কীর্তি থামল। যেন সামান্য একটু চিন্তা করে বললে, এ প্রশ্নের উত্তর মেজর কখনও পাবেন না। করতই, সেটা জোর গলায় বলা চলে না, আবার আলবৎ করত না তার উত্তরও তদ্বৎ। তবে মেজরের একটা সত্য নির্ণয় তর্কাতীত। ওরা আক্রান্ত না হলে, এবং তারই ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলাটা তো প্রায় অসম্ভব হত। আবার, তাদেরই চোখের সামনে গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন, মুক্তি গড়ে না উঠলে, গ্রামের লোক তো মনোবল হারিয়ে ফেলত– রুখে দাঁড়ানো দূরে থাক, বিরুদ্ধ ভাব অন্তরে অন্তরে পোষণ করতই-বা কদিন? এবং তার শেষে যখন বর্বররা ব্যাপকভাবে সর্বত্র হত্যা-লুণ্ঠন-দহন-ধর্ষণ আরম্ভ করত এবং করত তার সর্বাবস্থাতেই– তখন? তখন তো টু লেটু, তখন কে গড়ে তুলত মুক্তিবাহিনী?
শিপ্রা বললে, আমার মনে হয়, ভারত যে সরাসরি ইয়েহিয়ার গালে চড় মারছে না, তার প্রধান কারণ, সে দেখতে চায়, বাংলাদেশে যে বিদ্রোহ মনোবৃত্তি দেখা দিয়েছে সেটা বাঙালির নিত্যকালের হুজুগে মেতে ওঠার সোডা-বোতলের গ্যাস কি না। সেটা ঠিক ঠিক অনুমান না করে তড়িঘড়ি পুরোদম যুদ্ধে যদি নেমে যায় এখখুনি, এবং অল্পদিন পরেই পুব বাঙলার মনোবল ভেঙে যায় তবে যে শেষটায় ভারতকে বিশ্বের কাছে বিড়ম্বিত হতে হবে। ওদিকে ফরাসি অফিসারদের একজন আমাকে লিখেছেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, মিলিটারি দৃষ্টিবিন্দু থেকে জোর দিয়ে বলেছেন একমাত্র প্যোরলি মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির বিচারে– এইটেই ভারতের সুবর্ণ সুযোগ, এই বেলায়ই ভারতের যুদ্ধে নেমে যাওয়া উচিত।… তা তো বুঝলুম, কিন্তু প্রশ্ন, সব জেনেশুনে পৃথিবীর প্রায় সব নেশনই চুপ করে আছে কেন?
বা-রে! তোমার আপন দেশ ভারতবর্ষও তো এখনও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
সে কী কথা! একটা দেশের সরকারই বুঝি সব! আমরা– তুমি, আমি– আমরা বুঝি দেশের মালিক নই! এই বাঙলাদেশেই তুমি কখনও দেখেছ, ঘটি-বাঙাল হঠাৎ এক হয়ে গিয়ে পুব বাঙলার বেদনায় চিৎকার করে বলে উঠেছে, ভাই আমরা আছি। আর এটাও তো স্বীকার করতে হবে, আজ পর্যন্ত ভারতই সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে, স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছে, তার পূর্ণতম সহানুভূতি কার প্রতি। তুমি জানো–
কীর্তি কেন যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেটা বুঝতে না পেরে শিপ্রা থামল। তার হাতখানা আপন হাতে তুলে নিয়ে শুধালে, বন্ধু, আমার কোনও কথা কি তোমাকে পীড়া দিল?
