Site icon BnBoi.Com

তুলনাহীনা – সৈয়দ মুজতবা আলী

তুলনাহীনা – সৈয়দ মুজতবা আলী

তুলনাহীনা – ১ম খণ্ড

০১.

লে, চ, ঝপ করে আরেকটা গিলে ফেল।

না, দাদা। আমার আর সইছে না।

ওই তো তোদের দোষ। হুইস্কি, হুইস্কি আর হুইস্কি। স্কচ্ হুইস্কি। ভগবানের যেন খেয়ে-দেয়ে অন্য কোনও কর্ম ছিল না। তার কুল্লে রস ঢেলে দিলেন ওই ধেঋেড়ে পাহাড়ে স্কটল্যান্ডের খাজাদের মধ্যিখানে। আরে ব্যাটা ওইটেই যদি দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল হত তবে ওই খেয়ে ওদেশের লোকগুলো দুনিয়ার সেরা সেরা কেষ্টবিষ্ট হল না কেন? বাবুরা তো এখনও ইংরেজের গোলাম। ওদিকে দেখ, ফরাসিদের। শুনিনদের জাত। খায় দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল-বর্দো, বর্গন্ডি, শ্যাম্পেন। নাচে, গানে, প্রেমে–

কীর্তি বাধা দিয়ে বলল, বাঁচালে, সুদিনদা, তুমি তো জানো, আমি হপ্তা দু তিন ধরে—

একটি জান্-খুশ, দিল-তরুর পরীতে মজেছিস। তা বেশ, তা বেশ, তা বেশ। অতি উত্তম প্রস্তাব। তবে কি না আস্ত একটা আসুপ্ত ভলকানো। তা বেশ, তা বেশ!

এই আমাদেরই গানে গন্ধের চেয়ে গণগন্ধে ভরা কলকাতারই একটি অতি বিখ্যাত বার-এর সুমুখে দুটো দেড় গজি স্টেনলেস্ চোঙার লাল মুণ্ডর উপর বসে দুই ইয়ার পঞ্চ মকারের শ্রেষ্ঠতম যে মটি সর্ব বার-এ খুশবায়ে ম ম করেন তারই সেবা করতে মধ্যমণি তৃতীয় ম-এর আলোচনা-চরে নৌকো ভিড়িয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে দুজনাই ক্ষণতরে বার-এর গর্ভদেশের প্রতি প্রীতিপ্ৰসন্ন নড় করলেন। কারণ বার-এর বারাঙ্গনা কও আর বরাঙ্গনাই কও, বা-মেড় শ্রীমতি বেয়াত্রিচে ইতোমধ্যে লক্ষ করেছেন, দুনো ইয়ারের গেলাস তলানিতে এসে ঠেকেছে এবং সেটা যে তিনি অবশ্যই লক্ষ করেছেন তারই স্বীকৃতিস্বরূপ মোলায়েম মৃদুহাস্য মুখে মাখলেন। হেস্টিংস্ হার্ডিঞ্জের লীলাভূমি মহানগরীর মহা-বারু-এর মহারানির এতখানি দূরদৃষ্টি ও পরাভাবকাতরতা অবশ্যই আছে যে, এই খানদানি বার-এ কোনও মেহমানকে কোনও কিছু নিজের থেকে চাইতে হয় না–তা সে আই সে মিস্ বলে তাঁকে ডাক দিয়ে কিংবা শূন্য গেলাসের উপর ঠুংঠাং করে জলতরঙ্গ বাজিয়ে; এমনকি উচ্চ মঞ্চাসনের সামান্যতম উসখুস দ্বারা আপন অস্বস্তিটা প্রকাশ করে কোনও মেহমানকে কস্মিনকালেও সিন্নোরিনা বেয়াত্রিচের নেকনজর আকর্ষণ করতে হয়নি। সে-পরিস্থিতি, সে-ইনকিলাব ঘটবার বহুপূর্বেই বেয়াত্রিচে নিঃসন্দেহে আত্মহত্যা করবেন। সে আত্মনাশ জাপানি হারাকিরি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংভূ।… কবে, কবে সেই ফিMো পেলিত্তি, তার পূর্বেকার স্পেনসার-এর আমলে এদেশে এসেছিলেন বেয়াত্রিচে গোষ্ঠীর প্রথম মহিলা। বসন্তসেনাশ্রেণিয়া মনোরঞ্জনী, চিত্তহরিণী এ পরিবার-বংশানুক্রমে।

এখনও আমাদের এই সমসাময়িক বেয়াত্রিচে বিপদে-আপদে উৎসবে-ব্যসনে সুদিনদা এবং তার পঁচো ইয়ারের সম্মানরক্ষার্থে তাদের পার্টির মক্ষিরানির রূপে সেখানে ত্রিযামা যামিনী যাপন করে আসেন। তাঁর এখন বয়ঃসন্ধিকাল, অবশ্য কিঞ্চিৎ ভিন্নার্থে; তিনি যৌবন আর ভরা যৌবনের মাঝখানে। আমাদের ইতিহাসে তিনি পরিপূর্ণ স্টার না হলেও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুল্লেখার মতো বার বার আমাদের সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে যাবেন।… তাই এই বেলাই তাঁর সম্বন্ধে কিছুটা বলে নিতে হল।

আবার দেব? কিংবা ইয়েস্ প্লিজ? বাঁধা গতে বেয়াত্রিচে ফ্যালনা বার-মেডের মতো খদ্দেরদের সম্মুখীন হন না। সামান্যতম মৃদুহাস্য দিয়ে জানালেন, এই যে? অর্থাৎ জানি। কী চাই, কখন চাই, জানি। আসছে।

দুই ইয়ারও মানানসই স্মিতহাস্য না-বলা থ্যাঙ্কু জানালেন।

ছিঁড়ে যাওয়া রসালাপের রিপকর্মটি করতে করতে কীর্তিনাশ চৌধুরী ঈষৎ অভিমানের সুরে বলল, সুদিনা, তুমি মাইরি আমার চেয়ে আর ক-বছরের সিনিয়র? আমাকে যা বলতে চাও সোজাসুজি কইলেই পারো। আস্ত একটা ভলকানো কথাটার মানে কী? মিস্ শিপ্রা ভোরের শিশির-ভেজা শিউলিটি নন সে তো তুমি জানো আমার চেয়েও বেশি। আর পাঁচজনের তুলনায় তুমি তাকে কতখানি বেশি জানো কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারির পর– মানে, ইয়ে, কতদিক দিয়ে সেটা অবশ্য আমার অজানা, কিন্তু অশ্রাব্য হবে না, ভরসা আছে। তুমিই তো, বাপু, আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তাঁর সঙ্গে।

সুদিন চৌধুরী : অপরাধ করেছিলুম কি? চুপ করে রইলি যে? এবং এই চুপ করে থাকাটাই সদুত্তর। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে গভীরতম সত্য লুকনো আছে। এই যে তোদের পোয়েট রবিবাবু গেয়েছে,

দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে
কী জানি কী মহা লগনে

কেন বাপু, শুভ লগনে বললে অপরাধটা কী হত? অ। তা হলে তেনার অরিজিনালিটি থাকত কোথায়? তাই না? যেদো-মেদো, এস্তেক মুসলমানদের গাইয়া পোয়েট বসিরুদ্দি মৃদম খা তক শুভ লগনটা অ্যামন জাবড়ে ধরে আছে যে ঠাকুরবাড়ির তেতলার কবি, রাজপুত্ত্বর দ্বারকানাথের নাতি, আগাপাশতলা একটা নয়া ধর্মের ভগীরথ দেবেনঠাকুরের নন্দন নোবেল ঘোড়ার রেসে পয়লা নম্বরি সওয়ার তিনি ওই হাজাপচা শুভ লগনটা এস্তেমাল করেন কী প্রকারে? না? কিন্তু তা নয়। এ উত্তরটা অতি রদ্দি মার্কা প্রোলেতারিয়ার যা-তা উত্তর। আসলে ওই যে যেতে যেতে পথে দেখাটা হয়ে গিয়েছিল তার ফলে হল প্রেম– পূর্বরাগ, অনুরাগ, চুম্বন, আলিঙ্গন-এটসেটরা-গয়রহ ইত্যাদি, কিন্তু সে-সব থাক্। ওসবের কথা তুললে কফি হৌসের তরুণরা তেড়ে আসে। প্রেমের এসব বস্তাপচা প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি এখন যাদুঘরের মাল মুজিয়াম পিস। হক্ কথা। কিন্তু দাদা, তার সঙ্গে সঙ্গে যে-বিরহ, হু করে বিবিজান তোমাকে ঠাঠা রোদ্দুরের ব্লদেভুতে ছিবড়েটার মতো ফেলে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন লেকচারারটার সঙ্গে সিনেমায় আরও কত কী, সেগুলো কি শুভ লগনে দেখা হওয়ার সিমটম মোটেই না। মিলনের চুম্বন = শুভ-লগন + রাঁদেভুতে কর্ণমর্দন = অশুভ লগন। একুনে, মহালগন।

তোকে যে ম্যাডাম শিপ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলুম সেটা মহালগন। শিপ্রাপারে পৌঁছে গেছিস, আর তোর মাথাব্যথা কিসের। শিপ্রা তো মধ্যপ্রদেশে? না? ঝেড়ে দে না একখানা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম ওই প্রভিনসের টুরিস্ট ব্যুরোকে। ব্যস। তবে হ্যাঁ, ওদের ব্লেজার ট্রিপ লাঞ্চে আকছারই যাত্রী থাকে দেদার।

তা সে যাক্ গে। কথা হচ্ছিল,

আখ-খ-খ। শাস্ত্রালোচনায় অহরহ বিঘ্নবিপত্তি!

কী ব্যাপার?

বার-টার পাশেই ডাইনিং-ডানসিং-কাবারে এই তিন প্রকারের আনন্দভবন মিলিয়ে ঢাউস এক জলসা-দরবার। বার-এ তো মেয়েমদ্দে গিসগিস করছিল, সে তো প্রায় উদয়াস্ত লেগেই আছে। কিন্তু নবাব খাঞ্জা খাঁর আসল রঙ-মহল পাশের সেই পঞ্চরঙ্গের শ্রীরঙ্গমে একবার কেউ সম্মুখসগ্রাম লড়ে সে ভিড়ে প্রবেশ করতে পারলে সে ব্যক্তি আর কস্মিনকালেও বলবে না, কলকাতার বাসগুলো বড় ক্রাউডেড। আপনি শক্তসমর্থ জোয়ান মদ্দ মানুষ–আপনার নিতম্ব নিমর্দিত হবে মুহুর্মুহু। আপনি ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন মানেন– আপন রিজার্ভড় টেবিলে পৌঁছতে না পৌঁছতে আপনি দলিত মর্দিত পিষ্টিত এবং আলিঙ্গিত হবেন কেরালার তন্বী শ্যামা থেকে আরম্ভ করে, নর্ডিক ব্লন্ডিনীগণের অকৃপণ সহযোগিতা পেরিয়ে সর্বশেষে পুঞ্জীভূত মাংসাধিকারিণী মার্কিনিদের সঙ্গে অগুনতি কলিশন লাগিয়ে লাগিয়ে নব নব রেকর্ড নির্মাণ করে করে।

সেখানে লেগেছে আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়া এক ধুন্ধুমার।

আমাদের দুই ইয়ার এসব ব্যাপারে সচরাচর নির্বিকার। বলতে গেলে এরা এবং এদের গণ্ডা দুই দোস্ত মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে হাঁটতে শিখেছেন এই জলসাঘরেরই মার্বেল পাথরের মেঝের উপরে।

কিন্তু আজ ভিন্ন গীত।

কাইরো না বেইরুৎ কোথা থেকে এসেছেন সদলবল এক বিশ্ববিজয়িনী নর্তকী। উর্বশী মেনকা থেকে আরম্ভ করে ইজাডরা ডানকান্ আনা পাভলোভা তক আবহমান কাল থেকে আর সবাই নেচেছেন দু খানা পা দিয়ে, কিন্তু এই দিগ্বিজয়িনী নাচবেন পেট দিয়ে। সোনার পাথরবাটিও বুঝি কিন্তু, কিন্তু পেট দিয়ে নাচ!

সাপ হাঁটে পেটের উপর দিয়ে কিন্তু সে-ও তো দেখি নাচের সময় পেটের তোয়াক্কা না করে নাচে কাঁধ দিয়ে, ফণা দিয়ে, কোমর দিয়ে, ল্যাজ দিয়ে, যদিও সাপের পেটটা তার দেহের আগাপাশতলা জুড়ে। আর যদি ভাবার্থে নেন তবে এই সেই উদরসব ফিরিঙ্গি জাত, সে-ও তো পাক্কা দু শোটি বচ্ছর এদেশের চাষাভূষোর অন্ন মেরে আপন পেট ফাটিয়ে দিল, কিন্তু কই, তাকেও তো কখনও ওই দুনিয়া-খেকো পেট দিয়ে নৃত্যের তালে তালে মা মহারানির বন্দনা করতে দেখিনি।

যে কলকাতার তাবল্লোক পাঁচপেয়ে বাছুর দেখার তরে রিস্টওয়াচ গচ্ছা দিয়ে রেস্ত জোগাড় করে তারা আসবে না হদ্দমুদ্দ হয়ে এই বেলি-ডান্স, ঔদরিক নৃত্য পেটভরে দেখতে।

দুই ইয়ার ওই উত্তাল জনসমুদ্র উলুজ্জন অসমীচীন বিবেচনা করে জোগাড় করলেন একখানা উচ্চপদী চেয়ার। তার উপর দাঁড়াতেই স্পষ্ট দেখা গেল নাতিবিস্তীর্ণ নটমঞ্চ।

তখনও উচ্ছেভাজার পয়লাপদ শেষ হয়নি। অর্থাৎ নটরাজ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নন্দীভৃঙ্গী দু কদম আনাড়ি নৃত্য নেচে নিচ্ছেন। তখন বোঝা গেল, হট্টগোলটা উঠেছিল বিরক্তি এবং কথঞ্চিৎ উন্মা বশতও বটে– এসব হাবিজাবির ঠেলায় মেঘে মেঘে যে বেলা হয়ে গেল, আসল মাল বের করবে কখন? এরা কি পিত্তি না চটিয়ে খেতে জানে না।

হঠাৎ সব আলো ক্ষণতরে নিভে গেল। পাঁচ নাগর তার ফায়দাটা ওঠাবার পূর্বেই নন্দনকানন থেকে নেমে এল এক শ্যাফট নীল আলো। আবছা আবছা দেখা গেল যেন সমুদ্র থেকে ভেসে উঠছেন মরুভূমির স্কি, কিন্তু, তন্বঙ্গী নারীরূপিণী এবং দেখা-না-দেখার আলোছায়ার ইন্দ্রপুরীর যেন ইন্দ্রধনু।

সে আবেশ কাটতে না কাটতেই আরও অকস্মাৎ কী হতে কী যেন হয়ে গেল। হলসুষ্ঠু তাবজ্জন যেন বানের জলে হাবুডুবু খেতে লাগল। নাহ! তেমন কিছু একটা প্রলয়ঙ্করী ব্যাপার নয়। মাত্র গণ্ডা দশেক সূর্য জলসাঘরের মধ্যিখানে যেন একটা এটম বমের মতো ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তারই আচমকা ধাক্কায় তাবৎ পেট্রন-পেট্রনিদের চোখের মণি গেছে উল্টে–সেঁধিয়ে গেছে ভেতর বাগে।

স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে নটরানি– সেই বন্যার উপরে স্টেজের মাঝখানে।

সম্পূর্ণ নিশ্চল। চোখের পাতাটিতে পর্যন্ত কম্পন শিহরণ স্পন্দন কিছু না, কিচ্ছুটি নেই। কিন্তু ওই নিশ্চলতা থেকে সঙ্গে সঙ্গে যেন কোন এক চুম্বন সক্কলের দৃষ্টি টেনে নিয়ে গেল নটরানির নাভিকুণ্ডলীর দিকে।

টগর ফুলের পাপড়ি কোমর বেঁকিয়ে যেন সর্বাঙ্গে পাক খেয়ে ঢলে পড়ে পাশের পাপড়িটির উপর, তিনি ফের তার সখীর উপর এবং এই করে করে মাঝখানের স্থির বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে সবকটি সখী যেন নেচেই যাচ্ছেন, নেচেই যাচ্ছেন একে অন্যের পিছনে আমৃত্যু সে রাসনৃত্য!

নটরানির নাভিকুণ্ডলীটি যেন টগরিনীদের রানি।

ক্ষুদ্রাতিতম ক্ষুদ্র নটরানির নাভিটি; কেন্দ্রবিন্দুটি। আর সেই বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে হুবহু টগরের পাপড়ির মতো মাংস বলুন, পেশি বলুন, একের পিছনে আরেকটি যেন নেচে চলেছে চক্রাকারে। নাভিকুণ্ডলীর দয়ে যেন ক্রমাগত পাকের পর পাক খেয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুগঠিত পেশি-পাপড়ি।

টগরের পাপড়ি নাচে এক জায়গায় ধীরস্থির দাঁড়িয়ে। এস্থলে তা নয়। এ নারীর কুণ্ডলী-পাপড়ি পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত। এরা একে অন্যের পশ্চাতে কভু দ্রুত কভু মন্দ লয়ে যেন চটুল পদক্ষেপে পটীয়সী রাশান বা-এ নর্তকীর মতো নৃত্যে নৃত্যে চক্র রক্ষা করে।

নাভিকুণ্ডলী নিয়ে এ হেন ভেল্কিবাজি দেখানো যে সুকঠিন, সুকঠিন কেন, অসম্ভব সে তত্ত্ব যে কোনও মাল-ডান্সার কসম খেয়ে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু এহ বাহ্য, আগে গিয়ে পূর্ণ সত্য অনুভব হয় তখন, যখন রাত-কানা জনও হঠাৎ লক্ষ করে যে নটরানির বাদবাকি সর্বাঙ্গ নিশ্চল, নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ। বস্তৃত ওই যে ওটা গতিশীলা নিঝরিণী নয়, নিতান্তই সীমাবদ্ধ নিস্তরঙ্গ নিষ্প্রাণ সরোবর, অর্থাৎ দয়ের পাকচক্রে না থাকলে মনে কোনও দ্বিধারই উদয় হত না–এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, প্রতিমা নিশ্চয়।

কীর্তিনাশ ফিসফিসিয়ে বলল, ঃ। এ তো স্রেফ হুনুরির একটা কৌশল! এতে আর্ট কোথায় জানেন শুধু কুবের কুল মেড়ো গুষ্টি। পেরেকের বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে কাটান যারা বর্ষা-বসন্ত তেনারা তা হলে এ মহাপ্রাসাদের বিজয়িনী মিশরিনীর চেয়ে হাজার দফে গুনিন পাভলোভা-শঙ্করের শুরুর গুরু। হবেও-বা। নইলে এ মহফিলের চাই সব মেডোরা এখানকার নাভিকুণ্ডে স্নান সেরে নাক বরাবর ধাওয়া করবেন কেন পেরেক শয্যাশায়ী শুরু মহারাজকে ঢিপ ঢিপ করে পেন্নাম জানাতে? ধন্যি, বাবা, তোমাদের আর্ট, নৃত্যকলা উর্বশীমার্গে মোক্ষলাভের চতুর্থ মার্গ!

ইয়ার সুদিনদা ঢের ঢের উঁচুদরের খলিফে। কীর্তিনাশের পাঁজরে কনুই দিয়ে একখানা সরেস গুত্তা মেরে বললেন, ওরে আচাভুয়ো চাটচিস হুইস্কির বোতলটা, আর শুধোচ্ছিস এতে আবার নেশা কোথায়? সবুর কর এক লহমা। এখখুনি তেড়ে আসবে উড়ের হাত থেকে হোজের জলের তোড়ের মতো রসের মুগুর। কালবোশেখীর ঝড়ের আগে, বটগাছের মগডালে অ্যাটুনটুন কাঁপন। উপস্থিত শুরু হয়েছে তারই যেন দোহার। দাঁড়া না, হুড়মুড়িয়ে ঝড় নামল বলে।

একদম করেকট আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বেতারকে ঢিঢ দিয়ে।

তবে হ্যাঁ, আলবৎ, ঝড়টা হুড়মুড়িয়ে নামেনি। নামল ধীরে মন্থরে। কিন্তু দিগবলয় আচ্ছাদন করে।

পুকুরের মাঝখানে ঢিল ছুড়লে যেমন সেখান থেকে চক্রটি চতুর্দিকে চক্রাকারে ক্রমে ক্রমে সম্প্রসারিত হতে থাকে এ ক্ষেত্রেও হুবহু তাই। নাভিকুণ্ডলীর নৃত্য ডাইনে-বাঁয়ে সম্পূর্ণ নীবিবন্ধকে উদ্বেলিত করে তুলল। এদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যে-রসকে বাজুবন্ধ খুল খুল যাওত রূপে সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এস্থলে সে-রসই বাজুচক্র ত্যাগ করে কটিচক্রে সঞ্চারিত হল। নাভিচক্র থেকে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত হয়ে কম্পন আন্দোলন হল ঊর্ধ্বমুখী অধোগামী। সর্বদেহে কী আবেগ, কী আবেশ। হৃৎপিণ্ড মুহ্যমান।

পঞ্চেন্দ্রিয়, সর্বচৈতন্যের বিলুপ্তি আসন্ন।

বেয়ারা কীর্তিনাশের কানে কানে বলল, হুজুর, আপকে লিয়ে বহুত জরুরি ফোন।

.

০২.

হ্যালো?

হ্যালো। কীর্তি? শোনো–

এ যে একেবারে নয়া ব্যাপার। কীর্তির হৃদয়দুয়ারে লিলি ডলি বুজু নরগিস মাঝে মাঝে টোকা দিয়েছে বটে কিন্তু সে নিতান্ত হলে হল, না হলে না গোছ কিংবা অগত্যা ইংরেজিতে যাকে বলে অন্য এ রেনি ডে; আর এ হল ঠিক তার উল্টো, এখানে রে নামল খা খা খটখটে শুকনো মাঠে।

তুমি আধঘন্টাটাক পরে এখানে আসতে পার?

কেন? ব্যাপার কী?

মানে? তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না? তোমার কি কখনও বয়স হবে না? কেন, কেন, কেন? মিস্ত্রিকে বুঝিয়ে বলতে হয় কেন তাকে ডাকছি, দর্জিকে ডাকার কারণটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হয়! তুমি কোনটা যে তোমাকে কারণ দেখাতে হবে?

বেচারা কীর্তিনাশ। এই অবেলায় অকস্মাৎ অযাচিত অনুগ্রহ। এখন কি আর তার সে বোধশক্তি আছে যে কোনটা ঘটে সকারণে আর কোনটা ঘটে দেবতাদের যখন নিতান্তই কোনও কিছু করবার থাকে না বলে মানলি রিটার্নে নাম্বার অব অ্যাশ টেকেন দেখাবার তরে। শিপ্রা তখন দেবতাদের একজন। মূর্খ কীর্তির বোঝা উচিত ছিল, অকারণ অনুগ্রহই অনুগ্রহ।

হঠাৎ অতিশয় মধুরা নিস্তেজ গলায় কীর্তি, আমার বড় লোনলি লাগছে যে। তুমি এস।

খুট!

কে বলে কীর্তির নাম কীর্তিনাশ! কীর্তিমান পুরুষ সে। কীর্তিনাশা নদী যখন ওই বংশের সর্বশেষ সন্তানের সর্বশেষ পুকুরটি(!) পর্যন্ত গ্রাস করে ঢেউয়ের ডাকে ডাকে ঢেকুর তুলছেন তখন জন্ম নেয় এই সন্তান। বংশটা লোপ পেলেই করালী কীর্তিনাশা নদী আপন কৃতিত্বের পরিপূর্ণ সাফল্যলাভের আত্মপ্রসাদ প্রসাদাৎ অবশ্যই একটা কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করতেন যে ভূমি গ্রাস করেছেন তারই কোনও এক ভেসে-ওঠা অংশের বালুচরে। সেটা যখন নিতান্তই হল না তখন শেষ সন্তান কীর্তিনাশ নামের স্কন্ধে পীঠ স্থাপনা করে একাই চৌষট্টি-যোগিনী রূপে উচাটন নৃত্য নেচে যেতে লাগলেন।

ফোন ছেড়ে ভরাপাল তুলে বার-এ ফেরার সময় কীর্তিনাশ আপন পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে মনে মনে বলল, ছোঃ, আমার নাম কীর্তিনাশ না কচুনাশ। শিপ্রাপুলিনবিহারী নাগরদের এক ফুঁ মেরে পাঠিয়ে দিলুম পদ্মর হে-পারে। সুদিনদাটা একদম বুড়ব। বলে কি না, ঘুড়িবুড়ির দোআঁশলা না কী যেন। যে রমণীর চতুর্দিকে অষ্টপ্রহর কবি সাহিত্যিক ফিলিমস্টাররা ঘুর ঘুর করছে, যার জিরোবার তরে একলহমা ফুরসত নেই সে মেয়ে ফিল করছে লোনলি। তার হৃদয়টা অত সহজে ভরে না। সুদিনের কথার কোনও মানে হয় না।

বার বার কীর্তিনাশের বুকের রক্তে রিনিরিনি করে বেজে উঠছে আমি লোনলি এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বচৈতন্যে ছড়িয়ে পড়ছে গভীর এক প্রশান্তি।

আবার তার মন ভরে জেগে উঠল, আমি লোনলি। কেমন যেন মনের ভিতর হঠাৎ কে যেন একটা ইয়া লম্বা বিজয়-পতাকা খাড়া করে খটাস করে মিলিটারি কায়দায় তাকে একটা সেলুট ঠুকে জানাল সে বীর, সে বিজয়ী; শিপ্রা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বয়ংবরে সে প্রিন্স্ এলবার্ট। কে না জানে ইয়োরোপের সর্বদেশের রাজপুত্ররা তখন জমায়েত হয়েছিলেন লন্ডনে যে যার রাজাড়ম্বর নিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে কীর্তিনাশের বুকের ভিতর কে যেন বলে উঠল, ছিঃ! এ কী কথা! এটা কি আলিপুরের ঘোড়দৌড় যে তুমি পয়লা নম্বরি হয়েছ বলে দেমাকে মাটিতে পা পড়ছে না–ফারাক শুধু এইটুকু, ঘোড়ার চারটে পা, তোমার দুটো।

কে বোঝে এই সামান্য সত্যটুকু? ইহসংসারের সুদূরতম প্রান্তে একটি রমণী হোক। সে সুন্দরী সদাচার, হোক সে উপেক্ষিতা কদাকার– তার জীবন যেন হঠাৎ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে, মহাশূন্যে সে যেন হঠাৎ একা, সে লোনলি। সে তখন স্মরণ করল তোমাকে। তোমাকে স্মরণ করেছে– এর পর তো আর কোনও চরমতর সত্য নেই। এর থেকেই তো প্রতিষ্ঠিত হল যা জীবের কাছে চরমতম উপলব্ধি সে আছে, তার অস্তিত্ব তার নিজের কাছে এই প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করল।

***

ওরে ইডিয়ট এদিকে আয়। কেটে পড়ছিস যে বড়!

হ্যাঁ, আধ ঘণ্টা পরে যেতে বলেছে। ততক্ষণে ঝপ করে আরেকটা

বার-এ তখন পুরোদমে যা তর্কাতর্কি চলেছে কোথায় লাগে তার কাছে উভয় ভিয়েতনামের লড়াই। যদিও তর্কের বিষয়বস্তু কবে সেই প্লাতো না লাওৎসের আমল থেকে।

ডানস– বেলি ডানস্– সেকস্।

সরকার পক্ষের প্রধান বক্তা কিউ সি শ্ৰীযুত সুদিনের মুখে এক বুলি। আর্ট ফর আর্টস সেক্। সঙ্গীত হোক, কাব্য হোক, নৃত্য হোক– তার একমাত্র উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি করা। বিদ্রোহী কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে দেশের স্বাধীনতা আড়াই মিনিট আগে এল না পরে এল, মোনা লিজার ছবি দেখে তাবৎ ফরাসিনী পুত্রশোকে কাতর অবস্থায়ও আ লা মোনা লিজা মুচকি মুচকি হেসেছিলেন কি না, কিংবা বিলকুল শব্দার্থে কান-কাটা ভান গগের ছবি দেখে চিত্ৰামোদীগণ আপন আপন কান কাটাবার জন্য সার্জনদের কসাইখানায় কিউ কেটেছিলেন কি না সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর। বেলি-ডান্স ইজ বেলি ডান্স্। আসল দ্রষ্টব্য, উদরমণি নাভিসরোবরে রূপসাগরের যে তুফান জেগে উঠল সেইটে দেখে তোমার চিত্তরাজ্য কি আকুল হয়ে ওঠেনি ওই সরোবরে অবগাহন করে হৃদয়জ্বালা জুড়োতে? তুমি কি ভুলে যাওনি ক্ষণতরে ক্ষুদ্র ওই নাভিকুণ্ড বিশাল চিল্কা কুণ্ড নয়, তুমি

কীর্তির মনে অন্য ভাবনা। শিপ্রার কাছে যাব কোন ড্রিংক খেয়ে? হুইস্কি মুইস্কি চলবে না। বে-এক্তেয়ার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। একদম সাদা চোখেও যাওয়া যায় না। পুরুষের যে তেজস্ বিচ্ছুরিত হয় তার ব্যক্তিত্ব থেকে, তার পৌরুষ সত্তা থেকে সেইটেই তো রমণীকে মুগ্ধ করে বিহ্বল করে, সেটাকে কোনও একটা ড্রিংক মারফত কিঞ্চিৎ মরাল সাপোর্ট তো দিতেই হয়। নাহ্- ওসব বিচার-বিবেচনা করা বেকার। কলকাতার কুল্লে নটবর, কড়ির কুবের, কালোবাজারের নম্বরি নম্বরি ঘড়েল যারা চালাকি আর মিষ্টি হাসির বঁড়শি দিয়ে চিফ ডিটেকটিভের নাড়িভুড়ি থেকে গোপন কথার এপেডিক্স টেনে বার করতে পারে তাদের সব্বাই হার মেনেছেন শিপ্রাদেবীর টেনিস-লনের ওয়াটারলুতে। তিনি মোহাতুর হন, তার সর্বাঙ্গে আবেশ লাগে, তাঁর বক্ষে অরণ্যমর্মর জেগে ওঠে- সবই। ওদিকে কিন্তু বিচার-বুদ্ধির মেকদার জ্ঞান অষ্টপ্রহর ঝাঝালো বাঙাল কাসুন্দির মতো। তাই তোমার মাথাটি রাখতে হবে ফ্রিজের আইস বসে। তার গড়া ট্রাফিক আইনের রেড লাইটটাকে পিংক মনে করে মাত্রা ছাড়িয়েছ তো গেছ। পক্ষান্তরে তিনি যে ভাগ্যবানকে গ্রিন লাইট দেখান তার ট্রাফিক রেগুলেশন সম্বন্ধে, কীর্তিনাশের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আজকের এই ভর রাতের ফোনে যেন কাঁচা সবুজের আবছা আবছা আভাস দেখতে পেল। সুতরাং বহু আত্মচিন্তা ততোধিক পরকীয়া কিংবদন্তি সুবিবেচনা করে কীর্তি স্থিরনিশ্চয় হলেন এহেন পরিস্থিতিতে ড্রিংকরূপে ক্রেম দ্য মৎ-ই প্রশস্ততম এবং তদনুযায়ী ড্রিংক শেলফের দ্বিতীয় স্তরের পূর্বতম প্রান্তে ক্ষণতরে কটাক্ষ হানল। বেয়াত্রিচের বরদাপাণি সেদিকে প্রসারিত হল।

ড্রিংক সমস্যা সমাধান করার পর কীর্তির কান গেল বেলি-ডানস্ তর্কাতর্কির দিকে।

সুদিন-বৈরী শঙ্কর বলছে রেখে দাও আর্ট ফর আর্টস সেক। নাইট ক্লাব, কাবারে ললিতকলা অ্যাকাডেমি নাকি যে এখানে সেই কাইরো না মরক্কো থেকে আসবেন খাপসুরৎ খাপসুরৎ উপকিরা পপ্যার আর্ট আর এপলাইড আর্ট বাবদে আমাদের তালিম দিতে? উইদ ডেমোনস্ট্রেশন। সেইটেই হল আসল তত্ত্ব। আর আর্টের কথাই যদি উঠল তবে বলি, প্রকৃত আর্ট আদ্যন্ত সবকিছু প্রকাশ করে না– ইঙ্গিত দেয় বহু না-বলা, অ-চাখা রসের প্রতি। আজকের নাচে নাভিকুণ্ডলী থেকে নৃত্যরস বহির্গত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে শিহরণ কম্পন জাগিয়ে তুলল এবং নিম্নগামী হয়ে যে রূপে প্রকাশ দিল তার ইঙ্গিতটা ছিল কোনদিকে? সেটা অশ্লীল।

এক ঠোঁটকাটা সদ্য বিলেতফের্তা হাবা সেজে শুধাল, ইঙ্গিতটা কোন দিকে ছিল সেটা আগিয়ে বুঝিয়ে বলুন, তবে তো করা যাবে শ্লীল-অশ্লীলের বিবেচনা।

আখ! তুমি কী সেখানে ছিলে না? যৌনসঙ্গম।

সুদিন অত্যন্ত বিরক্তি এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যৌনসঙ্গম আবার কবে থেকে অশ্লীল হল?

.

০৩.

এসো।

আমাকে যে স্মরণ করেছ তাতে আমি ভারি খুশি হয়েছি। আসলে বলা উচিত ছিল, গর্ব অনুভব করেছি।

না আনন্দটাই বড়। কে কাকে কতখানি আনন্দ দিতে পারে বল।

তোমার কথাই সই। কিন্তু হঠাৎ তুমি এরকম লোনলি ফিল করলে কেন বলল তো? কলকাতার কোন ক্লাব, কোন পাটি, কোন শো থেকে তুমি প্রতিদিন নিমন্ত্রণ পাও না? অবারিত দ্বার একটা কথার কথা। তোমাকে তো সবাই লুফে নেয়। আর তুমি কি না লোনলি!

কিছুমাত্র ছলনা বা ভান না করে শিপ্রা বললে, কীর্তি, তোমার প্রাণরস অফুরন্ত, তোমার মতো অহরহ সজীব আমি খুবই কম দেখেছি। তাই তুমি সহজে বুঝবে না, জনতার মাঝখানে একটা মানুষ কতখানি নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, পরিত্যক্ত হতে পারে। আমার কথা বাদ দাও– এক্কেবারে পয়লা নম্বরিনীদের কথা চিন্তা করো তো : দিনের পর দিন তারা পার্টি পরব ফাঁকশনে যাচ্ছেন, তাঁদের চতুর্দিকে সমাজের সবচেয়ে উঁচু কাতারের পয়সাওলা, খ্যাতিমান শক্তিমান সবরকমের প্রভুরা। আর রয়েছে স্মার্ট সেন্টু। তারা স্মার্ট উইটি কথা বলে, টিপ্পনী কাটে আর সুন্দরী গরবিনীর স্মার্ট উত্তর দেন, যারা পারেন না তারা অন্তত মৃদু হাস্যের তারতম্য দিয়ে কোনটা ভালো কোনটা মাঝারি তার সার্টিফিকেট দেন। আচ্ছা, তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছ, এই সমস্ত ব্যাপারটার উদ্দেশ্য কী, অর্থ কী?

না। তুমি ভালো করেই জানো, আমি খুব চিন্তাশীল প্রাণী নই।

শিপ্রা তার সুডৌল ঘাড়টি আরেকটু উঁচু করে কীর্তির চোখে চোখে তাকিয়ে বললে, ওটা আর কিছু না। ওটা বর্তমান সমাজের একটা প্যাটার্ন মাত্র। চলছে, চলবে হয়তো বহুদিন ধরে, কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে আগাপাশতলা বদলে যেতে পারে।

মানে?

অতি সহজ। লন্ডনে এ প্যাটার্ন অনেকদিন ধরে গড়ে উঠেছিল। এবং তার গোড়াপত্তন করেছিল সে-দেশের খানদানি লোক। অথচ যেই লাগল লড়াই অমনি তার বড় ভাগটা হয়ে গেল উধাও। বাকিটুকুও ভোল পাল্টে নিল রাতারাতি। কোথায় গেল হাওয়ায় হাওয়ায় মিলে-যাওয়া সিল্কের বুক-কাটা, কোমর-হ্যাঁচা গাউন, অদৃশ্য সিল্কের ফ্রেশ কালার মোজা আর ত্রিভঙ্গ গোড়ালির জুতো! সবাই পরে নিল কাঠখোট্টা চামড়ার চেয়ে পুরু কাঁথার ইউনিফর্ম—প্রাইম মিনিস্টারের বেগম গিয়ে দাঁড়ালেন কিউয়ের ন্যাজে– রেশনশপের সামনে।

আর আমাদের এই কলকাতার প্যাটার্নটা

হঠাৎ থেমে গিয়ে শিপ্রাদেবী বললেন, ওহ! আই এম ফ্রাইটফুলি সরি। তুমি এখানে এসেছ বার ছেড়ে নাক বরাবর। আর তোমাকে একটা ড্রিংক অফার করিনি। কী খাবে বল।

কীর্তি আমতা আমতা করে বললে, না– তা–

শিপ্রা খিলখিল করে হেসে বলল, পষ্ট গন্ধ পাচ্ছি খেয়ে এসেছ ক্রেম দ্য মৎ– আরও কাছে এসে বসো দিকিনি। যে সোফাটাতে সে আধশোয়া অবস্থায় পা দু খানি গুটিয়ে রেখেছিল তারই একটুখানি একপাশে সরে গিয়ে একটান মেরে বসিয়ে বলল, ঠিক ধরেছি। তা এই অবেলায় ক্রেম দ্য মৎ কেন? জব্বর একটা ব্যানকুয়েট খাওয়ার পর ক্রেম দ্য মাৎ দিয়ে মুখশুদ্ধি করেছ বুঝি?

কীর্তি আকাশ থেকে পড়ে বললে, ব্যানকুয়েট! আজ আবার কিসের পরব যে ব্যানকুয়েট হবে। মান্থলি ডিনারও তো পরশুদিন। অবাক করলে বাছা তুমি।

কিসের পরব? আজ তো পরবস্য পরব। গ্রেট বেলি-ডাসের গ্রেটার ব্যানকুয়েট। বেলি-ডানস্ দেখবে বুঝি একাদশীর ফাঁকা পেট নিয়ে? বেলি-ডাস্ দেখতে হয় ফুল বেলি নিয়ে। লিকউইড সলিডে হাফাহাফি। তা সে যাক গে। এসো আমরা দুজনাতে সেলিব্রেট করি ওই মারাত্মক অমিশনটা। শ্যাম্পেন খাবে? বলতে গেলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন গোত্রের কয়েকজন আমার কাছে আছেন। তোমার জন্য বাকেটে বরফ দিয়ে রেখেছি। ওই সেই ঘরটায় পাবে।

শিপ্রার বেশভূষা, তার মোটরগাড়ি দেখলে যে কোনও লোক ভাববে এ মহিলার যা রুচি, প্রতিটি আইটেম এমনই মানানসই যে তার বাড়ি, ড্রইংরুম ড্রাইনিংরুম নিশ্চয়ই অতিশয় নিখুঁত কায়দায় সাজানো– কোনওপ্রকারে কোনও জায়গায় ছন্দপতন হওয়া অসম্ভব। অথচ প্রথম দর্শনে স্মার্ট সেটের যে কোনও ব্যক্তি বিস্মিত হবে। ঘরের একপ্রান্ত থেকে যে কালারস্কিম আরম্ভ হয়ে শেষ প্রান্ত অবধি ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে যাবে, আর আসবাবপত্র কার্পেট কার্টেন ছাত দেয়াল, মাথার উপরের এবং চারদিকের আলো সেই স্কিমের সঙ্গে মিল খাইয়ে যেন একটা হারমনি গড়ে তুলবে এখানে সে কম্পোজিশন একেবারে নেই সে-কথা বলা চলে না, আবার আছেও বলা চলে না। এ কথা তো শিপ্রা-দেবীর বুদোওয়ার না দেখেও বলা চলে সেখানে দৃষ্টিকটু কিছুই থাকতে পারে না কিন্তু সেই অনিন্দ্যসুন্দর সামঞ্জস্যটা তো চোখে পড়ে না।

কিন্তু দু-তিন দিন ধরে সে ঘরে বসলে, চা খেলে তখন বোঝা যায় শিপ্রা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ঘরটি গুছিয়েছে। উদ্দেশ্য দুটি : আরাম এবং একবার এক জায়গায় আসন নিলে যেন ফের উঠতে না হয়। কোচ সোফার হাতার ভিতর থেকে অ্যাশট্রে, ড্রিংকের গেলাস রাখার রিং ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস তো বেরুবেই, ছোটখাটো ব্রেকফাস্ট খাবার মতো ফোল্ড করা একটা ফ্রেমও ঠিক ফিট করে যায় যার উপর বেয়ারা খাবারের ট্রে চায়ের সরঞ্জাম অনায়াসে রেখে যেতে পারে। আর পাঁচটা অতিশয় ফ্যাশনেবল ড্রইংরুমে বেয়ারা স্ন্যাক্স নিয়ে ঢুকলেই যে কী তুলকালাম কাণ্ড আরম্ভ হয় ভুক্তভোগী মাত্রই সেটা জানেন। পেগ টেবিলে স্ন্যাক্স ধরছে না, সেন্টার টেবিলটা অনেক দূরে–লে আও আওর একটু টেবিল ইত্যাদির মহা ঝামেলা। তারই ধাক্কায় ইতোমধ্যে গালগল্প টুকরো টুকরো খান খান।

শিপ্রার বক্তব্য : মানুষে মানুষে ভাবের আদান প্রদান, রসের দান ও গ্রহণ, অভিজ্ঞতার বিনিময়, একে অন্যের সঙ্গসুখ– এসব নিয়েই তো মানুষের সত্তা, তার অস্তিত্ব। ড্রইংরুম তো তারই কেন্দ্রভূমি। সেখানে যদি ড্রিংক স্ন্যাক পদে পদে বাধা দেয় তবে সেটা ব্যর্থ। নাই-বা হল আমার বুদোওয়ার আন্দ্রা মডার্ন।

জর্মন সিলভারের বালতিতে করে কীর্তি শ্যাম্পেন নিয়ে এসেই শুধাল, বল তো, ভাই, এই দুর্দিনে যখন এক ফোঁটা বিয়ারের জন্য অর্জুনের মতো পাতাল ভেদ করতে হয় তখন তুমি এই জাত শ্যাম্পেন পাও কোথা থেকে?

শিপ্রা আদর করে কীর্তিকে কাছে টেনে এনে বললে, তোমার এত ভয় কিসের? তোমার বেলা দেখি, ভয় করে তুই বিজয়ারে হারাবি? শ্যাম্পেন? সে-কাহিনী সরল, আর এক মিনিটে ফুরিয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে আমি কিছুকাল প্যারিসে ছিলুম। তখন এক গরিব ছোকরা ফরাসি আর্ট স্টুডেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় প্রায় প্রেমের কাছাকাছি। আমি সামান্য যেটুকু পকেটমানি পেতুম তাই দিয়ে তাকে প্রায় জোর করে একদিন অতি সস্তা দরের এক বোতল শ্যাম্পেন খাইয়েছিলুম। আমরা দেশে ফিরে এলুম। তার পর দশ বছরের ভিতরই সে হুশ হুশ করে আর্টের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে একদম হলিউডে পৌঁছে গেল। ওদিকে মিলিয়নেরদের পোট্রট এঁকে পয়সা যা কামায় সে প্রায় পিকাসোর সঙ্গে নেক টু নে। শ্যাম্পেনের পাইকিরি বিক্রির সময় তার এজেন্ট শ্যাম্পেন ডিসট্রিক্টে এসে হুজুরের জন্য যা কেনা হয় তার একটা হিস্যে সে পাঠিয়ে দেয় দার্জিলিঙের ঠিকানায় ঠাণ্ডায় মোলায়েম থাকবে বলে।

তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়?

শিপ্রা হেসে কুটিকুটি। কীর্তির গালে মোলায়েম একটা ঠোনা মেরে বলে, ওরে মূর্খ, লন্ডনে পাকা দু-দুটো বচ্ছর কি হাইড পার্কে ঘাস খেয়েছিস শুধু? সে যাচ্ছে ভেসে ভেসে দেশ থেকে দেশান্তরে, আমিও উধাও হচ্ছি কাঁহা কাঁহা মুলুকে। একদিন কোন খেয়ালের মোহে এজেন্টকে বলেছিল আমার যেন শ্যাম্পেনের অভাব না হয়; তার পর এতদিন সে হয়তো সে-কথা বেবাক ভুলে গিয়েছে তা সে যাক্। বেলি-ডাস্ কীরকম লাগল সেই কথা কও।

কীর্তির অল্প অল্প নেশা হয়ে আসছে। গোড়ার দিকের জড়ত্ব অনেকখানি কেটে গিয়েছে। ওদিকে শিপ্রারও মুখের রঙ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যুবতী রমণীর প্রস্ফুটিতা চোখ দুটিতে যেন ক্রমে ক্রমে কিশোরীর সদ্য বিকশিত ভাব ফুটে উঠছে।

কীর্তির মুখে কথা ফুটছে। আকস্মিক আমন্ত্রণের বিহ্বলতা কেটে যাওয়ায় ওজন করে কথা কইবার ধরন অনেক পিছনে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, আমি আর নাচটা দেখলুম কই? বরঞ্চ স্মার্ট মাস্টার সুদিনকে সুধিয়ো। আমি বার ছাড়ার সময় সেখানেতে নাচের টপিক নৃত্য করছে– তাণ্ডব নৃত্য।

মানে?

সংক্ষেপে বলতে গেলে হিং টিং ছট। সুদিন-বৈরীরা তারস্বরে ঘোষণা করছেন, ওই বেলি ডান্‌সে আছে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস এবং ভালগার ইঙ্গিত সর্বোপরি বেলি ডানস্ না আছে বেলি, না আছে ডান্স্। এর বেশি আমি তোমাকে বলতে পারব না। এটুকুও বলতুম না; খানিকক্ষণ আগে তুমি বলছিলে না, এটা একটা সোসাইটির প্যাটার্ন, তাই এটার উল্লেখ করলুম।

শিপ্রা সিগারেট খায় কালেভদ্রে। এবারে একটা ধরিয়ে ধীরে ধীরে বলল, আমার একটি বিশিষ্ট বন্ধু আছেন। তুমি তাঁকে বোধহয় চেন না– কারণ তিনি একদা ছিলেন কাইরো শহরের স্মার্ট সেটের ফ্রন্ট বেঞ্চার। উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে কাইরো অবধি– সবরকম নাচ তাঁর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আছে। তিনি একদিন আমাকে বলছিলেন, খাঁটি বেলি-ডান্স শিখতে হলে অন্তত বারোটি বছর একটানা রেওয়াজ করে যেতে হয়। আজ রাতে যে মেয়েটি নাচল সে-ও তো শুনেছি বারো বছর ধরে ট্রেনিং নিয়েছে। তাই আশ্চর্য লাগে, সুন্দুমাত্র ভালগার সাজেশন দেওয়ার জন্য বারো বছর ধরে ট্রেনিং!

সবকথা কীর্তির কানে তখন আর ঢুকছিল না।

সেটা শ্যাম্পেনের প্রসাদে নয়। বরঞ্চ তার খনে মনে হচ্ছিল নেশা কেটে যাচ্ছে, খনে মনে হচ্ছিল নেশাটা যেন চড়াৎ করে তালুর ব্রহ্মদেশে চড়ে বসছে। এবং এটাও তার জানা ছিল, দু পাত্র রস-সেবনের সময় স্রেফ ফুর্তি ছাড়া কোনও দুশ্চিন্তা বা অন্য কোনও সমস্যাকে আমল দিলে এরকম ধারা হবেই। সর্বোপরি তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিল একটা ক্রিকেটের মাঠ।

কীর্তি একদা ভালো ক্রিকেট খেলত।

কীর্তি মনের চোখে দেখছিল, পুরো এক বছর ধরে বিপক্ষ ব্যাটিং করছে আর তাকে ফিলডিং করতে দেওয়া হয়েছে আউট ফিল্ডে, একদম কানট্রি সাইডে। অথচ তার দৃষ্টিশক্তি সুতীক্ষ, ফাস্ট বোলিঙের বেলা সে আগেভাগেই ঠাহর করে নিতে পারে ব্যাটের কোণে লেগে বল কি করলে কোন অ্যাঙ্গেলে আসবে, বাং মাছের মতো সর্বাঙ্গে মোচড় খেয়ে প্রায় মাটি থেকে বল কুড়োতে পারে।

তথাপি ক্যাপটেন শিপ্রা তাকে পুরো একটি বছর ধরে তার পার্টিচক্রের রঙ্গভূমিতে তাকে যেন অ্যাপ্রেন্টেসি করালেন এক যুগ ধরে।

আর আজ? বড় বড় চাঁইদের উপেক্ষা করে, বলা নেই কওয়া নেই, একমাত্র তাকেই নিয়ে তিনি চলেছেন পিচ পরিদর্শনে।

.

০৪.

সর্ব বিশেষজ্ঞরা সম্পূর্ণ একমত, মানুষ যে সভ্যতার যাত্রাপথে এতখানি এগিয়ে গিয়েছে তার প্রধানতম কারণ মানুষ বংশানুক্রমে, পিতা পুত্রকে, এক পুরুষ পরের পুরুষকে তার অভিজ্ঞতা বিশদভাবে বর্ণনা করে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। তদুপরি প্রতি যুগের প্রতি পুরুষই পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতাকে উচ্চতর পর্যায়ে তুলবে বলে তার সংস্কার করেছে, নতুন অভিজ্ঞতা পূর্বতর ভাণ্ডারে যোগ দিয়ে সম্পূর্ণ সঞ্চয়কে পূর্ণতর করে তুলেছে।

শুধু একটি মারাত্মক, জীবনমরণ সমস্যার ব্যাপারে, সৃষ্টির সেই আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি।

তুমি কি আমায় ভালোবাসো? এ প্রশ্নটি শুধোবার বেলা পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য কোনও প্রাণীরই রত্তিভর কাজে লাগে না, এমনকি সমসাময়িক প্রতিবেশী, অন্তরঙ্গ ইয়ারদোস্তের উদাহরণ দিকনির্দেশ সম্পূর্ণ বেকার, বেফায়দা। দাদা আদমের আমল থেকে আজ পর্যন্ত তথা ভুবনবিখ্যাত মহাপুরুষরাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, মহাপ্রলয়ের পর নবসৃষ্টির প্রারম্ভেও মানুষ ওই প্রাচীনতম প্রশ্নটি শুধোবার সময় সেই প্রথমদিনের মতো বিলকুল হাবা বনে যাবে, কাতরাতে কাতরাতে যেসব ধ্বনি প্রকাশ করবে সেগুলো একদম সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কনফার্মড রাম-ইডিয়টের গোঙরানোর মতো।

ওদিকে আবার শিপ্রার চরিত্র বিচিত্র। এমনিতে মনে হয় সে আর পাঁচটা টপ ক্লাস সোসাইটি গার্লেরই মতো- গার্ল বললে স্বল্লোক্তি হয়, লেডি বললে আবার অতিশয়োক্তি হয়ে যায়। আজ চিত্রপ্রদর্শনীর দ্বারোঘাটন, কাল প্রধানমন্ত্রীকে মাল্যদান এসব কোনওপ্রকারের সামাজিক, রাজনৈতিক কর্তব্যকর্ম করতে সে সম্পূর্ণ বিমুখ যদিও দেশে এবং বিদেশে লেখাপড়াতে সে অসাধারণ না হলেও ডিবেটে ছিল অত্যুত্তম, উচ্চারণ ন্যাকামিবর্জিত। দোষের মধ্যে ছিল স্মার্ট সেটের মতো সে ট্যারচা ট্যারচা বাঙলা বলতে পারত না।

তার আসল বৈশিষ্ট্য ছিল আলাপ-আলোচনার সময় মারাত্মক সব অভিমত প্রকাশ করে স্মার্টেস্ট সেটকেও হাজার ভল্টের শক দেওয়া। পবিত্র, শাস্ত্রীয়, আচারসম্মত এ ধরনের শব্দ তার অভিধানে ছিল না, কারণ তার পিতাই সেগুলো স্বহস্তে মুছে সাফ করে দিয়েছিলেন।

তদুপরি তার সঙ্গে প্যারিস-লন্ডন করার পর কোনও জিনিস বা লজি আঁকড়ে ধরার মতো মনোবৃত্তি তার আর ছিল না। সামাজিক আচরণে কাউকেই খুব বেশি কাছে ঘেঁষতে দিত না, আবার হট যাও হট যাও সায়েবিয়ানা সে ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে কখনও দেখেনি বলে সে গন্ধ তার গায়ে ছিল না। কৈশোরে পুরো একটি বছরের অধিকাংশ সময় কেটেছে প্যারিসের লক্ষ্মীছাড়া লঝঝড়ে গরিব পেন্টারদের সঙ্গে। সাম্যবাদ ফ্রানসের পার্লিমেন্টে মূলমন্ত্র বটে কিন্তু তার পরিপূর্ণ সপ্রকাশ দেখতে হলে যেতে হয় লাতিন কোয়ার্টার মা সরস্বতীর সর্ব কলার চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, নৃত্য, আরও কত কী যে নিত্য নিত্য সৃষ্টি হয় ওইসব কলার পাগলা চেলাদের মাঝখানে, যারা তিন দিন ধরে একটা লোফ খায়।

কীর্তি এসব ডিটেল জানত না কারণ শিপ্রা ঘড়ি ঘড়ি তার প্যারিস ভিয়েনার জেল্লাই নিয়ে কথা কওয়া দূরে থাক, ইংরেজি সাহিত্যের কথা উঠলেও সার্ত বা মারলোকে টেনে এনে নিজের বক্তব্য জোরদার করবার চেষ্টা দিত না। কীর্তি শুধু জানত শিপ্রা প্যারিসে ছবি আঁকা আরম্ভ করে এবং এখনও চিলেকোঠায় ওই নিয়ে মাঝে মাঝে মশগুল হয়।

অতীতের ওইসব নানা পরিবর্তনের ফলে শিপ্রার চতুর্দিকে এমন একটি আবহাওয়া বিরাজ করত যে, ঘনিষ্ঠতার বাড়াবাড়ি না করেও সরল জন তাকে মনের কথা বলতে পারত। আর আমাদের শ্রীমান কীর্তিনাশকে নির্মাণকালে সৃষ্টিকর্তা যে প্যাচালো বুদ্ধির সংমিশ্রণ একদম করেননি সেটা ক্লাবের অগারাজ বেয়ারাটি পর্যন্ত জানত।

শ্যাম্পেনটাও পেটের ভিতর বুজু বুজু করছে।

কী করে যে হঠাৎ শিপ্রাকে শুধিয়ে বসল, সে-ই জানে না : আচ্ছা শিপ্রা, তুমি আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করো?… আই মিন, আই মিন আমাকে ভালোবাসো? তার পর আবার গবেটের মতো হুট করে বলে ফেলল, হাও সিলি!

গেলাসটা ছিল কানায় কানায় ভর্তি। চো করে এক হ্যাঁচকায় খতম করে খট করে সেটা টেবিলের উপর রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল।

কীর্তি ধরে নিয়েছিল, যে মেয়ে এতদিন ধরে কারও ফাঁদে ধরা দেয়নি– যদিও মাঝে-মধ্যে এর-ওর নামের সঙ্গে জড়িয়ে ওর বদনাম রটেছে আবার আপনার থেকেই সেটা কেটেও গিয়েছে সে বুঝি এহেন অবস্থায় স্মার্ট সমাজের সুপ্রচলিত পদ্ধতিতে খিলখিল করে হেসে উঠবে।

হল এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া।

ধীরে ধীরে আধ শোওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে কীর্তিকে কাছে টেনে দুই বাহু দিয়ে আলিঙ্গনে বেঁধে খেল চুমো। তার পর তার গালে-মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। কীর্তি নির্বাক, অসাড়। এমনকি চুম্বন-আলিঙ্গনের সময় যে সাড়াটুকু দিতে হয় তার বিহ্বল অবস্থায় সেটুকুও সে দিতে পারেনি।

রুদ্র তপস্যার বনে বহুত্রাসে অত্যল্প আশে ভীরু অপ্সরা যেরকম প্রবেশ করে কীর্তির প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল সেইভাবে।

উত্তরে সপ্তর্ষিমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারকারাজি উভয় হস্তে সপ্ত গ্রহের আকাশকুসুম বর্ষণ করে আচ্ছাদিত করে দিলেন এই ধূলির অতি সামান্য প্রাণী কীর্তিকে।

.

০৫.

শিপ্রারই বাড়িতে পার্টি। তার এক বান্ধবী ফিরেছেন হাওয়াই থেকে হনিমুন যাপন করে। তাদেরই অনারে সুন্দুমাত্র পরিচিত জনকে নিয়ে মাঝারি গোছের শো। সবাই হেথাহোথা ঘোরাঘুরি করছেন গেলাস হাতে করে। বেয়ারাদের হাতের ট্রেতে আছে হুইস্কি, কন্যাক, ভোদকা আর বিয়ার। বর্দো বার্গেন্ডি রাইন মজেলের রেওয়াজ এদেশে নেই বললেই চলে। জোগাড় করাও কঠিন, বিগড়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। কিন্তু শিপ্রার ওয়াইন-সেলার দার্জিলিঙের মোলায়েম আবহাওয়ায়। নিজেরও যেটুকু মোহ তা ওইসব কন্টিনেন্টাল দ্রব্যের প্রতি। সে-সবের জন্য ব্যবস্থা ড্রইংরুমের ভিতর। সেখানে যে দু পাঁচজন চিড়িয়া আসন নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই ফরাসি-জর্মন। তারা বিলক্ষণ অবগত আছে এই কলকাতা-সাহারায় শিপ্রাই একমাত্র ওয়েসিস্। সঠিক কোন টেম্পারেচারে এসব পানীয় ফুল্ল বিকশিত হয়ে এই ভিনদেশে স্ব-দেশের রস সুবাস বিতরণ করবে সে তত্ত্বটিতে শিপ্রা স্পেশালিস্ট।

লনের এক প্রান্তে আসন নিয়েছেন সুদিনাদি স্মার্ট কোম্পানি। কীর্তি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রত্যন্ত প্রদেশে। আজ বসেছে সানন্দে। আজ গারাজে বসতেও তার কণামাত্র ক্ষোভ নেই। এ উৎসবের হৃদয় পদ্মাসনে যে রাজার রাজা, বাইরের ভুবনে সে কোথায় কোন ধূলির ধূলিতে অবলুষ্ঠিত হল সে সম্বন্ধে কোন মূর্খ হয় সচেতন।

তদারকির রোঁদে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় শিপ্রা ক্ষণতরে কীর্তিকে উদ্দেশ করে বলল শুধু হ্যালো! ঠোঁটে সেই এক বছরের পুরনো মৃদু হাস্য। কিন্তু সুদিন জানে আজকের এ কণ্ঠস্বর এ মৃদু হাস্য এক ভিন্নবাসিনী ভানুমতীর মদনরসে মন্ত্রপূত।

ইতোমধ্যে বধূ এসেছেন সুদিনাদির সামনে।

সুদিন একগাল হেসে শুধল, কী গো সুন্দরী, হাওয়াই দ্বীপের হুলা হুলা ডানস্ রপ্ত করে এসেছ তো? এক চক্কর দেখিয়ে দাও না পাঁচজন রস-পিপাসুকে।

বধূ বললেন, নিশ্চয়, কিন্তু হাওয়াইয়ের সেই ঘাস পাব কোথায়, নাচের ঘাগরা বানাবার তরে?

সুদিন বললে, সে আর এমন কী বিপত্তি। রাজকুমারী জাহানারা যে মসলিন পরে ঔরঙ্গজেবের সামনে সগর্বে উপস্থিত হয়েছিলেন সেটা জোগাড় করতে কতক্ষণ! সেইটে ফালি ফালি করে ঘাগরা বানিয়ে যদি পরেন–

শঙ্কর বলল, কী বেরসিক রে, বাবা। চাঁদের আলোর টানা আর রামধনুর পোড়েন দিয়ে বোনা হবে সে ঘাগরা। মিলকি উইয়ের দুধ দিয়ে সেটি থাকবে ভেজানো– তবে না সেটি লেপটে থাকবে সর্বাঙ্গে। তবে না দেখা যাবে নৃত্যের তালে তালে প্রতিটি পেশির আন্দোলন, সঙ্কোচন, সম্প্রসারণ।

ইতোমধ্যে বর-কনে এগিয়ে গেছেন আরেক দলকে হেঁ হেঁ করার জন্য।

চৌধুরী আখতর হুসেন শঙ্কর মিত্রকে ফিসফিসিয়ে বললেন, বুড়ো ধেড়ে কাক। সাতান্ন ঘাটের পানি খেয়ে শেষটায় বিয়ে করল নাতনির বয়সী মেয়েটাকে!

মিত্তির বলল, চৌধুরী, আমাদের সোশ্যাল সিসটেমটা তুমি আদৌ বুঝতে পারনি। পুরুষগুলো তো যায় গোল্লায়–ওই যে বললে সাতান্ন ঘাটের ঘোলা জল খেয়ে খেয়ে। বিয়েও যদি করে ওই ঢপের হাফ-বাইজিগুলোকে তবে জাতটা যাবে উচ্ছন্নে। অন্তত একটা সাইড তো ক্লিন রাখা দরকার।

নৃতত্ত্ব আর এগুলো না। কারণ ইতোমধ্যে একটি তরুণী লাভারসহ উপস্থিত। ইনি সদ্য উনিশে পা দিয়েছেন বলে ক্লাবের প্রাচীন মেম্বার তার পিতা তাকে সোসাইটি করতে অনুমতি দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে রসালাপ বন্ধ হয়ে গেল।

এদের এই একটা মহৎ গুণ এক লহমায় ভোল পালটাতে জানে। এই ছিল জল-বিছুটি আর এই হয়ে গেল ধোয়া তুলসীপাতা। চৌধুরী বলল, কী গো মিস্ ডাট, বিলেত যাওয়ার কদ্দূর?

ঠোঁট বেঁকিয়ে সুভা বললে, ফরেন একচেঞ্জ পাব কোথা?

মিত্তির বললেন, লাও! আম্বালাল কস্তুরভাই আছে কী করতে? তার তো দেদার ফরেন টাকা? তোমার পিতৃদেবের লিগেল এডভাইস ভিন্ন দু বান্ডিল বিড়ি কেনে না। সে তোমাকে লন্ডন-অক্সফোর্ড যেখানে প্রাণ যায় সর্বত্র পাউন্ডের দরিয়ায় ডুবিয়ে রাখবে। তোমার আবার ভাবনা কী?

সুভা একটা মামুলি উত্তর দিয়ে কেটে পড়ল। এসব হচ্ছে কথার কথা– নিতান্ত কিছু একটা বলতে হয় বলে প্রসঙ্গটা উঠেছিল। নইলে আমাদের এ গোষ্ঠীর কোনও একসচেঞ্জেরই কোনও ভাবনা নেই।

সর্বশেষে চৌধুরী ধীরে ধীরে প্রত্যেকটি কথা ওজন করে বললে, ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে হয়ে আসছে। ফরেন টাকার কুমির তো শেঠ চন্দ্রবদন। ইংলন্ডে আছে প্রায় লাখখানেক পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি। তারা প্রতি বছর দেশে পাঠায় কয়েক কোটি টাকা। শেঠজিও তাদের কামানো পাউন্ড কিনে নেয় সরকার যে রেটে টাকা দেয় তার চেয়ে বেশকিছু বেশি মুনাফা দিয়ে। ওদিকে শেঠজি খবর পাঠায় নারায়ণগঞ্জে তার আমিনকে সিলেটের অমুক শেখকে অত টাকা পাঠিয়ে দাও। এতে করে

এক হাফ-আনাড়ি বাধা দিয়ে বলল, নারায়ণগঞ্জে শেঠজি পাকিস্তানি টাকা পায় কোথায়? সেখানকার মিল কারখানা তো সব আদমজি ফাঁসি পশ্চিম পাকিস্তানিদের। সেখানে শেঠজির কোন ধান্দা যে তহবিল গড়বে?

চৌধুরী মিষ্টি হেসে বলল, তুমিও যেমন! আদমজির টাকা খাটে অমৃতসরে শেঠজি মারফত অ্যান্ড ভাইস ভারসা। আচ্ছা, না হয় মেনেই নিলুম তোমার আজগুবি গুল। এই কলকাতার শহরে ইন্ডিয়ান টাকা দিয়ে কিনতে চাও কত লক্ষ পাকিস্তানি টাকা খাসা সস্তা ভাওয়ে? সিলেটের মোকামে পাকিস্তানি টাকাটা পাঠিয়ে দেবার জিম্মাদারি তো ওই পাকিস্তানির শেঠজির কী?

কীর্তি এতক্ষণ চুপচাপ বসে একটা গেলাসও শেষ করতে পারেনি। আসলে তার শরীরে পাড় মাতালের রক্ত নেই। সে নয়া নয়া করে দেখছিল, গতরাতের স্বপ্ন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, উল্টেপাল্টে। আর দেখছিল, শিপ্রার দ্রুতপদে আসা-যাওয়া ছোট্ট দুটি পা ঘিরে শাড়ির পাড়ের খেলা। মেমসায়েবদের ফ্রক হয় শতেক ধরনের। প্রতি বচ্ছরে আবার মরসুম-মাফিক বার তিন-চার কাট বদলায়, ভোল পালটায়। সবকটাই যে এক্কেবারে ফেলনা সে কথা বলা চলে না কিন্তু এত চেষ্টা এত জিনিয়াস খাঁটিয়েও প্যারিস এমন একটা ফ্রক বানাতে পারেনি যেটা দুটি পা ঘিরে ঘিরে শাড়ির পাড়ের যে নৃত্য তার কাছে আসতে পারে। তার ওপর শিপ্রার চলনভঙ্গিটি তার কোমরের বাঁকা-সোজা নড়াচড়া, কাঁধের ডাইনে-বাঁয়ে হেলে পড়াটার সঙ্গে এমনই মিল রেখে নিয়েছে যে তার হেথা-হোথা আসা-যাওয়াটাই পাঁচজনের চোখ ভরে দেয়। পাড়টি যেন আল্পনা এঁকে এঁকে সমস্ত লন্টা ছেয়ে ফেলল।

কে কান দেয় তখন আদমজির ফরেন টাকার দিকে আমাদের কীর্তিবাবু না জানেন পলিটিক্স, না বোঝেন ইকনমি। তবু তার কানে গেল শেষ কথাটা চৌধুরীর :

এবার কিন্তু সবকিছু আবার হয়তো ঢেলে সাজাতে হবে। আওয়ামী লীগ জিতেছে ইলেকশানে উইদ এ থান্ডারিং মেজরিটি। দরিয়ার বাকিটুকু ভালোয় ভালোয় পেরুতে পারলে লীগওয়ালা আদমজি ফাঁসির থাউজেন্ড পার্সেন্ট মুনাফা বরদাস্ত করবে না।

সুদিন বললে, সে তো শুধু কেচ্ছা। আখেরে হয়তো-বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদম কেটে পড়বে। কে জানে, হয়তো-বা পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যাবে।

অ্যাঁ? হঠাৎ যেন কীর্তির কানে জল গেল। ওই স্বাধীনতা শব্দটার সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে। ছেলেবেলা থেকেই সে যা খুশি তাই করেছে। কালেভদ্রে যখন নিতান্ত বাধ্য হয়ে অনিচ্ছায় কোনও কিছু সয়ে নিতে হয়েছে তখনই পেয়েছে দারুণ পীড়া।

একবার শিপ্রাকে কথায় কথায় বলেও ছিল, বিবেক নামক ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমার পরিচয় বড়ই কম। কিন্তু তিনিও মাঝে মাঝে মোকা পেয়ে যখন চাপ দিয়ে আমাকে বাধ্য করেন অপ্রিয় সব কাজ করতে তখন আমার জানটা যেন ঠোঁটের কাছে এসে খাবি খেতে থাকে। বিবেকের চাপ কর্তব্য বাবুর চাপ বাপরে বাপ। এর ওপর আবার বাইরের চাপ। গোলামি!

সুদিন বললে, ওহে কীর্তিবাবু, চুপচাপ বসে বসে টুকুস ঢুকুস করছ যে বড়। অ্যাদ্দিন তুমিই তো, বাবা, ছিলে শিপ্রাদেবীর প্রতি পার্টিতে এডিকং! আজ সব ঝক্কি ওরই ওপর ছেড়ে দিলে কেন বল তো।

তা নয় সুদিনদা! আজ যাদের অনারে পার্টি ওদের ইয়ার-দোস্তও এসেছেন জনাকয়েক। ওঁরা তো নিত্যি নিত্যি এখানে আসেন না। আমার মতো পাকা নন–ওরা ঠিকে। আজ ওদের একটা চান্স্ দিতে হয়। দেখছ না, ম্যাডামকে হেল্প করার ছলে থার্ড ক্লাস বেয়ারার চেয়েও আনাড়ি সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু শ্রীমতীর সঙ্গে দু এক দফে রসালাপ করার সুযোগ পাচ্ছে তো।

সার্ভিসের কথা তুলছ কেন? ওদের বাপ-ঠাকুরদা বাটলার ছিল না কি?

লন্ডনের ক্ল্যারিজে চিফ ওয়েটারও সার্ভিসে তোমার কাছে হার মানবে। তোমার ঠাকুর্দা তো ছিলেন কোম্পানির মুৎসুদ্দি। তবে–

চোক্কর ছোকরা।

ঘণ্টা দুই হয়ে গেল পার্টি আরম্ভ হয়েছিল। এখন একা, জোড়া জোড়া, একসঙ্গে জনা তিনা বিদায় নিতে আরম্ভ করলেন। কোন এক সংস্কৃতের কবি বলেছেন, যেন পরাজিত বাহিনীর সৈন্যরা এক্কা দুক্কা হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। আরেকটা ছোটখাটো দল চলল একসঙ্গে ওদের অন্য একটা পার্টিডিনারে নেমন্তন্ন। শিপ্রা আগের থেকেই মাফ চেয়ে নিয়েছিল। এ পার্টির দু একজন বানচাল হয়ে যাওয়াতে সুদিন আর কীর্তি তাদের যেন আদর করতে করতে ড্রাইভারদের জিম্মায় মোটরে তুলে দিল। দু একজন সুপ্ত এবং অর্ধসুপ্ত। তাদেরও তুলে দেওয়া হল তদ্বৎ।

সুদিন বলল, কীর্তি ভায়া, এবারে আরামসে একটা শেষ ড্রিংক খাই তোমার সঙ্গে। এসব পার্টিতে এতসব রকমারি চিড়িয়া আসে যে প্রাণখুলে কথা বলা যায় না, আর প্রাণ খুলে কথা কইতে না পারলে গলা খুলে রস পান করবে কী করে?

লনের সুদূরতম প্রান্তে দুজনাতে বসে চুপ করে রইল।

শিপ্রা শেষ গেস্টকে বিদায় দিয়ে ধীর পদক্ষেপে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।

সুদিন দাঁড়িয়ে উঠে বলল, বসুন।

এরা আপনজন। তাই শিপ্রা বলল, না, ভাই, আমি নাইতে চললুম।

ড্রিংক শেষ করে সুদিন উঠল। বললে, আমি ব্ল্যাক ক্যাট-এ যাচ্ছি। তুই আসবি, এখানকার কাজ শেষ হলে?

বেয়ারাদের বিদায় দেওয়া থেকে আরম্ভ করে আরও পাঁচটা কাজ রাউন্ড আপ করার ভার প্রতি পার্টিতেই পড়ে কীর্তির ঘাড়ে।

সুদিন বলল, তোর অনারারি নোকরিটাতে কি কোনওকালে প্রমোশন পাবিনে?

কীর্তি হেসে বলল, কড়া কনট্রাক্ট করা আছে, অনারারি– ঠিক হৈ। কিন্তু, দাদা, পার্মানেন্ট।

.

০৬.

কীর্তি

শিপ্রা?

হ্যাঁ। শোনো। বেড়াতে যাবে? মোটরে। পুরো দিনটা। ফিরতে রাত দশটাও হয়ে যেতে পারে। কোথায় যাব? সে তো তুমি ঠিক করবে। আমি মেয়েছেলে, একটা শখ জানালুম। তুমি পুরুষমানুষ। শেষ ডিসিশন তো তোমার হাতে। হ্যাঁ, একটা সুটকেস নিয়ে এসো— যদি ব্রেকডাউন-টাউন হয়ে যায়। আর সব আমি নিচ্ছি। শিগগির এসো!

কীর্তি ভাবল, হুঁ সে পুরুষমানুষ, কুল্লে ডিসিশন তার হাতে। দু রাত্তির যেতে না যেতেই যে শিপ্রাচক্রের প্রত্যন্ত প্রদেশে সে লিকলিক করত হঠাৎ হয়ে গেল সে চক্রের চক্রবর্তী। নিজেকে সাতিশয় মহিমান্বিত পদে উন্নীত দেখেও তার থেকে অবিমিশ্র আনন্দ আহরণ করতে পারল না। সে বহুদিন বার বার অনুভব করেছে, শিপ্রার কমন সেন্স, সাংসারিক বুদ্ধি তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। যাকে বলে কালচার সেখানে তো কোনও তুলনাই হয় না। সর্বোপরি কি স্ত্রীলোক কি পুরুষ কস্মিনকালেও কেউ কড়েআঙুলটি তক্‌ তুলে ইঙ্গিতমাত্র দেয়নি তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে বিকট একটা পৌরুষ ভাব।

সে ড্যুক অব এডিনবরা হতে রাজি আছে সানন্দে। কিন্তু রানি এলিজাবেথের সিংহাসনে বসতে যাবে কোন দুঃখে?

ভরসাও অবশ্য আছে, শিপ্রা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাকে যে অযথা অকূল দরিয়ায় ডোবাবে সেটা একেবারেই অসম্ভব। যে মেয়ে কি না ইহজনে কোনও বেয়ারা-বয়কে ডিসমিস করেনি। কলকাতা শহরে রীতিমতো লজ্জাকর রেকর্ড।

তা সে যাকগে। অত ভেবে কী হবে? কিন্তু ভাবনাটা সুখ দিচ্ছে যে।

.

যাত্রারম্ভের শেষ ফিনিশিং টাচ সমাপন করে শিপ্রা শুধাল, তুমি চালাবে? ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে।

আঁতকে উঠে কীর্তিনাশ বললে, সর্বনাশ! তবেই হয়েছে। তোমাকে কেউ বলেনি আমি নিজে যখন গাড়ি চালাই তখন সেটাতে মড়া লাশকেও লিট দিতে রাজি হইনে। করব অ্যাকসিডেন্ট, পুলিশ বলবে তারই ফলে লোকটা মারা গেছে।

স্টিয়ারিঙে বসে শিপ্রা বলল, ফাজলামো রাখো। সোভানি মোটরের জউরি। তার মুখে নিদেন একশোবার শুনেছি তোমার মতো মোটর মেরামতির হুনুরি এদেশে তো নেই-ই, জর্মনিতেও মেলা ভার।

কে বলেছে? সোভানি? তা তো বলবেই। আহা, কালকের পার্টিতে যদি দেখতে তার নৃত্যকলা। তুমি তখন লনের অন্য কোণে, কোন এক কন্সাল না কী যেন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মোলায়েম করছিল। এদিকে সোভানি তার ইয়া আড়াইমণি লাশটাকে লনের উপর বিন ঠেকনা দাঁড় করাতে পারছেন না, ওদিকে সে অন্ধ্রের ফিল্ম স্টার গোলাবাম্মাকে ভরতনাট্যমের কী একটা দারুণ জিগজাগ স্টেপ দেখাবেই দেখাবে। দু পাত্তর টেনেই মগজটি গোবলেট। ভরতনৃত্য সশরীরে দেখাতে গিয়ে দু হাতের চেটো উল্টো করে কোমরে রাখল লখনৌয়ের বাইজি স্টাইলে। তার পর সে হাতির পায়ের সাইজের এক-একখানা থাবা দিয়ে দেখাতে লাগল হরেকরকম মুদ্রা। কী একটা গানও ধরেছিল বুঝি বাজত ঘুঙুরিয়া না কী যেন। শেষটায় জড়ানো গলায় গোলাবাম্মার দিকে সাতিশয় বিনয় লাজুক নয়নে তাকিয়ে বলল, আপনার মতো গুনিনকে বুঝিয়ে বলতে হবে না– সেটা হবে কেরিইং কোল টু এ বার্ড ইন দি হ্যান্ড এ নৃত্যটার মূল বক্তব্য হচ্ছে তন্বঙ্গী শ্রীরাধা রসরাজ কেষ্টঠাকুরকে তাঁর পূর্বরাগ নিবেদন করছেন।

শিপ্রা খুশি হয়ে বললে, পার্টিটা তো তা হলে দারুণ সাকসেসফুল হয়েছিল। আর কী দেখলে?

