তাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জনপদবাসী কতদিন ধরে এ অত্যাচার সইতে পারবে? তারা যদি মনোবল হারায় তবে তো সর্বনাশ! প্রবলতর শত্রুর হাতে পর্যদস্ত হওয়াতে লজ্জার কিছু নেই, কিন্তু সে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়াতে, তার দাসত্বে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়াতে সর্বনাশের চেয়ে সর্বনাশ। কারণ তার ফল ভোগ করতে হবে তাদের সন্তানদের বংশানুক্রমে।
ছোট-বড় শহর আয়ত্তে রাখা খানদের পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম, হাজার হাজার গ্রাম আয়ত্তে আনা অসম্ভব। কিন্তু যদি জনপদবাসী বশ্যতা স্বীকার করে নেয় তবে এইসব বাচ্চারা, ক্ষুদে ক্ষুদে বাচ্চারা, সুন্দুমাত্র দু চারটে উটকো বন্দুক নিয়ে ট্যাঙ্ক-সাঁজোয়া গাড়ির মোকাবেলা করছে, তারা পা জমাবে কোথায়?
জানো শিপ্রা, চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে বেরোয় খানদের সন্ধানে। বেতার নেই, কোনও প্রকারের যোগসূত্র নেই এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের আর ক রাউন্ড গুলিই-বা পায় এরা যাত্রাপথে নামবার সময় চাষাভুষো যদি এদের আশ্রয় না দেয়, চিড়ে মুড়ি না যোগায়, খানদের সন্ধান না বাতলায় তবে কদিন লড়বে তারা?
শিপ্রা অন্ধকার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, পার্কের উপরের রাস্তায় ক্ষীণ একটা আলোর দিকে। তার মনে ক্ষণে ক্ষণে ভয় জাগছিল ওদের জয়াশা আমাদের জয়াশা ওই আলোরই মতো ক্ষীণ। আবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে সাহস জেগে উঠছিল, প্যারিসের সেই বুড়ো জেনারেলের স্মরণে। তিনি বলেছিলেন, মামোয়াজেল যতক্ষণ না একটা জাত পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, ততক্ষণ সে পরাজিত হয়নি। এবং শেষ যে আপ্তবাক্যটি বলেছিলেন সেইটে সে মুখ ফুটে কীর্তিকে শোনাল;
যে ভেঙে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, তাকে প্রবলতম শক্তিও দাঁড় করাতে পারে না। যে জাত ভেঙে পড়েনি সে-ও যেন অপরের সাহায্যের ওপর বড় বেশি ভরসা না রাখে।
অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত, অত্যত হল কীর্তির প্রতিক্রিয়া! সোফা ছেড়ে প্রায় নাচ শুরু করে দিল ঘরময়। শিপ্রা অবাক। এমন কী দারুণ নয়া সত্য ছিল তার কথা কটিতে?
শিপ্রার হাত দু খানি আপন হাতে তুলে বলল, বাঁচালে তুমি আমাকে। আমি কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলুম এইবারে বলি, যে কথাটা, কবে সেই আগরতলা থেকে আমার মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু বলার মতো সাহস যোগাড় করতে পারিনি। আমি জানি, অনেকে মনে করে বাইরে তুমি যে রূপেই দেখা দাও না কেন, যেমন মনে করো হিস্পানি টাঙ্গো নাচে স্পেনের কন্সালকে পার্টনার পেলে এদেশের অজানা টাঙ্গোর জন্মভূমিতে যে রীতিতে একে অন্যের সঙ্গে সেঁটে গিয়ে দুই দুহু কুহু কুহু করতে করতে দো-দুল-দোলা জাগাও সেটা তোমার নিতান্ত বাহ্যরূপ, আসলে তোমার হৃদয় নামক বস্তুটি গড়া