শিপ্রার অবসাদ আগাপাশতলা উধাও। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ফরাসি অফিসারদের কাছ থেকে সে শুধু ফৌজি-তত্ত্বকথাই শোনেনি, শুনেছে বিস্তর গুলও তাদের মুখে নইলে আর্মিতে ঢুকবেই-বা কেন, গুল মারার সনাতন ট্রাডিশনটাই-বা ডোবাবে কেন? কিন্তু এরকম একটা সৃষ্টিছাড়া ভুতুড়ে গুল? ঢোক গিলে রাম-ভোলার মতো টক্কর ঠোক্কর খেতে খেতে শুধলে, সে কী করে হয়? তুমি সত্যি জানো? এ তো বিশ্বজোড়া শান্তির সময়ও অসম্ভব। আর এখানে সরকার যাকে পাঠিয়েছে সীমান্ত রক্ষার জন্য, তাঁর কী হাল হবে? বলা তো যায় না, ইয়েহিয়া জাতাকলে পড়লে দুর্যোগটা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কোনও না কোনও ডেসপারেট মিলিটারি গ্যাম্বল শুরু করে দেবে। তার শেষ তাস দিয়ে। আক্রমণ করবে আইনত নিরপেক্ষ কিন্তু কার্যত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ভারতকে– যাতে করে রাষ্ট্রপুঞ্জ ইন্টারফিয়ার করে দুই পক্ষকে ঠেকায় আর ইয়েহিয়া সেই লুপহোল দিয়ে সুড়ৎ করে বেরিয়ে যায়।
কীর্তি সোল্লাসে বললে, শুধু ইয়েহিয়াই বুঝি কলিযুগের নিরেস যুধিষ্ঠির! সত্য যুগের আসল যুধিষ্ঠির, না ইয়েহিয়া কে যে জুয়োতে বেশি বুদুমি দেখাতেন সেটা বাঙলার ইতিহাসে একটা চিরন্তনী সমস্যা হয়ে রইবে। সেই গুপ্তযুগ কিংবা তারও আগের থেকে কত না রাজা, পাঠান-মোগল কেউ বাদ যাননি এদেশে এসেছে জুয়ো খেলতে, ওদের সক্কলেরই মারাত্মক প্রয়োজন ছিল, যুদ্ধের জন্য হাতির। ত্রিপুরাতে প্রচুর সে মাল, প্রতিবেশী সিলেটিরা এখনও পৃথিবীর সেরা মাহুত। ইংরেজ বোম্বাই, মাদ্রাজ যে কোনও জায়গায় জুয়ো পার্টি বসাতে পারত। কিন্তু বেছে নিল বাঙলা। ধনী দেশ, অন্তত তখন পর্যন্ত ছিল আমাদের তরফ থেকে স্টেকটা হবে ভারী। জিওপলিটিক নামক আধা-বিজ্ঞানটি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তথ্যগুলো তো ছিল আমাদের বুদু এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কে যেন কথাচ্ছলে বলে, অক্সিজেন আবিষ্কৃত হয়, ১৭৭৪-এ। মন্ত্রী সবিস্ময়ে শুধালেন, তার আগে মানুষ বাঁচত কী দিয়ে? তার পর পাঁচ আঙুলে খ্যাস খ্যাস করে দাড়ির উকুনকে আদর করতে করতে ডরালু গলায় শুধালেন, কিন্তু সাপ্লাই ঠিক আছে তো?–
শিপ্রা শুধালে, তুমি একদিন কথায় কথায় বলছিলে না ডাঙর ইয়েহিয়ার আর বড়া বড়া জুন্টা-গোসাঁইদের কানও বড় বড় হয় তখন মনে পড়েনি ভলতের এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর এপিগ্রাম লিখেছেন চার ছত্রে, অনেকটা আমাদের সুভাষিতের মতো, হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্রে বিস্তর আছে–
কীর্তি ঠিক বুঝতে না পেরে শুধালে, পঞ্চতন্ত্র? সে তো কোন এক মোল্লা না কে যেন বাঙলা একটা সাপ্তাহিকে লেখে।
শিপ্রা বললে, দম্ভ আছে লোকটার! স্বয়ং বিষ্ণুশর্মা যে বই লিখে দূর মার্কিন মুলুক পর্যন্ত প্রাতঃস্মরণীয় লেখক হলেন, তাঁর গল্পের কাছে কখনও কেউ আসতে পারবে নাকি যে সে তার রাজ গুলতানির জন্য পঞ্চতন্ত্র নাম বেছে নিল।
কীর্তি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, বাঁচালে! আমি ভেবেছিলুম মাস্টারের পড়ানো সেই আগম পুরাণ বেদ পঞ্চতন্ত্রকথা বুঝি, আমাদের যে তন্ত্রট আছে তারই পাঁচটাতে মিলে কোনও একটা সিনথেসিস।… যাকগে… ভলতেরের একটা এপিগ্রাম বলতে যাচ্ছিলে না?