সেটা ঘটেনি তাই দেখেছি বলি কী প্রকারে?

যথা–

বাসন্তী আর সুশান্ত তো চিরন্তনী মানিকজোড়। পার্টি-পরবের কথা বাদ দাও, তারা হাঁচেন একসঙ্গে, কাশেন এক সুরে। কাল দুজনা বসেছিলেন পার্টি নদীর দু পারে– চখাচখীর মিলন হয় না, জানো তো। এ তারও বাড়া। যেন চিরবিরহের সতীদাহে দু পারে দুজন দগ্ধ হবেন! মাঝে মাঝে আবার একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাপস। তখন চোখ থেকে আগুনের যা হল্কা বেরুচ্ছিল, আমি তো ভয়ে মরি, তোমার সাধের বাড়িটাতে আগুন লেগে যায়।

আরও বিস্তর দেখবার ছিল, শোনবারও ছিল। হ্যাঁ, পুব বাঙলার পলিটিকস্ নিয়ে দেখলুম দু একজন চিন্তিত।

শিপ্রা বলল, তুমি তো খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোও পড় না, সে আমি জানি। আর আমি পড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ব্যাপারটা সত্যি বড্ড খারাপ মোড় নিচ্ছে।

কীর্তি বুঝল, শিপ্রা পুব বাঙলার পলিটিটা খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুধাল, আমাদের কি বিশেষ গন্তব্যস্থল আছে?

শিপ্রা বলল, রসো, গঙ্গা পেরোই। তার পর তুমি স্থির করবে। বোলপুর যাবে? শান্তিনিকেতন?

কীর্তি বলল, বোলপুর হ্যাঁ। তার পর ঈষৎ কাতর কণ্ঠে বলল, শান্তিনিকেতনে যেতে কিন্তু আমার সঙ্কোচ বোধ হয়, এমনকি ভয় করে।

শিপ্রা আশ্চর্য হয়ে শুধাল, কেন?

ওখানে সঙ্গীত নৃত্য এসব তো আছেই তার ওপর সেখানে হয় নানাপ্রকারের বিস্তর রিসার্চ। এসব তো আমি জানিনে, বুঝিনে। কারও না কারও সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। তখন তিনি যদি কোনও প্রশ্ন শুধান বা আলোচনা পাড়েন তখন আমি মুখ খুললেই তো চিত্তির। আবার একদম চুপ করে থাকাটাও অভদ্রতা।

এ তোমার বাড়াবাড়ি, আমি ভালো করে জানি, তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বহু বৎসর ধরে মন দিয়ে পড়ছ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালেকশন তোমার যা আছে সেটা রীতিমতো বিরল।

কীর্তি করুণতর কণ্ঠে বললে, ভাই, সে আমার নিতান্ত আপন আনন্দ। কিন্তু আটঘাট বেঁধে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় ওই দিয়ে কিছু বলতে যাওয়া তো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া।

শিপ্রা বাঁ হাত দিয়ে কীর্তির উরু চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, থাক না তা হলে আশ্রমদর্শন। এগোই তো উপস্থিত পশ্চিম দিকে। তার পর দেখা যাবে।

কীর্তি বললে, তুমি আমাকে ভুল বুঝলে আমার দুঃখের অবধি থাকবে না। যাকে বলে রবীন্দ্রদর্শন তার সঙ্গে আমার পরিচয় অতিশয় নগণ্য। তবু আমার একটা অন্ধবিশ্বাস– বরঞ্চ বললে ভালো হয় আমার ইনসটিকটু বলে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ এই দুটি লোক যা করে গেছেন সেটা পরিপূর্ণভাবে আপন বুকের রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে, ওই দিয়ে মগজের সেলগুলোর গঠন পালটে নিতে আমাদের আরও একশো বছর লাগবে।

শিপ্রা বলল, জর্মনরাও বলে গ্যোটেকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে তাদের আরও একশো বছর লাগবে। একাধিক চিন্তাশীল লোক বলেছেন, গ্যোটের নির্দেশ যদি সত্যিই আমরা আমাদের চিন্তাধারায়, আদর্শ নির্মাণে মেনে নিয়ে থাকতুম তা হলে হিটলারের আবির্ভাব হত না।

শীতকালে পশ্চিম বাঙলার বিশেষ করে বর্ধমান বীরভূম অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি থাকে না। তবে লক্ষ করলে প্রকৃতির একটা দিক মাঝে মাঝে বড়ই চমক লাগায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। শার্সি দিয়ে তাকিয়ে ঠাহর করা গেল না দেবতা আকাশে উদয় হয়েছেন কি না। তার পর হঠাৎ এক ঝটকায় সব দুনিয়া সাফ, আসমান জমিন এমনকি হাওয়াটাও যেন আলোয় আলোময় হয়ে গেল। রাজা অনেক আগেই আকাশের বেশ উঁচু জায়গায় সিংহাসনে আসন নিয়ে বসেছিলেন। সামনে ছিল যবনিকা। লগ্নকাল প্রত্যাসন্ন হওয়ামাত্রই রাজাদেশে দ্বারী চক্ষের পলকে সে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছে।

আজ কুয়াশা কাটল ধীরে ধীরে। মোটরও এগিয়েছিল সাবধানে। শ্রীরামপুর পেরনোর পর শিপ্রা বলল, এরই কাছেপিঠে ডাইনে মোড় নিলে একটা পুকুর আছে। উঁচু পাড়িতে ছোট-বড় গাছ-গাছালি, রোদ্দুরটা পিঠ তাতালে সতরঞ্চি একটু সরিয়ে নিলেই হল। কিংবা বর্ধমান পেরিয়ে বাবার বন্ধুর বাগানবাড়ি। দশ বছর ধরে ফাঁকা। একটা মালী আছে মাত্র। কোনটা পছন্দ? আমার কোনও চয়েস নেই।

এই শীতের সকালে চলাটাই লাগছে বেশ, বসাটার চেয়ে।

যদিও ফ্লাস্কে বিস্তর চা-কফি ছিল তবু একটা পেট্রল স্টেশনের পাশে দরমার দোকানের বেঞ্চিতে দুজনাতে চা খেতে বসল।

কীর্তি দোকানিকে শুধাল, ব্যবসা-বাণিজ্য কীরকম চলছে?

অত্যন্ত সবিনয়ে বললে, আমাদের খদ্দের তো গরুর গাড়ি। এখন বাবুরা হুশ করে মোটরে চলে যান। রাস্ দাঁড়ালে সেও-বা কতক্ষণ। গরুর গাড়ি কমে যাচ্ছে। দোকানটাকে তাই খাড়া করতে পারছিনে।

শুকনো দরদ শোনাবার মতো এদের দুজনার কেউ নয়।

কীর্তি বললে, এটা বাঙলা দেশ, আবার ঢাকা-সিলেটও বাংলাদেশ। কিন্তু আমার মনে হয় বাস, মোটর বোধহয় বাঙলা দেশের নৌকোকে এতখানি ঘায়েল করতে পারেনি। তুমি কখনও বাঙলাদেশে গেছ?

হেসে বললে, খাঁটি বাঙালদেশের মাটিতে কখনও পা ফেলিনি কিন্তু বাংলাদেশে গিয়েছি। কোন এক স্টিমার কোম্পানির কী যেন এক পরবে কলকাতা থেকে সেঁদরবন হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট না কী যেন। কী সুন্দর দেশ, কী বলব। পরে আরও বলব, এখন চল।

মোটর চালাতে চালাতে কিন্তু শিপ্রা বলে যেতে লাগল প্যারিসের গল্প। কথায় কথায় শুধাল, তুমিও তো প্যারিসে ছিলে?

আমি একটা অপদার্থ। মোকামে পৌঁছাই। সব বলব।

.

০৭.

বাগানবাড়িটি শৌখিন নয় বটে কিন্তু মালীটাও আলসে নয়।

বাড়িটার প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তার তিন দিকের প্রান্তর পরিমাণ বারান্দাগুলো। বাগান, রাস্তা পেরিয়েই কাটা ধানে খোঁচা খোঁচা শূন্য ক্ষেত। দিগন্তে গ্রামের সবুজ আভা। মালী প্রাচীন দিনের, অধুনা লুপ্তপ্রায় আরামদায়ক দু খানা ডেক-চেয়ার পেতে দিয়েছে। মোটর থেকে বের করে সতরঞ্চি-কুশনও।

শিপ্রা বললে, রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা, আর তোমাদের গানে আছে, দুপুরবেলার পিজি গো সন্ধেবেলার উ-ই-স্কি। কী খাবে বল।

বিলিতি পিনক জিন এদেশের বেয়ারা-বুলিতে পিনজিন। ছোট্ট গেলাসে প্রথমে কয়েক ফোঁটা বিটারস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গেলাসে জি ঢালা হয়। এটাকে জিন অ্যান্ড বিটাও বলেন কেউ কেউ। তবে এদেশে, বিশেষ করে গরমের দিনে, জিনের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা পাতিলেবুর রস দিয়ে গিমলেটটাই পছন্দ করেন স্মার্ট সেটের অধিকাংশ মেম্বার।

কীর্তি সঙ্গে সঙ্গে বললে, না, আমি সাদা চোখে কথা কইব।

শিপ্রা আতঙ্কের ভান করে বললে, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন গো? তুমি কি জর্মন আর আমি ফ্রান্স যে যুদ্ধশেষে সন্ধির শর্ত নিয়ে দরকষাকষি করতে এসেছি?

প্রথমটায় সামান্য একটু হকচকিয়ে কীর্তি হেসে বলল, ধরো তাই। কিন্তু আমার কোনওই শর্ত নেই। এতটা কাল আমি তোমার ভিতরের গণ্ডিতে ছিলুম না। তবু জানতুম, তুমি যে ধরনের মানুষ আমি কিছু চাইলে এ ধরনের লোক না বলতে পারে না। তবে এখন, আমি বলছি এখন, তোমার কাছে আমি কোনও কিছু চাইব কেন? যদিও আমি আমার সর্বাঙ্গে গৌরবের কাঁথা জড়িয়ে তোমার কাছে ভিখিরির মতো দু হাত একজোড় করে এককণা খুদের তরে উচ্চকণ্ঠে আবেদন আর দাবি দুই-ই জানাতে পারি।

শিপ্রা বললে, আমি যখন নিজের থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তোমার বুকের কাছে এসেছি তার সরল অর্থ, এবং আমার অধিকার তুমি আমাকে তোমার ডানার ভিতরে খুঁজে নিয়ে সর্ব বিপদ সর্ব আঘাত থেকে রক্ষা করবে। যেখানে কনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও কথাই ওঠে না, সেখানেও পিতা যখন সম্প্রদান করে তখনও তো বর জানে তার ঘাড়ে কী দায়িত্ব চাপানো হল। আর

বাধা দিয়ে অবিমিশ্র সরল এবং অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে কীর্তি বললে, অপদার্থ। আমি যে কত বড় অপদার্থ সেইটে আমি জানি এবং সেটা তুমি আমাকে আজ এখানে না আনলে আজ দুপুরে তোমার বাড়িতে গিয়ে সেইটে ভালো করে বুঝিয়ে আসতুম। আমার মাত্র ওই একটি বক্তব্য আছে : সেটা আমি অপদার্থ।

তথ্যটা যাতে করে শিপ্রার চৈতন্যে গভীর দাগ কাটে তাই কীর্তি অপদার্থ শব্দটার ওপর পুরো জোর দিয়ে চুপ করে রইল।

তত্ত্বটা সত্য হোক মিথ্যে হোক, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কীর্তিকে যারাই চিনত তারাই জানত, ওর ভিতরে রত্তিভর ভড়ং নেই এবং সে যে অপদার্থ সেটা তার সরল, স্বাভাবিক অকৃত্রিম বিশ্বাস।

পক্ষান্তরে স্মার্ট, নন্-স্মার্ট সব চক্রই আপন আপন অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসন্দেহে সোৎসাহে হলপ নিতে এগিয়ে আসত যে শিপ্রার মতো স্থির বুদ্ধিধারিণী কন্যার মাথায় হাত বুলোতে পারে এহেন ধুরন্ধর মহানগরীতে বিরল–সর্বসমক্ষে বুলোয় একমাত্র তার চাকর বেয়ারা ঝি আয়া।

তা হলে প্রশ্ন, জেনে-বুঝে এই শিপ্রা অপদার্থ কীর্তিকে তার পার্টি রাউন্ডে ইনকাম ট্যাক্স্ অফিসারের সঙ্গে বচসা করার জন্য অবশ্য ব্রিফিংটা পুরোপুরি শিপ্রারই পাঠায় কেন? অবশ্য সেটা যে খুব একটা চোখে ঠেকত তা নয়। আর পাঁচজনকেও সে এ-কাজ ও-কাজের ভার দিত। তারাও সানন্দে কর্ম সমাপন করে দিত। তার কারণটাও জলের মতো পরিষ্কার। এই জটিল কলকাতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক করপরেশনিক যুক্তফ্রন্টিক গোলকধাঁধার ভিতরে-বাইরে বহুজনকে নিত্য নিত্য এমনসব ব্যক্তিগত লজ্জাবতী-লতার মতো সাতিশয় ডেলিকেট সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় স্থলে বুদ্ধিমতী যে রমণী তার মৃদুহাস্য, তার দরদিয়া অনুরোধ, তার মোহনিয়া ছল-কাতরতা দিয়ে গ্রন্থিমোচন করে দিতে পারে অধিকাংশ সমস্যাঁতেই।

অবশ্য নিঃসন্দেহে বলতে হয়, শিপ্রার চাণক্যদত্ত এই কূটনৈতিক দক্ষতার খবর জানত অতি অল্প লোকই। সর্বসমক্ষে সে তাবৎ পার্টির প্রাণ, তাবৎ ক্লাবের জান্।

সেই শিপ্রা এই অপদার্থ কীর্তিটাকে কী তবে বাদরনাচ নাচাচ্ছে?– যদিও সে যে শিপ্রার প্রসাদ পেয়েছে সেটা মাত্র দু দিনের ভিতর কারওরই জানার কথা নয়। কাল যে পার্টি হয়ে গেল সেখানেও কীর্তিবাবু ছিলেন ঐতিহ্য অনুযায়ী পূর্ববৎ পার্টিফিন্ডের লাইনসম্যান। কোথায় ভুবন-ভাগানের ক্যাপটেন শিপ্রা, আর কোথায় সে!

কিন্তু বাঁদরনাচ নাচানো মেয়ে শিপ্রা নয়।

শিপ্রা তাকিয়ে আছে অলস নয়নে রাস্তার দিকে। সাঁওতাল মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় একে অন্যের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নিচু গলায় কোরাস গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে হাট থেকে কেনাকাটা সেরে। সাওতাল পুরুষের চিহ্নমাত্র নেই। একটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু চলেছে জোড় না মিলিয়ে। হাতে একটা কঞ্চি। সেটা দিয়ে কখনও-বা আস্ফালন করে, কখনও-বা দু কদম নেচে নেয়, কখনও-বা কঞ্চি দিয়ে অন্য মেয়েগুলোকে শাসায় আর তারা খিলখিল করে হাসে। আসলে সাঁওতাল মেয়েরা হাটেবাজারে তাড়িকাড়ি খায় না। এ মেয়েটা ব্যত্যয় এবং সাতিশয় ব্যত্যয়। বেশ খানিকটে গিলেছে। তাই তার এই ফুর্তি।

শিপ্রা তাড়াতাড়ি কীর্তিকে দৃশ্যটা দেখিয়ে বললে, দেখো দেখো, এই মেয়েটা হচ্ছে আমার সাওতাল সংস্করণ– ওদের সোসাইটি গার্ল।

কীর্তি প্রথমটায় আদৌ বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা কী। বললে, ছিঃ! এ মেয়েটা তো রীতিমতো বে-এক্তেয়ার।

শিপ্রা বললে, আহা, তুমি কিছু বোঝ না। ভিন্ন ভিন্ন সোসাইটির ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নের বে-এক্তেয়ারির রকমফের হয়। আমাদের অজ পাড়াগাঁয়েও দু একটি মেয়ের উড়কু উড়ুক্কু ভাব থাকে তোমরা যাকে বল, ফ্রাইটি গার্ল, একেবারে যেন শব্দে শব্দে অনুবাদ। তার ফষ্টিনষ্টি আর প্যারিসিনীর অর্ধোন্মত্ত তাণ্ডব লম্ফঝম্ফ কি একই প্যাটার্নের তবে হ্যাঁ, যেখানে মদের প্রচলন নেই সেখানে এসব ব্যাপারে মাত্রাধিক্য হয় না। তার পর বেশ কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করে বলল, জানো কীর্তি, আমি অনেক দেশ দেখেছি; আমার জানা মতে পুব বাঙলার একটা বৈশিষ্ট্য যে ওরা মদ খায় না। চাষাভূষো তাড়ি খায় না, মধ্যবিত্তদের তো কথাই নেই আর পার্টিশনের আগে পর্যন্ত বড় বড় বেশকিছু জমিদার কলকাতায় বাড়ি বানাত ফুর্তিফার্তি এবং মদ্যপানের জন্য। ছোট্ট কুর্দিস্তানে কী হয় জানিনে কিন্তু পুব বাঙলার মতো একটা মাঝারি রকমের দেশে মদের প্রচলন নেই, এটা সত্যই বিচিত্র ঠেকে আমার কাছে। ওদের কালচারটাই যেন বর্ধমান বীরভূম এক কথায় রাঢ়ের থেকে স্বতন্ত্র।

কীর্তি বললে, হুঁ। কিন্তু ঢাকা বেতার যা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সেটা কলকাতার চেয়ে কোনও অংশে খারাপ নয়। তবে পিন্ডির রাজারা সেটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।

শিপ্রা বাঁকা হাসি হেসে বললে, তুমি অতশত খবর রাখো কী করে। তুমি না অপদার্থ।

.

০৮.

কীর্তি।

ইয়েস, ম্যাডাম।

ঠাট্টা নয়। তোমাকে গুটিকয়েক কথা বলতে চাই।

দোহাই তোমার। আমি বড় আনন্দে ডুবে আছি। দয়া করে সেটাকে থাকতে দাও।

তুমি যদি আমার কথাগুলো ঠিকমতো গ্রহণ করো, তোমার ভিতর যে স্বাভাবিক বুদ্ধি আছে তারই সাহায্য নিয়ে আমার কথাগুলো বুঝে নাও তবে তোমার আনন্দ কিছুমাত্র কমবে না। কলকাতায় আমার ঘরে শুয়ে শুয়ে তোমাকে যে এ কথাগুলো বলা যেত না তা নয়। কিন্তু তুমি একাধিকবার বলেছ, আমার স্বরটি বড় রোমান্টিক। সেখানে যে আবহাওয়ায় তুমি কী বুঝতে কী বুঝবে, কী বলতে কী বলবে তার জন্যে পরে হয়তো পস্তাবে। তাই তোমাকে এখানে টেনে এনেছি। এখানে চতুর্দিকে লোকজন রয়েছে। হঠাৎ হৃদয়াবেগে আমার হাঁটু জড়িয়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারবে না, আমিও তখন সর্ব সঙ্কল্প ভুলে গিয়ে তোমার কান্নায় গলে যাব না।

বেচারা কীর্তি কোন দিকে যে হাওয়া বইছে কিছুই অনুমান করতে পারছিল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু শিপ্রার দিকে তাকিয়ে রইল।

শিপ্রাও সোজা স্থির পূর্ণ দৃষ্টিতে কীর্তির দু চোখে আপন দু চোখ রেখে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, আমি তোমার চেয়ে ছ বছরের বড়, কিংবা বেশি, কম নিশ্চয়ই নয়। আমাদের বিয়ে হতে পারে না। শিপ্রা সজ্ঞানে কথা বন্ধ করল। হয়তো-বা কীর্তির মুখ থেকে কোনও মন্তব্য প্রত্যাশা করছিল। হয়তো-বা তার প্রত্যেকটি বক্তব্য যেন অক্ষরে অক্ষরে, তার সম্পূর্ণ অর্থ নিয়ে কীর্তির বোধগম্য হয় তার জন্য আপন নীরবতা দিয়ে তাকে সুযোগ দিচ্ছিল।

কিন্তু কোনও উত্তরই দিল না। কিন্তু সে যে বক্তব্যটা বুঝতে পেরেছে সেটা তার মুখের ভাব পরিবর্তন থেকেই বোঝা গেল।

শিপ্রা ঠিক আগেরই মতো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, কিন্তু তারই ফলে আমাদের ভালোবাসাতে সামান্যতম আঁচড়টুকু লাগবে না, আমাদের ভালোবাসাতে কোনও দিক দিয়ে কোনওপ্রকারের অসম্পূর্ণতা থাকবে না। কারণ আমি স্থির নিশ্চয় জানি, আমার সর্ব সত্তা দিয়ে অনুভব করেছি, তোমার ভালোবাসা একাগ্র ভালোবাসা, তুমি আর তোমার প্রেম অভিন্ন সত্তা; আর আমার প্রেম তুমি দিনে দিনে চিনে নিয়ো, আমি আশা ধরি, তুমি কোনওদিন তার শেষ অতলে পৌঁছতে পারবে না। এবং তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলি, এই কলকাতার শহরে শত শত গতানুগতিক যেসব বিয়ে হচ্ছে সেখানে বর যা পায় তার চেয়ে তুমি পাবে এত বেশি যে দুটোর কোনও তুলনাই হয় না। সে-সব আমি স্বপ্নে দেখেছি, তুমি বাস্তবে পাবে। আর আমি তোমার কাছ থেকে কী পাব, কী নেব সেটাও আমি ভালো করেই জানি।

তুমি যে আনন্দসাগরে ডুবে আছ সেটাতেই তুমি থাকবে– শুধু আমাকে পাবে পাশাপাশি।

হায়রে কলকাতার রোমান্টিক সুখনীড় থেকে দূরে এসে পথপার্শ্বে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যুগ্ম ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে সর্বপ্রকার কবিত্ববর্জিত সাদামাটা ভাষায় আলোচনা করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা!

এ বিশ্বাস অবশ্য শিপ্রার পরিচিত জনের ছিল যে, সে যদি কখনও প্রেমে পড়ে তার স্যাঁতসেঁতে হৃদয় বাঙালির মতো রসসায়রে হাবুডুবু খাবে না, তার প্রেম হবে পাক্কা ইংরেজি কায়দায় বিজনেস ইজ বিজনেস হোক না লেনদেনের বস্তু ওক কাঠের তক্তার স্থলে যুবক-যুবতীর প্রেম।

কিন্তু এর পরই কৌতূহল জাগার কথা, শিপ্রার বক্তব্য শুনে– তা সে রোমান্টিক ভাষাতেই হোক কিংবা কাঠখোট্টা কাঠের ভাষাতেই হোক আমাদের অপদার্থ কীর্তি ঠাকুরের হৃদয়মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল।

এ কাহিনী যদি প্রেমের মোলায়েম গদ্যকাব্য হত তবে তারই সরস বর্ণনা দিয়ে হেসে-খেলে দু দশ অধ্যায় জুড়ে বিরাট রসসৌধ নির্মাণ করলে যুবজন উল্লসিত হতেন। কিন্তু এ স্থলে এই যুবক-যুবতী অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, সে পথে প্রেম-রস মুখ্য নয় গৌণও নয়- সেটি তাদের পাথেয়।

আত্মম্ভরিতার গ্যাসে ভর্তি বেলুনমুণ্ড অকালকুষ্মও ভিন্ন অন্য যে কোনও সাদামাটা বাঙালি প্রেমমুগ্ধজন তার প্রতিদান পেলে এতই আত্মহারা হয় যে সে আর তখন প্রিয়ার অন্য কথা শুনতে পায় না। অনাগত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার সাবধানবাণী, দুজনার শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য সামান্য দু একটি বোঝাঁপড়ার কথা কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। হারানো ছেলে ফিরে পেলে দুখিনী-মায়ের চতুর্দিকময় ঘন অন্ধকার যেরকম একমুহর্তে অন্তর্ধান করে, কীর্তির বেলা হল তাই।

তার চেতনায় মাত্র একটি অনুভূতি পেয়েছি, পেয়েছি, পেয়েছি।

এই আনন্দলোককে লণ্ডভণ্ড করবে কোন পাষণ্ড!

শিপ্রা তার মধুরতম হাসি দিয়ে কীর্তিকে নিরঙ্কুশ আত্মহারা করে দিয়ে বলল, কীর্তি, তুমি যে আনন্দসায়রে অবগাহন করছ সেটাতে আমি ঝড়তুফান তুলতে চাইনে। আমার যা বলার সেটা বলা হয়ে গিয়েছে। তুমি রসসায়র থেকে ওঠার পর তাই নিয়ে চিন্তা করে যদি কিছু বলার থাকে, কাল বল। উপস্থিত তোমার সায়র থেকে যে দু চারটি মুক্তো আহরণ করেছ সেগুলো দেখাও।

সে যাত্রা আর বোলপুর হল না। সামনে ময়ূর সিংহাসন। সেটা ছেড়ে কোন মূর্খ ধায় কাবুল-কান্দাহার পানে সেখানে মোড়ার উপর বসবে বলে।

.

০৯.

কীর্তি আসামাত্রই শিপ্রা উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, পড়েছ কাগজে পাজির পা-ঝাড়াদের ছুঁচোমোটা?

কীর্তি হবার মতো তাকিয়ে রইল।

শিপ্রা বললে, বাবার সঙ্গে যখন প্যারিসে ছিলুম তখন ফরাসিদের মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যাঁ সিরের কয়েকটি অফিসার বাবার সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুনিয়ার যতরকমের বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। একদিন কী একটা মিলিটারি প্রশ্ন উঠলে তারই খেই ধরে যে চারটি কথাবার্তা হল তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল আর পাঁচটা বাঙালির মতো বাবা মিলিটারির কিছুই জানে না– এস্তেক মিলিটারির ইতিহাস যা কি না সহজপাঠ্য– তা-ও পাল্টে দেখেনি। অফিসারগুষ্টি তো বিস্ময়ে নির্বাক। শেষটায় এক জাঁদরেল বলল, মসিয়ো, এ কী অদ্ভুত ঠাসবুনোট-জড়োয়া কাশ্মিরি শালের মাঝখানে একটা বিরাট ফুটো। পাশ্চাত্য সাহিত্য চিত্রকলা বিশেষ করে জুরিসপ্রুডেনস থেকে আরম্ভ করে হেন বিষয় নেই যেটা আপনি হজম করে আপন সিস্টেমে বেমালুম মিশিয়ে নেন, আর মিলিটারি সায়েন্সের কিছুই জানেন না, এ যে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!

বাবা একটু সলজ্জ ভাষায় বললেন, ইংরেজ দু-শ বচ্ছর ধরে বিশেষ করে বাঙালিদের ওই জিনিসটার দিকে ঘেঁষতে দেয়নি। পাখি মারার সামান্য একটা শটগান জোগাড় করতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। মিলিটারি সায়েন্স তো প্যোর-ফিজিকস নয় যে পুরনো খামের উল্টো পিঠে তার ফরমুলা লিখে কর্ম খতম করা যায়।

তারা তখন উঠেপড়ে লেগে গেল বাবাকে ওই বিষয়টি শেখাবেই শেখাবে। কাহা কাঁহা মোকামে নিয়ে গিয়ে কী সব দেখাত বোঝাত খোদায় মালুম। ফরাসিদের যে সবচেয়ে বিরাট কলেবর বন্দুক কামানের কারখানা স্লাইডার সেটা পর্যন্ত দেখিয়েছে।

কিন্তু এহ বাহ্য। শামিয়ানা সাইজের বৃহৎ বৃহৎ বান্ডিল বান্ডিল ম্যাপ পাতা হত কার্পেটের উপর, এবং সব্বাই তারই উপর উপুড় হয়ে স্টাডি করতেন ইতিহাসের নামজাদা সব ক্যাম্পেন–নেপোলিয়নের আউস্টার লিৎস থেকে আরম্ভ করে এদানির ডি ডে নরমালি ল্যান্ডিং। একদিন কোত্থেকে জোগাড় করে এনেছিল বাবুর বাদশার পানিপথ লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি। সেটার অধ্যয়ন শেষ হলে ফরাসিরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বার বার বলছিল, ফাতাসতিক, ফরামিদাবল– নে স পা? অর্থাৎ ফ্যানটাসটিক, ফরমিডেবল নয় কি? কিন্তু এহ বাহ্য!।

একটু দম নিয়ে তার পর শিপ্রা বলল, কিন্তু যে কথা বলতে চাইছিলুম সেটা এ সবের বিচিত্র স্মৃতির চাপে প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলুম। সবচেয়ে আমাকে মুগ্ধ– মুগ্ধ কেন, আত্মহারা করেছিল এদের আদব-কায়দা, এদের অপরিসীম সৌজন্য ভদ্রতা। এবং সর্বোপরি তাদের তীব্রতম আত্মসম্মানবোধ কাউকে কোনও কথা দিলে সেটা রাখবেই রাখবে– যায় যা তাতে তার শেষ ফ্রা। এবং সেটা দিয়েও যদি শেষ শোধবোধ না হয় তবে সোজা রাস্তা রয়েছে নাক বরাবর। কপালে পিস্তলটি রেখে গুড়ুম!..

তাই বলছিলুম, এ ছুঁচোমোটা কেন? তুই ইয়েহিয়া, তুই বাবা প্রেসিডেন্ট ডিকটেটর যা-খুশি তাই নিবি তো নে। পুব বাঙলার লোক যদি তোর আদেশ অমান্য করে তবে চালা তোর বন্দুক কামান। আজকের দুনিয়া পরশুর ইতিহাস বিচার করবে ধর্মাধর্ম।

ডিকটেটর হ আর যাই হ তোর আসল স্বত্বটা কী? এবাভ অল তুই আমিম্যান, অফিসার। তোর শরীরের রক্ত, বাইরের চামড়া অফিসারের ধাতু দিয়ে তৈরি। তোর ধর্ম, আত্মগৌরব আত্মসম্মানবোধ। অনার। কথা দিবিনি, দিসনি। কিন্তু একবার দিলে জান কবুল। কী দরকার ছিল তোর গণতন্ত্র ফের চালু করার তরে ওয়ার্ড অব অনার দেবার? কী দায় পড়েছিল ইলেকশন করার? আর এখন হল কী? সোলজার, অফিসার হয়ে তুই তোর শপথ ভঙ্গ করলি, তোর স্বধর্ম ত্যাগ করলি। ভদ্র দেশ হলে অফিসারস ক্লাব থেকে তোর নাম কেটে দিত। ছা!

এতক্ষণে আসমানের বেপরওয়া চিড়িয়া কীর্তিবাবুর কানে জল গেল। তা-ও যেত না যদি না পরশু রাতে তার দেবীর প্রসন্ন বয়ান নির্গত তাপহরা বিন্দু বিন্দু অমৃতবারি তার ব্যথাভরা হিয়াটাকে সদ্য ফোঁটা বেলফুলের মতো বিকশিত করে দিত। সে-রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে শপথ নিয়েছিল, দেবীর পথ তার পথ। পরের দিন ভোরবেলা ইংরেজি কাগজটা তো পড়লই, একটা নেটিভ বাঙলা কাগজের খয়ের খা ভি হয়ে গেল। কিন্তু দু দিন ধরে অনভ্যাসে ফোঁটা চড়চড় করছিল বড্ডই। দুনিয়ার বেকার হাবিজাবি না দিয়ে কাগজ ভর্তি করা যায় না? অধিকাংশ খবরের অর্থ কী উদ্দেশ্য কী তার কোনও হদিসই পাচ্ছিল না সে। আজ যদি কোনও নিরীহ বাঙালি হঠাৎ নটিংহামের একটা লোক্যাল ডেলি পড়তে বসে তবে তার যা অবস্থা হবে কীর্তির হল তাই। কিন্তু তার কপাল ভালো, কালকের বাঙলা কাগজে আওয়ামী লীগের একটি সমসাময়িক ইতিহাসমূলক প্রবন্ধ ছিল। যাই বল, যাই কও, কীর্তির বাপঠাকুদ্দা স্রেফ মাথা খাঁটিয়ে এন্তের টাকাকড়ি কামিয়েছিলেন। ম্যান-ইটার বাঘের বাচ্চা তো আর ভেড়ার ছানা হয় না–কীর্তির খুলিটাতে বেশ খানিকটে বংশলব্ধ মদ্যসিক্ত অর্ধসুপ্ত প্যাচালো ঘিলু বাবুর খোঁচাতে জেগে ওঠবার তরে তৈরি ছিল। পাকা নায়েব যেরকম শহুরে কাঁচা বাবুকে জমিদারির হালটা দু দিনেই বেশ খানিকটে বুঝিয়ে দেয়, এ ক্ষেত্রেও হল তাই।

সদ্যলব্ধ বিদ্যে ফলিয়ে বলল, ওই ইয়েহিয়া ঘুঘুর পেছনে রয়েছেন আস্ত একটা খাটাশ মিলিটারি ক্লিক।

শিপ্রার চোখের পাতা স্তব্ধ– যেন অর্ধাঙ্গে অবশ। এ কী কথা শুনি আজি? দুনিয়ার তাবৎ বাবদে বেহদ্দ বেখেয়াল বেকুব নীচ কুলোদ্ভবা দাসীর মুখে সত্য মিথ্যা জ্ঞান তার তবে কী সম্ভবে? কীর্তির মুখে মোস্ট আপ টু ডেট ইনসাইড স্টোরি।

বিমূঢ় ভাব কেটে যাওয়ার পর শিপ্রা শুধু বলল, তুমি না অপদার্থ কীর্তি?

প্রশ্নটা যেন অদৃশ্য ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ছো, এ খবরটা আবার পদার্থ। খবরের কাগজ থেকে যে তত্ত্ব আধ ঘন্টার ভিতর জোগাড় করা যায়।

শিপ্রা আরও সাত বাও পানিমে। বলল, খবরের কাগজ? ওসব ব অভ্যাস হল তোমার কবের থেকে?

কীর্তি সবিনয় : সে অনেক কথা, পরে হবে।

শিপ্রা : তাই সই, তুমি যখন এসব বুঝতে আরম্ভ করেছ তখন তোমাকে আর একটা খবর জানাই। সেই যে বাবার দোস্ত বুড়ো ফরাসি জাদরেল বাঙলাদেশের মিলিটারি হিন্দ্রি জোগাড় করার চেষ্টা দিয়েছিলেন– নিছক আমরা ওই দেশের লোক বলে। এটাও একরকম দরদি হিয়ার আচরণ বলতে পারো। একদিন বাবাকে কথায় কথায় বললেন, ব্লাঙ্কো, ব্লাঙ্কো! প্রায় কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। তবে দিল্লিতে লেখা এন্তের রাজনৈতিক ইতিহাস পেয়েছি বেশকিছুটা। তার থেকে স্পষ্ট ধরা পড়ে দিল্লির হুজুররা বেঙ্গলে মার খেয়েছেন বিস্তর। তাই সে সম্বন্ধে নীরবতাটাই সমধিক। গ্রেট মোগল আকবরের নাম এদেশের লোকও শুনেছে। তিনিও দেখলুম বাঙলাদেশের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র জয় করতে পেরেছিলেন। জয় করেছিলেন তার ছেলে জাহাগির। মন্দ কপাল আমার, তার স্ট্র্যাটেজি খুঁজে পেলুম না।

কিন্তু যা পেয়েছি তার থেকে আমি বুঝেছি, এবং জোর গলায় বলতে পারি।

তেরাঁ, তেরাঁ, পুনরপি তেরাঁ
মল্লভূমি, মল্লভূমি, মল্লভূমি

এই বিরাট পৃথিবীতে আদ্যন্ত অদ্বিতীয়। বিরাট বিরাট নদী আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি যেখানে হয় সেই চেরাপুঞ্জি থেকে নামে আকাশের জল। দুয়ে মিলে এমন সব ভিন্ন। ভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির জলাভূমি তৈরি করে যে সেগুলোর নাম ইয়োরোপীয় কোনও ভাষায় নেই। দেশি শব্দের একটা সুর মনে আছে হাওর না কী যেন। এমনকি মস্কো যেতে পথে যে জলোজমি সেটাও হিটলার পেরিয়ে যেতে পেরেছিল কিঞ্চিৎ লোকক্ষয় স্বীকার করে। কিন্তু তোমাদের দেশে আমাদের সনাতন সংগ্রাম পদ্ধতি চলবে না।

শিপ্রা বলল, আমি এসব আলোচনায় যোগ দিতুম না। তখন সেই প্রথম বললুম, কিন্তু, মসিয়ো ল্যা জেনারেল, আকাশে থেকে বমিং? জেনারেল তো গড্ড্যাম গ্ল্যাড। আপন চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার কাছে এসে ফরাসিরা ভাবাবেগে, আনন্দোল্লাসে উত্তেজিত হলে যা করে তাই করলেন। সর্বপ্রথম আমার গালে খেলেন শুকণ্টকিত কিন্তু অতিশয় মিঠে মিঠে একটি চুম্বন, তার পর আমার চুলের উপর বুলোলেন তাঁর হাত, এবং সর্বশেষে রাজপ্রাসাদীয় কায়দায় দিলেন আমার বাঁ হাতটি তুলে ধরে একটি অতিশয় রিফাইনড চুম্বন।

প্রায় নৃত্য করতে করতে বার বার বললেন, মাদৃমোয়াজেল, মাদৃমোয়াজে। অর্থাৎ, কল্যাণী, কল্যাণী।

সে তো বুঝলুম– ফরাসিরা ওইভাবে বে-এক্তেয়ার হয়। তার পর কী বলতে চান তিনি? আর আমিই-বা এমন কোন গূঢ় গুহ্য মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক ট্যাকটিকাল প্রশ্ন শুধিয়েছি যে ঝানু জাঁদরেল আত্মহারা হবেন!

আমার পাশে আসন নিয়ে কিঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর বললেন, আমি বড্ড ভুল করেছি, মাদমোয়াজেল, বড় ভুল বুঝেছি এতদিন ধরে। আমি মনে করেছিলাম, তুমি। লন্ডন-প্যারিস সমাজে বাস করে করে দেশাত্মবোধ হারিয়ে ফেলেছ, কিন্তু এখন আমি দেখছি তুমি দেশের স্বার্থ, দেশের বিপদ সম্বন্ধে বেশ সচেতন। প্রশ্নটা তো অতিশয় সাদাসিধে, কিন্তু তারই ভিতর দিয়ে আমি তোমার অন্তরের অন্তস্তল অবধি দেখতে পেয়েছি।

শোনো, মাদমোয়াজেল, স্ত্রী হোক পুরুষ হোক, সবচেয়ে মূল্যবান ধন মানুষের মনুষ্যত্ব। কিন্তু আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস সেটাতে মানুষ পৌঁছয় দেশাত্মবোধ, ন্যাশনালিজম, পেট্রিয়টিজমের ভিতর দিয়ে এবং তার দৃঢ় ভূমি–

শিপ্রা বলল, অবাক মানবে, কীর্তি, তার পর সেই বৃদ্ধ জেনারেল এক লাফে কোচ ছেড়ে, যেন অদৃশ্য এক পতাকা এক হাতে উঁচু করে ধরে, রাস্তার ছোকরাদের মতো ঘরময় নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগলেন,

লিবেরতে, লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে
লিবার্টি, লিবার্টি, অলওয়েজ লিবার্টি
স্বাধীনতা স্বাধীনতা, স্বাধীনতা চিরদিনের।

.

১০.

উপরে চল। আমার কোনও বান্ধবী, বন্ধু দূরে থাক, কেউ কখনও দোতলায় ওঠেনি। বাবা কাউকে উপরে আনতেন না বলে আমি সে রীতিটা এখনও মেনে চলি। কিন্তু তোমাকে এখন সবকিছু দেখে-চিনে নিতে হবে। তুমিই মালিক। যদি চাও, বাড়ি-ঘর যা কিছু আছে, উইল করে তোমার হাতে সঁপে দেব।

কীর্তি আঘাত পেল; বললে, তুমি কি আমাকে এখনও চিনতে পারোনি?

শিপ্রা তাড়াতাড়ি বললে, সরি, আমি দুঃখিত। এই হল বাবার স্টাডি। এখানে বসে তিনি বৈষয়িক কাজকর্ম করতেন। আমার খেয়াল-খুশিমতো ওই কোণের কোচটাতে বসে খবরের কাগজ, বইটই, মাঝে মাঝে শেয়ার মার্কেট রিপোর্ট পড়তুম। আমি জানতুম তিনি তাতে খুশি হতেন। কাজ করতে করতে কখনও গুনগুন করতেন, খুশি হলে শিস্ দিতেন। কোনও কারবার ঠিক তার পছন্দমতো না এগোলে গরগর করে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আর প্রায়ই মাথা তুলে বেশ উঁচু গলায় বলতেন, দিজ আর লুকিং আপ, আমাকে শুধোতেন, তোর জন্য শ-খানেক চা-বাগানের শেয়ার কিনব? আমি শুধু একটু মুচকি হাসতুম– আমি ও-সবের কীই-বা বুঝতুম, তখন? কিন্তু আমাকে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য শেখাননি। বলতেন, এসব শুকনো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মানুষের প্রাণরস শুকিয়ে যায়–আমি অবশ্য কখনও তাঁর প্রাণরসে ভাটার টান পড়তে দেখিনি। শেষটায় বলতেন, তোকে কিচ্ছুটি শিখতে হবে না। তুই পেয়েছিস আমার ঠাকুমার বুদ্ধি এবং বিশেষ করে বিচক্ষণতা। বাবা পেয়েছিল তার বুদ্ধির বারো আনা, আমি পেলুম আট আনা, তোতে ফের এক্কেবারে ফুল হাউস ন সিকে। যেদিন দরকার হবে পুরো হপ্তাটাও লাগবে না, তুই হয়ে যাবি শেয়ার মার্কেট কুইন, কিংবা মফৎ লাগল এবং দেওকরণ নানজির সমন্বয়। এবারে চলো এগিয়ে।

বিরাট জোড়া খাটের বেডরুম। একশো বছরের পুরনো স্টাইলের।

শিপ্রা বলল, এখানে বাবার আর একটা ড্রইংরুম আর গেস্টরুম আছে। তবে এগুলো কখনও ব্যবহার হয়নি। এইখানে বাবার হিস্যে শেষ। এই আমার বেডরুম।

ছবিতে কীর্তি ফরাসি ধনী কুমারী কন্যার বেডরুম দেখেছে। এবারে আপন চোখে দেখল।

দেওয়ালে ওয়ালপেপারের বদলে খুব দামি সিল্কের ওয়ালকাভার। তার উপর আবার ভিন্ন ভিন্ন রঙিন সিল্ক দিয়ে বেহালাতে জড়ানো ফুলের মালার ডিজাইন। ছাতের চার কোণে চারটি দেবশিশুর বা-রিলিফ। তাদের হাত থেকে ঠিক মাঝখানে এসেছে চারটে ফুলের মালা। সেগুলো যেন ঝুলিয়ে রেখেছে একটা ফোয়ারার পাদপীঠচক্র। পায়ের নিচে ফরাসি কার্পেট।

আর খাটটি ঘোট এবং সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা। খাঁটি ফরাসি পালঙ্ক। এমনকি তিনদিকে ফরাসি কায়দায় সিল্কের কার্টেন ঝুলছে। বেড-কাভার ভারী কিন্তু সুতোগুলো অতি মিহিন। কার্টেন আর বেড-কাভারের ডিজাইন দেয়ালের সিল্কের সঙ্গে ম্যাচ কিন্তু মতিফ ভিন্ন– এখানে জলে চালিত ময়দা পেশার ওয়াটার-মিল ডিজাইন। ঘরের এক কোণে ড্রেসিংটেবল– তার উপর বিচিত্র ঢপ-ঢঙের বিস্তর শিশি-বোতল, এক সারি কৌটো– অথচ কীর্তি খুব ভালো করেই লক্ষ করে বুঝেছিল, শিপ্রা প্রসাধন করে সামান্যতম। সমস্ত ঘরটার কালার স্কিম মভ রঙের।

শিপ্রা বলল, আমার অত বাহার সয় না। বাবা করিয়েছিলেন টপ টু বটম।

পাশে শিপ্রার একান্তে বসার বুদওয়ার। তার মধ্যে দ্রষ্টব্য, মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট এবং প্রায় সম্পূর্ণ একটা প্রান্তজুড়ে বিরাট দৈত্যপ্রমাণ গ্র্যান্ড পিয়ানো।

কীর্তি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, তোমাকে তো কখনও পিয়ানো বাজাতে শুনিনি।

শিপ্রা বলল, আমার বাজনা শোনাবার মতো নয়। মাত্র দশ বছরের হেঁ ছেঁড়া রেওয়াজে শোনাবার মতো হাত পাকা হয় না। আমি বাজাই রাত ঘনালে আর অতি ভোরে। এবারে চলো ব্যালকনিতে।

.

১১.

ভেবে নিয়েছ? অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেছ? এখনও ব্যাক-আউট করার সময় আছে?

কাতর কণ্ঠে কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ভেবেছি। কিন্তু কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আর ভয়ও করছে।

শিপ্রা একটা কুশনওলা লম্বা হেলান চেয়ারে আধ-শোওয়া হয়ে সামনের পার্কের দিকে তাকিয়েছিল। বললে, ট্যারচা হয়ে বসো আর আমার দিকে না তাকিয়ে তাকাও পার্কের দিকে। সবুজ দিয়ে চোখ ভরে নাও। আর ভয়টা কিসের, শুনি।

যেন প্রাণপণ সিংহের কেশর ধরে, মরি-বাঁচি ভাব মুখে মেখে বললে, মাত্র একটি কথা নিয়ে আমি সমস্ত রাত ভেবেছি। আমাদের যদি বিয়ে না হয় তবে তোমার যে নিন্দে হবে, সে কথাটা কি ভেবে দেখেছ।

শিপ্রা অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে সহজ গলায় বললে, আমি জানতুম তুমি এ কথাটা তুলবে কিন্তু তুমি না অপদার্থ? তা হলে এ দুশ্চিন্তা তোমার মাথায় ঢুকল কী করে? কলকাতা-বোম্বায়ের স্মার্ট সেটের যে কোনও বিবাহিত-অবিবাহিত জোয়ান-বুড়ো ক্ষণতরে চিন্তা না করে উল্লাসে নৃত্য করত আমার মতো মেয়েকে মিসট্রেসরূপে পেলে।

কীর্তি লাফ দিয়ে উঠে শিপ্রার মুখ চেপে ধরে বললে, মাথার দিব্যি দিচ্ছি, শিপ্রা, তুমি যদি ওই শব্দটা আর কখনও ব্যবহার করো তবে ওই তোমার পায়ের সামনে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব।

কীর্তির হাতে হাত বুলাতে বুলোতে বললে, আচ্ছা আর বলব না। তোমাকে তো দিব্যি কেটে বলেছি, আমি তোমার সব আদেশ মানব।

কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ওই দুশ্চিন্তাটার সঙ্গে মাখানো ছিল আমি পেয়েছি, আমি তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছি। এবং আমি জানি আমার যে তিনটি সত্যকার খাঁটি বন্ধু, সুদিনদা, শঙ্কর আর খান সায়েব এরাও ঠিক এইভাবেই আমার অনুগ্রহ লাভের কথা ভাববে।

শিপ্রা উঠে বসে বললে, আমার যে লোকনিন্দাটা হবে সেকথা শুনে আমি হাসব, না কাঁদব ভেবে পাইনে। লোকনিন্দার প্রাপকরূপে আমি ভেটার। আমার বয়স যখন মোল পেরুল সেদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন, আজ থেকে তুই এ বাড়ির মিসট্রেস আর আমি যেসব পার্টি দিই তাতে হোস্টেস্। বুঝলি? আর আমি আমার ইয়ারদের যে রকম পার্টি দিই তুই যেদিন দিবি সেদিন আমাকে ডাকতে পারিস, না-ও ডাকতে পারিস। বুঝলি তো? সেদিন দুপুরবেলা বাবা আমার ক্লাস-ফ্রেন্ডস্, স্কুলের সব টিচার এবং অন্যান্য যাদের কাছে পড়েছি আর আমার ফ্রেন্ডস ছেলে এবং মেয়ে দুই-ই সবাইকে দিলেন জব্বর একটা ভোজ। সেটাতে হোস্টেস হতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি যদিও বাবা নিচের তলায় নেমে আগের মতো একবারও তদারকি করেননি। শুধু খাবার সময় আমাদের হেডমিস্ট্রেসের পাশে বসে তাকে আদর-আপ্যায়ন করতে করতে আহারাদি করেছিলেন।

তোমরা আবার পার্টি করো! আর আমার পার্টিই-বা কী? কে এক সোভানি একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে ভরতনৃত্যের নামে হস্তীনৃত্য নেচেছিল! ওইখানেই তো ফুলস্টপ। বাবার পার্টিতে অন্তত জনা পাঁচেক বেহুশকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলতে হত। জনা দশেককে দুজন তাগড়া জোয়ান বেয়ারা দু দিক থেকে স্যান্ডউইচ করে মোটরে তুলে দিত।

অবশ্য বাবা আমাকে বিস্তর টিপস আগের থেকেই দিয়ে রেখেছিল। একটা এখনও মনে আছে। যদি লক্ষ করিস কেউ একটু বে-এক্তেয়ার হয়ে যাচ্ছে তার পাশে গিয়ে বসবি। তাকে আদর-সোহাগ করে বলবি, আকল, তুমি তো জানো, আজ থেকে আমি হোস্টেস। আমার ভারি ইচ্ছে আমি নিজে তোমাকে ড্রিংক দিই। তুমি কোনও বেয়ারার ট্রে থেকে ড্রিংক তুলবে না। কথা দাও। কথা নিজেই দেবে। খাস হোস্টেসের কোনও অনুরোধ কোনও লোক উপেক্ষা করে না। তার পর বার টেবিলে গিয়ে যে ড্রিংকই হোক না সেটা বেয়ারাকে পাতলা করে দিতে বলবি। তাকে বোঝাতে হবে না। তার পর খামকা টালবাহানা করে, এর-ওর সঙ্গে দুটো কথা কয়ে বেশ দেরি করে এসে তোর সেই আনককে গেলাসটা আপন হাতে রেখে প্রথম তো হাজার দফা মাফ চাইবি তার পর জুড়ে দিবি লম্বা এক কাহিনী –গেলাসটা কিন্তু হাতে। গল্প শেষে গেলাস দিবি। তোর আন্কটিও চক্ষুলজ্জায় তোর কাছে ঘন ঘন ড্রিংক চাইবে না। আর কেউ যদি নিতান্তই বেহেড টালমাটাল হয়ে যায় তবে মজুমদার, কাঞ্জিলাল, ভবতোষ এদের কাউকে একটু হিন্ট দিয়ে আসবি। ওদের মাথা ঠাণ্ডা। সব সঙ্কটে মুশকিল-আসান।

পার্টি শেষ হল। বাবা ভারি খুশি। বললেন, একদিন তুই যে শহরেই যাস না কেন, নামজাদা হোস্টেস হবি। দু চারটে পার্টি করার পর মজুমদার, কাঞ্জিলালকেও তোর দরকার হবে না।

কিন্তু সেইদিন থেকেই আমার বদনাম শুরু। বিস্তর লোকের মুখে ছ্যা ছ্যা। বিশেষ করে মেয়েদের। এমনকি বাবার স্কুলফ্রেন্ড চৌধুরী সাহেব বাবাকে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এটা ঠিক হল না। বাবা বলেছিলেন, দেখো, চৌধুরী, তুমি খানদানি মুসলমান ঘরের ছেলে। তোমার চতুর্দশ পুরুষে কেউ মদ খায়নি তবু তুমি মদ ধরেছ। শুনেছি অভ্যাসটা নাকি মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর হিন্দুদের তো কথাই নেই। নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন বার খুলছে এবং সেগুলো ভর্তি। বেশিরভাগ ক্লাবে আসে সুদুমাত্র মদ খেতে। আর ড্রিংক পার্টির কথাই নেই। আমার মেয়ে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, সে আমি জানি তার ছোট্ট বয়স থেকে। তদুপরি তার হিউম্যান ইনট্রেস্ট অফুরন্ত। চাকরবাকররা তাদের বাড়িতে তাদের সমাজে কী করে, না করে তার থেকে আরম্ভ করে সে কুইন ভিক্টোরিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বর্ণনা খুটিয়ে খুটিয়ে জেনেছে। এ মেয়ে পাটিতে যাবে সেটা প্রায় অসম্ভব। তাই পার্টিতে, ক্লাবে বার-এ একটা ভদ্রমেয়ের আচরণ কীরকম হওয়া উচিত, সেসব জায়গার এটিকেট মেনে নিয়ে ভদ্রতা শালীনতাসহ কীভাবে মেলামেশা করবে, সেটা আমার কাছ থেকে শিখবে, না শিখবে ওইসব পাঁড় মাতাল ভেঁপো ছোঁড়াদের কাছ থেকে কোনও ক্লাবে বা পার্টিতে কেউ যদি অশালীন আচরণ করে তখন কীভাবে চতুরতা এবং ডিপ্লোমেসির সঙ্গে নিজের ভদ্রতা নিজের ডিগনিটি বাঁচিয়ে তাকে ট্যাকল করতে সে-সব শেখাবে ওইসব ছোঁড়ারা? আর শুধু কী তাই? আজ তাকে বলে রেখেছিলুম সে যেন কর্নেল সরকারের টেবিলে দু এক সিপ চাখে। আস্তে আস্তে তাকে ভোদকা আবসাতেরও দ্রব্যগুণ শেখাব। কোনটা কতখানি ক্ষতি করে, ও জেনে নেবে। তার পর কারও পাল্লায় পড়ে যা তা গিলে নিজের অনিষ্ট করবে না, বানচালও হবে না, কাকে কতখানি কী ঢেলে দিতে হবে সেটাও জেনে যাবে– হবে আইডিয়াল হোস্টেস। বাপের চেয়ে ভালো গুরু সে পাবে কোথায়?

শিপ্রা বললে, কথাটা অতি সত্য। আমার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছে পাশে এক গুরুমশাই বসেছিলেন মাত্র। স্কুল না-যাওয়া অবধি তাঁরই কাছে সব শিখেছি : প্রাইভেট টুটার বাবা ককখনও রাখেননি। কলেজে পড়ার সময়ও বাবার ঘরের এক কোণে বসে অধিকাংশ সময় পড়াশুনো করতুম। মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন শুধোতুম। জানা থাকলে সুন্দর বুঝিয়ে দিতেন– আর কী অসীম ধৈর্য। না জানা থাকলে একগাল হেসে বলতেন, ওরে শিপি, তুই যে বাপ-মারা বিদ্যে রপ্ত করে নিচ্ছিস। তার পর তার কোনও এক বন্ধু বা পরিচিত স্কলারের কাছে পাঠিয়ে দেবার সময় বলতেন, শিখে এসে আমায় বাতলে দিস্। তাঁর আর একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গুরুকে আপন বাড়িতে টেনে আনলে সত্য বিদ্যার্জন হয় না। গুরুগৃহে বসে থাকবে বারান্দার বেঞ্চিতে– গুরুর কখন কৃপা হয়।

কীর্তি মুগ্ধ হয়ে বলল, শিপি, তুমি সত্যি ভাগ্যবতী।

শিপ্রা বললে, আমার নামে কীসব বদনাম রটে তার খবর আমি রাখিনে আমরা যারা পার্টি-ফার্টি করি তাদের মধ্যে কার না বদনাম হয়! কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও বিবাহিতা রমণী বলেনি আমার বাড়ি থেকে তার স্বামী বে-এক্তেয়ার হয়ে ফিরেছে। বাবা বলতেন, তুমি লেডি। এ আইনটা বিশেষভাবে তোমার বেলা প্রযোজ্য। আর আমি নিজে যে সবচেয়ে মোলায়েম ড্রিংকে সীমাবদ্ধ করে নিজেকে সংযত রাখব সে-বিষয়ে তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না।

কীর্তি হাবা ছেলের মতো গদগদ সুরে বলল, সে কি আমরা জানিনে? কিন্তু ড্রিংক। কেন, কোন ব্যাপারে তোমার সংযম-সৌজন্যের অভাব। সুদিনদা যে জালা জালা খায়, ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত ডোন্টো কেয়ারের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায় সে-ও তোমাকে রীতিমতো সমীহ করে চলে। আমাকে বলে, ওরে মূর্খ! তোরা ভাবিস শিপ্রা বুঝি বেখেয়ালে আমাদের এটা-ওটা দেখতে পায়নি। ও মেয়ে না দেখেও সব দেখে, না শুনেও সব শুনতে পায়। আর আসল গেরো কী জানিস, তার আচরণ বা কথায় প্রকাশ পাবে না, সে অপরাধ নিয়েছে। তা হলে তো গেরোটা ফস্ করে খুলে যেত– হাত-পা ধরে মাপ চেয়ে নেওয়া যেত। বলে এটাই নাকি তোমার ব্রহ্মাস্ত্র।

শিপ্রা বললে, যাহ! বিশ্বভুবনটা রিফর্ম করার ভারটা কি আমার স্কন্ধে।

কিন্তু–

শিপ্রা বললে, আজ এসব অপ্রিয় আলোচনা এখানেই থাক। ইরানিরা যেরকম বলে, তখন আলোচনার কার্পেটটা রোল করে গুটিয়ে এক কোণে খাড়া করে রাখা হল। পরে

হয় আমরা ওটা আবার ঘরময় বিছিয়ে পুরনো আলোচনার শেষ রেশ ধরে নতুন করে ঢেলে সাজাব। আরেকটা কথা তোমায় বলি, কীর্তি। আমাকে যতশত গুণের গুদাম মনে করো না কেন, আমি অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করি দৈবে, অদৃষ্টে– আমি ফেটালিস্ট, অনেকটা খৈয়ামের মতো। তার প্রত্যাদেশ, তারই ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে পেয়ালা অধরে ধরো। অর্থাৎ আনন্দ করো। সেটা তো মোটামুটি মানিই, কিন্তু সবচেয়ে সেই ফরাসি বৃদ্ধ জেনারেল আমাকে যে ধর্মে দীক্ষা দেন :

লিবেরতে লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে।

.

১২.

খান সাহেবের সঙ্গে কীর্তির হঠাৎ মোলাকাত। খান সোৎসাহে বলে, হ্যাঁ রে, কিতে, এদানির তুই শিপ্রা বেগমকে দেখেছিস? আরে, ভাই, বয়স যেন দশটা বচ্ছর কমে গেছে। মোটরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে হাত নেড়ে নেড়ে যা প্যারটা জানাল, মাইরি, যেন আমি বহু বছরের লঙ লস্ট ব্রাদার। মেয়েদের ব্যাপারটাই ভানুমতীর খেল। আমি তো জানতুম বিয়ের জল পড়লে তবে না মেয়েদের জেল্লাই বাড়ে। কালা পেঁচিটা হয়ে যায় সোনালি ক্যানারি!

কীর্তি ভদ্রতার মৃদু হাসি হেসে বললে, শিপ্রা তো চিরকালের সুন্দরী।

খানের মাথায় অন্য চিন্তা। ব্যবসার। সে কথা কী শুকনো মুখে পাড়া যায়! বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছিস। তা চ, ঝপ করে একটা খেয়ে নিবি। ফাস্ট ক্লাস গর্ডনস।

এই অবেলায়?

বলিস কী রে? বেলা তিনটে অবেলা। চ-চ।

গুণীরা বলেন, অন্ধকার গুহায় আলো জ্বালালে সে অন্ধকার হাজার বছরের পুরনো হোক, আর দশ মিনিট পূর্বে কারও মশাল নিভে গিয়ে থাকার অন্ধকার থোক, দেশলাই দুটোকেই দূর করবে এক সময়েই, এক মুহূর্তেই। কিন্তু খান প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু কীর্তির। না যাব না বলে এক লহমায় সে বন্ধুতে আগুন ধরানো যায় না। আসলে কীর্তির ইচ্ছা ছিল পানের মাত্রাটা আস্তে আস্তে কমানো।

আরাম করে বসে খান ঢক করে পয়লা গেলাস বটম আপ করে কীর্তিকে বলল, হ্যাঁ রে, তুই তো কোথাও যাস নে। তবু একবার যদি আমার সঙ্গে আগরতলায়? তুই থাকলে কুচক্রীরা সমঝে যাবে, তোর শেয়ারসুদ্ধ, তুই আছিস আমার পিছনে। দু দিন আগে এরই ধাক্কায় আমাকে যেতে হল করাচি-লাহোরে।

কীর্তি হতভম্ব। তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর কি মাথা খারাপ? সেই হাইজ্যাকিঙের পর থেকে ওসব জায়গায় ইন্ডিয়ান হয়ে গেলি কোন সাহসে?

কীর্তির পিঠ চাপড়ে দিয়ে খান্ বলল, বেশ বাওয়া, বেশ। চতুর্দিকে নজর ফেলে ওকিবহাল হয়ে উঠছিস। এবারে ব্যবসার দিকে একটু মন দে না।

তা সেখানে কী দেখলি, কী শুনলি?

আর বলিসনি। ওদের কাগজগুলোর ক্রুড ছুঁচোর মতো ফিচেল মিথ্যে কথা বলার ধরন আর বহর দেখলে তোর মতো অগাও তাজ্জব মানবে। বলে কি না, আওয়ামী লীগ গুণ্ডা ভাড়া করে ইলেকশন জিতেছে। বিদেশি রিপোর্টারগুলো মিটমিট করে হাসে। আরে, ঝুট যদি বলবিই তবে বল্ হিটলারি স্টাইলে, গ্যোবেলসের সুপারফাইন সুতো দিয়ে বোন একটা মিহিন জাল। পুব বাঙলার পৃনের আনা লোক নাকি ইয়েহিয়াকে ফাদার-মাদার রূপে দেখে– মসজিদে মসজিদে তার জিন্দেগি আর ভালাই-এর জন্য দোয়াদরুদ পড়ে।

এর ফলে কী হবে জানিস? হিটলারি রাজের আখেরি ওক্তে যা হয়েছিল, ঠিক তাই। এরা হয়ে যাবে আপন প্রপাগান্ডার ভিকটিম! একদম টপ-এ যারা আছে– ইয়েহিয়াকে ঘিরে– তারা জানে এসব মিথ্যে প্রপাগান্ডা। কিন্তু যদি আখেরে বাঙলাদেশ রুখে দাঁড়ায় তবে সেটাকে দমন করার প্রস্তুতির ভার যে শত শত অফিসারের কাঁধে পড়ছে, তারা তো জানে না এসব ডাহা মিথ্যে, তারা ভাববে এসব বাড়াবাড়ি, মশা মারার জন্য খামোখা সেই কোন সুদূর পুব পাকিস্তানে পাঠাতে হবে কামান-ট্যাঙ্ক। কাজে আসবে গাফিলি। পানি-কাদা সাপ-জোঁকের দেশে এমনিতেই পশ্চিম পাকি সেপাই যেতে চায় না, এখন সেখানে যেতে হবে বিদ্রোহ দমন করতে? কিসের বিদ্রোহ? অ্যাদ্দিন ধরে তোমরা গাইলে ভিন্ন গীত। সাধারণ সেপাই যদি অফিসারকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে তবে আর্মির মরালটি হয়ে যায় ঝরঝরে।

আখেরে মামেলাটা এ শেপ নেবে কি না, সে জানেন আল্লা। কিন্তু লাহোর-পিন্ডির ক্লাবে ক্লাবে কী অন্ধ আত্মপ্রসাদ, কী কাণ্ডজ্ঞানহীন বড়-ফাট্টাই।

আর মদের কথা যদি তুলিস তো আমরা কলকত্তাইয়ারা ওদের তুলনায় শিশু, শিশু, শিশু। আমাদের সবচেয়ে বড় ক্লাবে সম্বৎসরে যে পরিমাণ খাওয়া হয় তাই দিয়ে ওদের ছোটাসে ছোটা ক্লাবের কপালে তিলকটি কাটা যাবে না। জালা জালা মদের সঙ্গে সঙ্গে সব্বাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালিগালাজে ভর্তি অশ্লীলতম ভাষায় যেসব নোংরা নর্দমায়। তারা গড়াগড়ি দেয়, গল্পের নামে মোস্ট পয়েন্টলেস যেসব মলকুণ্ডের বর্ণনা দেয় সে-সব না শুনলে কোনও দেশের গাটারস্নাইপও বিশ্বাস করবে না যে, নগরের সবচেয়ে সম্মানিত ক্লাবে দ্রসন্তানরা এসব বলে, শোনে আর চতুর্দিকে কী অট্টহাস্যের গমগমানি।

আমাকে এক্কেবারে চাটনি বানিয়েছিল সর্বশেষে এক জমিদার ব্যারন বললেই ঠিক হয় বাড়ির একটা বিরাট হলঘরে। ব্লু ফিল্ম কখনও দেখেছিস? তার বাস্তব– থাক্। তুই যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু যার সামনে আমি হরহামেশা প্রাণ খুলে সব কথা বলেছি, তোকেও ভাই বলতে পারব না।

কীর্তি বললে, বলারই-বা কী দরকার?

খান বললে, না ভাই, শুধু বলার জন্যই বলছিনে। আমি শুধু ভাবি এইসব আত্মপ্রসাদমত্ত দিবান্ধ, মিথ্যা ভাষণ যাদের হাড়ে হাড়ে এমনই ঢুকে গেছে যে পবিত্র শপথগ্রহণের সময়ও কুণ্ঠা নেই, লজ্জা নেই, যৌন ব্যাপারে যারা পশুর চেয়েও অধম এরা ভাবে এরা সভ্য, এদের তুলনায় পুব বাঙলার লোক জংলি, বর্বর। এসব ব্রুটগুলো শাসন করতে চায় সরল, বিশ্বাসী, দ্র পুব বাঙলার লোককে!

খান ভালোভাবেই জানত, কীর্তির মতো মাত্রা রক্ষায় অভ্যস্ত বনেদি ঘরের ছেলের কাছে এসব অবিশ্বাস্য, এসব তার কল্পনার বাইরে, তার দৃষ্টিচক্রের বহু বহু দূরে। পাকেচক্রে যদি-বা সে এ জাতীয় পশ্বাচারের কাছে-পিঠে এসে পড়ে তবে সঙ্গে সঙ্গে তার ইনসটিনটই তার লাগাম ধরে উল্টো পথে ডার্বি স্পিডে তাকে ছুটিয়ে দেবে। কিন্তু সে নিজে এ যাত্রায়, বিশেষ করে ব্যারনের বাড়িতে যে পাইকিরি পাপাচার যে সামান্য অংশটুকু দেখেছিল, এবং পরে শুনেছে আর সব জমিদারবাড়িতেও এসব ডাল-ভাত, পুরুষানুক্রমে চলে আসছে তাই নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করছিল এক একটা জাত এ রকম পথে চলে কী কারণে? আর পাঁচটা জাতের সঙ্গে মেলামেশার পরও নিজেদের সভ্যতর মনে করে কোন যুক্তি দিয়ে? দুজনাই চুপ।

খানই শেষটায় বললে, তুই তো জানিস আমাকে পুরো দুটি বৎসর লন্ডনে কাটাতে হয়েছিল, বাবার হুকুমে। ইংরেজের সঙ্গে আমার যে খুব-একটা দহরম-মহরম হয়েছিল তা নয়। তবু তাদের চরিত্র, সামাজিক আচরণ খানিকটে আমার নজরে আসে। অবশ্য যেসব বিশেষ বিশেষ সীমাবদ্ধ সম্প্রদায় থেকে ইংরেজ ভারতবর্ষে রাজত্ব করার জন্য লোক সংগ্রহ করত তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বৃহৎ অভিজ্ঞতা আমি যেটা অনিচ্ছায় সঞ্চয় করেছি সেটা তাদের অজ্ঞতা, সর্বগ্রাসী অজ্ঞতা। শিক্ষিত অশিক্ষিত তা তারা খবরের কাগজ পড়ুক আর না-ই পড়ক– শতকরা ৯৯ জন বাইরের দুনিয়ার কোনও খবর তারা রাখে না। ফ্রান্সে, শুনেছি, অজ্ঞতাটা তারও বাড়া।

পাঞ্জাবি সেপাইয়ের জনপদবধূ কি জানে, পুব বাঙলা কোথায়? এবং সেখানকার বধূর বুকে তারই মতো একটা সুখ-দুঃখ, দু মুঠো অন্নের যেন অনটন না হয় তার তরে তারো জীবনভর একই দুশ্চিন্তা!

তুই শুনলে হাসবি, আমি লাহোর ক্লাবের মেম্বার, ইংরেজ ও গাঁইয়া মেয়ের অজ্ঞতার ভিতর বিশেষ কোনও তফাত দেখিনে। লাহোরের মেম্বার ভ্যাটভূট করে ইংরেজি বলতে পারে বলে আমরা ভুল ধারণা করে বসি তারা বুঝি আপ টু ডেট।

এই সর্বব্যাপী অজ্ঞতার মাঝখানে ইংরেজ শাসকের অজ্ঞতা তাকে দিয়েছিল ভারতীয়ের প্রতি অবজ্ঞা আর পাঞ্জাবি করে ঘৃণা পুব বাঙলার লোককে। তুই তো ঘটি, তবু নিশ্চয় জানিস ওরা বড় টাচি, বাঙলাকে অবহেলা করলে সে তার উত্তর দেয় তিন ডবল অবহেলা দিয়ে। ইংরেজের অবহেলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে তাই তার একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু ব্যাটা যেদিন ঠিক ঠিক বুঝে যাবে, পাঞ্জাবি শুয়ারটা তাকে ঘৃণা করে, তখন শুরু হবে আতসবাজি।

খান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললে, সবই ঠিক, কিন্তু জানিস তো জোর যার মুলক তার। ব্যাটাদের শুধু বন্দুক নয়, আছে ট্যাঙ্ক-প্লেন।

কীর্তি বলল, ইংরেজের কি ট্যাঙ্ক-প্লেন ছিল না। তত্ত্বকথার মূল তত্ত্ব কী জানিস? আজ যদি ক্লেসিয়াস ক্লে আলি তোকে রাস্তায় পেয়ে এক ঘুষিতেই লম্বা করে দেয় সেটাতে তো তোর লজ্জা পাবার কিছু নেই, কিন্তু তার পর যদি তুই তার দাসত্ব স্বীকার করে নিস, সেখানে লজ্জা। ট্যাঙ্ক-প্লেনের শক্তি দিয়ে কাল যদি পাঞ্জাবি টের পাল পুব বাঙলাকে ছারখার করে দেয় তাতে বাঙাল লজ্জা পাবে কেন? শক্তিশালী হামেশাই দুর্বলকে পরাজিত করে।

কিন্তু তার পর যদি বাঙা পাঞ্জাবির দাসত্ব স্বীকার করে নেয় তবে সেখানে বাঙালের লজ্জা। তুই-আমি বাঙালি আমাদেরও লজ্জা।

.

১৩.

শিপ্রা অভিমানের সুরে বললে, এত দেরি করে এলে? এরই মধ্যে আমাকে অবহেলা?

কীর্তি অবাক। সামলে নিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, রবিঠাকুর ছাড়া দেখছি আমাদের গতি নেই :

তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।

আমি এসেছি তোমার দেওয়া সময়ের দশ মিনিট আগে এবং অতি ভয়ে ভয়ে। কারণ তোমাকে ঘরসংসার দেখতে হয়, তার ওপর পুরো তদারকি করতে হয় ব্যবসা-সম্পত্তির। এবং সর্বোপরি কয়েকটা চ্যারিটির হিসাবপত্র দেখা। ইজ্যাক্ট টাইমের এক মিনিট পূর্বে এলে হয়তো বারান্দায় মোক্ষম এক ধাক্কা, কোন এক ঝুনঝুনিয়া বা টুনটুনিয়ার সঙ্গে। আর তিনি হন যদি সিস্টার তেরেসা বা ক্লারা তা হলে তো কেলেঙ্কারি ব্যাপার। যাকে বলে, আমি মরমে মরে যাব, তার শরমে শে শে।

শিপ্রা বললে, উপরে চল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললে, চ্যারিটির কাজ যৎসামান্য। আমি নিজে সেসব স্থলে যাই। সিস্টারদের পক্ষে এখানে আসা সহজ নয়। এবং শুনেছি ক্যাথলিক নাদের অন্তত দুজন না হলে রাস্তায় বেরুনো বারণ। সে কথা থাক। আসল কথাটা শোনো। মনে কর কেউ যদি স্থির করে তার সাংসারিক সব অভাব দূর না হওয়া পর্যন্ত কোনও ভিখিরিকে ভিক্ষে দেবে না, কেউ যদি ভাবে বৈষয়িক সব ব্যাপার গোছগাছ না করে বৃন্দাবন যাব না, তা হলে এঁরও আজীবন ভিক্ষে দেওয়া হবে না, ওঁরও কস্মিনকালে তীর্থদর্শন হবে না। প্রত্যেক দানকর্মে থাকে আত্মবিসর্জন, ক্ষতিস্বীকার তা সে যত সামান্যই হোক। এই যে তুমি ক্ষুদ্রতম এটিকেট রক্ষার্থে বন্ধুর সিগারেট আগে ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা পরে ধরাচ্ছ তাতেও আছে পাঁচ সেকেন্ডের সেকরিফাইস।

কীর্তি সোৎসাহে বললে, হা হা, মনে পড়ছে, তুর্গেনিয়েফও বলেছেন, রকফেলারের লক্ষ লক্ষ ডলার দানের কথা যখন মনে আসে তখন আমার হৃদয়ে তার প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা, কিন্তু যেদিন দেখলুম, আমাদের গ্রামে আটটি কাচ্চা-বাচ্চার বাপ এক অতি গরিব চাষা একটি অনাথ বাচ্চাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিল তখন তার স্মরণে আমার মাথা গভীর গভীরতম শ্রদ্ধায় নত হয়। চাষার ভয় ছিল তার বউ সংসার চালাবার জন্য প্রতিটি কোপেক গোনে, সে দারুণ চটে যাবে। সে রান্না করতে করতে শুধু আপন মনে মন্তব্য করেছিল, এখন থেকে আমরা সপ্তাহে যে একটা দিন পরবের রোববারে চিজ খেতুম সেটা ছাড়তে হবে। আমার ঠিক ঠিক মনে নেই

কিছু দরকার নেই এ ঘটনাটির বর্ণনা তুর্গেনিয়েফের ভাষায় দেবার। ছ বছরের বাচ্চাও যদি এটি আধো আধো কথায় প্রকাশ করে তবু তার মূল্য এক কানাকড়ি কমবে না। লক্ষ টাকা দামের ফুলদানিতে একটি গোলাপ রাখো, আর চার আনার কাঁচের গেলাসে রাখো, গোলাপের সৌন্দর্য কি তখন আসমান-জমিন ফারাক হয়ে যাবে?

