শিশুর মতো সরল চোখে তাই দেখতে পেল, সেই মধু মুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই। সুধাভরা আঁখি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
শিশুকে আদর করার মতো শিপ্রা টেনে আনল কীর্তিকে তার কোলের দিকে।
মা মেরির মতো প্রসন্ন কল্যাণ মুখ স্মিতহাস্যে আলোকিত করে বললে, তোর মতো সরল লোক আজ বিরল। তুই কি সত্যি ভেবেছিস, আমি মনের কোণে কখনও ঠাই দিয়েছি, তুই একদিন গারিবাদি হবি, মাদৃজিনি-র মতো হিরো হবি! আর, দূর বিদেশের জন্য খুনিয়া এক হিরো, আটপৌরে সমাজেও যে হিরোর মতো দাপাদাপি করত, সেই বায়রন গেলেন গ্রিসে, দেশটাকে মুক্ত করতে হিরো স্টাইলে মারা গেলেন বিষ্টিতে ভিজে, বেতো সর্দিতে, তার সঙ্গে এসে জুটেছিল সঁতসেঁতে বিলুয়া হাওয়ার জ্বর, পুব বাঙলায়ও বিলের অনটন নেই। এই বুঝি হিরোজনোচিত শেষ শয্যা গ্রহণের নাটুকে কায়দা! ওদিকে তাঁর প্রথম যৌবনের সামাজিক আচরণ তাঁর দেশবাসীরা তাদের বুকের পাথরে খোদাই করে রেখেছে খুবই গভীর অক্ষরে। গ্রিসের মতো একটা প্রাচীন সভ্য দেশের জন্য তার সর্বস্বান, আত্মত্যাগ, অকালমৃত্যুবরণ খান খান হয়ে গেল, না পেলেন ঠাই সেই পাথরে টক্কর খেয়ে। শেষটায় সেই নটিংহাম যেখানে একদা ডাকু-বীর রবিনহুড় তার প্রতাপ দেখিয়েছিল সেইখানে বীর বায়রন পেলেন ছ ফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া গর্তে তাঁর চিরদিনের আবাস।… আর এখন তো দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। কম্যুনিস্ট ভায়ারাও রব তুলেছেন, প্রিয়েরে দেবতা করা চলবে না, চলবে না, চলবে না। ব্যক্তিবিশেষ কিছুই নয়। আমিও বলি, যদি কেউ থাকে তবে সে হরিপদ কেরানি।
বিস্তর লোক এখনও বলে, এককালে তো সবাই বলত, প্রকৃত বীরের প্রকৃষ্টতম উদাহরণ যদি দেখতে চাও তবে তার সন্ধান পাবে চার্চিল-এ। বলতে গেলে ওই একটিমাত্র লোক, অবহেলিত, বহু বৎসর ধরে তার পার্টিদ্বারা প্রায় অপমানিত, কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না– বাঙলাদেশ যেন এরই মতো কস্মিনকালেও না করে হিটলার যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চরম লাঞ্ছনাসহ পলায়িত ইংরেজের দেশে উইএনড় কাটাবার জন্য স্যান্ডউইচের রুটি কাটছেন। শত লক্ষ প্রাজ্ঞজন এখনও বিশ্বাস করেন, সেই বিকট সঙ্কট থেকে, সুনিশ্চিত বিনাশ থেকে ইংলন্ডে ও অসূর্যাস্ত কলোনিগুলোকে অবশ্যম্ভাবী শৃঙ্খলাবদ্ধ দাসত্ব থেকে পরিত্রাণ করতে আবির্ভূত হলেন, শ্বেত-কল্কি চার্চিলাবতার। কিন্তু… কিন্তু বুঝলে মিতা, স্বয়ং সেই চার্চিলও ভুলে গেলেন– কৃষ্ণাবতারও তো পরবর্তীকালে সীতা স্মরণে আনতে পারেননি– বেবাক ভুলে গেলেন তে হি দিবসা গতাঃ! এখন আর লাটবেলাটের বীরত্বের খড়ম পুজো করার দিন নেই। এখন গণতন্ত্র আর একচ্ছত্র মানে না, জমিদারবাড়িতে পাত পাড়তে যায় না, এখন