স্টেনলেস স্টিল দিয়ে। নাগরমল তুষ্ণীয়াল ভেজাল স্টেনলেসের রাজা, একদা তোমার এডমায়ারারদের রিংসিটে যে বসত সে চিনবে না আঁটি বস্তু। কিন্তু আমি প্রথমদিন থেকেই জানি, কী দারুণ রোমান্টিক তুমি। প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে পারতুম; হৃদয়ের শত সহস্র সংজ্ঞা, বহু বিচিত্র বর্ণনা আছে। তবু তুমি হৃদয় বলতে ভাবনার রাশিটাই যে তার মূল ধাতু সেটা মেনে নিয়েছ কেন? এবং সেই ভাবনারাশির সঙ্গে টানাপড়েন জড়িয়ে রয়েছে একটা অনাগত নৈরাশ্য- যেটা আমার মনে অহরহ এনে দেয় অজানা ভীতি।
শিপ্রা চায় না, তার আপন মনের মানুষ কোনও দুঃখ পায়– তা সে বাস্তব বা কাল্পনিক যা-ই হোক না কেন। বললে, আমি নৈরাশ্যবাদী নই। আমার কাছে বিশ্বসৃষ্টির কোনও অর্থ বা মূল্য এখনও ধরা পড়েনি। এর বেশি কিছু পাপষ্টি বলতে গেলেই আমি নিজের সঙ্গে নিজেই তর্কে জড়িয়ে পড়ব।
কীর্তি যেন একটু সাহস পেল। বললে, তা হলে তুমি বুঝতে পারবে অন্তত অনেকখানি। কিন্তু আমি যতদূর সংক্ষেপে পারি বলতে চাই, আমার বুকে একটা কাঁটা অহরহ খচ্ পচ্ করে খোঁচাচ্ছে সেটার কথা বলা দূরে থাক, ভাবতেও আমি চাইনে।
আমি জানি, তুমি রোমান্টিক। তাই আমার মতো অপদার্থ যখন একদিন তার জড়ত্ব ঝেড়ে ফেলল তখন তোমার আশা হয়েছে, আমি অবশ্যই একটা কৃতিত্ব দেখাতে পারব অসাধারণ না হোক, মামুলি বিস্বাদ, মিডিওকারের চেয়ে উচ্চ স্তরের, অন্তত সে ভিন্ন স্তরের তো হবেই, যতই ক্ষুদ্রতম ক্ষুদ্র হোক না কেন, আমার সাফল্য তার মধ্যে কিছু-না-কিছু একটা অসাধারণত্ব থাকবেই। কারণ, আমার জড়ত্বটা ছিল মিডিওকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের মামুলি বিরস চঞ্চলতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন– অসাধারণ বললেও অত্যুক্তি নয়, প্রশস্তি তো নয়ই।… কিন্তু আমি যতই ঘুরে-ফিরে সবকিছু দেখি, কোন পথে মুক্তি কোন দিকে আশার আলো তার সন্ধানে সর্ব চৈতন্য নিয়োজিত করি সেখানে কণামাত্র জড়ত্ব নেই, প্রচেষ্টাতে বিন্দুমাত্র শিথিলতা নেই- ততই স্পষ্ট অনুভব করি, আমি এমন কোনও সফলতা অর্জন করতে পারব না, যা দেখে তুমি গর্ব অনুভব করতে পারো–
এতক্ষণ কীর্তি কথা কইছিল মাথা নিচু করে। অকস্মাৎ যেন তার বুকে পরশ লাগল তারই চেনা আরেকটি বুকের অজানা স্পন্দন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনই শুধু সে শিহরণ জাগাতে পারে। চকিতে মাথা তুলে তাকাল শিপ্রার বিহ্বল মুখের দিকে।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আছে দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। সে মাতা আমাদের জনগণভাগ্যবিধাতাতেই সীমাবদ্ধ নন। সে মাতা দেশকালের অতীত– সে মা-জননী চিরন্তনী। তাঁর পরিচিত জনের নিত্যদিনের পরিচয় তাকে করে দেয় আমাদের কাছে অপরিচিত। নিত্যদিনের প্রাচীন অভ্যাস, সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে কজন ভাগ্যবান তাকে অকস্মাৎ একদিন চিনে ফেলতে পারার তুলনাহীন সম্পদ অক্ষয় অধিকার পায়। তাই না খ্রিস্ট বলেছেন, শিশুর মতো সরল হতে হবে তাঁকে দেখতে যদি চাও।