কিন্তু তোমার উদাহরণ সত্যি ক্লাসিক পর্যায়ের। রকফেলার বিশ লক্ষ ডলার দান করে কী ক্ষতিটা স্বীকার করলেন? ব্যাঙ্কের খাতাতে কয়েকটি শূন্য কাটা পড়ল মাত্র। বস্তৃত তন্মুহুর্তেই তিনি পাইকিরিতে আরও বিশখানা রোলস্ কিনতে পারেন।

তার নিভৃত বুদওয়ারে কীর্তিকে নিয়ে গিয়ে শিপ্রা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল তার ডিভানের উপর। কীর্তিকে বললে, বসো আমার পায়ের কাছটায়– আমি কেষ্টঠাকুর না হলেও তুমি তো অৰ্জুন। তিনি বুদ্ধিমান; ঠাকুরের পায়ের কাছে আসন নিয়েছিলেন। নিছক বিনয়বশত নয়; তার কুটিল স্বার্থ ছিল। আমারও তাই। তোমার মুখ দেখতে পাব বলে।

বলতে বলতে তার খোঁপা খুলে চুলে বিলি দিতে দিতে মাথার পাশের গোটা তিনেক কুশন ঢেকে দিল। কীর্তি লম্বায়, পরিমাণে এরকম রাশি রাশি চুলের স্তূপ আগে দেখেনি। বিস্ময়ে সেটার প্রশংসা করতে ভুলে গিয়ে বলল, তোমার খোঁপা দেখে তো আমার কখনও মনে হয়নি তোমার এত চুল।

কোঁকড়া চুলের ওই একটিমাত্র সুবিধে। কিন্তু আমার বক্তব্য শেষ হয়নি।

নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পূর্বে কিংবা হঠাৎ বিন্-নোটিশে এলে তুমি। তোমাকে তখন বসিয়ে রেখে টাকাকড়ির টানা-হ্যাঁচড়া করব ওই টুনটুনিয়া না ঝুনঝুনিয়ার সঙ্গে ইভন ফাইভ মিনিটস? নো, এ হানড্রেড টাইম নো। তাকে তদ্দণ্ডেই বিদায় দিলে কী হবে। একটা ডিল হয়তো হবে না। ঝুনঝুনিয়াও বিরক্ত হবেন।

ওরে হাবা, শোন, এইটুকু যদি আমি ত্যাগ স্বীকার না করতে পারি তোর সঙ্গ পাবার তরে তবে তোর মূল্যটা কত? ডিলটাতে হয়তো আমার দশ হাজার টাকার মুনাফা হত। তা হলে যে কোনও মুদি তোকে বলতে পারবে তোর দাম নিশ্চয়ই দশ হাজার টাকার চেয়ে কম– এ তো সোজা হিসাব। আর স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের মূল্য কত? মাত্র ত্রিশটি মুদ্রা। অবশ্য তাঁর যে শিষ্য তাকে বেচে দিয়েছিল দুশমনদের কাছে সে ছিল গ্যালিলির জেলে। আজকের দিনেও সেখানে ত্রিশ মুদ্রা পর্বতপ্রমাণ। আর আমার কাছে দশ হাজার কী! ওদিকে দু হাজার বছর ধরে দুনিয়ার দ্র-ইতর সক্কলের কাছ থেকে জুডাস পাচ্ছে অভিসম্পাত। আমাকে দেবে ক-হাজার বছর ধরে ঝুনঝুনিয়ার কাছে তোমাকে বেচে দেওয়ার জন্য।

তার পর আরামসে চোখ বন্ধ করে বললে, ভাগ্যিস, মা কালীর আশীর্বাদে তুমি-আমি কেউই যিশুখ্রিস্ট নই।

এমন সময় কোনও নোটিশ না দিয়ে কীর্তি হঠাৎ মাথা নিচু করে শিপ্রার একটা পায়ে চট করে চুমো খেয়ে অন্য পায়ে মুখ চেপে দিতে লাগল দীর্ঘতর চুম্বন।

ধড়মড়িয়ে শিপ্রা উঠে বসে কীর্তির মাথা চেপে ধরে বললে, ছি ছি! এ তুমি করছ কী?

কীর্তি কোনও উত্তর দিল না। নিরাশ হয়ে শিপ্রা বসে রইল।

অনেকক্ষণ পরে কীর্তির চুল ধরে তার মাথা টেনে তুলল তখন বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ ভাব না দেখিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললে, কেন? পদচুম্বন সমাসটা কি তোমার একেবারে অজানা। মানুষ গুরুর পদচুম্বন করে। কিন্তু আমি তো কখনও কোনও গুরুর কাছে দীক্ষা নেবার মতো পাত্র নই। তুমিই তো আমার গুরু।

বিস্মিত হয়ে শিপ্রা শুধাল, সে কী?

শোনননি চণ্ডীদাস তাঁর রজকিনীকে গুরু আখ্যা দিয়েছেন তাঁর গীতে?

সে তো তিনি তাঁর সাধনার ক্ষেত্রে রামীকে অনেক রূপেই দেখেছেন, অনেক নামেই ডেকেছেন। তুমি তো অপদার্থ অবশ্য তোমার আত্মাপলব্ধির ভাষায়।

অবাক করলে, গুরু, অপদার্থের তো গুরুর প্রয়োজন সর্বাধিক। খাঁটি সোনাতে কেউ কখনও পরশপাথর ছোঁয়ায় নাকি। আচ্ছা, তর্কস্থানে না হয় গুরুর প্রসঙ্গ বাদই দিলুম। কিন্তু প্রিয়ার পদচুম্বন কি তার প্রসাদলব্ধ জন করে না। তুমি যাকে গুরুদেব বলে প্রায়ই উল্লেখ করে তিনি গেয়েছেন :

অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে—

শিপ্রা বাধা দিয়ে বললে, সে তো তাঁর জীবনদেবতার পদচুম্বন করেছেন তিনি।

রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে কীর্তি বললে, বা রে। এর কয়েক লাইন আগেই তো ওর সঙ্গে তার মহা সাড়ম্বরে, আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক চক্র ততোধিক রেখার জাল এঁকে শুভলগ্ন স্থির করে, শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে পুরোহিত বৃদ্ধ বিপ্রের হাতে ধান্য দূর্বা তীর্থবারি এবং মন্ত্রসহ বিয়ে হল এবং সখীদল ও শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের পর সামাজিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করল।

দোঁহাকার সাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।

এবং এই যে একটা অভূতপূর্ব, ইতিহাসের সর্ব স্বয়ংবর বিবাহকে আপাদ-মস্তক লজ্জিত বিড়ম্বিত করি পাণিগ্রহণ– আমি এই পাণিগ্রহণ সমাসটির দিকে তোমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, শিপি– এই পাণিগ্রহণ মহোৎসবটি সমাধান হল এটির নির্যাস, এটির মধুরতম মধুমন্ত্র পাচ্ছি :

অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।

বধূ, বধূ, বধূ আবার বলি বঁধু নয়, বধূ।

সেই বধূর পদচুম্বন করেছিলেন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যার ভিতর সকল রসের ধারা সর্বদেশ সর্বকাল থেকে বয়ে এসে সম্মিলিত হয়েছিল। দম নিয়ে কীর্তি বলল,

তোমরা যা বল তাই বল, আমার কাছে বধূ যা জীবনদেবতাও তা।

এর পর দেখ, কবিতাটি তোমার আমার অতি কাছে চলে এল। কবিতার সখী পথ দেখিয়ে বরবধূকে বাসরঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে স্বয়ং তুমি। তার পর পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ তুমি যদি সে-ভাবে চরণ প্রসারিত করতে তবে আমি ছুটে গিয়ে পাদপীঠ সগ্রহ করে আনতুম না। তুমি যে শয়নে চরণ প্রসারিত করলে। তাই তো আমাকে ওই অবস্থাতেই পদচুম্বন করতে হল।

ইতোমধ্যে শিপ্রা তার দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে কীর্তির কবিতা আবৃত্তি, তার আপন টীকা কিছুটা শুনছিল। কিছুটা আপন মনে ভাবছিল। তার রাশি রাশি চুল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কীর্তি মাত্র দু দিন ধরে দরদি হিয়ার আহ্বান পেয়ে বক্ বক্ করতে শুরু করেছে। কিন্তু অতদিনের নীরব স্বভাব চট করে যায় না বলে চুপ করে শিপ্রার চুলের ভিতর এদিক-ওদিক আঙুল চালাচ্ছে।

হঠাৎ শিপ্রা মাথা তুলে কীর্তির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্বরে বলল, এসব প্রাণের কথা কার না শুনতে ভালো লাগে? কিন্তু, কীর্তি, আমার মন বার বার ঘুরেফিরে ওই পাদপীঠ কথাটির দিকে যাচ্ছে। পাদপীঠ, সোজা বাঙলায় চৌকি, ইংরিজিতে পেডেস্টেল। তোমার হৃদয়ে দু দিনেই আমার যা মূর্তি গড়ে তুলছ তার পাদপীঠটা উঁচু হতে হতে এখন সেটা ময়দানের বিরাট বিরাট মূর্তির দশ হাত উঁচু পাদপীঠ, স্ট্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, না তুমি আরম্ভ করেছ পাদপীঠ দিয়ে। সেটাকে গড়েছ তোমার চেয়ে তিন মাথা উঁচু। তার উপর খাড়া করবে বা বসাবে নিশ্চয়ই কোনও দেবীপ্রতিমা– অন্য কিছু মানাবে কেন? এবং স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছি সে দেবী আমি। নয় কি?

কীর্তি মুগ্ধ হয়ে ভাবছিল, আহা, এই তো শিপ্রা। রবি-কাব্যের কত না অতলে ডুবেছে সে। অথচ প্রয়োজনমতো আমার মতো এমেচারের সঙ্গেও সে কদম কদম মিলিয়ে চলতে পারে। ওই তো তার মহৎ গুণ। পার্টিতে, ব্যবসাতে, বিয়েবাড়িতে সর্বত্র সে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সক্কলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।

শিপ্রার প্রশ্নের উত্তরে কীর্তি, যেন সমের শেষে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, অবান্তর, অবান্তর এ প্রশ্নটা। প্রশ্নটাই স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ!

হায় রে কীর্তিঠাকুর! তুমি এখনও তোমার শিপ্রা চতুরাকে চিনতে পারনি। সে যেন সন্দেহের ধন্দে দোটানা হয়ে বলল, তোমার ওই কবিতাতেই আছে, বিয়ে বাড়িতে ছিল।

সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ!

বাঙ্গালোরি শাড়ি, বেনারসি ব্লাউজ আর ছেরামপুরি খোঁপা– ওই তো আমার সাজ। এ কি মানাবে সিংগির ঘাড়ের উপর বসলে?

তার চেয়ে ওখানে বসে যদি আমি হীরা-পানা বসানো সোনার চিরুনি দিয়ে কহকিনী মায়াবিনীর মতো চুল আঁচড়াই তবু না হয় ভেঁপো ছোঁড়ারা ওদিকে তাকিয়ে দু একটা রসাল টিপ্পনী কাটবে!

কীর্তির রোমানসে এই পয়লা খোঁচা। এবারে আসছে কু দ্য গ্রাস, ক্লের মোক্ষম মুষ্ট্যাঘাতে রোমান্স-বেলুনের শেষ সর্বনাশ।

অতি গুরুগম্ভীর হাস্যহীন আস্যে শিপ্রা বললে, সবচেয়ে খাসা মানায়, যদি আমি সেখানে কোমরে আঁচল বেঁধে টাটা স্টিলের কড়াইয়ের খাগড়াই কসার খুন্তি দিয়ে তোমার জন্য পুঁইশাকের চচ্চড়ি ঘাটাই।

আহা, যেন একটি সার্থক গবিতা! একটি বাক্যকেই তিন অসমান হিস্যেয় ভাগ করে তিন লাইনে ছাপলেই কোথায় পাউন্ড, কোথায় বন্ধু সমর সেন?

ডাস্টবি-এ পচা ইঁদুর
রিকশায় চীনা গণিকা

এগুলো মহাকাব্যরূপে স্বীকৃত হয়েছে। এবারে জুড়ে দিলে ময়দানের মিনারশিখরে ইশটিলের কড়াই।

কীর্তি যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। হার মানতে মানতে তবু শেষ বাণ ছাড়ল–

দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।

অতি সোহাগভরে দু হাত দিয়ে কীর্তির মাথা বুকে খুঁজে নিয়ে তার মধুরতম কণ্ঠে বললে– সে কণ্ঠস্বর তার পিতা বড় ভালোবাসতেন– ওরে ক্ষ্যাপা, প্রিয়াকে দেবতা করার জন্য প্রেমিক প্রেমিকা, উভয়েরই শাস্রাধিকার অর্থাৎ প্রেমাধিকার চাই। তোমার কিছুটা আছে বিধিদত্ত- কিন্তু দিনে দিনে সেটা বাড়বে না কমবে সেটাও জানেন একমাত্র বিধিই।

তুমি বার বার বলেছ, তুমি অপদার্থ, তাই তোমার ভিতর আমি কী দেখলুম যে তোমাকে ভালোবাসলুম? উত্তর দিই নি। আজ বলি, ওই প্রেমাধিকার। যাকে আমি নাম দিই ধাতু।

কীর্তি শুধাল, ধাতু? বুঝিয়ে বল।

শিপ্রা বললে, তোমাকে নির্মাণ করার সময় বিধাতা একটা বিশেষ ধাতুও মিশিয়ে ছিলেন। সেটা আমি চিনতে পেরেছি। এর বেশি বুঝিয়ে বলা যায় না। ওটা বোঝার জিনিস নয়, উপলব্ধির ধাতু। হয়তো নিজেই একদিন উপলব্ধি করতে পারবে। ব্যস! এখন চুপ করো।

.

১৪.

কীর্তিদের ক্লাব-বারের উচ্চ উচ্চ দণ্ডাসনে বসে ডাইনে-বাঁয়ে স্টিয়ার করাটা যারা সব সময় পছন্দ করতেন না, তারা আসন নিতেন ছোট ছোট টেবিলের চতুর্দিকে। আবদার ড্রিংক এনে দিত টেবিলে টেবিলে। আবদার কথাটা ফারসি থেকে এসেছে প্রাচীনতর যুগে, জোর চালু হয় কোম্পানির আমলে এবং ইদানীং মুমূর্ষ। যদিও আব শব্দের অর্থ জল, প্লেন ওয়াটার– যেমন আবহাওয়া ও দার কথাটার অর্থ, যে ধরে, যেমন জিম্মেদার তথাপি রূঢ়ার্থে সে মদ্যাদি তরল দ্রব্যের রক্ষক ও পরিবেশক। ইরান দেশে এই ব্যক্তিই যদি দ্ৰশ্রেণির শিক্ষিত তরুণ বা তরুণী হয় এবং বন্ধু বা বান্ধবীরূপে কাব্যালোচনা, সঙ্গীতাদির দ্বারা বিশেষ একজনকে আপ্যায়িত করে বা আসর জমিয়ে তোলে তবে তার নাম সাকি।

দণ্ডাসীনদের ভিতর কথাবার্তা হয় ছেঁড়া-ছেঁড়া। টেবিলওলাদের ভিতর মাঝে-মিশেলে দু একটি বিষয় নিয়ে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী আলোচনাও হয় কিন্তু আমাদের রক বা পাড়ার চায়ের দোকানে সেখানে প্রাগুক্ত ক্লাবের মতো একে অন্যকে চেনে এবং প্রায় সব খদ্দেরই বেনামি একটা ক্লাবের অনারারি মেম্বার যে রকম তর্কাতর্কির সাইক্লোন টর্নেডো বয়ে যায়, এই খানদানি ক্লাবে সেরকম হয় না। কারণ কেউই কোনও বিষয়ে সিরিয়াসলি নেয় না, কারওরই বিশেষ কোনও মতবাদে দৃঢ়বিশ্বাস নেই। তারা শুধু একটি বিষয়ে অচঞ্চল দৃঢ়মত পোষণ করেন পানের দ্রব্যটি যেন যে লোক যা নিত্যি নিত্যি খায় আজও যেন নির্ভেজাল তাই হয়। এবং যেহেতু সাধারণ মানুষ যদি কোনও বিশেষ একটা জিনিসের প্রতি তার সর্ব চৈতন্য সর্ব ধ্যানে পরিপূর্ণ নিয়োগ করে দেয় তবে সে অন্য সব বাবদে অম্লাধিক উদাসীন হতে বাধ্য– অর্জুন যে রকম পাখির চোখের দিকে তাগ করার সময় শুরু, ভ্রাতা এমনকি বৃক্ষটাকেও দেখতে পাননি। বাইবেলও বলেছেন, দুই প্রভুর সেবা করা যায় না!

আজ কিন্তু তর্কটা জমে উঠেছে। ইয়েহিয়া খান এসেছেন ঢাকায়। শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা আপস করতে। কীর্তি এসে দলে ভিড়ল আলোচনা যখন অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে– বসল তার সুদিনদা ও ইয়ার খানের পাশে। যে সমস্যা নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে সেটা : ইয়েহিয়া কি সত্যই আওয়ামী লীগের হাতে পুব বাঙলার চোদ্দ আনা কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।

মিত্তির যদিও প্রায় প্রতি রাত্রেই কিঞ্চিৎ বে-এক্তেয়ার হয়ে বাড়ি ফেরে তবু সবাই জানে যে বদ্ধ মাতাল অবস্থায়ও সে যদি কাউকে কোনও কথা দেয় তবে পরের দিন সে কথা তুললে, যদিও সে সে কড়ার বিলকুল স্মরণে না আনতে পারে তবু ক্ষয়ক্ষতির পরোয়া না করে সত্য রক্ষা করবে। অতএব তার দৃষ্টিবিন্দু এক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্যগত। বলল,

তোমরা ভুলে যাচ্ছ ইয়েহিয়া সেপাই, অফিসার। সে পলিটিশিয়ান নয় যে ঘড়ি ঘড়ি ভোল পালটাবে। ইংরেজ জাতটা পলিটিকস করে। আমাদের হোমরুল, অটোনমি, হাফ-স্বরাজ, স্বরাজ দেবার হোলি প্রতিজ্ঞা করে সেটা ভঙ্গ করেছে। কতবার হিসাব নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক একই সময়ে গোপনে আরবদের কাছে কসম খেল যুদ্ধ শেষে প্যালেস্টাইন ওদের হাতে সঁপে দেবে এবং সঙ্গে সঙ্গে টাকার কুমির মার্কিনদের হুবহু ওই একই প্রতিজ্ঞা করল। যুদ্ধ শেষে চেষ্টা করল, নিজেই সেটা হজম করার। শেষটায় যখন নিতান্তই বদহজমে যায় যায়, তখন আরব আর ইহুদিদের লড়িয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। এবং দুই পক্ষকেই আগুনের দরে আউট অব ডেট পুর্না পুর্না বন্দুক কামান বিক্রি করল। ওদিকে দেখ দ্য গল। সেপাই। রাজ্য চালনার সময় আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষার আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে পদে পদে মার খেয়েছে। ইয়েহিয়াও সেপাই।

সুদিন বললে, ইয়েহিয়া যদি সত্যিকার সেপাই হয় তবে পাক্কা সাড়ে তিনটি মাস ধরে ন্যাজ খেলানো কেন, বাবা? ইলেকশন হয়েছে সেই ডিসেম্বরের প্রথম হপ্তায় আর আজ মার্চের মাঝামাঝি। এখনও ডেট স্থির হয়নি এসেমরি কবে বসবে– বল না শঙ্কর তোর মামা না এসেমব্লিতে কী যেন কোন ডাঙর নোকরি করে এসেমব্লি ডাকতে কতদিন সময় লাগে? আসলে সুদিনের মতলব শঙ্করকে তাতানো। কারণ শঙ্করজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তর্কে সুদিনের বিপক্ষ মত তারস্বরে প্রচার করা। অন্য সর্ব বাবদে হরিহরাত্মা। আজ সব্বাইকে অবাক করে বলল, মেরেকেটে উইদ এ ভেরি লিবরেল মার্জিন– সাত দিন। কিন্তু সে প্রশ্নটা তোলার পূর্বে ভুলে যাচ্ছিস কেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইয়েহিয়া তো মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসেমব্লি সেশন ডিক্লেয়ার করে ফের সেটা নাকচ করে দিল। কী বল, মিত্তিরঃ ইয়েহিয়া না সোলজার।

ইউনুস মির্জা মেদিনীপুর না কোথাকার খাঁটি পাতি। রঙটিও বায়স প্রায়। দেমাক করেন তিনি মোগল না পাঠান কী যেন। বলতে ভালোবাসেন উর্দু- যদিও সেটা তালতলার স্ল্যাং। বেহারের নেটিভ আবদাররা পর্যন্ত সে বত্রিশ ভাজা শুনলে মুখ টিপে হাসে। উড়ে-ঘেঁষা বাংলা শুনলে মারওয়াড়ি ত আপন বাংলার পিঠে হাত চাপড়ায়। যেন মিত্তিরকে নিয়ে মিত্রপক্ষ রচনা করার জন্য অর্থাৎ ইয়েহিয়ার পক্ষ নিয়ে বলল, কিন্তু ইয়েহিয়া যথেষ্ট কারণও দেখিয়েছেন।

কীর্তিসখা খান ফ্যাকচুরিয়াস। কারণ না কচু! লেম একিউজ এবং তার কারণ– ঘোড়াটার চারটে পা-ই আগাপাশতলা লেম।

মিত্তির কী যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু খান বাধা দিয়ে বললে, লীগে-ইয়েহিয়ায় যদি একটা সমঝোতা হয়ে যায় তবে তো ল্যাঠা চুকে গেল। সে নিয়ে তর্কাতর্কি হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতো বিলকুল বেকার। আর যদি না হয় এবং ফলে পুব বাঙলা বিদ্রোহ করে– লীগ কুল্লে দেশের ভোট পেয়েছে তাই বিদ্রোহটা হবে তামাম দেশজুড়ে আর স্বভাবতই ইয়েহিয়া চালাবে খুন-খারাবির দমননীতি। তখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণজন আর ভারত সরকার রি-অ্যাক্ট করবে কীভাবে?

শঙ্কর তার পূর্বমত কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে চিন্তিত চিত্তে বললে, পাঞ্জাবি পাঠান সেপাইরা তাদের প্রতিবেশী, জাত-ভাই কাশ্মিরি মুসলমানদের সাহায্য দেবার নামে এসে তাদের ঘরবাড়ি কীরকম লুটপাট করেছিল সেটা অন্তত আমার অজানা নয়। আর এই বহুদূরের বাঙালদেশে তারা নরম চামড়ার দস্তানা পরে পিউনিটিভ অ্যাকশন নেবে, সেটা দুরাশা।

মির্জা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, যা-ই করুক না কেন, ওটা তো পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার।

খান তো রেগে টং। ঘরোয়া ব্যাপার! আসা ডিপ্লোমেটিক ভাষা। যেটা ডাহা সত্য বিকৃতির ভদ্র বা ভণ্ড নাম। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মেলা নিকট আত্মীয় রয়েছে পুব বাঙলায়, আর এখানে যেসব হিন্দু রেফুজি পুব বাঙলা থেকে এসেছে তাদের সে দেশে মা-ভাই রয়েছে ঢের ঢের বেশি। তাদের গায়ে বুঝি রক্ত নেই। তাদের বেলা এটা শব্দার্থে সত্যার্থে ঘরোয়া ব্যাপার। তোমার বেলা ওটা ডাহা নির্জলা ফন্দি–মানুষ মারার অজুহাত।

সুদিন বললে, ফ্রান্স-জর্মনির লড়াই ছিল ওদের দুজনার ঘরোয়া ব্যাপার। তবে কেন শতাধিক বৎসরের নিরপেক্ষ সুইটজারল্যান্ড হিটলারলাঞ্ছিত কি ইহুদি, কি জর্মন পলাতক সবাইকে আশ্রয় দিল? এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বে-আইনিভাবে। এদের প্রায় কারওরই সরকারি পাসপোর্ট, সুইস ভিসা ছিল না।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উচিত যে সুইস ফ্রন্টিয়ারে সে-দেশে ঢোকার সময় যে ধরা পড়েছে তাকে ধাক্কা মেরে যে দেশ থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সে দেশের পুলিশের হাতে সমর্পণ করা। অর্থাৎ পলাতক পুত্রকে ফের ডাইনির হাতে সমর্পণ করা। ওরা সবাই ছিল জর্মন সিটিজেন। হিটলার তাদের নিয়ে কী করবে, না করবে, সেটা তার নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। তবে সুইটজারল্যান্ডের মতো দ্র দেশ, ভদ্রতর সরকার দিনের পর দিন এরকম বেআইনি কর্ম করে ওদের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল কেন? তদুপরি সুইস সরকার বেশ জানত, হিটলার যখন হল্যান্ড, বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা চুক্তি উপেক্ষা করে দুটো দেশ দখল করে বসে আছে তখন প্রয়োজন বোধ হলে কিংবা নিতান্তই খামখেয়ালির ঝোঁকে সুইটজারল্যান্ডকেও আক্রমণ করতে পারে। বেআইনিভাবে পলাতক জর্মনদের আশ্রয় দেবার বিগলিতাৰ্থ : সুইটজারল্যান্ড আক্রমণ বাবদে অর্ধসুপ্ত ম্যান-ইটার হিটলার বাঘার ন্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টান মারা।

সোমেন চাটুয্যে বললে, অত সাত সুমুদ্র পাড়ি দিচ্ছ কেন বাওয়া? ওই যে তোমার পুব পাকিস্তান থেকে তেইশটি বচ্ছর ধরে কখনও বানের জলের মতো হুড়মুড়িয়ে, কখনও ঢেউয়ে ঢেউয়ে, আর ছিটেফোঁটায় তো অহরহ রেফুজি আসছে, তাদের ঢুকতে দিচ্ছ কোন আইনে। ওহে মির্জা সাহেব, ওদের ঠেলায় তোমার-আমার প্রাণ যায়। তুমি, দাদা, যাও না বর্ডারে। তোমার গভীরতম পলিটিকাল ডকট্রিন ঘরোয়া ব্যাপারটা প্রিচ করো না ওদের সামনে সবিস্তর সালঙ্কার। একটি কাজের মতো কাজ হয়।

শঙ্কর বলল, ছিঃ চাটুয্যে! মির্জা সাহেব উচ্চাঙ্গের সমাজসেবক এবং ভারতপ্রেমী। তাঁর অকাল মৃত্যু কামনা করাটা কি ব্রাহ্মণসন্তানের পক্ষে গৌরবের বিষয়!

এমন সময় বেয়ারা মিস্টার মির্জার হাতে একখানা ভিজিটিং কার্ড এনে দিল। সেটার উপর চোখ প্রায় না বুলিয়েই মির্জা সক্কলের দিকে চোখের দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে বললে, জেন্টলমেন, আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু লক্ষ্ণৌ থেকে এসেছেন। আপনারা যদি সদয় অনুমতি দেন তবে তাকে এখানে নিয়ে আসি, নইলে অন্য টেবিলে

তার সেই বিগলিত অনুরোধ শেষ হবার পূর্বেই সমস্বরে কোরাস গান উঠল :

নিশ্চয়, নিশ্চয়
সানন্দে, সানন্দে
মেহেরবানি কিজিয়ে,
সার্টেনলি, সার্টেনলি (কোরাস)

ক্লাবটা ইন্টারন্যাশনাল, মেম্বাররা কসমোপলিটান। এ হেন অভ্যর্থনা সাতিশয় স্বাভাবিক। গ্রাম্য কবির আপ্তবাক্য এই ফ্যাশন-ক্লাবে বেশভূষোয় ঠিক ফিট করবে না কিন্তু ভিতরের রস একই। শহুরে শ্যাম্পেন আর গাঁইয়া তাড়ির ধর্ম এক, বর্ণ ভিন্ন :

যে রসে মগন
তাহাতে তখন
হোক না কুজন
হল মহাজন।

শুধু খান আর কীর্তি উদ্বাহু হয়ে পাঞ্চজন্য আমন্ত্রণে যোগ দিল না।

মির্জা সেটা বোধহয় লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তাতেই-বা কী? ওভারহুয়েলমিং মেজরিটি তাঁর পক্ষে। যদিও জানা কথা, আজ স্পষ্টতর হল যে আওয়ামী লীগের থান্ডারিং মেজরিটির চেয়ে ঢের ঢের বেশি কবুল করেন ভুট্টোর হুইসপারিং মাইনরিটিকে।

চাটুয্যে ফিসফিসিয়ে খানের কানে কানে বললে, ব্যাটার হাড়কিপটেমি তার লোমে লোমে খাটাশের দুর্গন্ধ ছাড়ে। কখনও কোনও বন্ধুজনকে সঙ্গে আনতে দেখেছিস? তার সামনে চিচিং ফাঁক হয়ে যাবে যে। আজ শালাকে দু তিন রোদ খাওয়াতে হবে অন্তত। বেটা উড়ে স্নবস্য সুব। ওদিকে দোস্তটি খানদানি লখনওয়ি মনিষ্যি। জাতে ওঠবার তরে কোন না তিন পাত্তর খাওয়াবে? তুই অত মুখ গুমড়ো করেছিলি কেন রে, উল্লুক?

দ্যাখ, ও ব্যাটার দেওয়া শ্যামপেন আমার কাছে বিষ্ঠে। সত্যি বলতে কি, আল্লার কুদরতে ওই মির্জা সম্বন্ধী যদি কোনওদিন দরাজদিল হয়ে যায়, তবে তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আর্সেনিক খেয়ে মরতে রাজি আছি আমি একশো বার।

তুই বড্ড সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস। আর আজকের এই পুব বাঙলা নিয়ে ফ্যাশনেবল কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ এরকম সিরিয়াস হয়ে গেলিই-বা কেন? এই দ্যাখ না তোর এক লেঙোটার ইয়ার শ্রীমান কীর্তিকে। চাঁদপারা মুখ করে কখনও কান দিল, কখনও দিল না।

কীর্তি উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে এমন এক বিশেষ স্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হল যেখানে রাজাও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না, লক্ষ মোটরের মালিক ফোর্ডকেও পায়ে হেঁটে যেতে হয়।

টয়লেট থেকে ফেরার সময় বারের পাশে আসতেই বেয়াত্রিচের চোখে চোখ পড়ল। ইঙ্গিতটা অস্পষ্টতমের চেয়েও এক বাও নিচে। তবু কীর্তি বারের সর্বশেষ দণ্ডাসনে বসতেই বেয়াত্রিচে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে, মনামি।

ডিউটির সময় খাওয়াটা আমার পছন্দ নয়। তবু তোমার সম্মানে। কিন্তু দুটো ড্রিংকই অন মি।

আস্তে বল। নইলে বার-এর বোতলগুলো হাসতে হাসতে ফেটে পড়বে। একে তুমি লেডি, তদুপরি অবিবাহিতা লেডি। তোমার আপন কেতাদুরস্ত দেশে কখনও কোনও সিরিনা নোংরা লিরা হাতে তুলে একটা হুনোর জন্য পে করে?

না, কিন্তু আমি তোমার বন্ধু, সেইটেই আমার পরিচয় নম্বর এক। সিন্নোরা না সিস্লোরিনা– সেটাকে ঘোড়ার রেসে বলে অলসো র‍্যান–মানে থার্ড প্লেসও পায়নি। এবারে মন দিয়ে শোনো। এখন ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তাকিয়ো না। পরে এক ঝলকে দেখে নিয়ে, কিন্তু ভালো করে চিনে নিয়ো। তোমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসে ওই যে রামছাগল মির্জাটা, তার পাশে বসেছে তার এক ইয়ার-জান্ দিলের ইয়ার–একটা শয়তান ছাগল।

কেন যে তোমাকে বলছি, জানিনে। না, জানি।

তোমরা পাচো ইয়ারে বার-এর টেবিলের পাশে বসে কত না আজেবাজে কথা বল কে বা শোনে কে বা দ্যায় কান? কালেকস্মিনে অবশ্যি দু একটা সিরিয়াস আলোচনা করো বটে, কিন্তু কেউই সিরিয়াসলি ওসব গায়ে মাখো না। তোমাদের আলোচনা পিন টু এলিফেন্ট।

তিন দিন ধরে দেখছি, ওই মির্জেটা রোজ রোজ আসছে, সাঁঝের পয়লা ঝেকেই। রোজই কানে আসছে পুব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনা এবং রীতিমতো সিরিয়াস। তিন দিন ধরে। কেমন যেন খটকা লাগল। কাল সন্ধ্যায় লক্ষ করলুম, তোমাদের অভ্যাসমতো এক ব্যাপার থেকে অন্য ঘটনায় তোমাদের কথাবার্তা চলে গেলে ওই মির্জেটা আবার সন্তর্পণে আলোচনাটার মোড় ফেরায় পাকিস্তানের দিকে। আমি তো বার-এর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অবধি চৌকিদারি করি, সব কথা কানে যায় না, তবু আমার মনে হল মির্জা যত না নিজের কথা কয়, তার চেয়ে প্রশ্ন শুধিয়ে শুধিয়ে সব্বাইকে ওসকায়।

কীর্তি অবিশ্বাসের সুরে কিন্তু দরদি গলায় বলল, ওসব তোমার কল্পনা, বেয়াত্রিচে ডার্লিং।

বেয়াত্রিচে বললে, কাল বেলা তিনটে অবধি তোমার মন্তব্যটা মেনে নিতে আমার বিশেষ আপত্তি হত না।

কাল বেলা তিনটেয় মির্জা বারে এলেন ওই ইয়ারকে নিয়ে। বার তখন শূন্য, আমিও দুপুরের মিনি নিদ্রায় এক কোণে টুলছি। ওই দূরের কোণটায় বারের উঁচু টুলে বসে নিচু গলায় গুজুর গুজুর আরম্ভ করলেন, মির্জা কখনও ভাঙা ভাঙা উর্দু বলে সে উর্দু আমাদের এলিয়েট রোডের যমজ– ওটা আমার সড়গড়। কখনও বলে ইংরেজি– সেটা বুঝতে আমাকে বেগ পেতে হয় অবশ্য। কিন্তু সেইটে আসল কথা নয়। আসল কথা ওরা ভেবেছে আমি অতদূর থেকে তাদের কথা শুনতে পাব না, বুঝতে পারব না। আর আমি তো সামান্য বারু-মেড়। বুওনো দিও–গুড় লর্ড তোমাদের চোখের একটি চুলের কাঁপন থেকে একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, কেউ এখন কন্যাকের বদলে উইস্কি চায়, কে একটা নোভালজিনের বড়ি চায়। আর দশ হাত দূরের থেকে ওদের ঠোঁটের করতাল বাজানো থেকে বুঝতে পারব না, ওদের খুলির ভিতর কী সব বদামি আবজাব করছে? জানো, শার্লক হোমস অন্ধকারে বেড়ালের চেয়ে দেখত বেশি!

সর্বক্ষণ তারা কথা কইছিল পুব আর পশ্চিম বাঙলার বাঙালিদের নিয়ে। দোস্তকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল মির্জা উভয় বাঙলার বাঙালিদের মধ্যে কোনও দোস্তি নেই। বলল, জানেন না, ১৯৬৫-র লড়াইয়ের সময় যেসব পাঞ্জাবি পাঠান সেপাই বর্ডারে পাহারা দিচ্ছিল তাদের দিন কেটেছে বাদশাহি খানা খেয়ে, নবাবের হালে। গায়ের বাঙালি মেয়েরা বিরিয়ানি কোর্মা বেঁধেছে আর পুরুষগুলো বাঁকে করে সেগুলো ডেগ-ডেগচিতে নাকে নাকে ভরে নিয়ে গিয়েছে ওদের কাছে, আর–

হঠাৎ থেমে গিয়ে বেয়াত্রিচে বললে, বাকিটা এখন না। আমার মনে হল ওই বিদেশি ঘুঘুটি আমার দিকে একবার আড়নয়নে তাকাল যেন। তুমি এখন একটা চোটা পেগ পরিমাণ হেসে আমার গালে একটি মিষ্টিমধুর ঠোনা মারো। ভাবটা, যেন আমার সঙ্গে প্রেমালাপ করছিলে।

কীর্তি কিন্তু অকৃত্রিম হাসি হেসেই ঠোনা মেরে বললে, দান্তে তো তাঁর প্রিয়া বেয়াত্রিচের সঙ্গে কদাপি রসালাপ করেনি।

দণ্ডাবতরণ করে চলেছে মৃদুপদে কীর্তি পার্টির দিকে। বিদেশি ঘুঘুকে যেন শুনিয়ে দিয়ে একটুখানি উঁচু গলায় বললে, টেক কেয়ার! খান চটবে।

কীর্তি ঘাড়টা একটু পেছনবাগে বেঁকিয়ে আরেক গাল হেসে বলল, ও আমার আন্ডার স্টাডি।

তোমার হাফ ড্রিংকটা পাঠিয়ে দিচ্ছি! বাব্বা! রসে টইটম্বুর। প্রেমের বন্যা যেন। পেটে আর এক ফোঁটাও ধরবে না।

কীর্তি চেয়ারে বসতে না বসতে শুনতে পেল বিদেশি ইয়ার যেন যৎসামান্য ব্যঙ্গের সুরে টিপ্পনী কেটে বললেন, কোনও কোনও বার-এর ভিতরে-বাইরে দু দিকেই স্বরাজ। বন্দোবস্ত আচ্ছা হ্যায়।

সুদিন বেশ কঠিন গলায় বললে, সিন্‌রিনা বেয়াত্রিচের পরিবার বহু ক্লাবের বহু মেম্বারের চেয়ে প্রাচীনতর। আমাদের কলকাত্তাই কায়দা শিখতে অনেকেরই সময় লাগে, মিস্টার লারি।

মির্জার মুখ একটু বেগুনি হল। যদিও তার চামড়াটা গণ্ডারের বাটা কোম্পানি কিনতে চেয়েছিল দক্ষিণ মেরু অভিযানের বুট বানাবার তরে।

লারি কিন্তু সত্যই বেয়াত্রিচের ঘুঘুবর। যেন বিরাট প্রশংসা শুনে আনন্দের হাসিতে খান খান।

ইতোমধ্যে মির্জা দাঁড়িয়ে উঠে কীর্তির সঙ্গে লারির পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, ইনি আমাদের চৌধুরী কীর্তি সাহেব, আর ইনি মি. লারি।

মি. লারি যে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়েছেন সেটা না-দেখার ভাব। ভান করে কীর্তি ওর দিকে ভালো করে না তাকিয়ে ছোটাসে ছোটা একটা নমস্কার বলে ঝপ করে বসে পড়ল।

চাটুয্যে গুনগুন করে খানকে শুনিয়ে বললে, ব্যাটাচ্ছেলে মির্জাটা অ্যাদ্দিন ধরে আমাদের সঙ্গে ওঠবস করছে অথচ এটিকেটের এ অক্ষরটিও তার রপ্ত হল না। পরিচয় করিয়ে দেবার সময় কার নাম আগে আর কার নাম পরে বলতে হয় অ্যাটুকুন হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান হল না।

চাটুয্যের জ্যাঠামশাই তাঁর কচ্ছপের খোল ড্রেস শার্ট বিলেত থেকে স্টার্চ করিয়ে আনতেন, আর আইনের বই বাঁধিয়ে আনাতেন প্যারিস থেকে। চাটুয্যের মামা রসাল ঘোষালকুল যে পরিবারের গুরু তাঁরই একজন ইন্ডিয়ার প্রথম লর্ড। কায়দাকেতায় কেতাদুরস্ত।

কীর্তি দরদি কণ্ঠে বললে, মি. মির্জা, আমার নাম কীর্তি চৌধুরী। পাঞ্জাবি মহাখানদানিদের মতো চৌধুরী কীর্তি নই। আমি অতিশয় সাদামাটা বাঙালি– আল্লাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মি. লারি বড়ই অমায়িক ব্যক্তি। মৃদুহাস্যে শুধোলেন, পাঞ্জাবি হতে কি আপনার ঘোরতর আপত্তি?

কীর্তি বুড়বকের মতো মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, পাঞ্জাবি পাঞ্জাব পঞ্চ + আব– পাঁচ রকমের জল। ওরে বাবা!

লারি কীর্তির চেয়ে অধিক বুড়বকের মতো প্রশ্নভরা মুখে এর-ওর দিকে তাকালেন।

আমাদের ক্লাব-মেম্বার চাটুয্যেরই পূর্বপুরুষগণ অম্মদেশীয় শাস্ত্ররাজির ভূরি ভূরি টীকাটিপ্পনী রচনা করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। বক্ষ্যমাণ চাটুয্যের কাছে সংস্কৃত গোমাংস রাহমাংসবং বলা চলে না, কারণ উভয় মাংসেই তার ঔদরিক নীতি উদার, তবে সেটাকে সে মহামাংস অর্থাৎ মানুষের মাংস হিসেবে গণ্য করে। তাই এস্থলে টীকাকারের রক্ত কার গায়ে তার চেয়ে বেশি।

লারির দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জ্ঞানদান করে বললে, শব্দার্থে অর্থহীন, ভাবার্থে মহা মূল্যবান। পাঁচ ঘাটের জল খাইনে এ-ইডিয়ামের অর্থ আমি যত্রতত্র সর্বত্র থেকে আমার পানীয় সঞ্চয় করিনে। আমার রুচি আছে। অর্থাৎ কীর্তিবাবু ফেসটিডিয়াস, বাছেন, চুস্ করেন, অর্থাৎ ভেরি choosy।

লারিকে ঘায়েল করা কঠিন কর্ম।

বললেন, বাঙালি আর্যের পূর্বপুরুষ তো পাঞ্জাব থেকে এসেছেন। তারা তো পাঞ্জাবি।

অতিশয় মৃদুকণ্ঠে সুদিন বলল, এবং তাদের পূর্বপুরুষ বাঁদর- ডারউইন বলেছে। বলেই একটি কৃত্রিম হাই চাপতে চাপতে বললে, ভেরি সরি, মিস্টার লারি। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত, গুড নাইট। সকলের দিকে তাকিয়ে আরেকটা হাই চেপে, আরেকটা গুড নাইট হেঁকে বারের দিকে চলল।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। লারি আর মির্জা ছাড়া।

কীর্তি মনে মনে বললে, বেয়াত্রিচের সন্দটা বোধ হয় ঠিক। বাবুদের সব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি বলে সভা ভঙ্গে ক্ষুণ্ণমনা।

তার সঙ্গে চলল মাদ্রাজি রঙ্গনাথন। সমস্ত সন্ধ্যা মুখ খোলেনি।

কীর্তি তাকে শুধাল, তুমি আর লারি যখন একসঙ্গে টয়লেট যাচ্ছিলে তখন আসতে-যেতে কী গুজুর গুজুর করছিলে?

বলছিল, পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তান অভিন্ন অচ্ছেদ্য রাষ্ট্র। এক রাষ্ট্রাংশ যদি কেটে পড়ে তবে দ্রাবিড়রা যে উত্তর ভারত থেকে কেটে পড়তে চায় সে আন্দোলন কি বলবান হবে না? সেপারেটিস মুভমেন্ট আরও আবোল-তাবোল কী সব। সে মুভমেন্ট ভারতকে দুর্বল করে দেবে। পুব বাংলার আন্দোলন দৃষ্টান্ত হয়ে, অপরোক্ষে ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। সদানন্দ, সদানীরব রঙ্গনাথন শেষটায় বলল, নোজি চ্যাপ, শুক অঁক করছে সর্বক্ষণ! বেরুবার সময় বেয়ারা কীর্তির হাতে একখানা চিরকুট দিল। তাতে লেখা :

ডার্লিং কে,
কাল আমার অফ ডে। পাঁচটায় খানের ওখানে যাব। তুমি আসতে পারবে? বাকি সব-কথা ওর সামনে হবে।
—তোমার
বি।

.

১৫.

শিপ্রা ব্যালকনির উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় তাকিয়ে আছে পার্কের সবুজ ঘাসের দিকে। এ সময়টায় কলকাতার ঘাস তার সবুজিমা অনেকখানি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু যে জন অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানে, অল্পের ভিতর বৃহতের সন্ধান পায় সে যৎসামান্য উপাদান থেকে তার রসের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারে। কলকাতায় থাকার মধ্যে আছে কী? নিচে ঘাস, উপরে আকাশ। রসগ্রাহীর কাছে দুটোই সজীব। ঘাস তার রঙ বদলায় ঋতুতে ঋতুতে। গ্রীষ্মের প্রতাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ পরী তার ডানা দুটির উপর যে ক্রিম আপন হাতে তৈরি করে মাখেন তাতে নীলের পরিমাণ দিতে থাকেন কম– রঙ প্রতিদিন হলদের দিকে চলতে থাকে।

এমন সময় হঠাৎ হয়তো একদিন অকাল বৃষ্টি হল। সঙ্গে সঙ্গে পরের দিনের সার্থক করার কথা স্মরণে ক্রিমে নীলের মেকদার বাড়িয়ে দেন।

কিন্তু যে জন প্রতিদিন ওই ঘাসের দিকে না তাকায়, সবুজের ধ্যানে অন্তত ক্ষণতরে নিমগ্ন না হয় সে এই প্রাণবন্ত পরিবর্তনের রস থেকে হয় বঞ্চিত। শিপ্রা যবে থেকে প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে সেই থেকে সে এ রস চেখে আসছে। বিলেতে দুটো শীতকালে যখন মাঠ-বাট বরফে ঢেকে শ্বেতে শ্বেতে শ্বেতময়, তখন সে সেটার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় কিন্তু কলকাতার সে সময়কার হলদে-ঘেঁষা সবুজ ঘাসের বিরহ-বেদনা অনুভব করেছে।

কলকাতার আকাশ অতিশয় সজীব। তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় কৈশোরে– যখন জ্বর-সর্দির ভয় কম ছাতে শুয়ে। শহরের প্রদীপ যেমন যেমন নিভতে থাকে লাজুক আকাশবধূ তারই সঙ্গে সঙ্গে তারার মালা, অলঙ্কার একটির পর একটি পরতে থাকেন। হয়তো সে ঋতুতে প্রথমেই দেখতে পাবেন কেসিয়োপিয়া, কৃত্তিকা সাতভাই চম্পা কিংবা হয়তো বধূ প্রথমেই পরবেন কালপুরুষের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রমণিটি, তার পরই সপ্তর্ষি। চক্ষু যদি নিদ্রাহীন হয় তবে স্পষ্ট দেখতে পাবেন অরুন্ধতী, তার স্বামী বশিষ্ঠের পাশে বসে ক্ষণতম মৃদুহাস্য করছেন মিটমিটিয়ে। হয়তো সে রাত্রে আকাশে তার রঙ বদলাতে বদলাতে পরে নেবেন তার মেখলা, নীবিবন্ধ আকাশ-গঙ্গা দিয়ে, দিগ্বলয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজুড়ে। সেই কটিবন্ধ থেকে ঝুলবে কত না অত্যুজ্জ্বল ক্ষীণ-জ্যোতি, মধ্যজ্যোতির মণিমাণিক্য। আর অভিসারিকার গতিবেগ এতই মৃদুমন্দ যে সেটা চোখেই পড়ে না। হঠাৎ দেখতে পাবেন পশ্চিমাকাশের একটি গয়না নেই– তার বদলে পূর্বাকাশে আর একটি উজ্জ্বলতর মণির স্তবক।

মর্ত্যের কোন রাজ-রাজ্যেশ্বরী অভিসারে যেতে যেতে এই ইন্দ্রপুরীর মণির মতো ক্ষণে ক্ষণে অলঙ্কার পরিবর্তন করতে পেরেছেন।

কিন্তু হায়, এ বধূ রাত্রিশেষে হয়ে যাবে বিধবা। উষস দেবীর আশীর্বাদ তার তরে নয়। তার আগমনের আভাস পাওয়ামাত্রই বধু সর্ব অলঙ্কার ধীরে ধীরে বর্জন করেন। সর্বশেষে সর্বোল শুকতারা মণিটি।

শিপ্রা এ সৌন্দর্য উপভোগ করেছে বহুবার। আর সব বিষয়ে সে ইংরেজের মতো কাঁটায় কাঁটায় চলে। নিত্যদিনের রুটিন কাজকর্মে কোনও কামাই দেয় না। শুধু ডাইরি লেখার বেলায় সে আর সর্ব বাঙালির মতো গাফিলিতে পরিপক। সেই অনিয়মের ডাইরিতে, যেখানে শূন্যতারই রাজত্ব বেশি– লেখা-পাতার ওয়েসিস সামান্য। সে কটির অধিকাংশে আছে আকাশের অভিসার যাত্রা।

হঠাৎ শিপ্রার মনে নতুন ভাবোদয় হল, হৃদয়-মনের এই নবজাতক, এর কথা ডাইরিতে বলতে হবে।

ইতোমধ্যে অকালবৃষ্টি নেমে শিপ্রার পায়ের উপর সে রাতের এবং প্রতি রাতের কীর্তির মতো চুমো খেতে লাগল। শিপ্রা চোখদুটি বন্ধ করল– আহ! পা সরাল না।

আর কীই-বা দরকার! সে নেপালিশ ব্যবহার করে না। আলতা মাখে কালেভদ্রে– নিতান্ত বুড়ি নাপতেনিটাকে নিরাশ না করার জন্য।

.

যেখানে মানুষ জানে, তার প্রিয়জন আসবেই আসবে, ঠিক সময়েই আসবে, এমনকি তার কিছু পূর্বেও আসতে পারে, সেখানে প্রতীক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত মধুময়। কিন্তু যে স্থলে স্থিরতা থাকে না, আসবে কি আসবে না, সেখানে সন্দেহের দোলা হৃদয়-মন অশান্ত বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই আরবি প্রবাদ বলে, আল-ইন্তিজারু আশাদু মিনাল মউৎ– মৃত্যুর চেয়েও অধিক শক্তি ধারণ করে প্রতীক্ষা। কিন্তু মৃত্যু বা প্রতীক্ষা শিপ্রা-হৃদয়ের চেয়ে বলবান নয়।

দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজল। বুকটা ধক করে উঠল শিপ্রার। এ তো অসম্ভব। কীর্তি এখনও এল না!

মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। আশ্চর্য!

কিন্তু ওই তো হেডলাইটের জোর আলো গেটের উপরে পড়েছে। ছুটে গিয়ে গেট খুলে দেয় না কেন? দারওয়ানটা অতি নিষ্কর্মা। বৃথা পাঁচ মিনিটের ওপর অযথা আরও আধ মিনিট। নাঃ! ঐত্তো।

শিপ্রা ব্যালকনি ছেড়ে সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল।

স্বভাবতই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে যে-উপরে দাঁড়িয়েছে তার পায়ের দিকে চোখ পড়ে। কীর্তি চেঁচিয়ে বললে, এ কী? তোমার পা ভেজা, শাড়ির অনেকখানি ভেজা। যাও, যাও। এখুনি পা মুছে ফেল–না আমি ভালো করে আচ্ছাসে রগড়ে রগড়ে বোন্ড্রাই করে দেব?

শিপ্রা শান্ত কণ্ঠে বললে, তুমি যখন রয়েছ—

বুদওয়ারে ঢুকে শিপ্রা ডিভানে বসে পা-দুটি প্রসারিত করল। বললে, বাথরুমে বড় টাওয়েল আছে।

সঙ্গে সঙ্গে দেখ তো না দেখ তো কীর্তি গেল আর এল।

পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললে, যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই। পেয়েছি একটি জলচৌকি– এই নাও। সেই মধুর চিন্ময় কবিতাটিকে এবারে সশ এ করা যাবে, এই সেই পাদপীঠ।

পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ।

কিন্তু কাপড় ছাড়ো, আগে কাপড় ছাড়ো। নইলে পা যে বার বার ভিজে যাবে।

কাপড় ছাড়ি কখন? তুমি যেরকম ক্ষিপ্রবেগে ঢুকলে আর ক্ষিপ্রগতিতে বেরুলে তাতে করে দোরের গোড়ার সঙ্গে তোমার কলিশন লাগল জোর। ফলে ছিটকে এসে পৌঁছলে আরও স্পিট সেকেন্ড পূর্বে। কাপড় ছাড়ি কখন? নিয়ে আসছি শাড়ি কোনটা আনব? এখানেই ছাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের উপর দুষ্ট হাসির আবেশ।

কীর্তির মুখের রঙ একটু বদলাল বোধহয়।

শিপ্রা হাঁটু গেড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি কি ভুলে গেলে, কীতা, মিতা আমি মমারত্রের মতো রদ্দি পাড়ার বদ্ধ পাগল মুক্ত পাগল আর্টিস্টদের পাঁচতলা ছ-তলার উপরকার স্টুডিওতে আনাগোনা করেছি পুরো একটি বছর। ওইসব আকাশ-ছোঁয়া চিলকুঠুরির থেকে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে মুক্ত প্রকৃতি, নগ্ন আকাশ। কুঠুরির ভিতরেও তাই। তারা প্রকৃতাবস্থায় প্রকৃতিদত্ত রূপে কেউ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছে, কেউ পড়ি পড়ি সোফাটার উপর অঘোরে ঘুমুচ্ছে, কেউ এক কোণে কফি বানাচ্ছে। আমি যে শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃতাবস্থায়ই রয়ে গেলুম তার একমাত্র কারণ, মডেল হয়ে পোজ দিতে গিয়ে ওরা সর্বপ্রথম ন্যুড হয়। দি রেস্ট ফলোজ। আমি কখনও পোজ দিইনি।… আচ্ছা কোন শাড়িটা পরে আসব।

তন্মুহূর্তেই অচিন্ত্য উত্তর সেই জরি পাড়ের নীলাম্বরী?

শিপ্রা চিন্তার ভান করে বললে, সেটা তো ভেজা নয়।

???

শিপ্রা বললে, ওহো, তুমি তো পদাবলী রসের সোয়াদ জানো না, তবু তোমার সহজিয়া রসানুসন্ধানবৃত্তি তোমাকে ঠিক পথেই নিয়ে গিয়েছে। বুঝিয়ে বলি : আমি যদি নীলাম্বরীই পরি, তবে তার মূল রসটি অপূর্ণ থাকবে কেন। সে শাড়ি ভেজা না হলে তুমি গাইতে শিখবে কী করে,

চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি
পরাণ সহিত মোর

এই আটটি মাত্র শব্দের মাধুর্যবৈভব প্রথম শ্রবণে কে না বিচলিত হয়েছে!

শিপ্রা বৃথা বিনয়াসক্ত নয়। নীলাম্বরী পরে নিয়ে তবু বললে, নীলাম্বরী পরতে হলে যতখানি শ্বেতাম্বরী হতে হয় আমি ততখানি ফর্সা নই।

কীর্তি চোখ বন্ধ করে আটটি শব্দে মেশানো রসের ককটেল চুক চুক করে চাখছে।

ওরে কীর্তিনাশ, বুদ্ধিনাশ, এ আটটি শব্দের রস গ্রহণ করার তরে একটা মানুষের একটা যৌবন যথেষ্ট নয়। ক-বার কটা যৌবন-জ্বালা সইতে হয় কে জানে?

শিপ্রা বললে, মডেল হয়ে পোজ দিইনি, ভেবো না তাই আমি গঙ্গোত্রীর জলে ধোয়া তুলসীপাতাটি।… সেটা বোধহয় তুমি ইতোমধ্যে খানিকটে হৃদয়ঙ্গম করে। ফেলেছ। নইলে আজ তুমি পাকি পাঁচ মিনিট লেটে আসতে না। কিংবা আমি এরই মধ্যে বাসি ফুল।

কীর্তি চুপ করে শুনল। অভিযোগের জবাবে কোনও সাফাই গাইল না। হয়তো ভেবেছে, খুদ কোতোয়ালই যখন জানে তার মগজ গড়া ফরিয়াদ বিলকুল কুটমুট ঝুটা তখন বেকার তাবৎ বাৎ বজ্রসেনের।

শিপ্রা বললে, বেয়াত্রিচে কী জানাল।

অনেক কথা। খান আর আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। এই ঘুঘু লারিটা ইয়েহিয়ার গুপ্তচর। মোটামুটি যে কটা তথ্য জানতে এসেছে তার প্রথম, ইয়েহিয়া-মুজিবে যদি সমঝোতা না হয়, এবং ইয়েহিয়া দমননীতি চালায় তবে পশ্চিম বাঙলার হিন্দু-মুসলমান পুব বাঙলার বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানাবে কি? জানালে কতখানি? নকশালপন্থিদের বন্দুক-বোমা আছে? তারা সেগুলো পুব বাঙলায় পাঠাবে কি? আর কোন কোন রাজনৈতিক দলের অস্ত্রশস্ত্র আছে? পশ্চিম বাংলার জনগণ কিংবা। এবং সরকার ভারত সরকারের ওপর চাপ দেবে কি– পুব বাঙলাকে অল্ আউট সাহায্য দেবার জন্য? দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান মতিগতি কী সে সম্বন্ধে লারি অলরেডি ওকিবহাল। লারি নাকি পি করে মির্জাকে বলেছে, বুদ্র পাল রাজত্ব করে দিল্লিতে। পুব পাকে বিদ্রোহ দেখা দিলে ওই তো তাদের আল্লার পাঠানো বেহেস্তি মোকা– পুব বাঙলাকে পুরো মদত দিয়ে বিদ্রোহ সফল করা, সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে পশ্চিম পাককে চিরতরে দুবলা কমজোর করে দেওয়া। এই সামান্য তত্ত্বটি তারা এখনও সমঝে উঠতে পারেনি। তবে একথাও সত্য, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কল-এর মতো কিছু জঙ্গি আদমি বলছেন, পুব বাঙলার বিদ্রোহ একটুখানি ছড়িয়ে পড়লেই সেখানে বিনা বাক্যব্যয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ো। পুব বাঙলাকে স্বাধীন করে দাও। পশ্চিম পাক প্রান্তে আক্রমণ করবে না। সেখানে ডিফেনসিভ স্ট্র্যাটেজি।

দ্বিতীয় বৃহৎ প্রশ্ন, মির্জার মতো যথেষ্ট বাঙালি মুসলমান পশ্চিম বাঙলায় আছে কি, যারা দিল-জান্ দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিরুদ্ধে জোর প্রপাগান্ডা চালাবে? তারা সন্তর্পণে অর্ধপ্রকাশ্যে হুইসপারিং প্রপাগান্ডা চালাবে তো, যে ভারতের স্বার্থ পুব বাঙলাকে সাহায্য না করা। পুব বাঙলা পাকিস্তান থেকে কেটে পড়লে দক্ষিণ ভারত ঠিক ওই নজির দেখিয়েই উত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কেটে পড়বে।

শিপ্রা চুপ করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সব কথা শুনে যাচ্ছিল। তার মনে পড়ল ফ্রান্সের সেই বুড়ো জেনারেল তার পিতাকে বলেছিলেন, রাজনীতি যখন দেউলে হয়ে যায় তখন সে রাজনীতির উদ্দেশ্য সফল করতে হয় অন্য মাধ্যমে, অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে, অর্থাৎ পুরোপুরি সংগ্রাম চালিয়ে। তার মনে চিন্তা এল, ইয়েহিয়া ঢাকায় যে রাজনীতির চাল চালছে তাতে লীগ কিস্তিমাত হবে না। অতএব দমননীতি অনিবার্য। কীর্তিকে শুধাল, তোমাদের পকেট-ক্লাবে তোমাদের সঙ্গে বসে তো মাত্র একটি মাদ্রাজি রঙ্গনাথন। সে কী বলল?।

কীর্তি উৎসাহিত হয়ে বললে, তুমি সত্যি সত্যি অদ্ভুত একটা সিথ সেনসের মালিক। নানা প্রকারের ইঙ্গিত সত্ত্বেও যখন সদানীরব তামিল সন্তান রাম-গঙ্গা কিছুই বলল না, তখন সে যখন টয়লেট যাচ্ছে তখন লারি তার সঙ্গ নিয়ে তাকে করল ফ্রন্টেল অ্যাটাক কিন্তু ওর জিভের আর্তরাইটিস সারাবে, লারি! আমাকে অবশ্য লারি সম্বন্ধে তার মন্তব্য প্রকাশ করল দুটি শব্দে নোজি পার্কার।

শিপ্রা বললে, তার মানে টিকটিকি বিভীষণ, রঙ্গনাথন সেভেন্থ সেন্স্ ধরে। তোমার সম্বন্ধে তার কী ধারণা জানো? মাস তিনেক পূর্বে আমারই এক পার্টিতে ওর পাশে গিয়ে বসেছি এমন সময় তুমি লন ক্রস করছিলে তখন, অ অল থিংস, বলে কি না, আমি যদি মেয়েছেলে হতুম তবে ওই চ্যাপিটাকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতুম।

কীর্তি বললে, শূর্পণখার দেশে মেয়েরাই পুরুষকে তাড়া লাগায়। আর্য রামচন্দ্র, আদিকবি বাল্মীকি এ তত্ত্বটা জানতেন না বলে মেয়েটাকে নির্লজ্জা, বেহায়া ঠাউরে তাকে নিয়ে মশকরা করেছেন। দাঁড়াও, আমি বেয়াত্রিচেকে একবার ফোন করি। আজ তার অফ ডে বটে, বাড়ি ফেরার পথে তবু একবার ঢু মেরে যাবে বলেছিল। আমাদের দুই ইয়েহিয়া-দাসের হালটা কী।

ফরাসি কেতার বেডরুমে রোমানসের মৃদু সুবাস। সেখানে ফোন।

শিপ্রা তাড়াতাড়ি জলচৌকিটা সরাল এ ঘর থেকে। পাতল একখানা ডবল সাইজের শেতল-পাটি, করভুরয়ের ওড়ওলা কুশন– ওগুলো অতটা পিছলোয় না– একপ্রান্তে ছোট্ট শ্বেত পাথরের রেকাবিতে দুটি চাপা ফুল, অন্য প্রান্তে মুরাদাবাদি পানদান। নিজে শুয়ে পড়ল ঠিক মাঝখানে। বাঁ হাতে লম্বা হান্ডিলওলা আভাশেপের মসৃণতম রুপোর হাত-আয়না– ফরাসি স্টাইলের, অন্য হাতে বাজু সোনার পাতে মোড়া হাতির দাঁতের সিলেটি চিরুনি।

কীর্তি ফিরে এক নজরে সব দেখে বললে, আহ! এই তো দিল-আরাম গুলিস্তান, আর তুমি পরী–

নীলবসনা সুন্দরী–

বল কী? ও-বই তো ছেলে-ছোকরারা পড়ে। মেয়েরাও?

অন্তত আমি। আর মনে হচ্ছে, তোমার ওই ভি-দেশি টিকটিকিটি পাঁচকড়ির অরিন্দম না কী যেন নাম–তার শাকরেদি করতে পারেন পাকা চুলে পৌঁছনো অব্দি।

ক্লাবে আমাদের পকেট-ক্লাব কেটে পড়েছে। ওদের সঙ্গ দিচ্ছে একমাত্র খান।

খান! বল কী?

সে আজই স্থির করেছে, সুপার টিকটিকির পার্ট নিয়ে দুই ঘুঘুকে পাম্প করবে। মুখে জানিনে জানিনে বললেও সে ইসলাম ও তার ইতিহাসের অনেক গভীরে ডুব মেরেছে। সেইটে ভাঙিয়ে বলবে কনফিডেন্স ট্রিকস্টার! তার পর অতিশয় গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে বলল, আজ সন্ধ্যায় কিন্তু বেয়াত্রিচে একটা মারাত্মক খবর দিয়েছে। সে নিজেই নাকি প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারেনি– ঘুঘু যখন মির্জাকে তার মরাল চড়াবার জন্য তাকে বলল, ইয়েহিয়া এসেছে লীগকে স্রেফ ধাপ্পা মারতে। সমঝোতার কথাবার্তার বাহানায় ইয়েহিয়া শুধু সময় নিচ্ছে, পাঞ্জাব-পাঠান সৈন্য আনতে। এবং শুধু তাই নয়, লীগ যদি-বা স্ট্রাটেজি হিসেবে কিংবা মঙ্গলের জন্য ইয়েহিয়ার সর্ব শর্ত মেনে নেয়, তবুও ইয়েহিয়ার জুন্টা স্থির সমস্ত পুব বাংলার ওপর দিয়ে মিলিটারি স্টিমরোলার চালাবে।

তার অর্থ?

সরল। যে পরিমাণে ট্যাঙ্ক, আর্মাড কার আনা হচ্ছে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে তামাম দেশটাকে খাকছার করে দেবে। অবশ্য অতখানি সবিস্তার লারি বলেনি। তাই বেয়াত্রিচের মনে ধোকা, সে ঠিক ঠিক শুনতে পেয়েছে কি না, বুঝতে পেরেছে কি না।

শিপ্রা বহুক্ষণ হল আরশি-চিরুনি একপাশে রেখে দিয়ে পুরো মন দিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ গ্রহণ করছিল।

উভয়েই অনেকক্ষণ ধরে আপন আপন মনে চিন্তা করছিল।

শেষটায় শিপ্রা বললে, ওখানে আন্দোলন হলে পশ্চিম বাঙলা নির্লিপ্ত থাকতে পারবে না।তার পর শুধাল, আচ্ছা, বেয়াত্রিচে এ ব্যাপারে অত উৎসাহী আর কৌতূহলী কেন?

ঠিক ওই প্রশ্নটাই আমি ওকে শুধিয়েছিলুম। বললে, সে তার মার কাছে ক্লাস টেন্ অবধি পড়েছিল। তখন তাদের ইতালিয়ান রচনা সঙ্কলনে ছিল মাদসিনির বক্তৃতা স্বাধীনতা সংগ্রামের যুবাদের উদ্দেশে। সেগুলো তার মনে এমনই গভীর দাগ কেটেছে। যে সেই সময় থেকে পৃথিবীর যেখানেই যে জাতই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয় তখনই তার প্রতিটি খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। রাত্রে নাকি আবার মাদসিনির ভাষণ পড়ে তার প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।

খানদানি রক্ত আছে তার শরীরে। ও ক্লাব-বার-এর রানি, কিন্তু তোমাদের বার-এট-লর বারের চেয়ে আভিজাত্যে কোনও অংশে কম নয়।… কিন্তু আজ এ আলোচনা এখানেই থাক। আমাকে চিন্তিত তো করেই, পীড়াও দেয়।

কীর্তি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল। হঠাৎ পানদানটার দিকে আঙুল তুলে শুধাল, ওই মুরাদাবাদি-তাজমহলটি পেলে কোথায়?

উনি ছিলেন বাবার ঠাকুমার নিত্যসহচরী। তুমি মাঝে মাঝে পান চিবোও বলে তোমার অনারে ওঁকে আলমারির উচ্চাসন থেকে নামিয়ে আমাদের সমাসনে বসিয়েছি।

তুমিও তো ।

সে অতি কালে-কম্মিনে। নেমন্তন্নের ভোজে বড় বেশি ঘি-চর্বি থাকলে মুখটাকে পরিষ্কার করার জন্য। বাড়িতে একা একজনের জন্য পান রে, সুপুরি রে অত বায়নাক্কা সয় কে? হ্যাঁ, আগরতলা যাচ্ছ কবে?

বাইশ কিংবা তেইশে।

আমাকে ঠিক ঠিক জানিয়ো অন্তত একদিন আগে। তুমি আমাকে পিক আপ করবে, না আমি নিজে সোজা দমদমা যাব। উয়েদার খারাপ হলে কিন্তু আমার গা গুলোয়।

কীর্তি নির্বাক, স্তম্ভিত। সে তার প্রেমনিবেদন ভিন্ন অন্ন সব অনুভূতি– ভয়, বিস্ময় ঘৃণা কোনও অনুভূতিই তার চোখে-মুখে প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ এখন তার বিস্ময় তাকে এমনি অভিভূত করল যে সে বিস্ময় যেন তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল।

শিপ্রা তো লক্ষ করবেই। তবু সহজ সুরে বলল, কেন, কী হল?

কীর্তি সহজ সুরের অন্য দিকপ্রান্তের শেষ সীমানায়। জাত ইডিয়টের মতো চি চি শব্দ করল, তুমি, তুমি যাবে?

শিপ্রা যথেষ্ট সচেতন–কীর্তির মগজে তখন কোন ভূতের নৃত্য আরম্ভ হয়েছে। তবু সুন্দুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করে বললে, বা, রে! তুমি ওটা ধরে নাওনি? অবশ্য তোমার সব ট্রিপে তোমার সঙ্গে সর্বত্র যাব তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এবারের যাত্রায় রয়েছে খান। এরকম হোস্ট কোথায় পাব আমরা? একবার একটা ছোট স্টেশন থেকে গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে এমন সময় ধরা পড়ল হুইস্কির ন্যাজ সোডা ফুরিয়ে গিয়েছে। অমনি হোস্ট খান লম্ফ দিল এলার্ম চেনের দিকে। সবাই চেঁচাল করো কী করো কী? সামনেই সিলেটের সবচেয়ে বড় জংশন কুলাউড়া। ততক্ষণ জল দিয়েই হবে। খান গাড়ি থামাল, চাকরকে ছোটাল স্টেশনে সোডার জন্য। গার্ডের হাতে কশ টাকা জমা দিয়েছিল সে নিয়ে মতভেদ আছে। বলেছিল, এই নাও, জরিমানার পঞ্চাশ টাকা, বাকিটা রইল আরও জরিমানার জন্য। যতক্ষণ না বেয়ারা সোডা নিয়ে ফেরে ততক্ষণের ভিতর তুমি গাড়ি চালালেই ফের চেন টানব। গেস্টদের মধ্যে ছিলেন, আসামের আই. জি একজন ডাঙর সেক্রেটারি, ল অ্যান্ড অর্ডারের হর্তাকর্তা। এরা গার্ডকে মুখ দেখান কী করে? সবাই নাকি উল্টো দিকের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ ঢেকে ছিলেন।

হঠাৎ শিপ্রা টানটান সোজা হয়ে বসে স্থির দৃষ্টিতে কীর্তির দিকে তাকিয়ে এবারে যেন–ইংরেজিতে যাকে বলে থিক অব দি ব্যাটল, বিরাট রণক্ষেত্রের যে অংশে লড়াই চলছে প্রচণ্ডতম প্রতিযোগিতায় এবং ওইখানেই খুব সম্ভব জয়-পরাজয়ের মীমাংসা হবে– সে জায়গায় পৌঁছে বলল, শোনো শ্ৰীযুত কীর্তিমান রায়চৌধুরী, তুমি ভাবছ এ মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে স্বেচ্ছায় লোকনিন্দা গায়ে মাখতে যাচ্ছে কেন? তবে শোনো। এক নম্বর বলে ফরাসি কায়দায় ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের উপর রেখে বলল, আমি প্রথমদিনই তোমাকে স্পষ্ট বলেছি, সমাজের কুৎসা– আই কেয়ার এ ফিগ এ পিন, এ জট, এ টিটল–

বলে মারল তুড়ি। ফের তর্জনীটি অনামিকার উপর রেখে বললে, দুই নম্বর : আমরা যেমন যেমন ঘনিষ্ঠতর হব, কুৎসার নানারকম বেরকমের ধ্বনি জেগে উঠবে চতুর্দিক থেকে, যে রকম ফিলারমনিক অর্কেস্ট্রায় হয়। বেজে উঠবে আরও যন্ত্র, আরও ধ্বনি, বাড়তে থাকবে ধ্বনির বৈচিত্র্য, ভলুম, উচ্চতা এবং শেষটায় পৌঁছবে ক্রেসেন্ডো-তে– সর্বোচ্চস্তরে– যখন একসঙ্গে সবকটা যন্ত্র তীব্রতম তুমুল নাদে হল ভরে দেবে।

আমি আগরতলা গেলে ফিরে এসেই শুনব কনসার্ট ক্রেসেন্ডোতে। ফের মারল তাচ্ছিল্যের তুড়ি।

এবারে মধ্যমা। তোমার কি লোকনিন্দা হবে–

এতক্ষণে কীর্তির কিঞ্চিৎ চৈতন্যোদয় হয়েছে। বাধা দিয়ে বললে, সেটা আমাকে বলতে দাও, তোমার যদি আপত্তি না থাকে।

বিনীত কণ্ঠে আবার যেন শিপ্রা নিবেদন করল, তা হলে তোমার কোনও ইচ্ছা, কোনও নির্দেশে আমার কোনও আপত্তি থাকতে পারে না-না-না। আমি চলব তোমার আদেশে। আমার অভ্যাস– সেটা বিধিদত্ত– আমার বক্তব্য আমি স্পষ্ট ভাষায় জোরদার গলায় প্রকাশ করি। আসলে তুমি জোরদার, ঢের ঢের বেশি জোরদার।

এখন যদি বল, না তুমি আগরতলা যাবে না আমি নত মস্তকে সে আদেশ মেনে নেব এবং আমার অনুভূতির কোনও পরিবর্তন হবে না। তার পর বসে বসে প্রহর গুনব। কবে তুমি ফিরবে। তখন সেটা ধূমধামে করব সেলিব্রেট। তুমি নিজেই স্বীকার করবে, তোমার আদেশে আমার হৃদয়-মনে কোনও জায়গায় আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি।

এবারে কীর্তি বললে, আমার সামাজিক নিন্দার কথা তুলেছিলে? তুমি বহুদর্শী– তোমার মুখে এটা আদৌ মানায়। পুরুষের কুৎসা রটনা তার আয়ু কদিন? জলের তিলক কপালে কাটলে শুকোতে যতক্ষণ লাগে– বরঞ্চ বলি জিন্-এর। ওটা স্পিরিট, উপে যায় তড়িঘড়ি। দেখতে পাও না, এদেশের নিত্য দিনের ট্র্যাজেডি এমন সব পাষণ্ড যাদের কোনও কুকীর্তি কারও অজানা নয় তাদের হাতে আমরা নিত্যনিয়ত সঁপে দিই না সদ্য ফোঁটা শিউলিফুলের মতো সরল নিষ্পাপ বধূদের?

আমার বদনাম! খতিয়ে দেখলে শুনবে, অনেকেই আমাকে হিংসে করছে, কেউ কেউ আভাসে ইঙ্গিতে তোমার কাছে আমার এমন সব বদ-অভ্যাস কুকর্ম কেচ্ছা– যেগুলোর সঙ্গে জীবনে আমার কখনও পরিচয়ই হয়নি দূর থেকে সন্তর্পণে এগিয়ে দেবে; সেখানে আমার চিন্তা করার কিছুই নেই। তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো আমার কোনও দুর্বলতা তোমার অজানা নয়। ফারসিতে বলে, দুশমন কী করতে পারে, দোস্ত যদি মেহেরবান হয়? –দু চারজন বন্ধু আমার এমন আছে যাদের শরীরে-মনে যথেষ্ট বল আছে এবং দরকার হলে যারা সক্কলের সামনে দু পাঁচজনকে ঠ্যাঙাতে হামেহাল তৈরি– তা তারা তাদের সামনেই হোক্ আর আড়ালেই হোক, তোমার-আমার সম্বন্ধে অপছন্দসই কোনও মন্তব্য করলে। কিন্তু এ কথাটার উল্লেখ করলুম, নিতান্ত কথায় কথায়, এটা অবান্তর।

আর অগুনতি লোক তোমার রুচির খুব একটা প্রশংসা করবে না, তুমি আমার মতো অপদার্থকে বেছে নিয়েছ বলে।

শিপ্রা কোনও মন্তব্য করল না। সর্বশেষ কীর্তি বলল, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে; কাফেলা এগিয়ে যায়। দি ডগ বার্কস, দি ক্যারাভান পাসেস।

.

১৬.

বাগডোগরা অ্যারপোর্ট পৌঁছবার পাঁচ মিনিট আগে হঠাৎ শিপ্রা দেখে, পালে পালে সাদা ছোট ছোট মেঘের টুকরো যেন তেড়ে আসছে তাদের প্লেনের দিকে। প্লেন ঢুকে গেল মেঘের রাজ্যে। আবার তেমনি হঠাৎ প্লেনটা ফাঁকাতে বেরুতেই শিপ্রা দেখে পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে শ্বেত-শুভ্র হিমালয়। কী বিরাট, কী মহান, কী গম্ভীর সে গিরিরাজ। অথচ অতি দূর থেকে দেখছে বলে মনে হল যেন মাত্র গজ তিনেক খাড়াইয়ের এবড়ো-খেবড়ো একটা দেয়াল, পৃথিবী ইসপার-উসপার হয়েছে। পাঁচিলের উপরের প্রান্ত যেন অসমান ঝালর-কাটা– উচ্চতায় শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিশেষ তারতম্য চোখে পড়ছে না বলে পর্বত প্রাচীরের উপরের রেখা কাটা কাটা–নীল আকাশের পটভূমিতে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন প্রসারিত হয়ে।

কিন্তু হায়, ভালো করে দেখতে না দেখতেই প্লেন রানওয়ের দিকে নামতে লাগল। দূরের এবং কাছের গাছপালার পিছনে বিরাট হিমালয় পর্যন্ত ঢাকা পড়ে অদৃশ্য হল।

শিপ্রার শরীর রোমাঞ্চিত। এরকম দৃশ্য সে জীবনে কখনও দেখেনি। তার দু চোখ হরিষে বিষাদে ভরে গিয়েছে। তখন হঠাৎ মনে এল কীর্তির কথা বিস্ময়ে উত্তেজনায় তার কথা মোটেই মনে পড়েনি, তার দৃষ্টি সে দিকে আকর্ষণ করেনি। গোটা দুই খোঁচা দিয়ে বার বার শুধাল, দেখলে, দেখলে?