হ্যাঁ।
এলাস! লেজোরেই দে গ্রাঁ
সঁ সুভাঁ দ্য গ্রাঁদ জ অরেই
হায়! বড়লোকদের যে আকছারই বড় বড় কান হয়, অর্থাৎ গাধার কান। স্বভাবতই ইঙ্গিত রয়েছে, এদের মস্তিষ্কও ওই প্রাণীটার মতো।
কীর্তি বললে, তাই তো রক্ষে। বড়লোকদের ধন-দৌলত আছে, যশ-প্রতিপত্তি প্রচুর। তার ওপর যদি মগজটিও সরেস ধরনের হত তবে গরিবদের আর বাঁচতে হত না। তাদের হাড়-মাস খেয়ে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাত। এই ধরো না টিক্কা-ইয়েহিয়ার একটা মোক্ষম মুখোমি। আজ যে সমস্ত পুব বাঙলায় বড়র অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছোট রুখে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনী ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দর্শন বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিকুচি করে দিয়ে সামথিং গ্রোইং আউট অব নাথিং তার জন্য ওই মূর্থনীতি আচরণ কতখানি দায়ী সে-কথা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। এটা আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ, আপন খেয়াল নয়। মনে আছে তোমার, শিলঙে তোমাকে বলেছিলুম হবিগঞ্জের এক পাগলা-জগাই, শব্দে শব্দে,
ঢাল নেই, তলওয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার
ট্যাঙ্ক কামান হামলা করে, হুঙ্কারে মার মার!
সেই মেজর আমার এক মুরুব্বিকে বলেছেন, পঁচিশে রাত্রেই টিক্কা প্রয়োজনের চেয়েও ঢের ঢের অপর্যাপ্ত সৈন্যবল, আধুনিকতম ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, কামান সর্ব বল নিয়ে আক্রমণ করল তিন শ্রেণির লোককে। প্রথম দল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি। একদা পাকিস্তানের, বস্তৃত পশ্চিম পাকিস্তানের হয়ে এরাই লড়েছিল আইয়ুবখানি যুদ্ধে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ এবং তাঁর অল্পক্ষণ পরেই মামুলি পুলিশকে আক্রমণ করে প্রায় বিধ্বস্ত করে দিল। এদের মাত্র যে কিছু লোক পালাতে সক্ষম হয়েছিল, তাবৎ পুব বাঙলায় সুদু মাত্রই এরা জানে, কী করে রাইফেল চালানো শেখাতে হয়। এদের নিয়েই গড়ে উঠল বাঙলা দেশময় মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দল। এখন প্রশ্ন এই, এদের মাত্র যে কিছুসংখ্যক লোক লীগের প্রতি কতখানি দরদি ছিল সেটা বলা কঠিন- জুন্টা অবশ্যই সেটা আদৌ হিসাবে ধরেনি তাদের পুরো পাক্কা ধারণা, এদের সমূলে বিনাশ করতে কী আর বেগ পেতে হবে, সময়ই-বা লাগবে কতটুকু?–বমার অব্ বেলুচিস্তানের ওই বাবদে দম্ভ তো আজ দেশে-বিদেশে কারও অজানা নেই কিন্তু একথা তো সত্যি, যে এই তিন শ্রেণির লোক ডিসিপ্লিন্ কাকে বলে সেটা অতি উত্তমরূপে জানে, উপরওলার আদেশ এস্থলে মার হোক, বুচার হোক, টিক্কা খানের আদেশ তারা অন্তত একশো বছর ধরে মেনে নিতে অভ্যস্ত, এবং সর্বশেষ কথা– পাক আল্লার নামে কসম খেয়ে তারা রাষ্ট্রপতির আনুগত্য স্বীকার করেছে। তাই প্রশ্ন, এদের এভাবে টিক্কা যদি আক্রমণ না করত তবে কি এরা নিজের থেকে বিদ্রোহ করত?।