হৃদয়-বাসনা পূর্ণ হল আজি
হেরি আঁখি-ভরা মনে
মম প্রিয়া চিত্তমাঝে বসি স্থির আসনে।
তা হলে?
কীর্তি তখনও চুপ।
শিপ্রার আদর যেন অফুরন্ত। বললে, আজ আমার পেনি জমাবার দিন। যদি বলতে পারি এখন তুমি কী ভাবছ, আরেকটা পেনি দেবে?
বল।
মিতা, আমি জানি যে, তুমি জানো, আমি কী উত্তর দেব। এবং সেই নিয়ে তোমার মনে তোলপাড় আরম্ভ হয়েছে। আগে ছিল ভাবনা, এখন দুর্ভাবনা।
কীর্তির ঠোঁটের কাছে এনে তার নিশ্বাস শিপ্রা আপন নাক দিয়ে নিঃশেষে শুষে নিয়ে গুনগুন করে গাইল, আমাতে মিশা তব নিশ্বাস নবীন উষার পুষ্প সুবাস– বার বার। তার পর আবার বার বার বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল, হে প্রিয় করুণ মম অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। তার পর কীর্তনিয়া রীতিতে বার বার আখর দিল, অরুণ অধর পিয়ো হে পিয়ো। মাঝে মাঝে থেমে থেমে কীর্তির নিশ্বাস নিঃশেষে শুষে নিয়ে আপন বুক ভরে নেয়– তার শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই।
হঠাৎ একবার দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করা সত্তেও সেটা কীর্তির গাল ছুঁয়ে গেল। কীর্তির দু হাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়া ঘন কোঁকড়া চুলের নিচে আধা হারিয়ে-যাওয়া মুখটি কাছে টেনে এনে বললে, বল দেখি, তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছ?
শিপ্রা চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে ঠোঁটে মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললে, অস্বস্তি কিসের? নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে শুধু আমি একটু হতাশ হলুম। আমি আশা করেছিলুম, বাবার বন্ধু ফরাসি ফৌজি অফিসাররা যেরকম ভালো মন্দ বিপদ আপদ, সুখ দুঃখ, সব অবস্থাতেই ধরে নেয় যে এটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটাই তো স্বাভাবিক, আটপৌরে– এমনকি আমাদের কবির সর্বশেষ কবিতার যে প্রায় সর্বশেষ ছত্রে আছে, অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে ঠিক তা-ও নয়, ছলনাটাও তাদের কাছে ছলনা নয়, ওটা অত্যন্ত স্বাভাবিক কিন্তু কবির অনায়াস বেশিরভাগ চরিত্রেই থাকে এবং সেটার মূল্য দেয় শোল্ডার শ্রাগ করে, তা পি বলে, মানে, জানা তো ছিলই, জীবনটা একটানা শ্যাম্পেন আর কাভিয়ার হতে পারে না, জেনারেল ব্যাটা আটকে দিল প্রমোশনটা, আর প্রিয়া তো হর-হামেহাল উঁচিয়ে আছেন জিল করার পিস্তল– তার পর সেই স্বাভাবিক আটপৌরেটার সামনে তার আচরণটাও অনায়াসলব্ধ– প্যারিসের প্রিমা দন্নার অযাচিত প্রেম যদিস্যাৎ অকস্মাৎ বিলকুল ফ্লকে লটারির প্রাইজের মতো পেয়ে যায় তবে অনায়াসে তাকে নিয়ে সগর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবে, আবার বিকল্পে যদি উপলব্ধি করে, পরের দিন জুয়োর দেনা শোধ না করতে পারলে মান-ইজ্জত থাকবে না, তখন তো সেই নিত্যদিনের তা পি –সো মাচুদি ওয়ার্স আছেই– প্রিয়ার মুখটি সাদরে তুলে ধরার মতোই অনায়াসে পিস্তলটা তুলে ধরে ঠেকাবে রগে– আমি আশা করেছিলুম একটানা বহু সায়ং সন্ধ্যা তাদের অনায়াস সঙ্গ পেয়েছিলুম বলে আমিও তাদের শোল্ডার শ্রাগ করে তাঁ পি- বয়ে গেল– বলতে পারব, অন্তত খানিকটে।