তোমার মাথাটা যেভাবে জানালার উপর চেপে ধরে শার্সিটা চিবোচ্ছিলে সেটার মার্জিন ধরে আমি মাত্র একটা কোণ দেখেছি। কিন্তু এর আগে আরও কয়েকবার দেখেছি।

শিপ্রার উত্তেজনা তখনও পুরো মাত্রায়; আমি প্লেন থেকে আলপস দেখেছি অনেকবার। উপর দিয়ে ফ্লাই করার সময় জিনিভার বিরাট লেক থেকে ছোট ছোট ডোবাগুলোর নাম পর্যন্ত পিন্ ডাউন করতে পেরেছি। কিন্তু এরকম ওভারহুয়েলমিং দৃশ্য কখনও দেখিনি– যেটা মানুষের সর্বচৈতন্য আচ্ছন্ন করে তার সত্তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে। দেয়। কিন্তু কী ট্র্যাজেডি। দু মিনিট দেখতে না দেখতে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেল।

খান সান্ত্বনা জানিয়ে বললে, কিছু ভয় নেই, শোক করার নেই। বাগডোগরা থেকে আমরা যাব গৌহাটি– অনেকখানি পথ– হিমালয়ের সমান্তরাল রেখা ধরে। পুরো পথ ধরে বাঁ দিকে গিরিরাজকে যত প্রাণ চায় দেখবে আর পেন্নাম করবে। কিন্তু কালো চশমাটা পরে নিও। নইলে চোখ ড্যামেজড হতে পারে।

শিপ্রা বিপুল বিক্রমে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, কেন? পার্বতী কি তার পিতা হিমালয়ের মুখের দিকে তাকাতেন না– না তিনি গগলস পরতেন? আর হিমালয়ের শুভ্রতা যার তুলনায় মসীতুল্য, তার প্রাতঃসূর্যরুচি শ্বেতাম্বর বর শঙ্কর? শুভদৃষ্টির লগ্নেও কি তিনি গান্ধারীর মতো চোখে ফেটা বেঁধেছিলেন?

কীর্তি বললে, ওরকম অলৌকিক কর্ম শুধু মেয়েরাই পারে। আমরা তো নহি বধূ, নহি কন্যা।

শিপ্রা ব্যঙ্গ করে টিপ্পনী কাটল, অ। বধূর জন্য পাদপীঠ সগ্রহ করাতেই সর্ব সাধনা সর্ব কামনা শেষ? বলে দেব খানকে সব? কেন? চন্দ্রবংশের সংবরণ না কে যেন সূর্যের মেয়ে তপতাঁকে রানি করতে চেয়েছিলেন বলে শ্বশুরমশাই সূর্যের দিকে অপলক চক্ষে তাকাতে তাকাতে উপাসনা করে প্রার্থনা জানাননি?

শিপ্রা কান্নায় কান্নায় ভেঙে পড়ে আর কি! প্লেন ফের আকাশে ওঠামাত্রই ধরা পড়ল মেঘ আর কুয়াশা এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হিমালয়ের রূপরেখা ঢেকে ফেলেছে। দেবতারা কী অকরুণ, কী নিষ্ঠুর!

খান পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ওসব মেঘ-কুয়াশার নুইসেন্স যে কোনও সময় কেটে যেতে পারে। ততক্ষণ নিচের দিকে তাকাও না– ব্রহ্মপুত্র নদ। ইনিও তো হিমালয়ের জন্ম নিয়ে, বাপের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে দেশের পর দেশ অতিক্রম করে যাচ্ছেন, পথিকের তৃষ্ণা নিবারণ করে, তার অংশাবতার জনপদবধূর কলসিতে ঢুকে তাদের কাঁখে আরামসে বসে আনন্দধ্বনি ছলাৎ ছলাৎ করছেন। তার পর তিনি আদর করে কোলে তুলে নেবেন গঙ্গাকে– দু পথ ধরে দুজনাই বেরিয়েছিলেন হিমগিরি থেকে।… শুধোইগে পাইলটকে ওই মেঘবাবুদের গাত্রোৎপাটন করার আশু সম্ভাবনা আছে কি না।

কামাখ্যার উপর দিয়ে যাবার সময় কীর্তি বললে, এ জায়গার মেয়েরা বিদেশি পুরুষদের মেড়া বানিয়ে রাখে।

শিপ্রা বললে, আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। ভালো করে দেখে নিক সব্বাই, সত্য সত্য তিন সত্যের মেড়ি কাকে বলে।

কীর্তি বললে, আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, জোর গলায়, তোমার যা ইচ্ছার জোর, উইল-পাওয়ার আছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ব্রহ্মা বিষ্ণু তোমার অনিচ্ছায় তোমাকে স্বর্গে ইন্দ্রাণী উর্বশীর আসনে বসাতে পারবেন না, মর্তে চার্মিং মার্লেনে ডিটরিষ, সুইট, লিলিয়ান হার্ভের মাধুর্য দিতে পারবেন না। নরকে যমরাজার পাটরানি যমীর কথা দূরে থাক। আর তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি মেড়ি, নেড়ি, ভেড়ি যা খুশি তাই হবার শক্তি ধরো– অর্থাৎ কারও তোয়াক্কা না করে। তুমি তো কলকাতাতে এখনও একপাল মেড়া পোযো=

শিপ্রা বাধা দিয়ে বললে, থ্যাঙ্ক ইয়ু। কিন্তু বল তো, আমি কী হতে চাই?

কীর্তি চিন্তিত মনে আসমান-জমিন অনুসন্ধান করতে লাগল।

শিপ্রা ডান দিকে একটু সরে বসে কীর্তির উরুতে হাত রেখে বললে, কীর্তি-প্রিয়া।

পেটুক গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে খেতে মারা গিয়েছে তবু ভোজনকর্মে বিরতি দিতে পারেনি, এ দৃশ্যটি প্রাচীন দিনের বন্নভোজনের একাধিক পরিবেশক চোখের সামনে দেখেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু স্পর্শকাতর রূপের পূজারি, সুন্দরের পিয়াসীদের সামনে প্রকৃতি অকৃপণ হস্তে ছবির পর ছবি, দৃশ্যের পর দৃশ্য, রূপের পর রূপ ঢেলে দেন তবে সে বেশিক্ষণ সেদিকে তাকাতে পারে না। তার হৃদয় তখন আকুলিবিকুলি করে প্রত্যেকটি দৃশ্যের রস দিয়ে সে যেন তার হিয়া রাঙিয়ে নিতে পারে– শ্রীকৃষ্ণ যে রকম সুন্দরী রাধাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, রাধে, তোমার চোলির রঙ দিয়ে আমার মস্তকাভরণ রাঙিয়ে দাও, (রাধা কি তবে ভ্রমবশত, না স্বেচ্ছায়, বুক চিরে তারই রক্ত দিয়ে কানুর মস্তকের চূড়া লালে লাল রঙিয়ে কৃষ্ণচূড়ার জন্ম দিলেন?)– যাতে করে দুর্দিনে প্রাণের রসধারা যখন শুকিয়ে যায় সেই দারুণ দহনবেলায় এসব দৃশ্যের একটি একটি স্মরণে এনে নিজের ভাগ্যকে ক্ষমা করতে পারবে।

নিশ্চল হিমালয়, সচল ব্ৰহ্মপুত্র, বুকের উপর কত শত দ্বীপ শিশুর মতো প্রতিদিন বেড়ে বেড়ে বড় হয়ে উঠছে, জলের উপর ফোলা পালের স্ফীতবক্ষ বিশাল নিতম্ব মহাজনি নৌকার সারি যেন ডিমের খোসার সাইজ আর ওদেরই মতো হেলেদুলে নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, চরের পরিবর্তে হঠাৎ জেগে উঠছে, মাথা উঁচু করে ক্ষুদ্রায়তন উমানন্দ পাহাড় কিন্তু তার আকস্মিক অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব বুকে লাগায় চমক, গোয়ালপাড়ার ঘন সবুজ বাঁশ বেত আম-কাঁঠালের মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে উঠেছে হাজার হাজার অবঙ্কিম ঋজু গুবাকবৃক্ষের শুভ্রতা। কত দেখবে পিয়াসী শিপ্রা!

সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গৌহাটি, শিলচর শেষটায় আগরতলা। টসটসে ভেজা ব্লটিঙের মতো তার সৌন্দর্য গ্রহণশালার ভাণ্ডারী আর কোনও নবীন রস নিতে সম্মত হয়নি। শুধু শিলচর থেকে ত্রিপুরা পাহাড়ের উপর দিয়ে প্লেন যাচ্ছে তখন কীর্তি ডান দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এই তোমার বাল্যসখী বিকিস্-এর দেশ, সিলেট।

ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে, বিকি সত্যি বলেছিল, ফ্ল্যাট পুব বাঙলার মতো সবুজে সবুজ তো বটেই, মাঝে মাঝে উঁচু-নিচুর টিলাটালি, ক্ষুদে ক্ষুদে পাহাড়, আর সমস্ত দেশটা আঁকা-বাকা নদী-নালায় ভর্তি– সবুজ জেব্রার উপর ফালি ফালি ঘোলাজল স্বচ্ছ জলের ডোরা। মাঝে মাঝে আবার দিঘিও তো। না, স্মরণে এল বিলকিস্ বলেছিল ওগুলো হাওর, লম্বা-চওড়ায় অনায়াসে পাঁচ-সাত মাইল জুড়ে জল– মোস্ট ডেঞ্জারাস। শুধু দেখতে পেল বিকিসের বর্ণনার ময়ূরের মতো পেখম-মেলা বিরাট বিরাট কৃষ্ণচূড়ার নিচে, টিলার উপরে চা-বাগানের কলঘর, সানুদেশে চা গাছের ঝোঁপ, পাশের টিলার উপর ম্যানেজারের নির্জন নিঃসঙ্গ ছিমছাম বাঙলো– প্লেন যাচ্ছিল খুবই উঁচু লেভেলে।

আগরতলায় যে বাঙলোতে তারা উঠল সেটা উঠবার সিঁড়ি থেকে বাথরুমে জমাদার ঢোকবার দরজা পর্যন্ত সবকিছু মেগনাম সাইজের। বাড়িটা বানিয়েছিল এক ইংরেজ– ত্রিপুরা থেকে বিশ্বের জুগুলোতে একদা সে হাতি সাপ্লাই করত পাইকিরি হিসেবে, অন্য লোক যে রকম ভেড়া-ছাগল বিক্রি করে। নীলকরদের কুঠির মতো এক একটা কামরা আস্ত এক-একটা জলসাঘর– ছাত যে কোন উঁচুতে দেখতে হলে দুরবিনের প্রয়োজন। তাবৎ বাড়িটা জুড়ে যেন হাঁ করে সবকিছু গিলে ফেলে বিশাল বিস্তীর্ণ হলঘর। প্রটেস্টান্ট ইংরেজ যেন ক্যাথলিক পোপের ভাটিকানকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। দেশে ফেরার সময় বাড়িটা বিক্রি করতে গিয়ে দেখে, ত্রিপুরার লোকের কাছে হাতি ঘরকি মুরগি বরাবর বলে তারা বর্মার রাজদত্ত উপহার শ্বেতহস্তী পোষার খরচটা সম্বন্ধে আগাপাশতলা ওকিবহাল। অতএব শেষটায় এই শ্বেতোত্তর হস্তী ক্রয় করলেন আমাদের কলকাত্তাই খানের আব্বাসাহেব, বড়া খান।

শিপ্রা প্রথম পদার্পণের সময় এসব কিছুই লক্ষ করেনি। স্বপনচারিণীর মতো বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে সোজা ডাইনিংটেবিলে। সেখানে ইতোমধ্যে এসে গেছেন দুই ইয়ারের স্থানীয় ইয়ারের দু পাঁচজন। সামনে গেলাস। শিপ্রা দেবীকে পরম ভক্তিভাবে নমস্কার জানিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আপন আপন গেলাস একটানে শেষ করে ফের নমস্কার জানিয়ে প্রসেশন-পদ্ধতিতে ইয়াররা বেরিয়ে গেলেন।

ক্লান্ত কণ্ঠে শিপ্রা শুধাল, এরা পালাল কেন? আমি কি বাঘ?

খান তাড়াতাড়ি বলল, তুমি বাঘ না, তুমি ক্লান্ত। আর এরা যাবে কোথায়? বললেই আসবে, না বললেও আসবে। ওরা মফস্বলের লোক। তাদের দুশ্চিন্তা, বেগানা লোগের সাক্ষাতে বেগমসাবের সেবার (আহারাদি) তুরু (ত্রুটি) হইতে পারে। বাদে তেনার লগে লগে আরাম করন লাগবো (শুতে যেতে হবে)।

সীমান্তপারের পাকিস্তান থেকে এসেছে একাধিক বর্ণগোত্রের মাছ। কে বলে ভারত-পাকের সাধারণ জন জন্তু-জানোয়ারের প্রতি নির্দয়? ওপারযাত্রী মা চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন– পুত্র যেতে পারল না তার কাছে পাসপোর্ট-ভিসার অভাবে। এ পারের চাষা গিয়েছিল বর্ডার ক্রস করে ওপারে তার গুটি কবরেজের কাছে দাদিজানের জন্য কফ নিবারণের গুটি চারেক বড়ি আনতে। খুঁজে রেখেছিল পরনের দু হাতি লুঙ্গির তাঁকে। পড়ল ধরা। কাস্টমসের ছোটবাবু তার বিলিতি ফার্মাকপিয়ার ফিরিস্তিতে এই অসভ্য ওষধির নাম হল ডবল ফাইন। কিন্তু মাছের বেলা সদয়তর ব্যবস্থা তার পাসপোর্ট লাগে না, তার ট্যাক কেউ খোলে না। কালোতে এলেও ইলিশের রঙ কালো হয় না, কই ধরা পড়ার ভয়ে, পাঙাশ হয় না। দুটো বর্ডার ক্রস করে এসেছে খাসি পাহাড়ের কমলানেবু।

শিপ্রা বললে, মফস্বলের লোকের আহারাদি হয় মৌসুমে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে। এখানে দেখি নেবুর দোসর আনারস।

তাই তো লোকে বলে বাঘের দুধও মেলে। বাঘিনীও দুধ দেয় বিশেষ অবস্থায়। এখানে সর্বাবস্থায় বাঘ তো পেটে বাচ্চা ধরে না– বাঘ ভি দুধ দেয়। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে অবস্থা বড়ই সঙ্গিন। বর্ডারে এখন আর রাইফেলধারী পুব বাঙলার পুলিশ নেই– তাদের স্থলে এসেছে মেশিনগান, নানাবিধ অটোমেটিক হাতে পাঞ্জাবি পাঠান আর্মিমেন– পশ্চাতে আর্মার্ড গাড়ি। কাছেই কুমিল্লা কেনটনমেন্ট, ময়নামতীর ঘাঁটি। হাজার হাজার সেপাই-অফিসার আবজাব করছে। পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লাতেই পশ্চিমাদের সবচেয়ে ডাঙর কেনটনমেন্ট।

শিপ্রার আবছা আবছা মনে পড়ল, বাগডোগরা, এই আগরতলা এমনকি শিলচর কিছুটা দূরে হলেও সবকটাই ইন্ডো-পাক বর্ডারের কাছাকাছি বলে সর্বত্রই এমনকি প্লেনের ভিতরও তার কানে এসেছে মাত্র একটি টপিক। সেটা রহস্যময় ও প্রশ্নে প্রশ্নে কণ্টকিত। সুদ্দমাত্র লীগকেই যদি শায়েস্তা করতে হয় তবে কামান কেন, ট্যাঙ্ক কেন, সাঁজোয়া গাড়ি কেন? তবে কি ইন্ডিয়া অ্যাটা করার জন্য? তাই হবে। কারণ শেষ গুজব, লীগ-ইয়েহিয়াতে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে। ভারত যদি আক্রান্ত হয়, চীন কি তবে ফের দুশমনি করবে?

আরও কতশত প্রশ্ন।

খেয়েই শিপ্রা মারল ছুট– অনন্তকাল ধরে সে ঘুমুবে।

নিদ্রা-রেকর্ডে কুম্ভকর্ণের নাসিকা-গর্জন গোল্ড মেডেল পেয়েছে কিন্তু রেকর্ড কৃত্তিবাস স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, ক্ষুদ্র নিদ্রাকৰ্মটি কিন্তু হেঁদো। রইলেন শ্রীবিষ্ণু। অনন্তশয্যা। কিন্তু অবতার এবংকিংবা অংশাবতার হয়ে যখন অবতীর্ণ হতেন। তন্দ্রাবস্থায়? হা, ধিক! শাস্ত্রাদির সম্যক অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ রাখার কুফল বক্ষ্যমাণ পুস্তক।

তবু, অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে সেই দিন-যামিনীর শিপ্রা-নিদ্রা তার পূর্বতর রেকর্ড। তর্কাতীত ছ লেংথে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল।

ঘুম একটুখানি কেটেছে মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে শিপ্রা অনুভব করল, দুটি ছোট কোমল হাত– মেয়েছেলেরই নিশ্চয় তার পা টিপে দিচ্ছে, কিন্তু চাপেতে যে জোর, সেটা যেন পুরুষের। একটুখানি চোখ মেলে ক্ষীণালোকে দেখল, পাহাড়ি মেয়ে। এখানকার পাহাড়িদের নাম কু কী– কিন্তু শিপ্রার মনে হচ্ছে, আর পাঁচজন বাঙালিদের মতো গারো, লুসাই, কুকি সবই বরাবর।

কণ্ঠে অত্যন্ত বিরক্তি মিশিয়ে শুধাল, তোমাকে পা টিপতে বলেছে কে?

কুণ্ঠিত কণ্ঠ : কেউ না। আমার মিসিবাবা হয়রান হয়ে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লে আমি তখন পা টিপে দিতুম। সে আরামসে বেশি ওৎ ঘুমুত। আমি আরও দু মিনিট পরে চলে যেতুম– আপনার মালুম ভি হত না।

বাঁচালে, বাবা। পা টেপো আর যাই টেপো, চুলটা তো আঁচড়ে দেবে। নইলে হাতের নড়া খসে যেত– খুশি হল শিপ্রা।

কটা বেজেছে?

গ্যারহ সে জ্যাদা।

সর্বনাশ! ওদিকে কানে আসছে মফস্বলের বারান্দায় শ্যামবাজারি রকের তুফান।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে বললে, আয়া, তুমি ওদের গিয়ে বল, আমি এখুনি আসছি, ওদের কেউ যেন না পালায়। মফস্বলি এটিকেটের বাড়াবাড়ি অম্লান বদনে মেনে নেওয়াটাও এটিকেট নয়। আর ফিরে এসে এখুনি চুলটা আঁচড়ে দাও। আলোটা জ্বালো।

সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ মাথার কোন অজানা কোণ থেকে একটা সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত তার মনে ভেসে উঠল, লারি যে মির্জাকে বলেছিল, তামাম পুব বাঙলার ওপর স্টিমরোলার চালানো হবে সেইটেই ঠিক। সে যখন গভীর নিদ্রায় অচেতন তখন তার অবচেতন মনে নানা গুজব নানা তথ্যের কাটাকুটি করে সিপ্লিফিকেশন অঙ্কের মতো এই সরল রেজালটে পৌঁছেছে। কিন্তু আশ্চর্য! এই নিয়ে এত যে বচসা, ভবিষ্যদ্বাণী ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে সে শুনল, কেউ তো একবারের তরেও বলল না, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ির ছয়লাপ, হয় ভারতকে ভয় দেখাবার জন্য কোনও গভীর কূটনৈতিক চাল, নয় সরাসরি ভারতকে আক্রমণ। সবাই বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছে, নিছক সেঁদরি কাঠের লাঠি নিয়ে লম্ফঝম্প করছে লীগ, যদি তাদের অন্য কোনওপ্রকারের অস্ত্রের ব্যবস্থা থাকত, তবে সেটা কস্মিনকালেও গোপন থাকত না। অতএব ট্যাঙ্ক-কামান ভারতের তরে কিউ. ইউ, ডি। শিপ্রার মনে হল, তারা ওজনের আঁকে ধুরন্ধর পোদ্দারের মতো অতখানি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যুক্তিতর্কের সিটিটাকে যাচাই করে দেখেনি। এরিথমেটিকের অঙ্ক কষেছে তার অবচেতন মন; এদের সচেতন মন যেন জিওমেট্রির স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে চলে গেছে জিওমেট্রিক টেনজেনটে সরাসরি বিপরীত মুখে।

.

১৭.

আয়া খোঁপাটা বাধল কোন দূর বা নিকট পাহাড়িনী স্টাইলে সে সমস্যার সমাধান না করেই ছুটল বারান্দার হাইড পার্কি মিনি-মিটিঙের দিকে। দূর থেকেই লেডি-সুলভ মাঝারি গলায় বলল, আপনারা কোনও তকলিফ করবেন না, প্লিজ। আমি একপাশে বসে শুধু শুনব।

প্রথমটায় ওস্তাদি গানের অবতরণিকা আলাপের মতো বাক্যালাপ কিঞ্চিৎ মন্দ মধুর কৃচিৎ কাকলির সুর ধরেছিল বটে কিন্তু পেটের ভিতরকার তরল দ্রব্যগুণ যাবে কোথা? দ্রুত তেতালে স্থগিত দারুণ সংগ্রামে তারা ফিরে এলেন, দ্যাখ তো না দ্যাখ, ডার্বি ঘোড়া ধূলির ঝড় উড়িয়ে।

সুস্পষ্ট দুটি দল। মধ্যপন্থা জনশূন্য। স্বয়ং চেয়ারম্যান খান খনে ফ্রন্ট বেঞ্চার খনে চেয়ার আসীন।

প্রথম পক্ষের বক্তব্য : ঢাকাতে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে। মারপিট হবে না।

দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য : আদৌ হয়নি; হবেও না। ইয়েহিয়া জাত ঘুঘু। টালবাহানা দিয়ে সময় নিচ্ছে, শুধু আরও সৈন্যঅস্ত্রশস্ত্র জমায়েত করার জন্য।

শিপ্রা এসবের অধিকংশই শুনেছে। বেয়াত্রিচে যা বলেছিল সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিল মাত্র।

তুমুল তর্কযুদ্ধের সময় হঠাৎ এক এক সময় সবাই একসঙ্গে চুপ মেরে যায়।

সে স্তব্ধতা ভাঙলেন একটি বয়স্ক মুসলমান। তিনি হংসমধ্যে বক। অবশ্য বকের মতো জল খাচ্ছিলেন না, চুষছিলেন একটা নিম্বু পানি। বললেন, একটা ঘটনা আমার কাছে বড় রহস্যময় ঠেকেছে। দিন কয়েক আগে দুটো পাঞ্জাবি সেপাই গিয়েছিল বাজারে। কী একটা সামান্য অজুহাত পেয়ে রাস্তার ছোঁড়ারা হয়তো-বা লীগের দু একজন ছিল করেছে ওদের ডাহা বেইজ্জত। শেষটায় দুজনার পাতলুন মিয়া সাহেব যেন বিষম খেয়ে আচমকা থেমে গেলেন।

শিপ্রাই বুঝেছে সক্কলের পয়লা। অভয়বাণী শুনিয়ে বলল, মৌলভি সায়েব, আপনার যা বলার অসঙ্কোচে বলে যান। আমি নাজুক, লজ্জাবতী লেডিদের একজন নই, যারা কারও মুখে বাচ্ছা বিইয়েছি শুনলে ভিরমি যান, তাঁরা জন্ম দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কাছে সর্বদাই প্রথমটাই প্রকৃতিসম্মত এবং ভিরাইল ঠেকেছে।

মৌলভি সায়েব কিন্তু সেদিক দিয়ে পাক্কা মডার্ন। ভদ্র রমণীর আদেশ অলঙ্। বললেন- পাতলুন কেড়ে নেয়। ভাগ্যিস অন্য হ্রস্বতর অঙ্গবস্ত্র পরনে ছিল, তাই মানে মানে ছাউনিতে ফিরতে পারল।

কেউ মৃদু হাস্য, কেউ-বা অট্টহাস্য করলেন। শিপ্রা প্রথম শ্রেণিতে।

সায়েব বললেন, কিন্তু আসল কথা, তারা ছাউনিতে ফিরে গিয়ে বন্দুক এবং ইয়ার-দোস্ত নিয়ে এসে বেধড়ক মার লাগাল না কেন, গুলি চালাল না কেন, দোষী নির্দোষীকে অবিচারে– বেধড়ক? যা আকছারই হয়ে থাকে পাকিস্তানে। সেইখানেই তো রহস্য। তার কিছু করল না, সেইটাই তো রহস্য।

এবারে শিপ্রা যেন আলোচনায় যোগ দিল। বলল, শার্লক হোমসের অন্যতম রহস্য গল্পে আছে তিনি পুলিশ ইনসপেকটরকে বললেন, রাত্রে কুকুরটার রহস্যময় আচরণের দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইনসপেকটর আশ্চর্য হয়ে বলল, সে তো কিছু করেনি। হোমস হেসে বললেন, সেইখানেই তো রহস্য। শিপ্রা থেমে গেল।

খান আর কীর্তি ছাড়া আর সবাই কৌতূহলী নয়নে শিপ্রার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। এ সজ্জনদের মাঝখানে মাত্র ওরা দুজনাই জানে, শিপ্রা পয়েন্টলেস, উদ্দেশ্যহীন গল্প বা উদ্ধৃতি কখনও ছাড়ে না।

মিঞা সাহেব কিন্তু ধরে ফেলেছে। সে হোমস পড়েনি তবু। কারণ তার বক্তব্যের সঙ্গে এটা মিলে যাচ্ছে। হয়তো-বা তার এবং অন্য কিছুজনের গল্পটি স্মরণে এসেছে।

অন্য সবাই স্কুলবয়ের মতো পূর্বাপর সংযোগসহ সবিস্তার পূর্ণ বিবরণীর জন্য শুরু শিপ্রার দিকে তাকিয়ে আছে বলে সে বলল, আস্তাবল থেকে দামি ঘোড়া গিয়েছিল চুরি, গভীর রাত্রে, অথচ সেটাকে পাহারা দেবার জন্য যে কুকুরটা ছিল সেখানে, সে ঘেউ ঘেউ করে স্টেবল বয়গুলোকে জাগিয়ে তোলেনি। ডিটেকটিভ হোমস তার থেকে অনুমান করলেন, চুরি করেছে কুকুরের কোনও ঘনিষ্ঠজন। পরে ধরা পড়ল, চুরি করেছিল জমিদারের আস্তাবলরক্ষক স্বয়ং– অসদুদ্দেশ্যে।

মিঞা সায়েব সোৎসাহে বললে, বিলকুল সহি বাৎ! সেপাই দুটো তার ভাই-বেরাদর, ইয়ার-দোস্তকে অতি অবশ্যই তাদের বে-ইজ্জতির কাহিনী বলেছিল। তারা কিছু করল না, কমান্ডানটও কিছু করল না, এমনকি যেটা কম-সে-কম মিনিমামেসট সিভিল, পুলিশকে তদন্ত করার জন্য আদেশ করল না। অর্থাৎ কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করল না। বিগলিতার্থ যা স্বাভাবিক যা প্রত্যাশিত সেটা ঘটল না। কেন?

অন্য গুহ্য খবর আমার না থাকলেও আমি এর থেকে এই অর্থই বের করতুম, কর্নেল কর্তা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন,

এখনও তোদের সময় হয়নি।
যেথায় চললি যাসনি কো ধনি।

অর্থাৎ এ তাবৎ প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও যে পরিমাণ সৈন্য পশ্চিম পাক থেকে জোগাড় করা হয়েছে সে-সংখ্যা দিয়ে লীগ এবং তাদের অন্ধ সমর্থক পাগলা পাবলিককে শায়েস্তা করা যাবে না। তোদেরও সময় আসবে, মোকা পাবি তোটা দিলসে জাসে দাদ নেবার।

ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা ১৯২০/৩০-এর স্টাইলে চুলকাটা, ঘাড় কানের কাছে প্রায় কামানো এক ফুল-বাবু বললে, অর্থাৎ, স্যাকরার টুং টুং, কামারের এক ঘা।

মিঞাজি ভুরু কুঁচকে বললেন, এক ঘা নয়, চক্কোত্তি। একশো ঘা।

এক সিলেটি কারবারি ফ্রানস দেশে চালান দেয় কোলাব্যাঙ। কুমিল্লার আশেপাশে খুদ শহরের সর্বাঙ্গে এন্তের বিজ্ঞাপন সেঁটেছে, এখানে কোলাব্যাঙ ক্রয় করা হয়; কোলাব্যাঙের স্থলে কোনও কোনও বিজ্ঞাপনে আছে ঘাড় ব্যাঙ। এক খাস আগরতলি তাকে শুধাল, কিও হাজি, তুমি মুরগির চালান বন্ধ করে দিয়েছ? মিঞা হজ করার জন্য সুদূর মক্কা যাওয়া দূরে থাক, ঢাকা-চাটগা অবধি তার দৌড়। পরে এসেছে শার্ক স্কিনের পাতলুন, সিল্কের প্রিনকোট। এর অদ্ভুত হাজি ডাকনাম হল কী করে সে এক রহস্য এবং খাটো কান শুধাল, কিতা?

শিপ্রা কারও কথা কেটে আপন কথা কয় না। এস্থলে তার উত্তেজিত কৌতূহল ব্যত্যয় বাধাল। সঙ্গে সঙ্গে শুধাল, হাজি সায়েব, কিতা মানে কী?

এতাবৎ ভদ্রা শিপ্রা কাউকে উপেক্ষা করেনি, আবার কারও প্রতি বিশেষ দৃষ্টিনিক্ষেপও করেনি।

হাজি তাই শিপ্রাবানুর নেকনজর পেয়ে বিগলিত। কোমরে দু ভাজ হয়ে, বাও করে, ঘন ঘন কুর্নিশ ছেড়ে বলল, জনাব বেগমসাহেবা খানম-বানু, যে কোনও অর্বাচীন সিলেটি আপনাকে বলবে, কিতা মানে কী

আলবৎ। কিন্তু সেখানেই শব্দটার শেষ অর্থ খতম হয়ে দাঁড়ি কাটেনি। ওটা অনেক রহস্য ধরে। তুমি কিতা? তার কতই না উত্তর হতে পারে

আর এক সিলেটি সেখানকার মদনমোহন কলেজের লেকচারার, বললে, শুরুর গানে যদি সামান্য পাঠান্তর করি–বলেই দু হাত দিয়ে দু কান ছুঁলেন, অপরাধী যে-রকম মাফ চায় এবং বলি।

ওগো মিতা সুদূরের মিতা
আমার কী বেদনা জানো কি তা?

তা হলে ওই শেষ কি তা সিলেটি কিতার রহস্য ধরে।

শিপ্রা খুশি হয়ে দুই সিলেটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কীর্তি যাকে সে আদর করে কীতা ডাকে তার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল।

হাজি পূর্বতর প্রশ্নের খেই ধরে বললে, মুরগির ব্যবসার ঠ্যালাতেই তো, দাদা এখানে পালিয়ে এলুম। আমি লীগের রীতিমতো সম্মানিত সদস্য। ওদিকে খুদ লীগ হাইকমান্ডের হুকুম কি না জানিনে, পাঞ্জাবি-পাঠানদের খানাদানা সাপ্লাই বন্ধ করো। কিন্তু কার্যত গাঁয়ের লোকসুদু আমন ক্ষেপে গেছে, আমিও তাদের দলে, তাই ইচ্ছে থাকলেও মুরগি জোগাড় করতে পারি ক শো–ওই কেনটনমেন্টের তরে? ওটা তো অজানা থাকবে না। তার পর শা– সরি সরি বড়কর্তা কর্নেল আমায় এত্তেলা পাঠাল–

বাপস্!
সব্বোনাশা!
কিতা কিতা!
ইয়াল্লা! (কোরাস)

ধুকুপুকু মুরগিবাচ্চার জানটা নিয়ে গেলুম কর্নেল সমীপে- সুপুতুরের বাপ নিঝংশ হোক। আমাকে এই মারে কি তেই মারে। আন্দেশা করছি, হিন্দুদের মতো ধর্মপত্নীর সোনার কাঁকন-জোড়া খুলে আনলেই হত। বিক্কিরি করলে, এই মাগির বাজারেও এক কেস স্কচ কেনা যায়। তারই নাকি এক বোতল পেটে ঢেলে ডাচ্ কারেজ সঞ্চয় করে এলে হত। ব্যাটা– শিপ্রার দিকে ক্ষণতরে তাকিয়ে সেলাম ঠুকে বলল, ম্যাডাম। আপনি আমার এই অভদ্রস্থ কথাগুলো অ্যাটুকুন মাফ করে দেবেন প্লিজ। য ফলা শিখতে গিয়ে পাঠশালে পড়েছি,

অশ্লীল কুবাক্য সদা মুখে ফোটে যার।
লোক সনে ঐক্য সখ্য রহে না তাহার।

শিপ্রা : সাহেব, আপনি কি ভুলে গেলেন, আমি গোড়াতেই আপনাদের হুশিয়ার করে দিয়েছি, আমি লেডি নই। আপনি দিল্ জাম্ ভরপুর করে গালাগাল দেন, আপনার ওই কবিতার অশ্লীল কুবাক্য এস্তেমাল করুন। আমার কলিজাটা নেচে উঠবে। ওই হারামজাদারা আমার দু চোখের দুশমন।

হাজিকে তখন আর পায় কে? চেয়ার ছেড়ে উঠে অর্ধনৃত্য করে বললে, শাবাশ, শাবাশ, ম্যাডাম। এবার আমার সত্য জ্ঞানোদয় হল আপনি নিকষ্যি কুলিন লেডি। আপনি পরমহংসী। পাতিহাঁস, পাতি নেড়ের মতো পাতি লেডি এসব উত্তমোত্তম ভাবব্যঞ্জক কটুবাক্য শুনে কানে আঙুল– অবশ্য ফুটো দুটো পুরোপুরি বন্ধ করেন না, কারণ তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবলা– আর চোখে মুখে ছ্যা ছ্যা করেন। আমার মনে কোনও সন্দ নেই আপনি রিয়েল স্টাফ, খাঁটি স্কচ, ও স্যরি স্যরি, আই মিন আপনি পুরো পাক্কা লেডি। বিশেষ করে হারামির পরিবর্তে রূঢ়তর কিন্তু হাইলি কালচারড– জাদাটা যোগ করে।

কী বলব, ব্যাটা দেখি আমার হাঁড়ির খবরত রাখে। বললে, তার পাঁচশোর বদলে এখন থেকে হাজারটা মুরগির দরকার। আমি পাক্কা ইংরেজিতে বললুম, বাই দি লর্ড হ্যারি, পাব কোথায়? সম্বন্ধী ব্যাটা বলল, আমি জানি, তুমি রোজ ঢাকার হোটেলগুলোকে মুরগির চালান পাঠাও। আমিও কম যাইনে। ব্লাফ-মাস্টারের বেলুন। বললুম, তা হলে আপনি সেপাই মারফত সেগুলো স্টেশন থেকে পকড়কে আনিয়ে নিন। আমি জানতুম এখনও কামারের ঘায়ের লগন আসেনি।

তার পর কর্নেল হঠাৎ একদম খাদে নেমে বললে, মিস্টার মজুমদার, আমরা একটা পোলট্রি ফার্ম খুলতে চাই ময়নামতিতে। আপনি তো স্পেশালিস্ট। মেন্ পয়েন্টগুলো বাৎলে দিন। আপনার ব্যবসাতে চোট লাগবে না। আমার চাহিদা প্রতিদিন বেড়েই যাবে, কমবে না। তোমার থেকে আরও বেশি নেব। আমি অবশ্য হরবকৎ জেন্টেলম্যান আনাড়িতে নাড়ি-জ্ঞান শিখিয়ে বেহেস্ত যাব না কেন? সেইসব টিপসই দিলুম যেসব ঢাকা-কলকাতা দেয় তাদের রুরাল ব্রডকাস্টে পশুপক্ষী পালন বাবদে চাষাদের। শুনেছি, ওগুলো পালন করলে প্রতি তিন মাস অন্তর মুরগির মড়ক অনিবার্য। অবশ্য আল্লা যদি আমাদের প্রতি সদয় হন। কিন্তু এহ বাহ্য। দাদারা, বলুন ইয়েহিয়া-মুজিবে সমঝোতার সম্ভাবনা কতখানি? তা হলে আর্মির সংখ্যা কমত না?

শিপ্রা বললে, আমাকে এক বিদেশি জেনারেল বলেছিলেন, দেশের রাজধানী, বড় বড় শহরের পাকা পলিটিশিয়ান এমনকি আর্মির মধ্যস্তরের অফিসাররা বহুক্ষেত্রে যেসব টপ সিক্রেট জানতে পায় না, যেমন ট্রপ মুভমেন্ট, গ্রামের সাধারণ লোকের কাছ থেকে তা লুকিয়ে রাখা যায় না। হাজি সাহেব অবশ্য জবরদস্ত সাপ্লায়ার। কিন্তু তিনিও তো মুরগি-আণ্ডা কিনবেন গায়ের চাষা-ভূষোর কাছ থেকে। শাক-সবজি, এক কথায় যাবতীয় তাজা মাল ওরাই বেচে! জেনারেল বলছিলেন ইয়োরোপের যে কোনও কেন্টনমেন্ট থেকে মাত্র এক হাজার সৈন্য সরালে, সে-ও অতিশয় গোপনে, তবু আশপাশের গায়ের লোক সেই সন্ধ্যায় পাবৃ-এ বসে সঠিক নম্বরটি বলে দিত– একে অন্যের বিক্রির পরিমাণে খবর বদলাবদলি করে। এবং করেও।

হাজি তো তার মতের সমর্থন পেয়ে খুশি। বাকি পাঁচজনও তাজ্জব মানল। আর যেসব কলকাতার সোসাইটি লেডিজ দেখেছে তারা, খানের নিমন্ত্রণেই তারা এসেছেন আকছারই স্বামী বা ফিয়াসেসহ, তারা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন গেলাস-ফিল্ডে। ইনি তো এক ঘণ্টা হয়ে গেল ছোট্ট একটা ব্রান্ডির আধখানাও শেষ করতে পারেননি, ওদিকে ইয়েহিয়া রাজার গল্প, যেসব গল্পের রাজা– সেটাতে দস্তুরমতো তাদের অজানা সব তত্ত্বও যোগ দিতে পারেন।

আর কীর্তি তবে গর্বভরে আসমানি ঘোড়ায় চেপে তামাম শহরটার উপর হাওয়াই চক্কর মারছে।

খান মিটমিটিয়ে হাসছে। একবার হাত কচলাতে কচলাতে বললও, আমার বৃথা প্রশংসা করবেন না। এঁকে আমি গড়িনি। ইনি আমার স্কুলে পড়েননি। হেঁ হেঁ! ফের সবিনয় ভাব, কেন মিছে লজ্জা দিচ্ছেন!

খানের প্যারা দোস্ত গোস্বামী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তোমার প্রতি কোনও অবিচার হবে না; তোমার যা মগজের পরিমাণ সেটুকুন দিয়ে ওই সেই চাষার কবরেজি বড়িও হয় না। কিন্তু মোদ্দাটা হচ্ছে এই; আমরাও বই পড়ি, মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর ত্রৈমাসিক, বিলিতি লিটরারি সাপ্লিমেন্ট– অবরে সবরে। তার কিছুটা মনেও গাঁথা হয়ে যায়। কিন্তু কই, সঠিক মোকায় তো সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনে। ওদিকে দেখ, বেগমসাহেবা যে দু চারটি কথা কইলেন তাতে তাঁর গভীর তত্ত্বজ্ঞান, গভীরতর স্বাধ্যায় তো ধরা পড়লই, কিন্তু কী অলৌকিক মোকা মাফিক সেগুলোর প্রয়োগ! দেশ– অর্থাৎ পার্টিতে গল্পগুজব হচ্ছে এটা রয়েল সোসাইটির মিটিং নয়। পাত্র– আমরা অর্ধশিক্ষিত, ফুর্তির চিড়িয়া, তদুপরি ভিন্ন ভিন্ন ধান্দায় চড়ে বেড়াই, আমরা রিসার্চ করিনে। এবং সর্বশেষে সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কাল, অর্থাৎ টাইমিং। মিঞাসাহেব বা হাজির বক্তব্য শেষ হওয়ার বহু পূর্বেই তিনি ঠাহর করে নিয়েছিলেন, নলটা চলেছে কোন দিকে। যে কোনও মুহূর্তে ইন্টারাপ করে দেখেছ কোনও মেয়েছেলে কবে যার এ অভ্যাসটি নেই এবং সেটাতে তাদের হক্ক আছে তার বক্তব্য তিনি বলতে পারতেন। না, তিনি অপেক্ষা করে রইলেন। যতক্ষণ না আমাদের মন তৈরি হয়, তার প্রত্যেক শব্দ যেন আমাদের প্রত্যেকটি ব্রেন-সেলে পুরো মাত্রায় আঘাত দেয়। এই অসাধারণ গুণটি বড়ই দুর্লভ, হে খান, বড়ই দুর্লভ।

শিপ্রা চলে গেছে খাবার তদারকিতে আজ এদের সকলের দাওয়াত, তাদের ফ্রেন্ডস অ্যান্ড এনিমিজসহ।

আপন আপন গেলাস নিয়ে সবাই ডাইনিংরুমে এলেন।

শিপ্রা লক্ষ করল, হাজিকে সে তার পাশে বসাল এবং আর পাঁচজনের গালগল্পে কান না দিয়ে ডিনারের প্রায় অধিকাংশ সময়টা গম্ভীর মুখে গুজুর গুজুর করল। অবশ্য টেবিলের কায়দা মেনে মেনে। শিপ্রা তো প্রায় সেই ষোল বছর থেকে হোস্টেস। ওদিকে গল্প করছে, শুনছে মনপ্রাণ দিয়ে যে অন্য দিকে কোনও খেয়ালই নেই, ওদিকে তার চোখ তো চোখ নয়, বন্দুক। প্রত্যেকটি গেস্টের প্রতি বন্দুকের অব্যর্থ নিশানা। প্রত্যেকের মনে ধারণা হল শিপ্রা যেন একমাত্র তাকেই খেতে ডেকেছে আর সামনে বসে বাড়ছে। শ্রীহরি ও সখীগণসহ শ্রীরাধা যখন চক্রাকারে নৃত্য করতেন, তখন শ্রীরাধা তো কথাই নেই, প্রত্যেকটি সখী দেখতেন তারই পাশে পাশে কেষ্ট-ঠাকুর নেচে চলেছেন।

ডিনারের পর সবাই বিদায় নিলেন। রাত্রি তৃতীয় বামে পৌঁছেছে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠি উঠি করছে।

বিদায় নেবার সময় মিঞাসাহেব শিপ্রাকে বললেন, এটা মহরমের মাস। ইয়েহিয়া কট্টর শিয়া। সুন্নিরা মহরম মাস পবিত্র বলে স্বীকার করে বটে কিন্তু শিয়াদের কাছে মহরমের মাহাত্ম্য সর্বাধিক– এমনকি দুই ঈদের মাস বা রোজার মাসের সঙ্গেও তার তুলনা হয় না। এই পবিত্র মাসে ইয়েহিয়া খুন-খারাবি আরম্ভ করবে কী? কি জানি?

.

শিপ্রা শুয়ে পড়েছে। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে দরজার সামনে একটুখানি সামান্য নড়াচড়া করতেই শিপ্রা ডাকল, এসো।

একটা চেয়ার টেনে পাশে বসতেই শিপ্রা বলল, আহ্! এই তোমাকে পেলুম এখানে আসার পর থেকে একলা। ভিড়ে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলি। কীই-বা ভিড় ছিল আজ! কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার লোকের মেলা– আর তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, খুঁজছি বার বার।

শিপ্রার প্রসন্নতা দেখে কীর্তি সাহস সঞ্চয় করে বলল, হাজিকে শুধোচ্ছিলুম তিনি কুমিল্লা-আগরতলা এত ঘন ঘন মাকু মারেন কী করে। হাজি তুড়ি মেরে বললেন, ও তো ডালভাত। আমার তিনটে ভিন্ন ভিন্ন ন্যাশনালিটির তিনখানা পাসপোর্ট আছে। যখন যেটার দরকার হয় তাই দিয়ে চালাই। যদিস্যাৎ নিতান্তই আর্জেন্ট কাজ থাকে তবে বর্ডার চেকপোস্ট-এর লোকগুলোকে একটুখানি ইশারা দিই। ব্যস। বাতলটা বাতলটা, বউয়ের জন্য জবাকুসুমটা, ছেলের জন্য ইনস্ট্রমেন্ট বক্সটা এসব তো আমি প্রায়ই সওগাত দিই, পাসপোর্ট থাকলেও। আর তার চেয়েও জলদির মামেলা হলে কালোয়। যেসব পথ-বিপথ দিয়ে কেপাতা যায়, সুপুরি আসে, তার সবকটা আমার নখাঘদর্পণে। আমি শুধালুম, আমাকে বর্ডার অবধি দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন? হেসে বলল, আমি রাতারাতি আপনার কাগজপত্র তৈরি করিয়ে কালই খাস কুমিল্লায় আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এখন পাকিস্তানে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। তবে বর্ডার অবধি সে তো হেসে-খেলে। কালো পথগুলোও দেখাতে পারি। তবে মোটর ছেড়ে এদিক-ওদিক খানিকটে হাঁটতে হবে।

তুমি যদি অনুমতি দাও, তবে একবার বর্ডার পর্যন্ত হয়ে আসি। প্লিজ।

খানকে বলেছ?

হ্যাঁ, সে সঙ্গে সঙ্গে বললে, তোমার অনুমতি নিতে।

শিপ্রা চিন্তা না করেই বললে, তবে যাও। তোমার কোনও ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি প্রতিবন্ধক হব এ পরিস্থিতিটা আমি কল্পনাই করতে পারিনে। এবং আমি জানি, তুমি গোঁয়ার নও খামাখা বিপদ ডেকে আনবে না। আমার মনে হল হাজি পাকা লোক। তুমি গাইড পেয়েছ সর্বোত্তম।

কীর্তি বললে, আর ঘণ্টা দু ত্তিন পরেই হাজি গাড়ি নিয়ে আসবে। তুমি কিন্তু তোমার কাঁচা ঘুমটি নষ্ট করো না। আমরা দুপুরের আগেই ফিরব।

আমাকে একটা চুমো দাও।

চিরকালই শিপ্রার ঘুম ভাঙে পাশের মসজিদের ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সারারাতের পার্টি থেকে ফিরে যত ভোরের মুখেই শুতে যাক না কেন। আজও দেখতে পেল হাজির মোটরের হেডলাইট, শুনতে পেল বারান্দা দিয়ে কীর্তির এগিয়ে যাওয়া, কিন্তু বেরুল না।

সকালে খানের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে শুধাল, আজ তোমার পার্টি কখন শুরু হবে– মোটামুটি?

খান ইতস্তত করে বললে, তুমি যদি অনুমতি দাও তবে আমি একটু কাজ সেরে আসি। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের কাজ। এই ডামাডোলের বাজারে কিছুটা ব্যবসা গুটোতে হবে কিছুটা গুছোতে। নইলে যেতুম না।

বা রে, যাবে না কেন?

আরাম পেল খান। বললে, আর শোনো, যে ইংরেজ বাড়িটা বিক্রি করে সে তার বেশিরভাগ বই-ম্যাগাজিন রেখে গিয়েছে। বিলিয়ার্ড রুমের পাশের কামরায়। ইট্রেসটিং কিছু পেয়েও যেতে পারো।

কামরায় ফিরে দেখে, আয়া জরাজীর্ণ এক প্যাকেট তাসের প্রায় সব ক-খানা কার্পেটের উপর পেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে, কী যেন হিসাব করছে আর বিড়বিড় করছে আপন মনে।

হঠাৎ শিপ্রাকে দেখে চরম লজ্জা পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তাসগুলো এক ঝটকায় তুলে নিল। মাথা নিচু করে বার বার মাফ চাইল।

শিপ্রা সেদিকে যেন কানই দিল না। বরঞ্চ বলল, তা থামলে কেন? কী খেলছিলে, পেশেন্স?

একটু হিম্মত পেয়ে তার খিচুড়ি ভাষায় বললে, না, মিসিবাবা। আমি তার থেকে দেখছিলুম, কী কী হবে, মানে কী সব ঘটবে–

ফিউচার?

রাইট, মিসিবাবা। আর ভাগ্যগণনা। দুটো প্রায় একই। আমি যে মেমসায়েবের কাছে বাচ্চা বয়েস থেকে জোয়ানি ত নোকরি করেছি, তিনি আমায় তাসের বহুত কুছ থেল শেখান। আমার সঙ্গে রোজ দুপুরে খেলতেন। আমি ভেবেছিলুম, আপনার পায়ের শব্দ শুনতে পেলেই তাস ঝটপট তুলে নেব। বেয়াদবি মাফ করুন। আমি একদম মশগুল হয়ে গিয়েছিলুম।

কাট দ্যাট আউট। কোনও বেয়াদবি হয়নি। তা মশগুল হবার মতো কী পেয়েছিলে?

গম্ভীর স্বরে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টা করল। বলল, এই যে সবাই ভাবছে ফিনসে লড়াই শুরু হবে কি না, এক দফা জেসা হুয়া, সেইটে হবে কি না? মেমসাহেব বলত, আমি পাহাড়ি– সাদা-দিল-ঔরৎ। আমরা নাকি ওদের চেয়ে ঢের ভালো ফিউচার দেখতে পারি।

শিপ্রা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অলস কৌতূহলে শুধাল, কী দেখলে?

পাহাড়িনী কুঞ্চিত করে বললে, সব আন্ধেরা, আন্ধেরা। এসা বড় একটা হয় না। ফিসে দেখি। তাস শাফ করে শিপ্রার কাছে নিয়ে এসে বলল, টোকা দিজিয়ে। তা হলে উয়োঠো হোগা আপকা গিননা। শিপ্রা লক্ষ্মী মেয়ে। তুরন্ত টোকা দিল।

ইংরেজের ছেড়ে যাওয়া বইয়ের ভিতর সে পেয়েছে ইংরেজ লেখক উইলিয়ম মেকপিস থ্যাকারে ও সিলেট নিয়ে একখানা মোটা বই। তার জানা ছিল থ্যাকারের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। এই বইয়ের যে ক-খানা পাতা উল্টিয়েছে তাতে মনে হল লেখকের অন্য কোনও একটা নতুন গবেষণাপ্রসূত মতবাদ আছে। অবশ্য এটা ধ্রুব সত্য, থ্যাকারের পিতা সিলেটের সর্বময় কর্তা ছিলেন কিছুকাল। শিপ্রার চিন্তাধারা চলল অন্যদিকে। থ্যাকারে কি এসব মামোজাম্বোতে বিশ্বাস করতেন? কিপলিং। আজকাল তো বিস্তর হিপি করে।

আয়া গভীরতম মনোযোগ সহকারে এক-একখানা করে তাস ফেলে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে। এমনই বাহ্যজ্ঞানশূন্য যে শিপ্রার প্রশ্ন প্রথমটায় তার কানেই ঢোকেনি। সংবিতে ফিরে বলল, ঘোটালা, ফিসে ঘোটালা! এই তো দেখুন, বার বার পরপর তিনবার পাঞ্জা এসেছে। তো নিকলা, এক তরফমে পাঁচঠো আদমি। তার বাদে দেখিয়ে, দুটো দস্সা এসেছে। লাখ লাখ আদমি লেকিন মুশকিল আছে ইনকা। বোহ মুশকিল দোঠাই কালা দসসা। লেকিন উয়ো পাঁচঠো কিয়া? তিন বার আয়া। পেহলাই।

শিপ্রা অনুমান করল, দশের তাসগুলোকে আয়া জনতা হিসেবে নিয়েছে। কথায় বলে দশের মুখ খোদার তবল, এরই হুবহু লাতিন ভ পপুলি, ভস্ দেই; দশজনের গলা ঈশ্বরের গলা অতএব দশের তাস পপুলি, পাবলিক, জনারণ্য অর্থাৎ আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাদের বিপক্ষে আয়া প্রত্যাশা করেছে টেক্কা, কিংবা বাদশা অর্থাৎ ইয়েহিয়া। এসেছে পাঞ্জা। পঞ্চ আবৃ? পাঞ্জাব? হঠাৎ তার মনে পড়ল, লারি বলেছিল মির্জাকে, অনেকেরই বিশ্বাস, ইয়েহিয়ার তথাকথিত সমর্থক যে মিলিটারি জুন্টা আছে তারা সংখ্যায় পাঁচ এবং আসলে ওদের আদেশে ইয়েহিয়া ওঠবস করে। শিপ্রা আপন মনে হেসে উঠল। ধর্মরাজের পশ্চাতে পঞ্চপাণ্ডব। না তা হলে ইয়েহিয়াটা সাইফার। আয়াকে এই পাঞ্চজন্য তাসের মাহাত্ম্য বোঝাতেই সে আনন্দে ফেটে পড়ে আর কি! বার বার বলল, পুরানা মেমসায়েবের চেয়ে মিসিবাবার নজর বহু দূর দূর যায়, কাঁহা কাহা মুলুকে। বেরুল পরপর রুইতন আর ইস্কাপনের টেক্কা।

শিপ্রা, আয়া দু জনাতেই একই ওয়াটারলুতে। পরাজয়। কোনও অর্থ বেরয় না।

ভারত, পূর্ব বাঙলার কটা লোক তখন জানত, ইয়েহিয়া হারেমের পাটরানি হবার জন্য চলেছে তখন জোর লড়াই। একজন ফর্সা পশ্চিম পাকি– লোকে তার নাম দিয়েছে। জেনারেল রানি; অন্য জন পুব বাঙলার শ্যামা, ডাকনাম ব্ল্যাক বিউটি।

এসব হোকাস পোকাসে শিপ্রার মতো মেয়ের কৌতূহল দুরন্ত বাচ্চার হাতে বেলুনের মতো দীর্ঘজীবী। শিপ্রা পুস্তকের সুগন্ধি বাগিচায় ডুব মারল। আরব কবি বলেছেন, পুস্তক সে যেন একটি বাগান, যেটাকে পকেটে পোরা যায়। তার পর আয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টির ফলাফল শিপ্রার কানে আর যায়নি।

শুধু একবার শুনল, মুজিব। সঙ্গে সঙ্গে এলেন হরতনের বিবি মুজিবের বিবি। তার বাদেই পরপর দুটো কালো গোলাম। ভেরি ব্যাড়, ভেরি ব্যাড়। উনি বন্দি অবস্থায় গোলামদের পাহারায় থাকবেন কয়েক মাস।

আয়া যখন শেষটায় সব তাস গুটিয়ে নিল তখন হাই তোলার আভাসটা হাত দিয়ে চেপে শিপ্রা শুধাল, হরেদরে কী দাঁড়াল?

আয়া ভদ্রতা জানে। বললে, বড় খারাব তাস এককে বাদ দুসরা। লেকিন এদের নসিব ঔরভি খারাব হত যদি না মিসিবাবা টোক দিতেন। স কে সব বদ কিস্যুৎ। সক্কলের কপালে দুঃখ। তসল্লি (সান্ত্বনা) বস ইয়েহ– দুঃখের শেষে সুখ বেশি আখেরে।

তা হলেই হল, আনমনে বলল সে।

আয়া শুধাল, আপনার নসিব দেখব?

প্লিজ ইয়োরসেলফ।

এবারে পুরো তাসে টোকা মারল আয়া নিজেই। শিপ্রা আবার তার বই-বাগানে হেথা-হোথা ঘুরতে লাগল। বাগানটা কিন্তু তেমন আ মরি আ মরি করার মতো নয়। যদি সিলেটি বান্ধবী বিলকিসের সঙ্গে দেখা হয় তবে বইটার কথা তাকে বলবে। কিন্তু কোথায় কোন গ্রামাঞ্চলের জমিদারবাড়িতে হল তার বিয়ে। আবার দেখা হবার সম্ভাবনা কতখানি? হায়, শিপ্রা জানত না, ত্রিপুরা পাহাড়ের উপর দিয়ে আসবার সময় সে যেসব হাওর দেখেছিল তারই একটার পারে বিলুকিদের বাড়ি, টিলার উপর, প্লেন থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল মাত্র। পুনরায় ডবল হায়, হায়। জানা থাকলেই-বা কী হত?

না, সে খুঁজত এলোপাতাড়ি এবং ডাউন করতে পারত না। কিন্তু তাতেও তো আছে সুখে-দুঃখে মেশানো ছোট্ট একটি অনুভূতির আবেশ।

আয়া যেন বসে বসে উল্লাসে নৃত্য করছে। এরকম একটার পর একটা নিরবচ্ছিন্ন খুশ- কিস্মতের তাস সে কভি ভি দেখেনি। আচ্ছি শাদি, আচ্ছে বাল-বাচ্চে–ভুরু কুঁচকে বলল, লেকি কম। মাত্র কটি এই কথাই তার কানে এসেছিল। বিলকুল বোগাস! মুচকি হেসে ভাবল, পাহাড়িদের ভিতরও তা হলে আর‍্যা গান্ধারী মাতুকুল শ্রেষ্ঠা!

অকস্মাৎ শিপ্রার খেয়াল গেল অকস্মাত্তর বেগে আয়া উপু হয়ে দু হাত দুবাহু দিয়ে সব তাস গুটিয়ে নিচ্ছে। শুধাল, কী হল?

নিশ্চুপ।

শিপ্রা একটুখানি কাত হয়ে আয়ার মুখের দিকে তাকাল। সে ইতোপূর্বে বিস্তর মঙ্গোলিয়ান টাইপের পাহাড়ি মেয়ে দেখেছে, এবং লক্ষ করেছিল, এদের ভাব-পরিবর্তন মুখের ওপর অতি সামান্য রেখা আঁকে, রঙ পালটায়। এখন দেখে, আয়ার মুখ যেন কালো হয়ে গিয়েছে ছোট্ট বাচ্চা কাঁদবার আগে যেরকম মুখ বিকৃত করে অনেকটা সেইরকম।

অবাক হয়ে শুধাল, কী হল তোমার? খারাপ কিছু একটা দেখেছ? তুমি বড় সিমল। এসব কখনও কি সত্যি সত্যি ফলে? না হয় আমাকে বলেই দেখো, আমি কীভাবে নিই।

না পুছিয়ে মিসিবাবা। বলা শেষ হওয়ার পূর্বেই, সেই কবেকার বাচ্চা বয়েস থেকে তার হাড়ে হাড়ে লোমে লোমে যেসব ভদ্রতম দেশি-বিলিতি এটিকেট ঢুকে গিয়েছে, সেগুলো এক লহমায় ভুলে গিয়ে খাস পাহাড়ি মেয়ের মতো দুই হাঁটুর উপর শাড়ি টেনে তুলে ছুট দিল বাবুর্চিখানার দিকে।

শিপ্রা একটু মুচকি হাসল। সামান্য তাসের হেরফের ভুলিয়ে দিল সরলা পাহাড়িনীর পূর্ণজীবনের অভ্যাস, শালীনতাবোধ অবশ্য আয়ারই মতে– সেটা অলক্ষ্মনীয় শালীনতা, সামান্য দু খানা তাস এক টানে তাকে নিয়ে গেল সেই দুর্গন্ধ অন্ধকার গিরিগুহায়, তার ভিতরটা এক লহমায় ভরে দিল যুগ যুগ সঞ্চিত তার পিতৃপিতামহ পূর্বপুরুষদের ভীতি দিয়ে হিংস্র জন্তুর ভয়, ঝঞ্ঝা-বিদ্যুতের ভয়, সভ্য বিদেশির বন্দুকের ভয় এবং সবচেয়ে বড় ভয়– পৈশাচিক প্রেত-দৈত্যের দানবিক অট্টহাস্যের বিভীষিকা।

সব জানে, সব বোঝে শিপ্রা কিন্তু তবু তার মনটা খচখচ করতে লাগল।

তুলনাহীনা – ২য় খণ্ড

০১.

কীর্তি কাঁপছে। অন্য কারও চোখে পড়ত না, কিন্তু শিপ্রার চোখ ভালোবাসার চোখ, সে তো সব দেখতে পায়।

কাঁপছ কেন?

কই আমি তো টের পাচ্ছিনে।

যাও, চান করে এসো, মাথার প্রত্যেকটি চুল পর্যন্ত ধুলোয় ধুলোয় সাদা, গেরুয়া।

কীর্তির যে যাবার ইচ্ছে নেই, শিপ্রা খুবই টের পেয়েছে। কিন্তু সে চুপ করে রইল। বলে কীর্তি বাধ্য হয়ে উঠল।

শিপ্রা হলঘরে এল। বাইরে রোদ তেতে উঠেছে বলে হাজি বসেছে খানের মুখোমুখি হয়ে। দুপুরের পূর্বেই কীর্তিরা ফিরে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের অল্প পূর্বে অপ্রত্যাশিত এই আগমন মনে যে কী আনন্দ দিয়েছিল সেটা সকলের কাছে এতই অকিঞ্চিৎ যে সে সেটা কাউকে খুলে বলতে পারবে না– হয়তো একমাত্র কীর্তিই তার সামান্য কিছুটা অংশের মূল্য হৃদয় দিয়ে নিতে পারবে, কাঞ্চন যতই অকিঞ্চিৎ হোক না কেন, সে কাঞ্চন। হলবাইনের ছবিতে উল্লসিত ব্যক্তির মুক্ত অট্টহাস্যের চেয়ে মোনালিসার মৃদু হাসি ঢের বেশি অর্থধারী, রহস্যময়। মোটরের শব্দ শুনেই সে তাই দ্রুতপদে গিয়েছিল বারান্দায়, যদিও প্রাণ চেয়েছিল ছুটে যেতে। কীর্তির ধূলিধূসরিত অঙ্গ-বস্ত্র দেখে সে যত না বিস্মিত হয়েছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি হল তার চেহারার আকস্মিক এক অজানা পরিবর্তন দেখে। ইতোমধ্যে আয়ার পত্রলেখার ভাগ্যগণনাজনিত খচখচানিটা এক মুহূর্তেই পেয়েছে লোপ– তার অজানাতে, এবং আবার ফিরে এসে পূর্বাসনে বসবার জন্য সেটাতে রুমাল বেঁধে রিজভড হক্কের ইস্টাম্বো মেরে যায়নি।

কী কী দেখলেন বলুন।

হাজি বললে, দেখার মতো খুব বেশি একটা কখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এখন, আজ ক দিন যা দেখেছি সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে ভবিষ্যতের অদেখা অনেক কিছুর দিকে।

খান বিয়ারে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বিজ্ঞের মতো বললে, এ তো সবসময়ই হয়! অদেখা জিনিস তো কোনও ইঙ্গিত দিতে পারে না দেখা জিনিসই অদেখার ইঙ্গিত দেয়।

শিপ্রা বললে, যেমন সাহারার মাঝখানে দৃশ্যমান অন্তহীন বালুকা অদৃশ্য মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়, আষাড়ের ঘন বরিষণ অদেখা পাকা ধানের ইঙ্গিত দেয়।

হাজি বললে, একশো বার মানি। তুলনাহীনার অতুলনীয়া তুলনা দুটি শুনে আরও বেশি মানি। কিন্তু ব্যত্যয় এইখানে যে, দেখার জিনিসগুলো পরস্পর-বিরোধী অদেখার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিপদে। একদিকে দেখুন ইমিগ্রেশন আইন মোটেই ঢিলে হয়নি; অন্যদিকে লক্ষ করবেন যেসব ফালতো লোক ইন্ডিয়ার দিকে আসছে– সবই হিন্দু তাদের কোনও চেক করা হচ্ছে না। এরা ঠিক রেফুজি নয়। এমনিতে হয়তো এ সময়টায় আগরতলায় মামাবাড়িতে আসত না, এখন জাস্ট টু বি অন্ দি সেফার সাইড়। আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই ইয়েহিয়ার বিস্তর গুপ্তচর কালো পথে এদিকে আসছে। ওদিকে দেখুন, ত্রিপুরা রক্ষা করার জন্য কী কী গোপন মিলিটারি ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিনে, কিন্তু পাবলিককে কি যথেষ্ট তৈরি করা হচ্ছে?

খান হেসে বললে, কিচ্ছু ভয় নেই, হাজি। অন্তত স্পাইদের নিয়ে চিন্তা নেই। পিণ্ডিতে আজ যা ঘটে দিল্লি কাল তা জেনে যায়। আমাদের খবর তারা জানতে পায় পরশু। স্টাইলটা একটু নবাবি কি না।

হাজি বললে, কিন্তু সব মিলিয়ে, ওভার অল পিকচার কারও আছে কি? এই যে আজ কীর্তিবাবু আমার সঙ্গে মোটরে গেলেন, এন্তের ক্ষেত চষলেন, দেখলেন কটুকুন? ত্রিপুরার তিন দিকে পা বর্ডার। বলতে গেলে পাকসমুদ্রের মাঝখানে যেন ইন্ডিয়া-দ্বীপাংশ। এর কতুটুকু দেখেছি আমিই-বা, আর কীর্তিবাবুই এক সকালে দেখবেন কতটুকু?

শিপ্রার কান পড়ে আছে কীর্তির পদধ্বনির তরে। এত দেরি কেন? ফ্যাশনেবল মেয়ের মতো তার কাছে বাথরুম ঠাকুরঘর, আর ঠাকুরঘর বাথরুম নয় তো।

হাজিকে সরাসরি শুধলে, কীর্তি এত উত্তেজিত– না, এত বিচলিত, জাস্ট, নট হিজ ওন সেলফ হল কেন?

আসমানের দিকে তাকিয়ে হাজি বললে, জানেন আল্লাপাক। আমাকে খান কতবার বলেছে, কীর্তির মতো হ্যাপি-গো-লাকি-ফেলো, হেল-ফেলা-উয়েল-মেট হয় না। দুনিয়ার হাল-হালত সম্বন্ধে আস্ত একটি পরমহংস। প্যাখনার উপর দুশ্চিন্তার ফোঁটাটি পর্যন্ত জিরিয়ে নেবার ফুরসত পায় না। আর আজ? বর্ডারে পৌঁছে কী হল, বুঝতে পারলুম না। আমি যা যা দেখেছি তিনিও ওইসব দেখেছেন, তবে হ্যাঁ, আমি যে অদৃশ্যের প্রতি অলক্ষ ইঙ্গিতের কথা বলছিলুম সেগুলোতে আমি, ওয়াটসন, দেখেছি চায়ের পিরিচ, উনি, হোস দেখেছেন ফ্লাইং সসার। তবে হ্যাঁ, মোটর মেরামতিতে আমি যখন ব্যস্ত তখন তিনি গামছা-পরা গামছা-কাঁধে কয়েকটা নিতান্ত দীনদুঃখীর সঙ্গে মিনিট কয়েক কথা কইলেন। কিন্তু কখন যে তার গায়ে অল্প অল্প কাঁপন লেগেছে সেও আমি বুঝতে পারিনি– মোটরের ঝাঁকুনিতে। কথা এমনিতেই তিনি বলেন কম, আর আমার নিজের বকর বকরের ঠেলায় নিজে আমি নিযুতি রাতে অন্য ঘরে গিয়েই শুই। কিন্তু এতে চিন্তিত হবার মতো কিছু নেই আয়েম শ্যোর। আর আপনাদের তো সবকিছু বলবেনই– একটু ঠাণ্ডা হলে পর। আমাকেও উনি কিছু পর ভাবেন না। আমাকেও বলবেন। নইলে আমাকেই-বা বেছে নিলেন কেন গাইড হিসেবে কোনওপ্রকারের লৌকিকতা না করে?

শিপ্রা বললে, এ কথাটা ঠিক। আপনাকে সে একটা অতি তালেবর খলিফে লোক ঠাউরেছে। আচ্ছা, আমি এখন উঠি। জয়েন ইউ লেটার– টা টা।

ঘরে গিয়ে খাটে শুতে না শুতেই চিরুনি নিয়ে আয়া হাজির। খানিকটে আঁচড়াবার পরই কীর্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। আয়া বললে, একটু পরে আসছি মিসিবাবা।

কীর্তি সোজা ড্রেসিংটেবিলের টুলটা টেনে এনে বসল। শিপ্রার হাত-দুটি আপন দু হাতে তুলে নিয়ে বললে, তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

শিপ্রা তার হাত ছাড়িয়ে তুলে নিল কীর্তির হাত। তার উপর ভেজা চুমো খেয়ে বললে, আমার তিন তিন বারের সত্য তুমি ভুলে যাওনি আমি জানি। বল।

তুমি কালই শিলঙ চলে যাও। সেখানে আমি আসছি সপ্তাহখানেকের ভিতর। শিলচরে একদিনের জন্য নেমে করিমগঞ্জ বর্ডারটা দেখে নেব। তার পর শিলঙ এসে তোমাকে নিয়ে ডাউঁকি বর্ডার দেখতে যাব। কাল যাবে শিলঙ? এখন ওই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।

নিশ্চয়ই। কিন্তু নিরাপদ বলে নয়। তোমার ইচ্ছে, তাই।

শিপ্রা লক্ষ করল, এখন কীর্তি আগের মতো একটানা কাঁপছে না। মাঝে মাঝে, যেন অল্প নড়ে উঠে। শিপ্রা স্থির করেছে কীর্তিকে এখন কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে না। সে নিজের থেকেই বলবে, একটু পরে।

আমি প্লেনের টিকিটের কথা হাজিকে বলে এখখুনি আসছি।

ফিরে এসে বললে, যা। বাঁচালে। ওরা অন্তত এটুকুন বুঝেছে, তোমার চলে যাওয়াই ভালো।

যেই না ওই কথাটি বলেছে অমনি তার মনের দরজা কে যেন হঠাৎ লাথি মেরে খুলে দিল।

প্রথমটায় দ্রুতগতিতে, যেন পাঠশালে ছেলে পাখি সব আবৃত্তি করছে, কারণ কীভাবে তার সমস্ত বক্তব্যটা শিকে গুছিয়ে বলবে সেটা সে ঘণ্টা তিনেক ধরে মুশাবিদা করেছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার বাথরুমেও খসড়াটা আদালতি ইস্টয়োর কাঠামোতে ঢোকাতে গিয়ে বিস্তর ধস্তাধস্তি করতে হয়েছে। সেটারও প্রথম ইমপর্টেন্ট হাফ হয়ে গেল আদালতের প্রিমা ফাশিতে উট্রা ভিরেস। ব্রিজ খেলায় যাকে বলে ভিয়েনা গ্যামবিট। কীর্তি ধরে নিয়েছিল, শিপ্রা তাকে ফেলে শিলঙ যেতে রাজি হবে না এবং সেটাকে নাকচ করার জন্য তাকে সত্য এবং অর্ধসত্য যুক্তিতর্ক পেশ করতে হবে। পয়লা হাফ বিলকুল বরবাদ হয়ে গেল– কারণ শিপ্রা প্রস্তাবনার সঙ্গে সঙ্গেই কেতাবের ইনডেক পর্যন্ত মেনে নিল। এতে করে হয়ে গেল তার কুল্লে মুশাবিদা টালমাটাল। কিন্তু ধুয়োটা রইল ঠিক। সেটা পাঠক চেনেন। কীর্তিনাশ এস্থলে কীর্তিমান। শব্দটি অপদার্থ।

গড় গড় করে বলে যেতে লাগল, সবচেয়ে ভালো করে তুমি জানো, আমি অপদার্থ। আমি নিজেই জানি সেটা তোমার চেয়েও বেশি। আজ হঠাৎ, দয়াময়ের অসীম করুণায় দাঁড়াও ঠিক হল না, নিষ্ঠুর সম্মানসহ, এই অপদার্থের সামনে বিদ্যুল্লেখার সর্বোজ্জ্বল, আলোক উদ্ভাসিত করে দিলেন, এবং শিশু যেরকম মাকে খুঁজে পায় এ তুলনাটা তোমার কাছ থেকে শিখেছি, গুরু– অন্ধকারের শিশুর নৈসর্গিক জ্ঞান পন্থাসহ আমি সবকিছু স্বচক্ষে আলোকিত প্রকৃতির সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মাকে খুঁজে পেলুম এবং দেখে নিলুম।

কাল রাত্রে যেসব আলোচনা হচ্ছিল সেটা সম্পূর্ণ ভুল আশঙ্কা নিয়ে নয়। সেটার প্রধান এবং যার চেয়ে অধিক গুরুত্ব ধরে তার অসম্পূর্ণতা– সর্পকে তারা মানবিক বুদ্ধির অক্ষম চন্দ্রালোকে রজু বলে ভ্রম করেছে, স্বয়ং যমকে যমদূত বলে ধরে নিয়েছে এবং সেই সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধ থেকে যাত্রারম্ভ হয়েছে বলে তাদের আলোচনার দিক নির্ণয় করা হল যে সত্য স্বয়ং প্রত্যক্ষ তার সঙ্গে সমান্তরাল রেখা ধরে নয়, আলোচনার পথে চলে গেল টেজেনট-এ, কোণা কেটে এবং আলোচনা যতই অগ্রসর হতে লাগল তার দূরত্ব প্রত্যক্ষ সত্যের দৃঢ়ভূমি থেকে বাড়তে বাড়তে বাস্তবতাহীন অন্তরীক্ষে অদৃশ্য হল।

কারণ এরা যমকে যমদূত, মহামারীকে ছিটেফোঁটা পেটের ব্যামো, ইয়োরোপীয় ব্ল্যাক ডেথকে সাময়িক মূৰ্ছা বলে ধরে নিয়েছে।

শিপ্রা বললে, তোমার কাছে যেটা সত্যরূপে আবির্ভূত হয়েছে, তুমি সেটাকে স্বয়ং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করেছ, সেটা আমি উপলব্ধি না করেও সর্বান্তকরণে স্বীকার করে নিচ্ছি– যে কর্ম ইতোপূর্বে আমি কখনও করিনি– কারণ এখন তোমার ধর্ম আমার ধর্ম। তোমার এ উপলব্ধি ধর্মজাত। সত্যকার কৌতূহলসহ উঠে বসে শুধাল, তোমার কথা থেকে মনে হল শুধু ইনসটিন বা ইনটুইশন দিয়ে তুমি তোমার সত্য উপলব্ধিতে পৌঁছওনি। খুলে বল অন্য কিছু আছে কি?

