অনুকরণে বুদ্ধের মূর্তি গড়ে তাঁর পূজো করতে লাগল -ভারতবর্ষের আর সর্বত্র তখনও বুদ্ধের মূর্তি গড়া কড়া মানা, এমন কি বুদ্ধকে অলৌকিক শক্তির আধার রূপে ধারণা করে তাকে আল্লার আসনে বসানো বৌদ্ধদের কল্পনার বাইরে। সেই গ্রীক বৌদ্ধমূর্তি হিন্দুস্থানে ছড়িয়ে পড়বার পর, পরবর্তী যুগে সেই আর্টের নাম হল গান্ধার আর্ট।
ভারী খুশী হয়ে বললে, ওঃ! আমরা মহাজন।
আমি আরও খুশী হয়ে বললুম, বলে! এখনও কাবুলীরা আমাদের টাকা ধার দেয়।
গম্ভীর হয়ে বললে, ‘সে কথা থাক’। আরেক দিন এ কথা উঠলে পর শব্নম বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ভারত আফগান উভয় সরকারে মিলে এ বদনামি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
‘আর তোমাদের মেয়ে গান্ধারী আমাদের ছেলে ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ে করেছিল। তাদের হয়েছিল একটা ছেলে আর একটি মেয়ে।
‘ক’টি বললে?’
‘একশ এক।’
আমার হাঁটুতে মাথা ঠুকতে ফুকতে বললে, ‘হায়, হায়! আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি স্থির করেছিলুম, আমিই তোমাকে একশটা আণ্ডা বাচ্চা দেব। এখন কি হবে।’
আমি আনমনে বাঁ হাত তার গ্রীবার উপর রেখে চুলে পাক মেরে ডান হাতে ডগাগুলো পাকের ভিতর ঢুকিয়ে চাপ দিতেই খাসা এলে-খোঁপা হয়ে গেল।
শব্নম আপন জীবন মরণ সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে, ফারকোটের ঢাকনা ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শুধালে, ‘তিন সত্যি করে বল, তুমি ক’জন মেয়ের খোঁপা বেঁধে দিয়ে দিয়ে এ রকম হাত পাকিয়েছ?’
আমি অপাপবিদ্ধ স্বরে বললুম, মায়ের হাত জোড়া থাকলে আমাকে খোঁপাটা শক্ত করে দিতে বলতেন।
আস্তে আস্তে ফের পাশে বসে বললে, যাক! তোমার উপস্থিত বুদ্ধি আছে।
অর্থাৎ বিশ্বাস করল কি না তার ইসপার-উসপার হল না।
আমি বললুম, তুমি সেদিন আমার হাত টিপতে টিপতে বললে, আমার হাত বড় নরম। আমি সরল ইমানদার মানুষ-কই আমি তো শুধোই নি, তুমি কজন পুরুষের হাত টিপে টিপে এ তত্ত্বটা আবিষ্কার করলে?
‘বিস্তর। আব্বা, আজেমন—এ যাবৎ। টিপে দেব আরও বিস্তর। তোমার আব্বা,-বল তো ভাই, তোমার জানেমন্ কজন?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললে, ছিঃ। শহরের সঙ্গে প্রথম রাত্রে তর্ক করতে নেই। তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না, কি বই পড়ছি, যখন ঘরে ঢুকলে? আমার এক সখী বইখানা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিলেন। ‘শব-ই-জুফফাফ’—‘বাসর-রাত্রি’। আল্ল-রসুলের দোহাই দিয়ে বিস্তর ভালো কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এ বইয়ের লেখক একটা উপদেশ দিয়েছে পঞ্চাশ বার—“শওহরের ভালো-মন্দ বিচার করতে যেয়ো না। তিনি আল্লার দেওয়া উপহার।”
আমি পরম পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বললুম, ‘এ লেখক শতায়ু হন, সহস্ৰায়ু হন। আমি নিশ্চিন্ত হলুম-কারণ আমি-’
বাধা দিয়ে বললে, তুমি একটু চুপ করো তো। আমি তোমাকে যে কথা বলবার জন্য জানলার কাছে নিয়ে এসেছিলাম সেইটের আখেরী সমাধান করতে চাই—এ নিয়ে যেন আর কোনদিন কোনও বাক-বিতণ্ডা না হয়।
আমি সত্যিই ভয় পেয়ে বললুম, ‘আমি যে ভয় পাচ্ছি হিমিকা।’
‘আবার! শোনো।’
ওই যে পূর্ণচন্দ্র তাকে সাক্ষী রেখে বলছি,
আমি জুলিয়েটের মত তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললুম, ‘না, না, ওকে না। বরঞ্চ তুমি ফজরের আজানের পূর্বেকার শব্নম হিমিকার নাম করে-’
‘তা হলে তোমার প্রিয় গিরিরাজ হিন্দুকুশের উপর যে চির হিমিকা বিরাজ করছে, প্রচণ্ডতম নিদাঘেও যার ক্ষয়ক্ষতি হয় না, তাকে সামনে রেখে বলছি, তার দোহাই দিয়ে বলছি, তুমি আত্মবমাননা করো না, নিজেকে লঘু করে দেখ না। কুমারী কন্যা যে রকম প্রহরের পর প্রহর ধরে বছরের পর বছর আপন দয়িতের স্বপ্ন দেখে, মাতা যে রকম প্রথম গর্ভের কণিকাটিকে সোহাগ কল্পনায় প্রতিদিন রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলে, ঠিক তেমনি আমি তোমাকে তৈরি করেছি, সেই যে-দিন আমি প্রথম বুঝলুম, আমি অসম্পূর্ণ, আমি নিদ্রিতা শাহজাদী, আমি অন্ধ প্রদীপ, আমার দয়িত রাজপুত্র দূরদূরান্ত আমার প্রতীক্ষ-দিনান্তের ওপার থেকে এসে আমাকে সঞ্জীবিত করবে, অশ্রুজল সিঞ্চন করে করে আমি যে প্রেমের বল্লরী বাড়িয়ে তুলেছি, তারই করুণ করস্পর্শে পুষ্পে পূন্সে মঞ্জরিত হবে সে একদিন- আকাশ-কুসুম চয়ন করে করে রচেছি তার জন্য আমার শব্-ই-জুফফারের ফুলশয্যা, প্রার্থনা করেছি, সে রাত্রে যেন পূর্ণচন্দ্র গিরিশিখরের মুকুটরূপে আকাশে উদয় হয়। সূর্যের প্রেম পেয়ে সে হয় ভাস্বর, আমার অন্ধবদনও তেমনি জ্যোতির্ময় হবে আমার বঁধুর ওষ্ঠাধরের সামান্যতম ছোয়াচ লেগে।