লনের এক প্রান্তে আসন নিয়েছেন সুদিনাদি স্মার্ট কোম্পানি। কীর্তি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রত্যন্ত প্রদেশে। আজ বসেছে সানন্দে। আজ গারাজে বসতেও তার কণামাত্র ক্ষোভ নেই। এ উৎসবের হৃদয় পদ্মাসনে যে রাজার রাজা, বাইরের ভুবনে সে কোথায় কোন ধূলির ধূলিতে অবলুষ্ঠিত হল সে সম্বন্ধে কোন মূর্খ হয় সচেতন।
তদারকির রোঁদে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় শিপ্রা ক্ষণতরে কীর্তিকে উদ্দেশ করে বলল শুধু হ্যালো! ঠোঁটে সেই এক বছরের পুরনো মৃদু হাস্য। কিন্তু সুদিন জানে আজকের এ কণ্ঠস্বর এ মৃদু হাস্য এক ভিন্নবাসিনী ভানুমতীর মদনরসে মন্ত্রপূত।
ইতোমধ্যে বধূ এসেছেন সুদিনাদির সামনে।
সুদিন একগাল হেসে শুধল, কী গো সুন্দরী, হাওয়াই দ্বীপের হুলা হুলা ডানস্ রপ্ত করে এসেছ তো? এক চক্কর দেখিয়ে দাও না পাঁচজন রস-পিপাসুকে।
বধূ বললেন, নিশ্চয়, কিন্তু হাওয়াইয়ের সেই ঘাস পাব কোথায়, নাচের ঘাগরা বানাবার তরে?
সুদিন বললে, সে আর এমন কী বিপত্তি। রাজকুমারী জাহানারা যে মসলিন পরে ঔরঙ্গজেবের সামনে সগর্বে উপস্থিত হয়েছিলেন সেটা জোগাড় করতে কতক্ষণ! সেইটে ফালি ফালি করে ঘাগরা বানিয়ে যদি পরেন–
শঙ্কর বলল, কী বেরসিক রে, বাবা। চাঁদের আলোর টানা আর রামধনুর পোড়েন দিয়ে বোনা হবে সে ঘাগরা। মিলকি উইয়ের দুধ দিয়ে সেটি থাকবে ভেজানো– তবে না সেটি লেপটে থাকবে সর্বাঙ্গে। তবে না দেখা যাবে নৃত্যের তালে তালে প্রতিটি পেশির আন্দোলন, সঙ্কোচন, সম্প্রসারণ।
ইতোমধ্যে বর-কনে এগিয়ে গেছেন আরেক দলকে হেঁ হেঁ করার জন্য।
চৌধুরী আখতর হুসেন শঙ্কর মিত্রকে ফিসফিসিয়ে বললেন, বুড়ো ধেড়ে কাক। সাতান্ন ঘাটের পানি খেয়ে শেষটায় বিয়ে করল নাতনির বয়সী মেয়েটাকে!
মিত্তির বলল, চৌধুরী, আমাদের সোশ্যাল সিসটেমটা তুমি আদৌ বুঝতে পারনি। পুরুষগুলো তো যায় গোল্লায়–ওই যে বললে সাতান্ন ঘাটের ঘোলা জল খেয়ে খেয়ে। বিয়েও যদি করে ওই ঢপের হাফ-বাইজিগুলোকে তবে জাতটা যাবে উচ্ছন্নে। অন্তত একটা সাইড তো ক্লিন রাখা দরকার।
নৃতত্ত্ব আর এগুলো না। কারণ ইতোমধ্যে একটি তরুণী লাভারসহ উপস্থিত। ইনি সদ্য উনিশে পা দিয়েছেন বলে ক্লাবের প্রাচীন মেম্বার তার পিতা তাকে সোসাইটি করতে অনুমতি দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে রসালাপ বন্ধ হয়ে গেল।
এদের এই একটা মহৎ গুণ এক লহমায় ভোল পালটাতে জানে। এই ছিল জল-বিছুটি আর এই হয়ে গেল ধোয়া তুলসীপাতা। চৌধুরী বলল, কী গো মিস্ ডাট, বিলেত যাওয়ার কদ্দূর?
ঠোঁট বেঁকিয়ে সুভা বললে, ফরেন একচেঞ্জ পাব কোথা?