আছে। কিন্তু সেটা খুদ প্রত্যক্ষ উপলব্ধি নয়, কী যেন, কে যে আমাকে ধাক্কা মেরে সেই দিকে এগিয়ে দিল।

গামছা-পরা গামছা-কাঁধে আপাতদৃষ্টিতে গরিব দুটি চাষার সঙ্গে আজ আমার আলাপ হল।

শিপ্রা বললে, হাজি বলছিল বটে।

হাজি সত্যই সব কাজের, সন্ধিসুড়কের কাজী। কিন্তু আজ সে-ও ভুল করেছে– অবশ্য সেটা যমদূতে-যমে ঘুলিয়ে ফেলার মতো অতখানি দূর পার্থক্য ধরে না। ওরা দুজনাই উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপার্জনক্ষম শিক্ষিত যথেষ্ট সচ্ছল, শিক্ষিত ভদ্রসন্তান। একজন হিন্দু, অন্যজন তার প্রতিবেশী মুসলমান। রাজশাহী থেকে ওদের নামধাম বর্ণনাসহ মিলিটারি হুলিয়া বেরিয়েছে মোটা পুরস্কারের প্রলোভনসহ। যদিও মিলিটারি পুব বাঙলার পুলিশকে আর বিশ্বাস করে না– এ তত্ত্বটা এই আমি প্রথম শুনলুম– তাদের ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ও ব্যত্যয় হিসেবে ওদের নামের হুলিয়া পাঠাচ্ছে। আর খুদ মিলিটারি তো জিপে করে ওদের সন্ধানে উত্তর বাঙলাটা চষে বেড়াচ্ছেই।

অপরাধ? কাল রাত্রে আমাদের পার্টিতে যে সিদ্ধান্ত স্বীকৃত হয়েছিল সেটা ঠিক। ছোট-বড় সব মিলিটারি ঘাঁটিতেই কমান্ডাটরা সেপাইদের ঠেকিয়ে রেখেছে লুটপাট, অবিচারে যাকে তাকে গুলি করে মেরে বাদবাকিজনদের হৃদয়-মনে আতঙ্কের বিভীষিকা সৃষ্টি করে তাদের ক্লীব করে দেওয়া, এবং নারীহরণ করে ঘাঁটির ভিতর এনে ব্রথেল নির্মাণ করা।

রাজশাহী একমাত্র ব্যত্যয়। কেন, সে কথা শুধোবার কথা মনে ছিল না।

এই মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেখানে দিবাদ্বিপ্রহরে পাঞ্জাবি সেপাই তাদের ভদ্রলোক প্রতিবেশীর দুটি মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ছাউনিতে, বাড়িতে ফেরত দেয় অন্যান্য অত্যাচার করার পর। এই দুই পলাতকের একজন তখন অন্যজনকে ডাক দেয়। একজন বাইসাইকেল চালাল, অন্যজনের হাতে মার্কিন ডিজপোজেলের ক্যাম্পকটের খোল– মোস্ট হামলেস লুকিং।

ভাবতে গায়ে কাঁটা দেয়, কী দুঃসাহস! এ তো সজ্ঞানে অবশ্য মৃত্যুর মুখের দিকে ধাবমান হওয়া। এগোলো ছাউনির দিকে, পুরো স্পিডে সেপাইগুলো যাচ্ছিল পয়দল। শিগগির দূর থেকে ওদের দেখতে পেল– সবসুদ্ধ ছ জন। যতখানি অনুমান হল, সংজ্ঞাহীন মেয়ে দুটিকে রিকশায় বসে ধরে রেখেছে দুজন সেপাই। রাজশাহীর প্রত্যেকটি গলি, প্রত্যেকটি কুঁড়েঘরও তারা চেনে আপন বসতবাড়ির গলির মতো। একটুখানি ঘুরতি পথে জোরসে সাইকেল চালিয়ে তারা একটা অতি সরু আঁকাবাঁকা গলির মুখে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করল। শয়তানগুলোর জন্য। কী আশ্চর্য! অবস্থার ফেরে দুই শতাধিক বৎসর ধরে সংগ্রামে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ শ্রেণিও কীরকম হঠাৎ ইনসটিকটিভলি সর্বোত্তম মিলিটারি টেকটিক এস্থলে কী হবে সেটা সরাসরি উপলব্ধি করে ফেলেছে।

রিকশা দুটোকে তো এগিয়ে যেতে দেবেই। তার পর গেল আরও কয়েকজন। সক্কলের পিছনের দুই না-পাকিকে এদের একজন দুটো কার্তুজ দিয়ে ঘায়েল করল। প্রথম দুজনকে গুলি করলে পিছনের সবাই গলিটার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে বলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যেত ফায়ারিং হয়েছে কোন জায়গা থেকে। কিন্তু এই কূট পদ্ধতির ফলে সামনের সবকটা সেপাইকে ঘাড় ফিরিয়ে, সন্ধান করতে হল, ফায়ারিং কোনও বাড়ি থেকে, পাঁচিলের আড়াল থেকে গলিটার এ মুখ থেকে, না রাস্তা ক্রস করার পর গলির ও-মুখ থেকে। ওরা সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকে গিয়েছে দুটো বাসাবাড়ির টাটির মাঝখানের মেথরের পথ দিয়ে, খাটা পাইখানা চড়ে উসপার হয়ে, আরেক আঁকাবাঁকা গলি দিয়ে ঢুকল একটা জীর্ণ বাসাবাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে।

গৃহস্বামী অর্ধপরিচিত। বুঝিয়ে বললে, আপনি যদি ঘুণাক্ষরেও স্বীকার করেন আপনি আমাদের দেখেছেন– কথা কয়েছেন বললে তো কথাই নেই তবে আপনিও নিস্তার পাবেন না। তার পর তাদের দামি পাতলুন বুশসার্ট বার্টার করে পেল তিনখানা গামছা– চারখানা ছিল না। উপদেশ দিল, জামা পাতলুন উপস্থিত বাসন মাজার ডোবাতে ডুবিয়ে রাখুন– যদিও তার খুব একটা দরকার নেই, কারণ আমরা যখন মেথরের পথে ঢুকি, তখনও বাকি খানগুলো পিছন ফিরে গলির মুখ অবধি পৌঁছয়নি।

বন্দুক তারা গোটাপাঁচেক খাটা পাইখানা পেরুবার সময় যেটা সবচেয়ে জঙ্গলে ভর্তি, নোংরা সেটাতে পুঁতে দিয়ে দ্বিতীয় গলিতে ঢোকে নিরস্ত্র নিরীহ নাগরিকের মতো।

তখন তাদের সামনে একমাত্র সমস্যা, রাত্রের মতো বা দু দিনের মতো আশ্রয় নেয় কোথায়? গামছা-পরা অবস্থায় সঙ্গের দশ টাকার একগুচ্ছ নোট রাখে কোথায়? ওদের কপাল ভালো, একটা বাড়ির সামনে দেখতে পেল কাটা মুরগির রক্ত। খোঁড়াতে বেড়াতে গিন্নিমার কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিল খানিকটে হলুদ চুন আর ন্যাকড়া। নোট কানা পায়ে সাজিয়ে তার উপর বাঁধল নোংরা ন্যাকড়ার বান্ডেজ। তার উপর মাখাল মুরগির রক্ত, কোনও জায়গায়-বা কিঞ্চিৎ হলুদ রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে করা হল পুঁজের সাব্সটিটুট। এমারজেনসির জন্য দু দুখানা দশ টাকার নোট ভাঁজ করে পিটে পিটে প্রায় কবচের সাইজে এনে, কলাপাতা দিয়ে মুড়ে, বেঁধে মাড়ি আর গালের মাঝখানে দুজনা দুটো গুজল।

রাত্রিটা কোথায় কাটানো যায়, এই তখন সমস্যা। এদের একজন উকিল। তিনি সঙ্গীকে বললেন, আদালতে সঞ্চিত তার অভিজ্ঞতা মতে ক্রিমিনাল মাত্রেরই একমাত্র ভরসা বেশ্যাবাড়ি। সেখানে যে কোনও লোক বনাফাইডি ক্লায়েন্টরূপে যেতে পারে। কোনও পুলিশ, সেপাই আর যা শুধোর শুধুক, এ প্রশ্নটা তুমি এখানে কেন?– সম্পূর্ণ অবান্তর। ক্রিমিনালকে লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া ওদের একটা সাইড প্রফেশন। কিন্তু এই গামছা-পরা লোকদুটোকে আশ্রয় দেবে কি? দেবে। যদি আগাম টাকা ফেলা যায়। উকিল তাই বুদ্ধি করে কিছুটা গালে পুরে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। মেয়েদের পাড়ায় বরাতজোরে তারা আশ্রয় পেয়ে গেল। খেয়া পেরুবার সময় নৌকাডুবিতে ওদের জামাকাপড় ভেসে গেছে এ অজুহাত মেয়ে দুটো কতখানি বিশ্বাস করেছিল সেটা অবান্তর। রোক্কা দশটি টাকা সর্বঅজুহাতের চেয়ে বড় যুক্তি।

রাত্রে মেয়েগুলো আমাদের মিলিটারি সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা শোনাল। প্রথমেই আরম্ভ করল, বলে ওরা নাকি মুসলমান। ডোম-চাড়ালকেও ওরকম মেয়েমানুষ গিলতে আমরা কখনও শুনিনি। কোনওদিন আমাদের নিয়ে যেত ছাউনিতে সেখানে যা হত বলে কাজ নেই নীলাটা তো মারাই গেল। পালাতে পারলে তো বাঁচি। আশ্রয় দেবে কে আর রোজ ওই এক জিগির, ওদের সর্দার ভদ্রঘরের মেয়ে চান, আমরা জোগাড় করে দিলে মেলাই টাকা পাব। তার পর তারা প্রায়ই ঠা ঠা করে হেসে বলত, মাস খানেক পরে মুতেই পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে খবর এলেই আমরা শুরু করব সব কুছু। একদিনেই স্কুল-কলেজ থেকে এক ঝাঁপটায় নিয়ে যাব সবকটা মেয়ে আর পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে।

কীর্তি দম নিয়ে বললে, দুই বন্ধু এ কথাগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি কিন্তু আমি করি।

সপ্তাহখানেক ওদের লেগেছিল পাবনা পৌঁছতে।

শিপ্রা শুধাল, ওরা অত দূরের পথ না নিয়ে পদ্মা পেরিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেল না কেন?

ওদের কপাল। ওরা ভুল খবর পেয়েছিল, চাঁপাই-নওয়াবগঞ্জ থেকে যশোর অবধি মিলিটারির কড়া পাহারা অবশ্য সে পাহারা মোতায়েন হয়েছে, সবে, সেদিন।

পাবনার পাশ দিয়ে যাবার সময় এক কনস্টেবল উকিলকে চিনে ফেলল। কিন্তু সে করল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আচরণ। ছুটে এসে তাকে কানে কানে বলল, উকিলের নামে হুলিয়া বেরিয়েছে।… তখন জানতে পারলেন, পুলিশ আর ফৌজে তখন রীতিমতো নিরস্ত্র লড়াই, পারলে ওদের আশ্রয় দেয়। পুলিশটাই দুজনাকে জেলেডিঙিতে তুলে দেবার সময় বলল, ওই একটামাত্র বাঁচওতা রয়েছে এখনও। খানরা পানি বড় ডরায়। নৌকো দূরে থাক, লঞ্চে পর্যন্ত উঠতে চায় না।

কীর্তি কথার মোড় ফিরিয়ে বললে, এদের হাতে এখন মাত্র দু মাস সময়। পুব বাঙলার এদিকটায় বিশেষ করে চেরাপুঞ্জির তলাকার সিলেটে বর্ষা নামে কলকাতার অনেক আগে। দু মাসেই কাজ গুটিয়ে নিতে হবে ওদের। তাই ওদের দণ্ড নেমে আসবে খুব শিগগিরই এ ধারণাটা কাল রাত্রেই আমার হয়েছিল; আজ এরা আপন অজানতে কনফার্ম করল।

আরেকটা কথা; এরা বললে, সেই দূর রাজশাহী অঞ্চল থেকে এই আগরতলা অবধি বহুলোকের সঙ্গে তাদের আলাপচারী হয়েছে। একজন লোকও পায়নি যার ধারণা আছে, এবারে যে মিলিটারি জুলুম আসছে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। ওরা ধরে নিয়েছে, পঁচিশ বছর ধরে নানা রাজা, নানাপ্রকারের খেল দেখিয়েছেন, এবারও সেটা হবে– বেশিরভাগেরই অবশ্যই উইশফুল থিঙ্কিং সমঝোতা হয়ে যাবে সেটারও প্রকৃতি হবে একইরকমের। উনিশ-বিশ হবে শুধু পরিমাণে।

কীর্তি বললে, ওদের দুজনাকে আমি তোমার কলকাতার ঠিকানা দিয়েছি।

শিপ্রা একটু চমকে বললে, তোমার প্রোগ্রাম কী?

যতটা বলেছি, ততখানি ঠিক আছে। আমি তোমাকে শিলঙে মিট করব। তার পর কলকাতা যাব। সেটার দিন স্থির করা তোমার হাতে। কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমার কী হবে, আমি কী করব সেটা আমার হাতে তো নয়ই, তোমার হাতেও নয়, খুব সম্ভব।

শিপ্রা বললে, ওদের দুজনার নাম দাও তো। আমি শিলঙ থেকে রামাকে জানাব, এঁরা যদি আমার কলকাতা ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তবে যেন ওদের কলকাতার ঠিকানা ঠিক ঠিক লিখে রাখে এবং বলে আমি ফিরে আসা মাত্রই ওদের সঙ্গে দেখা করব। ঠিক তো?

তোমাকে তো ককখনও অঠিক কাজ করতে দেখিনি। আয়াকে ডাকব তোমার খোঁপাটা বেঁধে দিক। আমাদের একবার হলে যাওয়া দরকার।

তার পর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে, দাঁড়িয়ে উঠে, মাথা নিচু করে শিপ্রার তরঙ্গে তরঙ্গে নেমে-আসা কুঞ্চিত কেশদামে মাথা গুঁজে দিয়ে পরিতৃপ্ত নিশ্বাসে বুকভরে নিল।

শিপ্রা এলোখোঁপায় পাক লাগাতে লাগাতে বলল, চলো, ডার্লিং। হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তা এতকাল ধরে তোমাকে অপদার্থ, অকর্মণ্য করে রাখেননি তিনি তোমার ব্যাটারি চার্জ করেছিলেন। এইবারে খেলো, খেলো, তব ভৈরবখেলা।

শিপ্রা লক্ষ করেছে, কীর্তির কম্পন সম্পূর্ণ থামেনি বটে, তবে যেটুকু আছে বাইরের লোকের চোখে পড়ার মতো নয়।

.

০২.

লাফ দিয়ে উঠল হাজি। খনে দু হাত দিয়ে কপালের রগ চেপে ধরে করুণ কণ্ঠে গোঙরায়, গেলুম, গেলুম, আমায় ধরে তো, পরমুহূর্তে দু হাতে বুক চেপে ধরে গভীর পরিতৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে বলে, আহ্ কী আরাম, এসো ক্ষুদিরাম।

শিপ্রা সোফাতে হাজির পাশের জায়গায় বসে মুচকি হেসে বললে, আমি একদম সোজা ঘোড়ার মুখ থেকে পাক্কায়েস্ট খবর পেয়েছি তা-ও যে-সে ঘোড়া নয়, উত্তম স্কচ জাতীয় হোয়াইট হর্স-এর মুখ থেকে, যে আপনি তিন বোতল হোয়াইট হর্স গেলার পরও ঘোরঘুটি অন্ধকারে পথ-বিপথ ঠাহর করে করে, কালোয় কালোয় বর্ডার ক্রস করতে পারেন। অতএব আপনি যে এই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রব্যগুণের প্রভাবে

বিষাদে হরিষ, ম্যাডাম হরিষে বিষাদ। এইমাত্র সেদিন আপনার আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা আগরতলাটা আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠল। চোখ কচলালুম, দু চোখ ভরে আরও দেখব বলে, চোখ খুলতেই দেখি, গোধূলির ম্লান আলো। আপনি গোধূলির ধূলি না ছুঁয়ে আপন ধুলো-পায়েই ফিরতি পথ ধরেছেন। হবে না বিষাদ? আর আপনার সঙ্গসুখের আনন্দটাও কি বেআইনি ক্ষণস্থায়ী।

কিন্তু এ বিষাদেও, হর্ষ না হোক, আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছি। উপস্থিত যা হাল তাতে গোটা পূর্ব-পাকিস্তান এবং লাগোয়া আগরতলা কোনও প্রাণীর পক্ষে স্বাস্থ্যকর তো নয়ই বরঞ্চ আয়ুক্ষয়, এমনকি বায়ু নির্বাপণেরও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত সম্ভাবনা আছে।

শিপ্রা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পূর্ব পাকের আগুন আগরতলাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই তো আপনার আশঙ্কা? তবে বউবাচ্চাদের কথা ভাবছেন না কেন? দিন না পাঠিয়ে আমার সঙ্গে। ভাই খান, তুমি একটা কসম খেয়ে তাকে ভরসা দাও, প্লিজ, যে আমার বাড়িতে ওদের স্থানাভাব হবে না, আদরযত্নের ক্রটি হবে না। আমার মনে হয় আপনি এবং বাদবাকি বিবাহিত পুরুষের ৯৯% বড্ড ইরেসপনসি– ওই বিষয়টায় অন্তত।

হাতজোড় করে হাজি বিনীত কণ্ঠে বললে, আমি করজোড়ে স্বীকার করছি দারা-পুত্র সম্বন্ধে কোনও প্রকারের দুর্ভাবনা আমার সুখনিদ্রাটিকে কোনও কালেই রত্তিভর জখম করতে পারেনি কিন্তু ওদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আমি দশ বছর পূর্বেই একটা ফৈসালা করে রেখেছি। অবশ্য সবই ভগবানের হাতে। কিন্তু ইতোমধ্যে অর্থাৎ আজ ভোরে আমি অতি বিশ্বস্ত সূত্রে একটা ভয়াবহ সংবাদ পেয়েছি। কাহিনীটি প্রাচীন ও দীর্ঘ; আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি।

ইয়েহিয়া চায়, ভারতে একটা ক্যুনাল রায়েট লাগুক।

কম্যুনাল রায়েটের জন্য উত্তর ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের জমিন সবসময়েই তৈরি। উত্তর ভারতের উগ্রতম পন্থি কিছু হিন্দু আছেন, যারা পাকিস্তানের বিনাশ চান, এবং ভারতের মুসলমানদের নিতান্ত দায় পড়ে সহ্য করেন। এঁরা এই ইচ্ছেটা প্রকাশ করেন পলিটিকসের মুখোশ পরিয়ে (পাকিস্তান তৈরি হয়ে যাওয়া মাত্রই ভারত আক্রমণ করবে; তার পূর্বেই আমাদের আক্রমণ করা উচিত) এবং নিজেদের মনগড়া এক আজব হিন্দুধর্মের ঝাণ্ডা তুলে। আমি পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে বলছি, তাঁরা যা প্রাণ চায় সে পলিটিক্স করুন, কিন্তু সনাতন ধর্মের এরকম নীচ অবমাননা যেন না করেন– ধর্মে সইবে না।

আর ভারতের প্রতি বিশেষ করে বহু বহু পাঞ্জাবিদের ঘৃণা, বিদ্বেষ, নফরত, শত্রুতা এমনই প্রচণ্ড যে তার কোনও তুলনা নেই। এদেরও একটা আজব মনগড়া ইসলাম আছে যে ইসলাম বলে, অমুসলমান মাত্রই কাফির এবং ভারতের কাফিরকুল তন্মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট অমানুষ। এদের কতল করা ইসলামের (তাদের মনগড়া ইসলামের) আদেশ– দোষী-নির্দোষী উভয়কে সমভাবে। এবং এদের স্ত্রীজাতিকে লুণ্ঠন করা সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত। পাঠানদের রক্তে-মজ্জায় থাকে সবচেয়ে বড় যে রিপু সেটা– লোভ, গৃধুতা ও তজ্জনিত তঙ্করবৃত্তি। কাফিরদের প্রতি তাদের ঘৃণা পাঞ্জাবিদের মতো রিফাইনড মিন নয়। ফলে পিণ্ডিতে যে কোনও সরকারই রাজত্ব করুন না কেন, ভারত-বিদ্বেষনীতি তারা অবলম্বন করতে বাধ্য, এবং গোপনে সোসাহে বিশেষ করে পাঠানদের আপ্যায়িত করেন এই বলে, দাঁড়াও না, দিল্লি লুণ্ঠন করার ব্যবস্থা শিগগিরই হচ্ছে।

উত্তর ভারতে কট্টর অখণ্ড পাকিস্তানপন্থি, যাদের সঙ্গে অন্য কারুরই তুলনা হয় না বেহারি মুসলমান। এদের এক প্রভাবশালী অংশ কলকাতায় বাস করেন। তাঁদের পাকিস্তান-প্রীতি চৌদ্দ আনা পরিমাণ নিতান্ত হীন স্বার্থবশত। তাদের ভাই-বেরাদর, একদা যারা, কবিদের মতো ঈষৎ অতিশয়োক্তি করে বলছি, পাটনা স্টেশনে কুলির কাজ করত আজ তারা পূর্ব বাঙলায় ট্রাফিক ম্যানেজার, রেলওয়ে সেক্রেটারি। বাইরে তারা উর্দু কথাবার্তা বলে খানদানি মনিষ্যিরূপে পরিচিত, ভিতরে বলেন, ভোজপুরি মঘি বা মৈথিলি। বিদ্যাপতি নিশ্চয়ই আপনার প্রিয় কবি; সে ভাষা যদি উর্দু হয় বদ্ধমানের পদী পিসির কোঁদলের ভাষাও তা হলে উর্দু। এই বেহারিদের অর্ধশিক্ষিত সম্প্রদায় উর্দুর কল্যাণে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে একজোট হয়ে পুব বাঙলাকে শুষছেন, হীনতম কলোনির মতো। এরা এবং বেহার ও কলকাতার বেহারিগণ সূচ্যগ্র পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন পূর্ব বাঙলাকে দিতে রাজি নয়। এরই ওপর নির্ভর করছে তাদের পাকিস্তান-প্রীতি।

শিপ্রা জিগ্যেস করলে, এরা পার্টিশনের সময় পশ্চিম পাকিস্তান গেল না কেন? সেখানে তো অন্তত শিক্ষিত পাঞ্জাবিরা উর্দু বলে, অশিক্ষিতেরাও অনেকখানি বোঝে। বাঙলায় এল কেন?

হাজি বললে, ওই তো সরল রহস্য, ভদ্রে। পশ্চিম পাকিস্তানে ওই সময়ে গেল উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি অঞ্চলের অনবদ্য উর্দুভাষী বিস্তর লোক। ওদের সামনে বেহারির উর্দু যেন রবীন্দ্রনাথের সামনে আমার কুমিল্লার খাজা বাঙলা! তদুপরি পাঞ্জাবিরাও রাইটলি অর রংলি দাবি করে তাদের উর্দু বেহারিদের উর্দুর চেয়ে বেহৃতর– যদিও লক্ষ্ণৌ দিল্লিবাসীদের মতে দুটোই একটা গাধার দুটো কান।

পুব বাঙলায় যেসব বেহারি আছে তারা পাঞ্জাবিদের চেয়ে নৃশংস পদ্ধতিতে লড়বে লীগের বিরুদ্ধে। পাঞ্জাবিরা অবস্থা মারাত্মক জানা মাত্রই ফিরে যাবে আপন দেশে, এরা যাবে কোথায়? দে হ্যাঁ বার্নট দ্যার বুল কার্টস।

এবং আছে আর একটা দল তামাম উত্তর ভারত জুড়ে। এবং পশ্চিম বাংলার মুসলমান বাঙালিও কিছু সংখ্যায় আছেন।

তিন কলকাতাগত জনের চোখের সামনে ভেসে উঠল মির্জার কুটিল মুখচ্ছবি।

তবে এদের অধিকাংশ মক্তব-মাদ্রাসার লোক।

ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই ধরনের মুসলমানদের পাকপ্রীতিও স্বার্থজাত। এরা ভাবে, কাল যদি ভারতে কমনাল রায়ট বাধে তবে আমরা যাব কোথায়? পুব বাঙলাই তো হাতের কাছে। সে-দেশটা যদি লীগের পন্থা অবলম্বন করে স্বাধীন হয়ে যায়, তবে তারা ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। তখন আমরা মুসলমান বলে তো কোনও আদর, প্রেফারেন্স পাব না। বেহারি মুসলমানরা আরও জানে, বাঙালি মুসলমান ভিতরের-বাইরের দু দল বেহারিকেই ধীরে ধীরে প্যাঁদাবে।

ইয়েহিয়া এজেন্ট জোগাড় করতে চায় এই পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাবিরোধী, অতএব পশ্চিম পাকপ্রেমী দল থেকে। এবং সবচেয়ে বেশি চায় কলকাতায়। কলকাতাবাসীর পয়সা আছে, তাদের পক্ষে পুব বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করা খুবই স্বাভাবিক। তাদের বিস্তর হিন্দু ইনটেলেকচুয়েল সর্বদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম মনেপ্রাণে সমর্থন করে। এই পশ্চিম বাঙালি সাহায্য করবেই করবে অন্তত ভাষা বাবদে তার বেরাদর পুব বাঙালিকে। বেতারযন্ত্রটা তার প্রধান অস্ত্র।

অতএব কলকাতায় একটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি করতেই হবে। এবং সেটা আখেরে সাম্প্রদায়িক রূপ নেবেই নেবে। অবশ্য চেষ্টাটা দিতে হবে তাবৎ ভারতে আগুন জ্বালাতে।

খান বলল, কলকাতায় এসেছেন ওই মন্ত্রধারী একটা আস্ত ঘুঘু। তার কথা তোমাকে বলিনি। নাম লারি

কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই হাজি হার হায় করছে আর মাথা থাবড়াচ্ছে। শেষটায় বলল, ওকে আমি চিনিনে? ব্যাটা কুমিল্লাতে এলে সুধা পান করে কেন্টনমেন্টে। আর আমার বাড়িতে। কিন্তু বেরাদর, ওকে আমি হাড়ে-হদ্দে চিনি। ব্যাটার কাছে পাকিস্তান হিন্দুস্তান মুসলমান কেরেস্থান সব বরাবর। মাত্র দুটি জিনিসের তরে সে সব করতে পারে। তার আপন স্বার্থের তরে। তার খাই প্রচণ্ড। মাতৃগর্ভে তার দাঁত ছিল না কেন, জানেন কীর্তিবাবু? মায়ের নাড়িভুড়ি খেয়ে ফেলত যে! সে চেনে দুটো জিনিস একটাও বলা যেতে পারে। রূপচাঁদ ঠাকুর– টাকা, টাকা; ওই দিয়ে মদ আর থাকগে। আপনি তো, কীর্তির্বাবু, গোঁড়া হিন্দু নন। ওকে দুইয়ে দিন কিঞ্চিৎ। টিকে গজিয়ে নামাবলি পরে না, বরঞ্চ তান্ত্রিক পন্থাই বেটা বেছে নেবে। ওর কথা অন্য মোকায় সবিস্তর বলবে।

শিপ্রার দিকে তাকিয়ে বললে, আমি জানি, ম্যাডাম, আমি জানি আপনার ডানার নিচে আমার বউবাচ্চা পাবে সর্বোত্তম প্রটেকশন। কিন্তু অপরাধ নেবেন না, দেবী, রায়টের সময় খুনখারাবি করে এ পাড়ার গুণ্ডা ও-পাড়ায় গিয়ে এবং ভাইস ভার্সা। এক দল অন্য দলকে লেটেষ্ট খবর দেয়, কার বাড়িতে সোনা দানা রুক্কা টাকা পাওয়া যাবে, কোন ব্যাচেলরের বাড়িতে পাওয়া যাবে না কিছুই। আমি রায়ট দেখেছি, ঢাকা-কলকাতা দুই শহরেই।

কিন্তু মুসলমান পুষেছেন এ কথাটা প্রকাশ পাবেই পাবে, এবং তখন হামলা হবেই হবে।

আপনার বাড়ি এমনিতে লুঠ হবে না। দারওয়ানের বন্দুক আছে, বরঞ্চ তার চেয়ে বেশি বন্দুক চালাবেন আপনি, জানি, বিলক্ষণ জানি। ফরাসিদের কাছ থেকে শুধু একাডেমিক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি শিখেছেন আর ওরা আপনাকে আত্মরক্ষার্থে যেটুকু প্রয়োজন বলতে কী তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি বন্দুক-পিস্তল চালাতে শেখায়নি সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আপনার ভিতর দক্ষতা আছে, নৈপুণ্য আছে। সেটা লক্ষ করার পরও? প্রকৃত হুনুরি, সত্যকার আর্টিস্ট– তা তার আর্ট বন্দুক চালানোই হোক, আর ছবি আঁকাই হোক– সে উপযুক্ত পাত্র পেলে তার ভিতর আপন ইনুর, সাধনালব্ধ সম্পদ রাখবেই রাখবে। ম্যাডাম যদি বলতেন যে ফরাসি আপাশ সম্প্রদায়ের গুনিন পকেটমারদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, তা হলে কার নামে কিরে কাটব?– আপনারই সুন্দর নামে কাটি– বিচক্ষণ ব্যক্তির যা সর্বথা করা উচিত, আমি তাই করলুম– গলা কাট্যা ফেলাইলেও মানিব্যাগটা এখানে আনতুম না।

সিরিয়াসলি বলছি, কলকাতাতে দাঙ্গা লাগার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

সে অবস্থায় গোটাকয়েক মুসলমানের জিন্মেদারি আপনার স্কন্ধে চাপাই কোন বিবেকহীন বুদ্ধিতে?

শিপ্রা বললে, এ আপনার আদিখ্যাতা। প্রত্যেক দাঙ্গায় কত মুসলমান কত হিন্দুকে বাঁচিয়েছে, কত হিন্দু কত মুসলমানের প্রাণ রক্ষা করেছে, হাজি সাহেব।

খান বললে, শিপ্রাদি, প্রথমেই আমার একটা নিবেদন আছে। সবাই আমাকে হাজি বলে ডাকে, ব্যঙ্গ করে। একে তো হজ করিনি, অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান বাবদেও আমি গাফিল। প্রতিবারে আমাকে হাজি নামে ডেকে হয়তো ওঁদের ওই ব্যঙ্গ করার পিছনে আছে তাদের সদিচ্ছা, আমি যেন ধর্মপথে চলি। অবশ্য, আল্লার ডাক শুনতে পেলে আমি কে, আমার ঘাড় তখন যাবে মক্কায়। কিন্তু আপনি আমাকে এ নামে ডাকবেন না।

শিপ্রা বললে, আচ্ছা ডাকব না। কিন্তু আমারও সদিচ্ছা হয় না, আপনি ধর্মপথে চলুন। আমার বিশ্বাস আপনার পথ ধর্মপথে গিয়ে মিশবে।

হাজি আবেগভরে বললে, আমেন, আমেন। তাই হোক তাই হোক। মূল কথায় ফিরে গিয়ে হাজি বলল, দাঙ্গার ভিতরও আল্লা তাঁর করুণা প্রকাশ করেছেন, যেমন আমার মতো অপদার্থও তার দয়া পেয়েছে।

কীর্তি : দেখুন হাজি, আমার সঙ্গে কম্পিট করতে যাব না। অপদার্থ বলতে বোঝয় কীর্তি রায়!

হাজি সবিনয়, দাদা বয়সে অজস্র হলেও এ ব্যাপারে আমি আপনার অনুজ, বিশ্বস্ত অনুগামী।…

প্রতি দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান যখন একে অন্যকে বাঁচায়– তখনই দেখি, প্রতিবার, মানুষের মনুষ্যত্ব। স্বার্থপর পলিটিশিয়ানের প্রপাগান্ডা উপেক্ষা করে, পথভ্রষ্ট ধর্মযাজকদের অনুশাসনে কান না দিয়ে, সশস্ত্র গুণ্ডাদের ভীতি প্রদর্শনকে তুড়ি মেরে মানুষকে তখন সত্যের পথে, আর্তজনকে রক্ষার পথে চালায় কে?– সে তার মনুষ্যত্ব। বললে পেত্যয় যাবে না কেউ, আমার মতো অপদার্থ–সরি পাষণ্ডের ভিতরও খুব সম্ভব ওই ধাতুটির একটি ক্ষুদ্রতম কণার ক্ষীণতম ছায়া অতি কালে-কস্মিনে চিলিক মেরে যায়– নইলে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনারা দোহাই মনুষ্যত্বের– এতকাল ধরে বউ আমাকে বরদাস্ত করছে কী করে? হুঃ। কিন্তু ওই লারি সম্প্রদায়ের ভিতর মনুষ্যত্বের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাকে বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে মেহনত আমার সয় না।

কিন্তু, ম্যাডাম, আমার প্ল্যানটা আপনার সামনে পেশ করি।

আগরতলা বিপন্ন হলেই আমি বউবাচ্চা নিয়ে চলে যাব, কিছুটা মোটরে বা পুরোটাই হেঁটে চলে যাব পার্বত্য ত্রিপুরা অঞ্চলে, যার উপর দিয়ে আপনি প্লেনে উড়ে এলেন– সেখানকার পাহাড়িদের সঙ্গে আমার বিস্তর ভাবসাব আছে। সেখানে এখনও প্রায় ফি-বছর যাই শিকারে। প্রথমযৌবনে মেয়েগুলোর সঙ্গে নেচেছি, এদের তৈরি নেটিভ বিয়ার বিস্তর খেয়েছি। ইয়েহিয়ার বাপের সাধ্য নেই সেখানে নাক গলায়। আর ওরাও কারও সাতেপাঁচে নেই। এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আমার কল্পনার বাইরে।

আর আপনার নিজস্ব, আপন কলকাতা তো আমার হাতের পাঁচ নো–পাঁচ কোটি রইলই।

কীর্তির দিকে তাকিয়ে বললে, কই কীর্তিবাবু এ অধম গাইড যেটুকু পারে সে তো দেখাল। এবারে পাকেচক্রে কলকাতায় এলে বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবেন তো?

কীর্তি কিছুমাত্র চিন্তা না করেই বললে, আল্লা করুন এবার যেন বাঙালরা পাঞ্জাবিদের হাইকোর্ট দেখিয়ে দেয়।

হাজি কার্পেটের উপর বসে পড়ে হাত দুটি উঁচু করে তুলে ধরল। আবেগভরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, আমেন, আমেন।

.

০৩.

স্পষ্ট মনে আছে শিপ্রার, বারটা ছিল বৃহস্পতি।

যে বেয়ারা বিকেলের চা নিয়ে এল তার চেহারা-ছবি ধরনধারণ দেখে শিপ্রার ধারণা হল লোকটা বোধহয় সিলেটি। শুধাল, তোমার দেশ কোথায়?

বেয়ারা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। শিপ্রার চেহারা, চাল-চলন, তার প্রসাধনের যে কটি কৌটো শিশি ড্রেসিংটেবিলে সাজানো ছিল সেগুলোর বাস বিলিতি টপ ঢং দেখে তার প্রত্যয় হয়েছিল, ইনি অতি খাঁটি মিসিবাবা, অর্থাৎ ইনি জানেন শুধু ইংরেজি, আর সে যে উর্দু-অহমিয়া-খাসিয়া-সিলেটি ভাষার লাবড়াকে হিন্দুস্তানি নামে চেনে, সেইটে বলতে পারেন চালে-কাঁকরে মিলিয়ে। তাঁর মুখে আচম্বিতে বিসুদ্দ বাঙলা ভাষা বেরিয়ে আসায় সে এমনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে যে তার মুখ থেকে, যেন রিলেক্স্ অ্যাকশনের মতো, বেরিয়ে গেল খাস সিলেটি, কিতা কইলা?

আদর করে শিপ্রা যে নামে ডাকে কীতা কখনও সে জুড়ে দেয় মিতা, এ কদিন দুশ্চিন্তার ভিতরে কবি এ শব্দের সঙ্গে যে মিল দিয়েছে তারই স্মরণে মনে মনে বলেছে, আমি কি বিস্মৃতা?

সিলেটি রহস্যময় কিতা শুনে তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল।

ইতোমধ্যে বেয়ারা নিজেকে সামলে নিয়ে হোটেলের ভদ্রস্থ হিন্দুস্তানিতে একাধিকবার বলেছে, সিলেটি, মেমসাহেব, সি মুলুক, মেমসাব।

তুমি মুসলমান? না?

জরুর জরুর। হাম্রা নাম শেখ গাত্ৰু, মেমসায়েব। মনে মনে দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে, এই মিসিবাটি নিশ্চয়ই কেরামতি জানেন নইলে কোন দূরের মুল্লুক থেকে এসেই তাকে দেখে ধরে ফেলেছেন, সে এদেশেরই লোক নয় এবং সে মুসলমান। এবারে শিপ্রা যে প্রশ্ন শুধাল তাতে তার বিস্ময় পৌঁছল চরমে। একমাত্র তার সহকর্মী দেশ-ভাইদের দু একজন তাকে তার জিন্দেগিতে মাত্র দু একবার শুধিয়েছে।

এখনও কি মহরম মাস চলছে?

এর সঠিক নির্ভুল উত্তর শ্ৰৈহট্ট অর্থাৎ শ্রীহট্ট, সিলেট-সন্তান গা মিঞার দেওয়া সম্ভবপর নয়। অবশ্য মহরমের শুক্লা দশমীতে (হিন্দু গণনায় একাদশী বা দ্বাদশী) হয়ে গেল মহরমের পরব– তাজিয়া তাবুদের প্রসেশনসহ। তার পর যে কটা দিন গেছে সেটা গুনে যোগ করলেই মহরমের ক তারিখ, না পরের মাস সফর শুরু হয়ে গেছে ধরা পড়ে যায়। অবশ্য মিয়া গাফ্র কটা দিন গেছে আঙুল গুনে মোটামুটি খবরটা দিতে পারত কিন্তু এহেন বিদ্যাধরী মিসিবাবা যিনি কি না মহরম যে সুদু একটা পরব নয়, মাসও বটে, সে হেন খাস ইসলামি খবর রাখেন তাকে তো উল্টোপাল্টা মাস তারিখ দেওয়া সৎ গুনাহ্ হবে।

হন্তদন্ত হয়ে বললে, আমাদের মোল্লাজি বেয়ারাদের ঘরে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে ইসলামি পঞ্জিকা এখুনি নিয়ে আসছি। সব খবর পাবেন। হঠাৎ তার মনে ধোকা লাগল : এনা খানদানি মিসিবাবা, ইনি বাঙলা, না হয় বাঙলা বলতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন কি? সভয়ে প্রশ্নটা শুধাল। শিপ্রা ঘাড়টি সামান্য বেঁকিয়ে মুচকি হাসল। গোস্তকির বিস্তর মাফ চেয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটল পাঁজি আনতে।

যবে থেকে শিপ্রা শিলঙ পৌঁছেছে সেই থেকে কীর্তি বা খানের কোনও খবর না পেয়ে আস্তে আস্তে সে অধীর হয়ে উঠেছে। এখন শঙ্কার চৌকাঠে পা দিয়েছে। ঘরের ভিতর ভীতি, বিভীষিকা।

সব কটা খবরের কাগজ লাইন-বাই-লাইন পড়েছে। সেগুলো এমনি বিস্ফোরক উত্তেজনায় ভরা যে সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয় পাছে না একটুখানি খোঁচা খেলেই বোমার মতো ফেটে ওঠে। ওদিকে বিটউইন দি লাইন্স্ পড়ে শিপ্রা ঠিক বুঝে ফেলে, অন্তত আগরতলা থেকে পাঠানো সংবাদ হয় অতিরঞ্জিত, নয় মৌনগুঞ্জিত। হাজি, মিঞাসাহেব–

মিঞাসাহেবের নাম মনে আসতেই সে যেন তাঁর শেষ কথা কটি আবার শুনতে পেল। ডিনার শেষে, গভীর রাত্রে, খাস করে তার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় একমাত্র তাকেই বলেছিলেন, যেন তাকে খানিকটে আশ্বস্ত করার জন্য, কিংবা পরিস্থিতির যে ছবিটা তর্কাতর্কি, লেটেস্ট সংবাদের অদলবদলের রঙ দিয়ে নিমন্ত্রিতেরা এঁকেছিলেন সেটাতে একটা অংশ ফাঁকা রয়ে গিয়েছে সেই ব্যক্তিনিরপেক্ষ তত্ত্বটির দিকে শিপ্রার নিছক দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য : পবিত্র মহরম মাসে কি কট্টর শিয়া ইয়েহিয়া খুন-খারাবি আরম্ভ করবে?

সেই গম্ভীর ইঙ্গিতভরা প্রশ্নরূপে প্রকাশিত তত্ত্বকথাটি শিপ্রার মনে আসতেই শিপ্রা কেমন যেন এক রকমের অকারণ অস্বস্তি অনুভব করেছিল। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে, এখনও মহরমের মাস চলছে কি? তাই চোখের সামনে যে পড়েছে তাকেই প্রশ্নটা জিগ্যেস করেছে।

হায় রে প্রখরা বুদ্ধিমতী রমণী শিপ্রা! তুমি সমস্ত প্রাণমন দিয়ে কামনা করছ, যে গ্রহনক্ষত্র বিশেষ করে শশীকলা লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে অলঙ্ নিয়মে যে বেগে চলেছে, পূর্ণিমা-অমাবস্যা এসেছে-গিয়েছে, এদের গতিবেগ যেন অকস্মাৎ মন্থর হয়ে যায়, এই মহরম মাসটা যেন বিলম্বিত হতে বিলম্বিততর হয়ে, ২৯/৩০ দিনের পরিবর্তে ২৯/৩০ মাস ধরে চলে। শুধু তার প্রিয়, তার বল্লভ কীর্তির চতুর্দিকে দাবানলের প্রজ্বলন নিরুদ্ধ করার জন্য। তার ফলে কার কীই-বা ক্ষতি হত? স্বয়ং যে রাজার রাজা মহারাজার কনিষ্ঠা-ইঙ্গিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে চলেছে তারই-বা কী ক্ষতি হত? তাই তো। হঠাৎ তার মনে এল একটি গীত। তারই এক বাল্যসখা উভয়ের কৈশোরে এ গীতটি তাকে উপহার দিয়েছিল। কবিতাটি শিপ্রা ছাপাতে কখনও দেখেনি কারণ কবিও বাংলা সাহিত্যে কণামাত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি। বাইবেলে বর্ণিত কিশোরী তার বল্লভের সন্ধানে যেরকম দোরে দোরে ঘা দিয়ে নিরাশ হয়েছিল, এ গীতি যে কাগজে লেখা সে-ও বহু সম্পাদকের টেবিলের উপর ফ্যানের হাওয়াতে কাঁপতে কাঁপতে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। এমনকি তার প্রিয়া কালী পেঁচির দৃষ্টিও না।

মহরম দীর্ঘতর হলে সৃষ্টিকর্তার কীই-বা হত ক্ষতি। গানটার মোতিফ ছিল একই :

কী বা হত তোমার, রাজা,
একটু মোরে দিলে?
কীই বা ক্ষতি হত কাহার
বিরাট এ নিখিলে?
তোমার বিশ্ব বসুন্ধরা
অনন্ত বৈভবে ভরা;
কণাটুকু যেত না তো।
করুণা বর্ষিলে।

চন্দ্র সূর্য গ্রহে গ্রহে।
সাজাও আলিম্পন
তারায় তারায় বাঁধো, তুমি
অলখ আলিঙ্গন।
তোমার এ যে পূর্ণ ছবি।
মিথ্যা হত এর কী সব-ই।
প্রিয়ার চোখে আমার চোখে
যদি যেত মিলে।

শিপ্রার মনে আছে, কবিতা বা কবি কারওরই চোখের সামনে সেই ধুমসীর চোখ মেলেনি। অথচ আখেরে এ লক্ষ্মীছাড়িটা বিধির বিধানে পেয়েছিল কলাগাছ যে রকম কার্তিককে পায়। এবং সে ছোঁড়া ছিল কুবের কুলের পিদিম! বিধির অধর্ম কি কোনওদিন বিধির বিধি কোনও সর্বেশ্বর বিচার করবেন না? প্রলয়শেষে কিয়ামতের দিনে?

যখন কবিতাটি শিপ্রা প্রথমে পড়ে তখন মনে হয়েছিল এটা ইন্টার ক্লাস। তবু এক একটা নিতান্ত বাজে সুর যেরকম মানুষের পিছনে অষ্টপ্রহর লেগে থাকে, তাকে হট করে এটাও করেছিল তাই। সেই মেয়েটা এবং একঝাঁক সম্পাদকের এই কাব্যের উপেক্ষিতাকে আজ শিপ্রা–কবিগুরু যেরকম ঊর্মিলাকে তাঁর করুণাধারা দিয়ে অভিষিক্ত করেছিলেন সেইরকমই কবিতাটিকে তার হৃদয়-আসনে বসাল।

হঠাৎ ওই অনবদ্য প্রবন্ধটির আরেকটি অংশ স্মরণে আসতে তার সর্বচৈতন্য বিকল হয়ে গেল। অবশ্য শুধু ভাবার্থটুকু। শব্দে শব্দে আছে :

সলজ্জ নবপ্রেমে আমোদিত বিকচোখ হৃদয়-মুকুলটি লইয়া স্বামীর সহিত যখন প্রথমতম মধুরতম পরিচয়ের আরম্ভ সময় সেই মুহূর্তে লক্ষ্মণ… বনে গমন করিলেন!

কিছুতেই মনে আনতে পারল না শিপ্রা, আর্যপুত্র ঊর্মিলাবিলাসী বনগমনের পূর্বে কয়দিন নববধূ নির্জনে সঙ্গোপনে একান্ত আপন ভাবে আর্যপুত্রকে কণ্ঠাশ্লেষে আবদ্ধ রাখার অবসর পেয়েছিল। সে তুলনায় শিপ্রা কদিনের তরে কীর্তিকে? আর এখন সে কোথায়, কোন অবস্থায়।

চিন্তাধারা শিলাখণ্ডে বাধা পেল। ভালোই হল। জানালা দিয়ে দেখতে পেল, ঝঞ্ঝা-তাড়িত মেঘদূতের ন্যায় পবনবেগে আসছে গাব্ৰু শেখ। হাতে ঢাউস একখানা কেতাব, মুখে বিস্তৃত হাসি।

সাইজে এক্কেবারে যেন শুণ্ডপ্রেস পঞ্জিকা। ভিতরে ওই মতো ফুলকপি মুলোর বিজ্ঞাপন, এবং মুসলমান ধর্মের আচার অনুষ্ঠান, পালপরবের সবিস্তর বর্ণন। তার বিস্তর শব্দ তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং কোটেশনগুলো যে কোন ভাষা থেকে নেওয়া সে সম্বন্ধে তার সামান্যতম ধারণা নেই। এই বিরাট দণ্ডকারণ্যে কোথায় মহরমের সন্ধান? হঠাৎ লক্ষ করল পঞ্জিকার এক্কেবারে শেষপ্রান্তে ময়ূরপালকের বুক মার্ক সামান্য একটুখানি বেরিয়ে আছে। সেখানে কেতাব খুলতেই চোখে পড়ল আধপাতা জুড়ে বাংলা, মুসলমানি, শক, ইংরেজি, বিক্রম বহু অব্দের তারিখ গয়রহ দেওয়া আছে। হ্যাঁ, ২৫শে মার্চ, এখনও মহরম, থ্যাঙ্ক গড়।

মহরম মাসে শিয়া ইয়েহিয়া খুন-খারাবি করতে ইতস্তত করতে পারে। সেই নিছক চোরাবালির অনুমানের ওপর, দ্যাখ তো না দ্যাখ, শিপ্রা গড়ে তুলল, ইয়াব্বড়া পর্বতপ্রমাণ দেউল– কোণারকের মন্দির। যে খায় চিনি তারে যোগায় চিন্তামণি। সে চিনির তলায় ফাটা সাকি আছে, না মিং বংশীয় সর্বোৎকৃষ্ট পর্সেলিন– কোন মূর্খ করে তার বিচার?

বেয়ারা এতক্ষণে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে। শিলঙ শহরে বারো আনা লোকের মুখ চিন্তাকুল। এদের সক্কলেরই কেউ না কেউ আছে– সিলেট, কুমিল্লাদিতে। এই সর্বব্যাপী দুশ্চিন্তা উপস্থিত অন্য কোনও দুর্ভাবনাকে আমল দিচ্ছে না। মেমসায়েবের মুখে দুশ্চিন্তার আভাস সুস্পষ্ট। রিসেপশনিস্টের কাছে শুনেছে তিনি ডাক, তারের জন্য ব্যাকুল। অতএব তারই মতো অবশ্যই মেমসায়েবের কেউ না কেউ পুব-পাকে আছে। আপন অজানাতেই যেন মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেল, মেমসায়েব, আপনার পোশ কুটুম কি কেউ পাকিস্তানে আছে? সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি বার বার আপন বে-আদবির জন্য মাফ চাইল। শিপ্রা তার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, এতে মাফ চাইবার কী আছে! তোমার দিলে দরদ আছে। তাই শুধিয়েছ।

গাব্রু মিঞা কী করে শিপ্রাকে চিনবে? সে বেচারী চেনে দুই জাতের মেমসায়েব। চা-বাগানের ইংরেজের স্ত্রী মেমসায়েব এবং তাদের অনুকরণে গড়া দিশি মেমসায়েব। এ দু জাত দূরে থাক সে কোনও জাতেরই মেমসায়েব, গিন্নিমা, বেগম সায়েব কিছুই নয়। বিধাতা তাকে কোন কোন ধাতু দিয়ে নির্মাণ করেছেন, পঞ্চভূতের মশলা মেশাবার সময় যে-তৃতীয়টি তেজ প্রচুর পরিমাণে ঢেলেছেন– সে বিষয়ে অবশ্য কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই, সর্বোপরি তার স্বাধ্যায়, একাধিক। সমাজ-দেশের সঙ্গে তার কুণ্ঠাহীন হৃদ্যতা, তার বিচিত্র বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা তার জীবনদর্শন- এসব মিলিয়ে যে শিপ্রা, তাকে বিশ্লেষণ করবে কে? যার নির্মাণ, যার জীবন শিপ্রার চেয়েও বিচিত্র বৈভবে ভরা সে-ই তো? সে কোথায়? তবে কি না, ভালোবাসার সোনার কাঠির পরশ যার প্রাণে লেগেছে সে হয়তো পারে। কীর্তি হয়তো একদিন পারবে।

শিপ্রা বললে, আমার দুই আপনজন আগরতলায়।

এর উত্তরে গাব্রু যে মন্তব্য করেছিল তার জন্য সে মনে মনে নিজের গাল দুটোকে অকাতরে চড় মেরেছে। মোল্লাজির কাছে কাদো কাঁদো হয়ে সে-কাহিনী যখন শোনাল তখন তিনি মনে মনে না– সশব্দে তার দু গালে দুটো চড় কষিয়েছিলেন। একসারি কটু শব্দ বলে গিয়েছিলেন অল্পশিক্ষিত মোল্লাজি তার গুরুর কাছে যেগুলো শুনেছিলেন– আরবি ফারসি উর্দু, সিলেটি ভাষা-উপভাষায়, আহম্মক, নাদান, উলুকে পাট্টা থেকে সিলেটি আচাভুয়া হুমাভুতা পর্যন্ত।

গাব্রু সরাসরি অজানতে বলে ফেলেছিল, আখাউড়া আগরতলা তো বরাবর।

বলতে না বলতেই সে বুঝতে পেরেছিল, কী সর্বনেশে কথা কটি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। রাখালের মাসি যেরকম বুঝেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করেছে, মিসিবাবার মুখ যেন মলিন হয়ে গেল।

গাব্রু প্রথমটায় ছুট লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু থেমে গেল। একখানা আধা সেলাম অসমাপ্ত রেখে ধীরে ধীরে কোয়ার্টারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রাত্রে খাবার নিয়ে এল অন্য বেয়ারা। শিপ্রা শুধাল, সে বেয়ারার কী হল? আমি জানতে চেয়েছিলুম, সিলেটের খবর ঠিকমতো পায় কি না, তার পরিবার

এ বেয়ারা বৃদ্ধ, বহুদর্শী, নানা গেস্টের বহু উনুনে পোড় খেয়ে খেয়ে সে ঝামা হয়ে গিয়েছে। সে পর্যন্ত কুল্লে কায়দাকানুন ভুলে গিয়ে দু হাত দিয়ে হঠাৎ চোখমুখ ঢেকে ফেলল।

শিপ্রার প্রশ্নটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। কী হল– বলতে গিয়ে থেমে গেল। বুড়ো নিঃশব্দে কাঁদছে– তার দু হাতের কাঁপন থেকে বোঝা যাচ্ছে।

বুড়োকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিয়ে শিপ্রা বলল, যাও তো মিঞা, মুখ ধুয়ে আসবার সময় মাস্টার্ড নিয়ে এসো।

মাস্টার্ডের কোনও প্রয়োজন ছিল না শিপ্রার। তার মাথার ভিতর একসঙ্গে বহু চিন্তা লড়ালড়ি করছে। কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরই সে কিছুটা শান্ত হয়ে কিছুটা মনস্থির করে ফেলেছে।

বুড়ো ফিরে এল।

শিপ্রা শুধাল, মিঞা তুমি নামাজ পড়ো?

জি মেমসায়েব।

রোজা রাখো।

জি, হ্যাঁ।

আচ্ছা তবে শোনো। এ সব তো করো আল্লার হুকুমে? না? আমি বুঝতে পেরেছি। তুমিও সিলেটি, তোমার বাল্-বাচ্চাও সেখানে? না?

বুড়ো ঘাড় নাড়ল।

তা হলে এবারে ভালো করে শোনো। সমস্ত জীবন ধরে নামাজ-রোজা সব করলে আল্লার হুকুমে। তার ওপর নিশ্চয়ই তোমার ভরসা ছিল, নইলে হুকুম মানলে কেন? তুমি আমার বাপের বয়েসী। অবশ্যই তোমার মাথার ওপর দিয়ে বহুত ঝড়-তুফান গিয়েছে। তারই ওপর ভরসা রেখে এসব বিপদ-আপদ কাটিয়েছ। এখন এই শেষ বয়সে সে ভরসা কম-জোর হয়ে গেল? তুমি ভেঙে পড়লে ওই অল্প-বয়সী বেয়ারাটাকে হিম্মত যোগাবে কে? উপরে মালিক সব দেখছেন।

আমার হাল তবে এবারে শোনো। আমি এখানে একা। তোমাদের তিনজন, ম্যানেজার-ট্যানেজার ওরা কাজের লোক, আপন কাজ নিয়ে থাকেন। ব্যস্। আমি মেয়েছেলে। আমার এক দোস্ত, আরেকজন তাকে আমি মহব্বত করি দুজনা আটকা পড়েছে আগরতলায়। হয়তো-বা বেরিয়ে আসতে পারবে, হয়তো-বা পারবে না। আমার বাপ নেই, ভাই নেই। এবারে যাও, মিয়া, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আর ওই আহাম্মক ছোকরাটাকে বল, সক্কলেরই দিল এখন কাতর। সে কী বলেছে, না বলেছে। তাতে কী যায়-আসে? ভাবনা বাড়বে? কমবে? তার কথায়? এখন যাও।

এই যে আল্লার নাম নিয়ে শিপ্রা বুড়োকে শান্ত করল সে নিজে কি ঈশ্বর মানে?

আর বহুলোকের মতো শিপ্রা ছিল ধর্ম বাবদে মোটামুটি উদাসীন। প্যারিসে টুরিসট গাইড তাকে সুদু একপাল মার্কিনকে নিয়ে গিয়েছিল বিরাট এক গির্জা দেখাতে। গির্জা তখন ফাঁকা। শিপ্রা বেরুবার সময় গাইডকে বলল, চমৎকার! ফুলদানিটা অতি সুন্দর। কিন্তু ফুল কোথায়? মানুষ উপাসনা করছে সে-ই তো গির্জার ফুল। তার পর সে মাঝে মাঝে গির্জায় যেত উপাসনার সময়। বিশেষ করে মমারৎর-এ পুরো শনির রাত হৈ-হুঁল্লোড় করে রবির ভোরে বাড়ি ফেরার মুখে। ক্যাথলিক গির্জার অর্গেন সঙ্গীত ধ্বনি-লোকের অপূর্ব গম্ভীর যেন বিরাট সিন্ধু। হাড়-পাকা নাস্তিকও সে সঙ্গীতে অবগাহন করে। পেচি নাস্তিক ওই সঙ্গীতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে গির্জাঘর এড়িয়ে চলে। শিপ্রার ভয় নেই, ভরসাও নেই।

একদা এক প্যারিসিনী তাকে শুধিয়েছিল, সে ঈশ্বর-বিশ্বাসী কি না?

যেন শব্দগুলো বাছাই করে করে শিপ্রা বলেছিল, ভগবান বাজারে বিক্রির রেডিমেড টমাটো কেচাপ নন– কিনে নিয়ে ব্যাগে পুরলেই হল। সমস্ত জীবন ধরে তাকে উপলব্ধি করতে হয়। অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।

রোদন-ক্রন্দনের বিকৃত মুখ, দুশ্চিন্তার শোকে ভেঙে পড়ার বিকট ভঙ্গি শিপ্রা আগেও দেখেছে। কিন্তু আজকের মতো নয়।

কীর্তির সর্বাঙ্গ কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর্লোকের আকস্মিক পরিবর্তন শিপ্রার কাছে এক মুহূর্তে সরল স্বচ্ছ হয়ে গেল নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে রকম আগের দিনের কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান পেয়ে যায়।

শিপ্রা কোচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কটেজ ছেড়ে সুস্থ গতিতে হোটেলের মেন বিল্ডিঙে গিয়ে দাঁড়াল রিসেপশনিস্টের মুখোমুখি হয়ে। স্মিত হাস্য দিয়ে আপ্যায়িত করল গুড ইভনিং সহ। পুনরায় গুড় ইভনিং– এয়া-এর–

হন্তদন্ত হয়ে ছোকরা বললে, সরি, মিস রে– আমাকে উইলস বলে ডাকে সবাই জিমি উইলসন।

ছোকরা হকচকিয়ে গিয়েছে। এতদিন দু চারবার শিপ্রাকে যখনই দেখেছে, তখনই তার মনে হয়েছে, ইনি অন্যলোকের প্রাণী। আজ রাত এগারোটায় সেই নিরাসক্তা, গম্ভীরা এ কী রূপে দিল দরশন! তার মন বলছে, হাউ লাভলি! হাউ সুইট।

শিপ্রা সহজ সুরে শুধাল, এনি নিউজ?

আসলে এতদিন সে কোনও রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলেনি- পাছে কোনও অপ্রিয় গুজব, সংবাদ, ওয়ার্নিং ওরা দিয়ে ফেলে। বিশ্বময় ওই গোত্রের কর্মচারী অর্থাৎ রিসেপশনিস্টদের চোদ্দ আনা চ্যাটারবকস।

ছোকরা কাউন্টারের উপর একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললে– যদিও স্থানটা জনশূন্য উয়েল মিস রে, বলব কি বলব না, বুঝতে পারছিনে। আমার এক বন্ধু আছে এখানকার ট্রাঙ্ক-কল দফতরে। ওরা অনেক কিছু শুনতে পায়। এখখুনি সে আমায় ফোন করেছিল। তারই মতো আরেক ট্রাঙ্ককর্মী শুনতে পেয়েছে ইন্ডো-পাক বর্ডারের গারো না ডাউঁকি না যশোর কোথা থেকে কে যেন কাকে ট্রাঙ্ক-কল-এ বলেছে, আজ রাত্রেই নাকি ঢাকাতে ট্রাবৃল আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। তা, তা, মিস রে, সে-ও যে খুব শ্যোর শুনেছে তা নয়।

গুজব হোক, খবর হো এইটেই যদি সে ঘণ্টাটাক পূর্বে শুনতে পেত তবে আপাদমস্তক মুষড়ে পড়ত। কিন্তু এখন তার বুকের ভিতর কে যেন একখানা টিন প্লেট বসিয়ে দিয়েছে।

স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধাল, আর যশোর, কুমিল্লা, বাদবাকি বর্ডার?

ছোকরা উত্তর দিল, আজ, এখখুনি, তো আর কিছু বলেনি। তার পর খানিকক্ষণ ঘাড় চুলকে বললে, কিন্তু দিন পাঁচেক আগে বলেছিল, গোলমাল লাগলে সব জায়গায় একসঙ্গেই লাগবে। তবে সে শ্যোর ছিল না এটো। এখন কে শ্যোর হয়ে কী বলতে পারে?

শিপ্রা হাঁটুর কাছে কেমন যেন একটা দুর্বলতা অনুভব করল।

খানিকক্ষণ না জানি কোন দেবতার কৃপায় তার দুশ্চিন্তা-বর্ষার অবিরল বারিধারা সম্পূর্ণ থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তার পরের ইলশেগুঁড়ি ক্ষণে আসে ক্ষণে যায়। তারই স্বচ্ছ যবনিকা যেন নেমে এল তার বুকের ভিতর।

তবু মুখে হাসির ক্ষীণ পরশ লাগিয়ে বললে, তোমার কথা খাঁটি, উইলসন। সব-কথা বিশ্বাস করলে কি আর মানুষ বাঁচতে পারে? থ্যাঙ্কয়ু, অল্ দ্য সেম। গুড নাইট শিপ্রা মনে মনে বললে, ছেলেটি দরদি, লক্ষ করল তার বুশ শার্টের বুকের কাটে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ক্ৰস্। বললে, মাদার মেরি, তোমার মঙ্গল করুন। গুড নাইট ওলড ম্যান।

জিমি যদিও ছোকরা বেয়ারারের মতো ওরকম খুনিয়া ফো পা অর্থাৎ সাপের ন্যাজ মাড়ায়নি তবু শিপ্রার ভাব পরিবর্তন থেকে আমেজ করতে পেরেছিল সে বেসুরো কর্কশধ্বনি ছেড়ে বসেছে। এক ফো পা মেরামত করতে গিয়ে দুসরা কদম খাদে ফেলল না। কাউন্টার ঘুরে শিপ্রার পাশে পাশে, কিন্তু সম্মানার্থে আধ কদম পিছনে পা ফেলে তাকে কটেজে পৌঁছিয়ে দিতে সঙ্গে চলল। যেতে যেতে বলল, মাদার মেরি হেভেন্ আর্থের কুইন মেরি! তাকে আমার স্মরণে আনি আর নাই আনি, তাঁর করুণাধারা কখনও ক্ষান্ত হবে না।

শিপ্রা মৃদু কণ্ঠে দরদভরে বলল, আমেন।

সঙ্গে সঙ্গে বহুদিনের অনভ্যাস সত্ত্বেও, ফরাসিদেশের আর পাঁচজনের মতো অজানতেই ডান হাত দিয়ে বুকের উপর ক্রসচিহ্নের প্রতীক দেখাল।

উইলসন একটু লজ্জা পেল। বিধর্মী পালন করল সেই আচার– সে যেটা সমাজে পাঁচজনের অযথা দৃষ্টি আকর্ষণ না করার জন্য আপন সমাজের বাইরে এড়িয়ে যেত। কটেজের সামনে পৌঁছে বলল, গুড নাইট, ম্যাডাম। এনি থিং এলস্ আর কিছু?

এই অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতেও তার মনে পড়ল– প্রাচীন স্মৃতি নবীন পরিস্থিতির বিনা অনুমতিতেই উদয় হয় প্যারিসের রেস্তোরাঁতে ওয়েটার খানা অর্ডার দুফে দফে শেষ হওয়ার পর যখন জিগ্যেস করত, এনি থিং এলস্ মাদাম তখন তাদের মধ্যে বেপরোয়া মেয়ে বলে উঠত, হ্যাঁ, তোমার প্রেম!

শিপ্রা বললে, থ্যাঙ্ক ইউ, গুড নাইট, ইয়াং ম্যান্। মা মেরি তোমার মঙ্গল করুন।

কুটিরে ঢুকে শিপ্রা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভুলে গিয়েছে এর পর কী করতে হবে, তার পর কী, শুয়ে পড়বার আগে। মাথাটা যেন ভেকুয়াম। এবং সে বোধশক্তিও নেই। হাতমুখ ধোয়া, কাপড় ছাড়া, এসব নিত্য রাতের যান্ত্রিক রীতি– তবু–

এমন সময় কাঠের বারান্দায় দুমদাম করে পায়ের শব্দ হল। ছুটে আসছে কেউ। হঠাৎ একেবারে চুপ। আস্তে আস্তে দোরে টোকা। মৃদু কণ্ঠে মাদাম, টেলিগ্রাম।

তার হাত কেঁপেছিল কি না, পরে স্মরণ করতে পারেনি। শুধু একসপেরিমেন্ট করে দেখেছিল বারান্দার ক্ষীণালোকে টেলিগ্রামটা পড়া যায় কি না। তখন কিন্তু পেরেছিল।

বেচারা জিমি ঠায় দাঁড়িয়ে।

যেই দেখল, শিপ্রার মুখে হাসি ফুটেছে, ভদ্র হোটেলের বেবাক এটিকেট ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গুড় নিউজ, ম্যাডাম?

থ্যাঙ্কু। হ্যাঁ। জিমির তিন লম্ফে পলায়ন।

শিলচর থেকে তার। সাতাশ তারিখে পৌঁছাচ্ছি। কী খান।

.

০৪.

শিলঙকে বলা হয়, হিল স্টেশনের রানি– রাজা কে? দার্জিলিং

রবীন্দ্রনাথ দুটো তুলনা করেছেন অতিশয় সঙ্কীর্ণ পরিসরে :

দার্জিলিঙের তুলনাতে ঠাণ্ডা হেথায় কম হবে,
একটা খদর চাদর হলেই শীত-ভাঙানো সম্ভবে।

কিন্তু দার্জিলিঙের সঙ্গে তুলনা না করে তার পর শিলঙের যে-বর্ণনা দিয়েছেন তাতে শিলঙের প্রায় কোনও মাধুরিমাই বাদ পড়েনি। যে পাইন বন শহরে পৌঁছুবার বহু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় সেটাই শিলঙের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। রবীন্দ্র কবিতাতে দু দুবার তার উল্লেখ করেছেন।

খুব ভোরেই শিপ্রার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এই পাইন বনের অকল্যাণে বিশেষ করে যেখানে বনটা নিবিড় ঘন– কবি বর্ণিত :

এখানে খুব লাগল ভালো গাছের ফাঁকে চন্দ্রোদয় সেই চন্দ্রোদয়, সূর্যোদয় শিলঙের বহু জায়গা থেকেই দেখা যায় না। তাই শিপ্রার চোখে পড়েছে, অনেকক্ষণ ধরে ঘন পাইনবনের ছাঁকনির ভিতর দিয়ে গলে আসা প্রদোষের আধ-আলোর কেমন যেন সবুজ সবুজ ভেজা ভেজা রেশের পরশ। কিন্তু কানে আসছিল যে–

বাতাস কেবল ঘুরে বেড়ায় পাইন বনের পল্লবে।

তারই ক্ষীণ ঝিরঝির মধুর, যেন কুচিৎ জাগরিত বিহঙ্গ-কাকলি। শিপ্রা কিন্তু পূর্ণ জাগরিত। নিত্য ঊষায় তার সদভ্যাস– প্রথম আলোর চরণধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সে প্রথম পদক্ষেপ করে শয্যা থেকে ভূমিতে কলকাতায় শেষের দু ভোরে করেছে পাদপীঠ পরে। কীর্তি সোনালি-নীলের গালায় আঁকা, ঢেউ খেলানো পা-ওলা বর্মা দেশের একটি পাদপীঠ তার অজানতে একদিন চুপিসাড়ে রেখে গেছে।

বেদনার উত্তেজনাতে মানুষ তবু কিছুটা কাজকর্ম করতে পারে, কিন্তু নির্ভাবনার প্রশান্তি আনে অবসাদ।

ছোট্ট জানালাটির শার্সির ভিতর দিয়ে সে তাকিয়ে আছে মাঝারি পাইনের শীর্ষ পল্লবের মৃদু আন্দোলনের দিকে, আর হেথা হোথা টুকরো টুকরো নীলাকাশের পানে। ততখানি উপরে উঠতে দেবতার ঢের সময় লাগে। টিলার সানুদেশ পাইনপাতার ছুঁচে আবরিত। এখানে-ওখানে সূর্যরশ্মির গোম্পদ। চিকচিক করে তার পিচ্ছিলতা। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন একটা সঁতসেঁতে ভাব মনটাকে প্রফুল্ল করে তোলে না।… একটি খাসিয়া মেয়ে পিছলে পাইনপাতার উপর পা টিপে টিপে সন্তর্পণে পাহাড়ে চড়ছে। মাঝে মাঝে পিছন পানে তাকাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে ওদিকে? ওখানে কাঠ কাটতে দেয় না। একটা ছোকরা এসে নিচের রাস্তা থেকে ডাকল ওকে। মেয়েটা কিছু উত্তর না দিয়ে সন্তর্পণতা বর্জন করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল উপরের দিকে। কীই-বা করে ছোঁড়াটা! সে-ও ছুটল পিছনে। দুজনাই অদৃশ্য। অনেকক্ষণ পর নেমে এল দুজনা, হাত ধরাধরি করে, কিন্তু রাস্তায় নেমে একে অন্যের হাত ছেড়ে দিল। শিপ্রার মনে হল এদের রস আছে– নইলে এত সকালে লুকোচুরি খেলা!

বেয়ারা ভোরের চা নিয়ে এল। শিপ্রা বিছানা থেকেই বলল, বাইরের ঘরে রেখে যাও। সে সুসংবাদ পেয়েছে, ওকে মুখ দেখায় কী করে। কবির বিনু ছিল কমবয়সী তার চিত্তে উদয় হয়েছিল ভাব, বিশ্বসংসারের দুঃখ না ঘোচাতে পারলে তার সেই হঠাৎ-পাওয়া আপন আনন্দ সম্পূর্ণ হবে না। শিপ্রার সে সাধ হওয়ার কথা নয়, তবু চেনা জনের দুশ্চিন্তা, তার সামনে বেরোয় কোন মুখে।

আবার দুমদাম শব্দের সঙ্গে নিস্তব্ধতা, টোকা, কাম ইন্।

তিনবার গুড মর্নিং বলার পর উত্তেজনায় ফেটে চৌচির জিমি একরাশ খবর দিল। সেগুলো সংগ্রহ করেছে, কিছুটা বেতার থেকে, কিছু ট্রাঙ্কতারের বন্ধুর কাছ থেকে, কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সবজান্তাদের ফোন করে, ফোন পেয়ে।

সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান সংবাদ। ঢাকায় কাল রাত থেকে লেগে গেছে ধুন্ধুমার। অন্য কোন কোন জায়গায় সে খবর সঠিক কেউ বলতে পারেনি তবে খুব সম্ভব সব ক্যান্টনমেন্ট টাউনে। জোর দিয়ে বার বার বলল, শিলচর ইজ সেফ–পাকা খবর।

কী করে শ্যোর হলে জিমি?

গুড লর্ড! আমি আমার ট্রাঙ্ক-বন্ধুদের অতিষ্ঠ করে তুলিনি, সেই ভোরবেলা থেকে, শিলচরের খবর জানাতে? মুচকি হেসে বলল, ওরা হয়তো ভেবেছে আমার ফিয়াসে বুঝি শিলচরে।

আরেকটা ইমপর্টেন্ট খবর, মাই লেডি, পাক আর্মি ইন্ডিয়ান এলাকায় ঢুকবে না এইটেই ৯৯% রিপোর্টার স্বামীনাথন তো বলল, সে তার লাস্ট শার্ট বেট করতে রাজি আছে? অতএব শিলচর ভেরি সেফ।

সিলেটের খবর?

গলা নামিয়ে বললে, ভালো নয়, মন্দও নয়। তবে স্বামীনাথন জোর গলায় বলল, সে নিজে জানে সিলেটে পাঞ্জাবি পাঠান সেপাই অতি অল্প নেগলিজেবল!

শিপ্রা একটু চিন্তা করে বললে, দ্যাট ইট। বল তো, জিমি, এখানকার সবচেয়ে সরেস রেডিয়ো-ডিলার কে?

গুডনেস মি! সে তো আমার ইয়ার বরুয়া। নাইস চ্যাপ। কিন্তু ম্যাডাম আপনি টাকা দেবেন না। শুধু দামটা জিগ্যেস করবেন। তার পর দেখি তার দৌড় কদ্দূর।

টাকা না দিলে—

দেবে না? মানে? হেভেনস্। ন টার সময় দোকান খোলে যাকে বলে কারেক্ট টু দি গান।

কী দরকার দর-কষাকষি করে?

প্লিজ, ম্যাডাম। আমাকে অন্তত একটা চান্স দিন। আপনি এখন খুশি। লেট মি বি হ্যাপি ওলসো।

শিপ্রা এখন গুজব, খবর, ব্লা, প্রপাগান্ডা, সব শুনতেই রাজি।

কাঁটায় কাঁটায় ন টায় বরুয়ার দোকানে গেল ট্যাক্সি করে। সর্দারজি ঢাকা, কুমিল্লার যেসব রোমাঞ্চকর গুল্-ই-বাকলির কেচ্ছা শোনাল তার কাছে জিমির রিপোর্ট সরকারি ইশতেহারের মতো পানসে, বলে অনেক মিন করে নাথিং, যেন হাওয়ার কোমরে রশি বাঁধা। কোনওপ্রকারের উসকানি শিপ্রাকে দিতে হয়নি। সেদিন ডিকটেটর ইয়েহিয়ার কাহিনীই সকল কাহিনীর ডিকটেটর। এমনকি পুঁচকে ডিকটেটর ইয়েহিয়ার তুলনায় দানবকায় বড়া ডিকটেটর হিটলারের অতর্কিত রুশ আক্রমণের খবর তার দুশমন চার্চিল-রুজভেল্ট দুজনাই জানতেন ও স্তালিনকে মাসখানেক পূর্বে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মুসসোলিনির অতর্কিত গ্রিস আক্রমণের পূর্বাভাস হিটলার পাননি। আমাদের পুঁচকে ডিকটেটর হেইয়া সাব কিন্তু কুল্লে ডিকটেটরকে এ বাবদে ঘোল খাওয়ালেন। শেখের সঙ্গে সন্ধির কথাবার্তা দিনের পর দিন তিনি যখন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন পশ্চিম পাক থেকে তিনি আনাচ্ছেন টর্নেডো বেগে হাজার হাজার পাঠান-পাঞ্জাবি সঙ্গে সঙ্গে দিনের পর দিন। ২৫ মার্চের দুপুররাত পর্যন্ত ঢাকার অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করত, ইয়েহিয়া-মুজিবের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে গিয়েছে। সদর (শব্দার্থে চক্রবর্তী) ইয়েহিয়া দু একদিনের মধ্যেই ফৈসালার বিবরণ প্রকাশ করবেন। ২৬ মার্চ সকালে ইয়েহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের সম্মিলিত হওয়ার পাক্কা এপয়েন্টমেন্ট। ২৫ মার্চ বিকেল পাঁচটায় ইয়েহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন মুজিব এমনকি তাঁর বামহস্ত ভুট্টোকে পর্যন্ত কোনও খবর না দিয়ে। সেদিন সে খবর জানতে পারল অতি অল্প লোকই। খোদ ঢাকা শহরেও। আর্মি অফিসার ইয়েহিয়া তাবৎ সিভিলিয়ান ডিকটেটরদের শিখিয়ে দিল একটি নবীন তত্ত্ব। আর্মি ডিসিপ্লিনে যে কোনও প্ল্যান গোপন রাখা অফিসারদের ধর্ম–সিভিলিয়ানের পক্ষে সেটা অস্ত্রমাত্র।

শিলঙ জানতে পেরেছে ২৬ মার্চ সকালে ধুন্ধুমারের খবর। যুদ্ধারম্ভের পূর্বেই ঢাকার রণাঙ্গন থেকে জঙ্গি লাটের পলায়ন- যথা, দুর্যোধনের হৃদয়ে সাহস দেবার জন্য শঙ্খ না বাজিয়ে পিতামহ ভীষ্ম যদি চুপিসাড়ে পুস্পক প্লেনে পলায়ন করতেন, তোবা! তোবা শুনলেও পাপ হয়– এ খবর হয় তো লাগে তাক না হয় তুঙ্কারূপে কোনও কোনও ফলিত জ্যোতিষী অনুমান করেছিলেন মাত্র। ড্রাইভার সর্দারজি হয়তো পূর্বজন্মে জ্যোতিষী ছিল।

শিপ্রার স্মরণে এসেছে, আগরতলায় মিঞা সাহেবের কথা।

তা হলে শিয়া ইয়েহিয়া শেষ পর্যন্ত মহররমের পবিত্রতা বিনষ্ট করে ওই মাসেই নরহত্যায় লিপ্ত হল।

ইসলামি পঞ্জিকা-খানাতে শিপ্রা শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হচ্ছিল বটে, কিন্তু ঠিক যে স্থলে সংক্ষেপে বলা হয়েছে, মুসলমানি হিসেবে দিবস আরম্ভ হয় সন্ধ্যা থেকে, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে, সে অবধি পৌঁছয়নি। ২৫ মার্চ দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বিশ্ব মুসলিমের স্যাবাৎ পবিত্র জুম্মাবার, শুক্রবার। কট্টর শিয়া আরম্ভ করলেন তার নরহত্যা শিয়া-সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ের পবিত্র জুম্মাবার রাত এগারোটায়, সুন্নির কাছে পবিত্র, শিয়ার কাছে পবিত্রতম মুহরম মাসে!