কীর্তির মুখে অমনি হাসি ফুটল। কণ্ঠস্বরে যেন সর্ব মধু ঢেলে দিয়ে বললে, শিপ্রা তুমি সত্যি শিপ্রা– শব্দটি এসেছে ক্ষিপ্রা থেকে, অর্থাৎ যে দ্রুতগতিতে চলে। তুমি প্রথম যেদিন আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি– কেউ-দেখল-কেউ-না– প্রসন্ন স্মিত হাস্যের আভাস দিয়েছিলে, সেদিনই সর্বপ্রথম আমি একটা বড় বাঙলা অভিধানের স্মরণ নিই। তারই কল্যাণে বুঝতে পারি যে শিপ্রা বা ক্ষিপ্রা–
ক্ষিপ্ৰা বললে আরও মানানসই হয়।
চিন্তাকুল বদনে কীর্তি যেন আপন মনে বললে, প্রেমে পাগলিনীকে ব্যাপা বা ক্ষিপ্তা বলেছেন কবি, কিন্তু সংক্ষিপ্তা যেন না হয় আমার প্রতি তোমার প্রেম-প্রীতি-আসক্তিটি–
শিপ্রা করুণ কণ্ঠে অনুনয় করল, বলবে না, রাজা, আমার কোন কথায় তোমার বুকের ভিতর থেকে গরম বাতাস বেরুল- হঠাৎ, কোনও আভাস না দিয়ে?।
কীর্তি যেন ঝটিতি রাজাদেশ পালনে শশব্যস্ত হয়ে বললে, বলছি, শুরু, বলছি। যে মুহূর্তে তুমি বললে, পশ্চিম বাঙলার লোক আজ যেন সমবেত কণ্ঠে পুব বাঙলার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহস দিচ্ছে, আমরা আছি আমার মনে তৎক্ষণাৎ সেই দুশ্চিন্তা, সেই কবেকার আগরতলায় যার জন্ম, সেটা অহরহ আমাকে আশা-নিরাশায় ক্ষণে আকাশে তোলে, ক্ষণে মাটিতে আছাড় মারে। পুব বাঙলা দাঁড়িয়েছে প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে। সে শক্তিকে একমাত্র সৈন্যবল ছাড়া আর সব দিচ্ছে পূর্বাচল-অস্তাচলের দুই বৃহত্তম রাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, প্লেন– যা চাই তাই, যুদ্ধ যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে তবে পশ্চিম পাকে তার জন্য অপর্যাপ্ত অকাতর অর্থসাহায্য সেসব সাহায্য যদি সুন্দুমাত্র পশ্চিম পাকেই যেত তবু না হয় একটা ব্লাফ মারা যেত এগুলো পশ্চিম পাকে দেওয়া হচ্ছে, ভারত আফগানিস্তান ও রুশ একজোট হয়ে যেন পশ্চিম পাক আক্রমণ করে বিশ্বশান্তি ভঙ্গ না করে!–এগুলো খোলাখুলিভাবে পাঠানো হচ্ছে পুব বাঙলায় হারামিদের হাতে, তারা কী নয়া ধরনের বিশ্বশান্তি রক্ষা করছে সেটা জেনেশুনে যাতে করে তারা আরও নির্ভয়ে, জীবন বিপন্ন না করে আরও নিধনধর্ষণলুণ্ঠনদহন কর্ম আরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে করতে পারে। শুধু কি তাই নিরীহ গ্রামবাসী নরনারীকে কীভাবে যমদূতেরও বাড়া নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয় দেখাতে হয়, কী প্রকারে স্বামী পিতা পুত্রের সম্মুখে অবলা নারীকে ধর্ষণ করে মানুষের শেষ সম্পদ তার আইজ্জৎ ইমান কোন কোন বীভৎসতা দ্বারা বিনাশ করে তাকে ক্লীব পশুত্বে পরিণত করার বিভীষিকা দেখাতে হয় সে-সব নীতি কায়দা শেখাবার জন্য বিত্তশালী দেশে বাছাই বাছাই সাদিস্তদের জন্য একটা– কেউ কেউ বলেন একাধিক বিশেষ স্কুল খোলা হয়েছে– খানদানি মিলিটারি অফিসার ও জোয়ানদের জন্য। আইয়ুবের সামনেই সেখানে পশ্চিম পাকের আর্মি বাছাই বাছাই লোক পাঠায়। ইয়েহিয়ার সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না, কিন্তু জুন্টা জানত, হাওয়া একদিন কোন দিক দিয়ে বইবে। তারা সে ইস্কুলে ছাত্র পাঠাতে কোনও কসুর করেনি। আসলে আজ আর এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, যে স্বয়ং আইয়ুবই জানতেন, পুব পা আর পশ্চিম পাকে একদিন মোকাবেলা হবেই হবে।