আমি বললুম, “শোন শব্নম, তোমাকে একটা সত্য কথা আজ বলে রাখি। আমার মত লক্ষ লক্ষ হিন্দুস্থানী আল্লার দুনিয়ায় রয়েছে। এমন কি এখানে যে কয়জন হিন্দুস্থানী আছে তার ভিতরও আমি অ্যাডোনিস্ বা রুডলফ্ ভালেন্টিনো নই। তোমার সৌন্দর্যের খ্যাতি ওদিকে আমুদরিয়া, পূর্বে পেশাওয়ার, পশ্চিমে কান্দাহার, দক্ষিণে দক্ষিণপাহাড় ছাড়িয়ে কহাঁ কহাঁ মুল্লুকে গেছে, কেউ জানে না। আমি শুনেছি ভারতীয় শিক্ষকদের কাছে, তারা শুনেছেন তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে। তাঁরা বলেন, বাদশা আমানুল্লা নিতান্ত একদারনিষ্ঠ বলে তুমি অবিবাহিতা—একই দেশে তো দুটো রাজা থাকতে পারে না, যদিও একই গাছতলায় একশ’টা দরবেশ রাত্রি কাটায়। গর্ব যদি কারও হয় তবে সে হবে
আমার। তামাম হিন্দুস্থান তোমার দিকে তাকাবে আর ভাববে কোন পুণ্যের ফলে আমি তোমাকে পেয়েছি।”
বললে, ‘শুনতে কী যে ভাল লাগে, কি বলব তোমায়। আমি জানি, আমার লজ্জা পাওয়া উচিত, মাথা নিচু করা উচিত, কিন্তু আমি এমনি বে-আব্রু বেহায়া যে এসব কথা আমার আরও শুনতে ইচ্ছে করছে। যদি কুপে পেয়ে যাই তবে আমি খোলা জানালার উপর মুখ রেখে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকব, আর তুমি পিছনে বসে আমার পিঠের উপর খোলা চুলে মুখ গুজে এই সব কথা বলবে।’
তারপর আমার দিকে স্থির কিন্তু স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, শুনে রাখ, আমার ভালবাসা দিয়ে দেহের সৌন্দর্যকে হার মানাবো। সে হবে পরিপূর্ণ একটি হিমকণিকার মত—যার প্রেমের ডাকে আকাশের শত লক্ষ তারা হবে প্রতিবিম্বিত, আর দিনের বেলা গভীর নীলাবুজের মত নীলাকাশ-তার অন্তহীন রহস্য নিয়ে।
তারপর শব্নম পড়লো তার সফর-ই-হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারত ভ্রমণ নিয়ে।
হিন্দুস্থানের রেল লাইনের দুপাশে অক্লেশে সে গজালে আঙুর বন, দিল্লীর কাছে এসে রিজার্ডের বরফে ট্রেন আটকা পড়লো দুদিন, ডাইনিং কারে অর্ডার দেওয়া মাত্র পেয়ে গেল কচি দুম্বার শিককাবাব, ট্রেন পুরো পাক্কা একটা দিন ছুটলো ঘন চিনার বনের মাঝখান দিয়ে, আগ্রা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সে কিনলে নরগিস ফুল আর হলদে গুল-ই-দায়ুদী, মোমতাজের গোরে দেবার জন্য। আর সর্বক্ষণ পাশের গাড়ীতে বসে আছে তোপল্ খান, উরুর উপর দু’খানি রাইফেল পাতা, পকেটে টোটা ভরা রিভলভার, বেল্টে দমস্কসের তলোয়ার–পাছে তার চার মুহম্মদী শর্তে ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগান খেলার কেনা টিকিট স্বামীটিকে কেউ কেড়ে নেয়!