শিপ্রা দোকানে ঢুকে বেছে নিল সবচেয়ে ভালো বেতারযন্ত্র– পরের মুখে ঝাল না খেয়ে সে স্বকর্ণে শুনতে চাইল ঢাকা, কলকাতা, পিভি, বিবিসি এবং জোরদার বিদেশি স্টেশনগুলো। দাম শুনে শুধাল সর্বোত্তম এরিয়ালের সরঞ্জাম বরুয়ার লোক হোটেলে ফিট করে দিয়ে আসতে পারবে কি না, তার চাই আজই, এখুনি। বলতে না বলতে জিমি এসে উপস্থিত। মাদামকে আরেক দফা সুপ্রভাত জানিয়ে তাকে বলল, আপনার সেট পছন্দ হয়েছে? গুড়। এবারে আপনি সেটটি সঙ্গে নিয়ে যান, আর এই লাগিয়ে দিচ্ছি ঘণ্টা দুয়েকের তরে মোস্ট টেম্পরারি একটা এরিয়েলের তার। তারের অন্য প্রান্তটা কোনও একটা জানালা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে দেবেন। দাঁড়ান, এই আমি ১৩ মিটারে লাগিয়ে দিচ্ছি। নিডলটা। ডাইনে-বাঁয়ে ওটাকে সামান্য নাড়লেই পেয়ে যাবেন এবিসি, আই মিন অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি না করপোরেশন কী যেন? মিনিট পনেরো পরেই পেয়ে যাবেন নিউজ বুলেটিন। ইন্ডো-পাক খবর বিতরণে এরা প্রায়ই বিবিসিকে কানা করে দেয়। টাকা? সে আপনি আমাকে বরুয়ার নামে চেক দিয়ে দেবেন অ্যাকাউন্ট পেয়ী। অবশ্য সেটা পছন্দ হলে। নইলে আজ বিকালে আমি বরুয়ার সেটটা– বেস ইন দি ইটা অব সুয়েজ, মাদাম। বলে সেট তুলে নিয়ে চলল মাদামকে আধ বোটের মতো পিছনে পিছনে টেনে।

প্যোরেস্ট অব দি প্যোর অহমসন্তান বড়য়া সমস্তক্ষণ দু কান-ছোঁয়া মৃদু হাস্য, তৎসহযোগে ঘাড় নেড়ে নেড়ে, অফ কোর্স, সার্টেনলি, টাকার কথা কে তুলেছে?– নট মি, বহক, ম্যাডাম, বহক, চেয়ারতায় বসূটে আজ্ঞা হোক মৃদু কণ্ঠে বলে যাচ্ছে তো বলেই যাচ্ছে। শিপ্রা দু একবার আপত্তি তোলবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।

প্লাগে কনেকট করতে আর তার লটকাতে ক মিনিট লাগে। নিডল একটু ছুঁতে না ছুঁতেই মেলবার্ন গাক গাঁ করে উঠল, এরিয়ালের উদ্বাহু, বামন বেতারের কল্যাণেই। ইতোমধ্যে দেখতে পেল এসে গেছে অহম দেশের গভীরতম অরণ্যের গগনচুম্বী বংশাবতংশদ্বয়। এ-হেন এরিয়েল দিয়ে কটকের চিউ চিউ মিউ মিউ থেকে টোকিয়োর গাক গাক শোনা যাবে পরিষ্কার– দাঁতমুখ খিঁচিয়ে স্পিকারে কান না সেঁটেও!

সমস্ত দিন কাটল শিপ্রার এ-স্টেশন ও-স্টেশন শুনে শুনে।

বিশেষ করে কলকাতার ডি সি বেতার রিসেপশন এতই পীড়াদায়ক যে, সে সেখানে তাদের যন্ত্রটাকে কয়েক মাস নাড়াচাড়া করে একদম তালাক দিয়েছিল।

এখানে কী লাক!

প্রথম সন্ধ্যাতেই, পিন্ডি থেকে নিডল একটু সরে যেতেই শিপ্রা শুনতে পেল পরিষ্কার যদিও ঈষৎ মৃদু কণ্ঠে, ইসি পারি, ইসি পারি। এখানে প্যারিস এখানে প্যারিস, মেমোয়েজেল, মেদাম–।

শিপ্রা মুহ্যমান! কত বর্ষ, কতকাল পরে সে শুনতে পেল সেই প্রাচীন যুগের নিত্যদিনের সঙ্গী ইসি পারি, ইসি পারি। সংবিৎ হারিয়ে প্যারিস দিচ্ছিল খবর- সে কথা কইতে লাগল প্যারিসের সঙ্গে উই উই– হা হা, মে সার্তেনমা– নিশ্চয় নিশ্চয় তার পর কী একটা অনিবার্য দুর্ঘটনার সংবাদে মে ক্য ভুলে ভু–আহা, তার আর কী করা যায়–ফ্রানসবাসী যে কোথাকার কোন এক কনফারেনসে তাদের ফরেন মিনিস্টার যাচ্ছেন না শুনে মোটেই বিচলিত হয়নি শুনে শিপ্রা ঘাড়-গর্দান ত্যাগ করে মুখ বেঁকিয়ে বলল, জ্য মা ফু অসি– আমো থোড়াই কেয়ার করি।

কে যেন দরজায় নক করল। শিপ্রা তখন প্যারিসে।

আঁত্রে, সিল ভু প্লে–ভিতরে আসুন প্লিজ। যেই দেখল ঢুকেছে সেই জোয়ান সিলেটি বেয়ারা, অমনি কোথায় মিলিয়ে গেল প্যারিস! একটা ফু-তে নিভে গেল পিদিমটি। অন্ধকার।

.

০৫.

শিপ্রা ইংরেজি, ফরাসিস, বাংলা বুঝতে পারে ভালো, কিছুটা হিন্দি।

সকালে মেলবার্ন হতে যাত্রা আরম্ভ করে পিন্ডি, দিল্লি হয়ে বিবিসি, দুপুরে জর্মনির কলোন, সন্ধ্যায় প্যারিস। সর্বশেষে চীন আর রাশা। ইতোমধ্যে হয়তো উটকো আজারবাইজান থেকে শুনল ফরাসিতে কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বাংলাতে।

ফলে সবকিছু গেল ঘুলিয়ে। পরে কিছুতেই মনে পড়ল না স্বাধীন বাংলা বেতারের বাক্যস্ফূর্তি হয়েছিল কোন দিন, আর, ঢাকা বেতার লীগ-প্রেমীদের হাত থেকে খানরা ছিনিয়ে নিল কোন সময় ছাব্বিশের সকালে। বস্তৃত ঠিক সে সময় শিপ্রা বেতার কিনতে বাজারে গিয়েছে। তবে তার ভাসা ভাসা একটা ধারণা হয়েছিল, খানদের অমানুষিক অত্যাচার এবং পাশবিক বর্বরতার সর্বপ্রথম সংবাদ দেয় এবিসি।

শেষপর্যন্ত শিপ্রার হৃদয়ঙ্গম হল, বিস্তর স্টেশন শুনে বিশেষ কোনও লাভ হয় না। পঞ্চপাণ্ডবের চেহারা হুবহু এক রকমের হলে দ্রৌপদী নিশ্চয়ই আপত্তি জানাতেন। এস্থলে গোটা পাঁচ বিবিসি, মার্কিনি এবং গোটা দুত্তিন, একুনে ওকিবহাল পঞ্চ স্টেশন বিস্তর মেহনত ও দেদার পয়সা ঢেলে খবর সংগ্রহ করে; বাদবাকি কুল্লে দুনিয়ার বুড়ি বুড়ি স্টেশন এদের সঠিক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত কার্বন নন বটে কিন্তু ওই পঞ্চপাণ্ডব প্রদত্ত সংবাদের বিভিন্ন রকমের ঘাট বানিয়ে বিতরণ করে। শিপ্রার এত প্যারা যে ইসি পারি তিনি পুব বাংলা বাবদে প্রায়শ উদাসীন কিন্তু যখন নিন্দে করতে চায় তখন বিবিসির মতো পিন-পিনিয়ে শ্যাম-কুল রক্ষা না করে, দ্যায় চুটিয়ে গালাগাল এবং মাঝে মাঝে একটা হুলো আর মেনী বেড়াল গালগল্পের মাঝখানে এমন সব বর্ডার-ছোঁয়া আদি-রসাত্মক মাল ছাড়ে যে আমাদের একস-প্যারিসিনী শিপ্রা ভিন্ন– মেয়ে নয়– যে কোনও পুরুষেরই পিলে চমকে উঠত।

লিবেরতে, লিবেরতে তুজুর লা লিবেরতে।

কোন বেতার কতখানি লিবেরতে উপভোগ করে সে প্রশ্নটা শিপ্রার মনে আবার উদয় হল। বছর কয়েক আগে সে পাক-ভারত লড়াইয়ের সময় বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আর-সবাই শুনতে চায় বলে সে-ও সঙ্গ দিয়ে কয়েকবার বিবিসি শুনেছিল। এখন মাত্র দু দিন অবশ্য বেশ বার-কয়েক–বিবিসি শুনে তার মনে হল দায়িত্ববোধ মাত্রাধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে সে ক্লীব হয়ে যাচ্ছে। আধ-ফর্সা সুন্দরীর আপন ফর্সা বাঁচানো সম্বন্ধে দায়িত্ববোধ যখন বড্ড বেশি বেড়ে যায় তখন সে যেমন রোদ্দুরে বেরুতে চায়। চিন্তা করে শিপ্রা সিদ্ধান্ত করল, এখন বিবিসির মূল্য নেতিবাচক। অমূক গুরুত্বপূর্ণ নিউজ-আইটেমটা পুব পাকের প্রতিবেশী বর্মা বেতার দিয়েছিল সকালবেলা, সেদিন তো নয়ই, পরের দিনও বিবিসি সেটা উল্লেখ করল না, এমনকি বর্মার বরাত দিয়েও না। অতএব খবরটার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে।

ইতোমধ্যে পশ্চিম পাক বেতার যে একটাই রেকর্ড অনবরত, কিবা দিন কিবা রাত্রি, বাজিয়ে চলেছে তার ধুয়ো তামাম পূরব বাঙালময় অখণ্ড শান্তি, অপার নিরাপত্তা। ওইটা যে হবে সে তো নিতান্ত স্বাভাবিক। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রপাগান্ডা বিশারদ হের ডক্টর গ্যোবেও শেষপর্যন্ত আপন প্রপাগান্ডার হাড়কাঠে মুণ্ডটি হারালেন। বার্লিনের পতন কখনও হবে না, বার্লিন কস্মিনকালেও পরাজিত হতে পারে না এ জিগির তিনি শত শত বার শুনিয়েছেন বেতারে, বিশেষ বিশেষ বুলেটিনে, মার্চ ম্যাজিকের তেজীয়ান তালয়সহ, বলীয়ান রণদামামা সহযোগে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী বার্লিন নাগরিকদের আজ যে রকম হুবহু পৃথিবীতে শান্তি অন্তরীক্ষে শান্তি জিগির গাইছেন চোটা ডিকটেটর ইয়েহিয়া– বার্লিন পতনের পূর্ব মুহূর্তে সেই কাপ্তান গ্যোবেলস্ নিমজ্জমান বার্লিন-মানওয়ারি জাহাজ থেকে খালাসি-লস্করকে আপন আপন নসিবের হাতে সমর্পণ করে এক লাফে লাইফ-বোটে আশ্রয় নেবেন কী করে? সে তো অনেক দূরের কথা– ইয়েহিয়ার তরে, এখন। এখন তার জীবনপুঁথির নয়া পাতা সে উটিয়েছে মাত্র। কিংবা সে নব-বর। আতশবাজির ফাঁকা আতশ আগুন নয়, উৎসব-বহ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে, জ্বালাচ্ছে হাট-বাড়ি, মন্দির-মসজিদ। কাঁচা বাঁশের খুঁটি আগুনে তেতে উঠে যে বিকট শব্দে ফেটে উঠছে তার কাছে কোথায় লাগে পাঠানের বিয়েতে রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ? লোকে বলে ইয়েহিয়া পাঠান, আসলে সে শিয়া দারওয়ান গুষ্টির ছেলে, জাতে কিজিলবাশ, পাঠান কুত্রাচ শিয়া হয় না। বিয়ের বর্ণ লাল, লালে লাল, রক্ত লাল। আবির আর পিচকারি মারার তরে লাল রঙের কী প্রয়োজন? মোগল ছবিতে হোলির দিনে, বিয়ের সাঁঝে পাঠান মোগল হারেম-মহিলারা পিচকারি দিয়ে টকটকে সুগন্ধি লাল জল– সুখ-আ মারতেন একে অন্যের তনুদেহে- এন্তের মোগল তসবিরে আছে, মুসলিনের দু পাট্টা, সোনার চুমকিদার উড়িষ্যার ফিলিগিরি রুপোর তার আর রেশমি সুতোয় বোনা সদরিয়া ভেদ করে সিক্ত করে দিয়েছে শুভ্র ফেননিভ সিত কুঞ্চলিকা। নৃত্যের তালে নীবিবন্ধ শিথিল হতে শিথিলতর হয়ে উন্মোচিত করে দিয়েছে নাভিপদ্ম। লক্ষ্য ভেদ করো, মারো পিচকারি, হে হারেমরাজ নটবর ইয়েহিয়া মহরমের শুক্রের রাতে। কী? রক্তরাগরঞ্জিত বারি আর নেই!

কী ভাবনা তব ওহে সৈনিক,
হোয়ো নাকো ম্রিয়মাণ।

না, না, না– ফটিকাধার থেকে শিরাজের লাল পানি নিচ্ছ কেন, রসরাজ। যদি তুমি এখন ঢাকেশ্বরীর প্রসাদাৎ প্রাসাদে দুর্বার স্কন্ধাবার নির্মাণ করে থাক তবে আনাও না রক্ত, জোয়ানদের তাজা খুন, রমণীদের অঙ্গরক্ত। বুড়িগঙ্গার পানি তো ডুবে মরেছে উপরের রক্তস্রোতের চাপে। কোনও লাস্যবতী ন্যাকরা করে বলতে পারবে না, বঁধু রঙ দিয়ো না গায়।

তুমি তো দিচ্ছ রক্ত। ড্যাম ইয়োর রঙ।…

সাতাশে মার্চ শিপ্রা ধীরপদে গেল রাত এগারটায় হলঘরে। উইলসন মাস্টার ছোট্ট একটা কমজোর বালব ছাড়া, সবকটা আলো নিভিয়ে ঝিমুচ্ছে। যেন ঘিয়ের পিদিমের আলোতে একটা বাচ্চা ছেলে ঘুমুচ্ছে। কোনওপ্রকারের শব্দ হলেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নিদ্রালু ভাব কাটবার আগের থেকেই জপ করতে আরম্ভ করে, ইয়েস্ প্লিজ! হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। কিন্তু শিপ্রা এসেছে অতিশয় নিঃশব্দে। এবং তার পায়ে দিল্লির বিল্লি মোরান মহল্লার সেলিম-শাহি– এর সোল নাকি তৈরি হয় চামচিকের ডানা পিটে পিটে; সত্য নির্ণয় কঠিন। শিপ্রা দুই হাত আড়াআড়ি বিছিয়ে তার উপর বুকের ভর দিয়ে দিয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে রইল। দেখছিল, সরল কিশোরের তন্দ্রা তার মুখচ্ছবি কী মধুর আর সরলতর করে দিয়েছে। এরকম আদুরে আদুরে মুখ থাকলে কি কিশোর, কি যুবা, কি শিশু সবাইকে কন্টিনেন্টে বলে মাদার ডার্লিং মায়ের দুলাল।

একসময় জেগে উঠবেই। ধড়মড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুড়– সম্পূর্ণ করার পূর্বেই শিপ্রা শুধল, জিমি, সে, ইউ গট ব্র্যান্ডি, কন্যা–ফ্রেঞ্চ?

জিমি থ। ইনি অবশ্যই সোসাইটি লেডি। এর চতুর্দিকে যে আবহাওয়া সে তো সোসাইটি লেডিরই উপযুক্ত, এবং সে-ও ইলিয়ট রোডের প্রাচীন দিনের অ্যাংলো– মদ্যের সঙ্গে শিশু বয়েস থেকে তার পরিচয়– তবু এ লেডির সঙ্গে কন্যা কেন, ব্র্যান্ডির ফোঁটা পর্যন্ত খাপ খাওয়াতে পারল না। যেরকম তার ড্যাডি। পাল-পরব ভিন্ন তাকে সে কখনও সে পাশ মাড়াতে দেখেনি।

জিমি : সার্টেনলি, সঙ্গে সোডা, না প্লেন জল?

সোডা আর জল দুই-ই। আর দুটো ওয়াইন গ্লাস নিয়ে আসবে, সঙ্গে করে। কিন্তু বঁ দিয়ো ইয়াল্লা– কাউন্টার সামলাবে কে?

কী যে বলেন, মাদাম! বেয়ারা রেখে যাব। সে ডেকে দেবে। কিন্তু এখন তো বড় কিছু একটা কাজ থাকে না।

শিপ্রা কটেজের ড্রইংরুমে জিমিকে মুখোমুখি বসিয়ে হিয়ার ইজ লাক! বলে জিমির গেলাসে আপন গেলাসের সঙ্গে টক্কর লাগিয়ে টুং করে ধ্বনিতরঙ্গ জাগাল।

জিমির বয়স কম হলেও বড় হোটেলের রিসেপশনিস্ট্ররূপে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে বহু বিচিত্র এবং প্রচুর। সে তাগড়া জোয়ান, চেহারা মিষ্টি মিষ্টি, সব্বাইকে আপ্যায়িত করতে হামেহাল তৈরি। বিস্তর চা-বাগানের মেমসায়েব, নেটিভ মেমসায়েব, সোসাইটি লেডি, মার্কিন টুরিস্টিনী হিল স্টেশনে আসে নিছক যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্ত করতে। তাদের ভিতর আবার গড় ড্যাম পার্ভার্ট। কলকাতায় পুরুষরা বড় বড় হোটেলে ঢলাঢলি করেন। শঙ্কর তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সে-নাটকের অত্যুত্তম বর্ণনা এবং নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতিতে যে রস সৃষ্টি করেছেন, সেটি গৌড়জন আনন্দে করিছে পান সুধা নিরবধি। অবশ্য ঢলাঢলির জন্য রমণী দরকার। অতএব তেনারাও আছেন, কিন্তু সেখানে তারা প্যাসিভ উপাদান মাত্র, যেমন হুইস্কি। কিন্তু বোম্বাই-কলকাতাতে যৌন-ক্ষুধাতুরা রমণীরা সক্রিয় স্বাধীন পদ্ধতিতে রতি-সখার সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য বড় বড় হোটেলের সদ্ব্যবহার করতে ঈষৎ কুণ্ঠিত হন। ফলে বংশানুক্রমে এঁরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সেটা বহুবিধ পথ আবিষ্কার করেছে। তার মধ্যে দুটি পন্থা উৎকৃষ্ট। জাহাজে করে দরিয়ায় দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে নব নব যৌনাভিজ্ঞতানন্দ সঞ্চয় অত্যুত্তম বটে, কিন্তু যদি অত্যধিক, সহ্যাতীত উৎকট উৎঙ্খলতার দরুন সঙ্কট দেখা দেয়– যদিও এস্থলে পরিষ্কার বলে রাখা ভালো, এসব টুরিস্ট জাহাজের অধিকাংশই ইহভুবনে সর্বজনবিদিত, সমর্থিত জলচর সোনাগাছি–সোনাগাছিকে অপমান করা এ পুস্তকের উদ্দেশ্য নয়– তখন কাপ্তেনের আদেশে কাট, আউট কেবিনে রুদ্ধাবস্থা থেকে সে রমণী মুক্তি পায় কী প্রকারে? অথচ প্রতি রাত্রে কোটিপতিনীর অসহ্য প্রয়োজন একটা তাগড়া জোয়ানের, কোনও কোনও স্থলে একাধিক। কথিত আছে, রাশার জারিনা কাতেরিনার জন্য প্রতিদিন নিত্যনতুন গার্ড অব অনার উপস্থিত রাখা হত, নিত্য নবীন বলিষ্ঠ প্রিয়দর্শন আর্মি-অফিসার দ্বারা নির্মিত। মহারানি ফাইলের সম্মুখ দিয়ে ধীরপদে যেতে যেতে যাকে সে-সন্ধ্যার নৰ্মসখারূপে উৎকৃষ্ট মনে হত তার দিকে এক মুহূর্তের শতাংশেক মাত্র চোখের একটি ঝলক বুলিয়ে দিতেন। মহারানির সহচর বয়স্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ক্ষুরধার অসিকে এক কটাক্ষে দ্বিখণ্ডিত করতে পারত। মানুষ মাত্রেরই ভ্রান্তি হয় এ প্রবাদটি বক্ষ্যমাণ বয়স্যের ক্ষেত্রে নিতান্ত অপ্রযোজ্য। যমরাজ সম্বন্ধে সুপ্রচলিত গল্পটির ট্র্যাজেডি অব এরর তিনি কুত্রাপি কদাচ ঘটাতে দেননি কিংবদন্তি সে-বিষয়ে সবিশেষ সোচ্চার।

কিন্তু মার্কিন কোটিধারিণীরা যা-ই করুন না কেন, জারের আর্মি অফিসারদের মতো বিশ্ববাছাই সুদর্শন যুবক সংগ্রহ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ জারের আর্মিতে বা রাজদরবারে প্রবেশ করার গৌরব তথা অর্থলাভার্থে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে বাছাই বাছাই সুদর্শন, দুঃসাহসী, দ্ৰাচরণসম্পন্ন যুবক আসত সেন্ট পিটারসবুর্গে, মস্কোতে। রুশের কালিদাস কবিসম্রাট পুশকিন্-এর মাতামহ মূলত ছিলেন আবিসিনিয়ার হাবশি– পিটার দি গ্রেটের ফৌজে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আজ কি নিকসন, কি মাও সে তুং এ সম্মেলন করতে অক্ষম। ন্যাশনালিটি তার বিষফল পাসপোর্ট স্বদেশে আপন নাগরিকতা না হারিয়ে ভিন্ন দেশের ফৌজে ঢোকা আজকাল প্রায় অসম্ভব। শ্রীসুভাষের ফৌজ হিটলার বা মিকাডো-ফৌজের অঙ্গরূপে শপথ নেয়নি। এ তত্ত্বটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, কারণ বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পূর্বে ও পরে এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

অতএব মার্কিন কোটিধারিণীরা বিশ্বপরিক্রমায় বেরোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সভ্য অসভ্য নানা সৌন্দর্য উপভোগ করতে। হিল স্টেশনে অর্ধসভ্য, পূর্ণ অসভ্য সর্বশ্রেণির মানুষ সুলভ। এঁদের অনেকেই অতিসভ্য ককটেল, মাত্রাধিক মার্জিত পুরুষসঙ্গ, সর্বাধুনিক নৃত্য অত্যধিক উপভোগ করার ফলে এ সবের তরে সোয়াদ রুচি হারিয়ে ফেলেন। তারা তখন বেরোন প্রকৃতির সন্ধানে। সভ্যতা দ্বারা অকলুষিত তরুণ-তরুণীর সন্ধানে যারা পূর্ণিমা রাতে গাঁয়ের ছোট্ট নদীটির পারে পারে বাঁশি বাজিয়ে প্রিয়াকে জানায় আহ্বান, প্রকৃতিদত্ত তার দেহটি মনুষ্যনির্মিত কোনও উপাদান দ্বারা কলঙ্কিত না করে তরুণী নিমজ্জিত করে আছে তার দেহবল্লরীটি ঝরনাধারার স্বপ্নমগ্ন বালুচরের উপর। পূর্ণচন্দ্রের উজ্জ্বল রৌপ্যালোক তার ঘনকৃষ্ণ চিকূণ মসৃণ চর্মে বার বার আঘাত হেনে চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

হিল স্টেশনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ : সমস্ত রাত ধরে পাহাড়িদের সঙ্গে নৃত্যগীতে টুরিস্ট মগ্ন হলেন, লুকোচুরি খেললেন, সমতলভূমি হলে ছোট্ট নদীটিতে জলকেলি করলেন, ওদের হোম মেড় বিয়ারে ধক্ অত্যল্প বলে বে-এক্তেয়ার হলেন না, ওদের আচার-ব্যবহার কায়দা-কেতায় খাপ খাইয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারলে ওরাই অতিথির (ঠিক শব্দ নয়, যেন ভিন্ গায়ের জাতভাই) নিঃসঙ্গতা সইবে না, গা ঘেঁষে বসে এমন এক বলা-না-বলার ভাষায় ভাবের আদান প্রদান করবে, আভাসে ইঙ্গিতে মৃদুহাস্যে লজ্জাবনত নয়নে কতনা না-বলা-বাণী দিয়ে ভিনদেশিকে সম্পূর্ণ আপন করে নেবে। সখীরা কখনও কাছে এসে, কখনও দূরের থেকে সাহসিকাকে গানে-গীতে সঙ্গ দেবে, আর কখনও-বা অশরীরিণীর মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।… পক্ষান্তরে তাঁতের ঘরে বলদ ঢোকার মতো রামপেঁচা গাড়লস্য গাড়ল কোনও কোনও টুরিস্ট ইডিয়টের মতো বেমক্কা জেব থেকে নোটের তাড়া বের করে সঙ্গিনীর হাতে ঠাস করে চড় খেয়েছে এ হেন বিপর্যয়ও অবিদিত নয়। এবং মাঝে-মধ্যে শ্রাদ্ধারম্ভ হয় সেখানেই। পরের দিন পাহাড়ি বেয়ারাদের ঠোঁট-কাটা-কোনও-একজন কাহিনীটি কীর্তন করে অন্য বেয়ারাদের কাছে এবং ক্রমে ক্রমে সেটা লেফাফা-দুরস্ত ক্লাবেও পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে মাঝদরিয়ার জাহাজ থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? হিল স্টেশনের সেই তো সুবিধে। চলে যাও অন্য কোনও স্টেশনে। বেটার লাক নেক্সট টাইম এট নেক্সট প্লেস, ওল্ড বয়, ও রভোয়া। রাত তো কাটল প্রকৃতির অকলুষ বাতাবরণে আনন্দঘন চৈতন্য থেকে চৈতন্যান্তরে।

দুপুরে টুরিস্ট ফের সভ্যতার উচ্চতম শিখায় আরোহণ করবে, অর্থাৎ ঝকঝকে চকচকে উচ্চ দণ্ডাসনে বসবে পেতল, স্টেনলেসের বার-এর সম্মুখে। বার-এর থাকে। থাকে স্ফটিক পাত্রে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানা বর্ণের রশিচ্ছটা। বার-মেড় হেথায় মেড় অব্‌ লিপস্টিক, রুজ, ম্যাসকারা মাখানো আঁখিপল্লব; ভুরুর স্থলে দুটি বঙ্কিম রেখা যেন অনঙ্গ বিহঙ্গ এই এক্ষুনি দুটি বিস্তৃত পক্ষ সামান্যতম কম্পন লাগাতে না লাগাতেই বিলীন হয়ে যাবে দিকচক্রবালে। মাথায় প্রতিদিন নিত্য নবীন কবরী। কভু-বা বাবুই পাখির বাসা, কভু-বা ব্রোন্টের আঁকা বিদেশি সদাগরের পাগড়ি-পরা, কভু-বা মুণ্ডুটা যেন আস্ত একটা টি-পট– তার উপরে বসিয়ে দিয়েছে ভুটানি টি-কোজি।

উত্তম উত্তম পানীয়। দূর থেকে ভেসে আসছে বিলিতি বাদ্যির বাজনা। দু চক্কর শটিশে বা পেনশনারদের মতো মন্থরগতিতে সম্মুখপানে মর্নিং ওয়াক, মন্থরতর গতিতে প্রত্যাবর্তন– ল্যামবে ওয়াক।

কিন্তু বেচারী জিমি সভ্যতার এ প্যাটার্নের সঙ্গে নিজেকে কখনও খাপ খাওয়াতে পারেনি। চা বাগিচার রদ্দি থার্ড ক্লাস ইংরেজও যে ভিতরে ভিতরে তাকে অ্যাংলো বলে তাচ্ছিল্য করে সে সেটা আট বছর বয়সে প্রথম স্কুলে গিয়েই টের পেয়েছে, পরে অপমানিত বোধ করেছে, এখন অনেকটা সয়ে গিয়েছে। কারণ বিজনেস ইজ বিজনেস, খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করতেই হবে, হোক সে পাড় মাতাল, লম্পট ইংরেজ, হন তিনি মার্কিন লক্ষ ডলারের মালিক।

সেইখানেই তো সঙ্কট। সে বড় হয়েছে তার কট্টর পুরিটান পিতার হাতে। তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না যে, হোটেল বার-এ যে সভ্যতার প্যাটার্ন বিরাজ করে সেটা খ্রিস্টানদের কলঙ্ক। কারণ এসব নারকীয় উচ্ছঙ্খলতা এদেশে প্রবর্তন করে ইংরেজ এবং তারা খ্রিস্টান।

তদুপরি জিমির চেহারাটি যেমন মধুর হাসলে দু পাটি দাঁত ঝলমলিয়ে ওঠে শরীরটাও তেমনি দড় মজবুত। সুন্দুমাত্র তার কব্জি কতটা চওড়া একবার তাকিয়ে দেখলেই হয়, বুকের পাটা থাক্। মার্কিন টুরিস্টিনীদের কেউ কেউ সর্বভুক, দূরের অনেককে নিকটতম বন্ধুরূপে পেতে চান। ঠেকাবে কী, কে? ডলার নেই?

একথা সত্য যে ম্যানেজার, প্রোপ্রাইটারের ইচ্ছা এটা নয় যে জিমি অনিচ্ছায় হোটেলের বেসরকারি জিগোলো–পুং বেশ্যা–রূপে মার্কিন মহিলাদের সঙ্গ দিক। অবশ্য এটাও সত্য, ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেলে হোটেলের কিছুটা বদনাম হবে। সেটা তাদের স্বার্থবিরুদ্ধ। পক্ষান্তরে জিমির অনমনীয়তায় ক্রুদ্ধ হয়ে কোনও মার্কিন যদি পরদিন জিমির বিরুদ্ধে উল্টোপাল্টা অভিযোগ আনেন সেটাও হোটেলের সুখ্যাতিকে ক্লিষ্ট করে আর জিমির পক্ষে ভয়াবহ সঙ্কট।

হোটেল-ম্যানেজারকুল উকিল ডাক্তারের চেয়েও বহুদর্শী। ম্যানেজার জানে অভিযোগ মিথ্যা।

তাই এহেন উভয়সঙ্কট ম্যানেজার মাত্রেরই মুখে মাত্র একটি বুলি, ট্যাট, জিমি, ট্যাফ্ট। একটুখানি ট্যাক্ট দিয়ে ম্যানেজ করো না কেন? তোমার কী দরকার, জানো, জিমি? আরেক আউন্স্ ট্যাক।

ব্যাপারটা ট্যাকটের সীমা ত্রিসীমানার ওপারে সেটা জিমি সবিস্তর বুঝিয়ে বলেনি ককখনও। তার যথেষ্ট ট্যাকট আছে বলেই সে জানে, বলাটা হবে ট্যাকটলেস। ম্যানেজারকে আহাম্মুক বানিয়ে তার লাভ? সব জেনে বুঝেও তাঁর আত্মসম্মানে লাগবে চোট। তাই সেটা হবে মোক্ষম ট্যাকটলেস। হুঁ: ট্যাকট? হিটলারকে বললেই হত, একটুখানি ট্যাকট খর্চা করলেই তো স্তালিনগ্রাদের লড়াইটা জিততে পারতে!

এবং ম্যানেজার সেটাও বুঝতে পারত, দু তিন দিন পরে অকারণ তার পিঠ চাপড়ে বলত, উয়েল, জিমি, জীবনটা কীরকম? হাও ইজ লাইফ?

.

এই হোটেলের চাকরিতে জিমির এরকম অভিজ্ঞতা পূর্বে কখনও হয়নি।

চাকরির দৈনন্দিন জীবনে আপিসে হোটেলে দোকানে চাকুরের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ আছেই। এই যে ম্যানেজার অ্যাব্বড়া তনখা পায় তাকেও তো জাতাকলের ভিতর দিয়ে যেতে হয় প্রতিদিন। তবে হ্যাঁ, কারও কলটা বড্ড ভারী, কারওটা অপেক্ষাকৃত হালকা।

এরকম ধারা রাত এগারোটায় তাকে এতদিন কোনও টুরিস্ট দুটো গেলাসসহ আহ্বান জানানো মাত্রই বস্তুত জানানোর পূর্বেই সে গোঁফ দেখতে পেত জানানোর পর শিকারি-বিড়ালসুদ্ধ। ডিউটির সময় আমাদের ড্রিঙ্ক বারণ ৩২ নম্বর অপেক্ষা করছেন টোকিও থেকে একটা ট্রাঙ্ক-কল; আমাকেই কানেক্ট করতে হবে দুনিয়ার কুল্লে সত্য কারণ, মিথ্যে অজুহাত, দুটোর ককটেল অছিলা– এটা অবশ্য এখনও পরখ করে নেয়নি–আবহাওয়া দপ্তর এখখুনি খবর দিয়েছে, কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা দশে আমাদের হোটেলে দারুণ ভূমিকম্প হবে। সেটা সামলে নিয়ে, এই এলুম বলে, ম্যাডাম। প্রায় সবকটাই এস্তেমাল করেছে জিমি এখন তার রেস্তো তলানিতে খতম খতম করছে– এক কড়ির ফায়দা ওঠাতে পারেনি।

আজ এই তার জীবনে সর্বপ্রথম দুটো গেলাস সে নির্ভয়ে– না, নির্ভয়ে নয় বড় তৃপ্তি আর আশা পূরণের দৃঢ় আশ্বাস নিয়ে এসেছে। ডিউটিতে, বাইরে, বাড়িতে না, বাড়ি বলতে হতভাগার প্রায় কিছুই নেই, গৃহে মাতা নাস্তি এমনকি অপ্রিয়বাদিনী ভার‍্যা চ নেই তার জীবন বৈচিত্র্যহীন। প্রত্যেকটি দিন যেন অন্তহীন একটা মালগাড়ির ওয়াগন– সবকটা হুবহু একই ঢঙ একই বহরের। জন্মমুহূর্তে এঞ্জিনটা চলে গেছে পশ্চিম দিকে অস্তাচলের দেশে, এখন সে দেখছে, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ওয়াগনের পর ওয়াগন চলেছে তো চলেছেই। অবশ্য কোনওটার রঙ-চটা, কোনওটা ডাইনে-বাঁয়ে দুলছে, কোনওটা-বা ঝাঁ চকচকে সদ্য বার্নিশ পালিশ করা। কিন্তু এ মালগাড়ির শেষ কোথায়? পূর্বাচলের দিকে তাকিয়ে দেখে গাড়ির শেষান্ত সেখানে বিলীন, ফের অস্তাচলের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রারম্ভাংশও সেখানে অদৃশ্য।

কী মহিমান্বিত, কী ডিগনিফাইড এই সুন্দরী। সামান্যতম অস্বস্তির চিহ্নমাত্র নেই তাঁর প্রশান্ত মুখচ্ছবিতে। আর কী সহজ সুরে বললেন, তোমাকে আমার বড় ভালো লেগেছে, জিমি। তোমার মুখটা খাঁটি মাদারস ডার্লিঙের মতো, কিন্তু দেহটা বাই অল দাট ইজ হোলি– কী মজবুত, ম্যাগনাম সাইজের হাড় দিয়ে তৈরি।… শোনো, তোমাকে ডেকে আনলুম, সেলিব্রেট করতে। স্টেশনটার কী নাম ধরতে পারিনি। বলল, রাশা নাকি অতি দৃঢ় ভাষায় ইয়েহিয়াকে বলেছে, রক্তারক্তি বন্ধ করতে। আমার মনটা যেন নাচছে।… কই তুমি খাচ্ছ না কেন? আমি কিন্তু, ভাই, কিছু মনে করো না, এক গেলাসের বেশি খাইনে। তুমি নির্ভয়ে খেয়ে যাও। বানচাল হবার বহু আগেই তোমার একটা চুলের অ্যাটুন কাঁপন দেখেই তোমাকে থামিয়ে দেব।

জিমি মনে মনে বললে, সে আবার বলতে! আস্ত বোতল গেলার মতো চিজ ইনি নন। গেলাসটা নাক অবধি তুলে ধরে একটু বাও করে বলল, আমাদের ভিতর সক্কলেই কোনও না কোনও দিক দিয়ে পুব বাঙলার সঙ্গে বিজড়িত। আমার মুরুব্বি মিস্টার সেন– হেম সেন– সিলেটে তাঁর বেশকিছু টাকা পড়ে আছে। ভিসা পাননি সেখানে গিয়ে তদ্বির করার জন্য। শেষটায় আমি যাই, সিলেটের চা-বাগান ম্যানেজার এক ইংরেজকে পটিয়ে। বাগাতে পারলুম সামান্যই এক বেহারির বাচ্চা খামোখা দিল বাগড়া পদে পদে। ওই বিচ্ছুগুলোই বি ইন দি অয়েন্টমেন্ট। আর এটা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন, কোন এক মেজর জিয়া আজ সকালে চাটগাঁ বেতারে পুব বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন? কিন্তু ম্যাডাম, আপনার আনন্দে আমি পুরোপুরি যোগ দিতে পারছিনে। আমার ট্রাঙ্ককলের বন্ধু ঘণ্টাটাক আগে আমাকে জানাল সেই সুন্দরবন অঞ্চলের হাসনাবাদে, পশ্চিমে পদ্ম পেরিয়ে উত্তর বাগডোগরা অঞ্চলে আর এই আমাদের দক্ষিণের সিলেট বর্ডার পেরিয়ে দুটি-পাঁচটি রেফুজি আসতে আরম্ভ করেছে, অলরেডি

আর শিলচর?

যে দু পাঁচটি ওই পুব বর্ডারে ক্র করেছে, তারা নিশ্চয়ই করিমগঞ্জেই আশ্রয় নেবে। আমি রেফুজি দেখেছি অনেক। ওদের শরীরে কি কিছু আছে যে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে দূর শিলচরে যাবে!

আমার বন্ধুরা তা হলে কাল না-ও আসতে পারে?

আপনার অনুমতি নিয়ে, কেন?

ওরা বোধহয় রিফুজিদের সাহায্য করতে চাইবে।

জিমি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনারা তো কলকাতার লোক। অপরাধ নেবেন না, আমি কিই-বা জানি। তবু বলি, সাহায্য করতে পারে কলকাতা আর দিল্লি। ড্যাডি আমাকে বলেছিল, চল্লিশের দশকে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তখন সবচেয়ে বেশি সাহায্য আসে কলকাতা থেকে। কিন্তু কলকাতার খাস বাসিন্দারা তো অনেক পরে জানতে পারবে, তা-ও আপন চোখে দেখে নয়, ওদের কী মরণ-বচন হাল। করিমগঞ্জ, শিলচরে ভলান্টিয়ারের অভাব হবে না, আমি শ্যোর। আপনার বন্ধুরা ইনফিনিটলি বেশি সাহায্য করতে পারবেন, কলকাতাতে চাল-ডাল, ওষুধপত্র এবং টাকা- ইয়েস্ টাকা জোগাড় করে। ওঁরা তো আগরতলা, করিমগঞ্জ, শিলচরে যথেষ্ট দেখেশুনে ওয়াকিফ হয়ে গিয়েছেন। ওঁরাই পারবেন কলকাতায় পাবলিক ওপিনিয়ন ফর্ম করতে। স্যরি, ম্যাডাম।

.

০৬.

এবারে আর কম্পন শিহরণ নয়। এবারে কেমন যেন আড়ষ্ট আড়ষ্ট ভাব। খান তাকে সোজা নিয়ে গিয়েছে পাশের কটেজে। খাটে শুইয়ে বলল, তুমি শিপ্রার সঙ্গে কথা কও তো, ভায়া। কিন্তু দোহাই আল্লার, সবটা বোলা না কেটে-হেঁটে। আমার এখনও পিলে চমকাচ্ছে। আমি চললুম জিমিকে শুধোতে লেটেস্টটা কী? ওর গায়ের প্রত্যেকটা লোম বেতার এনটেনা।

শিপ্রা বললে, জিমি এখন অফফ ডিউটি।

ওই আনন্দেই থাকো। আমি আসছি জেনেও সে অফ হবে! পিপিং পিটারকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। শেয়ানা ছোকরা, আমাদের ত্রিমূর্তি-মিলনে চতুর বলেই চতুরানন হতে চায়নি ওয়ান– নো টু, টু-মেনি হতে যাবে কেন?

শিপ্রা খুশি মনে খানের বকর বকর শুনছে : ততক্ষণে কীর্তি জিরিয়ে নিক, মনের জট ছাড়াক। বলল, আমার ঘরে একটা বেতার আছে। মিনিট দশেক পরেই বিবিসি খবর।

আমাদের ত্রি-মূর্তির ওই একটামাত্র কমন পয়েন্ট। বেতারাসক্তি কারওরই নেই। শুনেছি, লেবাননের আরব চাষা হাল চালাবার সময় বলদের শিঙে ট্রানজিস্টার ঝুলিয়ে বেলি ডানসের তালে তালে হেলে-দুলে এগুতে থাকে। বেতার বটতলার মাল। এখন অগত্যা শুনি। কপাল!

বলদটাও তালে তালে পা ফেলে তো? তা হলে নিশ্চিন্ত মনে নটের গুরুর কাছে দীক্ষা নাও। তোমার তো, জানি, দুটোই বাঁ পা।

নো, মাদাম, ভূতের হয়। আমার চারটে।… তা কী হবে, কও (বার-এর কোন মদ্য খাবের পরিভাষা)? কীর্তি হোয়াট ইজ ইওর পয়জন? তোমার সর্বাঙ্গে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। কড়া বিষ খাও। চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

শিপ্রা বললে, ব্র্যান্ডি অ্যান্ড চেসার-ই ভালো। আর আমার জন্য আলাদা করে পাঠিয়ো না। আমি ওরই থেকে এক-আধ চুমুক নেবোখন। খান অন্তর্ধান।

.

শিপ্রা ঝুঁকে নিচু হয়ে কীর্তির কানের লতিতে চুমো খেয়ে কানে কানে বলল, কাপড় ছাড়বে না, কীতা?

মিতা, এখন তুমিই আমার সব। আমি সব সয়ে নিয়ে সব করতে পারব। আমি হৃদয় দিয়ে বলছি, শিপি, আমার সব অবশতা কেটে গিয়েছে। আগরতলাতে আমি সত্যি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলুম, কিন্তু করিমগঞ্জে আমার বিভ্রান্তি অন্তর্ধান করল। দাঁড়াও বুঝিয়ে বলি; আগরতলাতে যেন শীতের ছায়া-ঢাকা দুপুরে হঠাৎ কে আমায় পিছন থেকে ধাক্কা মেরে হিম-শীতল জলে ফেলে দিল আর আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অবশ। এমন সময় দেখি, ওপারে বুড়ো গোছের লোক দিব্য সাঁতার কেটে কেটে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ইতোমধ্যে আমার হাত-পা নিজের থেকেই একটু-আধটু নড়াচড়া আরম্ভ করে দিয়েছে– রক্ত সঞ্চরণের প্রয়োজনবশত। আমি ভালো সাঁতার জানি, ডুবে মরতুম না নিশ্চয়ই। এবং অবশ্যই পত্র-পাঠ ফের ডাঙায় ফিরে আসতুম, কিন্তু ঠাণ্ডা জলের প্রতি বুড়োটার ওই ন্যক্কার-ভরা তাচ্ছিল্যে যেন আমার অজানতেই সর্বাঙ্গের জড়ত্ব ডাঙাশ মেরে তল্লাট-ছাড়া করে দিয়েছে। আম্মো ততক্ষণে পাই পাই করে মাঝ পুকুরে চক্কর মারছি আর ডুবসাঁতারে পুকুরের এপার-ওপারে মাকু চালাচ্ছি। করিমগঞ্জে গিয়ে সে-বুড়োটার কাহিনী শুনলুম। কিন্তু তুমি কি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলে? খবর গুজব যতই ছড়াচ্ছিল ততই তোমার কথা ভাবছিলুম।

শিপ্রা সদয় মুচকি হেসে বললে, প্রথমদিনটা বড় খারাপ গেল। দু কান বন্ধ করে রইলুম পাছে খবর গুজব শুনে ফেলি। তার পর কী যেন হল জানিনে। নিজে যেচে খান যে-জিমির কথা বলছিল তার কাছে গেলুম। ও-রকম ছেলে হয় না। সে-ই আমার রয়টার, টাস্ এবং মাতাহারি।

মাতাহারি? স্পাই?

ইনটেলিজেন্স্ ম্যান। আমি জানতুম না ট্রাঙ্ককল কর্মীদের ভিতর এত দোস্তি সমঝোতা থাকে। কোথায় জলপাইগুড়ি, কোথায় বনগাঁ শিলচর শিলঙ একে অন্যকে কখনও দেখেনি কিন্তু গলা চেনে নাম জানে। ওরা যে অনেক কথাবার্তা শুনতে পায় সে তো জানা কথা। জিমির এক বন্ধু ট্রাঙ্কে কাজ করে। সে ইভো-পাক বর্ডারের যত সব তাজা খবর জিমিকে জানাত। তাই জিমি আমার মাতাহারি x ১০০ = ০০

শেষটায় যখন শুনলুম ঢাকায় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে শয়তানের কারবার হেলেট লুস তখন সব ভয় কেটে গেল।

পড়ল পড়ল ওই তো ভয়
পড়ে গেলে সব-ই সয় ॥

কীর্তি বলল, কী আশ্চর্য! আমার বুড়োর কাহিনী ওই ট্রাঙ্ককল অপারেটার দোস্তি নিয়েই শুরু। ২৫ মার্চ বিকেলের দিকেই ঢাকার ট্রাঙ্ক কর্মীরা জেনে যায়, রাত্রেই আর্মি ক্র্যাক ডাউন ঢাকা, চাটগাঁ, আরও অনেক টাউনে একইসঙ্গে আরম্ভ হবে। আর্মির আপন বেতার, জোরালো ট্রানমিটার আছে, কিন্তু কাজের চাপ সামলে উঠতে না পারলে ওরা সাধারণ ট্রাঙ্কেরই শরণ নেয়। নিশ্চয়ই টাপেটোপে এবং পাঞ্জাবি ডায়লেটে ঢাকা থেকে অফিসাররা অন্যান্য শহরের অফিসারদের ইনস্ট্রাকশনস্ দিচ্ছিল ক্র্যাকডাউন সম্বন্ধে। কিন্তু ট্রাঙ্কের লোক আড়ি না পেতেও আপন কাজের খাতিরেই কয়েকটা চালু ভাষা বেশ শিখে ফেলে– আর পাঞ্জাবি তো তারা শোনে নিত্যি নিত্যি, সিভিল মিলিটারি দুই-ই।

আমি যে-বুড়োর বাহাদুরির কথা বলছিলুম, তিনি আদৌ বুড়ো নন। এমনকি প্রৌঢ়ও বলা চলে না। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসারদের একজন মেজর। তিনি কী করে খবর পেলেন সিলেটের হবিগঞ্জ টাউনে বসে, ২৫-এর সন্ধ্যায় যে, আজ রাত্রেই শুরু হবে বোঝাঁপড়া? ট্রাঙ্ক কর্মীর কল্যাণে। অবশ্য অন্য মাধ্যমও হয়তো ছিল।

বেঙ্গল রেজিমেন্টের একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার মেজর দত্ত তখন ছুটিতে, হবিগঞ্জ থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিঠি পাঠালেন, সেই রাত্রেই, লোক মারফত, খবর জানিয়ে; তিনি পরদিনই না-পাক্ খানদের খতম করার জন্য সিলেটের দিকে রওনা হবেন। দত্ত যোগ দেবেন কি?

দত্ত উত্তরে জানালেন, কাল ভোরেই তাঁর কাছে পৌঁছবেন।

কীর্তি অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে, যেন স্মরণে আনতে পারছে না, ভুলে-যাওয়া কোনওকিছু। মাঝে মাঝে তাকায় শিপ্রার চোখের গভীরে যেন সেখানেই পাবে রহস্যের সন্ধান। শেষটায় প্রত্যেকটি শব্দ, মনে হল যেন বাছাই করে করে ধীরে ধীরে বলল, শিপ্রা, আমার বিস্ময়ের অবধি নেই, অত্যাশ্চর্য অলৌকিক এরকম একটা ব্যাপার যে আদৌ সম্ভবে তারই সামনে আমি দিশেহারা, সৃষ্টিরহস্যের চেয়েও ঘনতর রহস্য যেন সৃষ্টির এক নগণ্য অংশ, ওই ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র হবিগঞ্জে– যার নাম তুমি-আমি কেউই কখনও শুনিনি, শুনতুমও না– অকস্মাৎ কুয়াশার যবনিকায় বৃহত্তম, খুদ সৃষ্টিরহস্যকে ঢেকে ফেলতে পারে, এ যে সর্ব তর্কশাস্ত্রে, ন্যায় মীমাংসাকে অর্থহীন করে দেয়; অংশ কি কখনও পূর্ণের চেয়ে বৃহত্তর হতে পারে। সিন্ধু-বিন্দু কি কখনও সিন্ধুর চেয়ে বিরাটতর কায়া ধারণ করতে পারে? ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় এই হবিগঞ্জের লোকটি কোন দুঃসাহসে একাই যুদ্ধঘোষণা করে দিল ইয়েহিয়া, তার ফৌজ এবং সবচেয়ে বাস্তব কঠিনতম শত্রু ওদের ট্যাঙ্ক, বমার প্লেন, সাঁজোয়া গাড়ি, বিরাট বিরাট কামানের বিরুদ্ধে? লোকটা তো গলির আধ-পাগলা পুচকে ছোঁড়াটার মতো নয়, যে নিত্যি নিত্যি রাস্তায় রাস্তায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্তালিন হিটলার মা কালী মৌলা আলির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ঘোষণা করে। দুজনার কাছ থেকে আমি ওর কথা শুনলুম। দুজনাই একমত : লোকটা অতিশয় শান্ত প্রকৃতির, স্থির ধীর। তার দুর্দমনীয় চঞ্চলতা প্রকাশ পায় সুন্দুমাত্র তার ঘন ঘন ঠা ঠা উচ্চহাস্যে– যেন সে সর্বক্ষণ তক্কে তক্কে আছে ঠা ঠা করার সুযোগের তরে।… মেজর সে। সে কি জানে না, ইয়েহিয়ার শক্তি কতখানি? পুব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা কত, কোন কোন শহরে আছে ক্যান্টনমেন্ট, ট্যাঙ্ক বোমারু জঙ্গিবিমান সংখ্যা সব– সব তার নখদর্পণে, সে যে তাদেরই একজন; সে জানবে না? সব জেনেশুনে সে হয়ে পড়ল একা, একান্ত একা ছিটকে পড়ল সেই সর্বগ্রাসী অসংখ্যের মাঝ থেকে? যেন গ্রহচ্যুত নক্ষত্রের মতো ক্ষিপ্ত বেগে অদৃশ্য অজানার পানে ধেয়ে ধেয়ে জ্বলে পুড়ে ছাই-ভস্ম খাকধুলোতে–না– নিঃশেষ নাস্তিতে পরিণত হতে?

কোন মামদো-পিশাচ চাপল তার স্কন্ধে যে হঠাৎ উদোম ভূতের নৃত্য আরম্ভ করে দিল সে!

জানো শিপ্রা, বরিশালের খাজা বাঙাল আমার এক ক্লাসফ্রেন্ড বিপদে পড়লেই, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করত,

কী কল পাতাইছ তুমি?
বিনা বাইদ্দে নাচি আমি।

হ্যাঁ, এ ভূতের বাদ্যের সঙ্গতও নেই। কোথায় মৃদঙ্গ, জগঝম্প, ঢক্কা-ডিড্ডিম? এমনকি একটা বাঁশের বাঁশি– অর্থাৎ একটা রাইফেলও নেই কারও কাছে।

বললুম না, অজানা অদৃশ্যের উদ্দেশে?

শেখ সায়েব, আওয়ামী লীগের নেতারা সব কোথায় কে জানে?

কোনওপ্রকারের নির্দেশ মেজর পাননি। ইনি যে পদক্ষেপ করলেন সেটা পরে ওঁদের সম্মতি পাবে কি যদি, অবশ্য, তাঁরা স্বয়ং কোনও নিরাপদ আশ্রয় পান।

বরিশাল-খুলনা থেকে সিলেট, কক্সবাজার থেকে দিনাজপুর এই বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে এমন কোনও সংযোগ ব্যবস্থা নেই যে, সংবাদ আদান-প্রদান মারফত ইয়েহিয়ার বর্বরতার ফলে কোন জায়গায় কী প্রকারের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল সে-সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হওয়া যায়।

তিন শ্রেণির বাঙালি রাইফেলটা অন্তত চালাতে পারে

(ক) বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব অফিসার সেপাই বাঙালি

(খ) আধা-মিলিটারি বেঙ্গল রাইফেলস

(গ) পুলিশের বেশকিছু সংখ্যা

এরা কি মেজরের পন্থা অবলম্বন করবে? যদি না করে তবে যেসব কিশোর-যুবক তাঁর চতুর্দিকে জড়ো হবে, রাইফেল চালানোর ওই যৎসামান্য ট্রেনিংটুকুই-বা ওদের দেবে কে?

এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, উপর থেকে নির্দেশ না-পাওয়া সত্ত্বেও গ্রামের লোক সাড়া দেবে কি?

কীর্তি দম নিয়ে বললে, এরকম দফে দফে প্রশ্নের সংখ্যা অগুনতি। মোদ্দা কথা : অর্গেনাইজেশন নেই, নির্দেশ নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই।

আমার লেটেস্ট খবর দুই মেজর কয়েকশো রাইফেল নিয়ে এগুচ্ছেন শ্রীমঙ্গলের দিকে। সেখানে নাকি একঝাঁক খান রয়েছে।

তার পর কাল ২৭ মার্চ চাটগাঁ থেকে আমাদের এই মেজরেরই মতো সমস্ত দায়িত্ব আপন স্কন্ধে নিয়ে মেজর জিয়া স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন, চাটগাঁ বেতার মারফত। এখন দেখা যাক বাদবাকি দেশটা কীভাবে সাড়া দেয়।

শিপ্রা বলল, তুমি যেসব সমস্যার অসম্পূর্ণ ফিরিস্তি দিলে ঠিক ওইগুলোই নিয়ে মেজর বিব্রত হয়েছেন, এমনতরো না-ও হতে পারে। যারা তোমাকে বিবরণ দিয়েছে তারা পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে তাদের যুক্তি বুদ্ধি অনুযায়ী এসব প্রশ্ন তুলেছে। এই সমস্যাগুলোকে মেজরকে বিব্রত করুক আর না-ই করুক, তাঁর অন্য সমস্যা থাক আর না-ই থাক, প্রশ্নগুলোর কিন্তু একটা বাস্তব মূল্য আছে। এগুলোতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে, অন্তত হবিগঞ্জ অঞ্চলের সাধারণ জনের চিন্তাধারা, মনের অবস্থা। আমাদের কাছে তার মূল্য প্রচুর।

কীর্তি মুগ্ধ হয়ে বললে, মিতা, আমি কি বৃথাই বলি তুমি তুলনাহীনা। আমি শুধু সমস্যা আর প্রশ্নগুলোকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম, তোমার অন্তর্দৃষ্টি গিয়েছে সেগুলোর পটভূমির দিকে তীক্ষ্ণতম ক্ষুরধার নিয়ে।… বেচারী রবি কবি! তাঁকে যেতে হয়েছিল তুলনাহীনার সন্ধানে সাতসমুদ্র পেরিয়ে আর্জেনটিনা না কোথায় যেন।

সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।

আর আমি কী অবিশ্বাস্য ভাগ্যবান।

শিপ্রা হেসে বললে, আর আমি যদি বলি, আমি ভাগ্যবান, আমিও দেখেছি সমুদ্র না পেরিয়ে–

অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।

এমন সময় ঘরটাকে দাপটে খান খান করে খান সাহেবের প্রবেশ।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললে, মদ্যাদি যখন আরেক কদম এগুলেই সম্পূর্ণ বর্জন করে ফেলবে। তখন মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে নাও না, এই বেলাই? আমার মতো সরু পাবে না। খুদ আরব মুলুকেও না। পাকি একটা ঘণ্টা আমি বেতারযন্ত্রটার কান মলে মলে, বিবিসি কলোন ভিয়েনা ছুঁ মারার সঙ্গে সঙ্গে সাপটে দিলুম আধা বোতল গর্ডন। আর হেথায় হেরি, ফুলবাবু মশাই আর পটের বিবিটি কড়ে আঙুল পরিমাণ গেলাসটি শেষ করতে পারেননি। একেই কি বলে সভ্যতা? হায় শ্রীমধু!… শোনো আমি এসেছি তোমাদের বাইরে নিয়ে যেতে। সত্যি বলছি এরকম বন্ধ ঘরের অবশ বাতাসে গুজুর গুজুর করতে তোমাদের গুজুর গুজুরের উদ্দেশ্যই সফল হবে না। মুক্তি সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হলে চাই মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস। আরেকটা তত্ত্বকথা বলি, তোমরা মদ ছেড়ে দিলেই বাঙালিরা রাতারাতি পাঞ্জাবিদের হাইকোর্ট দেখাতে পারবে না, আর মাত্রা বাড়ালেও লীগ তাদের আশা ভরসা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে না। অ্যাব্বড়া যুদ্ধটা যখন চার্চিল চালালো সে কি তখন নির্জলা উপবাস করেছিল? হ্যাঁ, নির্জলা অতি অবশ্য বটে; নির্জলা হুইস্কি ওই সময়েই মাঝে-মধ্যে সে টেনেছিল। রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না? তৈরি হও এখখুনি।

ঘর থেকে বেরুতেই দেখে জিমি দাঁড়িয়ে আছে।

খান তার গতানুগতিক সম্ভাষণ করার পূর্বেই জিমি নিচু গলায় বললে, সব কথা বলতে গেলে এখানে দাঁড়িয়ে হয় না। কাল একজন নতুন গেস্ট এসেছে হোটেলে। আমাকে অ্যাংলো জেনে ড্রিংক অফার করল, দোস্তি জমাবার তরে। তার ইংরেজি উচ্চারণ থেকে হানড্রেড পার্সেন্ট শ্যোর লোকটা পাঞ্জাবি। কিন্তু কোন পাঞ্জাবের? অথচ হোটেলের খাতাতে লিখেছে, মিরাট। আমার কীরকম যেন ধোকা লাগছে। কারণটা হয়তো আপনার কাছে এপিল করবে না, তবু বলি। লোকটা যদি আর পাঁচটা টুরিস্টের মতো আমাকে সোজাসুজি শুধাত, ইন্ডো-পাক বর্ডার কতদূরে, কদুর অবধি যাওয়া যায়, রেফুজিরা ভিড় লাগায়নি তো রাস্তায়, তা হলে আমার মনে ধোকা লাগত না। দিস জনি সোজা পথ না ধরে বিস্তর বিটিং এবাউট দি বুশ করে করে পৌঁছল চেরাপুঞ্জিতে– কী তার আগ্রহ, কত বৃষ্টিপাত, বছরে কদিন বৃষ্টি হয়, আর যত সব রাবিশ প্রশ্ন। তার পরও বর্ডারের পথ ধরল না। ফের আশ-কথা পাশ-কথা। তার পর এল বর্ডারের টপিক। আমি ইচ্ছা করেই ভাসা ভাসা উত্তর দিতে লাগলুম। কখনও-বা রহস্যময় উত্তর ফিসফিস করে। স্পষ্ট দেখলুম তার ক্যোরিসিটি দারুণ উত্তেজিত হয়েছে। মুখোশ খসে গেছে। হুস হুস করে একটার পর একটা প্রশ্ন শুধাতে লাগল। মাঝেসাঝে বাজে প্রশ্নের ভেজাল দিয়ে আসল উদ্দেশ্য কামুক্লাজ করতে ভুলে গিয়েছে। তার প্রশ্নের রকমারি থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম ব্যাটা এখানে আসার আগেই সবকিছুর সন্ধান নিয়ে এসেছে। এখন শুধু লেটেস্ট অবস্থাটা জানতে চায়।

আরেকটা কথা : এখানে নেবেই চেল্লাচেল্লি, পথে তার ট্রানজিস্টার খোয়া গিয়েছে। মুজিক ভিন্ন সে দু দণ্ড বাঁচতে পারে না। আকে সক্কলের পয়লাই শুধাল, এখানে ট্রানজিসটার পাওয়া যাবে তো, দোকান কোথায়? ছুটল টি না খেয়েই। সঙ্গে সঙ্গে আমি বড়য়াকে ফোনে আমার সন্দেহের কথা জানালুম। বড়য়া তো একদম শ্যোর, লোকটা ওয়েস্ট পাঞ্জাবের। এবারে শুনুন মজাটা। যতবার আমি তার কামরার বারান্দা দিয়ে গিয়েছি কান পেতে শুনেছি, নো, নো, নো মুজিক এটোল। লো ভলুমে শুনছে নজ। এনি উয়ে, টক্‌। মুজিক ককখনও না।

আজ আমাকে শুধাচ্ছিল, অত উঁচু অ্যারিয়েল কার? তবে কি বেতারকর্মী? তবে

হঠাৎ জিমি থেমে গেল। বললে, ওই আসছে চিড়িয়াটি। আপনি পরিচয় না করতে চাইলে, স্যার কেটে পড়ন। ও সক্কলের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চায়। দু একবার স্নাবড়ও হয়েছে। অভ্যাস বদলায়নি।

চিড়িয়া এসেই অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ বিরক্তির সুরে বললেন, বাজে ট্রানজিসটার। আচ্ছা, ওই মি. বড়য়া, সে এটার দাম কেটে একটা পুরো পাক্কা রেডিয়ো সেট দেবে না, ওইরকম স্কাই হাই এরিয়েলসহ?

আমার তো মনে হয় না, মি. কুরেশি। (বাজে কথা। কিন্তু জিমি বড়ুয়ার স্বার্থ দেখছে)

কেন? হোটেল বলতে পারে না, আমি রেসপেকটেবল গেস্ট? ওর মেশিন বিগড়োইনি।

আমি পাতি রিসেপশনিস্ট। বরঞ্চ ম্যানেজার পারেন। (জিমি জানে, বেটা আখেরে বড় রেডিয়ো কিনবেই।)

খান মাঝখানে নাক গলিয়ে বললে, আপনাদের কথার মাঝখানে বাটু ইন করছি বলে অপরাধ নেবেন না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি টুরিস্ট। হেথা হোথা ঘুরে বেড়াবেন। ট্রানজিসটারটা কাজে লাগবে আজকাল প্রতি বুলেটিনে গরম গরম খবর দিচ্ছে। আর বাড়ির বড় সেটটা দিয়ে শুনবেন রাত্রে ফরেন, দুবলা স্টেশন।

চিড়িয়া সোৎসাহে খানের সঙ্গে জোর ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যান্ডশেক করে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলুম। আমার নাম রহমান কুরেশি

জিমি বিস্মিত হল, খান তখখুনি নিজের পরিচয় দিল না কেন– যেটা স্বাভাবিক এটিকেট।

খান তখন কুরেশিকে বলছে, বা শ্যোরলি আই মেট ইউ এট লাহোর, প্রেসক্লাবে– এই ফেব্রুয়ারি, না জানুয়ারিতে অর্থাৎ হাইজ্যাকিঙের আগে। আপনার গলায় ছিল ভারি মজার একটা টাই।

এক মিলিমিটারের শতাংশের এক অংশ টাক লোকটা যেন বেসামাল হল। একটু জোর গলায় বললে, অসম্ভব। আমি কখনও পাকিস্তান যাইনি। আরও সামান্য গলা চড়িয়ে আমি ইন্ডিয়ার সিটজেন বাই বার্থ। উত্তরপ্রদেশ।

খান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, আই এম স্যরি, অত্যন্ত দুঃখিত…, অতঃপর তার এক্কেবারে নিজস্ব উর্দুতে–বেয়াদবি মাফ করেংগাহৈ।

কুরেশি উর্দুতে তুফান তুলে টর্নেডোতে পৌঁছবার পূর্বেই খান ইংরেজিতে ফিরে গিয়ে বলল, আমি উর্দু জানি না তাই বলে কি কোনটা লক্ষ্ণৌয়ের উর্দু আর কোনটা লাহোরের উর্দু তার তফাত জানিনে! আমি মুগ্ম মুসল্লম বানাতে জানিনে, তাই বলে কোনটা সুখাদ্য হয়েছে আর কোনটা রদ্দি তা-ও জানিনে! লাহোরের কারও মুখে এমনকি স্যার ইকবালের ভাতিজার মুখেও এমন চোস্ত উর্দু শুনিনি।

থ্যাঙ্কু, খুদা হাফিজ বলে কুরেশি ঈষৎদ্রুতপদেই স্থান ত্যাগ করলেন। জিমি একটু গলা চড়িয়ে বললে, আমি কি বড়ুয়াকে ফোন করব আপনার ট্রানজিসটার বিষয়ে?

কুরেশি শুনেও শুনল না।

.

খান একরকম জোর করে দুই ইয়ারকে নিয়ে গেল মরেলল্লাতে। বললে, এ দোকানের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের বেয়াত্রিচের দেশ-ভাই, কিন্তু আভিজাত্যে বেয়াত্রিচের হেঁটোর বয়সী। মানুষের হাতে তৈরি অপ্রাকৃতিক লোকটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শিপ্রার খুবই পছন্দ হল। এমপরিয়ামে যদিও শিপ্রা গেল অনিচ্ছায় তবু আসামের পাত সিল্ক জীবনে সে এই দেখল প্রথম। খান শব্দতত্ত্ব ঝেড়ে বলল, আমার চেয়েও যারা অগা তারা বলে পট্টবস্ত্র– সিল্ক- পাট থেকে তৈরি হয়। আমার মনে হয় এই পাত শব্দটা অনেক অহমিয়া পাট উচ্চারণ করে বলে ওটার শুদ্ধি করে পণ্ডিতেরা ওর নাম পট্টবস্ত্র দিয়েছেন।

বড়বাজারও দেখাল খান, বললে, এই দেখ, মাতৃক সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ! তাবৎ দোকানিই খাসিয়া মেয়েছেলে। ব্যাটাছেলেগুলো বিড়ি ফোঁকে, জুয়ো খেলে আর প্রতি সন্ধ্যায় মদ খেয়ে মাতলামো করে, বউয়ের পয়সায়। তবে হ্যাঁ, বউ যদি কোনও ইয়ারের সঙ্গে রাত্রিবাস করে আসে– কত পার্সেন্ট করে জানিনে, আমার অতি সোহাগের খাসিয়া মেয়েদের সম্বন্ধে আমি অপ্রিয় কোনও কথা বলতে চাইনে– তবে স্বামীটির টু ফাঁ করার সামাজিক হক্ক নেই। অত্যুত্তম ব্যবস্থা।

শিপ্রা বললে, স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক বাবদে আজ পর্যন্ত কোনও সামাজিক ব্যবস্থারই প্রশংসা তো করা যায়ই না, গুণী-জ্ঞানীরা স্বীকৃতি পর্যন্ত দেননি। তাই বিশ্বজনের মতে পৃথিবীতে মাত্র যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রবাদ আছে সেটি বিবাহ একমাত্র জুয়োর বাজি খেলা (গ্যামলিং) যাতে দু পক্ষই হেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুধিষ্ঠির তো জুয়ো খেলায় সর্বস্ব হারালেন। এর পর তার জুয়ো খেলা বন্ধ– বাজি ধরার স্টেক একটা কানাকড়িও নেই। দুর্যোধন ছোকরা চালাক। সে দিয়ে দিল দ্রৌপদীকে ফেরত– সব জুয়ো যখন বন্ধ তখন চলুক ওই মোক্ষম জুয়োটি, যেখানে দুই পক্ষই হারে। এখানে একদিকে একজন দ্রৌপদী, অন্যদিকে পাঁচজন।

খান শুধল, পাঁচজন কেন? আমি তো শুনেছি, তিনি অর্জুনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, যে কারণে তার পতন হল। অর্জুন অন্তত লুজার নন।

শিপ্রা বললে, আর অন্য মতে তিনি যে গোপনে কর্ণকে ভালোবাসতেন সেটা জানো না? যে মোটর ড্রাইভারের ছেলে কর্ণ (তখনও কুন্তী ছাড়া কেউই জানে না, কর্ণ আসলে যুধিষ্ঠিরেরও অগ্রজ) প্রকাশ্য রাজসভায় ডাচেস্ বল, এমপ্রেস বল, দ্রৌপদীকে সক্কলের চেয়ে এমনকি দুঃশাসনের চেয়েও বেশি অপমান করেছিল রূঢ় চণ্ডালের ভাষায়। বাকর্ষণ করাতে দুঃশাসনকে বলা যেতে পারে বর্বর, কিন্তু ভাষা দিয়ে অপমান করাতে কর্ণ ইতর, মিন। ভাষার মার মোক্ষমতম মার। অতএব দ্রৌপদীও লুজার। এবং সবচেয়ে বেশি লুজার। কারণ দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবকে কস্মিনকালেও অপমান করেননি।

এবারে কীর্তি মুখ খুলল, বিস্ময়ের ভান করে বললে, অতাই বুঝি কেউ কেউ বিয়ে গ্যাম্বলটাকে ডরায়!

.

০৭.

টোকা দিয়েই কটেজে ঢুকেছিল। কিন্তু হাবভাব দেখেই বোঝা গেল বিলক্ষণ উত্তেজিত।

শিপ্রা বলল, এক কাপ চা?

থ্যাঙ্কু মাদাম। খানের দিকে তাকিয়ে বলল, মি. কুরেশি মিসিং।

খান ইচ্ছা করেই শিপ্রাদের কিছু বলেনি– কুরেশির সঙ্গে তার প্রেমালাপ সম্বন্ধে। জিমিকে বলল, দাঁড়াও, এঁরা ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানেন না। বলে নিই। বলা শেষ হলে কীর্তি মন্তব্য করল, মিসিং নয় এবসকভিই— পালিয়েছে।

জিমি বললে, সেই যে আপনার সঙ্গে কথা প্রায় শেষ না করে কুরেশি ঘরে চলে গেলেন তার পর লাঞ্চ, টিতেও এলেন না। তা সে মেলাই টুরিস্ট আকছারই দু-তিনটে খাবার পর পর মিস্ করে যান। টির সময় বেয়ারা অনেকক্ষণ ধরে টোকা দিল– সাড়া দিল না। ডিনারে এল না। সন্ধ্যা থেকে দুটো কামরাই অন্ধকার। রাত এগারোটায় কিন্তু একটা বেয়ারা দেখতে পেল ঘরে আলো জ্বলছে। টোকা দিয়ে সাড়া পেল না। সমস্ত রাত কিন্তু আলো জ্বলল। সংক্ষেপে বলছি, আজ সকাল দশটায় বেয়ারাদের সন্দেহে ম্যানেজার পুলিশ ডেকেছেন। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল সুট মুট শার্ট টাই শেভিঙের জিনিস সব বিছানার উপর ছড়ানো, ট্রানজিসটারও রয়েছে। তখন কে যেন লক্ষ করল, নেই মাত্র একটি জিনিস– সুটকেসটা, অর্থাৎ শূন্য সুটকেসটা মাত্র নিয়ে লোকটা দুপুররাতে উধাও হয়েছে। কাল রাতে আমার ডিউটি ছিল না। তাই পুলিশ আমাকে কিছু শুধোয়নি। শুধোলে কী বলব, মি. খান?

সত্যি কথা বলবে। সে যেসব প্রশ্ন করেছিল আর তোমার উত্তর যতখানি স্মরণে আনতে পার বলবে। তোমার মনে কী সন্দেহ হয়েছিল অথবা নিজের কোনও মন্তব্য প্রকাশ করবে না, পুলিশ সরাসরি জিগ্যেস না করলে। সর্বশেষে বলবে, তোমার যতদূর জানা মি. খানের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আর কেউ তাকে দেখেনি। পুলিশ আমার কাছে আসবে। আমিও সরাসরি যে কটি কথা হয়েছিল বলব। আমাকে জিগ্যেস না করলেও আমি আমার সন্দেহের কথা বললে বলতেও পারি। তুমি কোনও চিন্তা করো না, জিমি। আমি আমার ওয়ার্ড অব অনার দিচ্ছি তোমাকে, তোমার কেশাগ্রটুকুও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে ডিউটিতে ফিরে যাও।

জিমি চলে যেতেই খান বললে, জিমিকে বলিনি, এখন বলি, আমি লাহোরের প্রেস ক্লাবে কখনও যাইনি। ওটা প্যোর ব্লাফ।

শিপ্রা : তা হলে ঠিক ওইটেই বললে কেন?

কীর্তি : সোজা উত্তর : প্রেসক্লাবে যায় নুজ-মেন এবং খবরের সন্ধানে বিস্তর পাই। নেটিভ লাহোরের পাঞ্জাবি স্পাই যায় বিদেশি সংবাদদাতাদের পাম্প করতে। লোকটা যদি সত্যই স্পাই হয় তা হলে, তা হলে হয়তো সামান্য একটু বেসামাল হবে।

শিপ্রা : কিন্তু মজাদার টাই?

খান : ওর গলায় ছিল যে টাইটা সেটার মতো বিকট টাই আমি কখনও বাস্তবে বা ফিল্মেও দেখিনি। শিলঙের মতো আন্ডার ডেভেলাপড় শহরের হোটেলে-ক্লাবে অর্ধসভ্য ইংরেজ এখনও পরে এডওয়ার্ডিয়ান সোলেস টাই। সেটা দেখার পরও যে খলিফে ওরকমের আচাভূয়া টাই পরে, তার স্টকে পাদ্রি সায়েবদের পানসে টাই থাকার কথা নয়। এটাও ব্লাফ, আগের ব্লাফটা জোরদার করার জন্য।

কীর্তি : তার প্রতিক্রিয়ায় সে তার ন্যাশনালিটি নিয়ে চেল্লাচেল্লি করতে লাগল। আর তুই তখন নিশ্চয়ই খুব বেকুব বনে গেলি? না?