মিত্তির বললেন, লাও! আম্বালাল কস্তুরভাই আছে কী করতে? তার তো দেদার ফরেন টাকা? তোমার পিতৃদেবের লিগেল এডভাইস ভিন্ন দু বান্ডিল বিড়ি কেনে না। সে তোমাকে লন্ডন-অক্সফোর্ড যেখানে প্রাণ যায় সর্বত্র পাউন্ডের দরিয়ায় ডুবিয়ে রাখবে। তোমার আবার ভাবনা কী?
সুভা একটা মামুলি উত্তর দিয়ে কেটে পড়ল। এসব হচ্ছে কথার কথা– নিতান্ত কিছু একটা বলতে হয় বলে প্রসঙ্গটা উঠেছিল। নইলে আমাদের এ গোষ্ঠীর কোনও একসচেঞ্জেরই কোনও ভাবনা নেই।
সর্বশেষে চৌধুরী ধীরে ধীরে প্রত্যেকটি কথা ওজন করে বললে, ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে হয়ে আসছে। ফরেন টাকার কুমির তো শেঠ চন্দ্রবদন। ইংলন্ডে আছে প্রায় লাখখানেক পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি। তারা প্রতি বছর দেশে পাঠায় কয়েক কোটি টাকা। শেঠজিও তাদের কামানো পাউন্ড কিনে নেয় সরকার যে রেটে টাকা দেয় তার চেয়ে বেশকিছু বেশি মুনাফা দিয়ে। ওদিকে শেঠজি খবর পাঠায় নারায়ণগঞ্জে তার আমিনকে সিলেটের অমুক শেখকে অত টাকা পাঠিয়ে দাও। এতে করে
এক হাফ-আনাড়ি বাধা দিয়ে বলল, নারায়ণগঞ্জে শেঠজি পাকিস্তানি টাকা পায় কোথায়? সেখানকার মিল কারখানা তো সব আদমজি ফাঁসি পশ্চিম পাকিস্তানিদের। সেখানে শেঠজির কোন ধান্দা যে তহবিল গড়বে?
চৌধুরী মিষ্টি হেসে বলল, তুমিও যেমন! আদমজির টাকা খাটে অমৃতসরে শেঠজি মারফত অ্যান্ড ভাইস ভারসা। আচ্ছা, না হয় মেনেই নিলুম তোমার আজগুবি গুল। এই কলকাতার শহরে ইন্ডিয়ান টাকা দিয়ে কিনতে চাও কত লক্ষ পাকিস্তানি টাকা খাসা সস্তা ভাওয়ে? সিলেটের মোকামে পাকিস্তানি টাকাটা পাঠিয়ে দেবার জিম্মাদারি তো ওই পাকিস্তানির শেঠজির কী?
কীর্তি এতক্ষণ চুপচাপ বসে একটা গেলাসও শেষ করতে পারেনি। আসলে তার শরীরে পাড় মাতালের রক্ত নেই। সে নয়া নয়া করে দেখছিল, গতরাতের স্বপ্ন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, উল্টেপাল্টে। আর দেখছিল, শিপ্রার দ্রুতপদে আসা-যাওয়া ছোট্ট দুটি পা ঘিরে শাড়ির পাড়ের খেলা। মেমসায়েবদের ফ্রক হয় শতেক ধরনের। প্রতি বচ্ছরে আবার মরসুম-মাফিক বার তিন-চার কাট বদলায়, ভোল পালটায়। সবকটাই যে এক্কেবারে ফেলনা সে কথা বলা চলে না কিন্তু এত চেষ্টা এত জিনিয়াস খাঁটিয়েও প্যারিস এমন একটা ফ্রক বানাতে পারেনি যেটা দুটি পা ঘিরে ঘিরে শাড়ির পাড়ের যে নৃত্য তার কাছে আসতে পারে। তার ওপর শিপ্রার চলনভঙ্গিটি তার কোমরের বাঁকা-সোজা নড়াচড়া, কাঁধের ডাইনে-বাঁয়ে হেলে পড়াটার সঙ্গে এমনই মিল রেখে নিয়েছে যে তার হেথা-হোথা আসা-যাওয়াটাই পাঁচজনের চোখ ভরে দেয়। পাড়টি যেন আল্পনা এঁকে এঁকে সমস্ত লন্টা ছেয়ে ফেলল।