আমার তো ভয় হচ্ছিল, ‘আবার বুঝি শব্নম বোরকার ভিতর থেকেই পিস্তল মারতে আরম্ভ করে মার্কিন গ্যাংস্টাররা যে রকম পকেটের ভিতর থেকেই তাগ করে দুশব্নমন ঘায়েল করতে পারে।
নানাবিধ মুশকিল যাবতীয় ফাঁড়া-গর্দিশ এবং তার চেয়ে প্রচুরতর আনন্দের ভিতর দিয়ে শব্নম বীবী তো শেষটায় পৌঁছলেন পূর্ব বাঙলায় তার শ্বশুরের ভিটায়।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, বাঁচালে।
‘দাঁড়াও না, তোমার খালি তাড়া। হাফিজ বাঙলাদেশে না আসতে পেরে বাঙলার রাজদূতকে তার বাদশার জন্য কি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন? সেই যেটা তোমাকে হোটেলের বারান্দায় দিয়েছিলুম।
আমি বললুম,
‘হেরো, হেরো, বিস্ময়।
দেশ কাল হয় লয়!
সবে কাল রাতে জনম লইয়া এই শিশু কবিতাটি
রওয়ানা হইল পাড়ি দেবে বলে এক বছরের ঘাটি।’
‘তুমিও এক মাসের বন্ধু, এক বছরের পথ পাচ দিনে পৌঁছলে।’
‘চুপ, চুপ, ওই বৈঠকখানায় মুরুব্বিরা বসে আছেন। ওঁদের গিয়ে প্রথম সালাম করতে হবে, না সোজা অন্দর মহলে যেতে হবে? কী মুশকিল, ‘কিছু যে জানি নে।’
আমি বললুম, ‘এই বারে পথে এস—আমাকে যে কথা কইতে দাও না।
‘তোমার পায়ে পড়ি, বলে দাও না। এই কি দাদ নেবার সময়?
আমি বললুম, প্রথম অন্দরে। মা বরবধু বরণ করবেন যে।
‘সে আবার কি?’
‘মা মোড়ায় বসবেন, আমি তার ডান উরুতে বসব, তুমি বাঁ উরুতে বসবে-’
সর্বনাশ! আমার ওজন ত কম নয়। তোমার কত?
‘একশ দশ পৌণ্ড।’
কিলোগ্রাম বল।
‘সে হিসেব জানি নে।’
দাঁড়াও, কাগজ পেন্সিল নিয়ে আসি।
ওর আঁক কষার মাঝখানে আমি দরদ ভরা সুরে বললুম, হ্যাঁগা, তোমার হিসেব তো দেখছি তোমার ওজন চারশ পৌণ্ড। আমার চেয়ে চারগুণ ভারী। তা হতেও পারে।
‘ইয়ার্কি ছাড়। ওটা ট—ওটা হল গিয়ে আউন্স।’
‘তা হলে তোমার ওজন আমার চার ভাগের এক ভাগ, হবেও না।’
সর্বনাশ! তাও তো হয় না। এখন কি করা যায়?
আমি বললাম, আলতো আলতো বসলেই হবে।
মা বরণ করলেন। কলাপাতা দিয়ে তেকোনা করে বানানো সমোসার মত পত্রপুটের ভিতর ধান-তিন কোণ দিয়ে বেরিয়ে আছে দূর্বা। আমাদের মাথার উপর অনেকগুলো রাখলেন। শব্নমের ওড়না তার হাঁটু পর্যন্ত নামানো।
আমার দুই ভাইঝি জাহানারা আর রাণী—কুটিমুটি প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে নূতন চাচীর মুখ সক্কলের পয়লা দেখবে বলে।
শব্নম স্বপ্ন দেখছে। আমি কথা বলে এক স্বপ্ন উড়িয়ে দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে আরেক স্বপ্নে ঢুকে যায়। কিন্তু সব চেয়ে তার ভাল লাগে মায়ের কোলে ওই বসাটা।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, আমার রইল জীবনে একটি মাত্র আশঙ্কা। মা যদি আমাকে ভালো না বাসে।
আমি ব্যাকুল হয়ে বললুম, তুমি ওই ভয়টি করো না শব্নম-প্লীজ-লক্ষ্মীটি। তোমাকে ভালবাসবে মা সবচেয়ে বেশী। তুমি কত দূর দেশ থেকে এসেছ সব আপনজন ছেড়ে, শুধু আমাকে ভালবাস বলে। একথা মা এক মুহুর্তের তরেও ভুলতে পারবে না। মাকে যদি কেউ ভালবাসে এক তিল, মা তাকে বাসে একতাল। আমাকে যদি কেউ ভালবাসে এক কণা, মা তাকে বাসবে দুই দুনিয়া—ইহলোক, পরলোকে।