শিপ্রা : এ কী কথা। সে তো তখন খুশি যে তার টেসট সফল হয়েছে।

খান : না, কীর্তির অনুমানটাই ঠিক। এরকম একটা থার্ড ক্লাস টেস্টের মুখে নেহাত কাঁচা স্পাইও বিচলিত হয় না। সে যে স্পাই এটা আমি তখন আদৌ ধরে নিইনি। রোমান্টিক জিমি হয়তো ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখে ধরে নিয়েছে লোকটা স্পাই আর যখন সর্বত্র পা স্পাই ম ম করছে। তাই ব্যাটার চেল্লাচেল্লি শুনে আমি প্রথমটা বেকুব বনে গিয়েছিলুম। তখন বুঝলুম, একমাত্র গাড়ল পাঞ্জাবিদের মধ্যে গাড়লস্য গাড়লই কল্পনা করতে পারে, সে পার্ফেক্ট স্পাই এবং শুধু তাই নয়, আর পাঁচটা, জাতভাই, গাড়লের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সমর্থ হয় যে, সে স্পাইরানি মাতাহারির জারজ সন্তান কারণ তার উর্দু অ্যাসন চোস্ত লখুনওয়ি যে এখনও বাপের সে-সুপুত্ত্বর পয়দা হয়নি যে ঠাহর করতে পারবে, সে আম্মাজানের গব্ব থেকে তেড়ে পাঞ্জাবি বুলির ফোয়ারা ছুটিয়েছে শালিমার বাগ-এর বেবাক ফোয়ারা এক জোট করে।… খান নিজের রসিকতায় নিজেই খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করেছে। শেষটায় সামলে নিয়ে বলল, লোকটা যেই না আমার ইচ্ছাকৃত বিকৃততর খাস কলকাত্তাই উর্দুর দুটিমাত্র লজো শুনেছে অমনি ছোটাল তার উর্দু- সে যে উত্তর প্রদেশের প্রকৃত সন্তান সেইটে সপ্রমাণ করার জন্য। আর বলব কী দিদি, সেটা শুনলে আমাদের পাড়ার পর্দানশিন কুলীন ঠাকরুন পদিপিসি পর্যন্ত বলে উঠত, এ ম্যা– ভদ্রলোকের ছেলে, মাইরি, কতা কইচে ডাইভার সদ্দারজির মতো নোকের সামনে লজ্জা করে না! অতিশয় নির্ভেজাল অমৃতসর-লাহোর-মার্কা পাঞ্জাবি উর্দু-প্লাস্টিকের পাতর-বাটি! সুনীতি চট্টো রেকর্ডে তুলে রাখতেন। আমাদের পাড়াতে এক বাঙাল ভদ্রলোক আছেন–তুই তো চিনিস রসরাজ ভশচায–ত্রিশ বছর ধরে। প্রায়ই বলতে শোনা যায় রারী (রাঢ়ী) দ্যাশে মাক্যা থাকা দ্যাশের আপন ব্বাসাটা (ভাষাটা) এক্কেবারে পাউরি গেছি, (ভুলে গিয়েছি, পাসরি গেছি)। এমনই আবেস্তা (অবস্থা) ওংকা (এখন) গিরিনি (গৃহিণী) পইরজন্ত (পর্যন্ত) আমার বিসুর্দ রারী ধ্বসা (বিশুদ্ধ রাঢ়ী ভাষা) বুস্তা পারইন না (বুঝতে পারেন না)। মি. কুরেশি উর্দু বলার সময় হুবহু ভশচাযের আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আপন উত্তর প্রদেশীয়ত্ব সপ্রমাণ করার জন্য লেগেছিলেন ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুলের চর্বি খেয়ে।

এমন সময় জিমি এসে বললে, পুলিশ আপনার কাছে আসতে চায়, না আপনি যাবেন।

খান বললে, আমিই যাচ্ছি। থাকত আজ আই জি তালেবর দত্ত, :, আমাকে কেন, কাউকে কোনও প্রশ্ন না শুধিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, ক্যা করে আপন হাতে পাকড়াত হারামিকে।

খান চলে গেলে শিপ্রা শুধাল, খান লাহোরিটাকে টেস্ট না করে অগাটার চেয়ে অগা সেজে, ধীরে ধীরে খাঁটি মুসলমানত্ব জাহির করে সেটা করতে পারত সে কোনও ভান না করে, এবং অতি অনায়াসে, কারণ তুমিই বলেছ, সে ইসলামের ইতিহাস বহু বৎসর ধরে পড়েছে এবং মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই, তাই ইয়েহিয়া তার বড় ভাই সাহেব মির্জা সেটা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। তার পর লাহোরের মিঞাজিকে সাপ্লাই করত ইন্ডিয়া সম্বন্ধে রগরগে বোগাস ইনসাইড় ইনফরমেশন, এবং পাম্প করত তার পেট থেকে পশ্চিম পাক সম্বন্ধে যতখানি মাল বের করতে পারে, এবং সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট কনটাক্ট রাখার নাম করে ভারতে পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানি স্পাইদের যে-কটা নাম সংগ্রহ করতে পারে। দুচ্ছাই, ওসব আবার বলি কেন?– লারি কোম্পানিকে সে যে-উদ্দেশ্য নিয়ে তেলিয়েছিল।

কীর্তি বললে, ওরকম একটা গণ্ডমূর্খকে কোনও দেশ যে স্পাই করে পাঠাতে পারে, সেটা বেচারী অনুমান করবে কী করে? সে ভেবেছিল, একটুখানি ন্যাজ খেলানোর পর, ধরবে সাপের ন্যাজটা। কিন্তু পয়লা কোপেই বেরিয়ে এল সাপের বদলে কেঁচো। তবে মিঞা খুব একটা কাজে লাগতেন বলে মনে হয় না। ওকে হয়তো পাঠিয়েছিল জেনে-শুনে যে সে ধরা পড়বেই। ভারতের কদিন লাগে ওকে পাকড়াতে, পাকড়ে ওকে নিয়ে কী করে– অর্থাৎ ওর নাম করে, কিংবা ওকে বাধ্য করে বোগাস খবর পাঠায় কি না, ওকে কিনে ফেলে নিজেদের স্পাই করে পশ্চিম পাকের এমন জায়গায় পাঠায় কি না, যেখানে সে পরিচিত নয়, এবং আরও অনেক কিছু– এবং তার থেকে বিচার করবে ইন্ডিয়ান অ্যান্টি-শাই বিভাগ কতখানি চালাক, কতখানি আপ-টু-ডেট।

শিপ্রা : ঢাকা বেতার এখন খবর দেবে। কী বলে শুনি।

প্রধান খবর ছিল, হামিদুল হক বিবৃতি দিয়েছেন, এটা যুদ্ধ নয়, হত্যা নয়, বর্বরতাও নয়। সামান্য অপারেশন। তাতে দু চারজন লোক মরবেই–

কীর্তি : মাই গড!

–যারা আইন মেনে চলছে আর্মি তাদের কোনও ক্ষতি তো করছেই না, বরঞ্চ তাদের নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশ লীগ শয়তানদের গুণ্ডামি থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখন যা লুট রাহাজানি খুন হচ্ছে সেসব করছে লীগের লোক। গ্রামের লোক ভারি খুশি, আর্মি অপারেশনের খবর শুনে আমার কাছে গাঁয়ের সব খবর আসে এবং সর্বপ্রকারের কটুকাটব্য, জলজ্যান্ত মিথ্যা ভাষণ। সংক্ষেপে বলতে গেলে আয়নার উল্টো ছবির মতো ইয়েহিয়া-টিক্কার সপক্ষে অনবদ্য একখানা মাস্টারপিস।

শিপ্রা স্তম্ভিত হয়ে শুনল। সে এমনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে যে গ্যোবেলস্-এর তুলনা পর্যন্ত তার অবশ মনে সঞ্চারিত হল না।

কীর্তি অতখানি না। শুধাল, এই হটি কে চেন? ইনি বাঙালি মুসলমান। ইনি এবং একজন বাঙালি হিন্দু দুজনাতে পার্টিশনের পূর্বে বর্মা থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য ফান্ড থেকে অন্তত লাখ তিরিশেক টাকা তছরূপ, চুরি, যা ইচ্ছে, বল করাতে– ওদের নামে গ্রেফতারির হুকুম বেরোয়। ঠিক ওই সময় পার্টিশন হল; হক ঢাকা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। খুব সম্ভব এখনও তার নামে কলকাতায় এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারি আছে; এই চব্বিশ বছরে তিনি ভারতে পদার্পণ করেননি। সেখানে রাজনীতির খেলাধুলোতে সুবিধে না করতে পেরে রাজনৈতিক বনবাসে চলে গেলেন– তখনকার মতো। বর্মার কড়ি দিয়ে একটা দৈনিক খবরের কাগজ কিনে রেখেছিলেন; সেইটে দিয়ে আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াতে লাগলেন। অনেকটা–

থামলে কেন?

অল রাইট– অনেকটা গোয়িং ইনটু টেম্পরারি রিটায়ারমেন্ট লাইক এন ওড় প্রসটিটুট, বিকাম এ হোল-টাইম, প্রফেশনাল পিমপ অ্যানড় এওয়েট এ স্টেজ-ব্যাক অ্যাজ দি সো ওনার অব্‌ ফুল-ফ্লেজেড় ব্রথেলস্।

খানের প্রবেশ।

খান : চতুর্দিকে পুলিশ ছড়িয়ে পড়েছে; হুলিয়া বেরিয়েছে মিঞাকে পাকড়াবার জন্য।

কীর্তি : চতুর্দিকে কেন? ও তো এখন সিধে ধাওয়া করবে সবচেয়ে নিকটের পাক বর্ডারের দিকে। এবং যাবে চেরাপুঞ্জির ঘুরতি পথে। জিমিকে যে পই পই করে চেরাপুঞ্জির খবর জিগ্যেস করেছিল সেটা শুধু কামুফ্লাজ নয়। পশ্চাদপসরণ– লাইন অব রিট্রিট সম্বন্ধেও ওকিবহাল হওয়ার প্রচেষ্টা তাতে ছিল। এবং সে সোজা সরকারি সড়কও ধরবে না। খাসিয়ারা অতিথি-বৎসল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর হয়ে চেরাপুঞ্জি একপাশে রেখে কী একটা জায়গার নাম, কী যেন, উঠনি–মহাদেরে উঠনি না কী যেন সেটা অপরিহার্য কয়েকশো ধাপ সান-বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে চেরাপুঞ্জি অঞ্চলের উচ্চতা থেকে নামবে কী যেন একটা ছোট্ট খাসিয়া গ্রামে কী এক পুঞ্জি– সেখান থেকে কোম্পানিগঞ্জ, ভুলাগঞ্জ, জন্তিয়ার ওত্রাইটার পথ খুবই সহজ। চেপোস্টটার নাম বোধহয় ডাউঁকি। সে নিশ্চয়ই সেখানে যাবে না। ওখানেও পা-সিলেটে ঢোকার তরে বিস্তর চোরাবাজারের গুপ্তিপথ রয়েছে।… স্পাই মাস্টার যে রকম ভয় পেয়েছে আর অ্যাক্কেলটিও গুড়ম, সে তার বর্তমান মুক্ত-কচ্ছাবস্থায় দু কান-কাটার মতো সদম্ভে গৌহাটির অষ্টপ্রহর গগ করা সরকারি বে-সরকারি কোনও পথই ধরতে পারে না।

খান শুধাল, ম্যাপটি যোগাড় করলে কোত্থেকে?

কীর্তি, তৃপ্ত বদনে : হাজি সকল কাজের কাজী; নিজের থেকেই দিয়েছিল, টু মাইল টু এন ইঞ্চ ম্যাপগুলো।

খান : তার পর প্রশ্ন উঠল, লোকটা সবকিছু ফেলে রেখে সুদুমাত্র খালি সুটকেসটা নিয়ে গেল কেন? এমনকি ট্রানজিসটারও ফেলে গেল কেন? অন্তত ডাউঁকি বর্ডারের অবস্থাটা তো গৌহাটি স্টেশন থেকে শুনতে পেত।

কীর্তি : উত্তর অতি সরল। সুটকেসটাতে ছিল ফস বটম গুপ্তি-তলা। সেখানে আর কিছু না থাক, ম্যাপ-ট্যাপ কম্পাস এমনকি হোট ট্রান্সমিটার থাকাও অসম্ভব নয়। কামরার ভিতর সেগুলো নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। অতএব পয়লা মোকাতেই ওটা সে ফেলে দেবে যে কোনও জঙলা একটা খাদে তার অভাব কী এখানে। তোকে যদি কখনও মার্ডার করি তবে শিলঙে ডেকয় করে এনে। লাশ গায়েব করার তরে আইডিয়াল প্রলোভিনী এখানকার খাদগুলো। লেকের পাশ দিয়ে যদি যায় তবে সেটা ব্যাড সেকেন্ড। কী মূর্খ লোকটা সেটা আরও বোঝা গেল ট্রানজিসটার সঙ্গে নেয়নি বলে।

শিপ্রা বললে, অনুমান করতে পারছি।

খান বললে, আমি সদাই ওয়াটসন। রহস্য সমাধান হয়ে যাওয়ার পরও সে-সমাধানের কৈশলও তার কাছে রহস্যময় থেকে যায়।

কীর্তি বললে, নিয়ে গেলে পুলিশের হুলিয়াতে অন্তত থাকত সম্ভবত পলাতকের হাতে ট্রানজিসটার আছে। তোরই মতো পুলিশ ভাববে, ওই যন্ত্রটি ছাড়া ওর চলবে কী করে? ওদিকে সে সেটা সুটকেসে পুরলে সেটার ওজন বাড়বে। খাদের ঝোঁপঝাড়ে আটকা পড়বে না– তদুপরি পুলিশের অন্যতম শক্তিকরণ চিহ্নও তার হাতে নেই। পুলিশ কিছু বুদ্ধি খাটালে ও সামান্য তৎপর হলেই ওকে ধরতে পারবে সেই উঠনির নিচে। পকেটে যদি কিছু পায় তবে, কম্পাস আর ম্যাপ।

খান বললে, মিঞাকে নিয়ে দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। তোকে ফারসি প্রবাদটি তো একাধিকবার বলেছি, আহাম্মুখ দোস্তের চেয়ে আক্কেলওলা দুশমন ভালো। কিন্তু ওই মিঞাটার মতো দুশমন যদি রাঁচির সার্টিফিকেট প্রাপ্ত ইম্বেসাইল হয়, সে সম্বন্ধে প্রবাদ নীরব।

শিপ্রা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, এরকম, একটু ভালো, আরও বোকা কত আসবে-যাবে, সে নিয়ে মাথা ঘামালে হবে বর্বরস্য বলক্ষয়– আর তুমি, খান, মাত্র অর্ধ বর্বর। চলো না কলকাতায়, তোমার মতো ধুরন্ধর চোখ না মেলেও দেখতে পাবে মার্কিন, রুশ, চীনা, বিশেষ করে উভয় পাকের চর কভু স্ববেশে কভু-বা ছদ্মবেশে আবজাব করছে।

কীর্তি বললে, তোমাদের সম্মতি থাকলে কালই কলকাতা রওনা হওয়া—

খান আশ্চর্য হয়ে শুধাল, এত ম্যাপ ঘাঁটাঘাঁটির পর ডাউঁকি যাবে না?

কীর্তি শান্ত কণ্ঠে বললে, করিমগঞ্জে যে দু একটি শরণার্থী দেখেছি, সেই প্যাটার্নই। তো ইছামতী থেকে পদ্মা ব্রহ্মপুত্র ডাউঁকি, সর্বত্রই একই রূপে দেখা দেবে।

খান বললে, অ-অ-অ! হাতে হাঁড়ির একটা ভাত টেপা ঝোঁপের দশটা পাখির সমান।

.

০৮.

জিমি!

ইয়েস, ম্যাডাম!

তুমি সত্যি ভেরি ভেরি ব্যাড় বয়।

আমার ড্যাডি, অনুমতি করুন ম্যাডাম, আমাকে এইটুকু হাইট থেকে (হাত দিয়ে দেখিয়ে) এই সত্য বাক্যটি বলেছেন। আমার মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল, আজ থেকে সেটা একদম লোপ পেল

ফাজলামো করো না। সেই ভোর চারটে থেকে তোমাকে আমি খুঁজছি। সবাই বলে, তুমি অফ ডিউটি। সো হোয়াট? শেষটায় গৌহাটির পথে তোমার বাড়ি গেলুম। পথে দেখি, সেই জোয়ান বেয়ারাটা, ভ্যাক করে যে কেঁদে ফেলেছিল আমার সামনে, সে ছুটেছে টাটু ঘোড়ার মতো। জিগ্যেস করলুম, লিটু চাই। বললে, তোমার বাড়ি যাচ্ছে, তোমাকে খবর দিতে। সেখানে শুনলুম, ইয়োর বেড হ্যাঁজু নট বি স্লেপ্ট ইন এটোল। আই লাইক দ্যাট! কোথায় ছিলে সমস্ত রাত? আমি তোমার বাপ হলে এতক্ষণে আমার দুই উরুর উপর উপু করে ফেলে, উইদ দি রং সাইড অফ মাই ব্রাশ এমন প্যাদানি দিতুম–

হঠাৎ জিমিকে গৌহাটিতে পেয়ে এমন খুশি যে বহুদিন পরে অনর্গল বকর বকর করে যেতে লাগল।

জিমি সবিনয় বললে– ছোকরাকে এরকম বকাঝকার লাই ইতোপূর্বে কেউ কখনও দেয়নি অ্যান্ড বাই হোয়াট এ ড্রিমল্যান্ড ফেয়ারি! মাদার মেরি তুমি এঁকে সর্ব অমঙ্গল থেকে রক্ষা করো, মা!– ম্যাডাম, আমার ওজন ১৭০ পাউন্ড, তাই এই মাটিতে লম্বা হচ্ছি! আপনি– ছোকরা জীবনে এতখানি স্নেহ ইহজন্মে পায়নি। নইলে এরকম বাঁচালতা তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকত। বাপের স্নেহ ছিল পুরুষের, পিতার স্নেহ।

চুপ করো। এই চেয়ারটায় বসো তো। তার পর হ্যান্ডব্যাগ খুলে সিল্কে মোড়া একটা কেস বের করল। বলল, খুলে দেখো। তুমি পরো। আর বিয়ের বউয়ের আঙুলে আংটি পরাবে তো, চার্চের ভিতর? বেরিয়ে এসেই এটি তাকে পরিয়ে দেবে- ইফ আই বি অন দি আদার সাইড

ম্যাডাম, প্লিজ!

শোনো। আমি বেঁচে থাকলে অন্য কথা। এখন সিরিয়াস হয়ে শোনো। এটা তোমাকে আমি ফ্রি দিচ্ছি না। আমি প্রতিদান চাই।

জিমি হাত তুলেছে শপথ করতে।

শুনে যাও, প্লিজ। তোমার হেল্প্ আমার দরকার হতে পারে, না, হবেই। হয়তো উইদাউট এনি নোটিস। হয়তো-বা দিতে পারব। তুমি না বললে আই শানট টেক ইট এমিস্ এটোল। সি হোয়াট আই মিন?

প্লিজ, ম্যাডাম। আমাকে মাত্র একটি কথা বলতে দিন। আমার ড্যাডির জীবনের আদর্শ তিনি নিয়েছিলেন কার কাছ থেকে আমি ঠিক জানিনে। বোধ হয় প্রিন্স কনসর্ট এলবার্টের এই মটো ছিল। জর্মনে দুটি শব্দ, ইষ ডিনে (Ich diene) আমি সেবা করি, আমি সেবার জন্য, আই এম হিয়ার টু বি যুজড়। আমিও সেই আদর্শে বিশ্বাস করি।

গুড। আমি তোমাকে এমন কোনও সেবা করতে বলব না, যেটা হীন কিংবা তোমাকে কোনও বিপদে পড়তে হবে। প্রথম সন্ধ্যাতেই আমি বুঝেছিলুম, পরের হিত করে তুমি আনন্দ পাও। তার পর যখন মি. খানের কাছ থেকে শুনলুম, পাঞ্জাবি গুপ্তচরের প্রতি তোমার ঘৃণা, এবং খানকে সবকিছু তুমি বলেছ যাতে করে সে খানের বা অন্য কারওর অনিষ্ট না করতে পারে তখনই– ওয়েল নেভার মাইন্ড– তুমি কবে কলকাতায় আসছ?

আপনি যখনই আদেশ করবেন।

আচ্ছা, তোমাকে শেষ প্রশ্নটা জিগ্যেস করি : তোমার পিতা এবং তুমি বড় হওয়ার পর, তোমার সম্প্রদায়ের আর পাঁচজনের মতো তোমরা ক্যানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলে না কেন?

ড্যাডি ছিলেন অতি এক্সপার্ট বয়লার ইনসপেক্টর। কাজেই তিনি আর পাঁচজনের তুলনায় ঢের ঢের ভালো অফার পেয়েছিলেন। এবং তিনি এটাও জানতেন, তার নিকট আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই মাইগ্রেট করার ফলে তাকে বৃদ্ধ বয়সে নিতান্তই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে। তবু তিনি যাননি। কেউ জিগ্যেস করলে উত্তরটা এড়িয়ে যেতেন। মাত্র একদিন একবার আমাকে, একান্ত আমাকেই বলেছিলেন, যারা যাচ্ছে, যাক্। আমি কখনো বলব না, তারা অন্যায় করছে। কিন্তু, মাই জিমি, আমি যে-দেশে জন্মেছি, যে-দেশকে আমি ছেলেবেলা থেকে ভালোবাসতে শিখেছি, সে-দেশ আমি ত্যাগ করতে পারব না। আমি এদেশেই মরতে চাই, যাতে করে আমার বাপ-পিতামোর হাড্ডির কাছে আমার হাড়িও ঠাই পায়– আই উয়ান্ট মাই বোস টু বি গেদার আনটু মাই ফোর ফাদার্স হোয়ার দে আর। ম্যাডাম, আমার বেলাও তাই সে হিয়ার। আমি চলে গেলে তার গোরে ফুল দেবে কে?

তাই তো, অবাক হয়ে ভাবল মনে মনে শিপ্রা, তাই তো, খ্রিস্টান-মুসলমান যাদের গোর দেওয়ার রীতি, তারা চায় তাদের হাড়গুলো যেন তাদের বাপ-পিতামোর হাড়ের কাছে স্থান পায়, কালক্রমে ধুলো হয়ে মিশে যায়। হৃদয় দিয়ে যারা এ দেশকে ভালোবেসেছে তাদের পক্ষে এদেশ ত্যাগ না করার বিরুদ্ধে এটা একটা অতিরিক্ত হৃদয়ের যুক্তি।

সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল, বার্টন না ওপেন্‌হাইম্ কার লেখাতে সে-যেন পড়েছে, বসরা বন্দর থেকে ভারতাগত জাহাজ যেসব শত সহস্র মুসলমানদের ওষধি-রক্ষিত মৃতদেহ সাত-সমুদ্র পেরিয়ে নিয়ে এসেছে, তাদের বোঝাই করে এগিয়ে চলেছে মরুভূমির এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে বিলীন শত সহস্র উষ্ট্র-গর্দভের কাফেলা পুণ্যভূমি কারবালার দিকে, যেখানে তাদের নেতাজি শহীদ ইমাম হোসেনের রক্তধারা কারবালা-মরুভূমির সহস্রাধিক বৎসরের শুষ্ক বালুকা সিক্ত, রঞ্জিত করেছিল, যেখানে তার অস্থি সমাহিত হয়েছিল তারই নিকটে একই মরুভূমিতে ভারতীয় অস্থি স্থান পাবে বলে, একই ধুলোয় ধূলি হবে বলে।

এবং এরই সঙ্গে তার মনে আরেকটি চিন্তা উদয় হয়ে তার দেহটা যেন বিষিয়ে দিল : জেনারেল ইয়েহিয়া অতিশয় গোঁড়া কট্টর শিয়া, এবং সম্প্রতি জানতে পেরেছে মিস্টার জুলফিকার আলি ভুট্টোও শিয়া– গোপনে গোপনে তিনিও ধর্মান্ধ, তার শিয়া মতবাদ ভিন্ন অন্য সর্ব বর্ণ সর্ব গোত্রের মুসলমানের প্রতি তার প্রতিটি লোমকূপ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-হলাহলে জর্জরিত।

এবং সে সাম্প্রদায়িকতা এমনই বিশ্বব্যাপী যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ–যে সে ধর্মান্ধতাকেও পরাস্ত করে ধর্মনিয়ন্ত্রিত পবিত্র মহরম মাসে, পুণ্য শুক্রের দিবসারম্ভে তাদের সর্ব পবিত্রতাকে কলুষিত করে শিয়াদের ধর্মবৈরী সুন্নি মূর্খ পাঠানকে উত্তেজিত নিয়োজিত করে তার ধর্মভ্রাতা পুব বাঙলার সুন্নি মুসলমানকে নিধন করতে, তার বধূভগ্নী কন্যাকে। তাদের শেখানো হয়েছে পূর্ব বাংলার মুসলমান কাফির। ইয়েহিয়া শুধু মদের নেশায় বলতে ভুলে গিয়েছিলেন শিয়ারা সর্ব সুন্নিকে, অতএব পাঠানকেও কাফের মনে করে।

ইয়েহিয়ার পরলোক ইরাকের কারবালায়, ইহলোক শিয়া ইরানে। তিনি ভুলতে পারেন না, ভুলতে চান না যে তার পূর্বপুরুষ কিজিলবা গোষ্ঠী এসেছে ইরান থেকে শুধু ভুলে গেছেন তারা ইরানে এসেছিল মূল মাতৃভূমি সুন্নি তুর্কোমানিস্তান থেকে। ইরানের সঙ্গে তাঁর দোস্তি; পুব বাঙলার সুন্নি তাঁর দুশমন। তার দোস্ত ইরান তাই তাঁর সুন্নী নিধন কর্ম সুসমাপ্ত করার জন্য শানিয়ে দিচ্ছে তার তলওয়ার, সওগাত পাঠাচ্ছে বোমারু বিমান।

হঠাৎ সংবিতে ফিরে এল শিপ্রা। জিমি সম্বন্ধে শেষ কথা তার যা জানার ছিল সেটা জানা হয়ে গিয়েছে। তার আনুগত্য ইংলন্ডে বা কানাডার প্রতি একস্ট্রা টেরিটরিয়াল নয়।

আমাদের মেয়েরা একদা অষ্ট অলঙ্কার দিয়ে প্রসাধন করতেন, ওষ্ঠরঞ্জন ইদানীং বহুস্থলে হোটেলে, ট্রামে-বাসে, থিয়েটারে তাদের একমাত্র অলঙ্কার। পক্ষান্তরে। গোরা রায় অদ্যাপিও অষ্টপদী ব্রেকফাস্ট খায়! তারই এক ঢাউস সংস্করণ বেয়ারা এনে রাখল জিমির সামনে।

শিপ্রা বললে, আজ এই খাও। এতদিন তোমার কর্তব্যের আওতায় না পড়া সত্ত্বেও তুমিই যে আমার খানার তদারকি করতে সে আমি জানি। একটু মৃদু হেসে বললে, আর কলকাতার বাড়িতে খাবে পুইশাকের চচ্চড়ি আর মোচা-ঘন্ট।

কিন্তু আপনি অর্ডার দিলেন কখন?

ওহে জনপদবাসী যুবক, আমি নাগরিকা। আমাদের টেকনিক ভিন্ন। আমার চেয়েও সুচতুরা, বিদগ্ধা নাগরিকার নাম বেয়াত্রিচে। আমাকে তুলে খেতে পারে। এসো কলকাতায়। এই এপ্রিলেই। ওই কথাই রইল– ডান?

ডান! অনার ব্রাইট। ওই কথাই রইল।

শিপ্রা সেন্টিমেন্টাল নয়। শব্দটি ইংরেজিতে স্থানবিশেষে সবসময় প্রশংসনীয় নয়। বাংলায় আমরা বলি ভাবাবেগে গদগদ হওয়া, উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হওয়া কিংবা যে-রকম বলা হয়, পড়য়া প্রহ্লাদ যখন বর্ণমালার ক অক্ষরে এলেন, তখন কৃষ্ণ নামের স্মরণে ভাবাবেশে মূৰ্ছিত হয়েছিলেন। শিপ্রার অনুভূতি এস্থলে সে পর্যায়ে নয়। সে দেখতে পেয়েছিল জিমির ভিতর একাধিক চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য যেগুলোকে সাধারণ জন রিসেপ্সনিস্টের মামুলি কর্তব্যবোধ মনে করে তার দিকে আরেকবার ভালো করে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করত না। সব ভালো হোটেলেরই রিসেপসনিস্ট– এমনকি ক্লাব-চ্যাটার বসের সমগোত্রীয় হোটেল-সব হয়তো বলেই ফেলত, ছোকরার উচ্চারণ ট্যাঁশুয়া–চেষ্টা করে গেটের সেবা, কিন্তু সেবাই যে জিমির ধর্ম সেটা যত না বুদ্ধি দিয়ে ততোধিক অনুভূতি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করেছিল শিপ্রা। শিপ্রার সেন্টিমেন্ট আছে, কিন্তু সে সেন্টিমেন্টাল নয় কারণ তার সেন্টিমেন্টের পিছনে অহরহ জাগ্রত থাকে পর্যবেক্ষণশীল অন্তর্দৃষ্টি।

শিপ্রা আর জিমি লাউঞ্জে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় একে অন্যকে যখন চিনে নিচ্ছিল, খান ততক্ষণে ঝপঝপ গোটা পাঁচেক জিন মোকামে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, রেস্তোরাঁতে বসে কীর্তি সঙ্গ দিয়েছে বটে কিন্তু সে আধ গেলাসও শেষ করতে পারেনি।

মাইক্রোফোনে প্যাসেঞ্জারদের উদ্দেশে সমন জারি হয়েছে। খান খপ করে কীর্তির গেলাসটা তুলে নিয়ে বট আপ করে বললে, চ, যত সব দুশ্চরিত্র পেঁচি মাতাল!

লাউঞ্জে শিপ্রাদের সামনে দাঁড়িয়ে এবারে বাক্য সম্পূর্ণ করে বললে, যত-সব পেঁচি মাতালদের পাল্লায় পড়ে আমার চরিত্রটা ঝরঝরে হয়ে গেল!

জিমি এখন শিপ্রার প্রটেজে। জিমির ইংরেজি ব্ল্যাশুয়া হোক, আর নাই থোক, তার বাংলাটা খাজা ব্ল্যাশ মার্কা। শিপ্রা প্রথম তাকে বুঝিয়ে বললে, পাড় মাতাল অর্থাৎ কনফার্মড বুজার, আর পেঁচি মাতাল মানে, যারা আধ ফোঁটা গিলতে না গিলতেই ঘরের ভিতর আটটা পাঁচিল দেখতে পায়। তার পর খানকে শুধাল, পেঁচির সহবতে দুশ্চরিত্র হলে কোন অলৌকিক অধ্যবসায় এবং ইন্দ্রজাল-ভানুমতীর সমন্বয়ে।

খান হাহাকার সহকারে বললে, হায় হায়, এই সামান্য তত্ত্বটুকু পর্যন্ত জানো না, সুন্দরী। তাই বলছ ভানুমতীর খেল। ওই যে আমাদের পাড়স্য পাড় কেষনগরের ব্যারিস্টার গোসাঁই, তাকে লন্ডনে পুলিশ ধরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। অপরাধ? রাস্তায় মাতলামো করেছে রাত দুটো অবধি। পুলিশ যা প্রমাণপত্র পেশ করলে তার সামনে হাকিমের মনে কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না, ব্যাটা পাড়। তবু জানো তো, ব্রিটিশ জাস্টিস, অপরাধের পুরো বয়ান শোনার পর তবে তো স্থির করবে, দণ্ডটা গুরু না লঘু হবে। আসামিকে শুধালেন, এমন কি কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল, এমন কি কোনও বিপাকে পড়েছিলে যে ফলে বেহেড মাতলামোটা করলে?

গোসাঁই চিঁ চিঁ করে করুণ কণ্ঠে বললে, আমি দুজন অসচ্চরিত্র লোকের পাল্লায় পড়েছিলুম, ধর্মাবতার, ইওর অনার।

জজ উৎসাহ দিয়ে বললেন, খুলে কও।

গোসাঁই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে, মি লাট, আমার সঙ্গী-দুটো যে এতখানি দুশ্চরিত্র জানা থাকলে আমি কস্মিনকালেও ওদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতুম না। দুই শয়ারই- বেগ পার্ডন, স্যর টি টি, টী টোটেলার। মদ্যস্পর্শটা মুসলমানদের চেয়েও হারাম বলে বিশ্বাস করে। ক্রিসমাস, আপন আপন জন্মদিনে পর্যন্ত মদ্যপান করে না।

প্রহেলিকাচ্ছন্ন দ্বিধাভরা কণ্ঠে জজ ফের বললেন, আরও খুলে কও।

আর ছিল, হুজর, একটা পুরো মেগনাম সাইজের হুইস্কির বোতল খাঁটি স্কচ, ছিপি পর্যন্ত খোলা হয়নি। সেই সমস্ত বোতলটা আমাকে একাই খতম করতে হল, পাষণ্ডেরা কিছুতেই হিস্যে নিল না। মেগনাম বোতলে নেশা হবে না তো কী হবে? ওই দুটো লোককে দুশ্চরিত্র বলব না তো কী বলব, কুসঙ্গ বলব—

কলকাতার স্মাট সেট-এর কায়দা-কেতা প্রটোকল-বাঁধা। কোন অঙ্গের রসিকতায় মুখে ফুটবে একটুখানি স্মিত হাস্যের ক্ষীণাভাস, কোন পর্যায়ের চুটকিলাতে শীতের ফাটা ঠোঁটের চেরা হাসি, মোনালিসা-স্মিতহাস্য করে করে স্তরে স্তরে সর্বশেষ রবীন্দ্রাগ্রজ বড়বাবুর ঠাঠা অট্টহাস্য। শিপ্রা কোনও প্রটোকল কখনও মানেনি, তার হাস্যমাত্রা কী হবে সেটা মেট-এর আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু গাঁইয়া জিমি একহাতে মুখ চেপে অন্য হাতে পেট চেপে দু ভাঁজ হয়ে গিয়েছে।

শিপ্রা বললে, আমো সেই লন্ডনি জজের মতো রহস্যাচ্ছলা হয়ে শুধোই, এস্থলে কথিকাটি কীভাবে প্রযোজ্য।

আরে কও কেনে? আমি সদাই সাথীরূপে রাখি ছটা বিগ হুইস্কি, ছটা ব্রা জিন– তোমাদের এই প্যারা কংগ্রেস সরকারের মেহেরবানিতে এসব সুধা ভারতময় লুকোচুরি খেলে, কটকে রাজরাজমহেন্দ্ৰবরম বা তিরুচিরপল্লী কোনটা ড্রাই, কোনটা ওয়েট, কোনটা সঁতসেঁতে, সেটা আবার হঠাৎ এক লম্ফে বোফ্রাই হয়ে গিয়েছে কবে, তার নেই খবর– মরো গিয়ে সেখানে সুধার অভাবে। অতএব প্রকৃষ্টতম পন্থা ক্যাঙারু পদ্ধতি। আপন থলেতে আপন মাল নিয়ে চলা-ফেরা করা। আজ সঙ্গে ছিল ছটা বড়া জিন্ আর ছিল আন্দেশা, দুনো ইয়ারের তরে বাড়ন্ত হলেই তো সব্বোলাশ নাশ নয় লাশ আখেরে হল সর্বনাশই। ছটার সাড়ে পাঁচটা খেলুম আমি, ইয়ার খেলেন হাফ। চরিত্র নষ্ট হল না আমার, এই পেঁচি মাতালটার পাল্লায় পড়ে? বরঞ্চ গোসাঁইয়ের কপাল ছিল ঢের ভালো, তার প্রলোভন ছিল মাত্র সেই বোতলটা। কাউকে খেতে দেখলে, কিংবা যদি কেউ সঙ্গ দেবে বলে জানা থাকে তবে প্রলোভনটা হয় প্যারাডাইজে সেই প্রথম নর-নারীর মতো নজিরহীন, অভূতপূর্ব লালসাভরা আপেল। এক পেগ আপেল, নো, আই মিন একটা আপেল সেটা হাফাহাফি করে খেয়ে একে অন্যকে উৎসাহিত করল। বাবু কীর্তিনাশ আমাকে সঙ্গ দেবার লোভ দেখিয়ে চাটলেন তার জিন্টা, পেঁচি রাধুনী যে রকম আড়াই ফোঁটা ঝোল চেটোতে নিয়ে দেড় বার চেটে নুনটা পরখ করে নেয়। এখন বল, ভদ্রে শিপ্রা, সম্পূর্ণ মদ্যবর্জিত লোক এবং কীর্তি কে বেশি বিপজ্জনক দুশ্চরিত্র! তবে কি না, একটা সান্ত্বনার কথা, শুধু ওই ছটা জিন পেগ নয়– ছ বোতল স্কচ আর তিন বোতল স্কচ লুট করেছি ওই পাতি স্পাই পাঞ্জাবিটার ঘর থেকে।

ত্রিমূর্তি বাকহারা, স্পন্দনহীন। এলেফেন্টার প্রস্তর ত্রিমূর্তি এদের তুলনায় তখন মুখরিত বাঁচাল।

.

০৯.

পো; আলীগ্রাম
গ্রাম পাহাড়পুর, সিলেট,
২০/৩/৭১

দোয়া পর সমাচার এই,
স্নেহের শিপ্রা বোন–

শিপ্রা যেন বিজলির শক খেল। খামের উপর ছিল ভারতীয় স্ট্যাম্প। ঠিকানাও অচেনা হাতের। অলস অবহেলায় চিঠি খুলেছে, আনমনে পড়তে শুরু করেছে– হঠাৎ বুঝতে পারল এ যে বিলকিসের চিঠি! কত যুগ পরে! চিঠির ডান কোণে তাকালো- হ্যাঁ, সিলেটের ঠিকানা। খামটা তড়িঘড়ি বাস্কেট থেকে তুলে নিল ঠিকই তো দেখেছে। ভারতীয় স্ট্যাম্প। তারিখ বিশ। তখনও তো মানুষ পূর্ব বাঙলা ছেড়ে চলে যেতে আরম্ভ করেনি। পাঁচ সেকেন্ডের ভিতর আগাগোড়া চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে ধরে ফেলল জায়গাটা যেখানে তার উত্তর আছে। লিখেছে :

এখানকার অবস্থা এমনই অস্বাভাবিক যে চিঠিটা এক হিন্দু ভদ্রলোক মারফত ভারতে পাঠালুম। ভদ্রলোক সেই পার্টিশনের সময় থেকে সবরকমের ঝড়ঝঞ্ঝা সয়েছেন, কিছুতেই দেশত্যাগ করতে রাজি হননি। কাল হঠাৎ এসে আমার মেয়েকে বললেন, তাকেও শেষ পর্যন্ত ভিটের মায়া ত্যাগ করতে হল। মেয়ে আশ্চর্য হল, কারণ আমাদের অনেকেই তো এখনও পুরো আশা ধরে আছেন, লীগ আর ইয়েহিয়াতে সমঝোতা হওয়া খুবই সম্ভবপর। অথচ একাধিকবার যখন হিন্দুদের চতুর্দিকে ঘোরঘুট্টি অন্ধকার, প্রায় সবাই পালাচ্ছে তখনও তিনি প্রতি সন্ধ্যায় এখানে এসে বৈঠকখানায় তোমার জামাইবাবুর সঙ্গে দাবা খেলে গেছেন। উপস্থিত হিন্দুদের ভিতর বিশেষ কোনও চাঞ্চল্য নেই, তবু তিনি বেবিকে বললেন, এতদিন বাইরের গুণ্ডা এসেছে মারপিট লুঠতরাজ করতে, তার হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশী, ইয়ার দোস্তের সাহায্যে তিনি তাদের ঠেকিয়েছেন। এবারে তাঁর স্থির বিশ্বাস স্বয়ং সরকার আসবে বেহদ্দ জুলুম করতে। জুলুম করতে আসে যে-সরকার তার জাত নেই, ধর্ম নেই। মুসলমান-হিন্দু কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না। বেবি তার ইঙ্গিতের কিছুটা ধরতে পেরে ভয় পেয়ে শুধাল, মুসলমানদের উপরও জুলুম চলবে নাকি? তিনি ভালো-মন্দ কোনও উত্তর না দিয়ে বেবির হাতে চন্দনকাঠের একগাছি মালা দিয়ে চলে গেলেন। ভশচায় মশাই করিমগঞ্জ হয়ে কোথায় যাবেন সেটা এখনও স্থির করতে পারেননি। দাদার বন্ধু শ্ৰীযুত দেশরঞ্জন চক্রবর্তী, করিমগঞ্জ, কাছাড়, ঠিকানায় উত্তর দিয়ে। ভশচাষ আমাদেরই মতো সাদামাটা মানুষ; তাঁর দিব্যদৃষ্টি আছে এরকম কোনও খবর বা গুজব আমার কানে কখনও পৌঁছয়নি, ভবিষ্যদ্বাণী করতেও শুনিনি। তাই তার দেশত্যাগ শুধু বেদনা দিচ্ছে। এর মধ্যে আশা বা নিরাশার কোনও আভাসই নেই।

বাইরে যথেষ্ট। মিনিটে মিনিটে রকমারি খবর গুজব এখানে পৌঁছাচ্ছে আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত। কোনটা সুখবর, কোনটা দুঃসংবাদ সেটা পর্যন্ত সবসময় বোঝা যায় না কারণ তারই ফল আখেরে কী হবে, কেউ অনুমান করতে পারে না। সর্বোপরি বেবি আর তার বেতার। ঢাকা বলে এক কথা, পিন্ডি বলে উল্টোটা, লন্ডন মনস্থির করতে পারে না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলুম, ইন্ডিয়া ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে কি? কলকাতা শুনে তো মনে হয় না। কিন্তু কে জানে? হয়তো দিল্লিই জানে সবচেয়ে বেশি কিন্তু উচ্চবাচ্য করাটা সময়োপযোগী বলে মনে করছে না।

চুপ করে শিপ্রা ভাবতে লাগল– বাকি চিঠি পড়া স্থগিত রেখে। একরাশ চিন্তা একটা আরেকটাকে ঠেলে ফেলে কোনওটাই তার শেষ সীমানা অবধি পৌঁছয় না। শুধু একটু বেদনাবোধ তার হৃদয়-মনের গভীর অতলে বসে আছে। তার কোনও পরিবর্তন নেই। ওয়ান জার্ট কার্ট থিংক ইট আউট– বহুকাল ধরে সে জানে বিকিদিদের পক্ষে দেশত্যাগ করে কলকাতা চলে আসাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কতকাল হয়ে গেল, কতবার সে অনুরোধ করেছে একবার দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে– দু দশ দিনের জন্য। সে নিজে যাবে স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়াটা হয়ে গেল বটে কিন্তু সেটা পাহাড়পুর নয়, সেটা স্কটল্যান্ডের পাহাড়পর্বত, নদী হ্রদ। তার পর দীর্ঘ নীরবতা। আলস্য, জড়ত্ব।

আবার চিঠিখানা পড়তে আরম্ভ করল, অন্য এক জায়গা থেকে। লিখছে, প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্য দেশের খবর দেবার মতো কিছুই নেই। সব পরস্পরবিরোধী। এবং সবচেয়ে মারাত্মক যে পাপ বিষ প্রত্যেকের দেহমনকে আচ্ছন্ন করে তাকে নির্জীব, ক্লীব করে দিচ্ছে সেটা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। কেউ জানে না, কার কপালে কী আছে? কোনও সন্দেহ নেই, এখন, এই মুহূর্তে দেশের পনেরো আনা লোক– মেয়েছেলেরাও পিছিয়ে নেই–লীগপন্থি। সত্য বটে এরকম সর্বব্যাপী আন্দোলন আমি ইতোপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তবু মনে ভয় জাগে- একাধারে ভাবালুতার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন জড়ত্ব– এ দুটোর ভিতর জিতবে কোনটা যদি কখনও পরীক্ষা আসে।

শেষ কথা। বেশিরভাগ লোকের বিশ্বাস, লীগ-ইয়েহিয়াতে যদি সমঝোতা না হয় তবে পূর্ববঙ্গবাসী যে আন্দোলন আরম্ভ করবে এবং সেটাকে আয়ত্তে আনার জন্য জুন্টা যে দমননীতি প্রবর্তন করবে তার আন্দোলনটা সেই স্বদেশী যুগ থেকে আরম্ভ করে যে-ধারা বয়ে ইয়েহিয়াতে এসে পৌঁছেছে সেই সনাতন ধারা বয়েই চলবে, সেই প্যাটার্নই যুগধর্মের বর্ণে রঞ্জিত হয়ে স্বপ্রকাশ হবে মাঝে মাঝে কখনও-বা ভাষার জন্য, কখনও-বা ইউনিভার্সিটির উচ্ছলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে কয়েকটি নিষ্পাপ যুবক আত্মাহুতি দিয়ে শহীদ হবে; এবং ইয়েহিয়ার দমননীতিও সেই আলিপুর মামলার ফলস্বরূপ কয়েকটা দ্বীপান্তর ধরনের শাস্তি, জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস, হাঙ্গার স্ট্রাইকের সময় রবারের নল দিয়ে জোর করে গেলানো, কখনও-বা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, গোপনে গোপনে কিছুটা উৎপীড়ন– এই প্রাচীন রাজকীয় পন্থাই অবলম্বন করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে-পন্থার সমান্তরাল হয়ে চলবে সেই সনাতন তোষণ-নীতি মোমেন খানদের সংখ্যা বাড়ানো হবে অকাতরে, স্পাই পোষা হবে অগণিত এবং অধুনা যে ছাত্র-আন্দোলন দ্রুতবেগে উগ্র হতে রুদ্রতর রূপ ধারণ করছে সেটাকে করায়ত্ত করার জন্য বিস্তর ছাত্র-স্পাইকে অকৃপণ হস্তে বিতরণ করা হবে দেদার কাঁচা টাকা, মাসিক মাইনে, তাদের ককটেল পার্টির জন্য কাপ্তাই ড্যামাবদ্ধ পরিমাণ নিষিদ্ধ পানীয় এবং সমান্তরাল পন্থায় সঙ্গে সঙ্গে সানন্দে সসম্মানে এগিয়ে যাবে এতাবৎ সরকার কর্তৃক পদদলিত, সমাজ কর্তৃক লাঞ্ছিত ভাড়াটে গুণ্ডার পাল– যেসব ভ্ৰষ্টমতি, দুষ্টবুদ্ধি, রাষ্ট্রদ্রোহী, পঞ্চনদবৈরী সম্প্রদায় সরকারের মেহেরবানি কদরদানি তাচ্ছিল্যভরে উপেক্ষা করে সদাশয় সরকারের প্যারাদের বদনমণ্ডলে আপন গণ্ডদ্বয় পূর্ণ নিষ্ঠীবন বিচ্ছুরিত করে লাঞ্ছিত করেছে তাদের পৃষ্ঠস্কন্ধমস্তকে সরকারি ফরমান মাফিক লগুড়াঘাত করতে করতে।

বোন শিপ্রা, বুঝতেই পারছ, এটা আমার ভাষা নয়। আমাদের পাশের গায়ের এক সরল গোসাঁইজিকে সেই দেশত্যাগী ভট্টাচার্য যাত্রাকালে একখানা চিঠি লেখেন। বেচারী গোসাঁই সেই চিঠি তোমার জামাইবাবুকে কাঁদতে কাঁদতে পড়ে শোনান।

সর্বশেষে ভশচায ইতোপূর্বেই যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেইটেই যেন প্রাণখুলে লিখেছেন, যেন গৌর গোসাঁইয়ের নরম বুকটি খান খান করার জন্য কিংবা যাবার বেলা সেটাতে হিম্মত ভরে দেবার জন্য। লিখেছেন, এক দরবেশ একদা আমায় বললে, খুদা-পাক্ সব শহরে এবং প্রতিটি জনপদখণ্ডে চার চারজন করে সাধুপুরুষ কুতুব (মিনার) বা স্তম্ভ রাখেন। সে দেশ, সে জনপদ তাদেরই দৃঢ়াত্মার ওপর নির্মিত। এ অঞ্চলে তুমি একজন, তোমার পিতা ছিলেন আর একজন। এঁরা স্বেচ্ছায় কদাচ, কুত্রাপি দেশত্যাগ করেন না। ভুবনেশ্বরের দৈবাদেশে যদি মাত্র একজনও দেশত্যাগ করেন তবে সে-দেশ, সে অঞ্চলের জনপ্রাণী কীটপতঙ্গ পর্যন্ত সমূলে বিনষ্ট হয়– সমূলস্তু বিনশ্যতি, মহতী বিনষ্টি–অন্য তিন মহাত্মা কুত্ত্বসহ। তুমি জানো– তোমাকে আর কী শেখাব সম্পূর্ণ গ্রাম যদিস্যাৎ খাণ্ডবদহনে ভস্মীভূত হয় তবে সর্বজনপূজ্য মহাকাল মন্দিরও নিষ্কৃতি পান না। দরবেশ ফারসিতে বলেছিলেন :

দাবানল যবে জনপদভূমি
দগ্ধদহনে দহে
কিবা মসজিদ, কবরসৌধ
প্রভেদ কিছু না সহে।

তুমি, গৌর, এ অঞ্চল ছাড়লে এর সর্বনাশ হবে।

তাই যাত্রারম্ভে তোমাকে সে-প্রস্তাব দিইনি।

গুরু সাক্ষী, তোমার আখড়া সাক্ষী, তার রাধামাধব বিগ্রহ সাক্ষী, আমি কস্মিনকালেও ভবিষ্যদ্বাণী করিনি। তবু একটা কথা বলে যাই, দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর ধরে আমি নিরবচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানে বাস করেছি, তার দৈনন্দিন পরিবর্তন, ক্রমবিকাশ, পতন-অভ্যুদয় সাগ্রহে লক্ষ করেছি। এরই ওপর নির্ভর করে আমার ভবিষ্যৎ দর্শন গণনা। এর সঙ্গে গণৎকারের ফলিত জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতির কণামাত্র সাদৃশ্য সামঞ্জস্য তো নেই-ই, অপিচ ফলিত জ্যোতিষীর বাক্যাড়ম্বরসহ ভ্রান্তিমুক্ত ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করার মতো কোনওপ্রকারেরই শাস্রাধিকার আমার নেই।

জনসাধারণের বিশ্বাস, ঢাকার দরকষাকষি নিষ্ফল হলে পুব পাক রাজনীতি সেই প্রাচীন ধারা বেয়েই চলবে, হয়তো ঈষৎ দ্রুততর বেগে। সঙ্গে সঙ্গে দমন-নীতিও তার ধারা বেয়ে চলবে, হয়তো ঈষৎ উদ্দামতর বেগে, রূঢ়তর পরিমাণে। মোদ্দা কথা প্যাটার্নের পরিবর্তন হবে না।

সেখানে আমার বক্তব্য, না, অবশ্যই হবে।

প্রথম সম্ভাবনা : কলমের এক খোঁচাতে পুব পা যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চায় সেইটে রাতারাতি পেয়ে যাবে। এটা কিছু অভিনব ইন্দ্রজাল নয়। খুদ পাকিস্তানের জন্ম ও স্বাধীনতা কলমের এক খোঁচাতেই হয়েছিল। সে উদ্দেশ্যে কজন লোক, কী স্বার্থত্যাগ করেছে, শুনি? কজন নেতা কারাবরণ নির্বাসন গমন করেছিলেন বলতে পারো? এক সিলেটি খালাসি তার সরল ভাষায় বলেছিল, স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান অর্জন করলেন জিন্না সাহেব তার পাতলুনের ভাঁজ–ক্রিজ সমুচা চো রেখেই, ফাইভ ফিফটি ফাইভ ফুঁকতে ফুঁকতে। তিনি যদি গাঁধী নেহরুর মতো জেলে-ফেলে যেতেন তবে গোটা হিন্দুস্তানটাই তার কজাতে এসে যেত। অন্তত একথা তো সত্য যে, ইংরেজ অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে পাক রাষ্ট্র নির্মাণে সম্মতি দিল তখন হবু পাক নেতারা রীতিমতো সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছিলেন।… তার পর গেল তেইশ বৎসরের মধ্যে কলমের এক খোঁচাতে কী রত্তিপরিমাণ স্বাধিকার অর্জন করতে পেরেছে? সে প্যাটার্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবশ্য বলতে পারো, সেটা ১৯৪৭-এর প্যাটার্ন। তাই সই। আমার প্রতিপাদ্য ছিল গত তেইশ বৎসরের প্রচলিত প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। ইয়েহিয়ার কলমের এক খোঁচাতেই যদি স্বায়ত্তশাসন ভূমিষ্ঠ হয় এবং এ তথ্য সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁর সে সদিচ্ছাই ছিল- তবে আর যা বল, আর যা কও সোঁদরী কাষ্ঠের লাঠি আপাদমস্তক নিষ্প্রয়োজন। আমার ইয়ার মৌলবি সাহেবের জবানে, বিলকুল বেকার, বেফায়দা ফজুল! এটা বললুম, নিতান্ত কথাপ্রসঙ্গে।

বিকল্পে যদি তা না হয়, তবে ঈশ্বর রক্ষতু। তখন যে দমননীতির বজ্রপাত হবে সেটাও সেই মান্ধাতার আমলি টিয়ার গ্যাস ছেড়ে হেথা হোথা বন্দুকের গণ্ডা কয়েক ফাঁকা আওয়াজ মেরে, দু দশ জনকে শহীদ পর্যায়ে উত্তোলন করে পুনরায় সেই প্রাচীন প্যাটার্নের অনুকরণ করবে না। (খুদাতালার দোহাই, এঁরা আমার নিত্যপ্ৰাতঃস্মরণীয়) এটা হবে সম্পূর্ণ অভিনব, অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়। যদিও-বা কলমের এক খোঁচায় স্বরাজ দানের উদাহরণ আমাদের কারও কারওর স্মরণ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, কিন্তু এই সিলেটে তথা পূর্ববঙ্গে দমননীতির চরমতম বীভৎস বিভীষিকার প্রকাশ তো আমাদের স্মৃতি মন্থনে প্রভাসিত হচ্ছে না। অম্মদেশীয় সাতিশয় নগণ্য সংখ্যক দু একজন মাত্র জানেন যে আমাদের সমসাময়িক কালেই বহু দূরের এক সভ্য দেশে অভূতপূর্ব এক নবীন প্যাটার্ন বুনেছিলেন বহু, বিচিত্র প্যাটার্নের সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ইতিহাসের এক অত্যুভূত অলিম্পন ডিকটেটর হিটলার। কজন জর্মন কল্পনা করতে পেরেছিল যে লুথার, কান্ট, গ্যোটে, বেটোফেনের মতো চিন্তাশীল, রুচিবান দেশে হঠাৎ এমন এক সৃষ্টিছাড়া কিং-নর আবির্ভূত হয়ে মাতৃভূমির সর্ব ঐতিহ্য সর্বসাধনার ধন লণ্ডভণ্ড করে এমন এক নৃশংস নিপীড়ন, সর্বব্যাপী নিধনযজ্ঞ প্রজ্বলিত করবে যে তার তুলনার জন্য মানুষকে এ যুগ ছেড়ে যেতে হবে চেঙ্গিস-আর্টিলার সন্ধানে

আর ভুলো না গোসাঁই, হিটলার যুদ্ধজীবী ছিল না। তার উভয় কুল অসামরিক। সে নিজে চিত্রকর। এখানে ইয়েহিয়া, তার মন্ত্রণাদাতা, তার আদেশ বহনকারী সর্বভূতে আছে মাত্র একটি ভূত– তেজস, অগ্নি, রণাগ্নি। এদের প্রত্যেককে তুমি ফৌজাবতার নাম দিতে পারো। এমনকি ইয়েহিয়া হারেমের রানি, প্রধান রক্ষিতার জনসমাজে প্রচলিত আদুরে নাম জেনারেল রানি।

অতএব, যদিস্যাৎ কলমের খোঁচায় সমস্যার সমাধান না হয় তবে বিকল্পে কী হবে? সবাই ভাবছে সনাতন সঙ্গিনের খোঁচা। না। আমাদের সুদূর এই পাহাড়পুরেও খবর পৌঁছে গেছে ঢাকাতে কী পরিমাণ ট্যাঙ্ক জড়ো হচ্ছে এবং হবে। এবারকার প্যাটার্নে হিটলারের কীর্তিকে ইয়েহিয়ার বিস্ফোরক-চূর্ণ-ধূম্রে ম্লান করে দেবে, অষ্টাঙ্গ আচ্ছাদিত করে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দেবে। ঈশ্বরের অভিসম্পাতে যদি এই বিকল্পই সাধিত হয়– আমি সন্ধ্যাহ্নিকের পর প্রতি রাত্রে আমাদের গুরু পির শাহজালালকে নতজানু হয়ে স্মরণ করিয়ে দিই, তিনি তার মাতৃভূমি আরব-ইয়েমেন ত্যাগ করে যেখানে এসে মুক্তিলাভ করলেন সে-দেশকে একমাত্র তিনিই রক্ষা করতে পারেন তবে আমি যে অনিশ্চিত আশ্রয়ের সন্ধানে যাচ্ছি, সেখানে হয়তো নিষ্কৃতি পাব না। তথাপি আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছাড়ব না, সুদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুনব।

মহাত্মাজি পদ্ধতিতে যদি দেশের মনস্কামনা পূর্ণ হয় তবে সোঁদরী কাঠের লাঠি বেকার!

বিকল্পে হিটলার পদ্ধতির ট্যাঙ্ক-কামানের সামনে সোঁদরী কাঠের লাঠি বেফায়দা।

তুমি, তোমার পিতা গোস্বামী সমাজের উজ্জ্বল নীলমণির পুত্র এবং শিষ্য। আমি জানি, তাই তুমি ওপারে যাবার জন্য নিত্যনিয়ত প্রস্তুত; এখন এপারে থাকার জন্য প্রস্তুত হও।

আমার শেষ অনুরোধ—

চিঠিটি অসমাপ্ত। বিস্তর দারুণ ইনটারেসটিং বইয়ের শেষ কখানা পাতা ছিল না বলে বালিকা শিপ্রা কতবারই না নিষ্ফল আক্রোশে গর্জন করেছে। প্লটটা কী সুন্দর সাজানো, ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত কী অদ্ভুত অথচ বাস্তব, চরিত্রগুলো রহস্যের কুহেলিকাচ্ছন্ন সত্ত্বেও পাত্র-পাত্রী সুস্পষ্ট পাতা কটির অভাবে অকস্মাৎ সবাই একসঙ্গে কর্পূর হয়ে গেল। কত কাল চলে গেল তার পর। এখন আর সে-অনুভূতির উদয় হয় না। মসিয়য়া পোওয়ারো বা দি সেন্ট অসমাপ্ত রেখেই, ফরাসি কায়দায় কাঁধে শ্রাগ্-এর সামান্য ছোঁওয়া লাগিয়ে বিলিয়ে দেয়।

জাল আবার এল সেই প্রাচীন দিনের অনুভূমি। অসমাপ্তির নিবিড়ঘন নৈরাশ্য– আক্রোশ দূরে থাক, ক্ষোভেরও শেষ রেশ সে-নৈরাশ্যে ঠাই পায়নি। যে লোকটি প্রতি শব্দে, প্রতি ছত্রে, প্রতি দরদি কথায় শিপ্রার চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে স্বপ্রকাশ করতে করতে তার সম্পূর্ণ আপন-প্রিয় হয়ে গিয়েছিল সে হঠাৎ কোন অদৃশ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এ যে মরণেরও অধিক মরণ। এ বড় অন্যায়, কঠিন অবিচার।… বিলকিসও এই আকস্মিক অসমাপ্তির ওপর কোনও মন্তব্য করেনি।…আজ কোথায় এই জনপদ স্পষ্টবক্তা, সত্যদ্রষ্টা! হঠাৎ শিপ্রার সর্বাঙ্গ ভয়ে শিউরে উঠল। হিটলারের আগমন ও ফলস্বরূপ শাশ্বত রাষ্ট্রাদৰ্শবৈরী শ্মশান-ধূম্রে গঠিত পৈশাচিক তৃতীয় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন শিপ্রা জয়ী ভটচাযের মতো সামান্য যে কটি জর্মন বিধিদত্ত দিব্যদৃষ্টি দ্বারা দেখতে পেয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই প্রাণ দেন সূক্ষ্ম দৃঢ় তারে ঝুলতে ঝুলতে ক্রমে ক্রমে নিরুদ্ধ নিশ্বাস হতে হতে। কসাই যে রকম হুক-এ ঝুলিয়ে রাখে শূকর বাছুরের মৃতদেহ, এদের নগ্ন শবও হিমঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন শত্রু-মিত্র সর্বজনের দর্শন ও শিক্ষা-দানার্থে।

প্রক্রিয়ার পূর্ণ ফিলম্ হিটলার প্রতি রাত্রে ডিনারের পর সবান্ধব আদ্যন্ত দেখতেন, আপন প্রাইভেট সিনেমা হলে।

.

১০.

নির্জীব কণ্ঠে কীর্তি বললে, শুনেছ, শিপ্রা?

শিপ্রা উঠে গিয়ে কীর্তির দু জানুর উপর কোলে বসে ডান হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে, বাঁ হাত দিয়ে তার মাথা বুলোতে বুলাতে বললে, কিছু কিছু শুনেছি বইকি? আজকাল বিদেশি বেতারগুলো– কাপুরুষ, মিন, ইতর, কী গাল দেব ভেবে পাইনে,- একটু একটু সাহস সঞ্চয় করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তোমার মুখে শোনা সে তো ভিন্ন–

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কীর্তি বললে, শুনে কোনও আনন্দ পাবে না। সব খবরই দুঃখের। একটিমাত্র খবর আমাকে এই নৈরাশ্যের মধ্যে মাঝে মাঝে আশার আলোক দেখায়। সুন্দরবনের পাশ থেকে হাসনাবাদ, যশোর হয়ে সীমান্তের যতখানি কাছে যেতে দেয়– গিয়েছি ভগবানগোলা, পদ্মার ওপারে পুব বাঙলার সারদা পুলিশ কলেজ, আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ- দুটো জায়গাতেই হারামিরা হানা দিয়ে পুলিশকে খুন করেছে। ভাগ্যিস, ক্যাডেট কলেজের বাঙালি প্রিনসিপ্যালে ঝাণ্ডু ঝাণ্ড পলিটিশিয়ানদের বহু পূর্বেই অশথ গাছের মগডালের কাঁপন থেকেই কালবৈশাখীর পূর্বাভাস ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছিল বলে মিঞাজি ছেলেদের আপন আপন বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরাই হারামিদের চার নম্বরি শিকার–

চার নম্বরি মানে?

অস্ত্র ব্যবহার যারা জানে, তারা ওদের শিকার। পয়লা নম্বর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি– এরাই ৬৫-র যুদ্ধে লাহোর বাঁচিয়েছিল এবং যত সব বড়ফাট্টাই করনেওলা পাঞ্জাবি পাঠান বলে তারা রণবীর, যোদ্ধার জাত, মার্শাল রেস, এদের সব্বাইকে ঢিড দিয়ে পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি মেডল আর ডেকোরেশন। তার প্রতিদান স্বরূপ এইসব প্রাণরক্ষকদের যেখানে মেডলের ঝোলে সেখানে ঢুকিয়েছে বজ্র-বুলেট, ইয়েহিয়া মেডল– আইয়ুব মেডলের জায়গায়। দুই নম্বর : ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এরা সশস্ত্র পুলিশ। রাইফেল চালাতে জানে, ব্যস। তিন নম্বর : সাধারণ পুলিশ, যাদের কেউ কেউ একটু-আধটু বন্দুক চালাতে পারে। এগুলোর কথা আমরা আগেই শুনেছিলুম। এবার এসেছে চার নম্বর : যে-কটি ক্যাডেট পুব বাঙলায় আছে তাদের ছাত্র এবং প্রাক্তন ছাত্র এরাও কিছুটা রাইফেল চালাতে জানে। এদের বেশকিছু ছেলে–কত আর বয়েস হবে, ষোল-সতেরো– পদ্মা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এসে এখানে ওখানে জড়ো হয়েছে। একটি ছেলে– কী বলব, শিপ্রা, সে কী লাবণ্যভরা মুখ, আর সর্বক্ষণ চোখে মুখে হাসি লেগেই আছে, আমার কান্না পেল, বয়স তার চোদ্দ হয় কি না হয়!

শিপ্রা কেমন যেন অজান্তে কীর্তির কোল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মনে পড়ল, ভট্টাচার্য তার বন্ধু গোস্বামীকে লিখেছিলেন, এবারকার প্যাটার্ন যাই হোক না কেন, সেটা হবে সম্পূর্ণ অচিন্ত্যনীয়। নইলে চোদ্দ বছরের বাচ্চা–? না তো, অভিমন্যুর বয়স কত ছিল? মনে আনতে পারল না শিপ্রা।

কীর্তি যে ছিন্নালিঙ্গন হয়েছে সেটা সে লক্ষই করেনি। গলাতে একটু জোর দিয়ে বলে যেতে লাগল, তোমাকে শক্ত হতে হবে শিপ্রা, এ ছাড়া অন্য গতি নেই। এখন শোনো। আমরা সেই চোদ্দ বছরের ছেলেটিকে মোটরে তুলে নিয়েছিলুম। কথায় কথায় বললে, যেন তেমন বলার মতো কিছু নয়, জাসটু এমনি, কে যেন কাকে খেয়া নৌকোয় বলছিল, ২৫শে ছিল বিষ্যুৎবার–।

শিপ্রা বললে, হ্যাঁ, ২৭শে মুহররম্ ছিল ওইদিন। পরদিন অমাবস্যা। ইসলামি পঞ্জিকা পড়ে পড়ে তার সবকিছু সড়গড় হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মুহরর যে শুদ্ধ উচ্চারণ সেটাও শিখেছে ওই পঞ্জিকার মেহেরবানিতে। বললে, পরে বুঝিয়ে দেব।

কীর্তি বললে, শনিবার দিন সকালে ঢাকাতে কারফু ছিল না। এক ভদ্রলোক বেরিয়েছেন তার বন্ধুর সন্ধানে। সে বন্ধু থাকেন যে-পাড়ায় তার পাশের বাজারটা আগের দিন ভোরে হারামিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তার সন্ধান না পেয়ে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন সেই পোড়া বাজারের একপাশে। এমন সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা, মা, মা বলে ডেকে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা পার হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছে– এমনিতেই সে ভালো করে চলতে শেখেনি তার ওপর দু চোখ জলে ভরে যাওয়াতে কিছুই ঠিক ঠিক দেখতে পারছিল না। রাস্তার ওপার থেকে এক বুড়ি ভাঙা গলায় ডাকছে, ওরে দুলাল, ও দুলু, আয় এদিকে আয়। দেশের স্বাভাবিক অবস্থায় ভদ্রলোক হয়তো কিছুই লক্ষ করতেন না। এখন কিন্তু শুধালেন, কী হয়েছে? বুড়ি, পরশুদিন ওর বাপ রিকশা চালাতে বেরিয়েছিল; এখনও ফেরেনি। রোজ রাতদুপুরে ফেরে। সে-রাতেই তো চাদ্দিকে গোলাগুলি চলল। ভোরের দিকে বাচ্চাটার মা রাস্তা পেরোচ্ছিল জল আনতে, এমন সময় কোত্থেকে একটা মিলিটারি গাড়ি এদিক দিয়ে জোর হাঁকিয়ে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়াল। বউটাকে গোটা তিনেক সেপাই একটানে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল, আমি রাস্তায় পৌঁছতে না পৌঁছতে। দেখলাম গাড়ি বোঝাই অল্পবয়সী অনেকগুলি মেয়েছেলে। মোল্লাজির কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লুম– আমার ছেলে-বউয়ের খবর নেবার তরে। তিনি বললেন, মেয়েগুলোকে ছাউনিতে নিয়ে গিয়েছে। ওরা আর ফিরবে না–

শিপ্রা এতক্ষণ কীর্তির মুখোমুখি টান টান খাড়া হয়ে সব শুনছিল। আস্তে আস্তে ডান হাত মুঠো করে, শক্ত– আরও শক্ত চাপ দিতে লাগল। নখগুলো বুঝি তেলোতে ঢুকে যাবে। বাঁ হাত দিয়ে ডান মুঠো জোরে চেপে ধরল। ডাইনে-বাঁয়ে সে অল্প অল্প টাল খেতে শুরু করেছে। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গিয়েছে, মেলে যাওয়া চোখ দৃষ্টিহীন, কীর্তির চোখের মণি ভেদ করে মহাশূন্যে বিলীন। কীর্তি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি তার কোমর ধরতে গেছে। শিপ্রা তাকে নিরস্ত করে শুধাল, তুমি মনস্থির করেছ তুমি কী করবে?

অতিশয় শান্ত কণ্ঠে কীর্তি বললে, সে তো আমি আগরতলাতেই করেছি, তুমি জানো। তবে হয়তো আমার অজান্তে লারির কুচক্রের ব্যাখ্যান শুনে আমার মন বিরূপ হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। এ কী ঔদ্ধত্য! নিরীহ পুব বাঙলার লোককে নিয়ে তোমরা বন্দুকের জোরে যা-খুশি করতে পারো?

শিপ্রার চট করে মনে পড়ল, বহুদিনকার ভুলে যাওয়া একটা ঘটনা। খান তাকে বলেছিল, ওই যে আমার ক্যাবলা শান্ত কীর্তিকান্ত– ওর মতো নিঝঞ্ঝাটে প্যালারাম এ দুনিয়ায় খুঁজতে হলে শকুন্তলার আশ্রমে-ফাশ্রমে যেতে হয়। মাত্র একটিবার একটা ব্যত্যয় ঘটেছিল– কেউ যদি দোসরা একটা বলতে পারে, আমি হাজার টাকা দিতে রাজি। বার আসিয়াতিকের টাকার কুমির মালিক খোট্টা ফোট্টা হবে– খামখা, অন্তত কীর্তির বিশ্বাস, বিলকুল বে-কারণ, খামখা, ঠাস করে চড় মেরেছিল এইটুকুন একটা বয়কে। কীর্তি প্রথমটায় কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করল। তার পর আমাদের কিচ্ছুটি না বলে মালিকের সামনে কী যেন ফিসফিস করল। মাইন্ড ইয়ু–আগাপাশতলা সাদা চোখে। মালিক ব্যাটাও কুল্লে দুনিয়ার মতো জানত, কীর্তিকান্ত সাতিশয় কর্মে ক্লান্ত শান্তশিষ্ট প্রাণী। সেই হল তার ব্যাকরণে ভুল। যেমন গুণ্ডাকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করা যায়, তেমনি শান্ত স্বভাবকে বস করতে হয় শান্ত স্বভাব দিয়ে। সে কীর্তির দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কী যেন একটা বলল। সঙ্গে সঙ্গে কীর্তি ঠাস ঠাস করে মালিককে মারল দুটো চড়। হৈহৈ রৈরৈ। পুলিশ এল। মালিকের বক্তব্য, হোটেল বার-এ যে কোনও ব্যক্তি আইন প্রয়োগ করার ভার আপন স্কন্ধে নিয়ে টেকিং ল ইন হিজ ঔন হ্যান্ড ভায়োলেন্ট অ্যাকশন নেয় তাকে সে বার-থেকে বের করে দিতে পারে। কীর্তির বক্তব্য, বয় যা করে থাকুক না কেন, মালিক আইন প্রয়োগ করার ভার আপন স্কন্ধে নিয়ে ভায়োলেন্ট অ্যাকশন করেছে– প্রথম– কীর্তির আগে। অতএব সে বার ছেড়ে বেরিয়ে যা। কে যেন মাফ চাইবার প্রস্তাব করাতে কীর্তি তাকে লাগায় তাড়া।… শেষটায় মোকদ্দমায় কীর্তির জরিমানা হয়। আর মালিককে জজ ভবিষ্যতে সাবধান হওয়ার জন্য ওয়ার্নিং দেন। পরদিন থেকে কীর্তি তিন বেলা ওই বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। এশিয়ান বার-এ কীর্তির প্রবেশ নিষেধ এ হুকুম আদালত দেননি। হনুমান লঙ্কায় ন্যাজ পুড়িয়েছিলেন বলে তাকে কি আর ফিসে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি? কীর্তি মালিকের ওপর কড়া চোখ রাখে, আর মাঝে মাঝে নোটবুকে কী সব টোকে। মালিকের প্রাণ অতিষ্ঠ। তার শেষ আশা, কীর্তি এ কর্ম কতদিন চালাবে? ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। উঁহু। ঠিক উল্টো। প্র্যাকটিসের ফলে অভ্যাস। অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় সে তিন বেলার ম্যাদ আরও বাড়াতে লাগল। মালিক বেয়ারা বয়কে ভালো করে শাসন করতে পারে না, মালিক চোখ রাঙালেই দেয়ালঘড়ি থেকে টাইমটা নোটবুকে কীর্তি টুকে নেয়– চড় মারার বাসনা মালিকের মাথায় উঠেছে। চাকরবাকরের পোয়াবারো। তাদের শাসন করলেই তারা এক ঝলক কীর্তির দিকে তাকায়। কীর্তি নোটবুক খোলে।… শেষটায় মালিকই হার মানল। মাফটাফ কী যেন, মনে নেই।

খান যদিও শিপ্রাকে বার বার বলেছিল, সবাই তখন কীর্তি যে আন্ডার ডগ-এর তরে মালিককে চড়, সরকারকে জরিমানা দিল, তার জন্য পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছিল, তবু শিপ্রা লক্ষ করেছিল ঘটনার অন্য আরেকটা দিক– সেটা কীর্তির ধৈর্য। ক্ষণতরে উত্তেজিত হয়ে চড় মারা, জরিমানার খেসারতি দেওয়াটা বিরল নয়, কিন্তু দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে স্বেচ্ছায় একটা রুটিন মেনে চলা বঙ্গসন্তানের পক্ষে যে কী গব্বযন্তনা সেটা শিপ্রা জানে– নইলে যে-বাঙলা সাহিত্যে সবকিছু আছে সেখানে নিত্যদিনের সহজ কর্ম ডাইরি-লিখন এবং তার থেকে যে ডাইরি-সাহিত্য গড়ে ওঠে– ইয়োরোপে যার ছড়াছড়ি– সেটা একদম নেই কেন?

আজ পূর্ব বাঙলার সাহায্যে দেবার মতো যে বিল ধাতু কীর্তির আছে, সেটা তার ক্লান্তিহীন, নিরবচ্ছিন্ন, অতন্দ্র ধৈর্য। সবুর সে করতে জানে; মেওয়াও সে চায় না।

কীর্তির চেয়েও আরও শান্ত কণ্ঠে শিপ্রা বললে, কোনওপ্রকারের অত্যাচারই তুমি বরদাস্ত করতে পারো না, সেটা আমি অনেক আগেই জানতুম আর আমাকেও এটা কতখানি পীড়া দেয়, সেও তুমি জানো। এছাড়া তোমার অন্য কোনও কারণ আছে?

কীর্তি খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবে নিয়ে বললে, পুর্ব বাঙলার পাশে গিয়ে পশ্চিম বাঙলার দাঁড়ানোটা আমার কাছে এতই স্বতঃসিদ্ধ যে নিজের জন্য আমি কোনও যুক্তি, ঐতিহাসিক নজির বা আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের সমর্থন খুঁজিনি। তবে সেদিন খানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ল একজন লোকের কথা। কপাল আমার মন্দ; একদা বাধ্য হয়ে অধ্যয়ন করতে হয় আমাকে, আন্তর্জাতিক আইন। এ বিষয়ে বহু দেশের বহু আইনজ্ঞ বিস্তর গ্রন্থ লিখেছেন; তদুপরি ছিলেন জিনিভা কনভেনশন, সাধনোচিত ধামে গত, লিগ অব নেশনস্, আছেন জীবতের চেয়েও অধম সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জ–

ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক,
তাহার তরে মিথ্যা করা শোক,
কিন্তু যখন বলে জীবন্ত
সেটা শোনায় তিতো।

এবং এমনই নোংরারকমের তিতো শোনায় যে কবি স্বয়ং পুস্তকাকারে ছাপার সময় এ লাইন কটি বাদ দেন। সে-কথা থাক্। আন্তর্জাতিক আইন শব্দদুটো শুনলেই আমার তেতো হাসি পায়। বড়ম্বরপূর্ণ স্ফীতোদর-এর ধারাগুলো নির্মিত হওয়ার বহু আগের থেকেই হোমরাচোমরা রাষ্ট্রগুলো সেগুলো তো ভেঙেছেই, নির্মিত হব-হচ্ছি হব-হচ্ছি। যখন করছে, তখনও এগুলো মদমত্ত উদ্ধত পদাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বার বার প্রমাণ করেছে এর ভারিক্কি ভারিক্কি ধারা-উপধারা সব পেপার টাইগারস, এগুলোতে বিশ্বাস করার ভান, ভক্তির ভণ্ডামি দেখায়, একমাত্র নপুংসক, পদলেহী, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল কতগুলো রাজনৈতিক যারা আপন আপন দেশের জনসাধারণের স্বীকৃতি না পেয়ে ওইসব অস্তিত্বহীন আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে অনেকটা নেই-ভূত খেদানেওলা ওঝার আগড়ম-বাগড়ম বিড়বিড় করে ইউনাইটেড নেশন্‌সের পবিত্র জর্ডনজলে বাপ্তিস্ম হয়ে আপন আপন দেশে ফিরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট, ডিকটেটররূপে স্বৈরতন্ত্রের অবাধ অত্যাচার-অবিচার চালায়– সুন্দুমাত্র টিকে থাকার জন্য। তাদের জন্য প্রতি মাসের টায় টায় পয়লা তারিখে আসে বন্দুক কামান, রোক্কা #পেয়া তনখা বৃহৎ-বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যারা এইসব রাষ্ট্রপ্রধানদের মারফত তাদের দেশগুলোকে শোষণ করে প্রতি মাসের পয়লা তারিখে, বাড়িউলি ও ভাড়াটিনীদের কাছ থেকে এতখানি টায়-টায় তার অতিশয় হক্কের পাওনা অষ্ট-গণ্ডা, ন-সিকে পায় না। পুতুল রাজার পাল আর তাদের মনিব দু দলই প্রতিদিন দুই কায়দায় দুনিয়াটাকে শুনিয়ে দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন –ফোঃ! ছোঃ!