পাঁচো ইয়ারে মিলে লাগায় পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো। সামত্ত জয়সেনের বীরত্বের যুগ ভিক্ষুণী সুপ্রিয়াদের ছায়াতলে স্নান। তিন মাস যেতে না যেতেই পঞ্চপিতার এক পিতা ভয়ত্রাতা চার্চিল পেলেন তার চরম অসম্মান। এককালে পিতা পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করত, গণতন্ত্রের যুগে পুত্রগণ–তারাই গণ, তারাই গণপতি, কবির ভাষায়, জয়ধ্বজা ওই যে তাদের গগন জুড়ে/পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে এখন পুত্রগণ পিতাকে ত্যাজ্যপিতা করে।
কীর্তি আরামের নিশ্বাস ফেলে বললে, আমার পিতা আমাকে অসংখ্যবার ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুমি যে গণতন্ত্র গণতন্ত্র কপচাচ্ছ, বলছ, পুব হতে কোন পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে, সেটা পূবের কোন দেশে চালু হয়েছে কও?
তোমার কথাও ঠিক, আমার কথাও ঠিক। গণতন্ত্রের পিটুলি গেলাতে যখন পাঞ্জাবিদের অরুচি ধরল তখন তারা আইয়ুবকে বানাল ডিকটেটর। অন্য দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে– ফিল্ড-এ জয়লাভ করে জাদরেলরা হতেন ফিল্ড মার্শাল; মার্শাল ল জারি করে আইয়ুব খেতাব নিলেন ফিল্ড মার্শাল। জেনারেল ইয়েহিয়া সেটার কার্বন কপি হলেন না। তাই তার জঙ্গিগুষ্টি তার প্রথম যৌবনের রক্ষিতা, বর্তমানে ইয়া ধুমসী লাশকে খেতাব দিয়েছে জেনারেল রানি। চীনেরা যে রকম কাগজের বাঘ বানায়, পা ভারতেও পেপার ডেমোক্রেসি, পেপার ডিকটেটর, পেপার পাদুর জেনারেল রানি।
কীর্তিকে আরও কাছে টেনে নিয়ে কিছুটা তিক্ততা কিছুটা করুণা মেশানো গলায় বললে, তোমার শক্তিতে যা আছে, তাই তুমি করবে। লঙ জাম্প মেডেলিস্টও আপন ছায়া লাফ দিয়ে ডিভোতে পারে না। আরেকটা সত্যে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুব বাঙলা যদি স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয় তবে স্বাধীনতা আনবে সে-দেশের চাষাভূষা, মাল্লামাঝি এমনকি লেঠেল-ডাকাতও কিছুদিনের তরে পৈতৃক ব্যবস্থা ক্ষান্ত দিয়ে তারা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পঞ্চতন্ত্র কিছুই বোঝে না। বুঝবার দরকারও নেই। সেই নিরীহ চাষা-বউকে ধর্ষণ করছে ইয়েহিয়া। ইছামতীর ওপার থেকে ওদের আর্তচিৎকার শোনা যায় এপারে, আমাদের পারে। একটা অতি নগণ্য সাপ্তাহিক থেকে আমার এক বন্ধু কাটিং পাঠিয়েছে–তাতে এক ফরাসি দরদি বলছে, যেন তারা আপন জাতভাই, এখনও যাদের দেশভাই বলে মনে করে, সে-সব পশ্চিমবঙ্গের লোককে চিৎকার করে আপন অসহায় অবস্থা জানিয়ে সাহায্য মাঙছে। তাদের আপন মরদরা তো সন্ধেবেলায়ই বন্দুকের গুলিতেই মরেছে আপন চোখের সামনে। তার পর সমস্ত রাত ধরে চলেছে অত্যাচার, টর্চলাইট দিয়ে বনবাদাড় থেকে খুঁজে বের করছে নতুন নতুন শিকার।