কীর্তি করুণ কণ্ঠে বললে, কেন অযথা আত্মনিন্দা করো? আমার যদি কাল ভোরের প্লেনে করে মোলায়েম সুইটজারল্যান্ডে যাবার প্ল্যান থাকত তা হলে তুমি সেটাকেও অত অনায়াসে নিতে পারতে না। যাকে ভালোবাসি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকলেও হারাই-হারাই ভাবনাটা সবসময়ই জেগে থাকে হৃদয়ের কোনও এক গোপন কোণে। তার ওপর তুমি মেয়েছেলে। পুরুষের হৃদয় যদি একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি দিয়ে গড়া হয়, তবে মেয়েদের বেলা একবিন্দু শোণিত আর রোদনের রাশি। আসলে আমার প্রশ্নটাই ভুল। আমি কিংবা খান তো এমন কোথাও যাব না, যা তোমার অস্বস্তির কারণ হতে পারে, আমি কিংবা খান বন্দুক চালিয়ে কটা পাঠানকে খতম করতে পারব? ছোকরা জিমি পর্যন্ত জানে, তুমিই তো বলেছিলে, আমাদের কাজ কলকাতায়। সেই ঘুঘু লারিটা পর্যন্ত জানে, নজর রাখতে হবে কলকাতার ওপর। এবং আমাদের বড় বড় ক্লাবগুলোর ওপরও। যেসব ছেলে-ছোকরারা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে পুব বাঙলাকে সাহায্য করতে চায়, তারা টাকার জন্য, বন্দুকের জন্য যাবে যেসব পয়সাওয়ালাদের কাছে তারা তো এসব ক্লাবেরই মেম্বার। এবং এরা লারি-ফারির সামনেও বেপরোয়া বলে দেবে, ছোকরাদের জন্য একসপ্লোসিভ যোগাড় করতে কার লবেজান, কে একরাশ টাকা দিয়ে ছেলেদের পাঠিয়েছে নাগা পাহাড়ে, সেখানে যদি জাপানিদের ফেলে-যাওয়া বন্দুক-মেশিনগান নাগাদের কাছ থেকে কেনা যায়। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট এখনও আসরে নামেনি বলে ছেলেরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, না মুরুব্বিরা তাদের শুধু হাতে ফিরিয়ে দেবে। শুধু কি তাই, খান বলেনি বুঝি, বাংলাদেশের এক রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার এ-পারে সময়মতো চলে এসেই শুনতে পেলেন, অমুক বাঙালি হিন্দু অফিসার বর্ডারে মোতায়েন হয়েছেন। ইআল্লা বলে এক লক্ষে তাঁর কাছে উপস্থিত। ব্যাপার কী? পার্টিশনের পূর্বে দু জনা একই জায়গায় ট্রেনিং পেয়েছিলেন, পার্টিশনের সময় পর্যন্ত একই আর্মিতে কাজ করেছিলেন। দু জনাতে দোস্তি হয়েছিল গভীর। গিয়েই বললেন, জানো তো, দোস্ত, আমি রিটায়ার করেছি বটে কিন্তু দেশে যে সঙ্কট এসেছে সেটার মোকাবেলা যথাসাধ্য আমি করবই করব– এই ভরসা যদি আমার দেশের লোক রাখে তবে কি সেটা অন্যায় হবে? আসলে অতখানি লম্বা-চওড়া অজুহাত একে অন্যকে এরা কখনও দেননি। এক ইয়ার আরেক ইয়ারকে দেখা মাত্রই বুঝে গিয়েছেন ব্যাপারটা কী। বাক্যব্যয় না করে ইয়ারকে নিয়ে গেলেন অস্ত্রাগারে, হাত দিয়ে কুল্লে হাতিয়ার দেখিয়ে বললেন, যা খুশি নিয়ে যাও, যত খুশি নিয়ে যাও হেলপ্ ইয়োরসেল। সত্যি বলছি।