শিপ্রা জানালা দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে পার্কের নিরস ঘাসের দিকে তাকিয়ে নির্জীব কণ্ঠে বললে, আমারও সেঁতো, তেতো হাসির সঙ্গে বেরিয়ে আসছে সেই প্রবাদপ্রায় তত্ত্বকথাটি, তোমারই ভূতের মতো উল্টো পা চালিয়ে, কাদম্বিনী বাঁচিয়া প্রমাণ করিতেছে, সে বাঁচে নাই।

কীর্তি বললে, তাই সুর মিলিয়ে গাইতে প্রাণ চায়, মাধবী, বাঁচিবে কি মরিবে কি? দ্বিধা কেন? কিন্তু নিদারুণতম তত্ত্ব, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হতে হয়, শিপ্রা, যখন সেই লোকটির কথা স্মরণে আসে, যার কথা খানকে বলছিলুম। হল্যান্ডের হুগো গ্রটিয়ুস, একাধারে বহুবিষয়ে পণ্ডিত, বিশেষ করে ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রে অর্থাৎ জুরিসপ্রুডেনসে অসাধারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিটির সম্বন্ধে কমিয়ে-সমিয়ে বলতে গেলেও আস্ত একটা দিন কেটে যাবে। ভাবো দিকিনি সেই কোন ১৬২৫-এর কাছাকাছি একসময়ে এই লোকটি নির্বাসনে, প্যারিসে প্রকাশ করেন যুদ্ধ ও শান্তিবিষয়ক আইন-কানুন। সেই আমলে লোকটি স্বাধীন মতবাদ প্রচার করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন স্বদেশে। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তাঁর ছিল আর একটি লুকনো গুণ, যে-সম্বন্ধে কড়া দণ্ডধর জেলার এবং অন্য সর্বজন ছিলেন তিমিরান্ধকারে তাঁর নিপুণ চতুরতা। তাই দুই বছর যেতে না যেতে এটিয়ুস হল্যান্ডের জেল থেকে পালিয়ে, যখন, সে-দেশময় হুঙ্কার উঠেছে, ধরো ধরো পাকড়ো পাকড়ো তারি মাঝখান দিয়ে, নিজস্ব চতুরতা প্রসাদাৎ দিব্য স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে প্যারিসে পৌঁছিলেন। ফ্রান্সের রাজা সসম্মানে তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রাখেন। আজও সে-রাজা গুণীজনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন।

আন্তর্জাতিক আইনে বিশ্বাস করো, আর নাই-বা করো ঘটিয়ু তার জন্মদাতা বলে আজ সর্বত্র স্বীকৃত। তাঁর যেসব বিধান তখনকার গুণী-জ্ঞানীদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল আজও সেগুলো বহুলোককে বিস্মিত করে, এবং নিশ্চয়ই বিগ ইয়েহিয়া এবং জুন্টার বিগার কর্ণে বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপবৎ শোনাবে।

সর্বপ্রথম তিনি বলছেন, মানুষে মানুষে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, নেশনে নেশনে তাই হবে। ব্যক্তিবিশেষ অন্য ব্যক্তির অনিষ্ট করলে যেরকম তাকে দমন করা হয়, ঠিক সেইরকম একই মাপকাঠি দিয়ে বিচার করতে হবে এক নেশন অন্য নেশনের অনিষ্ট করছে কি না, যদি করে থাকে তবে সে নেশনকে দমন করতে হবে। এ কথাগুলো নীতি হিসেবে অনেকেই মেনে নেবে। অবশ্য ভণ্ড মুচকি হাসিসহ।

কিন্তু এর পরই তিনি যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, যে ব্যবস্থা অবলম্বন বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছেন সেটা আজ যদি ইউনাইটেড নেশনসে কেউ প্রস্তাব করে তবে প্রভু খ্রিস্টের ন্যায় তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। দুই নেশনে যদি লড়াই লাগে তবে ছোট-বড় কোনও নেশনই নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না, সে হক্ক তার নেই।

শিপ্রা আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী? সব নেশনকে নামতে হবে লড়াইয়ে?

উৎসাহিত হয়ে কীর্তি বললে, ঠিক ধরেছ, গুরু। আমিও প্রথমটায় আমার চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি তো বাংলায় বললুম নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। আসলে এটিয়ুস ব্যবহার করেছেন, নন্-বেলিজারেট হতে পারবে না, অস্ত্র সংবরণ করে থাকতে পারবে না– তিনি সজ্ঞানে নিউট্রেল শব্দটি এড়িয়ে গেছেন, সে তো তিনি কাউকেই থাকতে দেবেন না। ওই যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া বশত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে নেশনের সামান্যতম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তাকেও দোষী নেশনকে সাজা দেবার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হবে।

সাজা দেবার জন্য!

হ্যাঁ, সুদ্দুমাত্র কড়া শাসনের শাস্তি দেবার জন্য। তাতে করে সে-রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধি পেল কি না, আখেরে তার ক্ষতির পরিমাণটা কী দাঁড়াবে– এ সমস্ত কুটিল অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা সম্পূর্ণ অবহেলা করে।

শিপ্রা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। কীর্তির একটা হাত তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে আপন কপালে থাবড়া মেরে বলল, হায় রে কপাল! সাড়ে তিনশো বছর হতে চলল ভদ্রলোকের কোন প্রস্তাবটা কে মেনেছে? কোন রাষ্ট্র আজ জানে না, পুব বাঙলায় আজ কী হচ্ছে? মাত্র ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্র বাকি দু জনা আগের থেকেই হাত গুটিয়ে আরাম করছিলেন তারই প্রধানমন্ত্রী ঘাড় ফিরিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন যখন হাহাকার রব উঠেছে অস্ট্রিয়ায়, তার কাতর আর্তনাদ ধেয়ে চলেছে লন্ডন পানে ধর্ষণ করছে তাকে গুণ্ডা হিটলার!… কে বলে নির্লজ্জতারও একটা সীমা আছে? বছরটা ঘুরলো কি না, পড়ি মরি হয়ে এবার ছুটল সেই সৌন্দৰ্যামোদী গোরা রাজ–চেকদের স্বহস্তে যূপকাষ্ঠে আবদ্ধ করার জন্য যাতে করে পিশাচ পূজোর পুরুত হিটলারের এক ঘা-তেই পটপট করে সারি বেঁধে সবকটা মুণ্ডই থাক।

কীর্তি একটু চিন্তা করে বলল, হিটলারের কীর্তিকাহিনী পড়লে শিউরে উঠতুম একদিন। এখন মনে হয় বেচারীর শেষ সান্ত্বনাটুকুও গেল।

মানে?

সাধনোচিতপ্রাপ্ত ধামে বসে সে অন্তত একটা গর্ব অনুভব করত যে, এ যুগে সজ্ঞানে তার মতো নিষ্ঠুরতা আর কেউ দেখাতে পারেনি। পঁচিশের পৈশূন্য-রাত্রে, ইতোমধ্যে বাঙালির মরণকামড় খেয়ে সেখানে ইয়েহিয়ার বেশ কটি চেলা হিটলারের সঙ্গ পেয়ে হাইল হিটলার পাকিস্তান জিন্দাবাদ সম্ভাষণান্তে দু দণ্ড রসালাপ করতে বসে গেলেন। যথাভ্যাস, হিটলার কাউকে মুখটি খোলর মোকামাত্র না দিয়ে তাঁর গৌরবময় দিনের মনিকি কায়দায় বলে যেতে লাগলেন, গ্যাস চেম্বার তার চেয়েও সস্তায় মানুষ খতম করার ইনজেকশন আবিষ্কার, ইহুদি রমণীদের কুন্তলদাম দিয়ে মোলায়েমতম তাকিয়াকুশন নির্মাণ, লাশের নীল উল্কিতে চিত্রবিচিত্র চামড়া দিয়ে তৈরি ল্যাম্পশেড– ওহোহো! সেগুলো কী অপূর্ব আলো-ছায়ার আলিম্পন ঘরের সর্বত্র বিচ্ছুরিত করে দিত।

বাধা দিয়ে এক পাঠান বললে, খাবসুরত নয়ি নয়ি চিজের বাই যদি তুললেন, তবে, আমার মনে হয়, হুজুর, গৃহস্থঘরের উচ্চ কুচ বিশিষ্টা… হঠাৎ কীর্তি থেমে গেল।

শিপ্রার তিক্ত মুখ কীর্তি ইতোপূর্বে আর দেখেনি। বললে, এখনও লজ্জা! ভয় তোমার গেছে, জানি, কোনওকালেই খুব-একটা ছিল না। ঘৃণাটা আমাদের কখনও যাবে না। তোমার সম্মুখে যে কঠোর কর্তব্য উপস্থিত সেখানে সহকর্মী সংগ্রহ করার জন্য তোমাকে লজ্জাশরম সম্পূর্ণ বর্জন করে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই বলতে হবে হীনতম অশ্লীলতম আচরণের কথা।

কীর্তি নীরস কণ্ঠে : পাঠান বললে, আমরা জনাদশেক একটা কলেজের মেয়েকে ধর্ষণ করার পর মেয়েটা আমারই নিচে খাবি খেতে লাগল। বেহুশ হওয়ার আগে পানি পানি বলে গোঙরাচ্ছিল, আধমরা গলায় আস্তে আস্তে ইয়া আল্লা! ইয়া রসূল! আরও কী কী সব বিড়বিড় করছিল, আমি জানিনে ওসব, কিন্তু ডেরা ইসমাঈল খানের মৌলবি সাহেবের জবানে শুনেছি। তার পর হাত-পা খিচতে খিচতে হঠাৎ চোখদুটো ইয়াব্বড়া তাম্বুর মতো খুলে গেল। দেখি, চোখের কালো মণিটনি কিচ্ছু নেই, একদম সাদা চোখদুটো জড় ছিঁড়ে ফেলে সমুচা উল্টে গিয়ে ভিতরের দিকটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে আমাদের সর্দারকে ফাঁসি দেওয়ার পর লাশে অ্যাসা চোখ দেখেছিলুম– মার্বেলের মতো ধবধবে সাদাতে কিন্তু রক্তের ছিট গোলাবি রঙ ধরে তার পাকা আপেলের গোলাবি গালের মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন গালদুটো হলদে রঙের পুঁজ মাফিক–আলবৎ তখন না, যখন সে ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল আপন জান নেবার জন্য আর আমরা নিচে তখন তৈয়ার ছিলুম ওকে পাকড়াবার জন্য। আরও কত পড়ল, আমরা গপাগপ পড়ার আগেই ধরে নিলুম। জ্যায়সাকে পাক্কা মেওয়া। হিটলার সাহেব, কী বাতাই আপকো। সবসে খাবসুরত দেখলুম, লাল খুন তার দুধের মতো সফেদ উরুর উপর– ওয়াহ, ওয়াহ্। সবকুছ আমার পির সাহেবের মেহেরবানিতে।… কিন্তু, হুজুর, জওয়ান ঔরটা বড়া বেতমিজ ছিল। কুছ না– অচানক দম বন্ধ— ছটসে মরে গেল। আমাদের শের দিল খান গয়রহ তিন বেরাদর তখনও বাকি। লেকিন ওরা পাক্কা মর্দ। জিন্দা-মুদাতে ফরক করনেওয়ালা পাঠানকা বেটা ওরা নয়। জঙ্গি খান একটা চোচির ডগা কামড়ে মুখে পুরল। আমি ছোরা দিয়ে দুসরাটা কেটে- অ্যাসা বড়া কভিভি দেখবার খুশ-কিস্মাৎ আমার জিন্দেগিতে হয়নি– পুরা সমুচা হাড্ডিতক কেটে আমার সঙিনের ডগায় খোঁচা দিয়ে সঙিন উঁচা করে ধরলুম। তার পর সব ভাই-বেরাদরের তালে তালে হাততালি শুনতে পেয়ে সঙিন উঁচা করে জুড়ে দিলুম মহরম মিছিলের নাচ আপনি, জনাব-ই-আলা হিটলার-সায়েব হয়তো জানেন না, মহরম আমাদের সবৃসে খাস, সসে পা মাস

আর তখনও চলছে মহরম। মেজর আসন খান আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, বড়া বড়হিয়া খেদমত করেছ পূরব-পাকিস্তানের কাফির লেড়কিকে খতম করে পাক্ মহরম মাসে। সোনার মেডেল পাবে। আমি সুপারিশি চিঠঠি আজই ভেজ দেব।

হিটলারের লাল গাল তখন হলদে। সর্বাঙ্গে কম্পন।

এমন সময় কে একজন কঠিনদর্শন অপরিচিত, ইউনিফর্ম-পরা অফিসার এসে উপস্থিত। সেটা হিন্দুর নরক, মুসলমানের দোজখ, খ্রিস্টানের হেল, ইহুদির গেহানেম, গ্রিকদের কলাসিস কোনও মুলুকেরই উর্দি নয়। পাঠানরা ঠাহর করতে পারছিল না, তারা কোথায় এসেছে। তবে এটা যে বেহেশত বা দোজখ কোনওটাই নয় সেটা বুঝে গিয়েছিল। হিটলার ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিলেন অত্যন্ত বিষণ্ণ বদনে।

অফিসার ডান হাত তুলে হাইল হিটলার সম্ভাষণ জানিয়ে শুধাল, আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? এ প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদ্ঘাটনের সময় আপনিই ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র সদস্য– যাকে বলে ফাউনডেশন মেম্বার। আপনি তকলিফ করে অন্যত্র যাবেন কেন?

হিটলার বিষণ্ণতর বদনে বললেন, আমি বিখ্যাত জর্মন গোষ্ঠীর একজন; কিন্তু আজ বড়ই লজ্জা পেয়েছি কতকগুলি আকাট, পাড় বর্বরের কথায়। আপনারা আমার সাধনোচিত ধাম নির্ণয় না করতে পেরে এই নবীন প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেন। আমার কোনও আপত্তি নেই– কারণ ইহুদিদের জন্য আমিই এক নয়া নিধনাগার গ্যাস চেম্বার নির্মাণ করি। কিন্তু এই পাঠানদের সামনে আমাকে নিত্য নিত্য লজ্জা পেতে হবে, এটা আমার সইবে না। আমাকে বরঞ্চ ডিমোট করে নিম্নাঙ্গের যে কোনও অগ্নি পূরীষ কুণ্ডে পাঠান।

অফিসার বিস্মিত হয়ে শুধালেন, লজ্জাটা কিসের? আমি অতিশয় প্রাচীন সর্বাভিজ্ঞ অফিসার। আদম-ইভের প্রথম পাপ থেকে আরম্ভ করে হেন কোনও অতিশয় উর্বর মস্তিষ্কধারীর অচিন্ত্যনীয় কল্পনা-প্রসূত কোনও আচরণ দেখিনি– অপরাধ নেবেন না– যেটা আপনাকে লজ্জা দিতে পারে।

হিটলার বললেন, থ্যাঙ্কু! আমি গর্ব অনুভব করছি। কিন্তু শুনুন, আমি ফ্রানসকে পদানত করেছি, আরেকটু হলে আমার চেয়ে ঢের ছোট ক্যালিবারের চার্চিলকেও ঘায়েল করতুম, গ্যাস চেম্বার, অনেক নতুন নতুন উৎপীড়ন পন্থা আবিষ্কার করেছি সে নিয়ে আমার কোনও অহমিকা নেই। গর্ব, আত্মপ্রসাদ, দম্ভ, ঔদ্ধত্য ছিল আমার মাত্র একটি সামান্য, সঙ্কীর্ণ বিষয়ে যেটাকে হোমরা-চোমরা পলিটিশিয়ান, মিলিয়নের, রাজারাজড়া, বীরবীরেন্দ্র কেউই কণামাত্র সম্মান দেন না, বস্তুত অবহেলা, তাচ্ছিল্য করেন, এমনকি কৃপার চোখে দেখেন– সে বিষয় আর্ট। এ তাবৎ আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস ছিল, কলানৈপুণ্যে আমি কল্পনা পরীর পাখায় ভর করে যে সর্বোচ্চ গগনে উড্ডীয়মান হয়ে নব নব সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম উল্কট উৎকট দৈহিক মানসিক যন্ত্রণাদায়িনী পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলুম, সেগুলো মহাপ্রলয় পর্যন্ত মহামানবের অভাবনীয় গৌরব, বিশ্বমানবের অকল্পনীয় বৈভব হয়ে মহাপ্রলয় পর্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে আমার জয়ধ্বনি গাইবে। এই মাত্র আমার সে-বিশ্বাস নস্যাৎ হল। এখন শুনছি, দিক-দিগন্তব্যাপী টিঢিক্কার।… মহামূর্খ যে-পাঠানের না আছে সাহিত্য না আছে নাট্য, যাদের সঙ্গীত শুনে শিবাশগাল সোল্লাসে উপযুক্ত শিষ্যপ্রাপ্তির পরিতুষ্টিতে চিৎকারিয়া নব নব কর্ণপটহ বিদারিণী রাগ-রাগিণী দ্বারা বনস্পতি মরুভূমি প্রকম্পিত করে সেই পাঠান আজ আমাকে সর্বজনসমক্ষে, নিপীড়ন কলাশাস্ত্র ও তজ্জনিত সঙিনাগ্রে স্তন সম্বলিত নৃত্যে প্রথম ভাগের প্রথম ছত্র শিক্ষা দান করল! যে-লোকে আছি তার অন্ত নেই তাই সেখানে অন্তিম বাসনাও নেই, নইলে এই মুহূর্তে বাম করতল নিষ্ঠীবনপূর্ণ করে সেই কুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে সর্ব অবসান ঘটাতুম। আমি চললুম।

কীর্তি বললে, এটা এক ভদ্রলোক আমাকে রসিয়ে রসিয়ে শোনাচ্ছিলেন যে-জায়গার একটা লজ্রঝড় ছাউনিতে তার নামটাও বিকট- ফাঁসি দেওয়া না কী যেন। সেই বাগডোগরা যেখান থেকে তুমি হিমালয় দেখেছিলে, তারই কাছে। ভদ্রলোক নিষ্ঠাবান মুসলমান। পুব পা থেকে এপারে এসে ছেলে-ছোকরাদের জড়ো করে বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছিলেন। কথায় কথায় তার মুখে গড়ে নতুন নতুন হাসির গল্প, কিংবা হাসি-কান্নায় মেশানো। আমি একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে শুয়ে অধোমুখে দেখছিলুম সেই হাস্যমধুর লোকটি খোলা আকাশের নিচে, জায়নামাজ পেতে প্রায় দুপুররাত অবধি নামাজ পড়লেন, দু হাত তুলে প্রার্থনা করার সময় গুনগুন করে গীত গাইলেন। তিনিই তার আপাতদৃষ্টিতে স্রেফ গুলতানি শেষ করে আমাকে বললেন, আচ্ছা, চৌধুরী সায়েব, বলুন তো হিটলার ইহুদিকুলকে নির্মূল করার সময় কি খুব বেশি ইহুদি স্পাই, স্যাদি-এর মদদ পেয়েছিল? আমি যদূর জানি খুব অল্প কয়েকজন মাত্র।

আমি বললুম, স্পাই স্যাদি আদৌ পায়নি। যেটুকু যে-কজন করেছে সেটা হিটলার-হিমলারের সেপাইদের গুলিভরা বন্দুকের সঙিনের খোঁচা খেয়ে খেয়ে।

অথচ দেখুন, মাতাল লম্পট ইয়েহিয়া ওদিকে আবার কট্টর শিয়া। ভুট্টোর বাপ স্যার শাহ নাওয়াজ খান ভুট্টোকে খাঁটি সিন্ধি মুসলমান বলা চলে না। সিন্ধু দেশের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করে খুদ আরবদের হাত থেকে অষ্টম শতাব্দীতে। পক্ষান্তরে ভুট্টোর হিন্দু পূর্বপুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন রাজপুতানাতে সপ্তদশ শতাব্দীতে। পরে সিন্ধুদেশে চলে আসেন এবং ক্রমে ক্রমে বিরাট বিস্তীর্ণ, আল্লা জানেন কত লক্ষ বিঘের জমিদারি গড়ে তোলেন।

শিপ্রা বলল, বাপ! একবার ভাবো তো মারওয়াড়, রাজপুতানার যারা এদেশে বসবাস করছে, তারা যদি মাছ-মাংস খেয়ে আমাদের সঙ্গে এক হয়ে যেত, তবে আমরা, বাঙালিরা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতুম না। পুব বাঙলায় যদি তারা মুসলমান হয়ে যেত, থাক। বল কী বলছিলে।

ভদ্রলোক বললেন, ভুট্টোর পিতা জমিদারির জোরে ক্রমে ক্রমে জুনাগড় স্টেটের প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশবিভাগের সময় মি. জিন্নার নির্দেশ অনুসারে তিনি নওয়াব সাহেবকে জুনাগড় যেন পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হয় সেই মন্ত্রণা দেন। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান প্রজারা রুখে দাঁড়াল। শেষ ফল তো জানেন। শাহ নাওয়াজ শেষ চিঠিতে জিন্নাকে লিখলেন,

জুনাগড়ের মুসলমানদের পাকিস্তান-প্রীতি নেই বললেও চলে।

কিন্তু আশ্চর্য, শাহ নাওয়াজ গোষ্ঠী শিয়া এবং অত্যন্ত গোঁড়া শিয়া। উভয় বাঙলায় শিয়ার যে ছিটেফোঁটার ভগ্নাংশ লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে সিন্ধুতে তারও বাড়া–আছি-কি-না-আছি গোছ। তৎসত্ত্বেও।

শাহ্ নাওয়াজ খানের চারজন বিবি ছিলেন। জনৈক প্রাজ্ঞ সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাম-সাংবাদিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এই ধরনের পরিবারে এইটেই ছিল রীতি। সে-সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছলেন কী করে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি– যদিও আমি পুব পাকের নিম্নতম স্তরের জজ ছিলুম বটে, তবু শুধু যে সেই দেশের মুসলিম আইনানুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন ব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করতে হয়েছিল তাই নয়, ভারতের ভিন্ন ভিন্ন। প্রদেশে মুসলমান, আধা-মুসলমান, সিকি মুসলমানদের ওপর সম্পত্তি বন্টন ব্যাপারে দেশাচার কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে তার গবেষণাও আমাকে করতে হয়েছে। কিন্তু এসব শপ শুনতে কি আপনার মন যাচ্ছে।

আমি সবিনয় বললুম, ধর্মাবতার, হুজুরই, বেগ পাৰ্ডন, মহামান্য আদালতই বিচার করুন। যদি অনুমতি দেন তবে নিবেদন, আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার নই।

বাধা দিয়ে ছোট জজ বললেন, সেটা আর বলতে হবে না। সংবাদদাতা গুষ্টির নিতান্ত চ্যাংড়া ভিন্ন কোন বড়া সাব ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল বার, কলকাতায় তো জাত-বেজাতের এন্তের, ত্যাগ করে হোটেলের দুর্গম প্যাসেজ, বিপদসঙ্কুল বারান্দা পর্যন্ত বেরোন সন্দেশ সংগ্ৰহনার্থে? মাফ করবেন আপনি বলুন।

ও সে তেমন কিছু নয়, মোদ্দা কথা, ওদেরও অধম যারা তামাশা দেখবার তরে হাসনাবাদ থেকে করিমগঞ্জ-আগরতলা অবধি রোদ মারে, আমি তাদেরও কেউ নই, আর আপনাদের মতে, স্বয়ং আল্লাতালা দ্বারা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠতম সৃষ্ট দেবদূতের কাছে এসে দাঁড়াবার মতো দম্ভ, হীন কৃপার পাত্র বাতুল আমি–

জজ জিভ কেটে ছি ছি, তওবা তওবা বলে কানে আঙুল দিলেন। এসব না-হক অভদ্রভাবে বন্ধ না করলে আল্লা পাক আমাকে আমার মায়ের কোলে ফিরে যেতে দেবেন না। কীর্তি বললে, ভাবালুতা, ক্ষুদ্র হৃদয়-দৌর্বল্য জজদের সর্বথা বর্জনীয়। তাই তাঁর আম্মাজানের কথাটা আপন অবিবেচনা মনে করে সেটা ঢাকবার জন্য তাড়াতাড়ি খেই তুলে নিয়ে বললেন, ভারতের যত্রতত্র ভূস্বামী, যত্রতত্র একদারনিষ্ঠতা– এটা মূল সূত্র, অবশ্য বাস্তবতর হবে একদারদাসত্ব। চারটে বিয়ে করে বারোটা ছেলে পয়দা করলে, ভাগ, তস্য ভাগের ফলে তিন পুরুষেই জমিদারি নিকুচি। অতএব রীতি চার স্ত্রী নয়, এক স্ত্রী এবং হারেমে জনাতিনা খাদেমা অর্থাৎ সেবিকা, কিংবা ওই জমিদার বিগ্রহের সেবাদাসীও বলতে পারেন। নিতান্ত যারা আল্লাকে বড্ড বেশি ডরায় তারা দু জন সাক্ষী সামনে রেখে বিয়ের একটা ভড়ং করে। তা সে যাক গে। মোদ্দা কথা, মি. জুলফিকার আলি ভুট্টোর মাতা শাহ নাওয়াজকে বিয়ের প্রাক্কালে হিন্দুধর্ম বর্জন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানেরই একাধিক কাগজ একাধিকবার বলে, বিয়েটা নাকি আদৌ হয়নি। ভুট্টো-প্রেমীজন প্রমাণ স্বরূপ বলেন, বিবাহে গুলাম মহম্মদ, হিদায়েউল্লা ও উল্লেখযোগ্য কিছু লোক ছিলেন। নিন্দুক বলে, ওটা বিয়ের মজলিস্ ছিল না মোটেই। ইংরেজ যেটাকে বলে nautch বাইনাচ। প্রধান নর্তকী কে ছিলেন, সে আলোচনা ঐতিহাসিক-কাম-সাংবাদিকরা করবেন।

বিয়ে হয়েছিল কি না, সেটা তর্কাধীন। জানি যে, আপনার কী মত, কিন্তু সেটা আমার মনের ওপর কণামাত্র রেখাপাত করে না। তর্কাতীত সত্য, জুলফিকারের মাতা হিন্দুরূপে জন্ম নেন। তার ওপরও আমি কোনও প্রাধান্য আরোপ করিনে। এক হজরত আলি ছাড়া আমাদের পয়গম্বরের সব শিষ্যই তো মুসলিম হওয়ার আগে আরবদের বর্বর ধর্ম মেনে চলতেন।

কিন্তু যারা ফ্রয়েট পদ্ধতি দ্বারা মি. ভুট্টোর সর্বপ্রধান ধর্ম- ভারতের প্রতি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, হিন্দুদের প্রতি তার প্রতি লোমকূপে প্রোথিত বিদ্বেষ, দ্ৰজনবর্জিত ভাষায় সুযোগে, কুযোগে, অযোগে নিত্য নিত্য তাদের প্রতি কুৎসিততম গালিগালাজ, এই একটিমাত্র অটল অবিচল অপরিবর্তনীয় অবিমিশ্র ধাতু দিয়ে নির্মিত তার সত্তা। তবে কি তার দেহে যে হিন্দু রক্ত আছে সেইটেই অস্বীকার করার জন্য, লোকে যেন সেটা স্মরণেও না আনতে পারে সেই উদ্দেশ্যে এই হিটলার-প্রশংসিত নীতি, হিট হিট হিট, হাতুড়ি দিয়ে হানো, হানো, হানো যতক্ষণ না লোকে পুনরাবৃত্তির ফলে হিপনোটাইজড, সম্মোহিত অবস্থায় তোমার বাণী, সত্যই হোক মিথ্যাই হোক, গলাধঃকরণ করে?

অপরাধ নেবেন না, আমার স্মৃতিরাজ্যে শেক্সপিয়রকে দেবার মত আসন নেই–হ্যামলেট না কে যেন বলেছিলেন তার দেহে তাঁর মাতার যে অংশটুকু আছে সেটা তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিতে চান অথচ ভুট্টোর মাতৃদেবী হয়তো সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন। এবং আমি এসব কথা আদৌ তুলতাম না যদি ভুট্টো স্বয়ং একাধিকবার শেখ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ না দিয়ে থাকতেন। শেখের ব্যাকগ্রাউন্ড জানে না কে? আমারই মতো পুব বাঙলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মামুলি মুসলমান তিনি। ভুট্টো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, পুব বাঙলার সমস্ত অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী মুজিব এবং তার ব্যাকগ্রাউন্ড। একথা তথাপি তর্কাতীত সত্য যে মুজিবের মাতার সঙ্গে তাঁর পিতার বিবাহ হয়েছিল কি না সে প্রশ্ন ফরিদপুর অঞ্চলের লীগবৈরী, মুজিবের আশু পরলোক গমনাকাতক্ষী নেমকহারাম বিহারিরা পর্যন্ত করেনি এবং বিয়েটা প্রমাণ করার জন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী হেদায়েউল্লার উপস্থিতিও প্রয়োজন হয়নি।

ভুট্টো ইসলামের কোনও নির্দেশই মানেন না। ওদিকে ভয়ঙ্কর শিয়া।

জুন্টার নির্দেশে যে মেজর জেনারেল ইসকন্দর মির্জা সর্বপ্রথম আইনত ডিকটেটর হয়ে তিন সপ্তাহ রাজত্ব করেন তিনিও গোঁড়া শিয়া। মির্জাই ধর্মভ্রাতা ভুট্টোকে আপন উপদেষ্টা রূপে বা মন্ত্রণা সভায় ডেকে নিয়ে রাজনীতির সুন্নৎ (সারকামশিসন) করান অবশ্যই শিয়া কায়দায়। অবান্তর নয় যে মির্জাকে ডিকটেটরিতে প্রমোশন দেবার ষড়যন্ত্রটা করা হয় এক শিয়া-ভবনে, ভুট্টোজনকের প্রাসাদে।

ইয়েহিয়াও গোঁড়া শিয়া। শিয়ারা বিশ্বাস করেন, সুন্নিরা তো মুসলিম নয়ই, তারা কাফির। এবং চরমপন্থি শিয়াদের স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস, সুন্নিমাত্রই ওয়াজিব উল ক অর্থাৎ সুন্নি দর্শনমাত্রই তাকে নিধন করা শাস্ত্ৰাদেশ।

ওদিকে জুন্টাতে কোনও শিয়া আছেন বলে শুনিনি। ইসকন্দরের আমল থেকে এযাবৎ জুন্টাই পাক রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তিধর।

সেই সুন্নি জুন্টাকে বোকা বানিয়ে, পুব বাঙলার মুসলমান মাত্রই কাফির সে-তালিম মুসলমান পাঞ্জাবি-পাঠান-বেলুচের অস্থিমজ্জায় উত্তমরূপে ঢুকিয়ে দিয়ে অগণিত বাঙালি মুসলমানকে করালো খুন, তাদের অবলাদের করালো ধর্ষণ, তাদের ঘরদোরে জ্বালাল খাণ্ডবদাহন মাত্র দুটি শিয়া। অদ্যদ্ভুত পৈশাচিক নৈপুণ্য না থাকলে দুটি মাত্র শিয়া ইয়েহিয়া এবং ভুট্টো যাদের কাছে উভয়াপা-এর অগণিত সুন্নিই কাফির এক পা-এর কাফির দিয়ে অন্য পাক-এর কাফির উৎপাটন করার মতো ধৃষ্টতা হৃদয়ে ধরতে পারত কি?

হিটলার পেরেছিল কি জর্মনির কাফির ইহুদিদের বোকা বানিয়ে, তাতিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের কাফির ইহুদিদের হত্যাধর্ষণলুণ্ঠন করাতে? দূরেই থাক সে দুরাশা! বরঞ্চ সে যাদের মর্ত্যের আদর্শ মানব (সুপারম্যান) উপাধি দিয়ে চিরজীবন প্রপাগান্ডা চালাল, সেই নর্ডিক জাতের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভ্রান্ত অনেক অফিসার, রমেলসহ, তিন-তিনবার চেষ্টা দিল তাকে হত্যা করতে। ফলে দু হাজার থেকে পাঁচ হাজার কে জানে কত– নর্ডিক সুপারম্যানকে মেশিনগান্-এর গুলিতে, ফাঁসিকাঠে, শক্ত সরু তারে ঝুলতে ঝুলতে আধ ঘণ্টাটাক শূন্যে পা দুটো আছড়াতে আছড়াতে এ পদ্ধতিতে ফাঁসির মতো এক ঝটকায় না–দমবন্ধ হয়ে প্রাণ দিল। এ যাবৎ কোনও শিয়ার শরীরে আঁচড়টি তক লাগেনি।

এবারে বলুন, চৌধুরী সাহেব, সেই অনামা অমর্ত্যলোকে কার নীচাসন– হিটলারের না ইয়েহিয়ার ফাঁসুড়েদের?

.

১১.

আলিঙ্গন ঘনতর করে বাষ্পভরা কণ্ঠে কীর্তি বললে, এই তো আমার অক্ষয় সম্পদ। তোমার প্রেমই আমাকে দেখিয়ে দেবে পথ, অরে দেবে আমার বুক সাহস দিয়ে, আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মতো অপদার্থকে করে দেবে কর্মনিষ্ঠ। যেখানেই যাই না কেন, যেতে যেতে তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি না কেন, তোমার কথা ভাবলেই পাব নবীন উৎসাহ।

মৃদুকণ্ঠে শিপ্রা বললে, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই।

কীর্তি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

শিপ্রা বিদায়-বেলার পীড়া হালকা করে দেবার জন্য বলল, একজন নীরবে চিন্তামগ্ন হলে অন্যজন প্রায়ই বলে, তুমি কী ভাবছ সেটা যদি আমাকে জানাও তবে তোমাকে একটা পেনি দেব– এ পেনি ফর ইয়োর থট; আমি যদি এটা পাল্টে বলে দিতে পারি, তুমি এখন কী ভাবছ, তুমি একটা পেনি দেবে?

কীর্তি তবু চুপ।

শিপ্রা বাসনার লহরে হরে রঙিন দুটি ঠোঁট দিয়ে কীর্তিকে নিবিড় চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দিয়ে বললে, তুই ভাবছিস, মিতা, এখন যদি বলি, আমাকে বিয়ে করো তবে শিপি আগের মতো আর না বলতে পারবে না, এইমাত্র যখন কথা দিয়েছে আমাকে তার অদেয় কিছু নেই বল, কিতা, ঠিক ধরেছি কি না?

কীর্তি একটিমাত্র শব্দে উত্তর দিল, ঠিক।

শিপ্রা অভিমানের ছল করে বললে, বা রে! তুমি কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছ না যে! একদিন আমার দুর্বলতম মুহূর্তে- যেদিন আমি আমার সর্ব উজাড় করে দিয়েছিলাম তোমাকে, অগ্রণী হয়ে, নিজের থেকে নারীর শেষ সম্বল তুমি আমায় বলনি ওইটেই তোমার একমাত্র ভাবনা। আমি তখন সেটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলেছিলুম, হৃদয় আর ভাবনা তো একই সত্তা :

কিবা সে হৃদয়? হৃদয় কাহারে কয়?
সে তো একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি।

শেষ ভাবনা উধাও হয়ে যাবে শেষ কামনা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন রইবে শুধু একবিন্দু শোণিত; ভাবনাটা উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে তোপ হৃদয়ও। ভাবনা-ভরা হৃদয়-হারা সুন্দুমাত্র একবিন্দু শোণিত তো মানুষ ভিন্ন সব প্রাণীরই আছে। ভাবনাভরা শোণিতবিন্দুটির নামই তো কীর্তি ঠাকুর। আমার ঠাকুর। উত্তরে তুমি বলেছিলে, তোমার মন্তব্যটাতে শোণিতবিন্দুও নেই।… আজ যদি কবির সুরেলা গলার সঙ্গে আমার বেসুরো গলা মিশিয়ে অর্থাৎ একটু পরিবর্তন করে গাই, জানি সেটা জনসমাজে করলে হবে ধৃষ্টতা, কিন্তু তুমি আমি মধুর ভাষে দীন, হিয়া প্রকাশে হীন, তাই কবি সেটা ক্ষমা করবেন

হৃদয়-বাসনা পূর্ণ হল আজি
হেরি আঁখি-ভরা মনে
মম প্রিয়া চিত্তমাঝে বসি স্থির আসনে।

তা হলে?

কীর্তি তখনও চুপ।

শিপ্রার আদর যেন অফুরন্ত। বললে, আজ আমার পেনি জমাবার দিন। যদি বলতে পারি এখন তুমি কী ভাবছ, আরেকটা পেনি দেবে?

বল।

মিতা, আমি জানি যে, তুমি জানো, আমি কী উত্তর দেব। এবং সেই নিয়ে তোমার মনে তোলপাড় আরম্ভ হয়েছে। আগে ছিল ভাবনা, এখন দুর্ভাবনা।

কীর্তির ঠোঁটের কাছে এনে তার নিশ্বাস শিপ্রা আপন নাক দিয়ে নিঃশেষে শুষে নিয়ে গুনগুন করে গাইল, আমাতে মিশা তব নিশ্বাস নবীন উষার পুষ্প সুবাস– বার বার। তার পর আবার বার বার বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল, হে প্রিয় করুণ মম অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। তার পর কীর্তনিয়া রীতিতে বার বার আখর দিল, অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। মাঝে মাঝে থেমে থেমে কীর্তির নিশ্বাস নিঃশেষে শুষে নিয়ে আপন বুক ভরে নেয়– তার শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই।

হঠাৎ একবার দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করা সত্তেও সেটা কীর্তির গাল ছুঁয়ে গেল। কীর্তির দু হাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়া ঘন কোঁকড়া চুলের নিচে আধা হারিয়ে-যাওয়া মুখটি কাছে টেনে এনে বললে, বল দেখি, তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছ?

শিপ্রা চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে ঠোঁটে মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললে, অস্বস্তি কিসের? নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে শুধু আমি একটু হতাশ হলুম। আমি আশা করেছিলুম, বাবার বন্ধু ফরাসি ফৌজি অফিসাররা যেরকম ভালো মন্দ বিপদ আপদ, সুখ দুঃখ, সব অবস্থাতেই ধরে নেয় যে এটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটাই তো স্বাভাবিক, আটপৌরে– এমনকি আমাদের কবির সর্বশেষ কবিতার যে প্রায় সর্বশেষ ছত্রে আছে, অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে ঠিক তা-ও নয়, ছলনাটাও তাদের কাছে ছলনা নয়, ওটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কিন্তু কবির অনায়াস বেশিরভাগ চরিত্রেই থাকে এবং সেটার মূল্য দেয় শোল্ডার শ্রাগ করে, তা পি বলে, মানে, জানা তো ছিলই, জীবনটা একটানা শ্যাম্পেন আর কাভিয়ার হতে পারে না, জেনারেল ব্যাটা আটকে দিল প্রমোশনটা, আর প্রিয়া তো হর-হামেহাল উঁচিয়ে আছেন জিল করার পিস্তল– তার পর সেই স্বাভাবিক আটপৌরেটার সামনে তার আচরণটাও অনায়াসলব্ধ– প্যারিসের প্রিমা দন্নার অযাচিত প্রেম যদিস্যাৎ অকস্মাৎ বিলকুল ফ্লকে লটারির প্রাইজের মতো পেয়ে যায় তবে অনায়াসে তাকে নিয়ে সগর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবে, আবার বিকল্পে যদি উপলব্ধি করে, পরের দিন জুয়োর দেনা শোধ না করতে পারলে মান-ইজ্জত থাকবে না, তখন তো সেই নিত্যদিনের তা পি –সো মাচুদি ওয়ার্স আছেই– প্রিয়ার মুখটি সাদরে তুলে ধরার মতোই অনায়াসে পিস্তলটা তুলে ধরে ঠেকাবে রগে– আমি আশা করেছিলুম একটানা বহু সায়ং সন্ধ্যা তাদের অনায়াস সঙ্গ পেয়েছিলুম বলে আমিও তাদের শোল্ডার শ্রাগ করে তাঁ পি- বয়ে গেল– বলতে পারব, অন্তত খানিকটে।

কীর্তি করুণ কণ্ঠে বললে, কেন অযথা আত্মনিন্দা করো? আমার যদি কাল ভোরের প্লেনে করে মোলায়েম সুইটজারল্যান্ডে যাবার প্ল্যান থাকত তা হলে তুমি সেটাকেও অত অনায়াসে নিতে পারতে না। যাকে ভালোবাসি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকলেও হারাই-হারাই ভাবনাটা সবসময়ই জেগে থাকে হৃদয়ের কোনও এক গোপন কোণে। তার ওপর তুমি মেয়েছেলে। পুরুষের হৃদয় যদি একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি দিয়ে গড়া হয়, তবে মেয়েদের বেলা একবিন্দু শোণিত আর রোদনের রাশি। আসলে আমার প্রশ্নটাই ভুল। আমি কিংবা খান তো এমন কোথাও যাব না, যা তোমার অস্বস্তির কারণ হতে পারে, আমি কিংবা খান বন্দুক চালিয়ে কটা পাঠানকে খতম করতে পারব? ছোকরা জিমি পর্যন্ত জানে, তুমিই তো বলেছিলে, আমাদের কাজ কলকাতায়। সেই ঘুঘু লারিটা পর্যন্ত জানে, নজর রাখতে হবে কলকাতার ওপর। এবং আমাদের বড় বড় ক্লাবগুলোর ওপরও। যেসব ছেলে-ছোকরারা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে পুব বাঙলাকে সাহায্য করতে চায়, তারা টাকার জন্য, বন্দুকের জন্য যাবে যেসব পয়সাওয়ালাদের কাছে তারা তো এসব ক্লাবেরই মেম্বার। এবং এরা লারি-ফারির সামনেও বেপরোয়া বলে দেবে, ছোকরাদের জন্য একসপ্লোসিভ যোগাড় করতে কার লবেজান, কে একরাশ টাকা দিয়ে ছেলেদের পাঠিয়েছে নাগা পাহাড়ে, সেখানে যদি জাপানিদের ফেলে-যাওয়া বন্দুক-মেশিনগান নাগাদের কাছ থেকে কেনা যায়। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট এখনও আসরে নামেনি বলে ছেলেরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, না মুরুব্বিরা তাদের শুধু হাতে ফিরিয়ে দেবে। শুধু কি তাই, খান বলেনি বুঝি, বাংলাদেশের এক রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার এ-পারে সময়মতো চলে এসেই শুনতে পেলেন, অমুক বাঙালি হিন্দু অফিসার বর্ডারে মোতায়েন হয়েছেন। ইআল্লা বলে এক লক্ষে তাঁর কাছে উপস্থিত। ব্যাপার কী? পার্টিশনের পূর্বে দু জনা একই জায়গায় ট্রেনিং পেয়েছিলেন, পার্টিশনের সময় পর্যন্ত একই আর্মিতে কাজ করেছিলেন। দু জনাতে দোস্তি হয়েছিল গভীর। গিয়েই বললেন, জানো তো, দোস্ত, আমি রিটায়ার করেছি বটে কিন্তু দেশে যে সঙ্কট এসেছে সেটার মোকাবেলা যথাসাধ্য আমি করবই করব– এই ভরসা যদি আমার দেশের লোক রাখে তবে কি সেটা অন্যায় হবে? আসলে অতখানি লম্বা-চওড়া অজুহাত একে অন্যকে এরা কখনও দেননি। এক ইয়ার আরেক ইয়ারকে দেখা মাত্রই বুঝে গিয়েছেন ব্যাপারটা কী। বাক্যব্যয় না করে ইয়ারকে নিয়ে গেলেন অস্ত্রাগারে, হাত দিয়ে কুল্লে হাতিয়ার দেখিয়ে বললেন, যা খুশি নিয়ে যাও, যত খুশি নিয়ে যাও হেলপ্ ইয়োরসেল। সত্যি বলছি।

শিপ্রার অবসাদ আগাপাশতলা উধাও। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ফরাসি অফিসারদের কাছ থেকে সে শুধু ফৌজি-তত্ত্বকথাই শোনেনি, শুনেছে বিস্তর গুলও তাদের মুখে নইলে আর্মিতে ঢুকবেই-বা কেন, গুল মারার সনাতন ট্রাডিশনটাই-বা ডোবাবে কেন? কিন্তু এরকম একটা সৃষ্টিছাড়া ভুতুড়ে গুল? ঢোক গিলে রাম-ভোলার মতো টক্কর ঠোক্কর খেতে খেতে শুধলে, সে কী করে হয়? তুমি সত্যি জানো? এ তো বিশ্বজোড়া শান্তির সময়ও অসম্ভব। আর এখানে সরকার যাকে পাঠিয়েছে সীমান্ত রক্ষার জন্য, তাঁর কী হাল হবে? বলা তো যায় না, ইয়েহিয়া জাতাকলে পড়লে দুর্যোগটা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কোনও না কোনও ডেসপারেট মিলিটারি গ্যাম্বল শুরু করে দেবে। তার শেষ তাস দিয়ে। আক্রমণ করবে আইনত নিরপেক্ষ কিন্তু কার্যত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ভারতকে– যাতে করে রাষ্ট্রপুঞ্জ ইন্টারফিয়ার করে দুই পক্ষকে ঠেকায় আর ইয়েহিয়া সেই লুপহোল দিয়ে সুড়ৎ করে বেরিয়ে যায়।

কীর্তি সোল্লাসে বললে, শুধু ইয়েহিয়াই বুঝি কলিযুগের নিরেস যুধিষ্ঠির! সত্য যুগের আসল যুধিষ্ঠির, না ইয়েহিয়া কে যে জুয়োতে বেশি বুদুমি দেখাতেন সেটা বাঙলার ইতিহাসে একটা চিরন্তনী সমস্যা হয়ে রইবে। সেই গুপ্তযুগ কিংবা তারও আগের থেকে কত না রাজা, পাঠান-মোগল কেউ বাদ যাননি এদেশে এসেছে জুয়ো খেলতে, ওদের সক্কলেরই মারাত্মক প্রয়োজন ছিল, যুদ্ধের জন্য হাতির। ত্রিপুরাতে প্রচুর সে মাল, প্রতিবেশী সিলেটিরা এখনও পৃথিবীর সেরা মাহুত। ইংরেজ বোম্বাই, মাদ্রাজ যে কোনও জায়গায় জুয়ো পার্টি বসাতে পারত। কিন্তু বেছে নিল বাঙলা। ধনী দেশ, অন্তত তখন পর্যন্ত ছিল আমাদের তরফ থেকে স্টেকটা হবে ভারী। জিওপলিটিক নামক আধা-বিজ্ঞানটি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তথ্যগুলো তো ছিল আমাদের বুদু এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কে যেন কথাচ্ছলে বলে, অক্সিজেন আবিষ্কৃত হয়, ১৭৭৪-এ। মন্ত্রী সবিস্ময়ে শুধালেন, তার আগে মানুষ বাঁচত কী দিয়ে? তার পর পাঁচ আঙুলে খ্যাস খ্যাস করে দাড়ির উকুনকে আদর করতে করতে ডরালু গলায় শুধালেন, কিন্তু সাপ্লাই ঠিক আছে তো?–

শিপ্রা শুধালে, তুমি একদিন কথায় কথায় বলছিলে না ডাঙর ইয়েহিয়ার আর বড়া বড়া জুন্টা-গোসাঁইদের কানও বড় বড় হয় তখন মনে পড়েনি ভলতের এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর এপিগ্রাম লিখেছেন চার ছত্রে, অনেকটা আমাদের সুভাষিতের মতো, হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্রে বিস্তর আছে–

কীর্তি ঠিক বুঝতে না পেরে শুধালে, পঞ্চতন্ত্র? সে তো কোন এক মোল্লা না কে যেন বাঙলা একটা সাপ্তাহিকে লেখে।

শিপ্রা বললে, দম্ভ আছে লোকটার! স্বয়ং বিষ্ণুশর্মা যে বই লিখে দূর মার্কিন মুলুক পর্যন্ত প্রাতঃস্মরণীয় লেখক হলেন, তাঁর গল্পের কাছে কখনও কেউ আসতে পারবে নাকি যে সে তার রাজ গুলতানির জন্য পঞ্চতন্ত্র নাম বেছে নিল।

কীর্তি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, বাঁচালে! আমি ভেবেছিলুম মাস্টারের পড়ানো সেই আগম পুরাণ বেদ পঞ্চতন্ত্রকথা বুঝি, আমাদের যে তন্ত্রট আছে তারই পাঁচটাতে মিলে কোনও একটা সিনথেসিস।… যাকগে… ভলতেরের একটা এপিগ্রাম বলতে যাচ্ছিলে না?

হ্যাঁ।

এলাস! লেজোরেই দে গ্রাঁ
সঁ সুভাঁ দ্য গ্রাঁদ জ অরেই

হায়! বড়লোকদের যে আকছারই বড় বড় কান হয়, অর্থাৎ গাধার কান। স্বভাবতই ইঙ্গিত রয়েছে, এদের মস্তিষ্কও ওই প্রাণীটার মতো।

কীর্তি বললে, তাই তো রক্ষে। বড়লোকদের ধন-দৌলত আছে, যশ-প্রতিপত্তি প্রচুর। তার ওপর যদি মগজটিও সরেস ধরনের হত তবে গরিবদের আর বাঁচতে হত না। তাদের হাড়-মাস খেয়ে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাত। এই ধরো না টিক্কা-ইয়েহিয়ার একটা মোক্ষম মুখোমি। আজ যে সমস্ত পুব বাঙলায় বড়র অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছোট রুখে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনী ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দর্শন বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিকুচি করে দিয়ে সামথিং গ্রোইং আউট অব নাথিং তার জন্য ওই মূর্থনীতি আচরণ কতখানি দায়ী সে-কথা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। এটা আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ, আপন খেয়াল নয়। মনে আছে তোমার, শিলঙে তোমাকে বলেছিলুম হবিগঞ্জের এক পাগলা-জগাই, শব্দে শব্দে,

ঢাল নেই, তলওয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার
ট্যাঙ্ক কামান হামলা করে, হুঙ্কারে মার মার!

সেই মেজর আমার এক মুরুব্বিকে বলেছেন, পঁচিশে রাত্রেই টিক্কা প্রয়োজনের চেয়েও ঢের ঢের অপর্যাপ্ত সৈন্যবল, আধুনিকতম ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, কামান সর্ব বল নিয়ে আক্রমণ করল তিন শ্রেণির লোককে। প্রথম দল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি। একদা পাকিস্তানের, বস্তৃত পশ্চিম পাকিস্তানের হয়ে এরাই লড়েছিল আইয়ুবখানি যুদ্ধে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ এবং তাঁর অল্পক্ষণ পরেই মামুলি পুলিশকে আক্রমণ করে প্রায় বিধ্বস্ত করে দিল। এদের মাত্র যে কিছু লোক পালাতে সক্ষম হয়েছিল, তাবৎ পুব বাঙলায় সুদু মাত্রই এরা জানে, কী করে রাইফেল চালানো শেখাতে হয়। এদের নিয়েই গড়ে উঠল বাঙলা দেশময় মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দল। এখন প্রশ্ন এই, এদের মাত্র যে কিছুসংখ্যক লোক লীগের প্রতি কতখানি দরদি ছিল সেটা বলা কঠিন- জুন্টা অবশ্যই সেটা আদৌ হিসাবে ধরেনি তাদের পুরো পাক্কা ধারণা, এদের সমূলে বিনাশ করতে কী আর বেগ পেতে হবে, সময়ই-বা লাগবে কতটুকু?–বমার অব্‌ বেলুচিস্তানের ওই বাবদে দম্ভ তো আজ দেশে-বিদেশে কারও অজানা নেই কিন্তু একথা তো সত্যি, যে এই তিন শ্রেণির লোক ডিসিপ্লিন্ কাকে বলে সেটা অতি উত্তমরূপে জানে, উপরওলার আদেশ এস্থলে মার হোক, বুচার হোক, টিক্কা খানের আদেশ তারা অন্তত একশো বছর ধরে মেনে নিতে অভ্যস্ত, এবং সর্বশেষ কথা– পাক আল্লার নামে কসম খেয়ে তারা রাষ্ট্রপতির আনুগত্য স্বীকার করেছে। তাই প্রশ্ন, এদের এভাবে টিক্কা যদি আক্রমণ না করত তবে কি এরা নিজের থেকে বিদ্রোহ করত?।

কীর্তি থামল। যেন সামান্য একটু চিন্তা করে বললে, এ প্রশ্নের উত্তর মেজর কখনও পাবেন না। করতই, সেটা জোর গলায় বলা চলে না, আবার আলবৎ করত না তার উত্তরও তদ্বৎ। তবে মেজরের একটা সত্য নির্ণয় তর্কাতীত। ওরা আক্রান্ত না হলে, এবং তারই ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলাটা তো প্রায় অসম্ভব হত। আবার, তাদেরই চোখের সামনে গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন, মুক্তি গড়ে না উঠলে, গ্রামের লোক তো মনোবল হারিয়ে ফেলত– রুখে দাঁড়ানো দূরে থাক, বিরুদ্ধ ভাব অন্তরে অন্তরে পোষণ করতই-বা কদিন? এবং তার শেষে যখন বর্বররা ব্যাপকভাবে সর্বত্র হত্যা-লুণ্ঠন-দহন-ধর্ষণ আরম্ভ করত এবং করত তার সর্বাবস্থাতেই– তখন? তখন তো টু লেটু, তখন কে গড়ে তুলত মুক্তিবাহিনী?

শিপ্রা বললে, আমার মনে হয়, ভারত যে সরাসরি ইয়েহিয়ার গালে চড় মারছে না, তার প্রধান কারণ, সে দেখতে চায়, বাংলাদেশে যে বিদ্রোহ মনোবৃত্তি দেখা দিয়েছে সেটা বাঙালির নিত্যকালের হুজুগে মেতে ওঠার সোডা-বোতলের গ্যাস কি না। সেটা ঠিক ঠিক অনুমান না করে তড়িঘড়ি পুরোদম যুদ্ধে যদি নেমে যায় এখখুনি, এবং অল্পদিন পরেই পুব বাঙলার মনোবল ভেঙে যায় তবে যে শেষটায় ভারতকে বিশ্বের কাছে বিড়ম্বিত হতে হবে। ওদিকে ফরাসি অফিসারদের একজন আমাকে লিখেছেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, মিলিটারি দৃষ্টিবিন্দু থেকে জোর দিয়ে বলেছেন একমাত্র প্যোরলি মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির বিচারে– এইটেই ভারতের সুবর্ণ সুযোগ, এই বেলায়ই ভারতের যুদ্ধে নেমে যাওয়া উচিত।… তা তো বুঝলুম, কিন্তু প্রশ্ন, সব জেনেশুনে পৃথিবীর প্রায় সব নেশনই চুপ করে আছে কেন?

বা-রে! তোমার আপন দেশ ভারতবর্ষও তো এখনও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

সে কী কথা! একটা দেশের সরকারই বুঝি সব! আমরা– তুমি, আমি– আমরা বুঝি দেশের মালিক নই! এই বাঙলাদেশেই তুমি কখনও দেখেছ, ঘটি-বাঙাল হঠাৎ এক হয়ে গিয়ে পুব বাঙলার বেদনায় চিৎকার করে বলে উঠেছে, ভাই আমরা আছি। আর এটাও তো স্বীকার করতে হবে, আজ পর্যন্ত ভারতই সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে, স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছে, তার পূর্ণতম সহানুভূতি কার প্রতি। তুমি জানো–

কীর্তি কেন যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেটা বুঝতে না পেরে শিপ্রা থামল। তার হাতখানা আপন হাতে তুলে নিয়ে শুধালে, বন্ধু, আমার কোনও কথা কি তোমাকে পীড়া দিল?

কীর্তির মুখে অমনি হাসি ফুটল। কণ্ঠস্বরে যেন সর্ব মধু ঢেলে দিয়ে বললে, শিপ্রা তুমি সত্যি শিপ্রা– শব্দটি এসেছে ক্ষিপ্রা থেকে, অর্থাৎ যে দ্রুতগতিতে চলে। তুমি প্রথম যেদিন আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি– কেউ-দেখল-কেউ-না– প্রসন্ন স্মিত হাস্যের আভাস দিয়েছিলে, সেদিনই সর্বপ্রথম আমি একটা বড় বাঙলা অভিধানের স্মরণ নিই। তারই কল্যাণে বুঝতে পারি যে শিপ্রা বা ক্ষিপ্রা–

ক্ষিপ্ৰা বললে আরও মানানসই হয়।

চিন্তাকুল বদনে কীর্তি যেন আপন মনে বললে, প্রেমে পাগলিনীকে ব্যাপা বা ক্ষিপ্তা বলেছেন কবি, কিন্তু সংক্ষিপ্তা যেন না হয় আমার প্রতি তোমার প্রেম-প্রীতি-আসক্তিটি–

শিপ্রা করুণ কণ্ঠে অনুনয় করল, বলবে না, রাজা, আমার কোন কথায় তোমার বুকের ভিতর থেকে গরম বাতাস বেরুল- হঠাৎ, কোনও আভাস না দিয়ে?।

কীর্তি যেন ঝটিতি রাজাদেশ পালনে শশব্যস্ত হয়ে বললে, বলছি, শুরু, বলছি। যে মুহূর্তে তুমি বললে, পশ্চিম বাঙলার লোক আজ যেন সমবেত কণ্ঠে পুব বাঙলার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহস দিচ্ছে, আমরা আছি আমার মনে তৎক্ষণাৎ সেই দুশ্চিন্তা, সেই কবেকার আগরতলায় যার জন্ম, সেটা অহরহ আমাকে আশা-নিরাশায় ক্ষণে আকাশে তোলে, ক্ষণে মাটিতে আছাড় মারে। পুব বাঙলা দাঁড়িয়েছে প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে। সে শক্তিকে একমাত্র সৈন্যবল ছাড়া আর সব দিচ্ছে পূর্বাচল-অস্তাচলের দুই বৃহত্তম রাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, প্লেন– যা চাই তাই, যুদ্ধ যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে তবে পশ্চিম পাকে তার জন্য অপর্যাপ্ত অকাতর অর্থসাহায্য সেসব সাহায্য যদি সুন্দুমাত্র পশ্চিম পাকেই যেত তবু না হয় একটা ব্লাফ মারা যেত এগুলো পশ্চিম পাকে দেওয়া হচ্ছে, ভারত আফগানিস্তান ও রুশ একজোট হয়ে যেন পশ্চিম পাক আক্রমণ করে বিশ্বশান্তি ভঙ্গ না করে!–এগুলো খোলাখুলিভাবে পাঠানো হচ্ছে পুব বাঙলায় হারামিদের হাতে, তারা কী নয়া ধরনের বিশ্বশান্তি রক্ষা করছে সেটা জেনেশুনে যাতে করে তারা আরও নির্ভয়ে, জীবন বিপন্ন না করে আরও নিধনধর্ষণলুণ্ঠনদহন কর্ম আরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে করতে পারে। শুধু কি তাই নিরীহ গ্রামবাসী নরনারীকে কীভাবে যমদূতেরও বাড়া নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয় দেখাতে হয়, কী প্রকারে স্বামী পিতা পুত্রের সম্মুখে অবলা নারীকে ধর্ষণ করে মানুষের শেষ সম্পদ তার আইজ্জৎ ইমান কোন কোন বীভৎসতা দ্বারা বিনাশ করে তাকে ক্লীব পশুত্বে পরিণত করার বিভীষিকা দেখাতে হয় সে-সব নীতি কায়দা শেখাবার জন্য বিত্তশালী দেশে বাছাই বাছাই সাদিস্তদের জন্য একটা– কেউ কেউ বলেন একাধিক বিশেষ স্কুল খোলা হয়েছে– খানদানি মিলিটারি অফিসার ও জোয়ানদের জন্য। আইয়ুবের সামনেই সেখানে পশ্চিম পাকের আর্মি বাছাই বাছাই লোক পাঠায়। ইয়েহিয়ার সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না, কিন্তু জুন্টা জানত, হাওয়া একদিন কোন দিক দিয়ে বইবে। তারা সে ইস্কুলে ছাত্র পাঠাতে কোনও কসুর করেনি। আসলে আজ আর এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, যে স্বয়ং আইয়ুবই জানতেন, পুব পা আর পশ্চিম পাকে একদিন মোকাবেলা হবেই হবে।

তাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জনপদবাসী কতদিন ধরে এ অত্যাচার সইতে পারবে? তারা যদি মনোবল হারায় তবে তো সর্বনাশ! প্রবলতর শত্রুর হাতে পর্যদস্ত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই, কিন্তু সে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়াতে, তার দাসত্বে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়াতে সর্বনাশের চেয়ে সর্বনাশ। কারণ তার ফল ভোগ করতে হবে তাদের সন্তানদের বংশানুক্রমে।

ছোট-বড় শহর আয়ত্তে রাখা খানদের পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম, হাজার হাজার গ্রাম আয়ত্তে আনা অসম্ভব। কিন্তু যদি জনপদবাসী বশ্যতা স্বীকার করে নেয় তবে এইসব বাচ্চারা, ক্ষুদে ক্ষুদে বাচ্চারা, সুন্দুমাত্র দু চারটে উটকো বন্দুক নিয়ে ট্যাঙ্ক-সাঁজোয়া গাড়ির মোকাবেলা করছে, তারা পা জমাবে কোথায়?

জানো শিপ্রা, চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে বেরোয় খানদের সন্ধানে। বেতার নেই, কোনও প্রকারের যোগসূত্র নেই এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের আর ক রাউন্ড গুলিই-বা পায় এরা যাত্রাপথে নামবার সময় চাষাভুষো যদি এদের আশ্রয় না দেয়, চিড়ে মুড়ি না যোগায়, খানদের সন্ধান না বাতলায় তবে কদিন লড়বে তারা?

শিপ্রা অন্ধকার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, পার্কের উপরের রাস্তায় ক্ষীণ একটা আলোর দিকে। তার মনে ক্ষণে ক্ষণে ভয় জাগছিল ওদের জয়াশা আমাদের জয়াশা ওই আলোরই মতো ক্ষীণ। আবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে সাহস জেগে উঠছিল, প্যারিসের সেই বুড়ো জেনারেলের স্মরণে। তিনি বলেছিলেন, মামোয়াজেল যতক্ষণ না একটা জাত পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, ততক্ষণ সে পরাজিত হয়নি। এবং শেষ যে আপ্তবাক্যটি বলেছিলেন সেইটে সে মুখ ফুটে কীর্তিকে শোনাল;

যে ভেঙে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, তাকে প্রবলতম শক্তিও দাঁড় করাতে পারে না। যে জাত ভেঙে পড়েনি সে-ও যেন অপরের সাহায্যের ওপর বড় বেশি ভরসা না রাখে।

অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত, অত্যত হল কীর্তির প্রতিক্রিয়া! সোফা ছেড়ে প্রায় নাচ শুরু করে দিল ঘরময়। শিপ্রা অবাক। এমন কী দারুণ নয়া সত্য ছিল তার কথা কটিতে?

শিপ্রার হাত দু খানি আপন হাতে তুলে বলল, বাঁচালে তুমি আমাকে। আমি কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলুম এইবারে বলি, যে কথাটা, কবে সেই আগরতলা থেকে আমার মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু বলার মতো সাহস যোগাড় করতে পারিনি। আমি জানি, অনেকে মনে করে বাইরে তুমি যে রূপেই দেখা দাও না কেন, যেমন মনে করো হিস্পানি টাঙ্গো নাচে স্পেনের কন্সালকে পার্টনার পেলে এদেশের অজানা টাঙ্গোর জন্মভূমিতে যে রীতিতে একে অন্যের সঙ্গে সেঁটে গিয়ে দুই দুহু কুহু কুহু করতে করতে দো-দুল-দোলা জাগাও সেটা তোমার নিতান্ত বাহ্যরূপ, আসলে তোমার হৃদয় নামক বস্তুটি গড়া স্টেনলেস স্টিল দিয়ে। নাগরমল তুষ্ণীয়াল ভেজাল স্টেনলেসের রাজা, একদা তোমার এডমায়ারারদের রিংসিটে যে বসত সে চিনবে না আঁটি বস্তু। কিন্তু আমি প্রথমদিন থেকেই জানি, কী দারুণ রোমান্টিক তুমি। প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে পারতুম; হৃদয়ের শত সহস্র সংজ্ঞা, বহু বিচিত্র বর্ণনা আছে। তবু তুমি হৃদয় বলতে ভাবনার রাশিটাই যে তার মূল ধাতু সেটা মেনে নিয়েছ কেন? এবং সেই ভাবনারাশির সঙ্গে টানাপড়েন জড়িয়ে রয়েছে একটা অনাগত নৈরাশ্য- যেটা আমার মনে অহরহ এনে দেয় অজানা ভীতি।

শিপ্রা চায় না, তার আপন মনের মানুষ কোনও দুঃখ পায়– তা সে বাস্তব বা কাল্পনিক যা-ই হোক না কেন। বললে, আমি নৈরাশ্যবাদী নই। আমার কাছে বিশ্বসৃষ্টির কোনও অর্থ বা মূল্য এখনও ধরা পড়েনি। এর বেশি কিছু পাপষ্টি বলতে গেলেই আমি নিজের সঙ্গে নিজেই তর্কে জড়িয়ে পড়ব।

কীর্তি যেন একটু সাহস পেল। বললে, তা হলে তুমি বুঝতে পারবে অন্তত অনেকখানি। কিন্তু আমি যতদূর সংক্ষেপে পারি বলতে চাই, আমার বুকে একটা কাঁটা অহরহ খচ্ পচ্ করে খোঁচাচ্ছে সেটার কথা বলা দূরে থাক, ভাবতেও আমি চাইনে।

আমি জানি, তুমি রোমান্টিক। তাই আমার মতো অপদার্থ যখন একদিন তার জড়ত্ব ঝেড়ে ফেলল তখন তোমার আশা হয়েছে, আমি অবশ্যই একটা কৃতিত্ব দেখাতে পারব অসাধারণ না হোক, মামুলি বিস্বাদ, মিডিওকারের চেয়ে উচ্চ স্তরের, অন্তত সে ভিন্ন স্তরের তো হবেই, যতই ক্ষুদ্রতম ক্ষুদ্র হোক না কেন, আমার সাফল্য তার মধ্যে কিছু-না-কিছু একটা অসাধারণত্ব থাকবেই। কারণ, আমার জড়ত্বটা ছিল মিডিওকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের মামুলি বিরস চঞ্চলতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন– অসাধারণ বললেও অত্যুক্তি নয়, প্রশস্তি তো নয়ই।… কিন্তু আমি যতই ঘুরে-ফিরে সবকিছু দেখি, কোন পথে মুক্তি কোন দিকে আশার আলো তার সন্ধানে সর্ব চৈতন্য নিয়োজিত করি সেখানে কণামাত্র জড়ত্ব নেই, প্রচেষ্টাতে বিন্দুমাত্র শিথিলতা নেই- ততই স্পষ্ট অনুভব করি, আমি এমন কোনও সফলতা অর্জন করতে পারব না, যা দেখে তুমি গর্ব অনুভব করতে পারো–

এতক্ষণ কীর্তি কথা কইছিল মাথা নিচু করে। অকস্মাৎ যেন তার বুকে পরশ লাগল তারই চেনা আরেকটি বুকের অজানা স্পন্দন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনই শুধু সে শিহরণ জাগাতে পারে। চকিতে মাথা তুলে তাকাল শিপ্রার বিহ্বল মুখের দিকে।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আছে দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। সে মাতা আমাদের জনগণভাগ্যবিধাতাতেই সীমাবদ্ধ নন। সে মাতা দেশকালের অতীত– সে মা-জননী চিরন্তনী। তাঁর পরিচিত জনের নিত্যদিনের পরিচয় তাকে করে দেয় আমাদের কাছে অপরিচিত। নিত্যদিনের প্রাচীন অভ্যাস, সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে কজন ভাগ্যবান তাকে অকস্মাৎ একদিন চিনে ফেলতে পারার তুলনাহীন সম্পদ অক্ষয় অধিকার পায়। তাই না খ্রিস্ট বলেছেন, শিশুর মতো সরল হতে হবে তাঁকে দেখতে যদি চাও।

শিশুর মতো সরল চোখে তাই দেখতে পেল, সেই মধু মুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই। সুধাভরা আঁখি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

শিশুকে আদর করার মতো শিপ্রা টেনে আনল কীর্তিকে তার কোলের দিকে।

মা মেরির মতো প্রসন্ন কল্যাণ মুখ স্মিতহাস্যে আলোকিত করে বললে, তোর মতো সরল লোক আজ বিরল। তুই কি সত্যি ভেবেছিস, আমি মনের কোণে কখনও ঠাই দিয়েছি, তুই একদিন গারিবাদি হবি, মাদৃজিনি-র মতো হিরো হবি! আর, দূর বিদেশের জন্য খুনিয়া এক হিরো, আটপৌরে সমাজেও যে হিরোর মতো দাপাদাপি করত, সেই বায়রন গেলেন গ্রিসে, দেশটাকে মুক্ত করতে হিরো স্টাইলে মারা গেলেন বিষ্টিতে ভিজে, বেতো সর্দিতে, তার সঙ্গে এসে জুটেছিল সঁতসেঁতে বিলুয়া হাওয়ার জ্বর, পুব বাঙলায়ও বিলের অনটন নেই। এই বুঝি হিরোজনোচিত শেষ শয্যা গ্রহণের নাটুকে কায়দা! ওদিকে তাঁর প্রথম যৌবনের সামাজিক আচরণ তাঁর দেশবাসীরা তাদের বুকের পাথরে খোদাই করে রেখেছে খুবই গভীর অক্ষরে। গ্রিসের মতো একটা প্রাচীন সভ্য দেশের জন্য তার সর্বস্বান, আত্মত্যাগ, অকালমৃত্যুবরণ খান খান হয়ে গেল, না পেলেন ঠাই সেই পাথরে টক্কর খেয়ে। শেষটায় সেই নটিংহাম যেখানে একদা ডাকু-বীর রবিনহুড় তার প্রতাপ দেখিয়েছিল সেইখানে বীর বায়রন পেলেন ছ ফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া গর্তে তাঁর চিরদিনের আবাস।… আর এখন তো দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। কম্যুনিস্ট ভায়ারাও রব তুলেছেন, প্রিয়েরে দেবতা করা চলবে না, চলবে না, চলবে না। ব্যক্তিবিশেষ কিছুই নয়। আমিও বলি, যদি কেউ থাকে তবে সে হরিপদ কেরানি।

বিস্তর লোক এখনও বলে, এককালে তো সবাই বলত, প্রকৃত বীরের প্রকৃষ্টতম উদাহরণ যদি দেখতে চাও তবে তার সন্ধান পাবে চার্চিল-এ। বলতে গেলে ওই একটিমাত্র লোক, অবহেলিত, বহু বৎসর ধরে তার পার্টিদ্বারা প্রায় অপমানিত, কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না– বাঙলাদেশ যেন এরই মতো কস্মিনকালেও না করে হিটলার যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চরম লাঞ্ছনাসহ পলায়িত ইংরেজের দেশে উইএনড় কাটাবার জন্য স্যান্ডউইচের রুটি কাটছেন। শত লক্ষ প্রাজ্ঞজন এখনও বিশ্বাস করেন, সেই বিকট সঙ্কট থেকে, সুনিশ্চিত বিনাশ থেকে ইংলন্ডে ও অসূর্যাস্ত কলোনিগুলোকে অবশ্যম্ভাবী শৃঙ্খলাবদ্ধ দাসত্ব থেকে পরিত্রাণ করতে আবির্ভূত হলেন, শ্বেত-কল্কি চার্চিলাবতার। কিন্তু… কিন্তু বুঝলে মিতা, স্বয়ং সেই চার্চিলও ভুলে গেলেন– কৃষ্ণাবতারও তো পরবর্তীকালে সীতা স্মরণে আনতে পারেননি– বেবাক ভুলে গেলেন তে হি দিবসা গতাঃ! এখন আর লাটবেলাটের বীরত্বের খড়ম পুজো করার দিন নেই। এখন গণতন্ত্র আর একচ্ছত্র মানে না, জমিদারবাড়িতে পাত পাড়তে যায় না, এখন পাঁচো ইয়ারে মিলে লাগায় পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো। সামত্ত জয়সেনের বীরত্বের যুগ ভিক্ষুণী সুপ্রিয়াদের ছায়াতলে স্নান। তিন মাস যেতে না যেতেই পঞ্চপিতার এক পিতা ভয়ত্রাতা চার্চিল পেলেন তার চরম অসম্মান। এককালে পিতা পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করত, গণতন্ত্রের যুগে পুত্রগণ–তারাই গণ, তারাই গণপতি, কবির ভাষায়, জয়ধ্বজা ওই যে তাদের গগন জুড়ে/পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে এখন পুত্রগণ পিতাকে ত্যাজ্যপিতা করে।

কীর্তি আরামের নিশ্বাস ফেলে বললে, আমার পিতা আমাকে অসংখ্যবার ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুমি যে গণতন্ত্র গণতন্ত্র কপচাচ্ছ, বলছ, পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে, সেটা পূবের কোন দেশে চালু হয়েছে কও?

তোমার কথাও ঠিক, আমার কথাও ঠিক। গণতন্ত্রের পিটুলি গেলাতে যখন পাঞ্জাবিদের অরুচি ধরল তখন তারা আইয়ুবকে বানাল ডিকটেটর। অন্য দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে– ফিল্ড-এ জয়লাভ করে জাদরেলরা হতেন ফিল্ড মার্শাল; মার্শাল ল জারি করে আইয়ুব খেতাব নিলেন ফিল্ড মার্শাল। জেনারেল ইয়েহিয়া সেটার কার্বন কপি হলেন না। তাই তার জঙ্গিগুষ্টি তার প্রথম যৌবনের রক্ষিতা, বর্তমানে ইয়া ধুমসী লাশকে খেতাব দিয়েছে জেনারেল রানি। চীনেরা যে রকম কাগজের বাঘ বানায়, পা ভারতেও পেপার ডেমোক্রেসি, পেপার ডিকটেটর, পেপার পাদুর জেনারেল রানি।

কীর্তিকে আরও কাছে টেনে নিয়ে কিছুটা তিক্ততা কিছুটা করুণা মেশানো গলায় বললে, তোমার শক্তিতে যা আছে, তাই তুমি করবে। লঙ জাম্প মেডেলিস্টও আপন ছায়া লাফ দিয়ে ডিভোতে পারে না। আরেকটা সত্যে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুব বাঙলা যদি স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয় তবে স্বাধীনতা আনবে সে-দেশের চাষাভূষা, মাল্লামাঝি এমনকি লেঠেল-ডাকাতও কিছুদিনের তরে পৈতৃক ব্যবস্থা ক্ষান্ত দিয়ে তারা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পঞ্চতন্ত্র কিছুই বোঝে না। বুঝবার দরকারও নেই। সেই নিরীহ চাষা-বউকে ধর্ষণ করছে ইয়েহিয়া। ইছামতীর ওপার থেকে ওদের আর্তচিৎকার শোনা যায় এপারে, আমাদের পারে। একটা অতি নগণ্য সাপ্তাহিক থেকে আমার এক বন্ধু কাটিং পাঠিয়েছে–তাতে এক ফরাসি দরদি বলছে, যেন তারা আপন জাতভাই, এখনও যাদের দেশভাই বলে মনে করে, সে-সব পশ্চিমবঙ্গের লোককে চিৎকার করে আপন অসহায় অবস্থা জানিয়ে সাহায্য মাঙছে। তাদের আপন মরদরা তো সন্ধেবেলায়ই বন্দুকের গুলিতেই মরেছে আপন চোখের সামনে। তার পর সমস্ত রাত ধরে চলেছে অত্যাচার, টর্চলাইট দিয়ে বনবাদাড় থেকে খুঁজে বের করছে নতুন নতুন শিকার।

উত্তরে তোমরা বলেছ, ভাই, আমরা আছি।

তুমি যাবে পুব দিকে, ছায়ার মতো তোমার পিছনে আমি আছি।

Exit mobile version